এই সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিন


এক

সিলভেস্টার স্ট্যালোন নামে অতিশয় পেশিবান এক অভিনেতা আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। র‌্যাম্বো নামক এক যুদ্ধবাজ নায়কের ভূমিকায় ইনি অভিনয় করে থাকেন। খালি গায়ের মারমুখো মাস্তান। নখ থেকে চুল পর্যন্ত যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত। এই নায়ক হামেশাই অন্য দেশ আক্রমণ করে। মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করবার তাগিদ তার ট্রিগারে, “মুক্তি” আর “গণতন্ত্র” নামক মন্ত্র তার বারুদে সদাই ধ্বনিত। তার কাজ দুনিয়ার তাবৎ “খারাপ লোক”-গুলোকে গুলি করে মেরে ফেলা। কোন নীতি নেই, বাছ বিচার নেই। পৃথিবীর একদিকে আছে “গুড গাইস” অর্থাৎ ভাল লোক। ভাল লোকদের নেতার গায়ের রং, বলা বাহুল্য, সবসময়ই সাদা; আর, মুখে তাদের নীতি কথার তুবড়ি। র‌্যাম্বো সেই দিক থেকে দারুণ চরিত্র। দুনিয়ার ভালো লোকদের সর্দার মার্কিন তো অবশ্যই। কালোরা সাদাদের কমান্ড বা সর্দারি বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিচ্ছে, ওদের পক্ষে লড়ছে আর মরছে। খুবই অনুগত। অন্য দিকে আছে “ব্যাড গাইস”। এরা কমিউনিস্ট বা টেরোরিস্ট বা অনা যে কোন অর্থেই ব্যাড — খুবই খারাপ। সাদাদের কাজ হচ্ছে দুনিয়ার খারাপ লোকগুলোকে মেরে কেটে সাফ করে দিয়ে সাদাদের জন্য পৃথিবী নিরাপদ করা।

র‍্যাম্বো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুবই জনপ্রিয় একটি ছবি। এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এর বেশ কয়েকটি ভাষ্য অর্থাৎ সিরিজ আছে। মার্কিন সমাজ ও রাজনীতি বোঝার জন্য গাদা গাদা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার বই পাঠ না করে এই সমাজের জনপ্রিয় ছবিগুলো দেখা বোধহয় অধিক ফলদায়ক। মার্কিন সমাজে যে সকল চিন্তার প্রকট আধিপত্য তার প্রতিফলন পপুলার ছবিগুলোতে যতো সহজে ধরা পড়ে, অন্যত্র ততোটা নয়। কেন বিশেষ ধরণের চিন্তা একটি সমাজে প্রকট হয়ে ওঠে তার নিশ্চয়ই আর্থ-সামাজিক কারণ আছে। মার্কিন অর্থনীতি ও তার সঙ্গে যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনের যোগ, টেকনোলজিসর্বস্ব সমাজ এবং বেচাবিক্রি ও মুনাফা কামানোর চক্রের মধ্যেই শিক্ষা-সংবাদ-জ্ঞানবিজ্ঞানের আবর্তন— প্রভৃতি নানান দিক সেই কারণ ব্যাখ্যার পটভূমি হতে পারে। সেই ব্যাখ্যা আমাদের অনেক কিছুই বুঝতে সহায়তা করে। একটি সমাজের চিন্তাচেতনা ধ্যানধারণা বা সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশের ব্যাখ্যা একদিক থেকে তার মোকাবিলাও বটে, তবে র‌্যাম্বো যখন সিনেমার নায়ক না হয়ে রীতিমতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের রূপ ধরে সশরীরে হাজির হয় তখন সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতি একাকার হয়ে যায়। ইতিহাসের এই মুহূর্তগুলো ঘোর একটি বিশ্বসংকটের ইঙ্গিত, একথা সত্যি। কিন্তু একে শুধু সংকট জ্ঞান করলে আমরা খামাখা হতাশায় ভুগব। বরং এই সেই মুহূর্ত যখন সত্য ও মিথ্যার লড়াই সকল প্রকার বুদ্ধিবৃত্তিক কূটতর্ক, নীতিকথা, দর্শনের কচকচি আর সাংস্কৃতিক ফ্যাসাদ ও বিবাদের রহস্য পরিত্যাগ করে উলঙ্গ হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়ায়। তখন শয়তানকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলতে হয়, এই সেই শয়তান: “এই সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিন”।

