তাঁত ও তাঁতী অর্থনীতি, রাজনীতি ও জীবন


(দেশের বিভিন্ন এলাকার তাঁতীদের অবস্থা সম্পর্কে জানার সুযোগ সাধারণত হয় না। তবু তাঁত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাঁতীদের সারিষ, সুতানাচার অভাব, পুঁজির টানাটানি ইত্যাদি খবর মাঝেমধ্যে পত্রিকায় আসে। যেটা আসে না সেটা হোল তাঁতখাতের হালহকিকত। আমরা কি এগুচ্ছি নাকি পিছিয়ে যাচ্ছি তার হদিস নেই। এই সব কথা ভেবে ভীত ও তাঁতীদের নিয়ে এই ক্রোড়পত্র। পাঠকদের

তাঁতীদের জীবন এবং তাঁতখাতের অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করেছি আমরা। আমরা মনে করি আমাদের শিল্পায়নের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে তাঁতখাতের বিকাশের মধ্যে এবং এ নিয়ে আরো ব্যাপক ভাবনাচিন্তা তর্কবিতর্ক হওয়া দরকার। ব্যাপারটা শুধু তাঁতীদের ব্যাপার নয়। এটা আমাদের জাতীয় প্রশ্ন। এই খাত সম্পর্কে পাঠকদের আগ্রহ যদি আমরা জাগাতে পারি তার জানোই। এই প্রয়াস।)

তাঁত সম্পর্কে তিনকথা

বাংলাদেশের এই ভূখণ্ডে একসময় অপরূপ মসলিন বোনা হোত, দারুন সব কাপড় বোনা হোত যার তুলকালাম কদর ছিল ইউরোপে — তাঁত নিয়ে কথা বললেই এই রকম নস্টালজিয়া বা পেছনের কাল্পনিক অতীতের জন্য আকুতি দিয়ে কথা শুরু হয়। গলা কাঁপে এবং যারা আবেগ প্রবণ তাঁদের চোখ ছলছল করে। সেই সময়ের বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে চমৎকার কাপড় বুনতো, সেটা সত্যি। কিন্তু তার মানেই কিন্তু এটা নয় সেই সময় বাংলার সমাজ, রাজনীতি সংস্কৃতি স্বর্ণময় ছিল এবং তাঁতীদের অবস্থা আজকের চেয়ে সুখের ছিল।

তাঁতীরা শুধু সেই পুরনো কালেই কেবল দারুন সব কাপড় বুনতেন আর এখন সব ভুলে গেছেন এটাও একদম বাজে কথা। সেই কৃৎকৌশল আর সেই দক্ষতা এখনও আমাদের তাঁতীদের আছে। অনেক ক্ষেত্রে কৃৎকৌশলের অগ্রগতি হয়েছে। নতুন টেকনোলজি এসেছে। যেমন বিদেশ থেকে এসেছে জ্যাকার্ড মেশিন । শাড়ীতে পাড়ের যে মনোলোভা কাজ মন আচ্ছন্ন করে দেয় সেটা এই জ্যাকার্ড দিয়ে তৈরী হয়। পা দিয়ে ডবি মেরে শাড়ীর শরীরে যেসব ডিজাইন তোলা হয় সেই টেকনোলজিটাও এদেশের নয়, বাইরের। এতে কাপড়ে বৈচিত্র্য এসেছে, ডিজাইনে নতুনত্ব

ঘটাতে পেরেছেন তাঁতীরা। সেদিক থেকে দেখলে মসলিনের যুগ থেকে আমাদের তাঁতীরা পিছিয়ে পড়েন নি। তাঁদের নিজের উদ্ভাবনী ও দক্ষতা দিয়ে তাঁরা বিস্তর অগ্রগতি সাধন করেছেন। কিন্তু তবুও সামগ্রিক ভাবে তাঁতখাত মন্থর, তদুপরি এর ওপর বেশ কিছু বিপদের খাড়া ঝুলছে। বিকাশের কৃৎকৌশলগত শর্ত ও দরকারি দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁতখাত মার খেয়েছে বার বার। এর জন্যে প্রথমত দায়ী আমাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা এবং দ্বিতীয়ত সরকারী নীতি এবং তৃতীয়ত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং এর আধিপত্য। তাই তিনটি দিক নিয়েই কিছু মন্তব্য করবো এখানে।

রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা

আমরা আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কি অবস্থা সেটা সরাসরি স্পষ্ট ভাবে জাতীয় ক্ষেত্রে কখনোই বিতর্ক করি নি এবং একটা জাতীয় মতৈক্য সৃষ্টির চেষ্টাও করি নি। স্নায়ুযুদ্ধের যুগে একটি দেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কি করা কর্তব্য সেটা “মতাদর্শ” দিয়ে স্থির করা হোত। বলা হোত যে, এমনকি এখনো বোধহয় বলা হয়, পৃথিবী দুই শিবিরে বিভক্ত। একদিকে আছে “পুঁজিতন্ত্র” আর অপরদিকে “সমাজতন্ত্র”। এখন এই দুই শিবিরের একটাকে বেছে নিতে হোত। “পুঁজিতন্ত্র” বা “সমাজতন্ত্র” নামক শব্দগুলোর অর্থ কি, কেন একটি ব্যবস্থা অন্য ব্যবস্থার চেয়ে ভাল বা মন্দ ইত্যাদি বিষয় যুক্তি বা বিজ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে স্থির করা হোত না। হোত আবেগ দিয়ে এবং অধিকাংশ সময় গায়ের জোরে।

দেশ স্বাধীন হবার পর অনেকটা গায়ের জোরেই আমরা “সমাজতন্ত্র” কায়েম করার পণ করেছিলাম। স্বাধীনতা সংগ্রামে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আধিপত্য প্রবল ছিল। এই শ্রেণীর আধিপত্য প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় সত্তরের শুরু থেকে। স্বাধীনতা সংগ্রামে এই শ্রেণীর আধিপত্য থাকলে শ্রেণীগত কারণেই সমাজতন্ত্র একটা শ্লোগান আকারে ওঠে। কিন্তু এই সমাজতন্ত্র এমনই এক সমাজতন্ত্রের ধারণা যার সঙ্গে দেশের বাস্তব উৎপাদন বা উৎপাদন সম্পর্কের কোন যোগ নেই। কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে উৎপাদনের যোগ ক্ষীণই হয়। একটা বিমূর্ত আকাঙ্খা এবং শ্রেণীগত ক্রোধ থেকে সমাজতন্ত্র নামক ধ্যান ধারণা আমাদের দেশে গড়ে ওঠে। এই ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত কেবল ততোটুকুই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পেরেছে যতক্ষণ সেই আকাঙ্খা ও ক্রোধের তাগিদে সে গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্যে প্রগতিশীল কোন অর্থনৈতিক নকশা সমাজতন্ত্র পয়দা করতে পারে নি। এই শ্রেণীর পক্ষে সেটা সম্ভবও ছিল না।

