কাসেদ আলী কি ভাবতেন: ব্যক্তিগত আলাপের আলোকে একজন অগ্রজ কমিউনিস্টের রচনাবলীর প্রাথমিক পাঠ
‘মার্কসবাদ ফতোয়া ফরাজবাদ নয়’- কাসেদ আলী
কাসেদ আলীকে চোখে দেখার আগে তাঁকে নামে চিনতাম। তাঁর “উপমহাদেশে শ্রেণী ও সমাজ” পুস্তিকাটি পড়ে তাঁর সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে তুলেছিলাম মনে মনে। কারো লিখা পড়ে লিখক সম্পর্কে ধারণা করে নেবার কাজটা বোধহয় আমরা সকলেই কমবেশী করি। বইটি কাসেদ আলী লিখেছিলেন ১৯৬৮-৬৯ সালে। যতোদূর আমার মনে পড়ে বইটি আমার হাতে এসেছিল ১৯৭৬ সালে। দেশ স্বাধীন হবার পর দেশে ছিলাম না অনেকদিন, কিছু সময়ের জন্য ফিরেছিলাম ১৯৭৬ সালে। সেই সময় বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁরা কি চিন্তা ভাবনা করছেন সেটা গভীর আগ্রহের সঙ্গে জানার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দলিলপত্র জোগাড় করে মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। সেই সময় বাংলাদেশের উৎপাদন সম্পর্কের চরিত্র নিয়ে তুমুল বিতণ্ডা শুরু হয়েই যেন থিতিয়ে গেছে। বিতণ্ডাটা নতুন করে শুরু হবার কারণ ছিল রাজনীতিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের আবির্ভাব। কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে— আখলাকুর রহমানের চটি কয়েক পাতার থিসিসের ওপর দাঁড়িয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে বিপুল ভাবে তরুণদের আকৃষ্ট করেছে। এই ডাকের চাপে যেন নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের উৎপাদন সম্পর্কের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের বিতর্ক। ইতোমধ্যে ঘটল ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা। আবু তাহের ও জাসদের নেতারা বন্দী হলেন। বিচারে তাহেরের মতো বিপ্লবী চেতনা সম্পন্ন একজন অসাধারণ সৈনিককে বিপ্লবীরা হারালো। একটা থমথমে শোকাকুল পরিস্থিতি। মনে পড়ে, সেই সময় বইটি আচমকা হাতে এসে পড়েছিল।
বইটি মনোযোগ কেড়েছিল, তখন থেকেই কাসেদ আলীকে নামে চিনেছি। বাংলাদেশে পুঁজিতন্ত্র এসে গেছে এই প্রবল মতের বিপক্ষে কাসেদ আলী আধা-সামন্তবাদীদের পক্ষের বক্তব্য তুলে ধরেছেন বলে বইটি মনোযোগ কাড়ে নি। যাঁরা বাংলাদেশে পুঁজিতন্ত্র এসে গেছে বলে দাবি করছিলেন বইটিতে কাসেদ আলী সরাসরি তাঁদের সঙ্গে বিতর্কে নেমে তাঁর কথা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন নি। এই ধরণের বিতর্ক তীব্র হবার আগেই বইটি লিখার কাজ তিনি হাতে নিয়েছিলেন। বিতর্কের খানিক চেষ্টা তিনি করেছিলেন তাঁর অন্য গ্রন্থে। তবে যে কারণে বইটি মনোযোগ কেড়েছিল সেটা হোল উপমহাদেশের শ্রেণী ও সমাজ নিয়ে ভাবতে গিয়ে কাসেদ আলী কতিপয় মৌলিক ধারণা নিয়ে গভীর ভাবে ভেবেছেন, বোঝা যায় এবং তাঁর নিজের স্বাধীন ভাবনাচিন্তা ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সেগুলো সাহসের সঙ্গে প্রয়োগ করারও চেষ্টা করেছেন। যাকে বলে সৃষ্টিশীল ভাবে ভাবা কাসেদ আলী ঠিক সেই অর্থেই সৃষ্টিশীল ভাবে ভেবেছেন, কোন বাঁধিগৎ ধারণার খপ্পরে নিজের মগজ বন্ধক দিয়ে বসেন নি। ‘বাঁধিগৎ’ শব্দটি কাসেদ আলীর নিজের এবং শব্দটি তিনি ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। এতেই বোঝা যায় যান্ত্রিক চিন্তার বিপরীতে সৃষ্টিশীল ভাবে ভাবার পক্ষে তাঁর একটা পক্ষপাত ছিল। আর ঠিক এই সৃষ্টিশীল ভাবে ভাবার কারণে সামন্তবাদ সম্পর্কে তিনি যে কথাগুলো বলতে চাইছিলেন সেটা ছিল অনেক ক্ষেত্রে নতুন। ফলে উপমহাদেশের শ্রেণী ও সমাজের বাস্তব চিত্র অনুধাবনের জন্য যে তথ্য ও উপাত্ত তিনি হাজির করেছেন তার চেয়ে বেশী আকর্ষণীয় ছিল তাঁর পদ্ধতিগত আলোচনা। পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, আধা-সামন্তবাদ প্রভৃতি ধারণাগুলো নিয়ে যে আলোচনার সূত্রপাত তিনি করেছিলেন, বোঝা যাচ্ছিল, তিনি এগুলো নিয়ে প্রচুর ভেবেছেন এবং কার্ল মার্কসের শিক্ষাকে নিজের মতো আত্মস্থ করেছেন, যান্ত্রিক ভাবে উগরে দেন নি। তবে একটা কথা বলা দরকার দার্শনিক বিষয়ে, যেমন জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রসঙ্গগুলো নিয়ে তাঁর লিখালিখি খুবই দুর্বল ছিল।
“উপমহাদেশে শ্রেণী ও সমাজ” বইটির ভূমিকার প্রথম পাতাটিও যদি কেউ মনোযোগ দিয়ে পড়েন তাহলে কাসেদ আলীর সক্রিয় চিন্তার দীপ্তিটা পাঠকের চোখে অনায়াসে ধরা পড়তে বাধ্য। একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা ধরিয়ে দেয়া যাক।
কাসেদ মার্কস সম্পর্কে লিখছেন:
“সমাজের বুনিয়াদী পরিচয় অর্থনীতিতে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল কাঠামো বা ভিত্তি বণ্টন-বিনিময় সম্পর্কের ভিতরে অবস্থান করে না। এটা মূলতঃ বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের অন্তরে। এটাই মার্কসের অন্যতম প্রধান, বলা যেতে পারে সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার”।
উৎপাদন সম্পর্কের অন্তরে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল কাঠামো বা ভিত্তি রয়েছে এই কথাটা যতো সহজ একটি বাক্য মনে হচ্ছে ধারণাগত দিক থেকে ততো সহজ বাক্য মোটেও নয়। এখানে বলা হচ্ছে না যে উৎপাদন সম্পর্কই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি বা কাঠামো, শুধু বলা হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্কের অন্তরে রয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গোড়া অর্থাৎ ভিত্তি বা কাঠামো। এর কারণ হোল কার্ল মার্কস বন্টন-বিনিময়কে উৎপাদন ব্যবস্থার অপ্রধান কোন অঙ্গ বলে মনে করেন নি। উৎপাদন মানে হচ্ছে খোদ উৎপাদন-ভোগ-বণ্টন-বিনিময় অর্থাৎ সবকিছু নিয়েই উৎপাদন ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থার চরিত্রটা বুঝবার জন্যে তাকাতে হবে উৎপাদন সম্পর্কের গোড়ার দিকে, তার অন্তরের দিকে। অপরদিকে বন্টন এবং বিতরণও উৎপাদন সম্পর্কের অভিব্যক্তি। কারণ তাদের ধরণ কেমন হবে সেটাও উৎপাদন সম্পর্কের ধরণ দ্বারা নির্ধারিত হয়ে যায়। শ্রমিক যদি মজুরি শ্রমিক আকারে শ্রমে নিয়োজিত হয়, অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্ক যদি পুঁজিতান্ত্রিক হয় কেবল তখনই উৎপন্ন সামাজিক সম্পদ বিতরণ ও বণ্টনের সময় শ্রমিকের সামনে হাজির হয় মজুরি রূপে। দাস সমাজ দাসের জীবন ধারণের জন্য দরকারী ভোগ্য বস্তু বিতরণ করে সরাসরি। এক্ষেত্রে বিতরণ ‘মজুরি’র রূপ পরিগ্রহণ করে না। অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্কই নির্ধারণ করে দিচ্ছে বন্টন ও বিতরণের রূপ কি হবে। উৎপাদন সম্পর্ককে কাসেদ আলী এভাবে আলাদা করে জোর দিয়ে বুঝতে চাইবার অবশ্য বিশেষ কারণ আছে।
কাসেদ বলছেন, সামন্ত সমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজের পার্থক্য উৎপাদন সম্পর্কের ‘মিল ও গরমিল’ দিয়ে তিনি চিহ্নিত করবেন। তারপর বলছেন,
বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় প্রচলিত বিভিন্ন বই ও পত্রিকায় পাঠক পেয়ে থাকবেন বিপরীত পদ্ধতি। শুধু বিপরীত নয়, সব তালগোল পাকানো। দৃষ্টান্ত হিসাবে কয়েকটি ভাবধারার ভুল ব্যাখ্যা তুলে ধরতে পারি। বলা হয় খাজনা প্রথা, মহাজনী প্রথা ইত্যাদি সামন্ত সমাজের বৈশিষ্ট্য এবং পণ্য ও মুদ্রা চলাচল, বাজার ও সংযোগ ব্যবস্থা, বাজারে অসম বিনিময়াদি ব্যাপার পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য। অথচ এ সবই বণ্টন-বিতরণ সম্পর্কের ব্যাপার- খাস উৎপাদন সম্পর্কের মর্মবস্তু নয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে শুরুতেই একটি পদ্ধতিগত প্রশ্ন তুলে কাসেদ আলী সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিতর্কের অবতারণা করেছিলেন। তিনি যে মৌলিক চিন্তা করতে ভালবাসতেন এটা তারই একটি ক্ষুদ্র প্রমাণ। যদি উৎপাদন সম্পর্কই সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের আসল মাপকাঠি হয় তাহলে বিতরণ ও বন্টনের রূপ দিয়ে সমাজের বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের যে ধারা প্রচলিত তার বিরুদ্ধে তিনি খুবই বড়ো ধরণের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর “উপমহাদেশের শ্রেণী ও সমাজ” গ্রন্থের প্রথম পাতাতেই এই চ্যালেঞ্জ বিধৃত। যতোদূর মনে পড়ে পদ্ধতিগত প্রশ্নে এই ধরণের মৌলিক ভাবনার কারণে তাঁর বইটি আমাকে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করেছিল।
তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ হয় সম্ভবত ৮২ সালের শুরুর দিকে, কোন একটি সেমিনারে। আমি যেখানে বসে তাঁর বক্তব্য শুনছিলাম তার আশেপাশে বেশ কয়জন তরুণও ছিলেন। লক্ষ্য করলাম তাঁরা কাসেদ আলীর বক্তব্য পছন্দ করছেন না। আসলে আকৃষ্ট করার গুণ তাঁর ছিল না। কিন্তু তিনি যে কথাটি বলতে চাইছিলেন। সেটা আমার কাছে মোটেও জটিল মনে হয় নি। তিনি বলতে চাইছিলেন, বাংলাদেশে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা। এই বিপ্লব একদিকে জাতীয় মুক্তি ঘটাবে অপরদিকে সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্ককে উৎখাত করবে। সেমিনারের পর নিজে যেচে গিয়ে আলাপ করলাম, তিনি খুশি হলেন। কিন্তু নানা কারণে আলোচনা জমলো না। আমি তাঁর বইপত্রগুলো কোথায় পাবো সেই খোঁজ খবর এক ফাঁকে নিয়ে নিলাম। একদিন চলন্তিকা বইঘর থেকে কিনেও আনলাম।
৮৭ সালের পর থেকে তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার শুরু। দ্বিতীয়বারও তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল একটি সেমিনারে। সেবার তিনি বক্তা ছিলেন না, ছিলেন শ্রোতা। শ্রোতাদের মধ্যে তাঁকে দেখে এগিয়ে যেতেই বলে উঠলেন ‘আপনার অনুবাদটি পড়েছি। মার্কসের “অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনা” অনুবাদটি প্রকাশ করে ভাল করেছেন’, তারপর আরো নানান কথা বললেন। আমি তো বিস্মিত। অনুবাদটি পুস্তিকাকারে খুবই খারাপ ভাবে সবে বেরিয়েছে। অনেকটা নিজের তাগিদেই অনুবাদটি করেছিলাম। এটিকে কেন্দ্র করে পাঠচক্র আয়োজন করলে দেখেছি খুবই দ্রুত ভাল ফল পাওয়া যায়। তিনি এই অনুবাদটি খোঁজ করে সংগ্রহ করেছেন এবং সেটা পড়েছেন জেনে অবাকই বোধ করলাম। সেমিনার শেষ হবার পর বিদায় নিয়ে আসার সময় হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘কাউকে যদি হেগেলের Science of Logic না পড়িয়েও লজিক পড়াতে চান তাহলে অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনাটা হাতে ধরিয়ে দেবেন’। এই মন্তব্যে আমার বিস্ময় আরো বাড়ল, ঠিক এই রকম একটা মন্তব্য তাঁর কাছ থেকে শুনব বলে মোটেও প্রত্যাশা করি নি। আমি তাকে বললাম এটি অনুবাদ করবার পেছনে আমার মধ্যে ঠিক এই রকম একটা চিন্তাই কাজ করছিল। হেগেলের Science of Logic-এর সঙ্গে মিলিয়ে তিনিও যে ‘অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনার ভূমিকা’ নামক রচনাটিকে বিচার করছেন সেটা জেনে খুশি লাগল। এই বুদ্ধিমান ও প্রাজ্ঞ মন্তব্য শুনে মনে হোল অনুবাদটা করা সার্থকই হয়েছে। বললাম তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে আরো আলেচনা করতে চাই।
