কলকাতা ব্যাশিং
১. কলকাতা ব্যাশিং
কলকাতা ব্যাশিং হীনমন্যতা
কলকাতা এটা পারে না ওটা পারে না বলা আসলে ছেলেমানুষী ও হীনমন্যতা। আরেকটি কথা, কারও কথায় অমত থাকলে প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে তাকে ছোট করার জন্য খামাখা তর্ক করাও তুমুল বালখিল্যতা।
আসলে শেক্সপিয়ায়ের অনুবাদ ঢাকা কিম্বা কলকাতা কোত্থাও ভালভাবে হয় নি। তো কি হয়েছে তাতে? কাজটা করা গেলে ভাল হোত। কিন্তু এখন ২০২৪ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের পর গাজায় গণহত্যা চলছে এবং হিন্দুত্ববাদী ভারত ছুরি শানাচ্ছে – ভূরাজনীতি প্রতিটি জনগোষ্ঠিকে তাদের অবস্থান এবং কাজের ক্ষেত্র পুনর্বিন্যস্ত করতে বাধ্য করছে। তাই ভাবতে হবে শেক্সপিয়ার আমাদের এখনকার প্রায়োরিটি কিনা!!
দ্বিতীয়ত, ঢাকা বড় জোর শক্তি-সুনীল-উৎপলদের কলাকাতা চেনে। যদি চিন্তা, মননশীলতা ও ইতিহাস চর্চার দিক থেকে বিচার করি তাহলে কলকাতা ঐতিহাসিক কারণে আমাদের চেয়ে কমপক্ষে দুই শ বছর এগিয়ে আছে। কলকাতাতে মোকাবিলা করবার পথ চিন্তা করবার ক্ষমতা অর্জন। ফেইসবুকে খোঁচাখুঁচি করা না।
ভুলে গেলে চলবে না, কলকাতাই হিন্দুত্ববাদেরও সূতিকাগার। দিল্লির অধীনে থেকে কলকাতা নিজের ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সত্তা হারাচ্ছে। নিজেকে উদ্ধার ও বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস কলকাতায় যদি ইন্তেকাল করে থাকে তাহলে হিন্দুত্ববাদের করুণ পরিণতিতে কলকাতা অচিরেই তুচ্ছ মফস্বলে পর্যবসিত হবে। সেটা বড় বাংলা ও বাংলাদেশের জন্য ভাল খবর নয়।
তাই কলকাতা ব্যাশিং বাজে জিনিস। হীনমন্যতা।
নিজেকে বড় করুন।
২. ক ল কা তা ব্যা শিং
লক্ষ্যে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা থাকা দরকার
কলকাতা ব্যাশিং-এর পজিটিভ দিক যদি থাকে সেটা হোল দিল্লি ও হিন্দুত্ববাদের আধিপত্য বোধের উপলব্ধি এবং কলকাতাকে অতিক্রম করে যাবার জন্য বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মনীষার বিকাশকে ঢাকা কেন্দ্রিক গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা। সেটা বাস্তবায়িত করবার একমাত্র পথ বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা, সজীব চিন্তা, প্রজ্ঞা ও মনীষার বিকাশে বদ্ধ পরিকর হওয়া। সেটা বড় কাজ । হীনমন্যতা দুষ্ট কলকাতা ব্যাশিং-এ কাজ হবে না।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর মুসলমান দীর্ঘকাল ইংরেজি শেখে নি। যখন একশ বছর পর শিখতে এল ততোদিনে বাংলা ভাষার ভিত্তি বা গড়ন কলকাতা কেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে, তাকে বৃহত্তর বাংলার উপযোগী করে তোলার কাজ এখন অনেক কঠিন, অথচ অনেক বড় দরকারি কাজ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য বলা যায়।