মার্কিন জনগণমাত্রই এককাট্টা একরকমের মানুষ, এই কথা ভাবার কোনই কারণ নেই। তাদের মধ্যে গায়ের রংয়ের পার্থক্য বা ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির ফারাক তো আছেই। সর্বোপরী রয়েছে শ্রেণী আর নারী পুরুষ ভেদ। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতির সঙ্গে সকল মার্কিন জনগণ একমত নন, বলাই বাহুল্য। কিন্তু মার্কিনী সন্ত্রাস ও আগ্রাসনের নীতির পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন অস্বীকার করা যাবে না। এই সমর্থন এতোটাই নীতি বহির্ভূত ও নিম্ন রুচির যে বিল ক্লিনটনের যৌন ব্যভিচার সুদান ও আফগানিস্তানে তার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানাবার ক্ষেত্রে কোন বাধা হয়ে ওঠে নি।

“শয়তান” শব্দটি যখন ব্যবহার করেছি তখন কেউ যেন মনে না করেন যে এটা আয়াতুল্লাহ খোমেনী বা ওসামা বিন লাদেনের পরিভাষা। ইসলামী ধর্মতত্ত্ব “শয়তান” বলতে যা বোঝে, ইসলামী সংস্কৃতির অন্তর্গত বহু জ্ঞানগত বা প্রজ্ঞাবান ব্যাখ্যা প্রায় সবসময়ই তার বিপরীত পথ অনুসরণ করেছে। সেই ব্যাখ্যার দার্শনিক ও জ্ঞানগত শক্তি আরো অনেক দৃঢ়। মোল্লা বা ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনুসারে শয়তান মানুষকে সবসময়ই খারাপ কাজে ফুসলায়, তাকে নীতি থেকে বিচ্যুত করে। ফেরেশতা হিশাবে তার সৃষ্টি কিন্তু সে আল্লার আদেশ অমান্যকারী। ধর্ম, বিধান, আইন সবই আল্লার কাছ থেকে নাজিল হয়ে এসেছে, মানুষের কাজ শুধু সেই ঐশ্বরিক বিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাওয়া। শয়তান হচ্ছে একটা বদ শক্তি, কারন আল্লার ধর্ম, বিধান বা আইন মোতাবেক মানুষকে সে চলতে দেয় না। এই বিবেচনাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি হিশাবে শয়তান। কিন্তু মোল্লাতন্ত্র বা ধর্মতত্ত্বের বাইরে ইসলামের শক্তিশালী দার্শনিক ধারা “শয়তান”-কে একটি গুরুত্বপুর্ণ প্রতীক ও ধারণা হিশাবে ব্যাখ্যা করে। “শয়তান” কে? জ্ঞানীর সোজা ও সরল উত্তর, যে মানুষকে সেজদা করে না। কিন্তু মানুষ কি? যে-সৃষ্টি নিজেই নিজের নীতি, ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, আইন, কানুন প্রণয়ণে সক্ষম, কারণ নিজের মধ্যেই এই সৃষ্টি স্রষ্টার “সিফাত” বা গুণাবলী ধারণ করে। এই অর্থেই আল্লা নিজেই মানুষের মধ্যে “কীর্তিকর্মা” হয়ে বিরাজ করেন। নিজের নূর দিয়েই আল্লা মানুষকে তৈরি করেছেন, ইত্যাদি। আযাযীল শয়তান হওয়ার আগেও ফেরেশতা ছিল, এখনও সে ফেরেশতা, কিন্তু তার কর্মফলই তাকে শয়তানে রূপান্তরিত করেছে। সেই কর্ম হচ্ছে সে মানুষকে সেজদা করে নি, এখনও করে না, এবং কখনই করবে না। সে আল্লাহকে উপাসনা করতে রাজী, কিন্তু মানুষকে নয়। এই সংজ্ঞানুসারে একদিকে বিল ক্লিনটন যেমন শয়তান, তেমনি প্রতিটি ধর্মতত্বের মোল্লা, পুরোহিত বা যাজক যারা আল্লাহ, ভগবান বা গড মানতে রাজী, কিন্তু মানুষের সার্বভৌম সৃষ্টিশীলতা মেনে নিতে রাজী নয়— তারা সকলেই শয়তান। ইসলামে শরিয়তের সঙ্গে মারফতের ঝগড়াটাও ঠিক এই গোড়ার জায়গায়। শয়তান আর মানুষের দ্বন্দ্ব।

