ক্রুসেড, জেহাদ ও শ্রেণীসংগ্রাম


১. কয়েকটি পদ্ধতিগত প্রশ্ন

লড়াকু আহমদ ছফা আর কাছে নেই; কিন্তু তার নাম ধারণ করে বানানো ‘আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা’-র প্রথম আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ক্রুসেড, জেহাদ ও শ্রেণীসংগ্রাম’। আফগানিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও হিংসা-যুদ্ধ এবং আমাদের কর্তব্য বিষয়ে এই সভা। আরও বড়ো পরিসরে বললে দুনিয়া জুড়ে পুঁজির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সম্প্রদায়, জাতি, জনগোষ্ঠি, রাষ্ট্র কিম্বা নারী ও পুরুষের মধ্যে যে লড়াই চলছে তাকে শ্রেণীসংগ্রামের দিক থেকে বোঝার চেষ্টা করা। লড়াইয়ের বাস্তব রূপ যেমন আছে, তেমনি তার বাস্তব ভাষাও আছে, কেতাবি ভাষা নয়। স্থানকালপাত্র বা ইতিহাস ভেদে আবার তার ফারাকও কম নয়। সংগ্রামের ভাষা সবসময় কেতাবি কায়দায় ব্যক্ত হয় না। তাহলে শ্রেণীসংগ্রামের দিক থেকে বিশ্বপুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই অনুধাবন মানে স্থানকালপাত্র ও ইতিহাস ভেদে তার বিভিন্ন রূপ ও ভাষার মধ্যে ঐক্যের জায়গাটা ধরতে শেখা। কেন? পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুনিয়ার নিপীড়িত শ্রেণী, নারীপুরুষ, জনগোষ্ঠি, জাতি বা সাধারণ জনগণকে ক্রমাগত বিভক্ত, পরস্পর থেকে আলাদা এবং পরস্পরকে দুশমনে পরিণত করে। এই ক্রমাগত বিভক্তি ও পরস্পরের দুশমন বানানোর প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য শ্রেণীসংগ্রামের নানান ঐতিহাসিক রূপের মধ্যে ঐক্যের অনুসন্ধান এই সময়ে রাজনৈতিকভাবে অতিশয় জরুরি। এই কাজটা আমরা করতে চাই বাংলাদেশের বৈপ্লবিক রাজনীতিকে শক্তিশালী ও বিকশিত করবার দরকারে। বিশ্বপুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সর্দার হিশাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে ও অন্যত্র যে সাম্রাজ্যবাদী হামলা চলছে তার বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবার ঐতিহাসিক প্রয়োজনে।

শ্রেণীসংগ্রাম দিয়ে ইতিহাস বিচারের প্রস্তাব ও চর্চার কথা তো বহুকাল থেকেই আমরা জানি। মার্কসেরও আগের। পুরনো। এমনকি এর অনিবার্য ফলাফল কী হয় সেই সম্পর্কে তাঁর নিজের ভাষ্য ছাড়া ধারণাটা মার্কসের নিজেরও নয়, মার্কস সেটা নিজেই আমাদের বলে রেখেছেন। পুঁজিতান্ত্রিক (বিশ্ব) ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই সর্বস্ব হারায়, বেঁচে থাকার জন্য শুধু নিজের গতরের শক্তি বিক্রি করার সম্পর্কটুকু ছাড়া। শ্রেণীসংগ্রামের ফলাফল হয়ে ওঠে এই শ্রেণী ‘একনায়কতন্ত্র’ — তাঁর এই প্রস্তাবটি মৌলিক। কিন্তু এখানে সেই বিষয়ে আলোচনা করবার মওকা পাব না।

শ্রেণীসংগ্রাম অনেকের কাছে হয়তো সেকেলে। অতিশয় ব্যবহারে ব্যবহারে জীবনানন্দের প্রতীকী জবানে ‘শূকরের মাংস’ হয়ে গিয়েছে বোধ হয়। বাংলাদেশে যার যেমন খেয়াল তেমন খোশহাল ব্যবহারে এই রকম মুশকিল হয়েছে। ধারণাটি ও তার চর্চার বিরুদ্ধে নানান কিসিমের মতাদর্শিক লড়াই তো আছেই। ফলে ধারণাটির উপযোগিতা কাজে খাটিয়ে দেখানোর দায় আমাদের কাঁধে নতুন করে চেপে বসেছে। আগে শ্রেণীসংগ্রামীদের বুদ্ধিবৃত্তিক জিন্দেগি আরামের ছিল। শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই কী বলা হচ্ছে সকলেই যেন বুঝে যেতো। এতোই আয়নার মতো ফর্শা ছিল ধারণাটি। এখন সোভিয়েত ইউনিয়নও নেই, সেই চীনও নেই। লেনিনের মূর্তি টেনে ভেঙে নামানো হয়েছে। জার্মানির ট্রিয়ার শহরে গিয়ে কার্ল মার্কসের বাড়ির কথা শুধালে রাস্তায় অনেকে হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় ‘এ যাবতকালের ইতিহাস শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস’ এই আপ্তবাক্য হাঁকলে ঈমান আনবার লোকের অভাব হোত না। যে আয়নায় একসময় সহজেই মুখ দেখা গিয়েছিল সেই আয়নার পেছনের পারদ কবেই ক্ষয়ে গিয়েছে, কোন প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে না। অতএব কাজ বেড়েছে। এখনকার ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে শ্রেণীসংগ্রামের ধারণাকে সপ্রাণ করে তোলা এবং কাজে খাটিয়ে তার উপযোগিতা প্রদর্শন করে নানান সংশয়, প্রশ্ন ও কৈফিয়ত মেটাবার দায় এড়ানো সম্ভব নয়। এখন আমরা খুবই সুনির্দিষ্ট একটি বিষয় ধরে আলোচনা করব। সেপ্টেম্বর ১১ তারিখের ঘটনা এবং তার ছুতোয় আফগানিস্তানে ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক হামলা। আফগান জনগণের বিরুদ্ধে ইঙ্গ মার্কিন হামলার মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে নমুনা আমরা দেখছি, তার বিচার ও কর্তব্য নির্ধারণ নিয়ে কিছু কথা বলব। সেটা করব শ্রেণীসংগ্রামের জায়গায় দাঁড়িয়ে ‘জেহাদ’ ও ‘ক্রুসেড’ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন পেশ করবার তাগিদে।

আমরা কারা? যারা মানি যে, সমাজে আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে মানুষে-মানুষে ভেদ থাকে। সব মানুষ প্রকৃতিগতভাবে বা দেখতে একরকমও যদি ভাবি তবু তাদের সামাজিক রূপের মধ্যে ধনী গরিব, মনিব মজুর পার্থক্য ও বিরোধ থাকে। আমরা বলি শ্রেণীভেদ। তার মানে ‘মানুষ’ নামক কোন বিমূর্ত জন্তু নেই। আমরা চাই বা না চাই শ্রেণীভেদের কারণে সমাজে শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণীর সংগ্রাম চলে। চলছে। এখন বিশ্বপুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্ফীতি, পুঞ্জিভবন ও বিস্তৃতির কারণে বিশ্বব্যাপী শ্রেণীসংগ্রামেরও বিস্তৃতি ঘটেছে এবং তার চরিত্রও ক্রমে ক্রমে বৈশ্বিক হয়ে উঠেছে। এই প্রাথমিক চিন্তা-কাঠামোর জায়গায় দাঁড়িয়ে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা — যাকে মানুষের একমাত্র ও শেষ সভ্যতা বলে হামেশা বর্ণবাদী প্রচারণা চালানো হয়—- তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই চালানো ছাড়া দুনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বেঁচে থাকার উপায় নেই। মানবেতিহাস অনন্ত সম্ভাবনাময়। সেই অনন্ত সম্ভাবনার দরোজাও খোলা যাবে না। এই ন্যূনতম কথাগুলো যাঁরা মানেন এবং নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে সেইভাবেই শ্রেণীসংগ্রামের জায়গা থেকে গড়ে তোলেন, তাঁদেরকেই মোটা দাগে সকর্মক রাজনৈতিক-দার্শনিক অর্থে এখানে ‘আমরা’ বলে শনাক্ত করছি।

এই ‘আমরা’-র কোন ‘তোমরা’ নেই। কার্ল মার্কস একটা দুর্ধর্ষ কথা বলে গিয়েছিলেন। শ্রমিক শ্রেণীর জয় মানে শ্রেণী হিশাবে তার জয় নয়। কারণ, তার জয়ের মধ্য দিয়ে যেহেতু সকল শ্রেণীভেদের অবসান ঘটে, শ্রেণীভেদমূলক সম্পর্কাদি যেহেতু নির্মূল হয়ে যায় অর্থাৎ বিশ্বব্যবস্থা মনিব/মজুর বা পুঁজিপতি/শ্রমিক ইত্যাদি তৈরি করে সেই ব্যবস্থাটাই খোদ ভাগে, অতএব শ্রেণীসংগ্রামের লক্ষ্য কেবল মনিব বা পুঁজিপতি শ্রেণী নয়। সর্বহারা নিজেও নিজের শ্রেণীসত্তার বিরুদ্ধে লড়ে। কারণ লড়াইয়ের ফলাফল হিশাবে শ্রমিক বা সর্বহারা শ্রেণী তো নিজেরই বিলয় ঘটায়। লড়াইটা তাহলে শুধু ‘অপর’ শ্রেণীর বিরুদ্ধে শুধু সামন্ত, বুর্জোয়া বা পুঁজিপতি শ্রেণীর বিরুদ্ধে নয়। শ্রমিক শ্রেণীর ‘আমার’/‘তোমার’ ভেদ নেই। কারণ লড়াইটা আসলে তার নিজ শ্রেণীর বিলয় সাধনের তাগিদেই। পোস্টমর্ডানিজম/পোস্ট কলোনিয়ালিজম নামে যেসব কথাবার্তা কানে আসে, যে সবের ভালোমন্দ যাঁরা হজম করেন, তাঁদের জন্য শ্রেণী ও শ্রেণীসংগ্রাম সংক্রান্ত এই কথাগুলোকে পুরনো মনে হতে পারে বলে আপাতত নোক্তা দিয়ে রাখলাম।

কিন্তু শ্রেণীসংগ্রাম কংক্রিট রাজনৈতিক অর্থে বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে বাইরের সুনির্দিষ্ট শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই হিশাবে হাজির হয়। শ্রমিক শ্রেণীর সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক শ্রেণীশত্রু থাকে। আছে। শক্রমিত্র নির্ধারণের মধ্য দিয়েই শ্রেণীসংগ্রাম রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহণ করে। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় নিপীড়িত শ্রেণী তার শ্রেণী দুশমন ঠিক মতো শনাক্ত করতে পারছে কিনা তার মধ্য দিয়ে তার নিজের চরিত্রও প্রকাশিত হয়। লড়াইটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, কোন ব্যক্তি, জাতি, ধর্ম বা গায়ের চামড়ার পার্থক্য থাকা জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে নয়। পশ্চিমের বিরুদ্ধে প্রাচ্যের লড়াই নয়। ধনী দেশগুলোর বিরুদ্ধে তৃতীয় বিশ্বের সংগ্রাম নয়। ইহুদি খ্রিস্টানের বিরুদ্ধে মুসলমানের লড়াই তো নয়ই। কিন্তু শ্রেণীসংগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে এই ধরনের রূপ পরিগ্রহণ করে বলেই বাস্তবতা আমাদের ভাষার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। কী করে ভাষার ঐতিহাসিকতার অন্দর মহলে আমরা তাকাবো এই প্রবন্ধে সেই পদ্ধতিগত সমস্যাটাই মোকাবিলার চেষ্টা আছে।

আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভায় আমরা যখন ‘পশ্চিমা আগ্রাসন’-এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবার কথা বলছি তখন ‘পশ্চিমা’ কথাটিকে তার ঐতিহাসিক অভিব্যক্তি দ্বারা শনাক্ত করেই বুঝতে হবে, কোনো শাশ্বত বা অনন্তকালীন ধারণা হিশাবে নয়। ঠিক তেমনি ‘জেহাদ’ বা ‘ক্রুসেড’ কথাগুলোকেও তার কংক্রিট ঐতিহাসিক অভিব্যক্তি দিয়েই মালুম করা জরুরি। নিছকই মুসলমানদের আর খ্রিস্টানদের ধর্মযুদ্ধ হিশাবে বুঝলে বিসমিল্লাতেই আমরা গলদ করবো। সাবধান।