কলোনিয়াল শক্তির তাঁবেদারির ফল হিশাবে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথদের জন্ম হয়েছে। তালিকা দীর্ঘ। সেই জন্যই বলেছি কলোনিয়াল শাসনের ফল হিশাবে ঐতিহাসিক কারনেই বাংলাদেশের জনগণ দুইশ বছর পিছিয়ে আছে। আগাম ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ পাওয়ায় পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের এখন আমরা পাশ্চাত্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সামনের সারিতে দেখি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী বাঙালি ডায়াস্পরা রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ নাই, পশ্চিম বাংলা আছে। সেই জায়গায় পৌঁছাতে চাইলে ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং পরিশ্রম দরকার। সবার আগে দরকার সুস্পষ্ট লক্ষ্য এবং তা অর্জন।
এটা ঠিক বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে পড়াশুনার আগ্রহ আগের চেয়ে বেড়েছে। সত্তর আশির দশক এমনকি নব্বই অবধি সুনীল-শক্তি-উৎপল-বিনয়দের কবিতা মুখস্থ আবৃত্তি করা এবং কৈশোর ও যৌবনে প্রেমে পড়ার যে আধিক্য দেখা যেত, মনে হয়, সেই কালপর্ব আমরা পার হয়ে এসেছি। একাত্তরের পর এই দেশের তরুণ কবিরা কলকাতার কবিদের নিকৃষ্ট অনুকরণ করে। বেইলী রোডের নাটক পাড়ায় থিয়েটার করে বাংলাদেশ উদ্ধার করে দেবার কালপর্বও বোধ হয় বাংলাদেশ পার হয়ে এসেছে। কিন্তু তার স্থান নিয়েছে টেলিভিশান ও সিনেমা। শিল্প-সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নাই। কিন্তু এই সেকুলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি অধিকাংশ সময় সাধারণ মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভাষার প্রতি বিরূপতা এবং কলকাতাতে অণুকরণ করেছে। কলকাতাকেই আদর্শ মেনেছে। আর ছিল তরুণদের কলকাতার স্বীকৃতি পাবার তাগিদ। ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণাই ছিল সেকুলারিজমের সংজ্ঞা, সাহিত্যের আদর্শ। ঔপবেশিকতার দীর্ঘ জের কাটিয়ে উঠে সচেতন ও সজ্ঞান হওয়া সহজ ছিল না, সেটা বিবেচনায় নেওয়া যায়। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে চিন্তা ও মননশীলতার যে দুর্ভিক্ষ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা দখি, সেটা অবিশ্বাস্য।
এর রাজনৈতিক ফল হয় মারাত্মক। তরুণরা যখন বুঝতে পারে না কোনটা শিল্প, সাহিত্য, নান্দনিকতা আর কোনটা চিন্তাশীলতা, নিজেদের রাজনৈতিক সত্তার বিকাশ বা আত্মসচেতন হবার প্রক্রিয়া – তখন নিজেদের 'জ্ঞানী' প্রমাণ করবার হন্য নেইমড্রপিং – অর্থাৎ বড় বড় পণ্ডিতের নাম আউড়িয়ে নিজেকে জ্ঞানী প্রমাণ করার খামাখা ভাঁজ বাড়ে। বিভিন্ন লেখকের দোহাই দিয়ে সস্তা ও চটকদার কথার আড়ম্বর বাড়ে। এই হীনমন্যতা থেকে তরুণদের মুক্ত হতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি উচ্চারিত হলে তা মানুষের বুদ্ধি ও হৃদয় উভয়কেই আলোড়িত করে। তাকে নান্দনিক রস সহ হাজির করতে পারার জন্য বড় প্রতিভা চাই। যাকে পছন্দ হয় না তাকে ফেইসবুকে দুইটা গালি দিয়ে শূকরছানার মতো যে প্রভূত আনন্দের নেশা তরুণদের মধ্যে তৈরি হয়েছে সেটা বড় কাজের আকাঙ্ক্ষা নয়। এই অসুখ থেকে মুক্ত হতে হবে।
