সন্ত্রাস, আইন ও ইনসাফ


ইংরেজিতে ‘সন্ত্রাস’ বোঝানোর দুটো শব্দ আছে: violence আর terror। দুটোর অর্থ কীভাবে কেমন করে আলাদা সেই বিষয় নিয়ে বাদবিসম্বাদ বহুদিনের। তাদের মধ্যে ফারাক বজায় রাখার কথা থাকলেও সংবাদপত্রে, সাহিত্যে, কথাবার্তায় দৈনন্দিন আলাপ-আলোচনায় তারা একাকার হয়ে যায়। বাংলাতেও আমরা তাই করি। যদি পার্থক্য বজায় রাখতে হয় তাহলে ভায়োলেন্সকে বলা যেতে পারে সহিংসতা, সশস্ত্রতা কিম্বা স্রেফ বলপ্রয়োগ। বলপ্রয়োগ সহিংস ও সশস্ত্র হতে পারে, আবার নাও পারে। নিরস্ত্র হয়েও বলপ্রয়োগ সম্ভব। অন্যদিকে terror বা terrorism-এর বাংলা করা হয় সন্ত্রাস। কিন্তু এই আলোচনায় আমরা দেখব দুইয়ের পার্থক্য বহাল রাখা জটিল ও কঠিন ব্যাপার। তাদের মধ্যে ধারণাগত পার্থক্য আছে কিনা, কিম্বা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে স্থানকালপাত্র ভেদে তারা কী অর্থে ব্যবহৃত হয় তার আলোচনা নিবন্ধের শুরুতেই সম্ভব নয়। আদৌ পার্থক্য আছে কিনা আর থাকলে তার আলোচনা আমরা কী করে করব সেই হদিস এই নিবন্ধ দিতে পারবে কিনা সেটাও আমরা শুরুতে দাবি করতে পারব না। তবে আমরা ধরে নেব আমাদের আলোচনার বিষয় সাধারণ অর্থেই সন্ত্রাস বলপ্রয়োগের সকল রূপই এই ধারণার অন্তর্ভুক্ত: সশস্রতা, সহিংসতা, নিরস্ত্র বলপ্রয়োগ, ক্ষমতা দেখানো, দাপুটেপনা, ইত্যাদি। অতএব ভায়োলেন্স আর টেররের মধ্যে পার্থক্য বজায় রেখে খামাখা বিভ্রান্তি দিয়ে শুরু করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু কিছু পার্থক্য যদি আসলেই থেকে থাকে সেই সন্দেহটা বজায় রেখেই আমরা আলোচনা করব। সন্ত্রাসের সমার্থক, সহকর্মী বা সহমর্মী নানা শব্দ আছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে তাদের ভিন্ন অর্থ তৈরির নজির থাকলেও এখানে ‘টেরর’ বা সন্ত্রাসের জায়গায় ভায়োলেন্স বা সহিংসতা, কিম্বা সহিংসতা, সশস্ত্রতা বা ভায়োলেন্সের জায়গায় পাঠক সন্ত্রাস পাঠ করতে পারেন। তবে আমাদের আলোচনার বিশদ বিষয় হচ্ছে সন্ত্রাসের সঙ্গে আইন ও ইনসাফের সম্পর্ক বিচার। সে ক্ষেত্রে দর্শন বা ভাববিচারের দিক থেকেই সন্ত্রাসকে আমরা বুঝতে চাই। কারণ হোল তখনই আইন ও ইনসাফের সঙ্গে সন্ত্রাসের সম্পর্ক আমরা ধরতে পারব।

একসময় দার্শনিকরা ভায়োলেন্সকে ‘ভায়োলেন্স’ নামেই পর্যালোচনা করতেন। Terror বা Terrorism কথাটা সম্ভবত নৈতিক দিক থেকে নিন্দনীয় ভায়োলেন্স অর্থে ব্যবহার হোত। কিন্তু কখন কীভাবে অর্থের বিভাজন ঘটল তার জন্য আলাদা গবেষণার দরকার আছে। আসলে সন্ত্রাসের নৈতিক, রাজনৈতিক কিম্বা আইন ও ইনসাফের দিক থেকে বিচারের পদ্ধতি এক, নাকি আলাদা, সেই প্রশ্নও প্রবল ভাবে জারি আছে। কিন্তু আমাদের সমাজে এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার গুরুত্ব এখনো স্বীকৃত নয়, ফলে অনেক পেছন থেকে আমাদের কথা শুরু করতে হচ্ছে। তবে আমরা ‘সন্ত্রাস’ শব্দটি সামনে নিয়ে কেন বিচার করতে বসছি তার কারণ এখনকার পত্রপত্রিকা বা গণমাধ্যমে এর আধিপত্য এবং ঘটনাক্রমে বিষয়টির গুরুত্ব। দ্বিতীয়ত বাংলায় এর চল Terror বা Terrorism-এরই অনূদিত প্রতিশব্দ হিশাবে, অর্থাৎ সাম্রাজবাদী শক্তি যে-অর্থে terror বা terrorism শব্দগুলো তাদের যুদ্ধনীতির অস্ত্র হিশাবে ব্যবহার করে তারই বাংলা অনুবাদ হিশাবে আমরা ‘সন্ত্রাস’ ব্যবহার করি, বাছবিচার ছাড়া। কিন্তু নৈতিক, রাজনৈতিক কিম্বা আইন ও ইনসাফের দিক থেকেও যদি আমরা ‘সন্ত্রাস’ বিচার ও মোকাবিলা করতে চাই তাহলে তার যুদ্ধবাজ সাম্যজবাদী ব্যবহার থেকে আমরা আমাদের ব্যবহার আলাদা করব কী করে? এটা একটা গুরুতর প্রশ্ন। ফলে শব্দটির বিচার একই সঙ্গে যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মোকাবিলার পথ অনুসন্ধান করাও বটে। সহিংসতা, সশস্রতা, বলপ্রয়োগ ইত্যাদি নৈতিক দিক থেকে মন্দ জিনিশ, অতএব বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারাই অস্ত্র নিয়ে লড়ে তাদেরকে নীতি ও সভ্যতার দুশমন হিশাবে আগাম আখ্যা দেবার তাগিদ থেকে এই ব্যবহার। সেই ঘোলা জলে সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র থাবা আড়াল করাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য। অন্যদিকে সমাজে, ইতিহাসে রাষ্ট্রে সশস্ত্রতা ও বলপ্রয়োগের ভূমিকাকে অপরিচ্ছন্ন করে তোলা, তার জ্ঞানগত, ভাবগত বা রাজনৈতিক বিচারের প্রয়োজনীয়তা ও কর্তব্যকে জ্ঞানে-অজ্ঞানে অস্বীকার করার একটা প্রক্রিয়া তো জারি আছেই। সে কারণে সন্ত্রাস শব্দটিকে সামনে রেখেই এই আলোচনা। এখনকার দার্শনিকদের কায়দায় শুধু ‘বলপ্রয়োগ’ বলে আলোচনা শুরু করলে আলোচনার প্রসঙ্গিকতা দুর্বল হতে পারে বলে মনে হয়। তবে বলাবাহুল্য এই কালের দার্শনিকরা যে অর্থে বলপ্রয়োগের সঙ্গে আইন ও ইনসাফ নিয়েও কথাবার্তা বলছেন আমাদের আলোচনা সেই একই ধারারই অন্তর্গত।

বাংলায় হরফ ধরে যদি terror বা terrorism-এর অনুবাদ করি তাহলে তারা ‘সন্ত্রাস’ শব্দটির কাছাকাছি। অন্যদিকে violence-এর অনুবাদ হতে পারে হিংসা, সহিংসতা, সশস্ত্র বা নিরস্ত্র বল প্রয়োগ। বল প্রয়োগ রক্তপাত ঘটায়, ঘটাতে পারে, আবার রক্তপাতহীনও হয়। যখন ইংরেজিতে violence against women বলা হয় বাংলাদেশের নারীরা তার অনুবাদ করেন নারী নির্যাতন বা নারীর ওপর অত্যাচার (অতি + আচার)। এখানে একদিকে শারীরিক আঘাত ও রক্তপাত কিম্বা অন্যদিকে মানসিক বা অ-দৈহিক নিপীড়ন — দুই প্রকার ভায়োলেন্স বা বল প্রয়োগই বুঝি আমরা।

পাশ্চাত্য আইনী বিদ্যা (jurisprudence) ও দর্শনে violence, terror, terrorism ইত্যাদির ধারণা, প্রয়োগ বা ন্যায্যতা নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক আলাপ আলোচনা আছে। তার সঙ্গে অতি প্রাথমিক হলেও কিছু পরিচয় হওয়া আমাদের দরকার। বাংলাদেশে এই সকল বিষয় নিয়ে কোথাও কোন আলোচনা হয়েছে বলে চোখে পড়েনি। এমনকি রাজনীতি, ফৌজদারি, দেওয়ানি বা সাংবিধানিক আইন ও বিচারের দিক থেকেও অপরাধমূলক ‘সন্ত্রাস’ আর রাজনৈতিক ‘সন্ত্রাস’— এই দুইয়ের মধ্যে ন্যূনতম পার্থক্য টানা দেশ শাসনের জন্য জরুরী সেই বিষয়েও কোন হুঁশ আমাদের আছে বলে মনে হয় না।

কিন্তু কেন সন্ত্রাসের বিচার এখন অতিশয় জরুরি বিষয়ে পরিণত হোল তার আভাস দেবার জন্য শুরুর অংশে কিছু সময় আমরা ব্যয় করব। তার আগে উপরের কথাগুলোর একটা সারমর্ম করে রাখা যাক।

এক: ‘সন্ত্রাস’ বলতে আমরা কি বুঝি বা কি বুঝবো তার একটা বিচার দরকার এবং জর্জ বুশ, টনি ব্লেয়ার বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের যুদ্ধবাজ নীতির অস্ত্র হিশাবে শব্দটি যেভাবে ব্যবহার করে তার খপ্পরে পড়ে যদি আমরা আত্মহননের পথ বেছে নিতে না চাই তাহলে আমাদের সমাজের লড়াই, সংগ্রাম ইচ্ছা আকাঙ্খা সংকল্পের আলোকে ‘সন্ত্রাস’-কে বিচার করা আমাদের দায় হয়ে উঠেছে। সেই দিক থেকে বিদ্যমান ব্যবস্থার অসাম্য, অন্যায়, বে-ইনসাফি, বেঈমানি, শোষণ, নির্যাতন, ধ্বংসযজ্ঞ ইত্যাদির বিরুদ্ধে দুনিয়ার খেটে খাওয়া শ্রেণীর দিক থেকে কীভাবে ‘সন্ত্রাস’-এর বিচার আমরা করব তার পদ্ধতিগত দিকও আমাদের আলোচনা করতে হবে।

দুই: আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে এই বিচার করতে বসলে দেখব যে এই শব্দ, ধারণা ও তার প্রয়োগের বিচার নৈতিক, রাজনৈতিক, কিম্বা আইন ও ইনসাফের দিক থেকে হয়তো একরকম হবে না, এমনকি তার শ্রেণীগত ও নারীপুরুষভেদে বিচারও ভিন্ন হতে পারে। এই সন্দেহ শুরুতেই আমাদের মনে জাগে, এবং জাগ্রত রাখা দরকার। এই সন্দেহটা সত্যি কিনা সেটা আমরা আগাম বলতে পারব না। সেটা ক্রমে ক্রমে পরিচ্ছন্ন হবে।

তিন: প্রাথমিক আলোচনায় আমরা সন্ত্রাসকে বলপ্রয়োগেরই একটা রূপ হিশাবে বিচার করব এবং আলোচনাকে প্রধানত ভাবগত বা প্রচলিত অর্থে দার্শনিক দিক থেকে তুলব। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে শুরুতেই এই কালের দার্শনিকরা এই বিষয়ে কি কথাবার্তা বলছেন তার খোঁজখবর করা যাতে ওপরে যে সন্দেহগুলো শনাক্ত করেছি তা মোচন করবার শর্ত তৈরি হয়।

সন্ত্রাস নিয়ে বাদবিসম্বাদ বহুদিনের

বিশেষ বিশেষ শব্দ বা ধারণার সঙ্গে কী করে ক্ষমতার দাপট দেখানো ও প্রয়োগের ব্যাপার জড়িত তা নিয়ে বিস্তর লেখালিখি আছে। ‘সন্ত্রাস’ তার মধ্যে অন্যতম। বর্ণ, শ্রেণী ও নারী-পুরুষ সম্পর্ক থেকে সমাজে একেক ধরনের বয়ান, কথন, বা লেখালিখির ধরন তৈরী হয়। বলাবলি ও লেখালিখির অনেক অভ্যাস গড়ে ওঠে, যার মধ্যে এক জনগোষ্ঠির সঙ্গে অপর জনগোষ্ঠির, উচ্চবর্ণের সঙ্গে নিম্নবর্ণের, আভিজাত্যের সঙ্গে নিম্নবর্গের, শ্রেণীর সঙ্গে শ্রেণীর, পাশাপাশি নারীর সঙ্গে পুরুষের সম্পর্কের লড়াই-সংগ্রাম হাজির থাকে। এই কালের দর্শনের প্রধান মনোযোগ হচ্ছে এই ধরনের লেখালিখি বা বলাবলির ধরন পড়তে পারা বা কথার মাঝখানে কথা শোনার শক্তি অর্জন করা। পড়বার বা শুনবার এই দক্ষতা অর্জন করলে ক্ষমতার লড়াই কী করে ভাষা তৈরি ও ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে চলে তার আন্দাজ করা যায়। সমাজের নানান পক্ষ নিজ নিজ তরফে মত তৈরি, পরমত খণ্ডন ইত্যাদি— অর্থাৎ শক্তি বৃদ্ধির লড়াই চালায়। নিজ নিজ ভাষা বা ভাষার ব্যবহার ক্ষমতার বয়ান বা সংজ্ঞা হয়ে নিজ নিজ শ্রেণীর বা গোষ্ঠির স্বার্থ বা ক্ষমতা খাটাবার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই বিষয়গুলো বিচার করবার জন্য শব্দ বা ধারণা হিশাবে ‘সন্ত্রাস’ বা ‘সন্ত্রাসী’ খুব ভাল নজির।