আরেকটি ছোট কিন্তু দরকারি কথা। ‘মানবেতিহাসের অনন্ত সম্ভাবনা’ কথাটিকেও হাওয়াই আওয়াজ ভাববার কারণ নেই। কৃৎকৌশলের বৈপ্লবিক ও নিত্যনতুন আবিষ্কার এবং মানুষের জ্ঞান, জীবনযাপন বা ভাবনার দিগন্তে পুঁজি নিত্যনতুন যে রূপান্তর ঘটাচ্ছে, তার মধ্যেও মানুষের অসাধারণ সম্ভাবনা আমরা টের পাই। ভবিষ্যতকে এখনই এখনকার বাস্তবতার মধ্যেই অন্বেষণ করতে হবে, কল্পজগতে নয়।

মানুষের আর্থ-সামাজিক ইতিহাস তার প্রাকৃতিক ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা বলে একটা ইঙ্গিত মার্কস দিয়েছিলেন। সেই প্রাকৃতিকতার সূত্র ধরে অর্থনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে তার শ্রেণীভেদ ও চেতনা নিয়ে কথাগুলো বলা হল। কিন্তু মানুষ তো কেবল অর্থনৈতিক সংজ্ঞা নয়। প্রকৃতিগতভাবে যেখানে দেখতে এক রকমও নয়। প্রকৃতিজগতের সঙ্গে তার বৈষয়িক বা বস্তুগত সম্পর্কও এক রকম নয়। নারী সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম, কিন্তু পুরুষের পেটে বোমা মারলেও সেই কর্মটি ঘটবে না। বনবাসী, আদিবাসী বা কৃষক জনগোষ্ঠির সম্পর্কও প্রকৃতির সঙ্গে শ্রমিকের মতো নয়। তখন? নারী/পুরুষ, বাঙালি/আদিবাসী, কিম্বা সাদা/কালো/বাদামি মানুষ, ইত্যাদির কথা উঠলে আমাদের সাবধানে ভাবতে হয়। তখন প্রথাগত অর্থে শ্রেণীপার্থক্যের কথাকে আমরা শুধুই অর্থনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে বিচার করলে ভুল করব। আরও নানান কিসিমের ভেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

শ্রমিক বা নিপীড়িত শ্রেণীর চিন্তাকাঠামোর মধ্যে সজ্ঞানে গড়ে ওঠা সংগ্রামগুলোর বাইরে নারী আন্দোলন ও পরিবেশ আন্দোলন এই কালে সুবিশাল অবদান রেখেছে। সেটা মনে রাখতে হবে। দুটো আন্দোলনই আমাদের কালে তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু যে তর্ক এখনো চলছে, সেটা হল কখন কোথায় কিভাবে প্রকৃতিগত পার্থক্য আর্থ-সামাজিক পার্থক্যের নিয়ন্তা হয়ে ওঠে, কিম্বা আর্থ-সামাজিক পার্থক্যই প্রকৃতিগত পার্থক্যের নিয়ন্তা হয়। বিয়েশাদি কাবিননামা করে নারী ও পুরুষের প্রকৃতিগত পার্থক্যের দ্বারা নির্ণীত ভূমিকা মেনে সন্তান ‘জন্ম’ দেওয়া আর টাকার বিনিময়ে জরায়ু ভাড়া নিয়ে কিম্বা টেস্ট টিউবে সন্তান ‘উৎপাদন’ কি এক জিনিস? দুটো ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক সম্পর্ক ও ক্ষমতা ক্রিয়াশীল। প্রশ্ন হল এই কালে পুঁজিতন্ত্রই কি পুরুষতন্ত্রের চরিত্র নির্ণয় করে, নাকি উল্টা? এই প্রশ্নগুলো বিপ্লবী রাজনীতির আভ্যন্তরীণ তর্ক এবং সেটা চালিয়ে যাওয়া অতিশয় জরুরি। আমরা কার্ল মার্কসের অনুসারী থেকে মেনে নেব যে, পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক আর সকল সম্পর্ক হয় ধ্বংস করে, কিম্বা তার আমূল রূপান্তর ঘটায়। তখন পুরুষতন্ত্র, আদিবাসী প্রশ্ন বা পরিবেশের সম্পর্ককে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের অভ্যন্তর থেকে দেখাই পদ্ধতিগত ভাবে সঠিক। অতএব পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব বা শ্রেণীসংগ্রামের গতিপ্রক্রিয়ার মধ্যে নারীপুরুষের সম্পর্ক ও ক্ষমতার প্রশ্নটিকে অনুধাবন করা দরকার।

কিন্তু নারী ও পুরুষের সংগ্রাম, আদিবাসীদের সংগ্রাম, এমনকি কৃষকদের সংগ্রামকেও পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব হিশাবে দেখা কিম্বা শ্রেণীসংগ্রাম মাত্রই পুরুষের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি বা শ্রমিকদের রাজনৈতিক দলকেই বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নেওয়া — কেচ্ছাগুলো বেশ ম্লান হয়ে গিয়েছে। বিপ্লবী রাজনীতিকে নারী, আদিবাসী, বনবাসী, কৃষি ও কৃষিসভ্যতার প্রশ্নকে তার প্রাপ্য তাৎপর্য দান করে যথাযথভাবে ভাববার তাকত অর্জন করতে হবে।

শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণীর লড়াইকে এই নিবন্ধে প্রধান গণ্য করে আলোচনা করলেও এই দিকগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকা দরকার। এই সকল প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কের ক্ষেত্রেও বিপ্লবী রাজনীতি যথাসম্ভব নিজেদের দরোজাজানালা খুলে রেখে নির্ভয়ে খোলা হাওয়া আসতে দেয়— এটাই নারী, আদিবাসী, পরিবেশ ও কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে বৈপ্লবিক মৈত্রীর প্রাথমিক পদক্ষেপ। এখানে সেই দিকগুলো নিয়েই আমরা এখন কথা বলব যেখানে অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রশ্নটাই মুখ্য। এই আলোচনা সভা ঘোষণার পর ‘শ্রেণীসংগ্রাম’ কথাটি দেখে অনেকেই যুক্তিসঙ্গতভাবেই এই ধরনের দরকারি পদ্ধতিগত প্রশ্ন তুলেছেন বলে নিবন্ধের শিরোনামে কেন অন্য সংগ্রামের কথা নেই, তার একটা কৈফিয়ত আপাতত দিয়ে রাখলাম। বলাবাহুল্য, আলোচনা যদি সেই সকল বিতর্কের দিকে যায় তাহলে আরও কথা বলা যাবে।

এবার পদ্ধতিগত প্রশ্নের আরেকটি পয়েন্ট। মানুষকে বাইরে থেকে একই রকম দেখতে মনে হলেও ভেতরে সে ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার পার্থক্যের কারণে নিজেকে একটি বিশেষ গোষ্ঠির মধ্যে কল্পনা করে, ভাবতে অভ্যস্ত হয় এবং তাকেই বাস্তব বলে জ্ঞান করে। শ্রেণীসংগ্রামের জায়গা থেকে আত্মপরিচয়ের এই কাল্পনিক নির্মাণ কিন্তু ইতিহাসের সক্রিয় উপাদান। একে বিচারের সঠিক পদ্ধতি কি? শ্রেণীসংগ্রাম দিয়ে গোষ্ঠি, জাতি, রাষ্ট্রচেতনা ও লিঙ্গ সম্পর্কের বিচারের সরলীকরণ সম্পর্কেও সাবধান থাকা জরুরি। কিন্তু এই পদ্ধতিগত প্রশ্নগুলো এখানে আমাদের প্রধান আলোচনার বিষয় নয়।

২. শ্রেণীসংগ্রামের ভাষা

বন্ধু ছফা আমাদের জন্য যে প্রেরণা রেখে গেছে তার সবচেয়ে বড়ো সম্পদ বুদ্ধিবৃত্তিক সাহস। নির্ভয়ে প্রশ্ন করা এবং প্রশ্ন তোলা। এটা পরিষ্কার যে আফগানিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চলছে। কিন্তু এতোটুকু বোঝাটাই কি বিপ্লবী রাজনীতির জন্য যথেষ্ট? যদি সত্যি সত্যি একে আমরা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বলে গণ্য করে থাকি এবং সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন হিশাবেই রুখে দাঁড়ানো সঠিক মনে করি, তাহলে এই যুদ্ধে আফগানিস্তানের জনগণের পক্ষে লড়বার জন্য কোন বিপ্লবীকে তো আমরা সরাসরি শামিল হতে দেখি না। সেটা তালেবানদের সমর্থন করা হয়ে যায় বলে? বাংলাদেশে বামপন্থীরা রাস্তায় নেমেছেন, সেই গৌরবটুকু তাঁদের প্রাপ্য। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ, প্রতিবাদ ও ঘৃণাকে সঠিক ভাবে কাজে লাগাবার জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির কাজ করবার শর্ত অনুসন্ধানের কোন প্রয়াস আমরা লক্ষ্য করি নি। আদৌ কি এটা করা উচিত? সেটাও তো প্রশ্ন। সাম্রাজ্যবাদকে ইসলামী মতাদর্শ দিয়ে যারা প্রতিরোধের কথা বলেন, তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তার, আলাপ-আলোচনার বা কাজের কি কোনোই সুযোগ নেই?

তালেবান বা যে কোন ইসলামপন্থী দল সম্পর্কে এতো ঘৃণা, শংকা, ভীতির কারণ কী? বাংলাদেশের একাত্তর সালের ইতিহাস একটা কারণ অবশ্যই এবং তাকে যথারীতি মনে রাখা দরকার। কিন্তু তালেবানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার ষোল আনা না হোক, সাড়ে আট আনা কি পশ্চিমা প্রপাগাণ্ডার ফল নয়? বিশেষত ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতি’, কিম্বা সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার কি একটা বড়ো কারণ নয়? যে ‘সভ্যতা’-কে আমরা সভ্যতা জ্ঞান করি আসলেই কি সেটা ‘সভ্য’? তাহলে উন্নত সমাজ সম্পর্কে আমাদের ধারণাগুলো আসলে কি? যুদ্ধ, হত্যা ও বিপুল সমরাস্ত্রের ভার ছাড়া যে সভ্যতা টিকে থাকতে পারে না, মুনাফা উৎপাদনই শুধু নয়, নিত্যদিন সারা দুনিয়ায় অনাহার, মহামারী এবং ন্যূনতম বেঁচে থাকার শর্তসমূহের ক্ষয় ঘটানোই যে সভ্যতার ধর্ম, তাকে আমরা প্রতিদিন মেনে নিচ্ছি কোন যুক্তিতে? তালেবান কী জিনিস আমরা কি তা সত্যি সত্যিই জানি? নাকি সাম্রাজ্যবাদী প্রচার মাধ্যমগুলোর প্রপাগাণ্ডাকেই সত্য বলে গ্রহণ করেছি? ধর্ম কী জিনিস, ইসলাম কী, কিম্বা অন্যান্য ধর্মের ইতিহাস ও মতাদর্শটাই বা কী? এই সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ থাকাই পছন্দ করি। এটাই আমাদের অধিকাংশের কাছে ‘প্রগতিশীলতা’। অন্যান্য আরও অনেক প্রশ্নের মধ্যে এই প্রশ্নগুলো আমাদের আছে। আমরা নির্ভয়ে প্রশ্নগুলো তুলতে চাই। ‘আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা’-য় আশা করি ক্রমে ক্রমে সেই সুযোগ আমরা করে নিতে পারবো। 

