সংকট গোড়ায়, উপরে নয়


রাজনীতির উপর তলায় আমরা যে সংকট দেখি তার গোড়া উপরে না, গোড়াতেই। অতএব গোড়া ধরে কথা না বললে আমাদের সামনে রাজনৈতিক ইস্যুটা ঠিক কী, সেটা বোঝানো কঠিন। কিন্তু আলোচনাটা উপরের ঘটনাঘটন থেকেই শুরু করা দরকার হয়ে পড়ে। নইলে সাধারণ পাঠকরা এ বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী হয় না।

রাজনৈতিক তর্কাতর্কির গোড়ায় না গিয়ে সামাজিক আলোচনা-সমালোচনা ভাসাভাসা রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে প্রধানত গণমাধ্যমই। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার ক্ষেত্রেও গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রধান। এই পরিস্থিতিতে পত্রিকায় মন্তব্যমূলক লেখা সংকটের চরিত্র ধরতে কিংবা বোঝাতে পারে না। সংকট আরও গাঢ় হতে থাকে।

ধরুন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা। আচ্ছা, আমরা কী দাবি কিংবা কী নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' কথাটা তো হাওয়াই কিছু না। সেই চেতনাটা কী ছিল? আমাদের নিজ নিজ মনগড়া চেতনার কেচ্ছার কথা বলছি না। স্বাধীনতার অর্থ ক্ষমতা, শ্রেণী বা লিঙ্গভেদে সমাজে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন রকম হতে পারে। কার চেতনা ছহি কার চেতনা ভুল সেসব তর্কও এখানে তুলছি না। স্বাধীনতার যুদ্ধ করতে হলে কারা কার বিরুদ্ধে কিসের জন্য যুদ্ধ করছে তার একটা ঘোষণা থাকে। এমন এক ঘোষণা যার মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী নিজের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ও গাঠনিক (constituent power) শক্তির আবির্ভাব ঘোষণা করে। স্বাধীনতা ঘোষণার রাজনৈতিক দিক আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু 'গাঠনিক শক্তি'  কথাটা বুঝি না। 'গাঠনিক শক্তি' নিয়ে আমাদের সমাজে আদৌ আলোচনা হয়েছে, আমার চোখে পড়েনি। একদমই আলোচনা হয়নি এবং হয়ও না। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের গোড়া বুঝতে হলে প্রাথমিকভাবে হলেও ধারণাটি সম্পর্কে পরিচয় দরকার।

প্রথমেই বুঝতে হবে স্বাধীনতার ঘোষণা কোনো ব্যক্তিবিশেষের ব্যাপার নয়, আমরা রাজরাজড়াদের ইতিহাস নিয়ে লিখতে বসিনি, এটা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ঘোষণা।  'ঘোষণা' নিয়ে আমরা এখানে পুরানা কাসুন্দি ঘাঁটতেও বসিনি। যেসব ঘোষণার কথা শুনি, সেখানে ব্যক্তির মহিমা বা ভূমিকার গৌরবকে অস্বীকার করাও আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির আবির্ভাব ও রাষ্ট্র গঠনের দিক বিচারের দিক থেকে সেসব ঘোষণা অর্থহীনও বটে। কারণ আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে  রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘোষিত হোল কিভাবে? কোন ভাষায়? যখন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের গাঠনিক শক্তির আবির্ভাব ঘটেনি, যা অনিবার্যভাবেই একটি রাষ্ট্র গঠনের দিকে ধাবিত হয় -- তখন কাগুজে ঘষণা, কিম্বা কে আগে কি দাবি করল সেইস অকল তর্ক অর্থহীন। স্বাধীনতার ঘোষণা একই সঙ্গে আসন্ন রাষ্ট্রের ভিত্তির কথাও ঘোষণা করে। গাঠনিক ক্ষমতা ধারণ করেনি বলে বাংলাদেশের সত্যিকারের স্বাধীনতার ঘোষণার আগের সব ঘোষণা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত নিদর্শন মাত্র। তার মধ্যে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর অনিবার্য আবির্ভাবের উপাদান আমরা খুঁজে পাই না, যার ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে, কিংবা যার ভিত্তিতে নতুন কোনো রাষ্ট্র জনগণ গঠন করতে পারবার কল্পনা ধারণ করতে সক্ষম হয়। গাঠনিক শক্তি সংবলিত ঘোষণা বিশেষ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে, এই ভাষা নিছকই সাহিত্য বা আবেগের ভাষা নয়।