নিপীড়কের বিরুদ্ধে সামাজিক-রাজনৈতিক লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে তাঁরা এই ব্যাপারগুলো খুবই ভাল বুঝবেন। কারণ নিপীড়ক শ্রেণী সবসময়ই নিপীড়িতের লড়াই-সংগ্রামকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘উগ্রপন্থা’, ‘হঠকারী’ ইত্যাদি বলে প্রবল প্রচার চালায়। কাজে কাজেই যাঁরা নিজেদের কার্ল মার্কস, লেনিন বা মাওজে দংয়ের অনুসারী বলে গণ্য করেন তাঁরা ক্ষমতাসীন শক্তি কেন প্রতিপক্ষকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে তার রাজনৈতিক মর্ম সহজে বোঝেন। নিপীড়ক শ্রেণী নিজেও কিন্তু ব্যাপারগুলো বোঝে। কারণ প্রতিপক্ষকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে তার সকল মানবিক সত্তা মুছে দেওয়া খুবই জরুরী — নইলে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস বা হত্যা করবার কোন নীতিগত ভিত্তি সমাজে তৈরি করা যায় না। মানুষ হত্যা করা অপরাধ, এই বোধ সাধরণত মানুষের মধ্যে কাজ করে। কিন্তু ‘সন্ত্রাসী’ হত্যা করা অপরাধ নয়, কারণ ‘সন্ত্রাসী’ মানুষ নয়। এটা আমরা র‍্যাবের ক্রসফায়ারে হত্যার মধ্যে যেমন দেখি, তেমনি মানুষের হাতে ধরা পড়া ডাকাত বা পকেটমারকে সকলে মিলে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার উল্লাসের মধ্যেও দেখি। এখনকার বাংলাদেশে কোন শ্রেণী কীভাবে ‘সন্ত্রাস’ ও ‘সন্ত্রাসী’ শব্দটি ব্যবহার করে এবং কার বিরুদ্ধে এবং কোন শ্রেণীর পক্ষে — সেটা খুবই ইন্টারেস্টিং একটি গবেষণার বিষয়। তবে সেটা সম্ভব হবে যদি ‘সন্ত্রাস’, ‘সহিংসতা’, ‘বলপ্রয়োগ’, ‘কর্তৃত্ব’ ইত্যাদি শব্দ ও ধারণার কিছু প্রাথমিক বিচার আমরা করতে পারি, বিশেষত এই প্রসঙ্গে আইন এবং ইনসাফ সম্পকে কথাবার্তাও যদি তোলা যায়।

‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ চালাবার যারা প্রবক্তা তারা নিজেরাও স্বীকার করেন, Terrorism বা ‘সন্ত্রাস’ শব্দটির সংজ্ঞা নির্ধারণ নিয়ে তাঁরা মুশকিলে থাকেন। International Policy Institute for Counter Terrorism প্রশ্ন তুলেছে Is One man’s terrorist another man’s freedom fighter? একজনের চোখে ‘সন্ত্রাসী’ কি আসলে অন্যজনের চোখে ‘মুক্তিযোদ্ধা’? তারা মানছেন এই শ্রুতি ডালপালাসহ বেশ হাজির, টেররিস্ট সেন্টারের ডেপুটি প্রধান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন— (১) এটা পরিকল্পিত কাজ হতে হবে, হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া সহিংসতা সন্ত্রাস নয় বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে তাকে আলাদা ভাবে বিচার করতে হবে। আবেগের বশে বা হঠাৎ উত্তেজনার চোটে যে সহিংসতা ঘটে, সেই সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়। কারণ তারা পূর্বপরিকল্পিত নয়। (২) সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মাত্রই রাজনৈতিক; মাফিয়া বা সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠির সন্ত্রাস আর যে অর্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাস’ ব্যবহার করে তার মধ্যে পার্থক্য আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সন্ত্রাস মাত্রই রাজনৈতিক সন্ত্রাস, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যে সহিংসতা তাকেই ‘সন্ত্রাস’ বলা হয়। অপরাধমূলক সহিংসতা সন্ত্রাস নয়। (৩) সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের টার্গেট বেসামরিক নাগরিক, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত সেনাবাহিনী নয়। (৪) একটি দেশের সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড সন্ত্রাস নয়, সন্ত্রাস শব্দটি সেই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যখন এই কর্মকাণ্ডের হোতা একটি দেশের অভ্যন্তরে কোন দল বা গোষ্ঠি (subnational group)।

‘সন্ত্রাস’ মানে কী সেটা বোঝানো তেমন কঠিন ব্যাপার না— একদিক থেকে তাহলে নোয়াম চমস্কির এই দাবি ঠিকই আছে, যদি আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তাদের কাগুজে সংজ্ঞাটাকে মানি, কারণ সেটাই সন্ত্রাসের বাস্তব সংজ্ঞা। এতে অবশ্য দার্শনিক বা ভাবুকরা তৃপ্ত হবেন না। কারণ ব্যবহারিক সংজ্ঞা, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ পরিচালনার জন্য দরকারি সংজ্ঞা এক জিনিশ আর তার ভাবগত বিচার ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু নোয়াম চমস্কি ব্যবহারিক প্রশ্নে বেশি আগ্রহী, এবং আমরা তার মূল্য অস্বীকার করলে ভাবগত আলোচনায় কোন ফল পাব না। তবে আমরা একটু পরেই দেখব দর্শন বিষয়টাকে নীতিনৈতিকতার মানদণ্ডের বাইরে কীভাবে আইন ও ইনসাফের দিক থেকেও বোঝার চেষ্টা করছে। চমস্কি তাঁর “The Evil Scourge of Terrorism”-এ মার্কিন সেনাবাহিনীর ম্যানুয়েল থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন সেখানে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা হচ্ছে, ‘ধর্মীয়, রাজনৈতিক অথবা আদর্শিক লক্ষ্য সাধনের জন্য বুঝেশুনে সহিংস ক্ষমতার ব্যবহার’ (‘the calculated use of violence or threat of violence to attain goals that are political, religious, or ideological in nature. This is done through intimidation, coercion, or instilling fear’)। পেন্টাগন সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞ Robert Kupperman-কে একটা গবেষণা করায় একসময়। সেই গবেষণার প্রসঙ্গ টেনে চমস্কি কথাটা পেড়েছেন। সেখানে ‘সন্ত্রাস’ মানে পুরাপুরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার অঙ্গীকার না করেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সহিংসতা। (‘to achieve political objectives without the full- scale commitment of resources’.) (চমস্কি ২০০৫)। আসলে এই সংজ্ঞা হচ্ছে মার্কিন পরিচালিত Low Intensity Operation প্রসঙ্গে। চমস্কির লেখার গুণ হচ্ছে তিনি ‘সন্ত্রাস’ শব্দটিকে আক্ষরিক ভাবে বা আগাম কোন নৈতিক মানদণ্ড দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন না। যাঁরা সন্ত্রাসকে ‘সন্ত্রাস’ বলে চিহ্নিত করছে তারা তাদের শত্রুদের কর্মকাণ্ডকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করে বা করছে তার দ্বারাই শব্দটিকে বোঝার চেষ্টা করছেন। আর এই অনুধাবনের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী যুগে সমরনীতি ও রাজনীতিতে শব্দটির তাৎপর ব্যবহার আমাদের বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছেন তিনি।

সন্ত্রাস রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পরিচালিত সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এই সাধারণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সকলেই কমবেশি একমত। তার মানে, যে-সন্ত্রাসের কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নাই সেটা নিছকই অপরাধমূলক সহিংসতা, সেটা টেররিজম নয়। দ্বিতীয়ত টেররিজমের টার্গেট সামরিক প্রতিষ্ঠান নয়, বেসামরিক লক্ষাস্থল। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি আছে। যেমন প্যালেস্টাইন লিবারেশান অর্গানাইজেশান যদি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে তাহলে কি সেটা সন্ত্রাস হবে? ওপরের সংজ্ঞা অনুসারে সোন ‘সন্ত্রাস’ নয়। কিন্তু মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের অভিমত হচ্ছে সেটা পরিস্থিতি বিবেচনা করে নির্ণয় করতে হবে। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে কোন সাধারণ নিয়ম করা যাবে না। যদি ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্যালেস্টাইনের মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়— তখনও সেটা আসলে সন্ত্রাসই হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্যালেস্টাইন লিবারেশান অর্গানাইজেশানের আদৌ কোন আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা বলা উচিত কিনা সেই বিষয়ে মার্কিন কংগ্রেস অনেকের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। মার্কিন কংগ্রেসের কমিটি অন ফরেন এফেয়ার্সের কাছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মধ্যপ্রাচ্য সংক্রান্ত বিষয়ের আন্ডার সেক্রেটারির সহযোগী নেড ওয়াকার (Ned Walker) যে বক্তব্য দিয়েছেন সেখান থেকে পরিষ্কার যে স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিদ্যমান সংজ্ঞা অনুযায়ী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের লড়াকুদের আক্রমণ ‘সন্ত্রাস’ বলে গণ্য হবে না, কিন্তু ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পিএলওর আক্রমণ সন্ত্রাসী হামলা বলেই গণ্য হবে। য়ুরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সাবকমিটির চেয়ারম্যান লী হ্যামিলটন (Lee Hamilton) আর নেড ওয়াকারের সঙ্গে যে কথাবার্তা হয়েছে তা এইরকম:

হ্যামিলটন: বেশ, আপনি তাহলে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা কীভাবে করেন? বেসামরিক ক্ষেত্রে হামলার বিবেচনা মাথায় রেখে কি?

ওয়াকার: সন্ত্রাস সম্পর্কে স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতিবছর যে রিপোর্টে প্রকাশ করে সেখানে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা হচ্ছে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হামলা।

হ্যামিলটন: তার মানে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ওপর হামলা সন্ত্রাস হিসাবে গণ্য হবে না, তাই না?

ওয়াকার: এর মানে এই নয় যে পিএলওর সঙ্গে আমরা যা করবার প্রস্তাব করছি তার ওপর এর কোন বিশাল প্রভাব নাই।

হ্যামিলটন: সেই জ্ঞান আমার আছে, কথা হচ্ছে এই হামলা তাহলে সন্ত্রাস নয়।

ওয়াকার: সামরিক লক্ষ্যস্থলে হামলা? স্টেট ডিপার্টমেন্টের সংজ্ঞা অনুসারে সন্ত্রাস হবে না। কিন্তু একটু রাখুন, এই কথা পুরাপুরি ঠিক না। আপনি জানেন, সামরিক লক্ষ্যবস্তুতেও এমন হামলা হতে পারে যা পরিষ্কার সন্ত্রাসী হামলা। ক্ষেত্রবিশেষেই সেটা বিচার্য।

হ্যামিলটন: থামুন তাহলে, আমি তো ভেবেছি আপনি আমাকে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সংজ্ঞাই দিচ্ছিলেন!

ওয়াকার: শব্দটা হচ্ছে নন কমব্যাটেন্ট বা যুদ্ধাবস্থায় নাই এমন টার্গেটে হামলা— সামরিকও নয় বেসামরিকও নয়।

হ্যামিলটন: বেশ। তাহলে যুদ্ধাবস্থায় নাই এমন যে কোন লক্ষাবস্তুতে হামলা সন্ত্রাস।

ওয়াকার: জ্বি। এটাই ঠিক।

হ্যামিলটন: এবং যুদ্ধাবস্থায় নাই এমন লক্ষ্যবস্তু সামরিকও হতে পারে।

ওয়াকার: অবশ্যই।

হ্যামিলটন: এটাতো নিশ্চিত যে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা এই সংজ্ঞার অন্তর্গত। ঠিক না?

ওয়াকার: ঠিক।

হ্যামিলটন: কিন্তু তাহলে কি একটি সামরিক ইউনিটের ওপর হামলা সন্ত্রাস বলে গণ্য হবে না?

ওয়াকার: সেটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।

হ্যামিলটন: সেই পরিস্থিতিগুলো কী?