সাধারণভাবে এই আকুতি আমাদের অনেকের মধ্যে আছে যে ভুক্তভোগী খেটে খাওয়া শ্রেণী (শ্রমিক ও কৃষক) এবং অন্য নিপীড়িত শ্রেণীগুলোর লড়াইকে আমরা কী ভাবে শনাক্ত করবো, বুঝবো, ব্যাখ্যা করবো এবং তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে নিজেদের রাজনীতি ও সংস্কৃতি কিম্বা তত্ত্ব ও তৎপরতার সঙ্গতি বিধান করবো তার সার্বক্ষণিক অনুসন্ধান দরকার। কিন্তু একটা দিক বিস্ময়করভাবে আমাদের এন্টেনার বাইরে থাকে। নিপীড়িত শ্রেণী নিশ্চয়ই সদা সর্বদা কার্ল মার্কস, লেনিন বা মাও জে দংয়ের ভাষায় কথা বলে না। অর্থাৎ মার্কস লেনিনের অনুসারী বা কমিউনিস্টদের শ্রেণীসংগ্রামের ভাষায় সকলকেই কথা বলতে হবে এ কেমন আবদার? মার্কসের নামে সংগ্রাম হলেই কি সেটা শ্রেণীসংগ্রাম হয়, নাকি যারা মার্কসের নাম শোনে নি তারা যদি আল্লাহর পথে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে ও অকাতরে প্রাণ দেয়, গরিবের পক্ষে ধনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় সেটাও শ্রেণীসংগ্রামের একটা রূপ। আমাদের চোখে সেটা আদর্শ নয়। কারণ আমরা পরলোকের জন্য লড়ি না, লড়ি ইহলোকের জন্য। ঠিক আছে। কিন্তু লড়াইটা তো ইহলোকেই হচ্ছে, পরলোকে নয়। তাহলে সেটা শ্রেণীসংগ্রাম নয় অস্বীকার করি কী করে? খ্রিস্টীয় চার্চ ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় নিপীড়িত মানুষ ও জনগোষ্ঠির পাশে লড়েছে। ঐ লড়াই থেকে লিবারেশন থিওলজি নামে একটি মতাদর্শিক ধারাও গড়ে উঠেছে। সেটা কি শ্রেণীসংগ্রামের মধ্যে পড়ে না? নিশ্চয়ই পড়ে। তাহলে প্রশ্ন হল— শ্রেণীসংগ্রাম দেশকালপাত্র ভেদে যে ভাষা ও তৎপরতা তৈরি করে, তাকে বোঝার জন্য বিপ্লবী জ্ঞান, সংস্কৃতি ও তৎপরতার প্রস্তুতি কতোটুকু? নিপীড়িত শ্রেণী বা জনগোষ্ঠি কখনো ধর্ম, কখনো ভক্তি, কখনো হিংসা, কখনো অহিংসা, কখনো শান্তি কিম্বা কখনো নৈরাজ্য ইত্যাদি নানান ভাষায় কথা বলে। কখনো ইসলামের ভাষায়, কখনো হিন্দু, কখনো বৌদ্ধ, কখনও খ্রিস্টান ইত্যাদি নানান ধর্মের ভাষায় কথা বলে, ঠিক যেমন ধর্ম নিপীড়িত শ্রেণীর নিপীড়নকে বৈধতা দেবার ভাষাতেও কথা কয়। ধর্ম মাত্রই ‘নিপীড়নমূলক’ এই থিসিস যে মার্কস, লেনিন বা এঙ্গেলসের নয় সেটা ‘মোকাবিলা’ নামে একটি দীর্ঘ রচনায় আমি আলোচনা করেছি।

এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু আমাদের থাকা উচিত যে নিপীড়িত শ্রেণী বা জাতি মাত্রই নিশ্চয়ই কমিউনিস্ট নয়। নাকি শ্রেণীসংগ্রামের ভাষা একটাই? যে ভাষায় বিভিন্ন শ্রেণী নিজেদের প্রকাশ করে ও পরস্পরের সঙ্গে লড়ে, সেই ভাষা তাহলে আমরা বুঝব কেমন করে? নিপীড়িত শ্রেণী বা জনগোষ্ঠি যে ভাষায় স্থানকালপাত্র ভেদে কথা বলে, সেই ভাষা কি আমরা বুঝতে সক্ষম? কাজের দিক থেকে আরও গুরুতর প্রশ্ন হল— যদি নিপীড়িত শ্রেণীর ভাষা এবং নিজেদের আত্মপরিচয়বোধ বা শ্রেণীচেতনায় এতো ভেদ ও বৈচিত্র্য থাকে তাহলে বিপ্লবী রাজনীতির দিক থেকে তাদের রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করার নীতি ও কৌশল কী হবে? নাকি কখনই সেটা সম্ভব নয়। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ কথাটা কি তাহলে হাওয়াই আওয়াজ হয়ে থাকবে?

‘আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা’-র উদ্দেশ্য আগে থেকেই তৈয়ারি প্রশ্ন তোলা বা ছকবাঁধা উত্তর পেশ করা নয়। প্রথাগত চিন্তাকে প্রশ্নসংকুল করে তোলা প্রথম কাজ। এই প্রেরণায় এখানে আমারও চেষ্টা হবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যথাসাধ্য আন্তরিকতা এবং সাহসের সঙ্গে তোলা। অবিলম্বে উত্তর পেশ করা নয়। প্রশ্নটা কী সেটা একবার স্পষ্ট হলে উত্তর অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। জ্ঞানচর্চা ও বিপ্লবী রাজনীতির এটাই তো পথ।

৩. ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধর্মের ভূমিকা

একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ‘লা-মজহাবি’, ‘ফরায়েজি’ বা ‘ওয়াহাবি’-দের ইতিহাস আমরা ভুলে গিয়েছি, কিম্বা জানা আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি না। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার ইতিহাস কেচ্ছা আকারে আমাদের কানে আসে, কিন্তু ইতিহাস আকারে আসে না। আফটার অল এ-গুলো মুসলমানদের লড়াই এবং তা সাম্প্রদায়িক হতে বাধ্য। এটাই প্রথাগত ধারণা। ঠিক তেমনি ‘তালেবান’ নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের বিশেষত মধ্যবিত্ত শিক্ষিতদের — মধ্যে একটা ঘৃণার ভাব জাগে। তালেবান মাত্রই ঘৃণার যোগ্য। মধ্যযুগীয়, বর্বর ও হিংস্র। পশ্চিমা গণমাধ্যম ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছে, সেটাই আমরা সজ্ঞানে ও অজ্ঞানে গ্রহণ করি। জন্মসূত্রে আমরা মুসলমানের ঘরে জন্মেছি বলে অনেকে হয়তো লজ্জাও বোধ করেন। যাঁরা অতোটা হীনমন্যতায় ভোগেন না কিন্তু নিজেদের সভ্য ও আলোকিত বোধ করেন, তাঁরা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামের জঙ্গী রূপকে বিশেষত পশ্চিমা সভ্যতার বিরুদ্ধে ইসলামের লড়াকু রাজনৈতিক অভিব্যক্তিকে তাঁদের দারুণ ভয়। ইসলাম যেহেতু পশ্চিমা সভ্যতা বা সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার সমার্থক নয়, অতএব পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ইসলামের একটা সুশীল ব্যাখ্যাও তাঁরা খাড়া করেন।

সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা যতোই হুংকার করি না কেন, নিপীড়িত শ্রেণী নানান কায়দায় নানান রূপে সেই সংগ্রাম করে। কিন্তু তাকে তার ঐতিহাসিক মর্যাদা দিতে আমরা নারাজ। নিশ্চয়ই নিপীড়িত শ্রেণী বা জনগোষ্ঠি কার্ল মার্কস বা লেনিনকে গুরু গণ্য করতে বাধ্য নয়। তাহলে তাদের সংগ্রাম কি তাদের শ্রেণীর সংগ্রাম হবে না? নবী মুহম্মদ অনেকের লড়াকু আদর্শের নেতা হতেই পারেন। বিচারটা হবে তাদের সংগ্রামের উদ্দেশ্য বা চরিত্রটা কেমন? জার্মানির কৃষক যুদ্ধ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এঙ্গেলস দেখিয়েছেন, কী করে নিপীড়িত শ্রেণী ধর্মকে তাদের লড়াইয়ের মতাদর্শ আকারে গ্রহণ করে এবং অনেক ক্ষেত্রে সফলও হয়। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের গোড়াতেও ধর্মের ভূমিকা আছে। আল্লাহর চোখে সকলে সমান, অতএব মানুষের মধ্যে রাজা-প্রজা বা সামন্ত ও শাসিতের ভেদ নাই এই ধারণার উৎপত্তি প্রথমে ধর্মতত্ত্বে। চার্চের বিরুদ্ধে লুথারের লড়াই যার ফলে রাষ্ট্র থেকে চার্চ বাহ্যিক অর্থে আলাদা হয়ে গিয়েছে সেখানেও ধর্মই প্রেরণা। সেটা খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে আমরা মানতে রাজি, এমনকি ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলও আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য, কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে আমরা সেটা মানতে রাজি নই। কেন এই অবস্থা তারও নিশ্চয়ই একটা ব্যাখ্যা দরকার। কেন ইসলাম বা বা মুসলমানদের সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্ব এবং ‘আধুনিক’ মানুষ এমন একটা ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে যার ফলে স্যামুয়েল হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘর্ষ অনিবার্য বলেই অনেকের কাছে মনে হয়। আসলেই ইসলাম কি সভ্যতার শত্রু? কার সভ্যতা? আর সভ্যতা ব্যাপারটাই বা আসলে কি?

‘তালেবান’দের আমরা নিছকই মধ্যযুগীয়, বর্বর ও সভ্যতার দুশমন গণ্য করতে শিখেছি। আমরা যারা অতি প্রগতিশীল তারা জানি যে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত রাশিয়ার সামরিক বাহিনী উচ্ছেদের জন্য ওসামা বিন লাদেন ও তালেবান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর বিশদ ভূমিকা আমাদের জানা। এই জানার বরাতে আমরা বলি, যেহেতু আমরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অতএব তাদের সৃষ্ট তালেবানদেরও বিরোধী। মার্কিনীদের তৈয়ারি হয়েও ওসামা বিন লাদেন ও তালেবানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়ছে কেন? প্রাণ দিচ্ছে কেন অকাতরে? সেই প্রশ্ন কিন্তু তুলি না। উঠলেও সেটা বিস্ময়কর ভাবে চেপে যাই। এই ধরনের বহু যুক্তি ও কুযুক্তি, আবেগ ও ঘৃণা, নানাবিধ হীনমন্যতা এবং দিশাহারের মধ্যে আমরা আছি। তালেবানরা যখন বুদ্ধমূর্তি ভাঙল, তখন তাদের অসভ্য ও বর্বর বলে সারা পৃথিবীতে রব উঠল। তখনও আহমদ ছফা জীবিত। যখন আফগানিস্তানের শিশুরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে, তখন তালেবানরা মানবিক সহায়তা চেয়েছিল ‘সভ্য’ দুনিয়ার কাছে। ‘সভ্য’ দুনিয়া শিশুদের অনাহার, অপুষ্টি ও মৃত্যু রোধের জন্য এগিয়ে এলো না। কিন্তু বুদ্ধের মূর্তি রক্ষার জন্য কাড়ি কাড়ি ডলার নিয়ে হাজির হলো। তালেবানরা বলল — আমরা অন্তত কিছুটা অর্থ শিশুদের জন্য ব্যয় করি। ‘সভ্য’ দুনিয়া রাজি হল না। ওটা নাকি মৃত মূর্তির জন্যই ব্যয় হবে, জীবিত শিশুদের জন্য নয়। তালেবানরা তখন মূর্তি ভেঙে দিল। চতুর্দিকে মূর্তিবাদী সভ্যতার জয়জয়কার শুরু হল এবং তালেবানদের বিরুদ্ধে বর্ষিত হল ঘৃণা। কেউই কিন্তু ব্যাপারটা আর খতিয়ে দেখল না। ‘সভ্যতা’রই জয় হল। ‘অসভ্য’ ও ‘বর্বর’দের ওপর নির্বিচারে বোমা মারা এবং নারী ও শিশুদের ধ্বংস করাসহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতো অবিশ্বাস্য ও নির্মম ঘটনা আর ঘটে নি। তালেবানদের সন্ত্রাসী ও বর্বর প্রমাণ করে অভাবনীয় মানবিক সংকট সৃষ্টির যুক্তি ও বৈধতা তৈরি করা হল। এই ভাবেই। ধীরে ধীরে। অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে ইরাকি শিশুদের মৃত্যু এবং ইরাকি জনগণের অবর্ণনীয় দুর্দশা ‘সভ্যতা’র কলিজায় কোন দয়া সৃষ্টি করতে পারে নি। এখন আমাদের চোখের সামনেই আমরা আফগান জনগণের ওপর নারকীয় বোমাবর্ষণ লক্ষ্য করলাম। এই হচ্ছে বিশ্ব-সভ্যতা। যাকে রক্ষার জন্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। আফগানিস্তানের যুদ্ধের দিকে তাকালে আমরা বুঝব ক্রমশ যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ছে ও মেরুকরণও তীব্র হচ্ছে। জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ার ঠিকই বলেছেন, এই যুদ্ধ ক্রুসেডের মতো দীর্ঘস্থায়ী হবে।

বুদ্ধমূর্তি ভাঙার পক্ষে তালেবানদের যুক্তি সম্পর্কে আহমদ ছফা আমাকে প্রথমে অবহিত করেন এবং ‘সভ্যতা’ রক্ষার জন্য তালেবানদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে বাংলাদেশে যাঁরা বিবৃতি দিয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে তাঁর স্বভাবসুলভ হাসিতামাশা করেন। পরে এ সম্পর্কে দুজনেই আরও খোঁজখবর নেই এবং পশ্চিমা প্রপাগান্ডায় বিভ্রান্ত না হয়ে এই দেশের জনগণের জন্য সঠিক অবস্থান অনুসন্ধানের তাগিদ অনুভব করি। কিন্তু এই কাজটি হবার আগেই ছফা চলে গেলেন। এই সম্পর্কে ছফার সঙ্গে আমি ছাড়াও আরও অনেকেরই কথা হয়েছে নিশ্চয়ই।