স্বাধীনতার ঘোষণার দুটি দিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক. রাজনৈতিক দিক এবং দুই. গঠনতান্ত্রিক বা আইনি দিক (constitutional)। ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস ইত্যাদি এই দুয়ের মধ্যে হাজির থাকে, কিন্তু তারা হাজির থাকে শুধুমাত্র ধর্ম, সংস্কৃতি বা ইতিহাস হিসেবে নয়, বরং নতুন রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি উপাদান হিসেবে। সেটা কেমন, সেই বিষয়েই আজ আলোচনা।

গাঠনিক শক্তি এক কথায় ক্ষমতা। যে কোনো সংঘ, দল বা গোষ্ঠির ক্ষমতা আমরা তো হরহামেশাই দেখছি। রাজনৈতিকভাবে নিজেদের এক মনে করে, এ রকম একটি জনগোষ্ঠীর ক্ষমতাই তার গাঠনিক ক্ষমতা। যে ক্ষমতার দ্বারা তারা শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, নিজেদের রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করে। তাদের গোষ্ঠীর অন্তর্গত সদস্যদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে ইত্যাদি। গাঠনিক শক্তি রাষ্ট্রের গঠনতান্ত্রিক (constitutional) প্রশ্নের অন্তর্গত। কেই শক্তি অর্জন করা ছাড়া রাষ্ট্র নতুন করে গঠন করা যায় না।

দুই

বাংলাদেশের কনস্টিটিউশনের অনুবাদ করা হয়েছে ‘সংবিধান’- অর্থাৎ কন্সটিউট করা একটা আইনের বপিয়ের মুসাবিদা পাশ করা। এই অনুবাদের দ্বারা বোঝানো হয়েছে রাষ্ট্র গঠন নিছুই বিধান বা আইন সংক্রান্ত ব্যাপার। কিন্তু কনস্টিটিউশন তো শুধু আইন নয়- এটা ভাষা, সমাজ, ধর্ম সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি ব্যাপক প্রেক্ষাপটে বা জমিনের ঐতিহাসিক ভাবে প্রকাশিত হবার ব্যাপার। রাষ্ট্র গঠনকে তাই আইনী বা সাংবিধানিক ব্যাপারে সংকুচিত করা যায় না। তাছাড়া রাষ্ট্র গঠন জনগণের স্মৃতি ও ইতিহাস, জনগণের অভিপ্রায় ও কামনা বাসনার নানান রূপ, জনগণের সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক, ধর্মীয় নানান শক্তি ও উপাদান, জনগণের নানান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও আচার আকিদার সঙ্গে জড়িত। প্রহসন হচ্ছে যারা ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা ধারণ করেন এবং ঔপনিবেশিক ব্রিটেনকেই আদর্শ মনে করেন এমন আইনজীবীরাই বাংলাদেশের সংবিধানের মুসাবিদা করেছেন। তারা ঔপনিবেশিক চিন্তা মাথায় রেখেই আরেকটি ঔপনিবেশিক সংবিধান লিখেছেন। 

ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে পরাধীন জাতিকে শাসন করবার আইনি বিধান ছাড়া কনস্টিটিউশন কথাটার আর কোনো মানে নেই। কারণ পরাধীন জাতি তাদের জনগোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত নয়। পরাধীন জনগোষ্ঠিকে শাসনের জন্য দরকার শাসনতন্ত্র, পরাধীন জনগোষ্ঠীকে শাসন করার একটি বিধান বা আইন। বাংলাদেশের ‘সংবিধান’ এ ধরনের ঔপনিবেশিক চিন্তার দ্বারা দুষ্ট। এই ঔপনিবেশিক চিন্তা থেকেই কনস্টিটিউশনের অনুবাদ ‘ করা হয়েছে সংবিধান’ -- অর্থাৎ নিছকই বিধান বা আইন, যার দ্বারা পরাধীন জনগোষ্ঠীকে শাসন করা হয়। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে নিছকই আইনি সত্তা। কোন ইতিহাস নাই, শাসক কিভাবে শাসন করবে তার দলিল ছাড়া 'সংবিধান' আর অধিক কিছু নয়। সংবিধানের সঙ্গে সংস্কৃতি, ইতিহাস, ক্ষমতা ইত্যাদির সম্পর্ক ক্ষীণ বা অতিশয় দূরবর্তী ব্যপার। এই ভাবে একদা একটি 'সংবিধান' উকিল-ব্যারিস্টাররা পয়দা করেছিলেন। আমরা ইংরেজের জায়গায় বাদামি সাহেবদের দাস হয়েছি।

সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্র্যবোধ গাঠনিক শক্তি (constituent power) পরিগঠনের পশ্চাৎকারণ, কিন্তু যথেষ্ট কারণ নয়। ষাট দশকের পর থেকে আমাদের উপলব্ধি ঘটতে শুরু করে যে, আমরা সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানের অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা। কিন্তু শুধু আলাদাবোধ আমাদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভাবের ন্যায্যতা দেয় না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে আমাদের স্বাতন্ত্র্য এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের মীমাংসা করা গেলে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশের আলাদা আত্মপ্রকাশের প্রয়োজনীয়তা থাকত কিনা সন্দেহ। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের উপলব্ধি শুধু সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্র্যবোধ নয়, একই সঙ্গে গাঠনিক ক্ষমতার উপলব্ধিও বটে। গাঠনিক ক্ষমতাই রাষ্ট্র গঠনের ন্যায্যতা দান করে। এটা সহজেই বোঝা যায় যে যতই আমাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উপলব্ধি থাকুক, যদি সেই উপলব্ধিকে আমরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গঠনের দিকে নিয়ে যাওয়ার হিম্মত না রাখতাম, তাহলে আজ আমরা যেখানে আছি সেখানে এসে হাজির হতে পারতাম কিনা সন্দেহ।

গাঠনিক শক্তি তাহলে গঠনতন্ত্র ও রাষ্ট্র বিচারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা কতটা বাঙালি, কত পারসেন্ট মুসলমান এই তর্কের চেয়ে আলাদা। আপনি বাঙালি? হ্যাঁ। অবশ্যই। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আপনার অবিচ্ছেদ্য অধিকার আপনি রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আপনাকে নিয়ে বিশ্ব গর্ব করে। আপনি কি মুসলমান? নিশ্চয়ই। এটা আমার ধর্ম বা বিশ্বাস শুধু না, এটা আমার ইতিহাস। কারণ কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর থেকে জমিহারা যে কৃষক ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছে আমিই সেই জনগোষ্ঠী। আমি পাকিস্তান চেয়েছি, পাকিস্তান কায়েমের জন্য লড়েছি। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে জমিদারি ব্যবস্থা রদ হওয়ার মধ্য দিয়ে আমার ইতিহাসের এক পর্ব শেষ হয়েছে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমি আরেকটি বিশ্ব-ঐতিহাসিক পর্বে প্রবেশ করেছি। ইনশাআল্লাহ্, এই যুদ্ধেও আমি জিতব। আপনি কি হিন্দু? নিশ্চয়ই, আমার হাজার বছরের সনাতন লোকায়ত সংস্কৃতি আর বিশ্বাস, আমি তা নানাভাবে আমার সংস্কৃতিকে ধারণ করি। তাছাড়া সিন্ধু নদের এদিকে যারা বাস করে, ধর্ম কিংবা নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় নির্বিশেষে তারা তো সবাই হিন্দু। আপনি কি বৌদ্ধ বা জৈন? আরে, নইলে আমার বিবর্তন বুঝবেন কী করে? কিংবা আমার ভাবচর্চা ও ভাবান্দোলন? আপনি কি চাকমা, সাঁওতাল, মান্দি, রাজবংশী, ম্রং বা অন্য কোনো ক্ষুদ্র জাতিসত্তা? আলবৎ। আমরা অনেক জাতি অনেক ভাষা বিচিত্র আমাদের সংস্কৃতি? আচ্ছা, বুঝলাম। এই বিচিত্র ও বিভিন্ন নৃ-তত্ত্ব, ভূগোল, ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও পরিচয় নিয়ে আপনি বা আপনারা বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে আছেন।