“এই সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিন”-কথাটা হয়তো অবাস্তব। কী করে সেটা সম্ভব। কার কাছে ধরিয়ে দেব। তবুও শয়তানকে যদি একবার চেনা যায় তবে মোকাবিলার পথ ও কৌশলও একসময় বেরিয়ে আসতে বাধ্য। এই ভরসায় পাক্ষিক চিন্তার এই প্রচ্ছদে একালের শয়তানের স্বরূপ এঁকে দেওয়া আমরা কতব্য জ্ঞান করেছি। সুদান ও আফগানিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সম্পর্কে এই সংখ্যায় রয়েছে নাতাশা আহমাদের একটি নিবন্ধ এবং যে ইসলামী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র লড়ছে তারা যে পাশ্চাত্য শক্তির হাতেই তৈরি হয়েছে সেই বিষয়ে জিয়াউল হক মুক্তার একটি রচনা।

দুই

বিল ক্লিনটন ওসামা বিন লাদেন ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের খুন করার জন্য সুদানে ও আফগানিস্তানে টমাহক ক্রুজ মিসাইল হামলার পরে বক্তৃতায় বলেছেন, “এই হামলা ইসলামের বিরুদ্ধে নয়া। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বিপর্যয় এবং স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর ইসলাম পাশ্চাত্যের প্রধান দুষমণ, এটা এখন আর কানাঘুষো নয়— রীতিমতো তত্ত্বে ব্যক্ত করেছেন স্যামুয়েল হান্টিংটন। তার তত্ত্ব হচ্ছে “সভাতার দ্বন্দ্ব” (Clash of Civilization)। এই তত্ত্বই এখন রূপ নিয়েছে ইসলাম প্রভাবান্বিত দেশ বা মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোর বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের ক্রমাগত হামলা। ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের সংঘর্ষ এখন সভ্যতার প্রধান দ্বন্দ্ব। এই তত্ত্ব কতোটা আজগুবি, আর কতোটা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে সাফাই বলা মুশকিল। মার্কিনী নীতির তো বটেই ইসলাম মোকাবিলা এখন পাশ্চাত্যের প্রধান প্রধান শক্তিধর দেশের কেন্দ্রীয় বিষয়। সুদান ও আফগানিস্তানে ক্লিনটনের এই র‌্যাম্বোগিরি এই নাতিরই প্রত্যক্ষ প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন।