এর অনেকদিন পরে একদিন তিনি নিজেই মতিন ভাইয়ের (আবদুল মতিন) সঙ্গে এসে হাজির। বয়সের বিরাট পার্থক্য উপেক্ষা করে অতি দ্রুত তিনজনেই পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হতে সময় লাগল না। তার সঙ্গে মিশ্রিত ছিল অনুজের প্রতি উভয়ের অকুন্ঠ স্নেহ। অগ্রজ কমরেড আবদুল মতিন আগে থেকেই ছিলেন ঘনিষ্ঠ ও শ্রদ্ধাভাজন। মার্কসীয় বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঘরোয়া ভাবে হলেও একনিষ্ঠ আলোচনার প্রয়োজনটা মতিন ভাই সবসময়ই উপলব্ধি করতেন। তাঁর উৎসাহে দুই একমাস অন্তর অন্তর প্রায়ই নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করবার জন্য একত্রে বসবার সুযোগ পেয়েছি। আজ কাসেদ আলী নেই, কিন্তু এই লিখাটি যখন লিখছি তখন মনে হচ্ছে তিনি সামনে বসে আছেন আর মতিন ভাই কথার মাঝখানে খেই ধরিয়ে দিচ্ছেন বা নিজের কথা যোগ করছেন। সেই আলোচনাগুলোর কথা যখন ভাবি তখন মনে হয় সেগুলো অমূল্য। একারণে নয় যে সবসময় আমরা গুরুগম্ভীর তাত্ত্বিক প্রশ্নের মীমাংসা করে ফেলতে পেরেছি। গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে পরস্পরকে, বিশেষত কাসেদ আলীকে অই সকল আলোচনার মধ্য দিয়ে চেনাজানা অনেক সহজ হয়েছে।
কাসেদ আলী সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে তাঁর চিন্তা ও রচনার মূল্যায়ন করতে বসা এখন যতোটা না দরকার তার চেয়ে বেশী দরকার তিনি কি বলতে চেয়েছিলেন সেটা পরিষ্কার করে তুলে ধরা। ব্যক্তিগত পর্যায়ের আলোচনাগুলোর আলোকে তাঁর চিন্তার যে সকল মৌলিক দিক আমার চোখে পড়েছে সে সম্পর্কে একটা প্রাথমিক পরিচিতি তুলে ধরা আমি আমার কর্তব্য বলে মনে করি। মূলত ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ আলাপের মধ্য দিয়েই আমি বুঝতে পেরেছি, তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি মৌলিক ভাবে ভাবতে ভালবাসতেন, কিন্তু নানা কারণে নিজের চিন্তার সূত্র ধরে নিজের বক্তব্য গুছিয়ে লিখতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন না। তাঁর কথা বলার মধ্যে যেমন, তেমনি তাঁর রচনার মধ্যেও উল্লম্ফন ছিল, ফলে কোথায় তিনি মৌলিক ভাবে ভাবছেন সেটা তাঁর শ্রোতা ও পাঠকদের বুঝে ওঠা খুবই কষ্টকর হোত। তাঁকে উপলব্ধি করার আরেকটি মুশকিল ছিল এই যে, তাঁর মনটা ছিল দার্শনিক বা ভাবুকের। বিপ্লবী রাজনীতিতে তিনি ফাঁপরে পড়ে বা দুর্ঘটনাবশত আসেন নি। ওটা ছিল তাঁর দার্শনিক সিদ্ধান্তেরই একটা ফল। কিন্তু আমাদের দেশের বিপ্লবী রাজনীতি মৌলিক ও সৃষ্টিশীল চিন্তাকে লালন করবার মতো কোন পরিবেশ তৈরী করতে সক্ষম হয় নি। যান্ত্রিক ভাবে কিছু আপ্তবাক্যমূলক সিদ্ধান্তের ভেতর থেকে কাসেদ আলীর মতো ব্যক্তিত্বকে কাজ করতে হয়েছে। ফলে নিজের মৌলিক চিন্তার বীজগুলোকে আরো পরিকল্পিত ভাবে বিকশিত করার কোন সুযোগ তিনি পেয়েছেন বলে আমার মনে হয় নি। অপরদিকে বিপ্লবী রাজনীতির চৌহদ্দির বাইরে বৃহত্তর সমাজেও মৌলিক চিন্তার বিকাশ ঘটবার কোন পরিবেশই ছিল না, এখনো নেই। মাঝে মাঝে আমার নিজের মনে হোত কাসেদ আলীর প্রকাশের সীমাবদ্ধতা কতোটুকু তাঁর নিজের দৌর্বল্য আর কতোটুকুইবা সমাজের?
নিজের প্রকাশভঙ্গির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি পূর্ণ মাত্রায় সচেতন ছিলেন। তাঁর একটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি, একজায়গায় তিনি লিখছেন, “এমন উদ্ভট উক্তিও পাওয়া যায় যে পুঁজিবাদী সমাজে জমিদার নয়, বুর্জোয়া পুঁজিপতি জমির মালিক, অতএব তার ওপর কোন ভূস্বামী নেই। আবার এসব পল্লবগ্রাহিতা শুধু সাত অন্ধের হাতি দেখা ও আলোচনা নয়, একের কাছে অপর এক্কেবারে হাতুড়ে। এই অন্ধ আবেগপ্রবণ তথাকথিত বিশ্লেষকরা নিজেরা দাবি করেন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বলে এবং প্রতিপক্ষকে আখ্যায়িত করেন পাতি বুর্জোয়াজি হরেক রকম বিশেষণে। কাণ্ডজ্ঞান-বর্জিত পল্লবী জ্ঞানে আমরা মার্কসবাদী বিশ্লেষণ পাই না, পাই শুধু বিভ্রান্তি। এই প্রকার মোহ ও বিভ্রান্তির শিকার পাঠকের কাছে আমাদের বক্তব্য খুব পরিষ্কার নাও হতে পারে। তবুও নিজের প্রকাশ ভঙ্গির দৈন্য সকাতরে কবুল করে পুঁজিবাদী-সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্ক ও কিছুটা অন্যান্য সম্পর্ক পাঠকের সমীপে পেশ করবো যেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অনুরাগী পাঠক সাহেবান এগিয়ে যেতে পারেন।”
নিজের প্রকাশ ভঙ্গির দৈন্য সকাতরে কবুল করবার কথাটা উদ্ধৃত করলেই এখানে চলত। কিন্তু শেষের উদ্ধৃতিটি বড়ো হলেও উল্লেখের কারণ হচ্ছে কাসেদ আলীর সঙ্গে আমরা বোধহয় অনেকেই একমত হবো যে “অন্ধ ও আবেগপ্রাণ” মার্কসবাদ এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যাতে “মোহ ও বিভ্রান্তির শিকার পাঠকের কাছে” শুধু কাসেদ আলীর বক্তব্য নয় যে কোন পরিষ্কার কথাও “পরিষ্কার নাও হতে পারে”। যে উদ্ভট উক্তির কথা তিনি তুলেছেন যে পুঁজিবাদী সমাজে জমিদার নয়, বুর্জোয়া পুঁজিপতি জমির মালিক, অতএব তার ওপর কোন ভূস্বামী নেই, সেটা আজ অনেকের কাছে কোন বড়ো বরণের সমস্যা মনে না হলেও ষাটের শেষ ও সত্তর সালের শুরুর দিকে এই ধরণের উদ্ভট ধারণার বিরুদ্ধেই কাসেদ আলীদের লড়তে হয়েছে। এখন এই ধরণের না হোক ভিন্ন রকম উদ্ভট উক্তির মোকাবেলা করতে হচ্ছে আমাদের। তিনি ঠিকই ধরেছেন, পরিস্থিতিটা আসলেই “সাত অন্ধের হাতি দেখা”র মতো ব্যাপার, “একের কাছে অপর এক্কেবারেই হাতুড়ে”। মার্কসীয় চিন্তার এই রকম “হাতুড়ে” পরিস্থিতি এক কুড়ি সাল পার হয়ে যাবার পর একই জায়গায় রয়ে গেছে বলে ভয় হয়।
যেটা বলা দরকার সেটা হোল কাসেদ আলীর প্রকাশভঙ্গির দুর্বলতাটা মোটেও ভাষাগত দুর্বলতা নয়, শব্দ ব্যবহার ও বাক্যগঠনের জড়তার কারণে যে ধরণের দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায় তাঁর রচনা সেই অর্থে দুর্বল নয়। তিনি রসিক ছিলেন, আলোচনার মাঝখানে রসাত্মক বাক্য লিখতে পছন্দ করতেন। অতএব তাঁর ভাষার ছোটখাট ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও সেটা সাহিত্যগুণ বিবর্জিত ছিল না। চিন্তার উল্লম্ফন ও অগোছালো ভাবটার জন্য তিনি নিজে অনেকটাই দায়ী এটা স্বীকার করেও বলা দরকার যে, একটা “হাতুড়ে” পরিস্থিতিতে মার্কসবাদের মূল কথাগুলো কিভাবে তুলে ধরবেন সেই বিষয়ে তিনি স্বভাবতই একটু বেশী দ্বিধাদ্বন্দ্বেই ভুগতেন। কাসেদ আলীর প্রকাশভঙ্গির সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে আমার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত আলোচনার আলোকে তাঁর চিন্তার কিছু দিক আমি এখানে আলেচনা করব। আমার চেষ্টা হবে তাঁর সঙ্গে আমরা একমত হই বা না হই, তিনি কি বলতে চেয়েছেন সেটা একটু স্বচ্ছভাবে বোঝার চেষ্টা করা।
১। বস্তুবাদী দর্শনের সমস্যা
আমি তাঁর সবচেয়ে দুর্বল দিক নিয়ে শুরু করব। সেটা হোল দার্শনিক বিষয়ে তাঁর লিখা। সংস্কৃতি সিরিজ নামে “গণশক্তি”তে প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধগুলো ইশতেহার আকারে তিনি ছেপেছিলেন। “সংস্কৃতি সিরিজ-১” নামক ইশতেহারটিতে তিনি “বন্য বর্বর দর্শন ও দর্শনের শিশু” নামক নিবন্ধটি ছেপেছেন। নিবন্ধের শুরুতে আছে :
মানুষ চিন্তা করতে পারে এবং পশু-পাখীর মতন বা তার চেয়েও বেশী পরিমাণে মানুষের ইন্দ্রিয়ানুভূতি তথা সংবেদনা আছে। সংবেদনা ও চিন্তা দৈহিক প্রক্রিয়া। মানব দেহে চক্ষু বর্ণ নাসিকা জিহ্বা ত্বক পাঁচটি মূল ইন্দ্রিয় ছাড়াও মস্তিষ্ক আছে। চিন্তার আধার মস্তিষ্ক, যা অবিরাম উপরোক্ত পাঁচটি ইন্দ্রিয় সংক্ষেপে ইন্দ্রিয়গ্রাম থেকে বহির্বিশ্বের প্রতিফলন বা প্রতিবিম্ব পায়। চক্ষুর মাধ্যমে রূপ, জিহ্বার মাধ্যমে রস, নাসিকার মাধ্যমে গন্ধ, ত্বকের মাধ্যমে স্পর্শ এবং কর্মের মাধ্যমে শব্দ মস্তিক্ষে ছাপ ফেলে। এ সবই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা।
জ্ঞানতত্বের দরোজার ওপর এই ভাবে উকিঝুঁকি মেরেছেন কাসেদ আলী, ভেতরে যান নি। তাঁর লিখা পড়ে মনে হয় বস্তুবাদ বিশেষত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ সম্পর্কে তাঁর ধারণাটা ছিল বেশ ভাসা ভাসা। যদিও ব্যক্তিগত আলোচনায় মনে হোত দার্শনিক বিষয় নিয়ে তিনি মোটেও অতো হাল্কা ভাবে ভাবতেন না, বরং তাঁর মনে বিস্তর প্রশ্ন ছিল। তাঁর লিখা এবং আলাপের মধ্যে একটা পার্থক্য ধরা যেত। কেন এই কথা বলছি সেটা বোঝাবার জন্য ওপরের উদ্ধৃতিটিকেই আরো অনুসরণ করা যাক। কাসেদ বলছেন:
“রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণকে আমরা বলতে পারি পঞ্চগুণ। এই পঞ্চগুণ ইন্দ্রিয়গ্রামের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে যে সব জিনিসের সন্ধান দেয় সেসব জিনিস বিভিন্ন ধরণের বস্তু। এই সব বস্তু সংবেদনা ও চিন্তার অপেক্ষা না করেই বাস্তবে বিদ্যমান জিনিস সংক্ষেপে মানবীয় চিন্তা নিরপেক্ষ তথা মন নিরপেক্ষ পদার্থ। জিনিসগুলো মানব দেহ মনের বাইরের বস্তু।”