কিন্তু আপনারা কি একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত? এখানে একটু থমকে দাঁড়ানো যাক। কী? রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী? হ্যাঁ, প্রশ্নটা এখানেই। সেই কথাই বলছিলাম। আপনি বাঙালি, না অবাঙালি, মান্দি নাকি মুসলমান তার বিচার তো আছেই। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, আপনারা সবাই মিলে কি একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত? নাকি আলাদা আলাদা? আপনি কি নিজেকে শুধু মুসলমান বা হিন্দু ভাবেন? নাকি আপনি ‘আমি কে, তুমি কে বাঙালি বাঙালি’ বলে নিজেদের হাতে মিডিয়া আছে বলে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলেন? কে আপনি? কে আপনারা? কী আপনাদের রাজনৈতিক পরিচয়? প্রশ্নটা এখানেই। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট কীভাবে নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে ভাবা, উপলব্ধি করা এবং সেই মোতাবেক গাঠনিক শক্তি গড়ে তোলার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত, আশা করি তা খানিকটা বোঝাতে পেরেছি।

আমরা কি আসলে একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। এটা তত্ত্ব করে বলা বা এখানে কলাম লিখে প্রমাণের বিষয় নয়। আমরা নিজেদের নিজেরাই প্রশ্ন করতে পারি। আসলেই আমি কে? কে আমি? কী চাই? কীভাবে চাই? এই বিশ্বসভায় টিকে থাকতে হলে আমার চাওয়া কেমন হওয়া উচিত যাতে ষোলো কোটি মানুষ নিয়ে আমি পরাক্রমে উঠে দাঁড়াতে পারি। আমার হুংকারে রয়েল বেঙ্গল টাইগার অন্তত প্রজাতি হিসেবে বিলুপ্ত হওয়ার আগে বুঝতে পারবে এ দেশে একদা বাঘ বাস করত।

একাত্তরে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, আমরা একই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। এই অভিন্নতাই আমাদের পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এ ঐক্যই আমাদের গাঠনিক শক্তি। এই শক্তির জোরেই আমরা যুদ্ধ করেছি। তারাই আমাদের শত্রু যারা একাত্তরে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের এই ‘গঠন’কে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তারাই মিত্র যারা আমাদের গাঠনিক শক্তিকে স্বীকার করেছে এবং শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকে ন্যায্য মনে করেছে। গাঠনিক শক্তির বিচার ছাড়া বাংলাদেশ কীভাবে রাষ্ট্র হল, কিংবা রাষ্ট্র হিসেবে আদৌ কোনো ন্যায্য প্রতিষ্ঠান কি-না সেই বিচার অসম্ভব। এই বিচারের সঙ্গে আমরা কে কতটা বাঙালি কিংবা কে কতটা মুসলমান তার কোনো সম্পর্ক নাই। আমরা একসঙ্গে দুটিই হতে পারি। কিংবা দাবি করতে পারি নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে আমরা মুণ্ডা, সাঁওতাল কিংবা অন্য কোনো জনগোষ্ঠীরই অন্তর্গত। বাঞলি মিশ জাতি ফলে ইথনিক স্বাতন্ত্র  কিংবা হতে পারে আমাদের অনেকের পূর্বপুরুষ আবিসিনিয়া, সিরিয়া, ইরাক বা ইয়েমেন থেকে এসেছে। আপনি যা খুশি তা হন, কেউই আপনাকে কামড়াতে যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, একাত্তরে যে গাঠনিক শক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল, আপনি তা ন্যায্য ভেবে সমর্থন করেন কি-না। সেই আবির্ভাবের একটা ঘোষিত দলিল আছে। আপনি কি তা মানেন? নাকি মানেন না? প্রশ্ন ঠিক এখানেই।

গাঠনিক শক্তির আবির্ভাবের ঘোষণা সংবলিত দলিলের কথাই বলছি। যদি থাকে, তাহলে হাওয়াই তর্ক করে লাভ নাই। দলিলে কী ছিল এবং দলিলের ন্যায্যতা দলিল নিজে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল কি-না, করলে কীভাবে- ইত্যাদি আলোচনা হতে পারে। সে সবই বিচারের অধীনে আনার কথা বলছি।