ওয়াকার: আমি মনে করি না কী ধরনের সংজ্ঞা ও পরিস্থিতিতে আমরা প্যালেস্টাইন লিবারেশান অর্গানাইজেশানের কর্মকাণ্ডকে ‘সন্ত্রাস’ বলে আখ্যায়িত করব তার ব্যাখ্যা-বর্ণনা আমাদের খুব একটা কাজে আসবে।

লী হ্যামিলটন আর নেড ওয়াকারের এই সংলাপের মধ্য দিয়ে এটা পরিষ্কার যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী দলিলগুলোতে ‘সন্ত্রাস’ সম্পর্কে যে সংজ্ঞা দেওয়া হয় সেটা কাগুজে সংজ্ঞা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজে এই সংজ্ঞার ভিত্তিতে চলে না। সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নির্ণয়ের জন্য যদি আমরা সরকারি কাগজপত্রের ওপর নির্ভর করি তাহলে শেষাবধি নগদ ফল হচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিট কপটতা প্রমাণ করা। যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে এই সংজ্ঞা ও তার ফলাফলের একটা ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে, মানতেই হবে। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের নিজেদের দেওয়া সংজ্ঞার কপটতা যদি আমরা ধরিয়ে দিতে পারি তাহলে এই নীতির বৈধতা কিছুটা হলেও মার্কিন নাগরিকদের কাছ থেকে হারায় সেই দিক থেকে নোয়াম চমস্কি আমাদের মিত্রের কাজ করছেন। সন্দেহ নাই। কিন্তু এতে সন্ত্রাসের বিচার মুলতুবিই থেকে যায়। যে কারণে আমরা সন্ত্রাসের ভাবগত বা দার্শনিক বিচারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলেছি।

কিন্তু সংজ্ঞা নির্ণয়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবার এতো উদগ্রীব কেন? কারণ সংজ্ঞার মধ্য দিয়ে কোন নীতিগত জায়গায় দাঁড়াতে না পারলে অন্যান্য দেশকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল করা কঠিন। তবে যে-জায়গায় একটা অভিন্ন মত গড়ে উঠছে সোটা হোল ‘সন্ত্রাস’ বা ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ বলতে সেই কর্মকাণ্ডকেই বোঝানো হয় যার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্য প্যালেস্টাইনের মুক্তি সংগ্রাম হোক, কমিউনিজম কায়েম হোক, জাতীয় মুক্তির লড়াই হোক, কিম্বা হোক ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক লক্ষ্যের বৈধতা বা ন্যায্যতা দিয়ে সেই লক্ষ্য অর্জনের উপায়ের বিচার করা হচ্ছে না। সন্ত্রাস মানেই হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টা বলপ্রয়োগ, সহিংসতা বা সামরিক কর্মকাণ্ড। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ যখনই পাল্টা আঘাত করে তখনই তা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। যেমন, প্যালেস্টাইনের মুক্তিসংগ্রামীরা যাই করুক তাকে সন্ত্রাসী বলেই গণ্য করতে হবে। প্রতিপক্ষের লড়াই ন্যায্য বা বৈধ কিনা সেই বিচার করা চলবে না। এটাও আমরা দেখছি যে ইংরেজিতে terror আর violence দুটো আলাদা শব্দ থাকলেও ওপরে টেররিজমের যে সংজ্ঞা আমরা দেখছি লক্ষ্যের দিক থেকে দিক থেকে দুইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য বজায় রাখা হয় নি। পার্থক্য ঘটছে প্রয়োগের লক্ষ্যবস্তুর বিচারে। সামরিক লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে সশস্ত্রতা বা সহিংসতার প্রয়োগ ঘটল নাকি, বেসামরিক টার্গেটে এই পার্থক্য দিয়েই একটি ভায়োলেন্স আর অন্যটি টেরররিজম নামে অভিহিত করার চল হয়েছে। ভায়োলেন্স অর্থে সহিংসতা, সশস্রতা বা বলপ্রয়োগ মানুষের ইতিহাস ও ইতিহাস নির্মাণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সে কারণে নীতি, আইন ও ন্যায্যতার পরিমণ্ডলে ভায়োলেন্স আমাদের কাছে টেররিজমের তুলনায় অন্য রকম প্রশ্ন ও সংকট তৈরি করে। বল প্রয়োগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন বা নতুন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উপায় হিশাবে মেনে নিয়েও উপায় হিশাবে আমরা সহিংসতা, সশস্ত্রতা বা বলপ্রয়োগের বিরোধী হতে পারি এবং নৈতিক কারণে তার বিরোধিতাও করতে পারি। যেমন, অহিংসা একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক অবস্থান ও রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের উপায় হিশাবে স্বীকৃত। কিন্তু সন্ত্রাসকে আমরা ঠিক এই ভাবে দেখি না। আমাদের সাধারণ অনুমান হচ্ছে টেররিজম বা সন্ত্রাসের উদ্দেশ্য মানুষের মনে নিছকই ভীতি সৃষ্টি। তার অন্য কোন স্বার্থ আছে কিনা সেটা সবসময়ই আমাদের কাছে গৌণ প্রশ্ন হিশাবে থাকে। হয়তো সন্ত্রাসকে আমরা শুধু সন্ত্রাস হিশাবেই দেখি। তার অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে সেটা আমাদের বিবেচনায় আসে না।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বয়ান তৈরি করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের। যে সংজ্ঞা দেয় তার চেষ্টা সন্ত্রাস সম্পর্কে আমাদের কাঁচা অনুমান কচলিয়ে এই যুদ্ধের পক্ষে নৈতিক বৈধতা আদায়। টেররিজম আর ভায়োলেন্স অর্থাৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ—এই দুইয়ের মধো এখানে কি পার্থক্য। ভায়োলেন্স বড়োজোর টেররিজমেরই একটা রূপ মাত্র। অথচ ভায়োলেন্স না বলে টেররিজম শব্দটি ব্যবহার করা হয় যাতে আমরা বিভ্রান্ত হই, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বল প্রয়োগ যে ইতিহাসে ঘটে সেই স্মৃতি বিস্মৃত হই এবং সন্ত্রাসকে নিছকই সন্ত্রাস গণ্য করি। কাজে কাজে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মার্কিন অভিযানে জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারেরই আমরা পক্ষাবলম্বন করি। বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা যদি সন্ত্রাসী হয় তাহলে দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো সন্ত্রাসী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে যুদ্ধাবস্থায় সামরিক ও বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর সীমারেখা কখনই স্থির থাকে না। ফলে সংজ্ঞা নির্ধারণ করে কাকে আমরা সন্ত্রাস বলব আর কাকে বলব না তার বিচার জটিল এবং অসম্ভবই বলা চলে। সেই তর্কে আমরা এখানে প্রবেশ করব না।

এ যাবতকালের ইতিহাস মাত্রই বলপ্রয়োগের ইতিহাস। এই ইতিহাসে কতো জাতি কতো গোষ্ঠি নির্মম নিষ্ঠুর ভাবে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছে, কতো সভ্যতা, ভাষা, সংস্কৃতি বিলীন হয়ে গিয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নাই। বলপ্রয়োগের বিপরীতে বলপ্রয়োগ করে নিজ নিজ জাতি গোষ্ঠি, সংস্কৃতি সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে যারা ব্যর্থ হয়েছে, তারা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। যারা পরাজিত হয়েছে তাদের হয় বরণ করতে হয়েছে সাক্ষাৎ মৃত্যু অথবা বিজয়ী পক্ষের দাসত্ব। নিজেদের দাসত্বের শৃঙ্খল যদি আমাদের চোখে না পড়ে তাহলে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেড ইন্ডিয়ানদের দিকে তাকাতে পারি। বুঝব কীভাবে জনগোষ্ঠির পর জনগোষ্ঠি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কিম্বা পরাজিতের তিলক নিয়ে বিজয়ীর দাসত্ব মানতে বাধ্য হয়েছে। এই সত্য মনে রাখতে হবে অপরের ভূখন্ড দখল ও সম্পদ কুক্ষিগত করেই আজ ইতিহাসে এক পক্ষ মনিব আর অন্যরা দাস মাত্র। সন্ত্রাস বা সহিংসতা সম্পর্কে মনিবদের সংজ্ঞার মধ্যে এই সত্যই অনুরণিত। তাকে মনিব হয়ে টিকে থাকতে হলে যুদ্ধ অনিবার্য।

তাহলে মনিব দাসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, সহিংসতা, যুদ্ধবিগ্রহ বা সাধারণ ভাবে বলপ্রয়োগ না করে যেমন টিকে থাকতে পারে না, দাসের মুক্তিও একমাত্র বিদ্রোহে, পাল্টা বলপ্রয়োগের শক্তি অর্জনের মধ্যে, পাল্টা সহিংসতা ও সন্ত্রাসের মধ্যে নিহিত। মনিবের ভাব, বিধান, নীতিনৈতিকতা, সংস্কৃতির জগত বা পরিমণ্ডলের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হয়ে যারা দাস হয়ে থাকতে চায় না, একমাত্র তাদের পক্ষেই এই দাসত্বের জালা বোঝা সম্ভব, অন্যের পক্ষে সম্ভব নয়। মনিবের জগতকে যারা স্বাভাবিক বলে মেনে নেয় কেবল তারাই দাসের বিদ্রোহ, সহিংসতা বা সন্ত্রাসকে ‘অস্বাভাবিক’, ‘বর্বর’, ‘হিংস্র’, ‘সভ্যতার পরিপন্থি’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করে। তারা দাস/মনিবের এই বিভাজনের ফাঁদে না পড়ে থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসের বিচার করতে পারে না।

এই বিচারে প্রবেশের জন্য যে প্রশ্নটা করে রাখা জরুরী সেটা হচ্ছে, তাহলে কি মানুষের ইতিহাস চিরকালই মনিব হয়ে ওঠার আর অপরকে দাসে রূপান্তরের ইতিহাস? যদি যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার জগতকে পরাস্ত করে নতুন শক্তির উদয় ঘটে, হয়তো বা তার উদয় ঘটল প্রাচ্য থেকেই, তাহলে কি পশ্চিম বা পাশ্চাত্য প্রাচ্যের দাসে পরিণত হবে? এটাই কি ইতিহাসের সম্ভাব্য একটি পরিণতি? এর জন্যই কি আমরা এখনকার দাসকে আগামির মনিবে রূপান্তরের জন্য সমর্থন দেব? বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়বার নৈতিক বৈধতা কি শুধু এখানেই?

এর উত্তর আমরা কার্ল মার্কসের বরাতে যতোটুকু পেয়েছি আপাতত ততোটুকু মেনে নেব। মানুষের ইতিহাস চিরকাল এক পক্ষ মনিব আর অপর পক্ষ দাসে রূপান্তরের ইতিহাস হয়ে থাকবে না। হতে পারে না। হবে না। বরং এই বিভাজন যতদিন চলবে তাকে মানুষের ইতিহাস বলা যাবে না। আসলেই। সেটা হবে মনিবের অবস্থান থেকে ইতিহাস রচনা, কারণ মনিবই ইতিহাস লেখে। মনিবের বয়ানে এখন আমরা যাকে মানুষের ইতিহাস বলি, সেটা কার্ল মার্কসের কাছে মানুষের ইতিহাস নয়, বরং পুঁজির হয়ে উঠার ও তার আত্মস্ফীতি ও পুঞ্জিভবনের ইতিহাস। এই ইতিহাসের কর্তাশক্তি মানুষ নয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং তার চরম প্রকাশ পুঁজির ইতিকথা। কিন্তু চরম ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পুঁজি প্রাচীন ও প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সকল সম্পর্ক তছনছ করে দিলেও, পুঁজির ইতিহাস একই সঙ্গে মানুষের আবির্ভাবেরও শর্ত। কিন্তু সেই শর্ত মনিবের বয়ানে ধরা পড়বে না। কারণ সেটা হবে পুঁজির বয়ান। বরং দাসের ভাষার মধ্যে আমরা তার ইঙ্গিত ততোটুকুই পাবো যতোটুকু দাস বিদ্যমান বিভাজন অতিক্রম করবার আকাংখায় লড়াই সংগ্রামে সরাসরি নিয়োজিত। এই লড়াইয়ের বৈষয়িক বা অর্থনৈতিক দিক পরিষ্কার বোঝাবার জন্য মার্কস এ লড়াইয়ের আখ্যা দিয়েছেন শ্রেণী সংগ্রাম। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই লড়াই পুঁজির বিরুদ্ধে শ্রমিকের লড়াইয়ে রূপ নেয়। কিন্তু মানুষ মাত্রই অর্থনীতি নয়। এটা পরিষ্কার যে আমরা ‘মানুষ’ বলে যে জীবসর্বস্ব প্রাণীকে বুঝি, কার্ল মার্কস ‘মানুষ’ বা মানুষের ইতিহাস বোঝাতে শুধু সেই জীবের ইতিহাস বোঝান নি। তার জৈবিকতা বা বৈষয়িকতা ইতিহাস নির্মাণের শর্ত, কিন্তু ‘মানুষ’ অর্থে তিনি এমন এক সজ্ঞান ও সচেতন সামাজিক কর্তাসত্তা বুঝিয়েছেন যে একদিকে প্রাকৃতিক ইতিহাস অন্যদিকে প্রকৃতি থেকে আলাদা একটি সম্ভাবনা হিশাবে বিকশিত হয়ে উঠছে। কাজে কাজেই যে কর্তাসত্তা প্রকৃতি ও নিজের ভেদ— উভয়েরই গতিপ্রকৃতি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এই কর্তাসত্তার চেতনা মার্কস দাবি করেছিলেন পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একমাত্র মজুর ও খেটে খাওয়া শ্রেণীর মধ্যে— মজুরি দাসত্বের নিপীড়ন ও নির্যাতনের মধ্যে গড়ে উঠবে।