মস্তিষ্ক, ইদ্রিয়গ্রাম ও বস্তু সংক্রান্ত কাসেদ আলীর এতটুকুন ধারণার মধ্য দিয়ে তাঁকে যেভাবে আমরা পাই সেটা ধ্রুপদী মার্কসবাদী লেনিনবাদী ধারার মোটা দাগের কাঠামোর মধ্যেই পড়ে। যদিও বস্তুকে মানব “দেহমনের” বাইরে রাখতে গিয়ে দেহ সম্পর্কে একটা অস্পষ্টতা তৈরী করে ফেলেছেন তিনি। দেহ কি? দেহ কি বস্তু নয় বা বস্তু দিয়ে গড়া নয়? তাহলে দেহমনের বাইরে ‘বস্তু’কে স্থাপন করে একটা বড়ো ধরণের ভুলই তিনি করেছেন। এতে মনে হয় দেহ একটা অন্যরকম একটা সত্তা, না বস্তু না মন। মন বা চেতনা নিরপেক্ষ ‘বস্তু’র এই জনপ্রিয় ধারণাটা এঙ্গেলসের হাতেই দানা বেঁধেছে। এই বস্তুবাদী ধারণার মোটা দাগের কথা হোল যা বস্তুময় ভাবে আছে, তা আছে। এই থাকাটা মানুষের চেতনা নিরপেক্ষ ব্যাপার। মোটা দাগে বস্তুবাদ দাবি করে যা কিছু আছে বলে আমরা মনে করি তা ‘বস্তু’ দিয়ে তৈরী বা তার একটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুময় সত্তা আছে। এই ধারণার অনেকগুলো মুশকিলের মধ্যে একটি মুশকিল হচ্ছে, যদি বলা হয় বস্তু ‘আছে’ তাহলে এই কথাটা জানতে পারে এবং বলতে বা প্রকাশ করতে পারে একমাত্র মানুষের চেতনা। তাহলে মানুষ নিরপেক্ষ বা চেতনা নিরপেক্ষ কোন বস্তু বা জগৎ থাকতে পারে না। তাছাড়া কাসেদ আলীর কথা থেকেই ধরা পড়ছে যে রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ হচ্ছে ‘পঞ্চগুণ’। এই ‘পঞ্চগুণ’ আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই কেবল অনুভব করতে পারি। তাহলে তো পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে ইন্দ্রিয় ছাড়া আমরা কিছু আছে কিনা নির্ধারণ করতে পারি না। বস্তু অতএব ইন্দ্রিয় নিরপেক্ষ নয়। মোটা দাগে বস্তুবাদ যখন বস্তু ও চেতনার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক অনুধাবন না করে এক দিকে চেতনা এবং অপরদিকে বস্তুকে আলাদা করে জগৎকে দ্বিখণ্ডিত ধরে নেয় তখনই এই রকম মুশকিলে পড়তে হয়। বস্তুবাদ নিয়ে পর্যালোচনামূলক দার্শনিক আলোচনা করার ফুরসৎ এখানে নেই। যে কারণে প্রসঙ্গটি তুলছি সেটা হোল কাসেদ আলী মোটা দাগের বস্তুবাদটাই জানতেন, মার্কসীয় দ্বান্দ্বিকতার আলোকে চেতনা ও বস্তুর সম্পর্কগত সমস্যাগুলো কি এবং মার্কস ও মার্কসের অনুসারীরা সেই সকল সমস্যাকে সমাধানের জন্য কিভাবে চেষ্টা করেছেন সে সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁকে দোষারোপ করার সুযোগ নেই কারণ মার্কসবাদ লেনিনবাদ হিসাবে যে বস্তুবাদী চিন্তা আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল, এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও প্রাধান্যে ছিল, কাসেদ আলী সেই আবহেই এই ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা চেতনাকে সাজিয়েছিলেন। প্রসঙ্গটি তুলছি একারণে যে এই বস্তুবাদ সম্পর্কে তাঁর একটা অস্থির অস্বীকৃতিও ছিল মনে মনে। সেটাই আমি তুলে ধরতে চাই। ব্যক্তিগত ভাবে একসময় তিনি বলেছিলেন যে, তাঁর সন্দেহ হয় এই মোটা দাগের বস্তুবাদটাই আসলে ইতরোচিত বস্তুবাদ (Vulgar Materialism) কি না যাকে মার্কস লেনিন মন্দ চোখে দেখতেন। মনে পড়ে আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ-কে তিনি ‘পঞ্চগুণ’ আখ্যা কেন দিচ্ছেন? এগুলো কোন জড় বস্তুর ‘গুণ’ নাকি চেতনার সক্রিয়তা? যদি চেতনার সক্রিয়তা হয় তাহলে তাকে জড় বস্তুর ‘গুণ’ আকারে নির্ধারণ করার কারণে তিনি আসলেই ইতরোচিত বস্তুবাদের ওপরেই পড়েছেন। এই প্রসঙ্গে তাঁকে কার্ল মার্কসের ফয়েরবাখ সংক্রান্ত একনম্বর থিসিসটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। সেখানে মার্কস বলেছেন যে তাঁর আগের সকল বস্তুবাদের আদত দোষ হোল বস্তু, বাস্তবতা, ইন্দ্রিয়ক্রিয়াকে ভাবা হোত শুধুমাত্র ভাবনার বিষয় হিসাবে, ইন্দ্রিয়কাতর মানবিক সক্রিয়তা হিসাবে, অনুশীলন হিসাবে অর্থাৎ কর্তার দিক থেকে দেখা হোত না। এখান থেকে মার্কসের সিদ্ধান্ত হোল, এই যে ইন্দ্রিয়কাতর মানবিক সক্রিয়তা, অর্থাৎ কর্তা হিসাবে বাইরের জগতের সঙ্গে আমাদের সক্রিয় পারস্পরিকতা— এর প্রতি নজর না দিলে এবং উপেক্ষা বা অবহেলা করলে সেটা তো আর অবহেলিত আর উপেক্ষিত পড়ে থাকতে পারে না। কারো না কারো সেদিকে চোখ পড়বেই। তো বস্তুবাদ যখন একে বাদ দিয়ে রাখল তখন এর ওপর চোখ গিয়ে পড়েছে ভাববাদের। দেখা যাচ্ছে মোটাদাগের বস্তুবাদ শুধু ইতরোচিত হবার কারণেই মন্দ বলে মনে করতেন না মার্কস। এটা মন্দ হবার আরো একটি কারণ আছে। সেটা হোল, এটা ভাববাদের চাষ ও বিকাশের জন্য জমি ফেলে রাখে, ভাববাদ শক্তিশালী হয়।
কাসেদ আলী এখন নেই, কিন্তু তাঁর সঙ্গে আলাপের পরিপ্রেক্ষিতে যেটা আমার মনে হয়েছে তিনি মোটা দাগের বস্তুবাদ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যে ইতরোচিত বস্তুবাদের পতাকা তুলে নিয়েছিলেন সে সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন না। ব্যক্তিগত আলাপে সচেতন হয়ে তিনি স্পষ্টতই মনে করতেন ইতরোচিত বস্তুবাদ পরিত্যাজ্য। এটাও তিনি আমার সঙ্গে সায় দিতেন যে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যর্থতার একটা বড়ো কারণ হোল দার্শনিক ধারা হিসাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে ইতরোচিত বস্তুবাদ বিভিন্ন কারণে আসর জাঁকিয়ে বসেছিল, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রাণের দিকটা এর ফলে সোঁটা হয়ে গিয়েছিল।
এই সকল বিষয়ে কাসেদ আলী তাঁর জীবদ্দশায় লিখে যেতে পারেন নি। তাঁর প্রতি অসহানুভূতিশীল সমালোচকরা তাঁকে যথার্থই এক্ষেত্রে নিন্দা করবেন, যদি তাঁর পক্ষে আমার সাফাই গাওয়ার কোন কার্যকারিতা না থাকে। অতএব তাঁর একই লিখা থেকে এই বিষয়ে তাঁর অস্থিরতা তুলে ধরে তাঁকে অনুধাবনের অন্য একটি দিক তুলে ধরার চেষ্টা করা ছাড়া আমার হাতে আর কোন কড়ি নেই।
কাসেদ আলীর ওপরের উদ্ধৃতিটিই অনুসরণ করে যাব। তাঁর চিন্তার উল্লম্ফনকে বাগে রেখে পিছু হাঁটা কঠিনই বটে। ইন্দ্রিয়গ্রামের কথা বলে কাসেদ আলী মার্কসের সাচ্চা ছাত্রের মতো ঠিকই বলেছেন, মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে উৎপাদন ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, এটাই অন্তত সকল প্রাণী থেকে মানুষের বৈশিষ্ট্যসূচক দিক। তারপর বলছেন:
“এই সামাজিক উৎপাদন কর্মে যে তিনটি প্রধান কর্মেন্দ্রিয় দরকার তা হোল হাত, পা ও বাকমুখ। (বোধহয় ছাপার ভুল আছে শুধু ‘মুখ’ হবে, কিম্বা আগে ‘বাক’ যোগ করে কথা বলার সামর্থ সম্পন্ন মুখের কথা বলছেন হয়তো এখানে – ফ.ম.)। এইসব কর্মেন্দ্রিয় গতিদায়ক শক্তি। আগেকার মূল ইন্দ্রিয় পাঁচটিকে জ্ঞানেন্দ্রিয় বলা যায়, তবে প্রথমে যে জ্ঞান লাভ হয় তা হোল ইন্দ্রিয়জ্ঞান অর্থাৎ জ্ঞানোন্মেষ মাত্র। এটা অভিজ্ঞতা। যা হোক কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয় অর্থাৎ যদ্বারা পদার্থের জ্ঞান লাভ ও কর্ম সাধন করা যায় এই সব হোল মানব দেহের বহির্ভাগীয় অংশ। এই বহির্ভাগীয় দ্বিবিধ ইন্দ্রিয় বাদে আছে অন্তরিন্দ্রিয়, যেমন মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত। তাই আমরা বলতে পারি ইন্দ্রিয় ত্রিবিধ।”
এখানেই কাসেদ আলীর অস্থিরতাটা স্পষ্ট। তিনি ইন্দ্রিয়কে হাত পা মুখের মতো সকর্মক সত্তা হিসাবে ভাবতে চাইছেন, আবার পিছিয়েও আসছেন। জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সঙ্গে কর্মেন্দ্রিয়ের সম্পর্ক আছে তিনি বুঝতে পারছেন, কিন্তু সম্পর্কটা কি ধরতে পারছেন না। মোটা দাগের বস্তুবাদী ধারার মধ্যে থাকলে একে ধরা সম্ভব নয়। তাঁর অস্থিরতা সবচেয়ে বেশী ধরা পড়ে যখন তিনি ‘মন’কেও অন্তরিন্দ্রিয় বলে ধরছেন। এবং সেই হিসাবে ‘মন’ সহ ইন্দ্রিয় কাসেদ আলীর কাছে তিন রকম। তাঁর অস্থিরতা এতো প্রবল যে ঠিক তার পরের বাক্যেই বলছেন :
“তবে তথাকথিত অন্তরিন্দ্রিয় আসলে ইন্দ্রিয় নয়। প্রাচীন অথবা স্থূল বস্তুবাদীরা মন চিন্তাদিকে অন্তরিন্দ্রিয় বলতে পারে। কর্মের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকেও কর্মেন্দ্রিয় বলা এই ভাবে ভুল।”
বোঝা যাচ্ছে ইন্দ্রিয় নিয়ে তিনি মহা ফাঁপরে পড়েছেন। সেই কারণে মন বা অন্তরিন্দ্রিয় নিয়েও একই সমস্যা। মন আসলে কি? এটা কি বস্তু নাকি ইন্দ্রিয়? নাকি চেতনা? এই ফাঁপরে পড়ে বেরুতে গিয়ে পড়েছেন আরো বড়ো ফাঁপরে। বলছেন, ‘তবে মনকে বোঝানো মুস্কিল। কারণ এর কোন চেহারা নেই। তাই দেখাও যায় না, অতএব ছবি আঁকা যায় না। এই মন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।’ মানে, সমস্যাটার সমাধান করা দূরের কথা, এগুতেই পারলেন না। ধরা ছোঁয়ার বাইরে মনকে খুয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে রাখলেন। তাঁর চিন্তার সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে দেয়া আমার আসল উদ্দেশ্য নয়। তাঁর সংস্কৃতি সিরিজ-১ পড়লেই যে কোন পাঠক তাঁর দুর্বলতা ধরতে পারবেন। কিন্তু এই লিখা পড়ার সময় যেটা আমার কাছে প্রশ্ন আকারে মনে জেগেছিল সেটা হোল মোটা দাগের বস্তুবাদের সূত্রানুসারে কাসেদ আলী মন বস্তু দিয়ে তৈরী এই কথাটা বলে আর উকিঝুঁকি না মারলেও পারতেন। মনকে বস্তু থেকে আলাদা ভাবে বিশিষ্ট সত্তায় ভাবার অস্থিরতা তাঁকে পেয়ে বসল কেন? তাঁর রচনায় দেখা যায় যে চেতনাকে বস্তু হিসাবে ভাবতে গিয়ে তিনি তাকে ‘মস্তিষ্ক’, ‘মগজ’ প্রভৃতি বস্তুময় সত্তা হিসাবে সনাক্ত করছেন ঠিকই কিন্তু তবু তাঁর চিন্তা মন সম্পর্কে কোন যান্ত্রিক ধারণার দিকে ধাবিত হয় নি যা ইংরেজীতে Behaviorist ধারণা নামে পরিচিত, মোটা দাগের বস্তুবাদের যা অন্তর্নিহিত পরিণতি। মস্তিষ্ক বা মগজ নামক বস্তুময় জিনিসের অস্তিত্ব মেনে নিয়েও কাসেদ আলী ‘মন’ নামক ধরা ছোঁয়ার বাইরের একটি সত্তার ধারণা ছাড়তে পারলেন না। এই অস্থিরতাটা কতো তীব্র সেটা আরো বোঝা যায় তার পরেও ‘মন’ নামক একটা সত্তার একটা সংজ্ঞা তিনি খাড়া করেই ছাড়লেন। কি সেই সংজ্ঞা? তাঁর কথা থেকেই শোনা যাক:
‘মানবেতর প্রাণীর মস্তিষ্কের মতন মানবীয় মস্তিষ্কও গতিশীল বা দ্বান্দ্বিক বস্তু দিয়ে গড়া। তবে মানব মস্তিষ্ক অতুলনীয় ভাবে সর্বোচ্চ ও সর্বোৎকৃষ্ট। এই মানবীয় খুলিতে অটকানো মগজ নামক বস্তুটির সামাজিক-ঐতিহাসিক জিনিসটাই মন’।
মগজ নামক বস্তুটির সামাজিক-ঐতিহাসিক জিনিসটা বলতে তিনি কি বুঝিয়েছিলেন একমাত্র তিনিই জানেন। তবে এর মধ্য দিয়ে আমরা তাঁর অস্থিরতাটা ধরতে পারছি ভালভাবেই। ‘মন’, চেতনা বা অন্তরিন্দ্রিয়ের সঙ্গে বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কটা যে আসলে কি সে সম্পর্কে মোটা দাগের বস্তুবাদের সঙ্গে তিনি ঠিক কণ্ঠ মেলাতে পারছিলেন না।
দার্শনিক বিষয় শেষ করার আগে ব্যক্তিগত আলাপ থেকে তাঁর আরেকটি উদ্বিগ্নতার কথা বলি। এই উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক-দার্শনিক ঐতিহ্যের আবহের কারণে তিনি মায়াবাদ সম্পর্কে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। সংস্কৃতি সিরিজে-১ পুস্তিকাটিতে মায়াবাদ নিয়ে কিছু বিচ্ছিন্ন উক্তি আছে। ব্যক্তিগত আলাপে এই বিষয় নিয়ে আলাপ উঠেছিল একবার। তাঁকে আমি বলেছিলাম মায়াবাদ কোন দার্শনিক সমস্যাই নয়, কারণ যে মায়াবাদ দাবি করে যে জগৎ সংসারই মায়া সেটা স্ববিরোধী এবং একে কোন সিরিয়াস দর্শন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। কারণ হোল যে ব্যক্তি এই ধরণের উক্তি করে যে জগৎ সংসার মায়া তখন সে নিজেকেও জগৎ সংসারের অংশ হিসাবে ধরেই কথাটা বলে। যদি তাই হয় তাহলে সে নিজেও মায়া। সে নিজে যদি মায়া হয় তাহলে তার মুখ থেকে উচ্চারিত বাক্য তো সঠিক হতে পারে না। তা অনিবার্য ভাবেই মিথ্যা বা মায়া হতে বাধ্য। এই স্ববিরোধিতা এড়াতে সে যদি বলে যে আমি সত্য, আমি ছাড়া আর সব কিছু মায়া, তাহলেও সে স্ববিরোধিতার খপ্পরেই পড়বে। কারণ এই ক্ষেত্রে জগৎ সংস্যর মায়া, মায়াবাদের এই মূল কথাটাই নষ্ট হয়ে যায়, কারণ অন্তত একজন, যে নিজেকে সত্য জ্ঞান করে বাক্যটি উচ্চারণ করছে, সে তো মায়া নয়।