তবে আশা ছিল যারা নিজেদের মার্কস বা লেনিনের অনুসারী বলে মনে করেন তাঁরা দূরদর্শী হবেন। আসলে ৬৭ সাল পর্যন্ত এদেশের কমিউনিস্ট পার্টি “সমাজতন্ত্র” কায়েমের কথা বলে নি। দেশের বাস্তবতা এবং ঐতিহাসিক মুহূর্ত বিচার করে তাঁদের মনে হয়েছে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করাই হচ্ছে কমিউনিস্টদের কর্তব্য। এর মানে হোল পুরনো ও পশ্চাৎপদ উৎপাদন সম্পর্ক, তাকে আধা-সামন্তবাদ বা সামন্তবাদ যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ঝোঁটিয়ে বিদায় করে দিয়ে একদিকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা আর অপর দিকে পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের পথ ত্বরান্বিত করা। এটাই ছিল মার্কস এবং লেনিনের ধ্রুপদী পথ। দ্রুত ও ত্বরান্বিত পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের মধ্য দিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে সমাজতন্ত্রের শ্লোগান বা কর্মসূচী মার্কস এবং লেনিনের বিচারে প্রতিক্রিয়াশীল বলেই গণ্য। কিন্তু দেখা গেল উনসত্তরের বিপুল গণ জাগরণের পর থেকে পার্টির কাগজে কলমে কমিউনিস্টরা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা বললেও তাদের প্রকাশিত নিবন্ধে, বক্তৃতায়, শ্লোগানে, আচরণে, হাবভাবে, কথাবার্তায় সমাজতন্ত্র কায়েম করাকেই কর্তব্য বলে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। এই সকল নানাবিধ প্রক্রিয়ায় যে রাষ্ট্র কায়েম হোল দেখা গেল সেখানে সকল অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার “রাষ্ট্রীয়করণ” হয়েছে। সমাজতন্ত্রের ছুতোয় কিছু কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ব হলেও সেটা বড়ো ধরণের কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো না যদি না সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের এই “রাষ্ট্রীয়করণ” না হোত। এর ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত সকল সিদ্ধান্ত ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে আমলাদের হাতে, আমলাতন্ত্রের জাঁতাকলে। গণতন্ত্রের বদলে কায়েম হয়েছে একটা পরগাছামূলক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই জোয়াল আমরা এখনো ভাঙতে পারি নি। আমরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আমলাতন্ত্রীকরণকেই “সমাজতন্ত্র” বুঝে থাকি। এটা বুঝি না যে রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক না হয়। তাহলে যে কোন রাষ্ট্রায়ত্ব খাত মানে আমলাদের খাত, ইত্যাদি।

এইসকল রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার অসম্ভব নেতিবাচক ফল ভোগ করেছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। চাষী, তাঁতী, কামার, কুমার, জেলে বা সোজা কথায় গ্রামের বিকাশমান পুঁজিপতি শ্রেণী। যেহেতু পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশকে আমরা অনৈতিহাসিক ভাবে যে কোন অবস্থাতেই মন্দ বলে ধরেই নিয়েছি এবং পুঁজিপতির প্রতি একটা নৈতিক ঘৃণা পোষণ করাকে ধর্ম আকারে গ্রহণ করেছি ফলে একজন তাঁতী পুঁজিপতি হয়ে উঠছে এটা ভাবতেই আমাদের গা রি রি করে। গ্রামে পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের কোন সম্ভাবনাকেই আমরা ইতিবাচক লক্ষণ হিসাবে গ্রহণ করি নি বরং প্রাণপণ বিরোধিতা করেছি।

যারা মার্কস এবং লেনিনের নামে এইসব ঢালাও ভাবে পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল বস্তাপচা তত্ত্ব ফেরি করেছেন। তাদের জন্য লেনিনের একটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

“পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের প্রগতিশীলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্যে যে কেউই নিজে নিজে ক্ষুদে উৎপাদকদের বিস্ময়কর বিভাজন প্রক্রিয়ার একটা ছবি নিজের মনে এঁকে নিতে পারে, যা কিনা প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক(patriarchal) কৃষির ফল। পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ জীবন ও অর্থনীতির হাজার বছরের পুরনো নিয়ম আর অনড়তার প্রাচীন ধরণটার ভিত্তিটাকেই ভেঙে ফেলে, ভেঙ্গে ফেলে মধ্যযুগীয় ব্যবধানের পেছনে উদ্ভিদসুলভ কৃষকজন্মের নিস্তরঙ্গ জীবন, আর তৈরী করে নতুন শ্রেণী যারা নিজেদের তাগিদেই সামগ্রিক অর্থনৈতিক জীবন (শুধু অর্থনৈতিকই নয়) ও সারা দুনিয়ার সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ, ঐক্য এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের দিকে ছুটে যায়।” এর পর লেনিন বলছেন যে ক্ষুদে কারিগর এবং তাঁতীদের মতো ক্ষুদে পুঁজিপতিরা যখন তাদের সংকীর্ণ ও ক্ষুদ্র জগত থেকে বেরিয়ে প্রথমে জাতীয় অর্থনীতি এবং পরে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয় তখন তাদের মধ্যে শ্রেণী হিসাবে একটা ইতিবাচক রূপান্তর ঘটে। এইসকল ক্ষুদে শিল্পপতিদের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ও পুঁজিতন্ত্র তাদের পেছনের অবস্থান থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে এনে একটা ঐতিহাসিক কাজ সম্পাদন করে। জনগণের অগ্রসর অংশ যে সকল বিষয়ের মুখোমুখি হয় তাদেরকেও সেই সকল বিষয়ের মুখোমুখি হতে বাধ্য করে। [১]