মনিব ও দাসের মধ্যে যে-লড়াই একদিকে দাস এবং অন্যদিকে মনিব তৈরি করবার খোদ ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করতে পারে, সেই লড়াইটাই হবে দাসব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের শেষ লড়াই। কী করে বুঝব আমরা সেই চরম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি? তখনই বুঝব যখন মানুষ তাদের রক্তের, গোত্রের, ভৌগলিক অবস্থান, দেশ, জাতীয়তা, ভাষা, দিব্য বিশ্বাস— অর্থাৎ সকল প্রকার ‘প্রাকৃতিক’ পরিচয় অতিক্রম করে নিজের ভেদ নিজে উপলব্ধি করতে শেখে ও প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সেই ভেদজ্ঞান আছে বলে সে টের পায়। ফলে একই সঙ্গে এক ও অনেক হয়ে উঠবার আকাঙ্ক্ষা তার জাগে। তখন অপরকে দাস করবার ইচ্ছা নয়, বরং অপরের মধ্যে, অপরের মধ্য দিয়ে, সকলের হয়ে নিজেকে দেখবার ও আবিষ্কার করবার তৃষ্ণা তার প্রখর হয়।

আন্তর্জাতিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা দাস ব্যবস্থারই একটা অবস্থা। কিন্তু শেষাবস্থা। এই ব্যবস্থা গড়নের পেছনে নির্মম ধ্বংসের যে-ইতিহাস আছে — যে রণক্ষেত্র, করোটি, খুলি, হাড় ও ছাই সে পেছনে ফেলে এসেছে তাকে আবার পুনরুদ্ধার করার আশা বৃথা। কিন্তু পুঁজির এই ফেলে আসা ধ্বংসচিহ্নের মধ্যে যে রক্তের দাগ সেই দাগ পাঠ করতে পারার শক্তি যতোটুকু আমরা অর্জন করতে শিখব পুঁজির গোলাম হয়ে থাকবার দিনও সেই মাত্রায় কমে আসবে। আগামিতে মানুষ কী হতে পারে, বা কী হবে তার ইঙ্গিতগুলো যদি আমরা পুঁজির ইতিহাস বিচার করে ধরতে পারি, তাহলে তার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই পুঁজির যুগের অবসান হবে। খোদ দাসব্যবস্থা ধ্বংসের লড়াইটা হতে হবে পুঁজির চূড়ান্ত বিনাশের লড়াই।

যদি তাই হয় তাহলে বলপ্রয়োগের সহিংসতার সশস্ত্রতার সন্ত্রাসের ঐতিহাসিক ভূমিকা আমাদের মানতেই হবে। কিন্তু কোন অর্থে? কীভাবে? এমনকি তারও আগে আমাদের বুঝতে হবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বা নতুন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বলপ্রয়োগ, সহিংসতা, সশস্ত্রতার অর্থ কী? সে কারণে ইত্যাদি বিষয়ে একালের দার্শনিকেরা যে তর্ক শুরু করেছেন তার খানিক আভাস দেবার জন্যই এই লেখা।

কার্ল মার্কস, শ্রেণীসংগ্রাম ও ভাষা

ক্ষমতার লড়াইয়ে কীভাবে বিশেষ বিশেষ ধারণা, সংজ্ঞা বা বয়ান তৈরি হয় আর কীভাবে তারা ক্ষমতা তৈরি ও ক্ষমতা রক্ষার কাজে খাটে সেই বিষয়ে মার্কস বা মার্কসের অনুসারী বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারার অবদান কেউই অস্বীকার করেন না। পাশাপাশি এই কালের ভাবুকরা আরো বিপুল চিন্তাশক্তি নিয়ে এসেছেন। জানাশোনা ভাবাভাবির গণ্ডি যেমন তাঁরা ভেঙেছেন তেমনি নতুন করে আমাদের তাঁরা ভাবতেও শিখিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে মার্কস ও তাঁর অনুসারীরা যেখানে চিন্তার প্রথাগত সীমানা ভাঙতে পারেন নি, এই কালের সামনের সারির অনেক ভাবুক নতুন জানালা খুলেছেন ও চিন্তার নতুন দিগন্ত খোলাসা করেছেন। চিন্তার শক্তিতে আমাদের বিস্ময় জাগাতে পেরেছেন তাঁরা। মার্কস দেখিয়েছেন— বৈষয়িক উৎপাদনের মধ্য থেকে শ্রেণীর পরিগঠন এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে লড়াই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘ভাষা’, বয়ান, কথকতা, তত্ত্ব, মতাদর্শ ইত্যাদি। মতাদর্শ বলি আর ‘ভাষা’ বলি কিম্বা যদি বলি চিহ্ন, ইশারা বা প্রতীক নির্মাণ ও ব্যবহার — তাহলেও ঘুরেফিরে আমরা কিন্তু একই কথা বলি। মার্কস দেশকালপাত্র ভেদে ভাষা, চিহ্ন বা সংকেত ব্যবস্থার পরিগঠন এবং তাদের অর্থ তৈরির সঙ্গে সমাজের বৈষয়িক উৎপাদন কীভাবে জড়িত সেই বিষয়ে লেখালিখি করেছেন। যেমন, অর্থশাস্ত্রে ‘মূল্য’, ‘দাম’, ‘বাড়তি মূল্য’ ইত্যাদি ধারণার উৎপত্তি কেন এবং কীভাবে ঘটল? এই ধারণাগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে যে ‘অর্থশাস্ত্র’ তৈরি হয়ে উঠছিল তাকে বিচারের পদ্ধতি কী হবে? ভাষার এই পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই তাঁর হাতে অর্থশাস্ত্র নামে জ্ঞানের এক নতুন ক্ষেত্রের আবির্ভাব ঘটেছে। আমরা প্রথম জানলাম মানুষের বৈষয়িক জীবন ও স্বার্থের সঙ্গে ভাষারও একটির বৈষয়িক সম্পর্ক আছে। ভাষা হাওয়াই কিছু নয়, এবং তার অর্থও সুনির্দিষ্ট নয়। বৈষয়িক উৎপাদন কীভাবে নতুন ভাষা তৈরি করে সেই দিকে মার্কস আমাদের নজর ফিরিয়েছেন। ভাষার ওপর বিভিন্ন শ্রেণীর দাবি ও ব্যবহারের বিচার — কীভাবে করতে হয় সেও আমরা মার্কস ও তাঁর অনুসারীদের কাছ থেকে শিখেছি। তাঁর পরে যাঁরা ভাষা নিয়ে কাজ করতে এসেছেন তাঁরা শিখিয়েছেন ভাষা দিয়ে ভাষার অন্দরমহলের ভেতরে কী করে প্রবেশ করতে হয়। মার্কস দর্শনের চর্চা থেকে — অর্থাৎ ভাষার মধ্যে চিন্তার পর্যালোচনা এবং সত্য মিথ্যা নির্ণয়ের ধারা থেকে বেরিয়ে যাবার তাগিদ দিয়েছিলেন এই কথা বলে যে দুনিয়াকে বদলানোই আসল কাজ, বিপ্লবের ভাষা তৈরি মাত্র নয়। এছাড়া তত্ত্ব বা ভাষার কী মূল্য আছে যদি তাকে কাজে খাটানো না যায় বা যদি সে বাস্তবের কাজে যদি নাই খাটে। নতুন ভাবুকরা বললেন, চিন্তার জগত থেকে বেরিয়ে কাজের জগতে নেমে পড়তে হবে— মার্কসের এই কথা ঠিক আছে। কিন্তু চিন্তা করাও তো কাজ। তাহলে ভাষার মধ্যে বসে, ভাষা দিয়ে ভাষার বিচারের যুগ শেষ হয় নি। চিন্তা কী করে চিন্তা করে সেটা ভাষা দিয়ে ভাষার মধ্যে বোঝা ও চিন্তার স্ববিরোধিতাকে হাতে নাতে ধরতে পারার একটা শিক্ষা দরকার আমাদের। বিশেষত নির্যাতিত যেসব কণ্ঠস্বর আমরা ভাষার মধ্যে শুনি না, বা শুনতে পারি না, কিম্বা আমাদের চাপাবাজির চোটে যাদের কণ্ঠস্বর আমরা ম্রিয়মাণ করি, নীরব করে দেয় — নৈঃশব্দ্যের সেই ভাষা, চিহ্ন বা দাগগুলোকে সরব করবার একটা দায় আছে দর্শনের। দর্শন সেই দায় ভুলে যেতে পারে না। যিনি এই কথা বলে ভাষা বা যে কোনো চিহ্নব্যবস্থা বিচারের নতুন কায়দা শিখিয়ে চিন্তাকে তুমুল শক্তিশালী করেছেন এবং কাজে কাজেই যুগপৎ মানুষের বৈষয়িক ও চিন্তার ইতিহাসের বৈপ্লবিক রূপান্তরের শর্ত আরো পাকা করেছেন, তাঁকে আমরা এক নামেই চিনি: ফরাসি দার্শনিক জাক দেরিদা। বলাবাহুল্য জাক দেরিদা ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে সমালোচনা আছে, কিন্তু এই নিবন্ধে তা তুলবার ফুরসত আমাদের হবে না। তবে বিপ্লবী প্রকল্পের আকাঙ্ক্ষা থেকে এই চিন্তার ধারা আগাগোড়াই বিচ্যুত এই ধরনের নেতিবাচক সমালোচনা আমাদের চোখে পড়ে নি। কথা হলো দেরিদা এমন কিছু প্রশ্ন তুলেছেন যার মীমাংসা ছাড়া বিপ্লবী প্রকল্পের পুনর্গঠন অসম্ভব— এটাই আমাদের অবস্থান। ভাবুকতার চর্চার ক্ষেত্রে দেরিদার এই কাজ সম্ভব হয়েছে মার্টিন হেইডেগার, নীটিশে, এডমুন্ড হুসার্ল, ইম্মেনুয়েল লেভিনাসহ আরো অনেকের অবদানের কারণে। খ্যাতির কারণে দেরিদার পরিচিতি বেশি। তবে মার্কসের পরে পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্ট বা পোস্ট-মর্ডানিস্ট নামে যারা পরিচিত তাদের চিন্তার ধারায়ও ইতিবাচক ফল আছে। সব মিলিয়ে ভাষার উৎপত্তি ও ব্যবহার বিচার করবার একটা শক্তিশালী ধারা তৈরি হয়েছে। সমাজের বৈষয়িক অবস্থা, অর্থনীতি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বাস্তব বিষয়কে বিচার করলে ভাষার উৎপত্তি ও ব্যবহারের দিক যেমন আমরা বুঝতে পারি — ভাষার অন্দরমহলে বসে যে কোন বয়ানের অন্তর্গত স্ববিরোধিতাও আমরা একালের দার্শনিকদের বরাতে চিহ্নিত করতে পারি। শ্রেণীর সঙ্গে শ্রেণীর লড়াই 'মতাদর্শ', চিন্তা বা বয়ান তৈরির পরিমণ্ডলে কীভাবে সক্রিয় থাকে শনাক্ত করা এখন তুলনামূলক ভাবে আগের চেয়ে সহজ। শুধু কে কাকে‘সন্ত্রাসী’ বলছে সেই দিকে যদি আমরা নজর রাখি দেখব, যে-পক্ষ প্রতিপক্ষের কাজকে ‘সন্ত্রাসী’ গণা করছে, অন্য পক্ষের কাছে সেই কাজটাই মুক্তির লড়াই। নীতিনৈতিকতার মীমাংসা এই বিভাজনের কাছে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে। কোন পক্ষের নীতি, কোন পক্ষের নৈতিকতার ওপর দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসের বিচার করব আমরা? নাকি পক্ষাপক্ষির বাইরে সন্ত্রাস নিয়ে কথা বলা সম্ভব?

সন্ত্রাস, সংবিধান, আইন ইত্যাদি

‘সন্ত্রাস’ মানে কী — আইন যদি সেটা শব্দে বাক্যে অনুচ্ছেদে ঠিক করেও দেয় তবুও সেই আইন ethics বা নীতিমাফিক হোল কিনা সেই মুশকিল থেকেই যায়। তারপর আইন নিজে আদৌ কোনো বৈধ ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো কিনা, কিম্বা সংবিধান বা আইন নিজের বৈধতা অর্জন করে কিভাবে— সেই সকল অতি প্রাথমিক প্রশ্ন তো আছেই। আইনের বৈধতা আইন নিজে দান করতে পারে নাকি তার বৈধতার উৎস অনাত্র— আইনের বাইরে। কিম্বা এমন পরিমণ্ডলে যার সম্পর্কে আমরা এখনো অজ্ঞাত, সেই পরিমণ্ডলের অনুসন্ধান দর্শন বা আইনশাস্ত্র হয়ত এখনও শুরুই করে নি। এই কালের ভাবুকদের মনোযোগ এই সকল প্রশ্নের দিকে।

সংসদে কোন আইনপাশ হলে সেটা সংবিধানসম্মত হতে পারে, কিন্তু নীতিসমত কিনা তার বিচার যে-সংবিধানের ভিত্তিতে আইনটি তৈরি হয়েছে সেই সংবিধান দিয়ে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। সংবিধানের পর্যালোচনা বা বিচার ছাড়া কোন আইনেরই নৈতিক দিক নিষ্পন্ন করা যায় না। হয়তো খোদ সংবিধানই নীতিনৈতিকতা বিরোধী। যে আইন নিপীড়িত ও অত্যাচারিতকে আরো নিপীড়ন ও অত্যাচারের জন্য তৈরি — সেই আইনকে কি আমরা আইন বলি, নাকি ‘কালোআইন’ বলি? একটি আইন সম্পর্কে আমরা বড়োজোর বলতে পারব আইনটি সাংবিধানিক হয়েছে— কিন্তু নীতিনৈতিকতা, ন্যায়বিচার বা ইনসাফের দিক থেকে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা সেটা সংবিধানের ভেতরে থেকে বিচার করা যাবে না। সেটা করা যাবে সংবিধানের বাইরের ভিন্ন মানদণ্ড দিয়ে, যে মানদণ্ড খোদ সংবিধানের পর্যালোচনা করতে সক্ষম। সেই মানদণ্ডে নীতিনৈতিকতা, ন্যায়বিচার বা ইনসাফ ইত্যাদির পর্যালোচনা থাকবে। কিন্তু এই নীতিনৈতিকতা, ন্যায়বিচার বা ইনসাফ এইসবই বা আবার কী? আইন, নীতি ও ইনসাফের মধ্যে একটা গূঢ় সম্পর্ক আছে আমরা অনুমান করতে পারি, কিন্তু সেই সম্পর্ক এখনো পরিচ্ছন্ন নয়। কিন্তু আরও গুরুতর প্রশ্ন হচ্ছে সন্ত্রাস, আইন ও ইনসাফের মধ্যে সম্পর্ক। তবুও সংবিধান পর্যালোচনার জন্য এমন এক মানদণ্ড খোঁজার তাগিদ আইনশাস্ত্রে ও দর্শনে থাকেই যে মানদণ্ড আইন বা ইনসাফের নীতি ও দর্শনের জায়গা থেকে বিদ্যমান সংবিধানকে বিচার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু দর্শনের কিছু বাতিক আছে। যাকে বলা হয় সন্দেহ করা। আসলে এই রকম কোন মানদণ্ড কিম্বা মানদণ্ড নির্মাণের কোন পরিমণ্ডল আদতে আছে কি? কী তার রূপ? কী তার চরিত্র? কী তার মর্ম?