ইসলাম মানে সুন্নী ওসামা বিন লাদেনের ইসলাম যেমন শুধু নয়, তেমনি শুধু শিয়া আমাতুল্লাহ খোমেনীর ইসলামও নয়। একই ভাবে সাদ্দাম হোসেনের ইসলামও ইসলামের শেষ কথা হতে পার না। যে কোন ধর্মের মতোই ইসলামেরও হাজার রূপ, হাজার ফেরকা, হাজার মত ও হাজার পথ। তবে এইবার সুদানে ও আফগানিস্তানে মার্কিন মিসাইল হামলা যতো গভীর ভাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগণকে অপমানিত ও আহত করেছে পাশ্চাত্যের আর কোন আঘাত এর আগে এতোটা গভীর ভাবে আহত করে নি। ইসলাম মাত্রই “মৌলবাদ”, যেন আর কোন ধর্মের মধ্যে মৌলবাদী অন্ধত্ব নেই। ইসলাম মানেই বর্বরতা ও পশ্চাতপদতার নামান্তর। ইসলাম মানেই গোঁড়ামি, মুসলমান মানেই “সন্ত্রাসী”- এগুলো তো পুরনো কেচ্ছা। কিন্তু টমাহক মিসাইল নিয়ে বিল ক্লিনটন যেভাবে সুদানে ও আফগানিস্তানে ঝাপিয়ে পড়লেন তার আগে আন্তর্জাতিক আইন বা রীতিনীতির প্রতি আদৌ প্রক্ষেপ না করার তাচ্ছিল্যটা অবিশ্বাস্য। ইসলামকে একটি বর্বর ধর্ম এবং যেকোন “ইসলামী” সংঘ মাত্রই সন্ত্রাসী এই সরল ধারণা পাশ্চাত্যে এতটাই বদ্ধমূল যেন ওসামা বিন লাদেন ও তার সহযোগিদের “সন্ত্রাসী” আখড়া ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আপনাতেই বৈধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ দাবি করেছে মার্কিন সংবিধান এবং সম্প্রতি (১৯৯৬) গৃহীত সন্ত্রাস দমন ও কার্যকর মৃত্যুদণ্ড দান আইন (Anti-terrorism and Effective Death Penalty Act) অনুসারে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। এই আইনের বক্তব্য এবং ভাষা এইরকম:

“অন্য দেশে সন্ত্রাস প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও নিরাপদ আশ্রয়সহ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীরা যে সকল আন্তর্জাতিক অবকাঠামো ব্যবহার করে সেগুলো ছত্রখান করা, গুঁড়িয়ে ফেলা ও ধ্বংসের জন্য প্রেসিডেন্ট (অর্থাৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট) গোপন অন্তর্ঘাতী অভিযান ও সামরিক শক্তি প্রয়োগসহ যে কোন উপায় ব্যবহার করবেন”।

“যে কোন উপায়” কথাটি লক্ষ্যণীয়। এই আইন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রয়োগের আইন নয়, তাহলেতো বহু আগেই যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হওয়ার কথা। বরং একপাক্ষিক ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্য দেশের বিরুদ্ধে প্রয়োগের একচ্ছত্র ক্ষমতা গ্রহণ। এই আইনে অন্য কোন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বা আন্তর্জাতিক আইন বা রীতিনীতির প্রতি কোন তোয়াক্কা নেই। এটা হচ্ছে এমন এক ক্ষমতাদর্পী দানবের বিকট মুখব্যাদান যে-দুনিয়ার অন্য কোন মানুষ, জনগোষ্ঠি, দেশ বা রাষ্ট্রের সম্মতি ও সমর্থনে গড়ে তোলা নীতি, আইন বা বিধান মানা দূরে থাকুক, বরং সকলের বিরুদ্ধে নিজের হিংস্র দাপট প্রতিষ্ঠার জন্যেই তৎপর। এই আইনটি নিজেই খোদ একটি সন্ত্রাসী বিধান। সন্ত্রাসী নিজের সার্বভৌম ও একচ্ছত্র ক্ষমতা তারই ঘোষিত “আইন” দিয়ে বিশ্বে জারী করছে। যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ার অধিপতি নয়, তার আইন প্রণয়নী সভা বা সিনেট বিশ্বের সকল মানুষের জন্য বিধান তৈরির সভা নয়। অতএব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন কোন আইন পাশ করতে পারে না যে-আইন তাকে তার দেশের বাইরে অন্য কোন দেশের ওপর প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব আর দুনিয়ার একাধিপত্য এক কথা নয়। অতএব এই আইন শুধু সন্ত্রাসী আইনই মাত্র নয়। এই আইনের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে দুনিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি বলেও ঘোষণা করছে। এই আইনের কোনই আন্তর্জাতিক ভিত্তি নেই। প্রচ্ছদে “এই সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিন” কথাটি এই অর্থেও ব্যবহার হচ্ছে যে সন্ত্রাসী যুক্তরাষ্ট্রের এই সাংবিধানিক ও আইনী চেহারাটাও র‍্যাম্বোরই পেশীসর্বস্ব শরীর ছাড়া আর কিছুই নয়। পাক্ষিক চিন্তা চাইছে সেই দিকটা আমাদের দৃষ্টিতে ও বুদ্ধিতে যেন অবিলম্বে ধরা পড়ে। জাতিসংঘের মার্কিন প্রতিনিধি বিল রিচার্ডসন দাবি করেছেন, জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী আত্মরক্ষার জন্য তাঁরা এই আক্রমণ করেছেন। কিন্তু এটা আত্মরক্ষামূলক আক্রমণ নয়, বরং প্রতিশোধমূলক হামলা। অথচ যে কর্মকাণ্ডের জন্য যার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে সেই ওসামা বিন লাদেন এই কাজে আদৌ জড়িত কিনা তার কোনই প্রমাণ হাজির করা হয় নি। শুধু একতরফা অভিযোগই করা হয়েছে। ওসামা বিন লাদেন পরিষ্কার ভাষায় মার্কিন দূতাবাসের ওপর সন্ত্রাসী হামলার সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তালেবানরা বলেছে যদি যুক্তরাষ্ট্র এমন কোন প্রমাণ হাজির করতে পারে তাহলে আমরাই তার বিচার করবো। দ্বিতীয়ত যদি আত্মরক্ষামূলক আক্রমণই হয়ে থাকে তাহলে প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের বিধান অনুযায়ী সমাধানের অন্য সকল চেষ্টা আগে নিতে হবে। অন্য ভাবে সংকটের মীমাংসা ব্যর্থ হলেই কেবল বল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আত্মরক্ষার অধিকার অর্জিত হয়। নইলে নয়।