তরুণদের চিন্তা প্রকাশের ভাল মাধ্যম ফেইসবুক, কিম্বা অন্যান্য সোশাল নেটওয়ার্ক। তরুণ বয়সে আমরা এই সুযোগ পাই নি। চিন্তার বিকাশের জন্য সোশাল নেটওয়ার্ক সফল ভাবে ব্যবহারের বিপুল সুযোগ আছে বটে, কিন্তু সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাহিত্য কিম্বা জ্ঞানচর্চার পরিসর না।
চিন্তার অক্ষমতা কোন জনগোষ্ঠির জন্যই অস্বাভাবিক কিম্বা অনৈতিহাসিক কিছু না, বিশেষত যদি আমরা উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং এখনকার অবস্থা বিবেচনায় রাখি। আমাদের অনেক কঠিন ইতিহাস পাড়ি দিতে হচ্ছে। কিন্তু চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে আমাদের দ্রুত সক্ষম হয়ে উঠতে হবে এবং সেটা হতে হবে বাংলা ভাষায় – তরুণদের মধ্যে এই ভাবনা ও সংকল্পের অনুপস্থিতি ভীতিকর। ভাষা নিয়া পরীক্ষা নিরীক্ষা ভাল, কিন্তু সেটা যদি স্রেফ যথেচ্ছ বানান চর্চা হয় কিম্বা মুখের ভাষাকে জবরদস্তি বাংলা ভাষায় ঢোকানোই সাহিত্য হয়ে ওঠে, তাহলে তা বিপদের কথা। সাহিত্যকে মুখের ভাষার কাছাকাছি নামিয়ে আনতে হবে, যদি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও ইংরেজদের হাতে তৈরি বাংলা গদ্যকে আমরা জনগণের ভাষায় রূপ দিতে চাই।
সাহিত্যের বিকাশ ভাষাকে দর্শন ও বিজ্ঞানচর্চার জন্য উপযুক্ত করে তোলে। ভাষা ভাঙতে পারার জন্য নান্দনিক ও সাহিত্যিক প্রতিভা জবরদস্ত দরকার। তরুণদের অনেককে আমি সেই জন্য পছন্দ করি। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে ভাষা নিয়ে অনেকের কাজ যারপরনাই ইয়ার্কি হয়ে যায়। অথচ সাহিত্যের বিকাশ মানেই ভাষার বিকাশ। আর ভাষার বিকাশ মাত্রই একটি জনগোষ্ঠির চিন্তার ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বিকাশ।
এবং ভাষার বিকাশ একটি ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের শর্ত তৈরিও বটে।
৩. ক ল কা তা ব্যা শিং
ক্ষুদে জমির মালিকদের জমিদারতন্ত্র
ঔপনিবেশিক আমল থেকে উপমহাদেশের পুরানা প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক কলোনিয়াল সমাজ ভাংছে, বাংলাদেশ তার বাইরে না। জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েম হয়েছে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ও পাকিস্তান আমলে নতুন ভূমি আইনের মধ্য দিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের আমল থেকেই ক্ষুদে জমিওয়ালাদের সমাজ ব্যবস্থা এখানে কায়েম হয়েছে, একাত্তরে তার কোন বদল হয় নি। তাই আমরাও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছোট ছোট পাড়ার মাস্তান হয়েছি। গ্রুপে চলি, সিন্ডিকেটে ভাবি। ক্ষুদে জমির মালিকানা জাত পেটিবুর্জোয়া চিন্তা ও সংস্কৃতি ঐতিহাসিক কারণেই আমাদের চিন্তাচেতনার প্রধান বৈশিষ্ট্যসূচক দিক বা ‘খাসিলত’ হয়ে উঠেছে। এর ব্যতিক্রম ঘটাতে হলে যে শিক্ষা, প্রজ্ঞা ও আত্মসচেতনতা দরকার, সেটা আমরা আজও অর্জন করতে পারি নি। এর প্রমাণের জন্য গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। কোন একটি বিষয় নিয়ে কেউ কিছু বললে যেভাবে খোঁচাখুঁচি শুরু হয় তার দ্বারা বোঝা যায়।