এই প্রতিকূল বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশ সত্ত্বেও বাংলাদেশের তাঁত খাত কোন কোন এলাকায় বিস্ময়কর ভাবে বিকশিত হয়েছে। পাবনা নরসিংদি প্রভৃতি এলাকায় পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের মাত্রা বহুদূর গড়িয়েছে এবং বাংলাদেশের তাঁতখাত একটা উল্লম্ফনের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সেটা বানচাল হয়ে যাবে যদি আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা অর্জনের পাশাপাশি দুটো হুমকির মোকাবেলা করতে না পারি। তার একটি হচ্ছে সরকারি নীতি এবং দ্বিতীয়টি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। এখন একে একে সেই দুটো দিক সম্পর্কে বলছি।

সরকারি নীতি

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আমলাতন্ত্রীকরণের সবচেয়ে দৃশ্যমান এবং নষ্ট দিক হচ্ছে সমিতি। তাঁতীদের নামে এর আগে ঋণ দেয়া হয়েছে। আমলাতান্ত্রিকতার সঙ্গে দুষ্ট-রাজনীতি ফলে সেটা লুটপাট হয়েছে। দ্বিতীয় দৃশ্যমান দিক হচ্ছে বিসিক বা হ্যান্ডলুম বোর্ডের মতো দরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এইসব প্রতিষ্ঠানে দক্ষ মানুষ আছেন কিন্তু আমলাতান্ত্রিকতার টানাপোড়েনে তাঁরা কোন ভূমিক রাখতে পারছেন না। যে রাষ্ট্র কায়েম হোল দেখা গেল সেখানে সকল অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার রাষ্ট্রীয়করণ হয়েছে। সমাজতন্ত্রের ছুতোয় কিছু কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ব হলেও সেটা বড়ো ধরণের কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো না যদি না সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের এই “রাষ্ট্রীয়করণ” না হোত। এর ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত সকল সিদ্ধান্ত ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে আমলাদের হাতে, আমলাতন্ত্রের জাতাকলে।

বাংলাদেশের হস্তচালিত তাঁতের এলাকাওয়ারী অবস্থান

জেলা               ইউনিটি                মোট তাঁত           উৎপাদক্ষম         মোট তাঁত

             
  সংখ্যা % সংখ্য % সংখ্যা %
ঢালা ৫২৫৮৯ ২৬.৬ ১,২০,৪৬৩ ২৭.৬ ৮৮৫৮৬৭ ৩৩
পাবনা ১৯৮৫৩ ১০.১ ৮৬০৬৩ ১৯.৭ ৫৬০১৫ ২১.৬
কুমিল্লা ৩০০৩৪ ১৫.২ ৫৯৮৬৮ ১৩.৭ ৪০৬২৭ ১৫.৬
টাঙ্গাইল ১৫৪২১ ৭.৮ ৩৭৪০৬ ৮.৬ ২১.০৫১ ৮.১
কুষ্টিয়া ১০৫৯৯ ৫.৪ ২০০৮০ ৪.৬ ১১,০৮৪ ৪.৩
যশোর ১০৮৮৭ ৫.৫ ১৫৭২৬ ৩.৬ ৮১২৬ ৩.১
বরিশাল ৬৯১২ ৩.৫ ১৪২৬৭ ৩.৩ ৭১৭১ ২.৮
ফরিদপুর ১২২৬৭ ৬.২ ১৭০৬৯ ৩.৯ ৬২২৭ ২.৪
খুলনা ৮৪৬৮ ৪.৩ ১২৬৮০ ২.৯ ৫২২৭ ২.০
  