ইত্যাদি নানা কারণে আইনের দর্শন ও ব্যবহারিক আইনশাস্ত্র উভয়েই ‘সন্ত্রাস’-কে কেমন করে আইনের মধ্যে মোকাবেলা করবে এবং সংবিধান ও আইনকে বৈধ প্রমাণ করবে সেই জবাবদিহিতার আপদ মাথায় বয়ে বেড়াচ্ছে বহুকাল। আইন-আদালতের চোখে ভায়োলেন্স আর টেররের অভেদ কিম্বা পার্থক্য দুটোই পরিষ্কার থাকা দরকার। সেটা আইন করে ভিন্ন করে দেখানো যায়। কিন্তু আসলে সন্ত্রাসকে আইন ও ইনসাফের জায়গা থেকে কীভাবে দেখলে সন্ত্রাসের ধর্ম আমরা বুঝব সেই তর্ক এখন উঠেছে। এই কালের আইনশাস্ত্রের তর্কবিতর্ক পড়লে পরিষ্কার যে এই সকল বিষয়ের মীমাংসা একটা তাগিদ আকারেই আছে, মীমাংসা হয় নি। সংবিধান, আইন ও আইনের প্রয়োগ এবং সর্বোপরি ন্যায়বিচার বা ইনসাফের দিক থেকে ‘সন্ত্রাস’-কে বোঝা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনীবিদ্যা ও দর্শন উভয়েই এখন কমবেশি স্বীকার করে যে এই কাজটি আসলে হয় নি। যদিও বিচ্ছিন্নভাবে এই সকল বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কিন্তু আজও মীমাংসা হয় নি।

এই মুশকিল আজকাল অনেক বেশি স্পষ্ট। ভায়োলেন্স বা টেরবের ভেদবিচার শুধু নয়, আসলে ‘সন্ত্রাস’ ব্যাপারটা কী— পাশ্চাত্য আইনবিদ্যা (jurisprudence) কিম্বা দর্শনেও সেটা পরিচ্ছন্ন নয়। সেই কারণে আইন ও ইনসাফের জায়গা থেকে সন্তাসের ভেদবিচার এই কালের দার্শনিকদের এক নম্বর প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। তাছাড়া সন্ত্রাসের ভেদবিচারের সঙ্গে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার সন্ত্রাস, যুদ্ধ ও ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবের বিরুদ্ধে দেশে দেশে নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের লড়াইয়ের ন্যায্যতা ও নৈতিক বৈধতার প্রশ্ন এতোই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে যে কি দর্শন কি আইনশাস্ত্র কেউ এই বিষয় নিয়ে তর্কের বাইরে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।

ঐতিহাসিকভাবে শোষক ও শাসক শ্রেণীর দেওয়া ‘সন্ত্রাস’- এর সংজ্ঞা ও তার ব্যবহারের ভুক্তভোগী সবসময় ছিলেন তাঁরাই যাঁরা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে বদলাতে চেয়েছেন, বদলাতে চান, কিম্বা যাঁরা বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বা জঙ্গি। কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা সবসময়ই বুর্জোয়া শাসক ও শোষক এবং তাদের আইন ও আদালতের চোখে ‘সন্ত্রাসী’। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় পাকিস্তানি শাসকদের কাছে মুক্তিযোদ্ধারাও ছিল ‘সন্ত্রাসী’। শাসক ও শোষক শ্রেণীর কাছে যা ছিল ‘সন্ত্রাস’ আমাদের কাছে তা ছিল মুক্তিযুদ্ধ — আমাদের বাঁচামরার সংগ্রাম। অথচ আবার বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ উভয়ের চোখেই পাহাড়ি জাতিসত্তার মুক্তি সংগ্রাম ‘সন্ত্রাস’ ছাড়া আর কী? কিন্তু অত্যাচারিত, নিপীড়িত ও গণহত্যার শিকার মুক্তিকামী পাহাড়িদের কাছে আমাদের অভিযোগের কী মূল্য? ঠিক তেমনি জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়ারসহ পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে ইসলামপন্থী জঙ্গিরা ‘সন্ত্রাসী’। অবশ্যই। কিন্তু আফগানিস্তান, ইরাক ও সাম্রাজ্যবাদের রক্তাক্ত ছোবলে ক্ষতবিক্ষত দেশগুলোর জনগণ নিশ্চয়ই জর্জ বুশ আর টনি ব্লেয়ারের চোখ দিয়ে জগত দেখে না। কোন রাজনীতি ঠিক বা বেঠিক- অর্থাৎ রাজনীতির উদ্দেশ্যে এবং উপায়ে ভুল বা নির্ভুলতার তর্ক যে যার রাজনৈতিক বিশ্বাসের জায়গা থেকেই করে। রাজনীতি নীতিকথার ক্ষেত্র নয়। শত্রুকে শত্রু এবং মিত্রকে মিত্র জানা এবং শত্রুর বিরুদ্ধে মতাদর্শিক, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিকভাবে লড়াই চালানোই রাজনৈতিকতা। রাজনৈতিক হয়ে ওঠা।

আইনী শাস্ত্র ও দর্শন এই ব্যাপারগুলো মোটামুটি জানে। কিন্তু এতে সমস্যার সুরাহা হয় না। কারণ তাহলে ‘সন্ত্রাস’ কি নিছকই একটা আপেক্ষিক ব্যাপার? নিজ নিজ রাজনৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে একে অপরকে সন্ত্রাসী বলা— এটাই কি মানুষের ইতিহাসের শেষ কথা? বলাবাহুল্য যাঁরা দর্শন বা ভাবের কারবারি তাঁরা এতো সহজে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দেবেন না কাউকে। প্রশ্ন হচ্ছে, আইনশাস্ত্র বা দর্শন এমন কোন প্রজ্ঞার পরিমণ্ডল বা ভাবের জায়গা দেখাতে পারে কিনা যেখানে দাঁড়ালে ‘সন্ত্রাস’-কে বোঝা অন্তত এখনকার চেয়ে অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন হয়? কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য সহিংসতা, সশস্রতা বা বলপ্রয়োগের এমন কোনো ভাবগত পরিমণ্ডল আছে কিনা যেখানে দাঁড়ালে আমরা এই বিষয়ে আরো পরিচ্ছন্ন চিন্তার সূত্রগুলো খুঁজে পেতে পারি? একালের এটাই প্রধান জিজ্ঞাসা।

মার্কসের পরে আসা ভাবুকদের অবদান

সম্প্রতি আইনের ক্ষমতা (Force of Law) ইনসাফ (Justice) এবং বলপ্রয়োগের (Violence) ভিত্তি ও তার বিচার পদ্ধতি নিয়ে ফরাসি দার্শনিক জাক দেরিদা নতুন করে কথা শুরু করায়, বিষয়গুলো হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ভাব বা দর্শনের জগতে যেমন, ঠিক তেমনি আইনী বিদ্যাতেও। এর আগে বিখ্যাত ভাবুক ওয়াল্টার বেনজামিন ভায়োলেন্স নিয়ে কথা তুলেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত নিবন্ধটির নাম Critique of Violence বা বলপ্রয়োগের পর্যালোচনা। স্বাভাবিক কারণেই জাক দেরিদা ওয়াল্টার বেনজামিনের এই লেখাটিকে ঘিরেই সহিংসতা, বলপ্রয়োগ, ইনসাফ ইত্যাদি নিয়ে তাঁর কথা খাড়া করেছেন। তাঁর সজীব তর্ক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ সংক্রান্ত তর্ককে সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। এইসব নিয়ে কথা বলতে গিয়েই ধর্ম নিয়ে তিনি যখন কাজ শুরু করলেন ঠিক তখনই তাঁর তিরোধান ঘটল। ভাব বা দর্শনের জগতে এর ফলে খুবই বড়ো এক অভাব তৈরি হয়েছে। জাক দেরিদার ভাবুকতার সঙ্গে আমাদের একমত হতে হবে এমন কোন কথা নাই, সেটা যে কোনো ভাবুঝের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কিন্তু কার্ল মার্কসের পরে এই শতাব্দিতে তাঁর সমান চিন্তাশীল মানুষ আমরা দেখি নি। কার্ল মার্কসের সঙ্গে তাঁর তুলনা করছি এই কারণে যে মার্কস শুধু বিপ্লবে অনুপ্রেরণা জোগান নি, সবার আগে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন। পর্যালোচনার প্রণোদনা তাঁর মধ্যেই আমরা পাই, ফলে তাঁর সঙ্গে, যেহেতু আমরা তাঁর সুবাদে চিন্তা করতে শিখি — তাঁর চিন্তার পর্যালোচনাও করতে পারি। ঠিক দেরিদাও আমাদের ভাবতে শিখিয়েছেন, যেন আমরা তাঁর চিন্তার ওপর দাঁড়িয়ে নতুনভাবে চিন্তা করবার তৌফিক লাভ করি। এটাই খাঁটি ভাবুকদের চেনার প্রথম পরীক্ষা বা একনম্বর মানদণ্ড।

মার্কস, লেনিন বা মাওজে দংয়ের কথা এখানে নতুন করে তোলার দরকার নাই। কে না জানে। (নাকি আমরা আজকাল আর কোনো খোঁজখবরই রাখি না)। ‘বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বদলে প্রলেতারীয় রাষ্ট্র বলভিত্তিক বিপ্লব ছাড়া অসম্ভব’ — মার্কস ও এঙ্গেলসের লেখালিখি থেকে লেনিন যে সারমর্ম করেছেন তাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বলপ্রয়োগের পক্ষে পরিষ্কার মতই আমরা দেখি। (লেনিন: রাষ্ট্র ও বিপ্লব)। অন্যদিকে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের চারটি বৈশিষ্ট্য লেনিন শনাক্ত করেছিলেন। এক: সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিবোধ ও দ্বন্দ্বের মীমাংসা না হওয়ার ফল হচ্ছে রাষ্ট্র। দুই: রাষ্ট্র হচ্ছে বলপ্রয়োগের হাতিয়ার যে হাতিয়ারের মধ্যে আছে সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও বলপ্রয়োগের জন্য সশস্ত্র ও নিরশস্ত্র নানান বাহিনী, কারাগার, ইত্যাদি। তিন: রাষ্ট্র হচ্ছে নিপীড়িত শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার এবং চার: বলভিত্তিক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা এবং তার সঙ্গে রাষ্ট্রের ‘শুকিয়ে মরা’-র সম্পর্ক বিচার।

‘বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস’— ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সশস্ত্র বলপ্রয়োগ সম্পর্কে মাওজে দংয়ের এই উক্তি বিখ্যাত। মাওজে দংয়ের এই উক্তির অনেক অপব্যবহার আছে সত্যি। কিন্তু তাঁর মূল কথা যে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন সরাসরি বলপ্রয়োগের ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ততাকে তত্ত্বগত ভাবে নাকচ করা যায় নি। এই বক্তব্যের বৈধতা নিজগুণে যেমন প্রতিষ্ঠিত, তেমনি ইতিহাসও মাওজে দং ও লেনিনের পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়। ফলে এই কালের ভাবুক আর দার্শনিকেরা লেনিন বা মাওজে দংকে অতিক্রম করে যেতে পারেন নি। তাঁরা বরং নতুন ও প্রশ্ন তুলেছেন। সেটা হোল বলপ্রয়োগের সঙ্গে আইন ও ইনসাফের সম্পর্কটা কী? কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বল প্রয়োগ অনিবার্য — এটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এর সঙ্গে কি আইন, আইনের দর্শন বা ইনসাফ বা ন্যায় বিচারের কোন সম্পর্ক আছে? জার্মান দার্শনিক মার্টিন হেইডেগারের ছাত্রী হানাহ আরেন্ডট-এর ‘বলপ্রয়োগ প্রসঙ্গে’ (On violence) নিবন্ধটিও দর্শনের জগতে পরিচিত। কারণ এখানে তিনি মার্কস, লেনিন ও মাওজে দং, সাত্রে, ফ্রানৎজ ফেনন এঁদের সঙ্গে দ্বিমত করেছেন। তবে তাঁর আলোচনা সন্ত্রাস সম্পর্কে প্রথাগত আলোচনার সীমা অতিক্রম করতে পারে নি বলে এই কালে তার উপযোগিতা কম।