৪. মূর্তি বনাম জীবন্ত শিশু

আহমদ ছফা ‘আধুনিক সভ্যতা’-র সমালোচক ছিলেন সত্যি, কিন্তু বিদ্যমান দিগন্ত বা মূল জ্ঞানকাণ্ডের প্রতি বড়ো ধরনের কোন সন্দেহ তাঁর ছিল না। আধুনিকতা বা এই যুগের অগ্রগামিতা তিনি মানতেন। ‘প্রগতি’র ধারণার মধ্যেই যে একটা মুশকিল আছে, এটা তিনি সম্ভবত টের পেতেন; কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে আলাপচারিতা ছাড়া বিষয়টি খোলাখুলি লিখিত ভাবে মোকাবিলা করেছেন বলে আমার চোখে পড়েনি। কোন সভ্যতা বা জীবনযাপন পদ্ধতি ‘আধুনিক’, ‘প্রগতিশীল’ বা ‘সভ্য’ আর কোন জীবনযাপন ‘মধ্যযুগীয়’, ‘পশ্চাতপদ’ বা ‘বর্বর’? কে, কীভাবে, কোন মানদণ্ড দিয়ে সেটা ঠিক করে? এই প্রশ্ন তাঁরও ছিল। তবুও তিনি ‘রেনেসাঁ’পন্থী ছিলেন। সংস্কার ও জাগরণে তাঁর আস্থা ছিল। বিপ্লবী রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ ছিল। কিন্তু সশস্ত্রতা বা রক্তপাত সহজে মেনে নিতে পারতেন না। বাংলাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠিকে ‘আলোকিত’ পথে নেবার একটা কর্তব্য রয়ে গিয়েছে, এটা মানতেন। তাদের ‘মধ্যযুগীয়’ ধ্যানধারণা ও পশ্চাতপদতা থেকে তাদের ‘যুগোপযোগী’ করে গড়ে তোলাটা তাঁর রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্তব্য এই জ্ঞান তাঁর ছিল। কিছু পার্থক্য সত্ত্বেও তালেবানদের প্রতিও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় একই রকমই ছিল। তাঁর বরাতে এর বেশি কিছু বলার এখন দরকার নেই।

কিন্তু বুদ্ধমূর্তি ভাঙার বিষয়টা তাঁকে ‘সভ্যতা’ সম্পর্কে দারুণ ভাবিয়েছে। তেমনি হয়তো আরও অনেককেও। মূর্তি বনাম জীবন্ত শিশু। এই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের দুনিয়ায় লড়াইটা কার সঙ্গে কার সেই প্রশ্নের উত্তর বিমূর্ত কায়দায় তুলতে ছফা নারাজ ছিলেন। ঝগড়াটা কমিউনিজমের পতনের পর ইসলামের সঙ্গে কেন? পশ্চিমা বিশ্ব ইহুদিবাদী ইসরাইলী রাষ্ট্রকে মানতে পারে কিন্তু ফিলিস্তিনী জনগণের জন্য স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নিতে পারে না কেন? সেটাও যদি মেনে নেওয়া যায় তবুই দ্বিতীয় ইন্তিফাদায় আমরা দেখলাম গুলতি দিয়ে যে ফিলিস্তিনী কিশোর ইসরাইলী ট্যাংকের বিরুদ্ধে লড়ছে সেটা হয়ে যাচ্ছে ‘সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ড। মুসলমান কিশোর মাত্রই ‘সন্ত্রাসী’ হয়ে পশ্চিমের বিরুদ্ধে জেহাদ করবার জন্য প্রশিক্ষিত হচেছ। মাদ্রাসা মানেই জেহাদি মুসলমান তৈরির কারখানা। অসভ্যতা, বর্বরতা ও হিংস্রতা শেখাবার জন্যই নাকি মাদ্রাসা। আর ‘আধুনিক পশ্চিমা শিক্ষা’য় শিক্ষিতরা ও পশ্চিমা সভ্যতায় বিশ্বাসীরা সুশীল। তাঁরা সন্ত্রাস করেন না। যুদ্ধ করেন না। কাউকে মারেন না। তাহলে দুনিয়ায় এই যে বোমাবাজি, বিপুল সমরাস্ত্র, মানুষ হত্যার অবিশ্বাস্য আয়োজন একমাত্র মাদ্রাসার ছাত্রদেরই জন্যই ঘটেছে। নয় কি? আধুনিক শিক্ষা বা বিজ্ঞান চর্চার জন্য নয়। মুসলমানরাই পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়েছে, হিরোশিমা নাগাসাকিতে বোমা বর্ষণ করেছে। একমাত্র সাদ্দাম হোসেনই বায়োলজিকাল যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করছে। মুসলমান ছাড়া এই বদকাজগুলো করবেটা কে?

জীবিত শিশু নাকি মৃত মূর্তি? আমাদের আলোচনার শুরুতেই এই প্রশ্নটা তুলতে চাইছি এই সভ্যতার চরিত্র সম্পর্কে তর্ক আরও খোলাসা করে তোলার জন্য। এই প্রসঙ্গে দি ইকনমিস্ট পত্রিকার (৩ নভেম্বর ২০০১) একটি ছবির প্রতি নজর দেবার জন্য সবাইকে অনুরোধ করব। একটি শিশু আরেকটি শিশুকে কাঁধে করে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে প্রাণে বাঁচবার জন্য ছুটে যাচ্ছে। এই ছবির পাশে ইকনমিস্টের ঘোষণা হল, ‘এতে আমাদের প্রাণ কাঁদে ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধটা খুবই দরকার’ (A heart-rending but necessary war)। কথাটা পরিষ্কার। বলা হচ্ছে, আমাদের স্বার্থে আমরা এই শিশুদের হত্যা করবই। আমাদের মন খারাপ লাগবে। কিন্তু ‘In this war, there will be no going back’। মরুক নারী, শিশু আর সাধারণ মানুষ — কিন্তু এই যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা যাবে না।

এই হল পশ্চিমা সভ্যতা। তথাকথিত ‘আধুনিক সভ্যতা’। ইকনমিস্ট যেমন তেমন পত্রিকা নয়। ব্যাপারটিকে নিছকই একটি পত্রিকার ব্যাপার গণ্য করলে আমরা মারাত্মক ভুল করব। এখানে খেয়াল করতে হবে এই কথাগুলো লিখিতভাবে বলা হচ্ছে। এই যুদ্ধ ও সহিংসতার পক্ষে এই নীতিবর্জিত ও নির্মম সিদ্ধান্ত। এই হচ্ছে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। ছবি ছাপিয়ে, এমনকি যে ধরনের শিশুদের মারা হবে তাদের ছবি ছেপে দিয়ে অনায়াসে ও অকাতরে শিশুদের জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা লেখা হয়েছে। হচ্ছে। বলছে দি ইকনমিস্ট, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অতি সামনের সারির মতাদর্শিক প্রতিনিধি। প্রধান-প্রধান পশ্চিমা পত্রিকায় এইভাবেই হত্যার কথা বলা হয়। শুধু সাদ্দাম হোসেন, মোল্লা ওমর বা ওসামা বিন লাদেন নয় শিশু ও নিরীহ মানুষও তাদের টার্গেট। নিরীহ অবোধ শিশু মরুক কিন্তু আমাদের স্বার্থই বহাল থাকবে। অতএব যুদ্ধ মানেই সকলকে আমাদের অধীনস্থ করা এই হচ্ছে এই ধরনের কভার স্টোরির মর্মার্থ।

ক্লিনটন প্রশাসনের সেক্রেটারি ম্যাডেলিন অব্রাইটকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল — ইরাকে মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে পাঁচ লক্ষ ইরাকি শিশু মারা গিয়েছে, এই সম্পর্কে তাঁর মতামত কি? তিনি বললেন, ‘এটা শক্ত সিদ্ধান্ত’। তবে সবদিক বিবেচনা করে we think the price is worth it। আমরা সবকিছু বিবেচনা করে যা করেছি তার জন্য পাঁচ লাখ ইরাকি শিশুর মৃত্যু এমন কিছু নয়। ঠিকই আছে। এটাই যখন বাস্তবতা তখন এর বিপরীতে ওসামা বিন লাদেন বা তালেবানদের কর্মকাণ্ডের নৈতিক মূল্যায়ন রীতিমতো হাস্যকর ও তুমুল তামাশা ছাড়া কিছুই না। কে সন্ত্রাসী আর কে সন্ত্রাসী নয়, সেটা বৃথাবাহাস। ‘সন্ত্রাস’ সম্পর্কে গুরুগম্ভীর তত্ত্ব ও নীতিকথাও বাজে, ফালতু তর্ক। প্রশ্নটা আসলে অতি সহজ ও সরল। জর্জ বুশ সেটা খুব সুন্দর ভাষায় পরিষ্কার করে দিয়েছেন। আমরা এবং তোমরা। হয় তোমরা আমাদের সঙ্গে অথবা তোমরা ওদের পক্ষে অতএব আমাদের দুশমন। সন্ত্রাসী। তোমাদের বরাতে ওদের মতোই ধ্বংস তোমাদের অবধারিত। আমাদের শত্রু হবার শাস্তি তোমাদের ভোগ করতেই হবে। হয় তোমরা আমাদের আধিপত্য ও অধীনস্থতা মেনে নাও — অথবা ধ্বংস হয়ে যাও। এই হচ্ছে পরিপ্রেক্ষিত। এখানে এসে ‘আধুনিক সভ্যতা’র দিগন্ত হঠাৎ প্যান্ট (এমনকি প্যান্টের তলের আন্ডারওয়ার) খুলে ল্যাংটা হয়ে সামনে ঝুলে পড়েছে। এখন আমাদের কী কর্তব্য? বুদ্ধমূর্তি বনাম আফগান শিশু নিয়ে আহমদ ছফার উদ্বিগ্নতাই আরও তীব্রভাবে ইকনমিস্টের ছবির মধ্য দিয়ে হাজির হয়েছে। ‘আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা’র প্রথম আলোচনার জন্য আমরা যে-বিষয় স্থির করেছি, তার গোড়ায় এই গুরুতর প্রশ্নগুলো রয়েছে।

৫। পুঁজি ও শ্রেণীসংগ্রাম

ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ এবং বহু জনগোষ্ঠি, ছোটবড় জাতি ও জাতিসত্তার অস্তিত্ব ও ইতিহাস ঝাড়ে-বংশে বিলকুল খতম করে কিংবা নামে মাত্র বহাল রেখে ‘আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা’ (সভ্যতা!) গড়ে উঠেছে। অনেকেই চোখের সামনেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অনেকের জন্য অপেক্ষা করছে সর্বনাশী ভবিষ্যৎ। উপনিবেশীকরণ এবং পুঁজিস্ফীতি ও পুঞ্জিভবনের প্রক্রিয়ার ঐতিহাসিক ফল এই ‘আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা’।

গত কয়েক দশকে এই ব্যবস্থার গতরে নয়া কিছু উপাদান বা চেহারাসুরতে নতুন ভাবসাব খেয়াল করে অনেকে একে ‘বিশ্বায়ন’ বা ‘গোলোকায়ন’ বলে চিহ্ন দান করছেন। কিন্তু পুঁজির খাসিলত সম্পর্কে মার্কসের একটা মৌলিক অর্থশাস্ত্রীয় বোঝাবুঝি আছে। সেখান থেকে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার কোন গুণগত পরিবর্তন হয়েছে দাবি করা কঠিন। ডিম ও ডিম থেকে বেরিয়ে আসা ছানা কি চরিত্র বা গুণগত ভাবে আলাদা? নাকি সেটা তাঁদের গড়ে ওঠার দুটো ঐতিহাসিক স্তর মাত্র? কিম্বা ছানা আর তার বয়স্ক অবস্থা? ইত্যাদি।

ব্যাপারটি অনুধাবনের জন্য ‘স্বভাব’ ও ‘গুণ’ নামে দুটো ধারণা আমাদের দরকার। ডিম আর মুরগির ছানার স্বভাবে কোন পার্থক্য নেই, কিন্তু ডিমের গুণ আর মুরগির গুণ এক নয়। কিন্তু মার্কসের কথা হোল মোরগের ডিম হলে সেটা যে মোরগই হবে তার জন্য ডিম ফুটিয়ে মোরগের গুণাগুণ বিচারের দরকার নেই। পণ্য-টাকা-পণ্য — পণ্যের এই বিচলন চক্র যখন টাকা-পুঁজি-টাকায় পরিণত হয়েছে এবং টাকা দিয়ে যখন উৎপাদনের উপায় ও শ্রম শক্তি কেনা যাচ্ছে তখনই মার্কস বলে ফেলতে পেরেছিলেন ‘পুঁজি বিশ্ব ঐতিহাসিক’। তাঁকে ২০০১ সাল অবধি বেঁচে থেকে পুঁজির গুণ বিচার করতে হয় নি। তবুও পুঁজিতন্ত্র নাকি দুনিয়াব্যাপী পরিব্যাপ্তি লাভের এই কালে স্বভাবেও বদলে গিয়েছে এই রটনা আমরা শুনি। প্রমাণ কেউই সফল ভাবে দাখিল করতে পেরেছেন বলে দেখি নি। গুণে আর স্বভাবে গোলমাল পাকিয়ে বলা হয় যেহেতু পুঁজি আমূল বদলে গিয়েছে ফলে শ্রেণীসংগ্রাম পুরনো ব্যাপার। এখন উত্তরাধুনিকতার যুগ। যদি সত্য বলে কিছুই নির্ণয় করা না যায় তাহলে তো কোন রাজনীতিই সম্ভব নয়। কোন সত্যের ভিত্তিতে মানুষ সংগঠিত হবে? পুঁজির বিরুদ্ধে লড়বে?