তাহলে মুক্তিযুদ্ধের দলিল কী? এটা একটি গুরুতর প্রশ্ন। এমন কোনো দলিল ছিল কি? ছিল। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে। এভাবেই হয়। কিন্তু তার আগে? তার আগে কি কেউ স্বাধীনতার কথা বলেনি? বলেছিল। কিন্তু আমরা যে অর্থে এখন স্বাধীনতার ঘোষণা কথাটা বলছি, সেই অর্থে নয়। সেটা স্বাধীনতার ঘোষণার দলিল হয়ে ওঠেনি। কেন? কারণ সেটাই স্বাধীনতার ঘোষণা, যার মধ্যে নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর আবির্ভাবের ঘোষণা থাকে এবং সে হাজির হয় শত্রুর বিরুদ্ধে নিজের ‘ক্ষমতা’ বা হিম্মতের চ্যালেঞ্জ দিয়ে। শুধু তাই নয়, নতুন রাষ্ট্রের গঠন অর্থাৎ স্বাধীনতার ঘোষণা একই সঙ্গে গাঠনিক শক্তির আবির্ভাবের ঘোষণা। যার দ্বারা শত্রু-মিত্র নির্ধারিত হয়ে যায়। তাহলে সেসব ঘোষণা স্বাধীনতার ঘোষণা হতে পারে না। সেসব ঘোষণার ডাকে জনগণের আবেগি সাড়া মিললেও না। কারণ সেটাই গাঠনিক শক্তি, যা একই সঙ্গে রাষ্ট্র গঠনের আগাম ঘোষণা হিসেবে হাজির হয়, নিছক আবেগ প্রকাশের জন্য নয়। শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন বলে যে দাবি উঠেছে এবং আদালত যে ঘোষণা মান্য করতে আমাদের বলছে, তা নিয়ে তর্ক থাকলেও সেটা গাঠনিক শক্তির আবির্ভাবও নয়, রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণাও নয়। শেখ মুজিব তখনও পাকিস্তানের গঠন কাঠামোর বাইরে যাননি। পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান চাইছিলেন। জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন বলে একটা দাবি আছে। কিন্তু আমরা যে অর্থে এখানে গাঠনিক শক্তির আবির্ভাব ও তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে রাষ্ট্র গঠনের কথা বলছি, জিয়াউর রহমানের ঘোষণাও তার মধ্যে পড়ে না। স্বাধীনতার ঘোষণার যে দলিলের কথা বলছি, জিয়াউর রহমানের ঘোষণা সেই প্রকার দলিলের পর্যায়ে পড়ে না। ঠিক একই কারণে শেখ মুজিবুর রহমানের যে বক্তৃতাকে 'স্বাধীনতার ঘোষণা' বলা হয়, তাকেও আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা বলতে পারি না। সে বক্তৃতা একান্তই একটি দলীয় বক্তৃতা। পাকিস্তানের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন। যদি তিনি আসলেই সাতই মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন তাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জীবিত রাখত না। আন্তর্জাতিক আইনে দেশদ্রোহিতার জন্য তাঁর ফাঁসি হোত। সেটা আন্তর্জাতিক আইনেও সিদ্ধ বলে গৃহীত হোত। অতএব শেখ মুজিবর স্বাধীনতার ঘোষক নন।

তিন

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সেটাই যেখানে বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কোনো ব্যক্তি কি এই ঘোষণা দিয়েছিল? না। কারা দিয়েছিল? ‘আমরা’। গঠনতান্ত্রিক বা আইনি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘we the elected representative of the people of Bangladesh...’ বা ‘আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ...’। এখানে ফাঁকি আছে, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ...’ বলা হয়নি, বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশের ‘নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ...’। কিন্তু সেই নির্বাচন তো বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের নির্বাচন ছিল না, ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের নির্বাচন। যারা নির্বাচিত করেছিলেন, তারা ছিলেন পাকিস্তানের নাগরিক। বাংলাদেশের আবির্ভাব তখনও ঘটেনি। পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের পাকিস্তানের গণপরিষদের জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। ফলে তারা বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধি ছিলেন না, ছিলেন পাকিস্তানের নাগরিকদের প্রতিনিধি। বিসমিল্লায় একটা বড়সড় গলদ ঘটে গিয়েছিল। যে কারণে স্বাধীনতার ঘোষণায় এই গাঠনিক শক্তির ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য ‘নির্বাচিত প্রতিনিধি’দের বিস্তর বাড়তি কথা খরচ করতে হয়েছে। তাঁরা পাকিস্তানি ছিলেন, পাকিস্তানের বাইরে কেউ না , কিম্বা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ করে পাকিস্তানের গণপরিষদের জন্য নির্বাচির হন নি। পকিস্তান মেনে পাকিস্তানের আইনী কাঠমোর মধ্যেই নির্বাচিত হয়েছিলেন।  বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনের গোড়ার গলদ এখানে।