সরকারি নীতির দিক থেকে এখনকার সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হোল বিটিএমসিভুক্ত ও বেসরকারি সুতাবাকলগুলোর সঙ্গে তাঁতখাতের স্বার্থের সংঘাত। তাঁতখাতকে যদি বিকশিত হবার পথ করে দিতে হয় তাহলে অবশ্যই সুতা ও অন্যান্য উপকরণের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে এবং উন্নতমানের সুতার আমদানির ওপর অনর্থক নিষেধ বা বাধা সরিয়ে ফেলতে হবে। অবাধ আমদানির আমরা পক্ষপাতি নই। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগী করে গড়ে তোলার জন্যে তাঁতখাতের সুতাসহ যা কিছু উপকরণ দরকার তার মূল্য কিছুতেই প্রতিযোগী দেশগুলোর মূল্যের চেয়ে বেশী হতে পারবে না। বস্ত্রশিল্প রক্ষা করার নামে তাঁতীদের প্রয়োজনীয় সুতা ও অন্যান্য উপকরণ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। অথচ কিছুদিন আগের বাজেট ঘোষণার মধ্য দিয়ে বোঝা গেল এই হুমকিটা তাতখাতের ওপর এখনো ঝোলা রয়েছে।

আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং এর আধিপত্য

তাঁতখাতের ওপর দ্বিতীয় যে হুমকিটা ঝুলে আছে সেটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্তি তাঁতখাতের জন্যে ভাল বা মন্দ দুটো ফলই আনতে পারে। সেটা একমাত্র নির্ভর করবে সরকারি নীতির ওপর। যদি সরকারি নীতি তাতখাতের অনুকূল না হয় তাহলে তাঁতে তৈরী কাপড়ের দাম বেশী হবে এবং জনগণের চাহিদার কিছু অংশ মিটবে কলগুলোর কাপড়ে আর অধিকাংশই বিদেশী কাপড়ে। ভারত থেকে কাপড় আমদানি হয়ে আসার কারণ হচ্ছে কাপড়ের দাম কম। ভারতের তাঁত ও মিলে তৈরী কম দামি কাপড় বাংলাদেশের তাঁতে তৈরী কাপড়ের সঙ্গেই বিশেষভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা। তবে বিশেষ যে হুমকির প্রতি আমাদের এখনই দেওয়া দরকার সেটা হচ্ছে উরুগুয়ে রাউণ্ডের আলোচনা নিষ্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে যে সমঝোতা চুক্তি হতে যাচ্ছে গাট (GATT : General Agreement on Tariffs and Trade) নামে পরিচিত, তার ফল আমাদের দেশের ওপর কি হয়। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অবাধ বাণিজ্যের জন্যে যে জোর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে সেটা আসলে অবাধ বাণিজ্যের জন্যে নয়, বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো যেন “মুক্ত” ভাবে পৃথিবীর যে কোন দেশে অবাধে বিচরণ করতে পারে তার জন্যে দাবি। যেটা দাঁড়াবে সেটা হোল ক্ষুদে উৎপাদকদের বাজারের জায়গায় কর্পোরেশনগুলোর একচেটিয়া প্রতিষ্ঠা। এটাকেই বলা হচ্ছে “মুক্ত বাজার”। বহুজাতিক কর্পেরেশনগুলোর স্বার্থে শৃঙ্খলিত বাজারকেই “মুক্ত বাজার” হিসাবে দাবি করা হচ্ছে।