ঔপনিবেশিকতার নির্মম প্রক্রিয়া, প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক জীবনযাপন ও অপরাপর পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাগুলো পুঁজি নির্মমভাবে ধ্বংস করে নিজের পথ করে নিয়েছে। নিচ্ছে। এই ঘটনাটি যে আসলেই ঘটে এবং ঘটবার কারণ পুঁজির চরিত্রের মধ্যে নিহিত সেটা যুক্তি, বিশ্লেষণ ও বেশ কিছু ঐতিহাসিক সাক্ষ্য-প্রমাণসহ কার্ল মার্কস আমাদের শিখিয়েছেন। ইতিহাসের কথা বললে এই গোড়ার কথাটাই এসে পড়ে। তাঁর কাছে আমাদের এই ঋণখানা আজও রয়ে গেল। শোধ হয় নি।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছে। সম্প্রতি কাতারের দোহা শহরে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে চীন ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’য় মোটামুটি বীরের বেশেই প্রবেশ করেছে। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ আফগানিস্তানে ইঙ্গ মার্কিন আগ্রাসনকে চীন সমর্থন করেছে। এতে মার্কসের প্রতি আমাদের ঋণ আরও বাড়ে। কারণ কেন সেটা ঘটে তার ভেতরের কেচ্ছা আমরা পুঁজির অর্থশাস্ত্র থেকে বেশ খানিকটা মালুম করতে পারি।

সারা দুনিয়াকে পুঁজি তার লজিক, তার গতিপ্রক্রিয়া বা তার অপ্রতিরোধ্য শাসন ও শোষণের অধীনস্থ করবে। এটাই নিজের শক্তির বাইরে অন্য শক্তির কাছে মানুষের শেষ দাসত্ব। কিন্তু বিশ্ব ইতিহাস একদিন এই দাসত্ব থেকে নিজেই মুক্তি লাভ করবে এই প্রতিশ্রুতি আমরা মার্কসের কাছ থেকে পেয়েছি। সেটা আপনা আপনি বা আপসে আপ ঘটবে এই কথা মার্কস বলেন নি। পুঁজির প্রক্রিয়ায় মানুষে মানুষে শ্রেণী ভেদ এবং কাজে কাজেই শ্রেণীসংগ্রামের কথাটা সেই কারণে এসে যায়। মানুষ তো নিছকই বস্তু বা প্রকৃতিমাত্র নয়। পুঁজির ইতিহাস যদি প্রাকৃতিক ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা হয় সেখানে ছন্দপতনের, অর্থাৎ পুঁজির বিনাশ এবং প্রাকৃতিক ইতিহাস থেকে সত্যিকারের মানুষের ইতিহাসে গুণগত উল্লম্ফনের সম্ভাবনা শ্রেণীসংগ্রামের মধ্যেই নিহিত। শ্রেণীসংগ্রামের কথাটা রাজনৈতিক ভাবে আমরা বিস্তর শুনেছি, কিন্তু তার জ্ঞানগত বা দার্শনিক দিগন্তে ওড়াওড়ির বরাত আমাদের খুব একটা হয় নি।

পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে সারা দুনিয়াব্যাপী একটা সংগ্রাম চলছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মুখে সিয়াটলের বিক্ষোভ এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং ধনীদেশগুলোর জোটের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ এবং বৈপ্লবিক নানান লড়াই দেখতে দেখতে হঠাৎ নিউইয়র্কের ঘটনা ঘটল। বিশ্বব্যবস্থার দুই প্রধান প্রতীক নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের টুইন টাওয়ার ও ওয়াশিংটনের পেন্টাগনের ওপর হামলা হল। যে ইমারত বা স্থানগুলোর ওপর হামলা হয়েছে তাদের প্রতীকী তাৎপর্য আছে। হামলার লক্ষ্য নির্ধারণের মধ্য দিয়েই একটা প্রতীকী ভাষ্য তৈরি হয়েছে। এটা পরিষ্কার যে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধেই এই লড়াই। এটা ধর্মযুদ্ধ নয়। সংগ্রামের শ্রেণীচরিত্রও ওর মধ্য দিয়ে যথেষ্ট পরিষ্কার। এই লড়াইয়ে নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে অবশ্যই। ওকে কেন্দ্র করে বিস্তর নীতিকথা ও ‘সন্ত্রাস’' সম্পর্কে নানাবিধ তত্ত্ব এবং সংগ্রামের পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে তুমুল বিতর্ক চলছে। এই ক্ষেত্রে নৈতিকতার বিতর্ক নিছকই নীতিবাগীশিতে পর্যবসিত হচ্ছে। নীতিবাগীশির শ্রেণীভিত্তি নিয়ে কোন আলোচনাও আমার চোখে পড়ে নি।

এখানকার বিশ্বব্যবস্থায় যাদের জন্য করুণ ও রক্তাক্ত বিলয় অপেক্ষা করছে বা যারা আমাদের চোখের সামনেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, তারা তাদের পরিণতির খবর একদমই টের পায় নি, এমন নয়। অতীতের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠি ও জাতিসমূহের করুণ ও নির্মম পরিণতির ইতিহাস দেখে হয়তো তারা নিজেদের নিয়তির আগাম খবর পেয়ে গিয়েছেন। ভুক্তভোগী জাতি, জনগোষ্ঠি বা নিপীড়িত শ্রেণীগুলো তাদের নিজেদের জীবন থেকেই টের পায়। যদি তাই হয় তাহলে কী এই সর্বনাশ, এই বিলয় এই ধ্বংস বিলীয়মান জনগোষ্ঠি বা জাতিগুলো নিয়তি জ্ঞান করে মেনে নেয়? নিশ্চয়ই নয়। ব্যাপারটি কি প্রতিবাদ, বিদ্রোহ বা রক্তাক্ত প্রতিরোধ ছাড়া শেষ হয়? নিশ্চয়ই না। তাহলে ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমর বা তালেবানরা নিশ্চয়ই খামাখা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ ঘোষণা করে নি। তারা একটা জীবনযাপন পদ্ধতিও রক্ষা করতে চায়। ‘আধুনিকতা’র নৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিচারের মানদণ্ডে তালেবানদের চিন্তা, আদর্শ, জীবনচর্চা ইত্যাদি একদমই গ্রহণযোগ্য নয়। সেটা ‘মৌলবাদী’ বলে নিন্দিত ও ঘৃণিত। ঠিক আছে। কিন্তু এই ধরনের আদর্শ ও জীবনযাপন পদ্ধতি মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তানের মুসলমান ছাড়া অন্যান্য ধর্মে এবং অন্যান্য সংস্কৃতিতেও তো ভুরি ভুরি আছে। এই জায়নিজম বা ইহুদিবাদ তো ‘আধুনিক সভ্যতা’ বা সাম্রাজ্যবাদীদের চোখে নিন্দিত বা ঘৃণিত নয়। ইসরাইলকে ধ্বংস করা দূরের কথা, তাকে রক্ষা ও তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার অঙ্গীকার। কিন্তু কেন ওসামা বিন লাদেনকে মরতেই হবে? কেন আফগানিস্তানে তালেবানী শাসন ধ্বংস করতে হবে? কেন একটি গরিব ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে বৃষ্টির মতো বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দিতে হবে? কেন? আসলেই। সেটাই তো মূল প্রশ্ন।

আইরিশ রেভিউলিশনারি আর্মিও পশ্চিমা মানদণ্ড অনুযায়ী সন্ত্রাসী হবার কথা। কিন্তু যে সকল সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংলন্ড খাড়া করেছে সেখানে আইআরএর নাম নাই। ইংলন্ডের বিরুদ্ধে আইআরএর সন্ত্রাসী বোমা হামলা ও রক্তপাতের ঘটনা বহু। বহু নিরীহ মানুষ সেই হামলায় প্রাণ হারিয়েছে। কই টনি ব্লেয়ার বা তাঁর আগের কোন প্রধানমন্ত্রী আয়ারল্যান্ডকে বোমা মেরে গুঁড়িয়ে দেবার কথা তো বলেন নি? তাহলে আফগানিস্তান কেন?

৬. এটা কি আসলেই ক্রুসেড?

জর্জ বুশ প্রথমেই বলেছিলেন ওসামা বিন লাদেন ও আল কায়েদার ইসলামী সন্ত্রাস বা জেহাদের বিরুদ্ধে এটা ‘ক্রুসেড’। নিজের কথা নিজে গিলে খেতে তাঁর বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। যাঁরা ক্রুসেডের ভয়াবহতা ও হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে জানেন তাঁরা প্রমাদ গুণেছিলেন। পোপ জন পলও এতে বিব্রত হয়েছিলেন। তাঁর নীতি নির্ধারকরা তাঁকে বলেছিলেন বিশ্বের মুসলমান জনগোষ্ঠির মধ্যে এবং মুসলমান দেশগুলোর ওপর এর প্রতিক্রিয়া ভাল হবে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে ‘গ্লোবাল কোয়ালিশন’ করার পরিকল্পনা তিনি হাতে নিয়েছেন, সেটাও কাজ করবে না। কিন্তু কথাটা বলে জর্জ বুশ ভাল করেছেন। তাঁর দিক থেকে যুদ্ধের চরিত্রটা কেমন এবং তাঁর ‘নতুন বিশ্ব যুদ্ধ’ সম্পর্কে ধারণাটা কী সেটা আমরা বুঝতে পারলাম।

অনেকের ধারণা রাষ্ট্র পরিচালনায় অনভিজ্ঞতা এবং মাথায় মগজের চেয়ে মাংসের পরিমাণ বেশি বলে জর্জ বুশ মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেছেন। এই যুক্তি মানা যেতো যদি ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু ‘ক্রুসেড’ সংক্রান্ত ধারণাটাই আবার নতুন ভাবে তিনি হাজির করলেন Infinite Justice বা ‘অনন্ত ন্যায়বিচার’-এর জন্য যুদ্ধের কথা কয়ে। ঈশ্বরই অনন্ত ন্যায়বিচার করেন, মানুষ নয়। তাহলে তিনি ঈশ্বর নির্ধারিত বা প্রদত্ত বিচারই ইহলোকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে সন্ত্রাসী মুসলমানদের বিরুদ্ধে বাস্তবায়ন করছেন। এটা ক্রুসেড ছাড়া আর কি? সেখানেই তিনি আবার ধরা পড়ে গেলেন। তারপর তাঁর যুদ্ধের নাম বদলিয়ে রাখা হল ‘অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম’।

টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন হামলার পেছনে ওসামা বিন লাদেন ও আল কায়েদাকে নিছকই সন্দেহ করে ‘বিশ্বযুদ্ধ’ শুরু করে দেবার নজির ‘সভ্য’ জগতে নাই। শুরু থেকেই ওসামা এই হামলার সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেছেন। তাঁর সম্পৃক্তির কোন প্রমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজও দাখিল করতে পারে নি। পরবর্তীতে এনথ্রাক্স বা বায়োলজিক্যাল যুদ্ধাস্ত্রের হামলা যখন শুরু হল, দেখা গেল তার উৎপত্তি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই। প্রথমত এনথ্রাক্স হামলার সঙ্গে সাদ্দাম হোসেন জড়িত বলে এই যুদ্ধ সম্প্রসারিত করার প্রয়াস চালিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। কিন্তু তার পরিণতি মন্দ হতে পারে বলে প্রকাশ্যে বাড়াবাড়ি করে নি।

ওসামা বিন লাদেন কোন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নন, এমনকি তিনি আফগান নাগরিকও নন। যদি এই হামলা ওসামা করেও থাকে তাহলে তা বড়োজোর একজন ব্যক্তি বা সংগঠনের ক্রিমিন্যাল এক্ট হতে পারে। কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরেকটি রাষ্ট্রের যুদ্ধ হতে পারে না। সেটা crime against humanity বা ‘মানবিকতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হতে পারে। জাতিসংঘ সনদের ৫১ নম্বর চার্টার অনুযায়ী একটি দেশের বিরুদ্ধে আরেকটি দেশের যুদ্ধ হতে পারে না। তাহলে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের ঘটনার কারণে একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কোন আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে পড়ে? তাও এমন এক রাষ্ট্র ও এমনই জনগোষ্ঠি যারা ইতোমধ্যেই যুদ্ধে বিধ্বস্ত। সবচেয়ে প্রহসন হল, এমনই রাষ্ট্র যারা এই কিছুদিন আগেও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ হয়ে লড়েছে এবং জান দিয়েছে। আফগানিস্তানে নির্বিচারে বোমাবর্ষণের যে নৃশংসতা ইঙ্গ মার্কিন শক্তি দেখিয়েছে তার কোন নজির নেই।