প্রসঙ্গটি তুলছি এ কারণে যে কাসেদ আলী এই ব্যাখ্যা শুনে খুবই মজা পেয়েছিলেন। মায়াবাদকে মোকাবেলার জন্য এর উল্টো দিকে বস্তুবাদকে খাড়া করা অনাবশ্যক, একে ভাববাদী দর্শনের ভেতর থেকেই খামোশ করে দেয়া যায়, এটা জেনে তিনি খুবই আমোদ বোধ করেছিলেন।
২। পুঁজিতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্র
আমার মনে হয়েছে সামন্তবাদ সম্পর্কে কাসেদ আলীর ভাবনা সবচেয়ে মৌলিক এবং বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতিকে সামনে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে তাঁর এই ভাবনার সুদূর প্রসারী ভূমিকা থাকবে। সামন্তবাদ সম্পর্কে বাংলাদেশে প্রচলিত ধারণার তুলনায় তাঁর চিন্তার সঠিকতা ও স্বচ্ছতার একটা বড়ো কারণ তিনি পুঁজিতন্ত্র সম্পর্কে মার্কসের চিন্তাকে আত্মস্থ করতে গিয়ে এর পদ্ধতিগত দিকটার প্রতি পূর্ণ নজর রেখেছেন। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝতে গেলে বণ্টন ও বিতরণ নয়, উৎপাদন সম্পর্কের দিকেই যে তাকাতে হবে এই উপলব্ধির কারণে তিনি মার্কসীয় পদ্ধতির খুবই গোড়ার জায়গা শক্ত করে ধরতে পেরেছেন। সামন্তবাদ সম্পর্কে তাঁর চিন্তার স্বচ্ছতার কারণে জনগণতন্ত্র সম্পর্কে বিশেষত বাংলাদেশে কমিউনিস্টদের কর্তব্য সম্পর্কে কাসেদ আলী স্পষ্ট ছিলেন।
পুঁজি সম্পর্কে তাঁর ধারণা দিয়ে শুরু করা যাক। উপমহাদেশে শ্রেণী ও সমাজ গ্রন্থের এক জায়গায় তিনি বলছেন:
“পুঁজির রূপ তাই দ্বিবিধ— পণ্য ও মুদ্রা। তবে প্রথমে মুদ্রা রূপে পুঁজি আবির্ভূত হয়। এটা পরিষ্কার বোঝা যায় বণিক পুঁজি ও মহাজনী পুঁজিতে মান্ধাতা আমলের দুটি আদিম রূপে। যেহেতু এই দুটো রূপই বিতরণ করে বণ্টনে-বিতরণে, তাই পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কে এই দুটো রূপ মূল বিচারে আসে না। উৎপাদন সম্পর্কে আসে যে পুঁজি সে হোল শিল্পপুঁজি।”
কথাটা পড়তে যতো সহজ মনে হচ্ছে, এই বিষয়ে মার্কসের ধারণা জানা না থাকলে কাসেদ আলীর বক্তব্যের মর্ম বোঝা যাবে না। কারণ এই কথার ভেতরে নিহিত রয়েছে মার্কসীয় চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সেটা হোল পুঁজি এবং পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে পার্থক্য।
মার্কসের চিন্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় না থাকলে একটা ভুল যে কারো পক্ষেই করা সম্ভব, সেটা হচ্ছে পুঁজি এবং পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ককে সমার্থক ভাবা। সে কারণে একটি ধারণা প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে যেহেতু পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন অতএব পুঁজি আর পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন ব্যবস্থা বুঝিবা একই কথা। অথচ কোন সমাজে পুঁজির উপস্থিতি থাকলেই সেই সমাজ পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত বা সেই সমাজ পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ হবে তার কোন কথা নেই। কাসেদ আলী বাংলাদেশে পুঁজির উপস্থিতি মেনে নিয়ে সেই সমাজকে যখন “আধা সামন্তবাদী” বলছেন তখন তাঁর চিন্তার মধ্যে মার্কসের এই শিক্ষাটাই প্রবল ভাবে উপস্থিত আছে লক্ষ্য করা যায়।
“পুঁজি” তৃতীয় খণ্ডে মার্কস বলছেন: “আমরা দেখেছি যে ব্যবসায়ী পুঁজি আর সুদবাহক পুঁজি পুঁজির সবচেয়ে প্রাচীনতম রূপ” (পুঁজি তৃতীয় খণ্ড: ৬০৯) অর্থাৎ পুঁজির এই দুই ঐতিহাসিক রূপের উদ্ভব পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা উদ্ভবেরও আগে। ব্যবসায়ী পুঁজি আর সুদবাহক পুঁজি উৎপাদনে না গিয়েও তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে। তাদের অস্তিত্বের জন্য বিনিময় সম্পর্কের বিকাশ অর্থাৎ পণ্য বিনিময়ই যথেষ্ট। পণ্য বিচলনের বিকাশ পুঁজির এই দুই প্রাচীনতম রূপের আবির্ভাবকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্যে পুঁজির এই দুই রূপের আবির্ভাবই যথেষ্ট। অনেক সমাজে পণ্য বিচলনের বিকাশ এবং পাশাপাশি পুঁজির এই দুই রূপের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা সেসব সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি। আরব, রোম, গ্রীক, প্রাচীন ভারতবর্ষে পণ্য বিচলনের বিকাশ হওয়া সত্ত্বেও পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে নি। কারণ পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের উদ্ভব ও বিকাশের জন্য পুঁজির এই দুই রূপের অস্তিত্ব যথেষ্ট নয়। সে কারণে পুঁজির অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও এই সমাজগুলো দাস বা সামন্ত সমাজ হিসাবেই বিবেচিত হয়েছে।
ব্যবসায়ী পুঁজি সম্পর্কে মার্কস একজায়গায় বলছেন:
“যেহেতু ব্যবসায়ী পুঁজি বিচলনের খোঁয়াড়ের মধ্যেই বাঁধা, এবং যেহেতু এর একমাত্র কাজ হচ্ছে পণ্যের বিনিময় সাধন, সরাসরি বিনিময়ের (কার্টার) অবিকশিত ধরণের কথা বাদ দিলে পণ্য এবং মুদ্রার সচল বিচলনের বাইরে এর অস্তিত্বের জন্যে আর কোনো শর্তেরই দরকার নেই।” (পুঁজি তৃতীয় খণ্ড:৩২৫)
অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্কের রূপ যাই থাকুকনা কেন ব্যবসায়ী পুঁজির অস্তিত্বের জন্যে সেটা কোন নির্ধারক শর্ত নয়। পণ্য এবং মুদ্রার বিচলনই তার অস্তিত্বের জন্যে যথেষ্ট। এ বিষয়টি মার্কস আরো স্পষ্ট ভাবে হাজির করছেন এভাবে :
“যেসব উৎপন্ন সামগ্রীকে বিচলনের মধ্যে পণ্য হিশাবে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে তাদের উৎপাদনের ভিত্তি কি তাতে কিছুই আসে যায়না হোক তারা আদিম কোন গোষ্ঠির, দাস উৎপাদনের, খুদে চাষী বা খুদে বুর্জোয়া, বা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে উৎপাদিত পণ্য হিশাবে উৎপন্ন সামগ্রীর চরিত্র এতে বদলায় না, এবং পণ্য হিশাবে বিনিময়ের প্রক্রিয়া এং আনুষঙ্গিক রূপের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে তাদের যেতেই হবে। যে প্রান্তগুলোর মাঝখানে ব্যবসায়ী পুঁজি মধ্যস্থতা করে সেসব প্রান্তগুলো তার জন্যে দেয়াই থাকে, যেমনটি দেয়া থাকে মুদ্রা এবং তার চলাচলের জন্যেও। একমাত্র যেটা দরকারী সেটা হচ্ছে প্রান্তগুলো যেন হাতের ওপর পণ্য হিশাবে হাজির থাকে, উৎপাদন আগাগোড়া পণ্যের উৎপাদন ছিল কিনা, নাকি স্বাধীন উৎপাদকদের অব্যবহিত প্রয়োজন তাদের নিজেদেরই উৎপাদনে মিটিয়ে শুধুমাত্র বাড়তি অংশটা বাজারে ছাড়া হয়েছে তাতে কিছুই এসে যায় না। ব্যবসায়ী পুঁজি পণ্য সঞ্চালনের চলাচলকেই শুধু সহায়তা করে যারা তার নিজেরই অস্তিত্বের পূর্বশর্ত (পুঁজি তৃতীয় খণ্ড : ৩২৫)।
উৎপাদনের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পুঁজির পরিগঠিত হয়ে ওঠার জন্য আবশ্যক নয়। মার্কস আরো বলছেন পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের উদ্ভব, বিস্তৃতি ও বিকাশের আগে পুঁজি পরিগঠিত হয়ে উঠতে পারে।
‘প্রান্তগুলোর ওপর— অর্থাৎ উৎপাদনের যে সকল ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে বিচলন মধ্যস্থতা করে তাদের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা শেখার আগে বিচলনের মধ্যে পুঁজি পরিগঠিত হয়ে উঠতে সক্ষম এবং পুঁজি অবশ্যই পরিগঠিত হয়’ (পুঁজি তৃতীয় খণ্ড: ৩২৮)।
এই উদ্ধৃতিটির সঙ্গে কাসেদ আলীর বার বার জোর দিয়ে বলা কথাটা মিলিয়ে দেখা দরকার যে বিচলন— অর্থাৎ বন্টন ও বিতরণ দিয়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল কাঠামো বা ভিত্তি বোঝা যাবে না। কারণ সেখানে পুঁজিকে দেখা গেলেও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিতান্ত্রিক হবে এমন কথা মার্কস কখনো বলেন নি। লক্ষ্যণীয় যে মার্কস বিশেষ ভাবে জোর দিয়ে বলছেন যে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হবার আগে পুরনো উৎপাদন পদ্ধতির গর্ভে পুঁজি পরিগঠিত হয়ে উঠতে সক্ষম এবং অবশ্যই পরিগঠিত হয়। এটা জোর দিয়ে বলার কারণ হচ্ছে পুঁজি পরিগঠনের প্রক্রিয়া খোদ উৎপাদন থেকে স্বাধীন— এই দিকটাই মার্কস উপরের উদ্ধৃতিতে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এই অর্থে স্বাধীন যে পুঁজির পরিগঠনের জন্যে বিনিময় বা বিচলনই গুরুত্বপূর্ণ, কিভাবে বিনিময়ের প্রান্তসীমার বাইরে পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে সেটা নয়, পরিগঠিত পুঁজি উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর পাল্টা প্রভাব ফেলতে শুরু করে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু একটি সমাজের উৎপাদনের বৈশিষ্ট্য যদি আমরা নির্ধারণ করতে যাই তাহলে আমাদের যেতে হবে খোদ উৎপাদনে, বন্টনে বা বিতরণে নয়।
যারা মুদ্রা পণ্য দেখেই সমাজের বৈশিষ্ট্যকে পুঁজিতান্ত্রিক নির্ণয় করেন তাঁদের জন্য মার্কসের আরেকটি কথা মনে করিয়ে দেয়া দরকার। সেটা হোল, ব্যবসায়ী পুঁজি একটা সীমা পর্যন্ত কেবল পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের শর্ত তৈরী করতে পারে। তার বেশী নয়। এর (ব্যবসায়ী পুঁজি) বিকাশ এক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে অন্য একটি ব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটাবার ক্ষেত্রে কিম্বা রূপান্তরের ব্যাখ্যা হাজির করতে অক্ষম (পুঁজি তৃতীয় খন্ড: ৩২৭)। অর্থাৎ ব্যবসায়ী পুঁজি পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারেনা। বাবসায়ী পুঁজির এই অক্ষমতা বা অসামর্থ্য অনুধাবন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা ধরেই নেয়া হয় যে ব্যবসায়ী পুঁজির পরিগঠনের পরপরই স্বাভাবিক নিয়মে সেই পুঁজি শিল্পপুঁজিতে পরিণত হয়। ব্যবসায়ী পুঁজির স্তর থেকেই উৎপাদন ব্যবস্থা আপনা-আপনি পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় রূপান্তর লাভ করে এই বুর্জোয়া ধারণাই আমাদের দেশে বিপুলভাবে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের দেশে সর্বহারা শ্রেণীর আন্দোলনের মধ্যে এই ধারণার প্রাবল্যই লক্ষ্য করা যায়। এখানেই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা এবং কমিউনিস্টদের কর্তব্যের বিষয়টা পরিষ্কার ভাবে ধরা পড়ে।
ব্যবসায়িক পুঁজি সম্পর্কে মার্কসের আরো কথা হচ্ছে।