এই আইন এবং তার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বই শুধু লংঘন করে নি, রাষ্ট্র সংক্রান্ত ধারণা এবং তার কার্যকারিতার শেষ আচ্ছাদনটুকুও টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। যুদ্ধ মানে দুটো দেশের মধ্যে যুদ্ধ, দুটো দেশ বা রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা করেছে একটি দল বা গ্রুপের বিরুদ্ধে। সুদান বা আফগানিস্তানের সরকার বা তাদের জনগণকে জানানো হয় নি যে তাদের দেশের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হচ্ছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক বা একটি দেশের জনগণের সঙ্গে অন্য দেশের নাগরিকদের সম্পর্কের কোন মর্যাদা নেই, ভিত্তি নেই, অর্থ নেই। যদি সুদানে নার্ভ গ্যাস তৈরি হয়েই থাকে, কিম্বা ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে বসে মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলার পরিকল্পনা এঁটেই থাকেন তাহলে সেই দুটো দেশের সরকার ও জনগণের নিশ্চয়ই এই বিষয়ে দায় দায়িত্ব রয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকার নামক একটা ব্যাপার তো এখানে আছেই, তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বা পাশ কাটিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওসামা বিন লাদেন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই দুটো দেশ বা তাদের সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক মীমাংসার উদ্দ্যোগ ব্যর্থ হলেই শুধু লাদেনের আখড়া নয়, দুটো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যোষণারও অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তায়। কিন্তু এই দুটো দেশকে কিছুই জানানো হয় নি, কিছুই বলা হয় নি। যেন তাদের কোন অস্তিত্বই নেই। পৃথিবী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে তাদের ভৌগলিক সীমানা আর অন্যদিকে বাকি দুনিয়া। এখন গায়ের জোরে ক্ষেপণাস্ত্রসহ যে কোন অস্ত্রের পাল্লা যতোদূর যায় ততোদূরের প্রতিটি লক্ষ্যবস্তুই এখন মার্কিন হামলার টার্গেট। এই এক নতুন ধরণের হানাদারি, এই কালের র‍্যাম্বোগিরি। এই এক বিকট আর বিদঘুটে সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাসী বদলে দিচ্ছে যুদ্ধের নিয়ম, রাষ্ট্রের সংজ্ঞা সার্বভৌমত্বের সীমানা। মানুষের সামষ্টিক চিন্তা-ভাবনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, নিয়ম-কানুন, বিধি-বিধানের সম্মুখে বিশাল দ্যৈত্যের মতো মার্কিন লাল নীল ভয়াবহ পতাকা। হাতে গোপন গর্ত থেকে উঠে এসেছে এক বিদঘুটে জন্তু। এই সন্ত্রাসীকে এখনই আমাদের বিচার বিবেচনা বিবেকের জগতে ধরে ফেলতে হবে।