একটি রাষ্ট্র আরেকটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী আক্রান্তকে আত্মরক্ষার বৈধতা ৫১ অনুচ্ছেদ দেয়। কিন্তু জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিল সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখেই জাতিসংঘের ৫১ সনদ অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সেই বৈধতা দিয়েছে। এরই অনুসরণে একই দিনে নর্থ আটলান্টিক কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নেয় যে এই ধরনের ‘সন্ত্রাসী’ হামলা ন্যাটো-ওয়াশিংটন চুক্তির ৫ নম্বর আর্টিকেলের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ এটা ব্যক্তি বা কোন সংগঠনের বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়। এটা একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অতএব নিজের প্রতিরক্ষার জন্য এর পাল্টা যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। এই প্রথম উত্তর আটলান্টিক আঁতাতের ইতিহাসে পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদ কার্যকর করবার তড়িঘড়ি উদ্যোগ আমরা লক্ষ্য করলাম।

পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদ কার্যকর করবার মধ্য দিয়ে ন্যাটো তাদের Principle of Collective Defence সক্রিয় করল। এর অর্থ কি এই যে ইসলামী হামলার বিরুদ্ধে খ্রিস্টীয় দেশগুলোকে যুদ্ধের জন্য সংঘবদ্ধ করা? পাঁচ নম্বর আর্টিকেল অনুযায়ী যদি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার সদস্যভুক্ত এক বা একাধিক দেশের উপর সামরিক হামলা হয় তাহলে সেটা সকল দেশের বিরুদ্ধে হামলা হিশাবে বিবেচিত হবে এবং সকলে মিলে তারা পাল্টা সামরিক ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় যে কোন প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। একজন ‘সন্ত্রাসী’-র বিচ্ছিন্ন হামলার অভিযোগে জাতিসংঘের আর্টিকেল ৫১ ব্যবহার করার ব্যাপারটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

এভাবেই আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাবার অবাধ ক্ষমতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পেলো। এর পাল্টা পদক্ষেপ হতে পারতো জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনের মেরি রবিনসনের প্রস্তাব। সেপ্টেম্বরের ২৫ তারিখে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে মেরি রবিনসন বলেছিলেন, সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখের ঘটনা কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের যুদ্ধ নয়। এটা ‘এটা মানবিকতার বিরুদ্ধে অপরাধ’। তার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে হতে পারে। প্রয়োজনে ‘সন্ত্রাসী’ অপরাধের জন্য একটি বিশেষ আদালতও গঠন করা যেতে পারে। কিন্তু তাঁর কথা বাতাসে মিলিয়ে গেল। এই ধরনের অপরাধ বিচারের জন্য একটি International Criminal Court গঠন নিয়ে কথাবার্তা চলছে। তবে সেটা গঠিত হবে ২০০১ বা ২০০৩ সালে। সেই আদালতে ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার বিচার করা যাবে না। আদলত গঠিত হবার পরে এই ধরনের ঘটনার বিচার হতে পারে।

জর্জ বুশ, টনি ব্লেয়ার ও খ্রিস্টীয় জগতের অধিপতি শক্তির দিক থেকে আসলেই তাহলে এটা ক্রুসেড। মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের ধর্মযুদ্ধ। ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দের প্রথম বা পরবর্তী ক্রুসেডের সঙ্গে এখনকার ক্রুসেডের অমিল নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু মিলও কম নাই। আরবে ইসলাম আবির্ভাবের অতি অল্প সময়ের মধ্যে হজরত ঈসা যে ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ ও বসবাস করেছিলেন সেটা মুসলমানদের দখলে চলে আসে। সেটা ঘটে ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। ক্রুসেডের যোদ্ধারা তাদের ‘পবিত্র ভূমি’ মুসলমানদের হাত থেকে উদ্ধার করবার জন্য ক্রমাগত লড়াই চালিয়ে যায়। ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের ‘পবিত্র ভূমি’ জেরুজালেম মুসলমান অধিকার থেকে উদ্ধার করবার জন্য দ্বিতীয় পোপ আরবান যে War of the Cross বা ক্রুসেডের ডাক দেন তারই প্রতিধ্বনি যেন এই যুগেও শোনা যাচ্ছে। খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধারা প্রথম ক্রুসেডে জেরুজালেম দখল করে নেয়। ক্রুসেডে শুধু সৈনিক নয়, নারীপুরুষদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেই হত্যাযজ্ঞের নিষ্ঠুর ইতিহাস স্মরণ করেই পোপ জন পল জর্জ বুশের ক্রুসেডের কথা শুনে আতংকিত হয়েছিলেন। সেই কালে ক্রুসেডের নেতা ছিলেন পোপ স্বয়ং। এই কালে তার সর্দার জর্জ বুশ আর টনি ব্লেয়ার।

আদি ক্রুসেড আর ২০০১ সালের ক্রুসেডের মধ্যে পার্থক্য কি? তখনও যুদ্ধটা ছিল জমি দখল নিয়ে। এখনও মামলা ভূখণ্ড নিয়েই। আদি ক্রুসেডে জমি ছাড়া প্রকাশ্য কোন দাহ্য পদার্থ ছিল না। যীশুর জন্মভূমি পুনরুদ্ধারের পেছনে কিম্বা মুসলমানদের জেরুজালেম দখল করে রাখার পেছনে আত্মার দাহ্যিক ভূমিকা থাকতে পারে। দুই হাজার এক সালের ক্রুসেডকে শুধু জমি দিয়ে বোঝা যাবে না। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা এবং তার পেছনে খ্রিস্টীয় বিশ্বের অকুন্ঠ সমর্থনের মধ্য দিয়ে ক প্রকার হাসিলই হয়েছে বলা যায়। এবারের ক্রুসেডের দাহ্য পদার্থ আসলে তেল এবং গ্যাস। প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সভ্যতায় ভূখণ্ড বৈষয়িক ও আত্মিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতএব মুসলমানদের হাত থেকে জেরুজালেম উদ্ধার করবার লড়াইয়ের বৈষয়িক ও আত্মিক কারণ পুরো মাত্রায় বর্তমান।

ক্রুসেড বা জেহাদকে ধর্মযুদ্ধ জ্ঞান করে তার বিচার বা বিশ্লেষণ ওখানেই সমাপ্ত করে দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য। মার্কসীয় বিচার জেহাদ বা ক্রুসেডের বাহ্যিক রূপ দেখে সন্তুষ্ট নয়। সেটা ধর্মযুদ্ধ ঠিকই কিন্তু অভ্যন্তরের বৈষয়িক কারণটা অনুসন্ধান করা জরুরি। যে বিশ্বাসে বা যে মতাদর্শের ভিত্তিতে ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হয় তার সঙ্গে মার্কসীয় বিচার পদ্ধতি সেই যুদ্ধের বৈষয়িক কারণ গুলিয়ে ফেলে না। যুদ্ধের মতাদর্শ এক জিনিস আর তার অন্তর্লীন কারণ অন্য কথা।

প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সভ্যতা এখনকার আধুনিক বিশ্ব-পুঁজিতান্ত্রিক সভ্যতা হয়ে উঠলেও পুরনো ক্রুসেডের সঙ্গে এখনকার ক্রুসেডের এক বিস্ময়কর মিল আছে। পুরনো ক্রুসেডের সময় হজরত ঈসার জন্মস্থান ও জেরুজালেম ছিল মুসলমানদের দখলে। প্রবল ধর্মের সেই যুগে এটাই ছিল সর্বোচ্চ সম্পদ, যার জন্য জান দিতে দুই পক্ষই প্রস্তুত ছিল। বর্তমান সভ্যতার ভিত্তি ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানি। তেল ও গ্যাস। যাকে আমরা বিশ্বসভ্যতা বলি তার বৈষয়িক ভিত্তির মূল উপাদান তেল এবং গ্যাস। এই তেল ও গ্যাসের নিশ্চয়তা ছাড়া আধুনিক সভ্যতা টিকে থাকতে পারে না।

কিন্তু ইতিহাসের প্রহসন এই যে. হজরত ঈসার জন্মস্থান বা পবিত্র ভূমি যেমন তখন মুসলমানদের দখলে ছিল, ঠিক তেমনি তেল গ্যাস কী এক অজ্ঞাত কারণে মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ইত্যাদি ইসলাম প্রধান দেশগুলোর দখলে। ক্রুসেডের পুরনো আধ্যাত্মিক স্বার্থের জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে তেলের স্বার্থ। তেলই বর্তমান বিশ্বসভ্যতার ঈশ্বর। অতএব এই ঈশ্বরের জন্য যুদ্ধ অনিবার্য। যেহেতু এই তেল প্রধানত ইসলাম প্রধান দেশগুলোতেই বেশিরভাগ মজুদ, অতএব যুদ্ধটার রূপ ধর্মযুদ্ধের আকার পরিগ্রহণ করছে। আরও করবে। এটাই স্বাভাবিক। স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ নামক থিসিসে খুব একটা ভুল করেন নি। তেলই যেহেতু বর্তমান বিশ্বসভ্যতার প্রাণ, অতএব তাঁর ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ কথাটিকে পাঠ করতে হবে তেলের সংঘর্ষ হিশাবে। এই তেল আছে ইসলাম প্রধান দেশগুলোতে। কিন্তু খ্রিস্টান প্রধান শিল্পসভ্যতা এই তেল ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। তেল শিল্পসভ্যতার অতিশয় আবশ্যিক, অতএব পরম পবিত্র জিনিস। সেই কারণে যুদ্ধের রূপটা আমরা চাই বা না চাই ধর্মযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহণ করতে বাধ্য। সেই কারণে জর্জ বুশের ক্রুসেডের ডাক কিম্বা ওসামা বিন লাদেন ও মোল্লা ওমরের জেহাদ পবিত্র তেলের লড়াই ছাড়া আর কি? ক্রুসেড ও জিহাদ দুটোই তৈলাক্ত।

মাত্র কয়েক বছর আগে ১৯৯৬ সালে যখন তালেবানরা সরকার গঠন করলো তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানদের সম্পর্ক বেশ ভালো। তালেবান নেতারা টেক্সাসের হিউসটনে তেল কোম্পানি ইউনোকল (Unocal) এর কর্মকর্তাদের সাথে চা-নাস্তা খেতে গিয়েছিল। কোম্পানির তেল এবং গ্যাস উত্তোলন থেকে মুনাফার একটা বড় অংশ তালেবানদের দেওয়া হবে বলে তাদের লোভ দেখানো হয়। কোম্পানি চেয়েছিল তেল এবং গ্যাসের জন্যে সোভিয়েত সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে আফগানিস্তান হয়ে একটি পাইপলাইন বসাতে। একজন মার্কিন কূটনীতিক এই কথা বলতেও দ্বিধা করেন নি যে আফগানিস্তান আমেরিকার তেল কলোনী হয়ে উঠবে, সেখানে পশ্চিমা দেশ থেকে আসা বিরাট অংকের মুনাফা থাকবে, কিন্তু গণতন্ত্র থাকবে না। নারীদের কোন আইনগত অধিকার না থাকলেও অসুবিধা নেই। 

খবর হল, চুক্তিটি হয় নি। এখন এই তেলের ওপর দখলদারিত্ব কায়েম করা বুশ প্রশাসনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। বুশের গোপন ইচ্ছা হচ্ছে ক্যাসপিয়ান বেসিনের মাটির নীচের সর্ববৃহৎ তেল এবং গ্যাসের মওজুদ সন্ধান করা। আমাদের পরিষ্কার খেয়াল রাখা দরকার এই তেল ও গ্যাস পেলে আমেরিকার আরও একটি জেনারেশন অনায়াসে চলতে পারবে। জীবাশ্ম ভিত্তিক সভ্যতার আয়ু আরও বাড়বে। যদি এটা পেতে হয় তাহলে পাইপলাইনগুলো আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তালেবানরা বাধা হয়ে উঠলো। এখন তেল ও গ্যাস পেতে হলে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতেই হবে। মার্কিনীরা আফগানিস্তানে একটু মডারেট বা মাঝারি ধরনের তালেবান সরকার চায়, তারা যেন আফগানিস্তানে একটি ঢিলেঢালা ফেডারেশন চালাতে পারে। তাই জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারের ‘সন্ত্রাস বিরোধী’ যুদ্ধ একটা ভুয়া কথা। নেহায়েতই লোক দেখানো।