ভায়োলেন্স বা বলপ্রয়োগ বিষয়ে মার্কস-লেনিনের অনুসারীদের মধ্যে যাঁর কথা না আসলেই নয় তিনি ফরাসি দার্শনিক লুই আলথুসার। বিপ্লবী রাজনীতি গরিবের বিরুদ্ধে ধনিক শ্রেণীর সহিংস বলপ্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রকে বিবেচনা করে। সেটা আমরা জানি। শ্রেণীসংগ্রামের ধারণার মধ্যে মতাদর্শিক লড়াই যেমন আছে তেমনি এক শ্রেণীর বিরুদ্ধে অন্য শ্রেণীর একনায়কতান্ত্রিক বলপ্রয়োগের অনিবার্যতা এবং প্রয়োজনীয়তার কথাও আছে। ধনী শ্রেণীর একনায়কতান্ত্রিক বলপ্রয়োগের বিপরীতে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কী বলপ্রয়োগের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা ও ন্যায্যতার কথাও আমরা জানি। কিন্তু লুই আলথুসার আমাদের বোঝালেন রাষ্ট্র যে শুধু দৃশ্যমান বলপ্রয়োগের মাধ্যমে গরিব ও সর্বহারা শ্রেণীকে দমন করে রাখে তা নয়, তার হিংসাহীন অদৃশ্য বলপ্রয়োগেরও হাতিয়ার আছে। একে তিনি নাম দিয়েছেন ‘মতাদর্শ তৈরির রাষ্ট্রীয় কারখানা’ (ideological state apparatus) শাসক ও শোষক শ্রেণী তাদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ ধরনের মতাদর্শ তৈরি করে এবং শিশু কিশোর বয়স থেকে যুবক বয়স অবধি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তরুণ তরুণীদের মস্তিষ্ক বিশেষ কায়দায় ধোলাই করে, সেটাও বলপ্রয়োগেরই আরেক রূপ মাত্র। আলথুসার যদি আমরা বুঝি তাহলে শ্রেণীগত কারণে তথাকথিত শিক্ষিতরা কেন মাদ্রাসা শিক্ষার বিরোধিতা করে সেটাও আমরা বুঝব। এক শ্রেণী তার প্রতিপক্ষ শ্রেণীর মতাদর্শিক কারখানাকে ধ্বংস করতে চায়। তাকে তাদের মতাদর্শিক কারখানায় অর্থাৎ তাদের মতো ‘আধুনিক’ শিক্ষায় রূপান্তরিত করতে চায়। এটাই তো স্বাভাবিক। শ্রেণী সংগ্রামের এ খুবই ইন্টারেস্টিং একটা রূপ। লুই আলথুসারের কারণে আমাদের বুঝতে সুবিধা কেন স্কুল, কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ‘মতাদর্শ বানাবার হাতিয়ার বা কারখানা’। মতাদর্শ তৈরির এই কারখানাগুলো ভেঙে নতুন ভাবে পুনর্গঠন না করলে গরিব ও খেটে খাওয়া শ্রেণীর মুক্তি অসম্ভব। অন্যদিকে নিজেদের কারখানার বাইরে মতাদর্শ তৈরির যে কোনো কারখানাকেই ধনীক শ্রেণী বিরোধিতা করে, সেটাও পরিষ্কার। ‘মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক করতে হবে’– এই দাবির পেছনে যে শ্রেণী ঘৃণা, প্রতিহিংসা ও নিজ শ্রেণীর ক্ষমতা নিরংকুশ করার আকাঙ্ক্ষা কাজ করে সেটা আলথুসারের কারণে আরো অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে ধনিক শ্রেণীর প্রকট ঘৃণার মধ্যে তাদের শ্রেণী স্বার্থেরই প্রতিফলন থাকে। কথা হোল, মাদ্রাসা শিক্ষা কিম্বা আধুনিক শিক্ষা ভাল কি মন্দ সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিতর্ক। মাদ্রাসা শিক্ষা যদি পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষা হয় তাহলে আধুনিক শিক্ষা ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষারই নামান্তর। কথা হচ্ছে দুটোই মতাদর্শ তৈরির কারখানা— একটি কারখানা ধনীদের, অন্যটি গরিব, এতিম, সমাজের নিম্ন আয়ের অভাবী মানুষদের। একটি আরেকটিরই প্রতিচ্ছায়া মাত্র। সমাজকে নতুন করে গড়বার কোন চিন্তা বা পরিকল্পনা এই দুইয়ের একটির পক্ষেও হাজির করা সম্ভব নয়। বিপ্লবী রাজনীতি উভয় ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনার মধ্য দিয়ে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা আবির্ভাবের শর্ত তৈরি করে। মোট কথা— শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মতাদর্শ তৈরির হাতিয়ার — অর্থাৎ সহিংস বলপ্রয়োগের হাতিয়ার হওয়ার পাশাপাশি হিংসাহীন অদৃশ্য কায়দায় বলপ্রয়োগের হাতিয়ারও বটে— এটাই ছিল লুই আলথুসারের প্রতিপাদ্য।

একবাল আহমেদ ও এডওয়ার্ড সাঈদ

তবে সন্ত্রাসের আলোচনায় যাঁদের প্রসঙ্গ না তুললেই নয়, এবং যাঁদের লেখালিখি ও চিন্তাভাবনা আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক তাঁদের মধ্যে রয়েছেন একবাল আহমেদ ও এডওয়ার্ড সাঈদ। সাঈদের যে-অবদানের সঙ্গে আমরা বেশি পরিচিত সেটা হচ্ছে পশ্চিমা দুনিয়া কীভাবে ইসলাম ও ইসলাম প্রধান দেশগুলোর জনগাষ্ঠিকে দেখে ও তাদের গণমাধ্যমে হাজির করে তার অজ্ঞতা, কপটতা ও ইতিহাস তিনি তাঁর লেখালিখির মধ্য দিয়ে বেশ খানিকটা দেখিয়ে দিতে পেরেছেন। বিশেষত সন্ত্রাস মাত্রই ‘ইসলামী’ ব্যাপার এই বয়ানটা গড়ে ওঠার পেছনে পাশ্চাত্যের ক্ষমতাধর শক্তির ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী প্রয়োজনটার প্রতি তিনি আমাদের নজর ফেরাতে পেরেছেন। অনাদিকে ‘ইসলাম’ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের অজ্ঞতার কারণে ইসলাম মাত্রই যে সন্ত্রাসী ব্যাপার এই প্রচার দানা বাঁধতে পেরেছে অনায়াসে। সেই ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলো যেমন ভূমিকা রেখেছে তাদের বুদ্ধিজীবীকুলও সমান পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছে সেটা কাগজে কলমে দেখিয়ে দিয়ে এডওয়ার্ড সাঈদ সন্ত্রাস সম্পর্কে দার্শনিক আলোচনার পথ অনেক সাফ করেছেন। সন্ত্রাস সম্পর্কে যাঁর বক্তব্য ও বিশ্লেষণকে সাঈদ বিশেষ মূল্য দিতেন তিনি হচ্ছেন একবাল আহমেদ (খান, ২০০৫)।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস সম্পর্কে একবাল আহমদের দেওয়া বক্তৃতায় একবাল বলছেন, ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত প্যালেস্টাইনের গোপন ইহুদি দলগুলোকে ‘Terrorist’ বলেই বর্ণনা করা হোত। কিন্তু ১৯৪২-এর দিকে ইহুদিদের ওপর হিটলারী নির্যাতন শুরু হোল (holocaust) এবং পাশ্চাত্যে ইহুদিদের প্রতি একটা উদারনৈতিক সংবেদনা তৈরি হওয়া শুরু হয়।

এই সময়ের প্যালেস্টাইনের ‘সন্ত্রাসী’, যারা একই সঙ্গে বিশেষ ইহুদিবাদী মতে ও পথে (Zionism) বিশ্বাসী, ১৯৪৪-৪৫-এর পর থেকে তাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিশাবে বর্ণনা ও পরিচয় দেওয়া শুরু হোল। মেনাযেম বেগিনসহ ইসরায়েলের অন্তত দুইজন প্রধানমন্ত্রীর নাম বইয়ে ও পোস্টারে পাওয়া যাবে যেখানে তাদের ছবিসহ ‘সন্ত্রাসী’- ধরিয়ে দিতে পারলে এতো টাকা ‘পুরস্কার’ দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা আছে। একবাল আহমেদ বলছেন, ‘সন্ত্রাসী’ মেনাখেম বেগিনের জন্য দশ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড পুরস্কারের ঘোষণা আমার নিজেরই নজরে এসেছে।

এরপর ১৯ ৬৯ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্যালেস্টাইন লিবারেশান অর্গানাইজেশান সন্ত্রাসী হিশাবে চিহ্নিত হয়। নিউইয়র্ক টাইমসের উইলিয়াম সাফায়ার ইয়াসির আরাফাতকে বারবারই ‘Chief of Terrorism’ বলে ভূষিত করেছেন। একবাল ঠাট্টা করে বলছেন, সেই ইয়াসির আরাফাতকেই আজ ১৯৯৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে দেখছি প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ডানদিকে ক্যামেরায় পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছবি। আর তাঁর বামে আছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু।

আরো অনেক উদাহরণ দিয়েছিলেন একবাল, আমাদের আলোচনার জন্য নজির হিশাবে এতোটুকুনই আপাতত যথেষ্ট। কে কখন কীভাবে সন্ত্রাসী হয়ে যায় আবার মুক্তিযোদ্ধা বনে তার নানান কাহিনী বলার পর একবাল বলছেন, এতো সব কাহিনী বলার মধ্য দিয়ে আমি এটাই বুঝাতে চাইছি সন্ত্রাসের ব্যাপারটা অনেক জটিল বিষয়। সন্ত্রাসী বদলায়। গতকালের সন্ত্রাসী আজকের নায়ক হয়ে উঠতে পারে। আর গতকালের হিরো আজ বনে যেতে পারে টেররিস্ট। এটা চারপাশের ছবি তৈরির জগতটার দ্রুত ভোল পাল্টানোর মধ্যে খুবই গুরুতর বিষয় যেখানে আমাদের মাথা সিধা রেখে ভাবতে হবে কাকে সন্ত্রাস বলে আর কাকে নয়। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোল কেন এটা ঘটে এবং কী করে আমরা বন্ধ করব ?

এডওয়ার্ড বা একবাল দুজনের কেউই নিজেদের ভাবুক বা দার্শনিক বলে দাবি করেন নি, কিন্তু এই সময়ে তাঁদের চিন্তার প্রভাব সারা বিশ্বব্যাপী পড়বার কারণ হচ্ছে তাঁরা এমন সব বিষয় নিয়ে লিখেছেন যা আমাদের কাজের নির্দেশনা দেয়। যেমন একবাল মনে করিয়ে দিচ্ছেন ‘সন্ত্রাস’ কী এবং কেন এগুলো জানা দরকার। কিন্তু কাজের দিক থেকে আদত প্রশ্ন হচ্ছে কী করে আমরা তা বন্ধ করব? এডওয়ার্ড সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে একবালের বিবেচনাকে শিরোধার্য মনে করেন। উৎস ভেদে সন্ত্রাসকে নানান ভাবে শনাক্ত করা যায়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ধর্মীয় সন্ত্রাস, অপরাধমূলক সন্ত্রাস, রাজনৈতিক সন্ত্রাস এবং অসুস্থতাজনিত সন্ত্রাস। এই বিভাজনের পরও একবালের দার্শনিক অন্তদৃষ্টি আমরা পাই যখন তিনি বলেন অন্য সব সন্ত্রাসে জান মালের বিপুল ক্ষয় ক্ষতির পরও সন্ত্রাসের একটি ধরনের প্রতি সকলের মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে। সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক সন্ত্রাস। (খানিক পরে ওয়াল্টার বেনজামিন ও জাক দেরিদার প্রসঙ্গে যখন আসব তখন আমরা দেখব, একবালের এই শনাক্তকরন দর্শনের জন্য কতো তাৎপর্যপূর্ণ। যদি জান মালের ক্ষয় ক্ষতি রোধ করাই আমাদের লক্ষ্য হয় তাহলে রাজনৈতিক সন্ত্রাস সেই দিক থেকে অন্য সকল সন্ত্রাসের তুলনায় কমই ক্ষয়ক্ষতি করে। কিন্তু রাজনৈতিক সন্ত্রাসই সন্ত্রাস সংক্রান্ত আলোচনায় এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দুনিয়াব্যাপী যুদ্ধের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। এই ব্যাখ্যার পর আছে একবালের সেই বিখ্যাত মন্তব্য। আমি খোদ ইংরেজিতেই একবাল থেকে বড় উদ্ধৃতি দেব:

So the focus is on only one, the political terrorist, the PLO, the Bin Laden, whoever you want to take. Why do they do it? What makes the terroristtick? I would like to knock them out quickly to you. First, the need to be heard. Imagine we are dealing with a minority group, the political, private terrorist. First, the need to be heard. Normally, and there are exceptions, there is an effort to be heard, to get your grievances heard by people.