তিন


 

সন্ত্রাসের আরেক রূপ: ইরাকের বিরুদ্ধে আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞার ফলাফল

নিষেধাজ্ঞা, জাতিসংঘের একটি বিশেষ বিধান, যদিও বিভিন্ন দেশের সরকার একে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, যেন অস্ত্রবিহীন যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট উডরো উইলসন বলেছিলেন, অবরোধ খুবই শান্তিপূর্ণ অথচ প্রাণঘাতী সমাধান। একটি বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার। সেটা হচ্ছে: “নিষেধাজ্ঞা হত্যা করে”। ইন্টান্যাশনাল ফেডারেশান অব রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট, মে, ১৯৯৮

‘অবরোধের ফলে ৫, ৬৭, ০০০ শিশু (পাঁচ বছরের কম বয়স) মারা গেছে’ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ১৯৯৫

‘প্রতিমাসে ৪, ৫০০-এর বেশী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু ক্ষুধা এবং রোগে মারা যাচ্ছে’। ইউনিসেফ, অক্টোবর ১৯, ১৯৯৬

‘নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের মৃত্যুর হার ৬ গুণ বেড়ে গেছে এবং দেশের অধিকাংশ জনগণ ক্ষুধা মেটাবার মতো যথেষ্ট খেতে পারছেন না।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, মার্চ, ১৯৯

‘অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরাকে প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫০ জন মানুষ মারা যায়’ ইউনিসেফ, এপ্রিল, ১৯৯৮


 

মার্কিন গণমাধ্যমগুলো ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয়টি নিয়ে কিভাবে যে ভাষায় লেখালিখি করছে তা লক্ষ্যণীয়। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল অগাস্ট ২৭ তারিখে এডওয়ার্ড জি শার্লির একটি প্রবন্ধ ছেপেছে। শিরোনাম:

Etiquette of Killing bin Laden। অর্থাৎ বিন লাদেনকে খুন করবার শিষ্টাচার। এর নীচে লেখা হয়েছে, “মিস্টার বিন লাদেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, যদি তাকে আগে খুন না করা হয় তাহলে লাদেন অনেক মার্কিন মেরে ফেলবে”। নিবন্ধটি শুরু হয়েছে এই ভাবে:

“আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের সংগঠনের ওপর হামলাকে ক্লিনটন প্রশাসন সৌদী জঙ্গী ইসলামী ব্যক্তিটিকে খুন করার চেষ্টা হিশাবে অভিহিত করতে নারাজ। এই ক্ষেত্রে তাঁরা তাঁদের মেধার ঘাটতি মেনে নিচ্ছেন। তবে এটা খুবই পরিষ্কার যে ওসামা বিন লাদেনকে খুন করাটাই এই হামলার একটি লক্ষ ছিল, যদিও দূরবীণ লাগিয়ে তাক করে খুন করবার বন্দুকের জায়গায় এই ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে ক্রুজ মিসাইল।”

১৯৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফোর্ড একটি নির্বাহী নির্দেশ জারী করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে ছিল কুখ্যাত ও সিদ্ধহস্ত। এই নির্দেশনামায় অবশ্য “রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড” নিষেধ করার কথা আছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টরা যখন জনসমক্ষে কথাবার্তা বলতেন তখন তাঁরা দাবি করতেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের লক্ষ্যবস্তু সন্ত্রাসীদের অবকাঠামো, সন্ত্রাসী নেতারা নয়। কিন্তু প্রেসিডেন্টরা কাউকে অপছন্দ হলে খুন করার জন্যে উৎসাহ দিতে কার্পন্য করতেন না। প্রেসিডেন্ট রিগান এই নির্বাহী আদেশের ওপর কখনোই তেমন আস্থা রাখেন নি, যদিও তিনি ১৯৮২ সালে একই আদেশ পুনরায় স্বাক্ষর করেছিলেন। তিনি যখন লিবিয়ার বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছেন তখন আদেশটি ঠিকই কার্যকর ছিল। অথচ মার্কিন জঙ্গী বিমানগুলো মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে গুলি করে হত্যা করার জন্যে ১৯৮৬ সালে রাত্রিকালীন অভিযানে ত্রিপলীর আকাশে হন্যে হয়ে উড়ে বেড়িয়েছে।