‘ব্যবসায়িক পুঁজি যেখানেই তার অবস্থানকে প্রধান করে তুলতে পেরেছে তার সব জায়গাতেই সে ডাকাতগিরি ব্যবস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে। পুরোনো আর নতুন যুগের বাণিজ্যকারী দেশগুলোর মধ্যে এর বিকাশ সবসময়ই যুক্ত থেকেছে লুটতরাজ, জলদস্যুতা, দাস অপহরণ এবং উপনিবেশ দখলের সঙ্গে’ (পুঁজি তৃতীয় খণ্ড: ৩৩১)
ব্যবসায়ী পুঁজির এই চরিত্র আমরা ইতিহাস থেকেই অনুধাবন করতে পারি। ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাসই এই সত্য অনুধাবনের জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু কাসেদ আলীকে বুঝতে গিয়ে আমরা মার্কসের যুক্তি ঘনিষ্ঠ ভাবে অনুসরণ করছি একদিকে মার্কসীয় বিশ্লেষণের পদ্ধতিকে অনুধাবন করার জন্যে অপরদিকে প্রসঙ্গটি তুলে মাঝপথে ছেড়ে দিতে চাইছি না। এর কারণ হোল এই সকল বিষয়ে অস্পষ্টতার কারণে বাংলাদেশের বিপ্লবী আন্দোলন, বিশেষত জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এখন ব্যবসায়ী পুঁজির স্বাধীন এবং প্রাধান্যকারী বিকাশের মানে কি? মার্কস বলছেন,
উৎপাদনের পুঁজির অধীনস্থ না হয়ে থাকা, অর্থাৎ অন্য ধরণের সাম্যজিক উৎপাদন পদ্ধতির ভিত্তিতে পুঁজির বিকাশ যা কিনা নিজেও পুঁজি থেকে স্বাধীন (পুঁজি তৃতীয় খণ্ড: ৩২৮)।
মার্কসের এই সিদ্ধান্তের তাৎপর্য অপরিসীম। এই সিদ্ধান্ত থেকেই মার্কস একটি সমাজের সামগ্রিক অনুন্নয়নের কারণ হিশাবে তাঁর বিখ্যাত সূত্রটি হাজির করেছেন। সূত্রটি হচ্ছে।
‘ব্যবসায়ী পুঁজির স্বাধীন বিকাশ সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে বিপরীত অনুপাতে সম্পর্কিত’ (পুঁজি তৃতীয় খণ্ড: ৩২৮)
অর্থাৎ ব্যবসায়ী পুঁজির স্বাধীন বিকাশ যে অনুপাতে ঘটে সমাজের বিকাশহীনতার প্রক্রিয়া সে অনুপাতেই ঘটতে থাকে। দুয়ের সম্পর্ক বিপরীতমুখী। বাংলাদেশে মতো দেশগুলোর অনুন্নয়ন এবং দারিদ্রের প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করবার একটা সূত্র এখানে পাওয়া যাচ্ছে।
মার্কসের চিন্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় না থাকলে একটা ভুল যে কারো পক্ষেই করা সম্ভব, সেটা হচ্ছে: পুঁজি এবং পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ককে সমার্থক ভাবা। সে কারণে একটি ধারণা প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত যে যেহেতু পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন অতএব পুঁজি আর পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন ব্যবস্থা বুঝিবা একই কথা। অথচ কোনো সমাজে পুঁজির উপস্থিতি থাকলেই সেই সমাজ পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত বা সেই সমাজ পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ হবে তার কোনো কথা নেই। কাসেদ আলী বাংলাদেশে পুঁজির উপস্থিতি মেনে নিয়ে সেই সমাজকে যখন “আধা সামন্তবাদী” বলছেন তখন তার চিন্তার মধ্যে মার্কসের এই শিক্ষাটাই প্রবলভাবে উপস্থিত আছে লক্ষ্য করা যায়।
পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে এই পরিস্থিতির অত্যন্ত মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। সে দিকটা মার্কস বারবার তুলে ধরেছেন। ব্যবসায়ী পুঁজির স্বাধীন বিকাশ মানে কি? এর মানে হচ্ছে পণ্য বিচলনের একটা বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব, এই বিচলন যেহেতু পুঁজির সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে সাধিত হচ্ছে ফলে এটা পুঁজিতান্ত্রিক বিচলন, কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের অস্তিত্ব ছাড়াই ব্যবসায়ী পুঁজি অস্তিত্বমান রয়েছে। সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার দিক থেকে যদি আমরা ব্যাপারটিকে দেখি তাহলে বিচলনের এই স্বাধীন অস্তিত্বের তাৎপর্য দুদিক থেকে অনুধাবনযোগ্য। এক হচ্ছে, বিচলন উৎপাদনকে নিজের আলিঙ্গনের মধ্যে বেঁধে ফেলতে পারে নি, তার সঙ্গে বিচলনের সংযুক্তি বাইরের কোনো কিছুর সঙ্গে সংযুক্ত থাকার মত অবস্থা। অন্যদিকে উৎপাদন প্রক্রিয়া বিচলনকে তার পুরো প্রক্রিয়ার একটা পর্যায় বা একটা মুহূর্তে পরিণত করতে পারে নি, অথচ পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় এটাই বিচলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। আবার এই দুদিক থেকেই সামগ্রিক পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন পুরোপুরি বিচলনের ওপর নির্ভরশীল কারণ বাজার থেকে মেশিনপত্র, কাঁচামাল, শ্রম ইত্যাদি কিনবার পরেই উৎপাদন শুরু হতে পারে। অন্যদিকে বিচলন হচ্ছে ‘নেহায়েতই উৎপাদনের একটি রূপান্তরশীল পর্যায়’ (পুঁজি তৃতীয় খণ্ড: ৩২৮)। যে পর্যায়ে উৎপন্ন পণ্য নিজের মূল্য এবং সামাজিক উপযোগিতা উশুল করে এবং প্রমাণ করে। ব্যবসায়ী পুঁজির যে বিচ্ছিন্নতা আমরা ওপরে দেখি পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সে আর তখন বিচ্ছিন্ন বা স্বাধীন থাকে না, পুঁজিরই উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়ার একটা পর্যায়ের রূপ হয়ে ওঠে, পুরো প্রক্রিয়ার অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে প্রক্রিয়াকে সক্রিয় রাখার ভূমিকা পালন করে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার বিকাশের ক্ষেত্রে সে তখন বাধ্য নয় বরং বিচলন সামাজিক উৎপাদনকে বিকশিত করে তুলবার মাধ্যম হয়ে ওঠে। ‘প্রাক পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে শিল্পের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রেখেছে বানিজ্য আর আধুনিক সমাজে বহাল হয়েছে উল্টোটা’ (পুঁজি তৃতীয় খণ্ড: ৩৩০)। এই উল্টো অবস্থাটাই উৎপাদন শক্তির বিকাশের জন্য জরুরী। মার্কসের এই কথা উপলব্ধি করতে পারলে আমরা বুঝব কাসেদ আলী পুঁজির অস্তিত্ব মেনে নিয়েও কেন বাংলাদেশের সমাজকে ‘আধা সামন্তবাদী বলতেন’ এবং এই অবস্থান থেকে উত্তরণের জন্য সবচেয়ে স্পষ্ট এবং সাহসী ভাবে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের একাংশের পক্ষে একাট্টা দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও “অধনবাদী” একাংশের ধারাকে তিনি “বদমাইশ” ধারা হিসাবে গালিগালাজ করার মর্মার্থটাও এখান থেকে অনুধাবনযোগ্য।
বাংলাদেশের সমাজকে “আধা সামন্তবাদী” হিসাবে শনাক্ত করতে গিয়ে কাসেদ আলী একটা কথায় বারবার জোর দিতেন সেটা হোল বাংলাদেশের সামন্তবাদী উৎপাদন প্রণালীতে জোতদার, বর্গাদার সম্পর্ক প্রধান নয় বরং এই সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্কের “খাস বৈশিষ্ট্য” হচ্ছে, মহাজন শোষিত মালিক চাষীর উৎপাদন প্রণালী। এই মহাজনী শোষণের রূপটা বুঝতে হলে মহাজনী পুঁজি সম্পর্কে মার্কসের ধারণাটার ওপরও একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া দরকার।
ব্যাংকের টাকা ধার করলে সুদ দিতে হয়, আবার টাকা জমা রাখলে সে জমা জলা থেকে সুদ জমে। পুঁজির এই সুদবাহক রূপটা তার আধুনিক রূপ। মহাজনি পুঁজি হিশাবে সুদবাহক পুঁজির যে আদি রূপ আমাদের কমবেশী চেনা তার সঙ্গে পুঁজির সুদবাহক আধুনিক রূপের মৌলিক পার্থক্য আছে।
আদি সুদবাহক পুঁজি বা মহাজনি পুঁজির উদ্ভব ও বিকাশ ব্যবসায়ী পুঁজির গা ঘেঁষেই বা একসঙ্গেই ঘটতে থাকে। ব্যবসায়ী পুঁজির মতো এর অস্তিত্বমান হয়ে উঠবার জন্যে শর্ত লাগে একটাই টাকা আর পণ্যের বিচলন। উৎপাদনের পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তর এই পুঁজির অস্তিত্বের জন্যে মোটেও জরুরী নয়।
পণ্য এবং টাকার সাধারণ পার্থক্য ছাড়াও উভয়ের পার্থক্যের মধ্যে একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে। সুদখেকো মহাজনি পুঁজিকে বিচার করতে হলে পার্থক্যের এই বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা জরুরী। সেটা হোল, পণ্য টাকার মতো সম্পদের সার্বজনীন রূপ নয়। টাকা দিয়ে বাজারে আবির্ভূত যে কোন বস্তুসামগ্রীই কেনা সম্ভব। এতে এই বোধই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় যে দুনিয়ার সকল সম্পদের প্রতিভূ বুঝিনা টাকাই। ফলে এই সার্বজনীন সম্পদকে স্ফীত করে তোলার জন্যে টাকা-রূপী সংম্পদ মজুত করে রাখার আকাংখা সমাজে জাগে। কুসিদজীবী মহাজন এই আকাংখারই অভিপ্রকাশ।
সুদখেকো মহাজনী টাকা হচ্ছে পুঁজির সেই বিশুদ্ধ রুপ যেখানে টাকা দিয়ে টাকাকে স্ফীত করে তোলা হয়, অতিস্ফীতির এই প্রক্রিয়াটা এক্ষেত্রে অতি স্পষ্ট আর সরাসরি।
এই মহাজনি সুদখেকো পুঁজির যে ধারক তার কারবার যে কেবল টাকাকে সুদে খাঁটানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা নয়, সে ব্যবসায়ীও হতে পারে। ব্যবসায়ী পুঁজি আর সুদখেকো পুঁজির প্রকাশ ঘটতে পারে একই ব্যক্তির মধ্যে। আসলে মহাজন বলতে অধিকাংশ সময় আমরা এই দ্বৈত ভূমিকা সম্পন্ন পুঁজিপতিকেই বুঝি।
কিন্তু যদি দাস ব্যবস্থার যুগে কোন ব্যবসায়ী টাকা ধার করে আর পুঁজিকে স্ফীত করবার জন্যে সে তা কারবারে খাটায় এবং সে টাকা যদি সে জমি কিনে উৎপাদনেও খাটায় তবুও শ্রমশক্তির রূপ এখানে দাস আকারেই হাজির থাকে। অর্থাৎ তার জমিতে খাটবে দাস, কোন কৃষি শ্রমিক নয়। বা ভূমিদাসসহ সে যদি কোন জমিদারী কেনে তবে সেক্ষেত্রেও শ্রমের রূপটা ভূমিদাসেরই রূপ— এর কোনটাই পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক নয়। অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের উদ্ভবের আগে পুঁজি পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কে উৎপাদনে নিয়োজিত হতে পারেনা। বিরাজমান উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে বাড়তি শ্রম আত্মসাৎ করে মাত্র। গ্রীক এবং রোমান সমাজে দাসপ্রথার একটা যুগে টাকা খাটাবার চরিত্রের মধ্যে যে আদতে দাসপ্রথারই বৈশিষ্ট্য নিহিত ছিল সে বিষয়ে উল্লেখ করে পুঁজির আদি রূপের সুনির্দিষ্ট চরিত্রলক্ষন সম্পর্কে মার্কসের অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসদৃষ্টি এক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে স্মরণীয় (পুঁজি তৃতীয় খন্ড: ৫৯৪)।
পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক উদ্ভবের আগে পুঁজির দুই আদি রূপ বিবিধ বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির থাকলেও মৌলিক ভাবে সুদখেকো পুঁজির বৈশিষ্ট্যমূলক রূপ যাচ্ছ দু রকম।
মার্কস বলছেন:
“সে যাই হোক পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের আগে সুদখেকো পুঁজির দুটো বৈশিষ্ট্যমূলক রূপ অস্তিত্বমান ছিল। আমি বৈশিষ্ট্যমূলক রূপ কথাটা উদ্দেশ্যপূর্ণ ভাবেই বলছি পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের ভিত্তিতে একই রূপের ফিরতি প্রকাশ ঘটেছে কিন্তু ঘটেছে একটা নিছক অধীনস্থ রূপ হিশাবে যখন তা আর সেই রকম কোন রূপ নয় যা সুদবাহক পুঁজির চরিত্র নির্ধারণ করে দিতে সক্ষম। এই দুটি রূপ হচ্ছে: প্রথমে, সমাজের উঁচুতলার অতি খর্চাবাজ শ্রেণীকে সুদে টাকা ধার দেয়া, বিশেষত জমির মালিকদের, দ্বিতীয়ত, শ্রম সম্পাদনের পরিমণ্ডল যাদের দখলে সেই সকল খুদে উৎপাদকদের ওপর সুদে টাকা খাটানো কারিগররা এই দলে অন্তর্ভুক্ত, তবে প্রধানত এরা কৃষকই। কারণ প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক পরিবেশে, যতক্ষণ তা স্বাধীনভাবে জনে জনে খুদে উৎপাদকদের টিকে থাকতে দেয় কৃষকরাই সেখানে থাকে যারপরনাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।” (পুঁজি তৃতীয় খন্ড: ৫৯৪)
শেষের কথাটি কাসেদ আলীর অবস্থান অনুধাবন করার জন্য অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বারবারই বলেছেন যে পণ্য ও মুদ্রার বিচলন যতোই বাড়ুক, ঝলমলে আধুনিক বিপণী কেন্দ্রের চোখ ধাঁধানো বণিকবৃত্তি বা অত্যাধুনিক ব্যাংকের কুসিদজীবিতা যতোই আমাদের ধন্দ সৃষ্টি করুক না কেন, গ্রামাঞ্চলের বিপুল স্বাধীন মালিক চাষীদের খুদে উৎপাদনটা এর কারণে পুঁজিতান্ত্রিক হয়ে যায় না। কারণ সেখানে উৎপাদন সম্পর্কটা পুঁজিতান্ত্রিক নয়। এটা বরং সামন্তবাদের শেষ অবস্থা। কার্ল মার্কসের মূল শিক্ষার সঙ্গে এখানেই তাঁর অবস্থানের চমৎকার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বণ্টন ও বিতরণের ধন্দে পড়ে তিনি বাংলাদেশের সমাজ অনুধাবন করার ভুলে পা দেন নি। পুঁজিতন্ত্র ও সামন্তবাদকে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ ভাবে বোঝার দিক থেকে তাঁর কৃতিত্ব আমাদের স্বীকার করতেই হবে।
কাসেদ আলীর বক্তব্য থেকে উদ্ধৃতির চেয়েও কার্ল মার্কস থেকে উদ্ধৃতি এখানে বেশী দেবার কারণ হোল আমার ধারণা কাসেদ আলীর লিখা পাঠের সময় কার্ল মার্কসের মূল অবস্থান সম্পর্কে একটা ধারণা থাকলেই এই অগ্রজ কমিউনিস্টের কথা আমরা বুঝতে পারব। কারণ প্রায় কখনোই নিজের কথা বলতে গিয়ে তিনি মার্কসকে টেনে আনেন নি। নিজের মতো করে অধিকাংশ সময় মন্তব্য আকারে বলে গেছেন। ধরে নিয়েছেন যে মার্কসের মূল অবস্থান সম্পর্কে পাঠক কমবেশী অবহিত। সেটা ধরে নেওয়াটা তাঁর ঠিক হয় নি।
অনেকের মনে হতে পারে যে বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থা “আধা সামন্তবাদ” বলার ফলে তাঁর অবস্থান অন্যান্য যেসব কমরেড বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থার বৈশিষ্টকে “আধা সামন্তবাদ” বলতেন তাঁদের কথাই বলছেন। এটা এক্কেবারেই ভুল।
কাসেদ আলীর অবস্থান হচ্ছে:
“বাংলাদেশের সমাজ আধা-সামন্তবাদী সমাজ যার মানে হোল শহরে পুঁজিবাদ আছে এবং গ্রামাঞ্চলে গোটা কৃষক সমাজে আছে মূলতঃ সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা। আমাদের এই বক্তব্য এতোই সুস্পষ্ট যে এতে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকার কথা নয়। তবে গ্রামাঞ্চলে এই সামন্তবাদ আদিম সামন্তবাদ থেকে এক বিশেষ স্তরে উন্নীত হয়েছে। এই উন্নতি যে সামন্তবাদের সর্বশেষ পর্যায় সে আলোচনা করার আগে বলতে হয় যে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের এই সামন্তবাদকে বুর্জোয়া সংস্কার ও আধিপত্যবাদী চরিত্র প্রদান সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির প্রচণ্ড প্রভাবের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা চলে না। সামন্তবাদী ও আধিপত্যবাদী এই দুটো চরিত্র অবিচ্ছেদ্য কিন্তু গুণগত ভাবে পৃথক”।
উল্লেখ করা দরকার যে আধিপত্যবাদ বলতে কাসেদ আলী সকল ধরণের আধিপত্যবাদ সহ সাম্রাজ্যবাদকেও অন্তর্ভুক্ত করতেন। তাঁর অবস্থানের স্বচ্ছতা হচ্ছে ওখানে যে যাঁরা মনে করেন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সামন্তবাদের অবশেষ আছে তিনি কঠোর ভাষায় তাদের সমালোচনা করতেন। আখলাকুর রহমানের কৃষিতে ধনতন্ত্র এসে গেছে এই ধারাকে মনে করতেন ‘প্রতিপাদ্যটা শুধু ভুল নয়, বরং চক্রান্তমূলক এবং প্রতিবিপ্লবী’।
এখানে কমরেড আবদুল হকের সঙ্গে তাঁর চিন্তার পার্থক্যটাও লক্ষ্যণীয়। কাসেদ আলী তাঁর “জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব” বইতে আবদুল হক “বিসমিল্লায় গলদ” কোথায় করেছেন সেটা ধরিয়ে দিচ্ছেন এভাবে যে, আধা সামন্তবাদী পূর্ব বাংলা সঠিক কিন্তু কৃষি ব্যবস্থা আধা-সামন্ততান্ত্রিক বেঠিক। কাসেদ আলী পরিষ্কার মনে করতেন কৃষি ব্যবস্থা সামন্তবাদী, তবে সেটা সামন্তবাদের শেষ পর্যায়। তবে ‘অ-কৃষি তথা শহরে শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থা বাংলাদেশে পুঁজিবাদী। এমনকি কৃষি ব্যবস্থায় ধনী কৃষক-ক্ষেত মজুর উৎপাদন সম্পর্কটা আধা-পুঁজিবাদী ভাষান্তরে আধা-সামন্তবাদী। কিন্তু গ্রমাঞ্চলে এই সম্পর্ক প্রধান নয়। কৃষি ব্যবস্থায় সামন্তবাদের অবশেষ আছে এটাকে তিনি মারাত্মক ভুল মনে করতেন। কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে বললে যেমন, তেমনি কৃষিতে সামন্তবাদের অবশেষ আছে বললেও মারাত্মক রণনীতিগত ভুল হয়। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই তখন কমিউনিস্টদের কর্তব্য হয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব-জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব নয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে কাসেদ আলীর “আধা সামন্তবাদ” ধারণাটা খুবই সতর্কতার সঙ্গে বোঝা দরকার। তাঁর মৌলিকত্বটা এখানেই যে তিনি পুঁজি ও পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের পার্থক্যটা যেমন চমৎকার খেয়ালে রেখেছেন, তেমনি পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক ও সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্কের পার্থক্যও মনে রেখেছেন। শুধু তাই নয়, সামন্তবাদকে একটা স্থির ও অনড় সমাজ হিসাবে তিনি দেখেন নি, এর আভ্যন্তরীণ রূপান্তর ও ঐতিহাসিক বদল অনুসরণ করে এই সিদ্ধান্তেও আসতে পেরেছেন যে সামন্তবাদ আমাদের কৃষিতে প্রধান ভাবেই বিরাজ করছে কিন্তু এটা সামন্তবাদের প্রাথমিক বা মধ্য অবস্থাও নয়, এটা সামন্তবাদের শেষ অবস্থা বা শেষ পর্যায়। এই শেষ অবস্থা বা শেষ পর্যায় মানে সামন্তবাদের “অবশেষ” নয়। এটা সামন্তবাদ ছাড়া অন্য কিছুই নয়।
৩। আধা-সামন্তবাদ ও জনগণতন্ত্র
কাসেদ আলী এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে বাংলাদেশের কৃষিতে সামন্তবাদ আছে মহাজন শোষিত খুদে মালিক চাষীর চাষাবাদের মধ্যে। তিনি জোর দিয়ে বলতেন, এটাই হচ্ছে আমাদের দেশের সামন্তবাদের খাস বৈশিষ্ট্য। তাঁর এই মূল্যায়ন অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর লিখালিখির মূল সুরটা এই সিদ্ধান্তের আশপাশেই কেন্দ্রীভূত ছিল।
এই সিদ্ধান্তের পেছনে তাঁর কৃতিত্বটা হোল এই যে সামন্তবাদকে এভাবে চিনতে গিয়ে তিনি ইউরোপীয় সামন্তবাদ বা চীন বা রাশিয়ার সামন্তবাদকে আমদানি করেন নি। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন, নিজের চোখে বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন ইউরোপীয় সামন্তবাদের যে ধারণা এ দেশে পুঁথিগত বিদ্যার মাধ্যমে আমাদের দেশের বিপ্লবী রাজনীতি ও শহুরে বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ আমদানি করেছেন সেটা বাংলাদেশের সমাজে প্রযোজ্য নয়। তিনি মাথায় সামন্তবাদ সম্পর্কে একটা পুঁথিগত ধারণা নিয়ে বাইরে কোথায় তা প্রয়োগ করা যায় ভাববাদীদের মতো সেটা খুঁজে বেড়ান নি। বাস্তবে বাংলাদেশের সমাজটা কেমন, তার আদত চেহারাটা কি সেটা জানতে চেষ্টা করেছেন। তারপর ‘সামন্তবাদ’ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাটাকে পর্যালোচনা করেছেন এবং সেই ধারণার সীমাবদ্ধতাটাও লক্ষ্য করেছেন। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ইউরোপ, চীন বা রাশিয়ার মতো আমাদের সমাজ নয় ঠিকই কিন্তু তার মানে এই নয় যে মহাজন শোষিত খুদে উৎপাদকরা সামন্তবাদ ছাড়া অন্য কিছু।
এই সিদ্ধান্তে আসার জন্য যে পদ্ধতিগত চিন্তা তাঁর মধ্যে কাজ করেছে সেটা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। সেটা হোল বন্টন বা বিতরণ দেখে উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অমার্কসীয়। বলা বাহুল্য তিনি এক্ষেত্রে মার্কসকে সবচেয়ে সঠিক ভাবে হৃদয়ঙ্গম করেছেন। উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে যদি সামন্তবাদ থেকে যায় তাহলে পণ্য ও পুঁজির বিচলন মানে সুদখেকো এবং ব্যবসায়ী পুঁজির প্রাধান্য ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। এখান থেকেই মহাজনী শোষণের সূত্রটা তিনি নির্ণয় করেছেন। তাহলে সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্কের অধীনে লক্ষ লক্ষ খুদে চাষীরা যে পণ্য উৎপাদন করছে, যে পণ্য কিনছে, যে টাকা ধার নিচ্ছে, যে টাকা দিয়ে ভোগ্য পণ্য কিনছে, পণ্য ও মুদ্রা বিচলনের এই সকল ক্রিয়াকাণ্ডটাই এক বিশাল মহাজনী শোষণের আবর্তে ঘুরপাক খেতে বাধ্য। কারণ পুঁজি এই সমাজে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক থেকে সৃষ্ট ও পুনরুৎপাদিত পুঁজি নয়।
এখানে মহাজনী শোষণের দুই রূপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মার্কস খুদে উৎপাদকদের সম্পর্কে যে কথা বলেছেন সেটা খেয়াল করা দরকার। এখানেও কার্ল মার্কসের সঙ্গে কাসেদ আলীর পদ্ধতিগত অবস্থান সঙ্গতিপূর্ণ। মার্কস বলছেন, মহাজনী পুঁজি শুধু খর্চাবাজ অভিজাত শ্রেণীকেই সুদে টাকা খাটিয়ে শোষণ করে না, শোষণ করে খুদে উৎপাদকদেরও। যাদের মধ্যে কারিগররা ছাড়াও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে থাকে ছোট ছোট কৃষকরা। “কারণ প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক পরিবেশে, যতক্ষণ তা স্বাধীনভাবে জনে জনে খুদে উৎপাদকদের টিকে থাকতে দেয় কৃষকরাই সেখানে থাকে যারপরনাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।”
কাসেদ আলী আরো সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্ক যেখানে বিরাজ করে বা অন্য কথায় যে সমাজ থেকে উৎপাদন সম্পর্ক হিসাবে দাস প্রথা অন্তর্হিত হয়েছে কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের বিকাশ ঘটে নি, সেখানে কৃষক যে রূপেই খাজনা দিক না কেন সেটা হবে এই মধ্যবর্তী সমাজের বা সামন্ত সমাজের খাজনা। যে কথা তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন সেটা হোল খাজনার রূপ মুদ্রা হলেই তা পুঁজিতান্ত্রিক খাজনা নয়। কিম্বা শ্রম খাজনা বা দ্রব্য খাজনার হ্রাস ঘটলেই তা পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের লক্ষণ নয়। কারণ সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত থেকে এই খাজনা দেয়া হচ্ছে।