তারপরও ইতিহাসের সত্য হচ্ছে, এ ঘোষণার অধীনেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। একে নস্যাৎ করে পাল্টা কোনো ঘোষণা দাঁড়ায়নি। সেটা হতো কি-না আমরা এখন জানি না। কারণ যুদ্ধ শুরু হওয়ার নয় মাসের মধ্যেই দিল্লির হস্তক্ষেপে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। দিল্লি এখন দাবি করে তারাই বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েছে। যে গাঠনিক শক্তির ক্ষণিক আবির্ভাব আমরা একাত্তরে দেখেছিলাম, সেটা দিল্লির শক্তির দ্বারা নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে। উই দ্য পিপল অব বাংলাদেশ বা ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ’ নিজেদের নিজেরা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গঠন করছি এবং আমাদের শক্তি বা হিম্মত নিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছি- এ কথা আমরা বলতে পারিনি। এখনও না। তাই ভারতের জনগণের কাছে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে যা ভারতই বাংলাদেশ 'স্বাধীন' করে দিয়েছে। এই দয়াপরবশ রাজনৈতিক দাবির খেসারত বাংলাদেশকে গুণতে হচ্ছে।

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গঠন করার এটা দ্বিতীয় গলদ।

কিন্তু নতুন রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হিসেবে যে তিনটি নীতি স্বাধীনতার ঘোষণায় সন্নিবেশিত হয়েছে তার তাৎপর্য অস্বীকার করার উপায় নাই। সেই তিনটি নীতি হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। রাষ্ট্র গঠন করার যে অঙ্গীকার নিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা তার ভিত্তি-উপাদান  এগুলো। এই তিন নীতি বা আদর্শ -- আবারও বলি -- হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার।

তাহলে কেউ যদি প্রশ্ন করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? এর স্পষ্ট উত্তর : সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। এই তিনটি নীতি বাস্তবায়ন ‘নিশ্চিত’ করার জন্যই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। স্বাধীনতার ঘোষণা তো তা-ই বলে। এর বাইরে স্বাধীনতার অন্য কোনো দলিল নাই।

কিন্তু আমরা তো সারাক্ষণ ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের কথা শুনি। ঠিক। কিন্তু এসব আওয়ামী লীগের দাবি। আওয়ামী লীগের কর্মসূচি। ইসলামী দলগুলো ইসলাম কায়েমের দাবি করে। আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের দাবি করে। সকলেরই রাজনীতির অধিকার আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কর্মসূচি বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি-উপাদান নয়। এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা স্বাধীনতা যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নাই। এটা আওয়ামী লীগসহ সবার কাছেই পরিষ্কার থাকা দরকার।।

আওয়ামী লীগ যা বলে, ইতিহাস বরং তার উল্টা। যারা আওয়ামী কর্মসূচীকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে দাবি করে, তারা আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা করে। প্রমাণ ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণা। এটাই স্বাধীনতার দলিল। এর ভিত্তিতেই যুদ্ধ হয়েছিল।

ইতিহাসের এসব সত্য সম্পর্কে সচেতন না হয়ে রাজনীতির ওপর তলার কেচ্ছা-কাহিনী আমাদের কোনো কাজে আসবে না। সমস্যা গোড়ায়। গোড়া সাফ করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নাই।

একাত্তরে যে গাঠনিক ক্ষমতার ক্ষণিক আবির্ভাব আমরা দেখেছিলাম, তাকে পুনরুদ্ধার সোজা কাজ নয়। সেটা এখন অনেক কঠিন। এটাও ভাবা দরকার, স্বাধীনতার এই তিন নীতির ভিত্তিতে আমাদের আবার ‘এক’ হয়ে দাঁড়ানোর কোনো সম্ভাবনা আছে কি-না। নাকি পুরনো যুদ্ধ সম্পূর্ণ করা ছাড়া রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব এখন অসম্ভব হয়ে গিয়েছে।

আগামী দিনের রাজনীতিই সেটা বলে দেবে।

১৪ নভেম্বর ২০১৪/ ৩০ কার্তিক ১৪২১, শ্যামলী, ঢাকা

(এই লেখাটি ১৫ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তবে সে সময় তাঁরা রাজনৈতিক কিছু ক্ষেত্রে সম্পাদনা  করেছিলেন, সেই সকল ক্ষেত্রে মূল লেখাই পেশ করা হোল)

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।