প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সম্প্রতি স্বীকার করেছেন যে তার প্রশাসন ইরাকে সাদ্দামের ওপর হতাশ ও বিক্ষুদ্ধ সৈন্যদের দিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল। এই প্রচেষ্টা ক্লিন্টনের আমলেও চলে। ক্লিন্টন ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে সিআইএ-কে ইরাকে সাদ্দাম বিরোধী সেনা বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে সাদ্দামকে হত্যার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায় যিনি এই তথ্যগুলো দিচ্ছেন তিনি মধ্য প্রাচ্যে সিআইএ-র একজন গোপন অপারেশনে নিযুক্ত টার্গেট অফিসার। এডওয়ার্ড জি শালি তাঁর ছদ্মনাম। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল দাবি করেছে তার আসল নাম রুয়েল মার্ক গেরেখট (Reuel Marc Gerecht)। বলাবাহুল্য, এটাও হয়তো একটি ছদ্মনাম।

যেটা ভয়াবহ সেটা হোল অন্যদেশের প্রেসিডেন্ট বা রাজনৈতিক নেতাকে “সন্ত্রাসী” আখ্যা দিয়ে মার্কিন গণমাধ্যমে সরাসরি তাকে মেরে ফেলা বা খুন করার প্রস্তাব জানিয়ে সিরিয়াস প্রবন্ধ হামেশাই লেখা হয়। এই নিবন্ধটিরও উদ্দেশ্যও তাই। এই খুনের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য সিআইএ এজেন্টদের দিয়ে নিবন্ধ লেখা হয়। এই প্রবন্ধের প্রধান যুক্তি হচ্ছে ১৯৭৬ সালের নির্বাহী আদেশ মেনে চললে মার্কিনীদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে। অথাৎ বিন লাদেনকেই হত্যা করতে হবে। তার সন্ত্রাসী কাঠামো বা অবকাঠামো ভাঙ্গার টালবাহানা করে লাভ নেই। একজন লাদেনকে মেরে ফেললে আরেকজন জঙ্গী ইসলামী নেতার হয়তো জন্ম হবে, কিন্তু প্রবন্ধটি দাবি করছে তবুও এতে সুবিধা, কারণ আর যাই হোক “লাদেনর জুতো তো তার পায়ে আর আর লাগবে না”। অর্থাৎ সে অন্তত লাদেন হবে না, যে ইতিমধ্যেই ইসলামী জগতে বীরের মর্যাদা লাভের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। অতএব টালবাহানা না করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও তাঁর প্রশাসনের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, সিআইএ এবং সেনাবাহিনী বিন লাদেনকে হত্যা করতে হলে কি করতে হবে সে ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করতে দেয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের পক্ষে বলতে গিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, “অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শত্রুভাবাপন্ন বিদেশের রাষ্ট্রনেতাদের খুন করে সাফ করাই একমাত্র লক্ষ্য নয়, কিন্তু যারা মার্কিনীদের হত্যা করছে সেই ক্ষেত্রে সন্ত্রাস দমনের অর্থ হচ্ছে সন্ত্রাসী নেতাদের হত্যা করা, এটাই মার্কিনীদের সাধারণ মত। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এই নিবন্ধের উপসংহার হচ্ছে যেভাবেই হোক বিন লাদেনকেই মেরে ফেলতে হবে, তার কাঠামোকে সহজে ভাঙা যাক বা না যাক।

যে দেশের গণমাধ্যম খোলামেলা প্রতিপক্ষকে খুনের ফন্দি আঁটে, সেই দেশের নৈতিক অধঃপতন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সহজেই অনুমান করা যায়।

চিন্তা, বছর ৭, সংখ্যা ১৩, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।