They're not hearing it. A minority acts. The majority applauds. The Palestinians, for example, the superterrorists of our time, were dispossessed in 1948. From 1948 to 1968 they went to every court in the world. They knocked at every door in the world. They were told that they became dispossessed because some radio told them to go away--an Arab radio, which was a lie. Nobody was listening to the truth. Finally, they invented a new form of terror, literally their invention: the airplane hijacking. Between 1968 and 1975 they pulled the world up by its ears. They dragged us out and said, Listen, Listen. We listened. We still haven't done them but at least we all know. Even the Israelis acknowledge. Remember Golda Meir, Prime Minister of Israel, saying in 1970, “There are no Palestinians.” They do not exist.

They damn well exist now. We are cheating them at Oslo. At least there are some people to cheat now. We can't just push them out. The need to be heard is essential. One motivation there. Mix of anger and helplessness produces an urge to strike out. You are angry. You are feeling helpless. You want retribution. You want to wreak retributive justice. The experience of violence by a stronger party has historically turned victims into terrorists. Battered children are known to become abusive parents and violent adults. You know that. That's what happens to peoples and nations. When they are battered, they hit back.

(Eqbal 1998)

যে কণ্ঠস্বরকে আমরা নিঃশব্দ করে ফেলি। যাদের কথা আমরা আর শুনতে চাই না, শুনি না। যাদের অস্তিত্ব আমরা মুছে ফেলতে চাই, যাদের মুখ আমরা আর দেখি না — তারা তাদের হাজিরা বুঝিয়ে দেবার জন্য, তাদের কণ্ঠস্বর শোনাবার জন্য- কথা বলবার নতুন ডিসকোর্স আবিষ্কার করে, কথা শোনাবার নতুন পথ তারা বের করে। সন্ত্রাস হচ্ছে ভাষা। প্রথাগত ভাষায় যখন আর কথা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব, সন্ত্রাস কথার জায়গায় নতুন ভাষা হয়ে স্থান দখল করে।

সন্ত্রাস সম্পর্কে ওয়াল্টার বেনজামিন ও জাক দেরিদার আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা দেখব ঘুরে ফিরে আমরা একবাল আহমেদের এই মোদ্দা কথাতেই ফিরে এসেছি। একবালের ভাষা সহজ, একবালকে বোঝার জন্য পণ্ডিত হবার প্রয়োজন পড়ে না। একবাল বোকা বানিয়ে দিতে ওস্তাদ। মনে হয় খুবই চেনাজানা কথাই বুঝি একবাল বলছেন, কিন্তু একবাল কথা বলেন কাব্য ও দর্শনের ভেতর থেকে, কিন্তু কবি বা দার্শনিকের মতো নয়— একজন কর্মোদ্যোগীর মতোন যিনি সম্মুখস্থ কাজ সমাধান করাকেই বৈপ্লবিক কাজ মনে করেন। বিপ্লবের কোন কাল্পনিক গুহায় বা কন্দরে যিনি বাস করেন না। এই জন্যেই একবালের প্রাসঙ্গিকতা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য অপরিসীম।

বলাবাহুল্য ‘সন্ত্রাস’ ‘সশস্ত্রতা’, ‘শ্রেণী সংগ্রাম’ ইত্যাদি ধারণা ও তার প্রয়োগ মানুষের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ও রাখে। এটা অন্তত খবর হয়েও আমাদের কানে হয়তো এসেছে। (নাকি আসে নি?)। কিন্তু এই সকল ধারণার ভেতরে প্রবেশের প্রয়োজনীয়তা আমরা বোধ করি না। ক্ষমতা বা সামর্থ্যের প্রশ্ন আসে পরে। তাদের প্রয়োগের যথার্থতা নিয়েও মাথা ঘামানোর প্রয়োজনীয়তা বোর করি না আমরা। রাখলেও এই সকল ধারণার যে যথেচ্ছ ব্যবহার আমরা করি তাতেই আমাদের মানসিক বৃত্তির মাত্রা ও হুজুগেপনার চরিত্র ধরা পড়ে। ‘সশস্ত্রতা’, ‘সন্ত্রাস’ ‘সহিংসতা’ ইত্যাদি সংবিধান, আইন, মানবাধিকারের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় — সেই বোধটুকুও আমাদের নাই। সে আলোচনা আমরা শুরু করি নি। ভাবুকতা বা দর্শনের তরফে আজকাল যেকথা উঠেছে তার ধারে কাছে যাবার প্রস্তুতি আমরা নিতে পারি নি। আমাদের আয়োজন নাই বললেই চলে। তবুও অন্তত মার্কস, লেনিন, মাওজে দং, এডওয়ার্ড, একবাল, ওয়াল্টার বেনজামিন, জাক দেরিদা হয়ে চিন্তা ও তৎপরতার ক্ষেত্র যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তার খানিক খোঁজখবর এখন না নিলেই নয়।

ওয়াল্টার বেনজামিনের ‘সন্ত্রাস’ পর্যালোচনা

ভাবের জমিনে দাঁড়িয়ে ওয়াল্টার বেনজামিনের জর্মন ভাষায় Zur Kritik der Gewalt বা ইংরেজিতে Critique of Violence নিবন্ধটি সামনে রেখে আর তাকে কেন্দ্র করে জাক দেরিদার ‘আইনের ক্ষমতা: কর্তৃত্বের রহস্য’ (Force of Law: The 'Mystical Foundation of Authority') শিরোনামের কথনটির সুবিধা নিয়ে আমরা কয়েকটি কথা এখানে পেশ করতে পারি। যদিও Zur Kritik der Gewalt-এর ইংরেজি অনুবাদ হিসেবে Critique of Violence করা হয়েছে, আসলে gewalt- এর অনুবাদ ঠিক ইংরেজি violence দিয়ে বোঝানো মুশকিল। বেনজামিনের বিষয়ের যে বিস্তৃতি ভায়োলেন্স শব্দের মধ্যে সেই বিস্তৃতি নাই। আসলে বেনজামিন আলোচনা করছিলেন ক্ষমতা বা বলপ্রয়োগ নিয়ে। ক্ষমতার ব্যবহার বা বলপ্রয়োগ বৈধ হতে পারে আবার অবৈধও হতে পারে, আবার তার রূপ সহিংস হতে পারে আবার নাও হতে পারে। অন্যদিকে আইনের পেছনে যদি ক্ষমতা বা বলপ্রয়োগ না থাকে সেটা তো কাগুজে আইন। যে কারণে দেরিদা এই নিবন্ধটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন, Force of Law — আইনের ক্ষমতা, বল, শক্তি, সহিংসতা ইত্যাদি অর্থে। মনে করিয়ে দিতে যে সন্ত্রাসের সঙ্গে আইনের একটা অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক আছে। কিন্তু ইংরেজি ভায়োলেন্স বললে শুধু সহিংসতার কথাই বলা হচ্ছে মনে হয় এবং ক্ষমতা বা বলপ্রয়োগের সঙ্গে তার বৈধতা কিম্বা অবৈধতার প্রশ্ন আড়াল হয়ে যায়। অন্যদিকে আমাদের আগের আলোচনায় দেখেছি যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধে terror বা terrorism কথাটা violence কথাটিরই প্রতিশব্দ হিশাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সহিংস বলপ্রয়োগ— তাকেই ক্ষমতাসীন শক্তি বা কর্তৃত্ব ‘সন্ত্রাস’ নামে আখ্যায়িত করছে। বেনজামিনের পর্যালোচনা সেই দিক থেকে ‘সন্ত্রাস’-কে আমরা কীভাবে বিচার করব সেই প্রশ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। সন্ত্রাস সম্পর্কে বেনজামিনের আলোচনার তাৎপর্য শুধু তার বিচারে নয়, বরং একই সঙ্গে আইন ও ইনসাফের প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।

বেনজামিন কথাটিই শুরু করেছেন এই ভাবে যে সন্ত্রাস বা সহিংসতার পর্যালোচনা আসলে আইন ও ইনসাফের সঙ্গে এর সম্পর্ক বিচার। তাহলে ভায়োলেন্স বা ‘সন্ত্রাস’ বললেই আমাদের মনে যে ছবি বা ধারণা আসে তার সঙ্গে এই প্রস্তাবনা মেলে না। বেনজামিন আইন এবং ইনসাফ নিয়ে কথা তুলছেন এই দিকটা শুরু থেকেই মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। বেনজামিনের ‘ভায়োলেন্স’ কখনও সহিংসতা, কখনও সন্ত্রাস, কখনও বলপ্রয়োগ এই প্রকার নানাবিধ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

আমরা যখন কোনো উদ্দেশ্য সাধন করতে চাই, সেটা রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়— যাই হোক, তাকে আমরা তখনই ‘সন্ত্রাস’ বলি যখন তা আমাদের নীতিনৈতিকতার জগতের সঙ্গে বিবাদ ধাঁধায়। নীতিনৈতিকতার এই জগত বা পরিমণ্ডলকে আইন এবং ইনসাফের ধারণা দিয়ে বাবার চেষ্টা চলে। আইনের দিক থেকে যদি বিচার করি তাহলে যে কোন আইনেরই বিচার্য বিষয় হচ্ছে উপায় ও লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পক নির্ণয়: সন্ত্রাসকে বিচার করতে হবে আগে উপায়ের মধ্যে, লক্ষ্যের মধ্যে নয়- অর্থাৎ কী উপায়ে একটি বিশেষ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তার নিরিখে। যদি সন্ত্রাস কোন একটি লক্ষ্য অর্জনের উপায় মাত্র হয়ে থাকে তাহলে একে পর্যালোচনা করবার মানদণ্ড যেন আমরা হাতের কাছেই পেয়ে যাচ্ছি। যেমন, লক্ষাটি ন্যায়সঙ্গত নাকি ন্যায়সঙ্গত নয়? যদি ন্যায়সঙ্গত হয় তাহলে সেই লক্ষ্য অর্জনের উপায় সশস্ত্র, সামরিক বা সন্ত্রাসমূলক হোক তাতে কী আসে যায়? যদি তাই হয় তাহলে সন্ত্রাসের পর্যালোচনা কাকে আমরা ন্যায়সঙ্গত লক্ষ্য বলি আর কাকে বলি না সেই মানদণ্ড বিচারের পরিমণ্ডলে গিয়ে পড়ে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ন্যায় ও অন্যায়ের সিদ্ধান্ত নিলেই বুঝি ঝামেলা চুকে যায়, কিন্তু বিষয়টি আরো গভীর। এই ভাবে যখন উপায়কে তার লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত করে আমরা ভাবি তখন আসলে। আমরা খোদ সন্ত্রাস নিয়ে কথা বলি না। কোন বিশেষ ক্ষেত্রে সন্ত্রাস, সহিংসতা বা বলপ্রয়োগকে আমরা ন্যায্য বলব আর কোন ক্ষেত্রে তা অন্যায় সেই কথাই শুধু বলা হয়। তাহলে তো আর সন্ত্রাসের পর্যালোচনা হোল না। এটা আরো বোঝা যাবে যদি আমরা প্রশ্ন তুলি, লক্ষ্য যদি ন্যায্যও হয় তাহলে উপায় হিশাবে সন্ত্রাস, সহিংসতা বা বলপ্রয়োগ নৈতিক দিক থেকে সমর্থনযোগ্য কিনা। এই প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য আরো ভালো মানদণ্ড আমাদের খুঁজতে হবে। লাক্ষার ন্যায্যাতা দিয়ে লক্ষ্য অর্জনের উপায়কে ন্যায়া প্রমাণ করা যাবে না।

(বেনজামিন দাবি করছেন, এই মানদণ্ডের অনুপস্থিতি আইনীবিদ্যা (jurisprudence) এবং আইন সংক্রান্ত দর্শনের মূল ধারার প্রধান চরিত্র লক্ষণ। লক্ষ্য ন্যায়সঙ্গত হলেই লক্ষ্য অর্জনের উপায়ও ন্যায়সঙ্গত কিনা এই প্রশ্ন আইনশাস্ত্রের ও আইনের দর্শনকে বিব্রত করে না। আমরা কিছু দেখবার লক্ষ্যে যেমন প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক কারণেই শরীর ঘুরিয়ে তাকাই, তাকানোর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করবার জন্য শরীর বাঁকানো যেমন আমার ‘অধিকার’— ঠিক তেমনি যেন প্রাকৃতিক উদ্দেশ্য সাধনের সঙ্গে সাধনের উপায়েরও একই সম্পর্ক। উদ্দেশ্য যদি ঠিক হয় তাহলে যেন উপায়ও সঠিক।