বাণিজ্য ও শুল্ক সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশের তাঁত শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। এর কারন হোল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগী করে গড়ে তোলার জন্যে কোন পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ আমরা নিচ্ছি না। এমনকি পুরো বস্ত্র শিল্পে নতুন আন্তর্জাতিক চুক্তির ফল কি হবে সে বিষয়েও নীতি নির্ধারকদের মহলে কোন উচ্চবাচ্য নেই। এতো বড়ো একটা আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়তে বাধ্য সে বিষয়ে কোন আলোচনাই নেই। এটা মারাত্মক ও বিপজ্জনক নীরবতা। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারের কক্ষপথে প্রবেশ করলেই সেটা বাংলাদেশের জন্যে ক্ষতিকর হবে তার কোন যৌক্তিকতা নেই। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রশ্নে আমাদের কোন প্রকার প্রস্তুতিই নেই, কোন সচেতনতা নেই, কোন ভবিষ্যত ভাবনা নেই। এই ঔদাসীন্য আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিকে লাটে তোলার জন্য যথেষ্ট, তাঁতখাত তো কোন ছার।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে গত দেড় দশক রপ্তানীমুখী উন্নয়ন নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এর মানে কিন্তু এই নয় যে আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগে বাংলাদেশকে এমন একটা জায়গায় দাড় করানো যাতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ একটা শক্ত জায়গায় দাড়িয়ে বিশ্ববাণিজ্যে অংশ গ্রহণ করতে পারে। এ মানে হোল পুঁজিকে কম দামে শ্রমশক্তি শোষণের ব্যবস্থা করে দেয়া এবং বাংলাদেশ থেকে কাঁচামাল বা তৈরী পণ্য কম দামে আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ করা। কম দামে ঝামেলা ছাড়া শ্রমশক্তি শোষণের জন্য “রপ্তানী প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল” প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ওদিকে ক্রমাগত বাংলাদেশী মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানীযোগ্য কাঁচামাল ও পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য কমানো হচ্ছে। সেই কারণে রপ্তানীমুখী উন্নয়নের মডেল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের জন্যে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে। এই নীতি বাতিল করতে হবে।

কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমরা রপ্তানি চাইবো না এবং রপ্তানি বৃদ্ধির জন্যে যথাসাধ্য চেষ্ট করবো না। অবশ্যই করবো। কিন্তু দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির বিকাশের প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে রপ্তানিমূলক খাতগুলোকে শুধু বিদেশের বাজারের সঙ্গে যুক্ত করে রাখার নীতি ও প্রক্রিয়া মারাত্মক ক্ষতিকর। দেখা দরকার এই খাতগুলোর সঙ্গে দেশের অন্যন্য শিল্পের সম্পর্কটা কি। ধরা যাক গার্মেন্ট। গার্মেন্ট তাঁত বা বস্ত্রকল কোনটির কাছ থেকেই কাপড় নেয় না। এটা হতে পারে না। সরকার বাধ্যতামূলক ভাবে কমপক্ষে পনোরোভাগ কাপড় দেশের ভেতর থেকে সংগ্রহের কথা বলেছেন। যদিও এটা বলা হয়েছে বস্ত্রকলগুলোর স্বার্থের কথা ভেবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁতজাত কাপড়ের ব্যবহারকেও অনেকক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করতে হবে।

আভ্যন্তরীণ শ্রমবিভাগের দিক থেকে সুতাকল ও তাঁতের সম্পর্ক বিচার করতে হবে এখন যেভাবে করা হচ্ছে তার সম্পূর্ণ উল্টো ভাবে। শক্তিশালী করতে হবে আগে তাঁত এবং প্রয়োজনে পাশাপাশি বস্ত্র শিল্পকে। সুতাকল এদের চাহিদা মেটাবে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা মূলক মূল্যে। শুল্ক কাঠামো ও সংরক্ষণ নীতির আড়ালে দাঁড়িয়ে সুতাকলগুলো অনেক ক্ষেত্রে দেশের বোঝা হয়ে দাড়িয়েছে। অধিকাংশ সুতাকলের বর্তমান যে অদক্ষতা ও ব্যর্থতা সেটা পোষা কোন বিচক্ষণ নীতি হতে পারে না।

সূত্র: [১] THE DEVELOPMENT OF CAPITALISM IN RUSSIA, — LENIN COLLECTED WORK, VOLUME-3 PROGRESS PUBLISHERS

 

চিন্তা, বছর ২, সংখ্যা ২৩, ১৫ শ্রাবণ, ১৪০০, ৩০ জুলাই, ১৯৯৩

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।