৭. বিন লাদেন: যে সত্য নিষিদ্ধ

‘বিল লাদেন: যে সত্য নিষিদ্ধ’ (Bin Laden, La Vérité Interdite) নামে একটি বই সম্প্রতি ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। লিখেছেন জাঁ শার্ল ব্রিসকা Jean-Charles Brisard এবং গিওম দাসকি Guillaume Dasqui। সেই বইয়ের মূল কথা, ‘সন্ত্রাসী’ তালেবান বা আল কায়েদা নেটওয়ার্ক ধ্বংসের যে চোটপাট আমরা বুশ-ব্লেয়ার চক্রের মুখে শুনছি সেটা ভুয়া। লড়াইটা আসলেই তেল গ্যাসের জন্য। কথাটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য নতুন নয়। কিন্তু এই দুজনেই পৃথিবী বিখ্যাত intelligence analyst অর্থাৎ গোপন গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষক। বইটি বেরুবার পর অনেকেই দাবি করছেন বিপুল তথ্যে সমৃদ্ধ এই বই বুশ আর ব্লেয়ারকে বিপদেই ফেলবে এবং তাদের Dirty Afgan War বা নোংরা আফগান যুদ্ধের গোমর ফাঁস করে দেবে।

নব্বই দশকের শেষের দিক অবধি ব্রিসকা ছিলেন ভিভেনদি নামে একটি ফরাসি কোম্পানির অর্থনৈতিক বিশ্লেষক। ব্রিসকা ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থার (DST) জন্যও কাজ করেছেন এবং ১৯৯৭ সালের ফরাসি গোয়েন্দাদের জন্য বিন লাদেনের নেতৃত্বাধীন আল কায়েদা নেটওয়ার্কের জন্য একটি রিপোর্ট তৈরি করেছেন। দাসকি একজন গোয়েন্দা বিষয়ক সাংবাদিক এবং Intelligence Online নামে একটি পত্রিকা বের করেন।

এগারোই সেপ্টেম্বরের আগে তালেবানদের সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সদয়, এমনকি দোস্তির। তালেবানদের দেখা হতো, “মধ্য এশিয়ার স্থিতিশীলতার উৎস হিশাবে যারা মধ্য এশিয়া ভেদ করে তেলের পাইপ লাইন নির্মাণ করার জন্য জরুরি।... তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এবং কাজাকিস্তানের সমৃদ্ধ তেল ক্ষেত্রগুলো থেকে তেল টেনে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান হয়ে ভারত মহাসাগর অবধি নিয়ে পাইপ লাইন নিয়ে যাওয়ার” জন্য তালেবানদের ওপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্ভর করেছিল। কিন্তু তালেবানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তেল কোম্পানির লুটপাটের প্রস্তাবে সম্মত হয় নি। সেখানেই গোলমাল দেখা দিল।

ক্যাসপিয়ান সাগর অঞ্চলের দেশগুলোতে (আজারবাইজান, কাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তানে) যে তেলের রিজার্ভ আছে তার পরিমাণ কমপক্ষে দুইশ বিলিয়ন ব্যারেল। পারস্য উপসাগরীয় এলাকার তেলের পরিমাণের তুলনায় এটা তিন ভাগের একভাগ। এই বিপুল তেলসম্পদ লুটের জন্যই আজ আফগানিস্তানের যুদ্ধ।

এই তথ্যগুলো যার বরাতে বলা হয়েছে তাঁর নাম ওনীল (O Neil)। ইনি একজন আইরিশ- আমেরিকান। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তেল কোম্পানিগুলো তালেবানদের কাছ থেকে আপোষে তেল পেয়ে যেতো তাহলে তেলের বিশাল বিকল্প উৎসের ওপর তাদের একচেটিয়া দখল কায়েম হয়ে যেতো। ব্রিসকা ও দাসকি বলছেন, “রাশিয়া মধ্য এশিয়ার এই তেল ও গ্যাস খবরদারি করবে। বুশ সরকার সেটা বদলে দিতে চেয়েছেন এবং বদলাতে গিয়েই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া।”

নভেম্বর ১৯ তারিখের Irish Times-এর একটি প্রতিবেদনে জানা যায় ওনীল (O Neil) ১৯৯৩ সালে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের বোমার ঘটনা, ১৯৯৬ সালের সৌদি আরবের মার্কিন ঘাঁটির হামলা, ১৯৯৮ সালে নাইরোবি ও দার-এস-সালামের মার্কিন দূতাবাস আক্রমণ এবং ২০০০ সালে ইউএসএস কোলের ঘটনা তদন্ত করেছেন। এই তদন্ত করার কাজ করতে গিয়েই তার মনে হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসলে ‘সন্ত্রাস’ সংক্রান্ত কোন তদন্তে মোটেও উৎসাহী নয়। বরং তদন্তে তাকে পদে পদে বাধা দেওয়া হয়েছে। বিরক্ত হয়ে তিনি চাকুরি ছেড়ে দিয়ে নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে নিরাপত্তা প্রধান হিশাবে নতুন চাকুরি গ্রহণ করেন। এগারোই সেপ্টেম্বরের ঘটনায় ওনীলও মারা যায়। ব্রিসকা ও দাসকি ওনীলের সঙ্গে যে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে রেখেছিলেন তার মূল্য অতএব অপরিসীম।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর কষাকষির এক পর্যায়ে মার্কিন প্রশাসন তালেবানদের বলেছে, “হয় আমাদের সোনার কার্পেটে তোমাদের মুড়ে দেবার প্রস্তাব গ্রহণ কর, অথবা অবিরাম বোমা বর্ষণের কার্পেট বিছিয়ে আমরা তোমাদের কবর রচনা করব।” এই লেখা যখন লিখছি তখন নদার্ন এলায়েন্স, আফগানিস্তানের প্রাক্তন রাজা জহির শাহ এবং তালেবান পন্থী নয় এমন পশতুন নেতাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের তালেবান-উত্তর সরকার গঠন নিয়ে কথাবার্তা চলছে। প্রহসন হল এই শহরেই তালেবানদের সঙ্গেও দর কষাকষি হয়েছিল।

বইটির তথ্যানুসারে বুশ প্রশাসন তালেবানদের সঙ্গে দর কষাকষি শুরু করে ২০০১ সালের শুরুর দিকে। ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদেও কথাবার্তা হয়। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে এশিয়া বিভাগের দেখাশোনা করেন ক্রিস্টিনা রকা (Christina Rocca)। সেপ্টেম্বর ১১ তারিখের ঘটনার আগে ক্রিস্টিনা পাকিস্তানে তালেবান রাষ্ট্রদূত আবদুস সালাম জায়িফের সঙ্গে আগস্টের দুই তারিখে কথা বলেন। জেনে রাখা ভাল যে ক্রিস্টিনা রকা হচ্ছেন এক কালে আফগানিস্তানে ‘মৌলবাদী’ গেরিলাদের পক্ষে কাজ করবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি অভিজ্ঞ প্রশাসনিক ব্যক্তি। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র অধীনে ‘মৌলবাদী’ ইসলামী গোষ্ঠিকে অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত করার দায়িত্বে ছিলেন। বিশেষত আফগান মুজাহেদিনদের স্টিংগার মিসাইল হস্তান্তরের দায়িত্ব তিনিই পালন করেছেন। তাঁর মাধ্যমে পাওয়া অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মুজাহেদিনরা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়েছে।

ব্রিসকা এবং দাসকির তথ্য থেকে জানা যায় যে তালেবানদের অতি গোঁড়া বা অতিশয় ‘মৌলবাদী’ বলে যে-ধারণা তৈরি হয়েছে সেটাও পুরোপুরি সত্য নয়। সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বহাল থাকার সময় এই সত্য নানাভাবেই ব্যক্ত হয়েছে। তালেবানরা পশ্চিমা বিশ্বে তাদের ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন করার জন্যও সচেষ্ট ছিল। তারা লায়লা হেলমস (Laila Helms) নামে একজন বিশেষজ্ঞকে এই কাজের জন্য নিয়োগ দেয়। লায়লা হেলমসের আবার আরেকটি পরিচয়ও ছিল। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা কী করে কাজ করে তিনি সেই বিষয়েও বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তার কাজ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তালেবানদের স্বীকৃতি আদায় করা। লায়লার চাচা রিচার্ড হেলমস (Richard Helms) সিআইএর প্রাক্তন ডিরেক্টর এবং তেহরানে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা কী করে কাজ করে তার খবরাখবর লায়লা চাচার মাধ্যমেই জানতেন।

ওনীল দাবি করেছেন যে ওসামা বিন লাদেন ও আল কায়েদা নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সকল তথ্যই সৌদি আরবের কাছে পাওয়া যাবে। কিন্তু সৌদি রাজপরিবারকে বিব্রত করতে যুক্তরাষ্ট্র রাজি নয়। দাহরানে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে বোমা হামলায় ১৯ জন মার্কিন সৈন্য নিহত হবার তদন্ত করতে গিয়ে এফবিআই অভিযুক্ত সন্দেহভাজনদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এই বিষয়ে কোন হৈ চৈ করতে রাজি হয় নি। সৌদি সরকারি কর্মকর্তারা অবশ্য সন্দেহভাজনদের নিজেরাই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। ওনীল তাঁর তদন্ত টিম নিয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন কিন্তু নভেম্বর ১৯ তারিখে প্রকাশিত Irish Times এর তথ্য অনুযায়ী তাঁদের বোমা হামলার জায়গা থেকে কিছু জিনিসপত্র কুড়িয়ে আনার অধিক কোন কাজের সুযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন করে দেয় নি।

ইরান, ইরাক, কুয়েত, ওমান, সৌদি আরব আরব আমীরাত ও উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো সবসময়ই তেলের অর্থনীতি ও রাজনীতির মধ্যে পাক খাচ্ছে। প্রথমে ইংরেজ এই অঞ্চলের তেলের ওপর দখলদারি কায়েমের জন্য লড়েছে, তারপর হামলা করেছে ফরাসিরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে তেলের থিয়েটারে অবতীর্ণ হয়েছে। জীবাশ্মভিত্তিক শিল্পসভ্যতা ততোদিনে যে অবস্থায় পৌঁছেছে তার কারণে তেল সরবরাহের নিশ্চয়তা এবং তেলের উৎসের নিরাপত্তা বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্ট এবং বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সউদ ১৯৪৫ সালের মার্চে একটি গোপন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে দীর্ঘকালীন সামরিক ভৌগলিক কৌশলগত মৈত্রীর দাসখৎ বলা যায়। জর্জ বুশের “অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম” সম্পর্কে এমনকি তেল সম্পদ বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল এর দুটো লক্ষ্য। এক নম্বরে “সন্ত্রাসী”-দের পাকড়াও করা, সেটাই ফলাও করে বলা হয়। দুই নম্বরে পারস্য উপসাগর ও ক্যাসপিয়ান সাগর সন্নিহিত ভূগোলে তেল ও গ্যাসের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দখলদারিত্ব পাকাপোক্ত করা। প্রথম কথাটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যতোই জোরগলায় মুখ্য ব্যাপার বলে হৈ হল্লা করুক, দুই নম্বর লক্ষ্যটার গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়। এই কথা নোয়ম চমস্কি বা এডওয়ার্ড সাঈদের মতো বামঘেঁষা মানুষের নয়। বলছেন আমহার্স্ট শহরের হ্যাম্পশায়ার কলেজের প্রফেসর মাইকেল টি ক্লেয়ারের (Michael T Clare) মতো তেল বিশেষজ্ঞ। ইনি Resources Wars: The New Landscape of Global Conflict নামক বই লিখে বিখ্যাত।

বুশ প্রশাসনের বহু কর্মকর্তাই তেল কোম্পানির সঙ্গে জড়িত। গত বছর পর্যন্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি ছিলেন হেলিবারটন (Halliburton) নামে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট। এই কোম্পানি তেল কোম্পানিগুলোর কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কনডোলেজা রাইস (Condoleezza Rice) ১৯৯১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত শেভরন (Chevron) তেল কোম্পানির ম্যানেজার ছিলেন। বাণিজ্য সেক্রেটারি ডোনাল্ড ইভানস (Donald Evans) এবং স্টানলি আবরাহাম (Stanley Abraham) টম ব্রাউন (Tom Brown) নামে আরেকটি তেল কোম্পানির কর্মকর্তা ছিলেন। তাহলে “অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম” তালেবান ও আল কায়েদাকে ধ্বংস করতে চায় কেন?