এই বাস্তবতার কারণেই ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ চিন্তা ও মানসিকতার পেটি বুর্জোয়া উগ্র বাঙালি জাতিবাদ বাংলাদেশে গড়ে উঠতে পেরেছে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের আগেই আমরা তাই পদ্য লিখেছি, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’। অর্থাৎ ব্যক্তির বিকাশের আগে তাকে খামাখা সমাজতন্ত্রের ভূয়া গল্প শুনিয়েছি। ব্যক্তিকে দল বা রাষ্ট্রের অধীন নাটবল্টু বানাতে চেয়েছি। সফলও হয়েছি। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার বিকাশ সে কারনে দুঃসাধ্য। ধরে নিয়েছি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চরম সংকীর্ণ ও স্বার্থপরদের ভোটাভুটির দ্বারা সকল ক্ষমতা একজন পেটিবুর্জোয়া ক্ষুদ্রমনা হিংসুক ফ্যাসিস্টের হাতে তুলে দেওয়াই গণতন্ত্র। ‘সমাজতন্ত্র’ বলতে বুঝেছি রাষ্ট্রের সম্পত্তি নিজেদের নামে দখল করা, কিম্বা রাষ্ট্রের নামে ভোগ দখল করা, ইত্যাদি। আমরা মার্কসবাদের অ আ ক খ জাতীয় বই পড়ে ‘বাম’ হয়েছি। মার্কস বা লেনিন আসলে কি বলেছেন তাদের কোন লেখা পাতা খুলে কোনদিন পড়েও দেখি নি। বুঝিও না। পড়তেও চাই না। নিজ বাপ মায়ের ধর্ম ইসলামকে ঘৃণা করতে শিখেছি। কোরান-হাদিসে কি আছে নিজেরা পড়ে বোঝার চেষ্টা করি নি। এখন স্বপ্ন দেখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের গণতন্ত্র বানিয়ে দেবে।
আমরা সমাজতান্ত্রিক দল এবং সমাজতন্ত্র অভিমুখে কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি বানিয়েছি। একই ভাবে পেটিবুর্জোয়া শ্রেণি জাত জাতিবাদী ইসলামবাদ এবং আরবদের রাজতন্ত্র ও গোষ্ঠিবাদ আমদানি করেছি। মোহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে আমাদের ধারণা ইনি সারাজীবন বেহেশতে যাবার জন্য মসজিদের মতো হেরাগুহায় জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। জালিমের বিরুদ্ধে কোন লড়াই করেন নি। তাঁর আমলের সমাজ, সম্পর্ক ও ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেন নি। আমাদের মসজিদে লেখা থাকে, "এখানে দুনিয়াবি কথাবার্তা বলা নিষেধ'। ইসলামকে হিন্দু ও বিধর্মীদের ঘৃণার তত্ত্ব বানিয়েছি। অথচ এসবের সঙ্গে মার্কস, প্রগতি ইত্যাদির সাথে যেমন সম্পর্ক নাই, তেমনি ইসলামেরও কোন সম্পর্ক নাই। বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাংলার ভাব সম্পর্কে আমাদের কোন খবর নাই। আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রা করি আর পান্তা দিয়ে ইলিশ খাই। আমাদের কোন ইতিহাসবোধ নাই।
এই সবেরই সম্পর্ক রয়েছে ক্ষুদে মালিকানা ব্যবস্থার জাত জমিদারতন্ত্র ও মনমানসিকতার সঙ্গে। যদি আমাদের ঘিলু থাকত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার গুরুত্ব বুঝতাম আজ আমাদের বর্তমান দশা হোত না।
যা জনগোষ্ঠি আত্মপ্রসাদে ভুটুরভুটুর না করে নিরন্তর নিজেদের নির্মোহ ভাবে পর্যালোচনা করতে শেখে, তারাই ইতিহাস নির্মাণ করে। নইলে গোলাম হয়ে থাকাই তাদের ঐতিহাসিক নিয়তি।