এখান থেকেই কাসেদ আলীর জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মর্মার্থটা বুঝতে হবে। কার্ল মার্কসের ছাত্র হিসাবে কাসেদ আলী জানতেন যে পুঁজি আপনা থেকে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক প্রবর্তন করতে পারে না। এই কথাটা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেকেই ধরে নেন যে বণিক পুঁজি আর সুদখেকো পুঁজি বুঝি আপনাতেই পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। সেটা ঠিক নয়। একটা সীমা পর্যন্ত পুরোনো সমাজের ভাঙন ত্বরান্বিত করার মধ্য দিয়ে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের শর্ত তৈরী করে অবশ্যই। ঠিক এ কারণেই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের উৎপাদন সম্পর্কগত মর্মার্থ হচ্ছে রাজনৈতিক ভাবে পুরোনো উৎপাদন সম্পর্কের ভাঙনকে এর অন্তর্নিহিত পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়ে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের আবির্ভাব ও বিকাশের পথ করে দেয়া। এবং সেটা করে দেয়া দ্রুততার সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে পোঁছবার জন্য।
কাসেদ আলী কার্ল মার্কসের ঘনিষ্ঠ অনুসারী হিসাবে জানতেন যে আধা সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্ক থেকে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কে পোঁছাবার কাজটা পুঁজি করে দিতে পারে না। তার জন্যই দরকার জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব। তিনি জানতেন সমাজ বিপ্লব উৎপাদন সম্পর্কের স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব নয়। তাঁর ভাষ্যেই শোনা যাক:
“সমাজ বিপ্লব কি উৎপাদন সম্পর্কের স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব? না, এই জাতীয় অর্থনীতিবাদ স্বতঃস্ফূর্ত মতের ও পথের শিকারে পরিণত সংশোধনবাদ। রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডের মাধ্যমে তথা প্রচলিত রাষ্ট্রযন্ত্র ধ্বংসের মাধ্যমে এক নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েই পুরানো উৎপাদন সম্পর্কের স্থলে নতুন উৎপাদন সম্পর্কে সে অগ্রসর হতে পারে”।
বাংলাদেশে আধা সামন্তবাদী সমাজ থেকে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে উন্নত পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক বিকশিত করতে হলে বিরাজমান রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করতে হবে। এক্ষেত্রে কাসেদ আলীর চিন্তার স্বচ্ছতা প্রশংসনীয়। তিনি জানতেন যে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব আধিপত্যবাদ বিরোধী ও সামন্তবাদ বিরোধী হতে বাধ্য। এবং বাংলাদেশের মতো আধা সামন্তবাদী দেশ “ঔপনিবেশিক বা নয়া-উপনিবেশী। অর্থাৎ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও বনেদী সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদের শিকারে পরিণত হতে বাধ্য”। তবু কাসেদ আলী বলছেন, “সে আলোচনা না করেও শুধু আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিবেচনাতেই এই সিদ্ধান্ত টানা যায় যে, এখানে পুঁজিবাদী শিল্প বিকাশ জাতীয় স্বার্থেই প্রয়োজন। শুধু তাই না। গ্রামাঞ্চলে ভূমি বিপ্লবের স্বার্থেও প্রয়োজন” অত্যন্ত পরিষ্কার ভাবে কাসেদ আলী বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক বিকাশের শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন। তাঁর চিন্তার এই স্বচ্ছতাই তাঁকে একজন খাঁটি মার্কসবাদী লেনিনবাদীতে পরিণত করেছে, পুঁজির প্রতিক্রিয়াশীল আচরণের যে প্রাধান্য বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যায় সেটা তাঁর মধ্যে একদমই ছিল না। এ বিষয়ে একটি ব্যক্তিগত আলাপ এখানে উল্লেখ করা দরকার। আমি একবার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম যে তিনি “আধিপত্যবাদ বিরোধী” কথাটা কেন ব্যবহার করছেন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নয় কেন? যদিও তাঁর “আধিপত্যবাদ” শব্দটির ভেতরে সাম্রাজ্যবাদ অন্তর্ভুক্ত। আমি বলেছিলাম এই ব্যবহার ভুল হচ্ছে এ কারণে যে আধিপত্যবাদ সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক দিকটাকে যতো জোর দেয় তার অর্থনৈতিক দিকটাকে ততো জোর দেয় না। তিনি আমার কথায় মোটেও বিচলিত না হয়ে— যে উত্তর দিয়েছিলেন সেটা আমার মনে আছে বিশেষ ভাবে এ কারণে যে তখনই আমি জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে তাঁর ধারণার স্বচ্ছতা সম্পর্কে আরো বেশী নিশ্চিত হয়েছি। তিনি বললেন, প্রথমত ভাষার সুবিধার জন্য লিখি, এটা ঠিক। কিন্তু আরেকটি কারণেও লিখি। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামটা প্রধানত রাজনৈতিক হতে বাধ্য, পুঁজি বিরোধী অর্থনৈতিক সংগ্রামের চেয়েও। এ কারণে যে সামন্তবাদ উৎখাত করে বাংলাদেশে যদি পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের বিকাশ সাধন করতে হয় তাহলে লেনিনের কথা মতো উন্নত দেশ থেকে ‘পুঁজির রপ্তানি’র তো আমরা বিরোধী হতে পারি না। কারণ এই রপ্তানি লেনিনের কথা মতো পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের বিকাশ সাধন করবে এবং সেই অর্থে তা প্রগতিশীল। তিনি তারপর তাঁর বই খুলে আমাকে তাঁর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পড়ালেন। “জনগণতন্ত্র প্রসঙ্গের ১১ নম্বর পাতায় কাসেদ আলী লিখেছেন :
“মার্কসবাদী-লেনিনবাদী, বিশেষত মাও চিন্তাধারা মতে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ অর্থাৎ আর্ন্তজাতিক পুঁজিবাদের দৃঢ় বিরোধী। কিন্তু ঢালাও ভাবে উন্নত দেশের পুঁজি ও প্রযুক্তিবিদ্যা আমদানির বিরোধী নয়। এবং স্বদেশী পুঁজিবাদ বিকাশেরও বিরোধী নয় বরং এই বিকাশকে ভবিষ্যৎ সমাজতন্ত্রের স্বার্থে এবং সমাজতন্ত্রের ভিত্তির জন্য সহায়তা করা হয়।”
দেখা যাচ্ছে “আধিপত্যবাদ বিরোধী” কথাটা স্রেফ সুবিধার খাতিরে তিনি ব্যবহার করেন নি। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে কাসেদ আলীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের সঙ্গে এই ব্যবহার সঙ্গতিপূর্ণ। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কিন্তু দেশের ভেতরে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক বিকাশের বিরোধী নয়। সেই কারণে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি— অর্থাৎ “উন্নত দেশের পুঁজি ও প্রযুক্তি বিদ্যা আমদানির বিরোধী নয়”। এই কারণে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চরিত্রের অর্থনৈতিক দিকটার চেয়েও রাজনৈতিক বা আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামটাই প্রধান।
কাসেদ আলীর জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে বুঝতে হলে ভূমি বিপ্লব সম্পর্কে তাঁর ধারণাটা বোঝা দরকার। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে তিনি শিল্প বিকাশটা গ্রামাঞ্চলের ভূমি বিপ্লবের স্বার্থেই প্রয়োজনীয় মন করতেন। ইউরোপের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পার্থক্যটা তিনি টানছেন এভাবে :
“পুরোনো ও নতুন বুর্জোয়া বিপ্লবের মূল মিল হলো বিপ্লবী কায়দায় ভূমি পুনর্বণ্টন অর্থাৎ প্রধানতম উৎপাদনের উপায়কে বণ্টন করা। আরো অনেক মিল আছে। গরমিলটা: পুরোনো বিপ্লবে জমি থেকে খোদ চাষীকে মুক্ত করা হচ্ছে এবং নতুন বিপ্লবে খোদ চাষী জবরদখল করছে তার হারানো জমিকে। সেখানে জমি ও অন্যান্য উৎপাদন-উপায় থেকে বিযুক্তি আর এখানে হচ্ছে সংযুক্তি।”
জনগণতন্ত্র সম্পর্কে কাসেদ আলীর ধারণার আরো অনেক দিক আছে তবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক অনেকের চোখে না পড়তে পারে সেই কারণে সেই দিকের উল্লেখ করে এই প্রসঙ্গটায় ক্ষান্তি টানবো। বলা বাহুল্য জনগণতন্ত্রকে তিনি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বশর্ত মনে করতেন। কিন্তু এটাও মনে করতেন যে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হবার পর জনগণতান্ত্রিক স্তর থেকে সমাজতান্ত্রিক স্তরে পৌঁছাবার জন্য আর কোনো রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রয়োজন হবে না। শান্তিপূর্ণভাবে সেই স্তরে পৌঁছানো যাবে বলে তিনি মনে করতেন।
“ইতর কমিউনিস্টরা বুর্জোয়া রাষ্ট্রীয়করণকে সমাজতন্ত্রের জন্য পদক্ষেপ বলে ঘোষণা করে”,
আওয়ামী লীগের কলকারখানা রাষ্ট্রীয়করণের এই সমালোচনা তার ছিল। সেই হিশাবে বাংলাদেশের সংবিধানের লক্ষ্য হিশাবে সমাজতন্ত্র থাকা ঠিক কি না, এই প্রশ্নটাও ওঠে। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে যে জনগণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণীত হবে সেখানে কি লক্ষ্য হিসাবে সমাজতন্ত্রের কথা থাকতে পারে? এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কাসেদ আলী মনে করতেন থাকতে পারে। তিনি বলছেন,
“লক্ষ্যাদর্শ হিসাবে সমাজতন্ত্র জনগণতন্ত্রের সংবিধানে থাকতে পারে। কারণ জনগণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ শান্তিপূর্ণভাবে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হতে পারে। অবিশ্যি অনেক অবশ্য-পুরণীয় শর্ত পূরণ হলে”।
জনগণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের এই প্রশ্নটি কাসেদ আলীর জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে ধারণার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই বিষয়টি শেষ করার আগে এই প্রসঙ্গে যে বিষয়ে তাঁর কাছে ব্যক্তিগত ভাবে অনেকবার তিরষ্কৃত হয়েছি সেটা বলা দরকার। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের বিপ্লবের চরিত্র এবং এখনকার কর্তব্য সম্পর্কে সাধারণ ভাবে আমার মতৈক্য থাকা সত্ত্বেও আমি এই বিপ্লবকে “জনগণতান্ত্রিক” না বলে “গণতান্ত্রিক” বলতে অভ্যস্ত ছিলাম মূলত লেনিনের ঘনিষ্ঠ থাকার তাগিদ থেকেই এই শব্দটি আমি ব্যবহার করতাম। কাসেদ আলী এই শব্দটি ব্যবহারের ঘোর বিরোধী ছিলেন, কারণ তিনি মনে করতেন এটা স্রেফ শব্দ ব্যবহারের ব্যাপার নয়, এই দুই বিপ্লবের সঙ্গে মৌলিক ধারণাগত পার্থক্য বিদ্যমান। চীনের বিপ্লবের পর চেয়ারম্যান মাও এই ধারণাটির প্রবর্তন করেন। ইউরোপের “গণতান্ত্রিক বিপ্লব” আর আমাদের দেশের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যগত ভাবে আলাদা। এমনকি বলশেভিকদের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বৈশিষ্ট্যটাও ইউরোপের মতো নয়। লেনিন তাঁর ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভালো কোন শব্দ ব্যবহার করেন নি, বা ব্যবহার করতে সক্ষম হন নি। কিন্তু মাও সে তুং পেরেছিলেন এবং তাঁকে অবশ্যই সেই কৃতিত্ব দেয়া দরকার। এক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত। কাসেদ আলী বিশ্বাস করতেন “জনগণতন্ত্র” গণতন্ত্রের আরো উন্নত ও ঐতিহাসিক ভাবে বিকশিত ধারণা। আমি গণতন্ত্রের ধারণার যে উন্নতি ও বিকাশ ঘটেছে সেটা সর্বান্তকরণে স্বীকার করি, তবে সেই ধারণার বিকাশকে নিশ্চিত ভাবে সমাজে ও রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে নতুন শব্দ আমদানি না করে পুরোনো ধারণাটাকেই পর্যালোচনা ও সমালোচনার মাধ্যমে বিকশিত করারটাকে সঠিক মার্কসীয় পথ বলে মনে করি। নইলে একটি ধারণার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যায় এবং শব্দের উল্লম্ফনগত বিস্মৃতি একটি ধারণার ঐতিহাসিক বিকাশের যোগসূত্র হারিয়ে ফেলে। কার্ল মার্কস যখন মূল্য, পুঁজি, মুনাফা, খাজনা প্রভৃতি শব্দের অন্তর্গত ধারণা ও ধারণাগত ইতিহাস পর্যালোচনা করেছিলেন তিনি নতুন শব্দ আমদানি করেন নি। একই শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু কেউই বলবে না যে তিনি মূল্য বা দাম বলতে যা বুঝতেন আদম স্মিথ বা ডেভিড রিকার্ডো সেই একই কথা বুঝতেন। সমাজের রূপান্তর বা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ধারণাগুলোরও রূপান্তর আর বিকাশ ঘটেছে কিন্তু শব্দগুলো সেই আগের মতোই আছে। “গণতন্ত্র” আর “জনগণতন্ত্র” আলাদা দুটো শব্দ হবার কারণে অনেকেই উভয়ের যোগসূত্রই ধরতে পারেন না। শাসক শ্রেণীর অপপ্রচারের ফলে অনেকে এই বিভ্রান্তিতেও ভোগে যে গণতন্ত্র একটাই, আর সেটা হচ্ছে শাসক শ্রেণীর গণতন্ত্র, জনগণতন্ত্র আসলে গণতন্ত্রই নয় বা যারা এই শব্দটি ব্যবহার করে তারা গণতন্ত্রের বিরোধী। সে যাই হোক কাসেদ আলী আমার অবস্থানকে সঠিক ভাবতেন না। আমাকে তিরস্কারের পেছনে একটি কথাই তিনি বেশী করে বলতেন সেটা হোল মাও প্রবর্তিত এই শব্দটিকে যোগ্য সম্মান না দিয়ে মাও সে তুং-কে অবমূল্যায়নের ধারাটাকেই আমি শক্তিশালী করছি। এই বিচার আমি এখন পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি। কারণ এই বিষয়ে আরো বিতর্ক হওয়া খুবই দরকার।
৪। উৎপাদন প্রণালী ও উৎপাদন সম্পর্ক
এটা সত্যি কথা কাসেদ আলী অসাধারণ কোন তাত্ত্বিক ছিলেন না। কিন্তু মার্কসীয় চিন্তার বেশ কিছু ক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের মধ্যে সামনের সারিতে স্থাপন করেছে। আমি নিশ্চিত যে আগামী দিনের তরুণ বিপ্লবীদের কাছে তিনি বাংলাদেশের একটা বন্ধ্যা রাজনৈতিক কালপর্বে এই স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই অমর হয়ে থাকবেন। উৎপাদন প্রণালী ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে যোগসূত্রের প্রশ্নে তাঁর একটা গভীর অন্তর্দৃষ্টি বোধহয় কারুরই চোখ এড়াবে না। কাসেদ আলী তাঁর সমাজ বিপ্লব সিরিজের ১৯ নম্বর পাতায় লিখেছেন :
“উৎপাদন প্রণালীর বিপ্লব একাধিক মানে কিন্তু সমাজ বিপ্লব নয়। সমাজ বিপ্লবের মূলসূত্র হোল উৎপাদন সম্পর্কের বিপ্লব উৎপাদন উপায়ের উপর সম্পত্তি মালিকানার বিপ্লব।”
উৎপাদন প্রণালী কথাটা ইংরেজীতে যাকে আমরা Mode of Production বলি তার অনুবাদ। কার্ল মার্কস যখন শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন তখন এটিকে কোন বিশেষ ধারণার অর্থবাচক হিসাবে সুনির্দিষ্ট সঙ্গতি মেনে ব্যবহার বা প্রয়োগ করেন নি। কিন্তু এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হিসাবে গড়ে ওঠে এবং ইতিহাস বিচারের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ শুরু হয় একটির পর আরেকটি উৎপাদন প্রণালীর ধারাবাহিকতা হিসাবে। একটি সমাজের একটি বিশেষ ঐতিহাসিক কালপর্বে একটি বিশেষ উৎপাদন প্রণালী প্রাধান্যে থাকে, সেই বিশেষ উৎপাদন প্রণালী দিয়েই সেই সমাজটিকে বুঝতে হবে। এই ভাবে উৎপাদন প্রণালী ইতিহাস বিচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হিসাবে জায়গা করে নেয় এবং উৎপাদন সম্পর্কের প্রশ্নটা আড়াল হয়ে যায়। কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সময় থেকেই এই ধারণাটি অর্থনীতিবাদী চিন্তার প্রাধান্যের কারণে সামনে চলে আসতে শুরু করে। স্টালিন এই উৎপাদন প্রণালী দিয়ে সমাজ ও ইতিহাসকে বিচার করার ধারাটা তাঁর Dialectical and Historical Materialism নামক গ্রন্থে বিধৃত করেন। ফলে এটা একটা অফিসিয়াল ধারণায় উন্নীত হয়। এই ধারণা ব্যবহারের পক্ষে কার্ল মার্কসের A Contribution to the Critique of Political Economy থেকে এর মুখবন্ধটিকে হাজির করা হয়।
কাসেদ আলী উৎপাদন প্রণালী দিয়ে ইতিহাস ও সমাজ বিচারের পদ্ধতিকে অমার্কসীয় মনে করতেন। তিনি মনে করতেন সমাজের বৈপ্লবিক স্তরগুলো অতিক্রম হয় উৎপাদন সম্পর্কের বিপ্লব দিয়ে, উৎপাদন প্রণালীর বিপ্লব দিয়ে নয়। এর কারণ হোল, একটি উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে নানান উৎপাদন প্রণালীর বিপ্লব হতে পারে। যেমন, পুঁজি গ্রন্থে কার্ল মার্কস পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে তিনরকম উৎপাদন প্রণালী চিহ্নিত করেছেন: [ক] সরল সহযোগিতামূলক বা একত্রীভূত পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন (Simple Co-operation) [খ] কারখানামূলক পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন (Manufactory), [গ] শিল্পভিত্তিক পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন (Industrial Capitalism)। এছাড়াও পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের অধীনে ক্রমাগত কৃৎকৌশলগত বিপ্লব ঘটে চলেছে যা মূলত উৎপাদন প্রণালীর বিপ্লব, উৎপাদন সম্পর্কের বিপ্লব নয়।
কার্ল মার্কসের মুখবন্ধটির ইংরেজী অনুবাদে কিভাবে Relations of Production এর জায়গায় Mode of Production ঢোকানো হয়েছে সেই ভুল সম্পর্কে কাসেদ আলী ছিলেন খুবই তিক্ত এবং সন্দিহান। তিনি দাবি করতেন মার্কসের মৌলিক ধারণাকে বিকৃত এবং বিপ্লবী আন্দোলনকে পথচ্যুত করার জন্য এটা ছিল একটা “আন্তর্জাতিক চক্রান্ত”। তাঁর কথাটা বুঝতে হলে আর মার্কসের একই মুখবন্ধের দুটো ইংরেজী অনুবাদ পাশাপাশি তুলে দিচ্ছি।
“The bourgeois mode of production is the last antagonistic form of the social process of production” (এটা হোল মস্কোর Progress Publishers থেকে প্রকাশিত মার্কসের আলোচ্য মুখবন্ধটির অনুবাদ। ১৯৭৭ সালের ছাপা, পৃষ্ঠা ২১।)
“The bourgeois relations of production are the last antagonistic form of the social process of production” (এটা হোল গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের Foreign Language Press থেকে প্রকাশিত অনুবাদ। ১৯৭৬ সালের সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৪)
এটা খুবই স্পষ্ট যে দুটো অনুবাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার শেষ স্ববিরোধী রূপ অবশ্যই বুর্জোয়া উৎপাদন প্রণালী নয়, বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্ক। কাসেদ আলী ঠিকই বলতেন যে উৎপাদন সম্পর্কের জায়গায় উৎপাদন প্রণালীর ধারণাটা ঢুকিয়ে দেয়া স্রেফ একটা অনুবাদগত ভুল বা শব্দ চুরি নয়। এর ফলে মার্কসীয় ধারণার মারাত্মক বিকৃতি ঘটেছে। তিনি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করতেন কমিউনিজম ও মার্কসবাদকে পথচ্যুত করার এটা একটা আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। এই চক্রান্তের সর্দার তাঁর মতে হচ্ছে মস্কো।
উৎপাদন প্রণালী ও উৎপাদন সম্পর্কের পার্থক্য তাঁর কাছে পরিষ্কার ছিল বলেই কাসেদ আলী মনে করতেন সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যেও অনেকগুলো উৎপাদন প্রণালীর বিপ্লব ঘটেছে। সামন্তবাদের প্রাথমিক মধ্য ও শেষ পর্ব আছে। তিনি একে তিনটি পর্বে ভাগ করেছেন। এক আদিম বা ধ্রুপদী রূপ; দুই: ভূমিদাসোত্তর যুগ এবং তিন: আধা সামন্তীয় যুগ। প্রতিটি যুগেই সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্ক বহাল থাকলেও ওর মধ্যেই উৎপাদন প্রণালীর বদল ঘটেছে। উৎপাদন প্রণালী ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে না পারার কারণে বাংলাদেশের সমাজের চরিত্র নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মারাত্মক বিভ্রান্তি বিরাজ করছে বলে তিনি মনে করতেন।
এটা অবশ্যই সত্যি যে উৎপাদন সম্পর্কের জায়গায় উৎপাদন প্রণালীর এসে যাওয়ার ফলে মার্কসবাদের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিকগুলোর ওপর সুদুর প্রসারী প্রভাব পড়েছে। সেগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা দরকার। এখানে সেটা সম্ভব নয়। তবে আমরা কাসেদ আলীর কাছে এই বিষয়ে ঋণী যে তিনি ব্যাপারটি সকলের দৃষ্টিগোচর করেছেন।
শেষে বলা দরকার যে কাসেদ আলীর রচনাবলীর এই প্রাথমিক পাঠ তাঁর রচনাবলীকে পরিচিত করার তাগিদ থেকেই কেবল লিখা হয় নি, এটা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনও বটে। এই লিখাটির পেছনে আরো একটি গভীরতর তাগিদ কাজ করছে, সেটা হোল আমি মনে করি আমাদের অগ্রজ কমিউনিস্টদের চিন্তা ও রচনাবলীর সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা ও বিভ্রান্তি সত্ত্বেও তাকে আন্তরিকতার সঙ্গে পাঠ করার ঐতিহ্য তৈরী করা দরকার। যাঁরা অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং নিজেদের প্রগতিশীল মনে করেন তাঁরা যদি এদেশের প্রগতিশীল চিন্তার ইতিহাস ও ধারাবাহিকতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত হতে না পারেন তাহলে তাঁদের পক্ষে প্রগতিশীল রাজনীতিতে মৌলিক কোন অবদান রাখা সম্ভব বলে আমি মনে করি না। এই ঐতিহ্য সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হচ্ছে, এবং অগ্রজ কমিউনিস্টদের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক ও অসমাপ্ত তাত্ত্বিক কাজ অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে। বলাবাহুল্য সেগুলো খুবই মোটা দাগের কাজ। এই মোটা দাগের কাজগুলোও যদি আমরা শেষ করতে না পারি তাহলে সেটা হবে প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য খুবই লজ্জা ও পরিতাপের ব্যাপার।
চিন্তা, ১ম বছর ৪র্থ সংখ্যা, ১৫ অক্টোবর, ১৯৯১