এক: মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার জন্য যেসব ইসলামপন্থী দল লড়ছে তাদের “মৌলবাদী” বলে বর্বর ও অসভ্য প্রমাণ করা ও তাদের ধ্বংস করে মার্কিন দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

দুই: বিন লাদেন ও তালেবানরা এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো বাধা এবং মতাদর্শিকভাবেও বিপজ্জনক হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করা এবং এই ধরনের প্রতিটি সামরিক সংগঠনকে উচিৎ শিক্ষা দান করা।

তিন: মধ্য এশিয়ায় মার্কিন তাবেদার সরকার উৎখাত করে জঙ্গী ইসলামপন্থী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সরকার কায়েমের সম্ভাবনা নস্যাৎ করা। লক্ষ্য করার বিষয় যে যুদ্ধ শুরুর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং কিরগিজিস্তানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

বুশের চেয়ে ব্লেয়ার কোন অংশে কম নয়। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা যেমন গ্রহণযোগ্য নয় তেমনি নিরাপরাধ মানুষ হত্যাও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যারা ক্লাস্টার বোমা মেরে বলে ভুল হয়েছে এটা তাদের ভান ছাড়া আর কিছুই নয়। হত্যা মানে হত্যা। এটা একটা প্লেন নিয়ে একটি বিল্ডিং-এর ওপর ধাক্কা মারলে যেমন অপরাধ তেমনি হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিস কিংবা লন্ডনের ডাউনিং স্ট্রিটে বসে হুকুম দিলেও একই ধরনের অপরাধ হয়। যদি ব্লেয়ার আসলেই সন্ত্রাসের বিরোধিতা করতে চান তাহলে তাঁকে প্রথমেই অস্ত্রব্যবসা থেকে সরে আসতে হবে। ব্লেয়ার যদি আসলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে হন তাহলে তাকে ইরাকের বিরুদ্ধে অবরোধ থেকে সরে আসতে হবে।

ওসামা বিন লাদেনের দুর্ভাগ্য তিনি ধনী এবং সৌদি। সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে লড়ে দেশে ফিরে এসে তিনি আবিষ্কার করলেন তাঁর নিজের দেশটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দখল করে রেখেছে। সেটাও তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করবার জন্য। ফলে তাঁর বন্দুকের নল ঘুরে গেল। কিন্তু সৌদি হবার কারণে ওসামা হয়ে উঠলেন রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক। কারণ সৌদি আরবে ও মধ্যপ্রাচ্যে দ্রুত তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বেড়েই চলল। তাঁর কারণে সৌদি আরবের রাজতন্ত্রের যদি পতন ঘটে তবে সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সভ্যতার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার সমীকরণে আমূল পরিবর্তন ঘটবে। অতএব ওসামা বিন লাদেনকে জীবিত বা মৃত ধরতেই হবে। এখন প্রচার করা হচ্ছে তিনি নাকি বলে গিয়েছেন যে তিনি শত্রুর হাতে ধরা দেবেন না। তাঁর দেহরক্ষীরাই যেন তাঁকে ধরা পড়বার আগে মেরে ফেলে। অর্থাৎ নিজেদের হাতে ওসামা বিন লাদেনকে মারবার দায়দায়িত্ব পশ্চিমা দেশগুলো নিতে চাইছে না। তাকে গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটাও হবে বিপজ্জনক। এগারোই সেপ্টেম্বরের ঘটনায় ওসামা বিল লাদেন আদৌ যুক্ত ছিলেন কিনা তার কোন প্রমাণ আছে বলে মনে হয় না। ওসামা নিজেও তা অস্বীকার করেছেন।

৮. ক্রুসেড ও জেহাদ

তেল ও গ্যাসের যুদ্ধটাই ধর্ম যুদ্ধের রূপ নিচ্ছে এবং আসলেই এই দাহ্য পদার্থগুলোই সভ্যতার প্রধান সংকট। গোড়ার এই কথাটা আমাদের ভালোভাবে মনে রাখতে হবে। সভ্যতার সংকট কথাটা আমরা এখানে উল্লেখ করছি সভ্যতা সম্পর্কে হাওয়াই ধারণা থেকে নয়। আমরা বলছি শিল্পসভ্যতার গোড়ায় রয়েছে জ্বালানি। তেল এবং গ্যাস। যদি এই জ্বালানি শিল্পসভ্যতা নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে তার পতন বা ধ্বংস অনিবার্য। লড়াইটা কিন্তু এখন শুরু হয় নি। শুরু হয়েছে সত্তর দশকের গোড়া থেকে।

যদি সভ্যতার সংকটের এই বিশেষ চরিত্রের দিকে আমরা মনোযোগ দেই তাহলে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রথাগত শ্রেণীসংগ্রামের ধারণার ক্ষেত্রে নতুন কিছু বিষয় আমাদের ভাবার দরকার আছে। পুঁজিতান্ত্রিক সভ্যতা কথাটা আমরা অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিচার থেকে বলি, প্রাকৃতিক বা সভ্যতার বস্তুগত উপাদানের দিক থেকে বিচার করে বলি না। “আধুনিক সভ্যতা”র জীবাশ্ম ভিত্তি সম্পর্কে কমিউনিস্টদের ধারণা দুর্বল। এই সম্পর্কে মূল সংগ্রামের ধারাটা পরিবেশ ও নারী আন্দোলন থেকে এসেছে।

ধরা যাক পশ্চিমা সভ্যতার সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তন ঘটল। কিন্তু এতে জীবাশ্ম ভিত্তিক শিল্পসভ্যতার কোন পরিবর্তন হবে না। এতে তেল ও গ্যাসের ওপর দখলদারিত্বের দ্বন্দ্ব কিন্তু শেষ হয়ে যাবে আশা করা দুরাশা মাত্র। কিন্তু ভবিষ্যত সম্পর্কে অনুমান না করে কিছু প্রয়োজনীয় বিষয়ের দিকে নজর ফেরানো দরকার।

জর্জ বুশের এই ক্রুসেড একই সঙ্গে বর্ণবাদী যুদ্ধ। সেই কারণে আরব, আফগান ও ইসলাম প্রধান দেশের জনগোষ্ঠিকে বর্বর, ট্রাইবাল ও পশ্চাৎপদ প্রমাণ তাকে করতেই হচ্ছে। কারণ কাউকে অমানুষ বা সভ্য জগতের অংশ নয় প্রমাণ করা গেলেই তাকে সহজে বোমা মেরে হত্যা করলে কোন দয়া বা মায়ামমতা জাগে না। এই যুদ্ধ ক্রুসেড এই কারণে যে জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারকে একটি মতাদর্শ হিশাবে জঙ্গী ইসলামের ও জঙ্গী মুসলমানদের মোকাবিলা করতেই হবে। তেল ও গ্যাসের দখল থেকে মুসলমানদের উৎখাত করতেই হবে। তাঁরা সেটা জানেন এবং আগে থাকতেই এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে তাঁরা বারবার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু মুসলমানদের বিভক্ত রাখবার জন্য তাঁদের বলতে হচ্ছে এই যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়। এই যুদ্ধ নাকি '”সন্ত্রাসী”-দের বিরুদ্ধে। মনে আছে কিনা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ও বলা হয়েছিল এই যুদ্ধ ভিয়েতনামীদের বিরুদ্ধে নয় বরং সন্ত্রাসী “কমিউনিস্টদের” বিরুদ্ধে যারা স্বাধীনতা ও সভ্যতার শত্রু। ইরাকে অর্থনৈতিক অবরোধ ঠিকই জারি রয়েছে। ফিলিস্তিনে ইসরাইলী হামলা এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ হয় নি। চলছে। ক্রুসেড হলেও জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারকে এই যুদ্ধ চালাতে হবে “সভ্যতা”, “মুক্তি” বা সন্ত্রাস বিরোধিতার নামে। ভূতের মুখে রাম নাম।

অন্যদিকে ওসামা বিন লাদেনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ফাঁকি খুঁজে আমরা কূটতর্ক করতে পারি। বাস্তবে আমরা দেখছি তারা ইঙ্গ মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেকে পিছু হটে আসে নি। এই যুদ্ধে বিপুল সংখ্যায় সংগ্রামীকে একত্র করার জন্যে তারা “জেহাদের” ডাক দিয়েছে। “দুনিয়ার মজদুর এক হও” বলে এই কালে ইঙ্গ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই আদৌ সম্ভব হতো কিনা সেটা বিচক্ষণ যে কেউই ভেবে দেখতে পারেন। বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিপীড়িত শ্রেণী, জাতি ও জনগোষ্ঠির লড়াই পরিগঠিত করে তোলার ব্যর্থতার জন্য ক্রুসেডের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ জেহাদের রূপ নিচ্ছে। ফলে ওসামা বিন লাদেন বা তালেবানদের “মৌলবাদী” বলে আমাদের সুখানুভূতি হতে পারে, কিন্তু সেটা আমাদের ইতিহাসবোধের ঘোরতর অভাবেরই পরিচয়। যে লড়াই বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সকল ভুক্তভোগী শ্রেণী, জাতি ও জনগোষ্ঠির লড়াই হবার কথা তাকে মুসলমানদের জেহাদি লড়াইয়ে সংকীর্ণ করে এনে ওসামা নিজের ধ্বংস যেমন ত্বরান্বিত করেছেন, তালেবানরাও নিজেদের নিশ্চিহ্ন করার বাস্তবিক শর্ত তৈরি করেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি ছাড়া অন্য কোন পরিস্থিতি কি আদৌ সম্ভব ছিল?

যুদ্ধের মতাদর্শ দুই ক্ষেত্রেই উল্টোভাবে হাজির হচ্ছে। বুশ আর টনি ব্লেয়ার তাঁদের ক্রুসেডকে বলছেন, ইনফিনিট জাস্টিস, বলছেন অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম — সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অন্যদিকে ওসামা, মোল্লা ওমর আর তালেবানরা একে বলছে “জেহাদ” আল্লাহর পথে সংগ্রাম। যদি এটা জ্বালানি যুদ্ধ হয় এবং তেল ও গ্যাস যদি ইসলাম প্রধান দেশগুলোতেই থেকে থাকে তাহলে সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে লড়বার আর কী মতাদর্শ তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর জনগণের রয়েছে? কী বলে তারা এই যুদ্ধে সৈনিক সংগ্রহ করবে? যে যুদ্ধ বৈশ্বিক, তার যোদ্ধাও নিশ্চয়ই এক দেশের হবে না। সত্যি যে আফগানিস্তানে বাংলাদেশের তরুণরাও লড়তে গিয়েছে। কী ভাষায় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করলে সেটা আমাদের কাছে “মৌলবাদ” বলে মনে হবে না? এই কালে বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বর্তমান কালপর্বে শ্রেণীসংগ্রামের ভাষা কী হবে?

এর উত্তর আমি দেব না। শুধু সকলকে ভাববার আহ্বান জানিয়ে শেষ করবো। শেষ করবো করাচির “উম্মত” পত্রিকায় ওসামা বিন লাদনের একটি সাক্ষাৎকার থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে:

আমি ইতোমধ্যেই বলেছি যুক্তরাষ্ট্রে ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে আক্রমণের সাথে আমি যুক্ত নই। একজন মুসলমান হিশেবে আমি মিথ্যে কথা যেন বলতে না হয় তার চেষ্টা করি। আমি এই আক্রমণ সম্পর্কে কিছুই জানি না এবং আমি মনে করি নিষ্পাপ শিশু, নারী এবং অন্যান্য মানুষ হত্যা করা কোন প্রশংসা করার কাজ নয়। ইসলামে শিশু, নারী এবং অন্যান্য মানুষ হত্যা করা কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যুদ্ধের সময়ও এমন হত্যাকাণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নারী, শিশু এবং অন্যধর্মের মানুষ, বিশেষ করে ইসলামধর্মের মানুষের ওপর এমন হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। গত ১১ মাস ধরে ফিলিস্তিনে যা ঘটছে তাতেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের ওপর আল্লাহর গজব পড়ার কথা। যে সকল মুসলমান রাষ্ট্র এই অত্যাচার নীরবে দেখছে তাদেরও এই ঘটনা দেখে সতর্ক হয়ে যাওয়া উচিত। এর আগে ইরাক, চেচনিয়া এবং বসনিয়ার নিরপরাধ মানুষের ওপর কী হয়েছে? এই সকল ঘটনায় আমেরিকা এবং পশ্চিমাদের নিস্পৃহতা এবং সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা দেখে একটি কথাই বলা যায় আমেরিকা একটি ইসলাম বিরোধী শক্তি এবং তারা ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপে মদদ দিচ্ছে। আমেরিকার সাথে মুসলিম বিশ্বের সখ্য নিছক লোকদেখানো এবং প্রতারণামূলক। যুক্তরাষ্ট্র এসব মুসলিম রাষ্ট্রকে একদিকে ভয় অন্যদিকে লোভ দেখিয়ে তার মতো কাজ করিয়ে নিচ্ছে। চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখুন, দেখবেন যুক্তরাষ্ট্রের দাস রাষ্ট্রগুলো হয় মুসলমানদের শাসক নয় শত্রু।

চিন্তা, বছর ১০, সংখ্যা ৯-১৩, ১৫ ডিসেম্বর, ২০০১


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।