এই তত্ত্বের অন্দরমহলের দিকে তাকালে দেখা যাবে এই তত্ত্ব যেন বলতে চাইছে সন্ত্রাস একান্তই একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার। প্রকৃতির মধ্যে হাজির কাঁচামাল কোন কিছু তৈরিতে আমরা যেমন ব্যবহার করি সন্ত্রাসও প্রাকৃতিক ভাবে আহরিত এক ধরনের কাঁচামাল যা আমরা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বাবহার করি। ফলে লক্ষ্য ও উপায়ের এই প্রাকৃতিক সম্পর্কের মধ্যে কোন গোলমাল নাই, মুশকিল শুরু হয় যদি সন্ত্রাস অন্যায় উদ্দেশ্য সাধনের জনা ব্যবহৃত হয়। এই তত্ত্বের মতাদর্শিক ভিত্তি বেনজামিনের কথানুযায়ী সাহংস ফরাসি বিপ্লব। ফরাসি বিপ্লব যদি ন্যায়া হয় তাহলে তার সহিংসতা ও সন্ত্রাস ও ন্যায্য। আইন ও ন্যায়ের ন্যায্যতা প্রকৃতি বা প্রাকৃতিকতার মধ্যে এই দার্শনিক তত্ত্বের গোড়া অনেক গভীরে। স্পিনোজা তাঁর Tractatus Theologico-Politicus এ বলছেন ব্যক্তি যখন অন্য সকল ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্র নামক যৌক্তিক চুক্তি সংস্পন্ন করে রাষ্ট্র নির্মাণ করে তখন তারা বাষ্ট্রের কাছে তাদের সকল সন্ত্রাস ও সহিংসতার সামর্থ্যও সোপর্দ করে। তার মানে চুক্তির আগে বাস্তবে (de facto) তার কাছে প্রাকৃতিক ভাবে যে সন্ত্রাস ও সহিংসতার সামথ্য থাকে সেটাই যখন ইচ্ছা তখন ব্যবহারের আইনী ‘অধিকার’- সে রাষ্ট্রকে সোপর্দ করে। প্রকৃতির মধ্যেই সন্ত্রাস আছে অতএব এটা এমন কোন দার্শনিক বা নৈতিক সংকট নয় এই কথাটা চার্লস ডারউইনের লেখালিখির মধ্য দিয়ে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক বিবর্তন সংক্রান্ত যে ধারণা গড়ে উঠেছে সেখান থেকেও রসদ সংগ্রহ করে। যেমন প্রাকৃতিক নির্বাচন বাদ দিলে সন্ত্রাস ও সহিংসতা প্রকৃতির অন্তর্গত স্বভাব। বাঘ যেমন হরিণ খায়, সাপ যেমন ব্যঙ খায়, কিম্বা চিল যেমন মাছ— ঠিক তেমনি সন্ত্রাস ও সহিংসতাও আগাগোড়া প্রাকৃতিক একটা ব্যাপার। এই তত্ত্বগুলো এইভাবেই এক ধরনের গোঁড়া বিশ্বাস বা জ্বলজ্যান্ত সত্যের মোড়কে হাজির হয়ে যায়। ইতরোচিত ডারউইনবাদ বা ডারউইনের লেখালিখি থেকে রসদ পাওয়া সেই অতি পরিচিত আইনী দর্শন বা তত্ত্বটাও আমাদের জানা যে প্রাকৃতিক লক্ষ্য সাধনের জন্য সহিংসতা বা সন্ত্রাসও বৈধ। বাঘ মানুষ খেলে সেটা প্রাকৃতিক দিক থেকে যদি ন্যায্য হয় তাহলে শক্তিমান দুর্বলকে আত্মসাৎ করলে সেটাও ন্যায্য। কারণ সেটাও প্রাকৃতিক একটা প্রক্রিয়া মাত্র। ঠিক একই যুক্তিতে জর্জ বুশ যদি দুনিয়াকে নিজের অধীনস্থ করবার জন্য যুদ্ধবিগ্রহ সশস্রতা চালিয়ে যেতে চান তবে সেটাও ন্যায্য, কারণ প্রাকৃতিক ভাবে যে শক্তিশালী সে দুর্বলের ওপর বলপ্রয়োগ করবেই। আইনশাস্ত্রের যে দুটো স্কুল আছে তার মধ্যে এই তত্ত্বটা Natural Law বা প্রকৃতিসিদ্ধ স্কুল নামে খ্যাত।

অন্যদিকে আছে ঐতিহাসিক ঘটনাঘাটনে বিদামান বা ঐতিহাসিক স্কুল (Positive Law)। এই ধারার চোখে সন্ত্রাস হচ্ছে ইতিহাসেরই একটা ফল। যেখানে প্রকৃতিসিদ্ধ স্কুল সকল বিদ্যমান আইনকে বিচার করে তার উদ্দেশ্যের ন্যায়-অন্যায় বিচারের নিরিখে, ঐতিহাসিক স্কুল সেটা করে উপায়ের ন্যায়-অন্যায় পর্যালোচনা করে। যদি ইনসাফ কায়েমই কোন কাজের লক্ষ্য হয় তাহলে উপায়ের মধ্যেই তার প্রতিফলন ঘটবে, সেখানেই তার বৈধতার বিচার করতে হবে। আইনশাস্ত্রের এই প্রাকৃতিকতা বা ঐতিহাসিকতার প্রভেদ থাকা সত্ত্বেও দুটো ধারাই একই গোঁড়ামির ওপর দাঁড়ানো: ন্যায়সঙ্গত উদ্দেশ্য সাধিত হয় ন্যায়সঙ্গত উপায় ব্যবহারের মাধ্যমে - ন্যায়সঙ্গত উপায়ের ব্যবহার হয় ন্যায়সঙ্গত লক্ষ্য অর্জনের জন্য। প্রতিসিদ্ধ স্কুলের প্রবক্তারা উদ্দেশ্যের ন্যায্যতা দিয়ে উপায়ের 'ন্যায্যতা' প্রমাণ করেন, আর বিদ্যমান বা ঐতিহাসিক স্কুলের প্রবক্তারা উদ্দেশ্যের ন্যায্যতা 'নিশ্চিত' করেন উদ্দেশ্য অর্জনের উপায়টাকে ন্যায্য দাবি করে। দেখা যাচ্ছে উভয় পক্ষেরই গোঁড়ামি হচ্ছে উপায় আর লক্ষ্যের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছেই এই আগাম অনুমানের মধ্যে। যদি গোড়ার এই অনুমান মিথ্যা হয় যদি দেখা যায় ন্যায্য উদ্দেশ্য আর উদ্দেশ্য সাধনের ন্যায্য উপায়ের মধ্যে অসঙ্গতি ও বিরোধ এমনই যা আর মীমাংসা করা যায় না তাহলে এই তর্কের কোন সমাধান হবে না। লক্ষ্য ও উপায়ের মধ্যে এই চক্রাকার সম্পর্ক ভাঙতে না পারলে পর্যালোচনা অচল হয়ে যায়। অতএব ন্যায্য লক্ষ্য এবং ন্যায্য উপায় দুটোকে আলাদা করে বিচারের মানদণ্ড অনুসরণ না করলে এই গেড়াকল থেকে বেরুবার অনা কোন পথ নাই। এই ছিল ওয়াল্টার বেনজামিনের প্রাথমিক প্রস্তাবনা।

অতএব বেনজামিন উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। অর্থাৎ কোন কাজ বা সংকল্পের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ন্যায্য কি অন্যায্য তার বিচার আপাতত মুলতুবি রেখে লক্ষ্য সাধনের উপায়কে তাঁর নিবন্ধে স্বাধীনভাবে বিচার করেছেন। যে-উপায়কে আমরা সন্ত্রাস, সহিংসতা বা বল প্রয়োগ বলে গণ্য করি তার ন্যায়-অন্যায় বিচারকেই তাঁর আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। আইনশাস্ত্রের প্রকৃতিসিদ্ধ স্কুল এই প্রশ্নটার মোকাবিলা করতে পারে না, ঘুরেফিরে ওদের যুক্তি ফুটা ঝুড়িতে ডিম রাখার মতো হয়ে যায় — কোন উপসংহারে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ঐতিহাসিক স্কুল উদ্দেশ্যকে পরম গণ্য করে তার ন্যায্যতা নিশ্চিত করবার জন্য উপায়কে ন্যায্য প্রমাণের চেষ্টা করে, সেই দিক থেকে উদ্দেশ্য ন্যায্য কি অন্যায্য সেই সম্পর্কে এই ঘরানা থাকে অন্ধ। ঠিক তেমনি প্রকৃতিবাদী স্কুল কী উপায়ে উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে সেই ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকে। তবে, বেনজামিন বলছেন, আলোচনা শুরুর প্রাথমিক প্রস্তাবনা হিশাবে আইনশাস্ত্রের ঐতিহাসিক স্কুল— অর্থাৎ সন্ত্রাস, সহিংসতা বা বলপ্রয়োগের ন্যায্যতা ইতিহাসের মধ্য দিয়ে নির্ণীত হয়— এটা মেনে কথা শুরু হতে পারে। কেন? কারণ কোন পরিস্থিতিতে বা কোন উদ্দেশ্যে সন্ত্রাস, সহিংসতা বা বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে তা বিবেচনায় না নিলেও মোনি দাগে এই ঘরানা সন্ত্রাসের মধ্যে ইতরবিশেষ করে। অর্থাৎ কোন সন্ত্রাস ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত অনুমোদিত সন্ত্রাস আর কোন সন্ত্রাস ইতিহাস অনুমোদন করে না— অন্তত এই বিভাজনটুকু মানে। যেমন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমরা যে সশস্ত্র সংগ্রাম করেছি তার ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে আইনশাস্ত্রের ঐতিহাসিক স্কুল বৈধ বলে মানবে। কথাটা এখান থেকে শুরু করলেও সন্ত্রাসের বিভাজন ঐতিহাসিক ভাবে অনুমোদিত বা অনুমোদিত নয়— এই খাপের মধ্যে যেন আবার না পড়ে যায় সেই দিকেও খেয়াল রাখ্য চাই। তার মানে যেহেতু সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তি আদায় হয়েছে অতএব সব সময়ই সশস্ত্র সংগ্রাম বৈধ বা ন্যায্য এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। কারণ মনে রাখতে হবে আইনশাস্ত্রের এই ঐতিহাসিক ধারা যে বিভাজনটা করছে সেটা একটা সন্ত্রাসের মূল্যায়ন মাত্র। কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে সন্ত্রাস ব্যবহার করা যায়, বা করা যায় না তার তত্ত্বগত কিম্বা ব্যবহারিক প্রশ্নের উত্তর দিতে সে অক্ষম। তাহলে সন্ত্রাসের পর্যালোচনা যখন আমরা নতুন করে করবার কথা বলি তখন আমরা ঐতিহাসিক ভাবে অনুমোদিত বা অননুমোদিত সন্ত্রাসের এই বিভাজনকে প্রশ্ন করে কথা শুরু করতে পারি। এই পার্থক্যের মানে কী? কী অর্থ এই পার্থক্য থেকে করা যায় যা সন্ত্রাসের বিচারে আমাদের কাজে লাগে? তাছাড়া যদি তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক সিদ্ধান্তে এটা কাজে না লাগে তাহলে কোন ক্ষেত্রে সন্ত্রাসের এই দুই প্রকার মূল্যায়ন খাটে, আর কোন ক্ষেত্রে খাটে না?

সারমর্মে কথাটা হচ্ছে এইরকম: যদি আইনশাস্ত্রের ঐতিহাসিক স্কুল সন্ত্রাসের বৈধতা ও অবৈধতা বিভাজনের যে মানদণ্ড প্রস্তাব করেছে সেই মানদণ্ড মূল্যায়ন করে তার অর্থ আমরা বুঝি ও অন্যদের বোঝাতে পারি তাহলে তার মূল্য অনুসারে সন্ত্রাস প্রয়োগের ক্ষেত্রগুলোরও একটা পর্যালোচনা আমরা করতে পারব। কিন্তু এই পর্যালোচনায় যদি আমরা নামতে চাই তাহলে প্রকৃতিসিদ্ধ আইনশাস্ত্র আর আইনের ইতিহাসবাদী দর্শন — উভয়ের পাটাতন থেকে নেমে আমাদের অন্য একটি জায়গা খুঁজতে হবে যেখান থেকে উভয় ধারার পর্যালোচনা সম্ভব। এই পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে আইনেরও একটা ঐতিহাসিক-দার্শনিক বিচারের জায়গা তৈরি হবে।

বৈধ আর অবৈধ সন্ত্রাসের অর্থ খুব পরিচ্ছন্ন নয়। আইনের প্রতিসিদ্ধ স্কুল ন্যায্য ও অন্যায্য উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসের ব্যবহার দিয়ে সন্ত্রাস বিচারের যে পদ্ধতি প্রস্তাব করে তাকে নাকচ করা দরকার, কারণ এতে বিভ্রান্তি বাড়ে। আইন বা দর্শনের খুব কাজ লাগে না। বরং সব সন্ত্রাসকেই নিজের পক্ষে তার নিজের উদ্ভবের ইতিহাস হাজির বা জন্মের প্রমাণ দাখিল করতে হয়। কেবল তখনই ক্ষেত্র বিশেষে তাকে বৈধ বা অনুমোদিত বলা যাবে-আইনী দর্শনের ইতিহাসবাদী স্কুলের এই দাবি থেকে শুরু করলে সন্ত্রাসের পর্যালোচনার কাজে অনেক সুবিধা। আইনের দিক থেকে বৈধ সন্ত্রাসকে আমরা পরিষ্কার বাস্তব ইতিহাসে কীভাবে তার প্রয়োগ হয়েছে সে দিক থেকে দেখতে পারি। যে বিশেষ লক্ষ্যে সেই সন্ত্রাস ব্যবহৃত হয়েছে— অর্থাৎ সেই সন্ত্রাস যে একটা স্বীকৃত লক্ষ্যের অধীন সেটাও সহজে বোঝা যায়। যে ধরনের সন্ত্রাস এই ধরনের ইতিহাসসিদ্ধ স্বীকৃতি লাভ করতে পারে নি অর্থাৎ নিজের জন্মসূত্র দাখিল করে নিজেকে আইনের দিক থেকে বৈধ প্রমাণ করতে পারে নি তারা আইনের বাইরে প্রাকৃতিক উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিশাবে গণ্য হতে পারে, আগেরটিকে বলতে পারি, আইনী উদ্দেশ্য সাধনের উপায়। আইনী উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বৈধ সন্ত্রাস, সহিংসতা বা বলপ্রয়োগ আর প্রাকৃতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সন্ত্রাস, সহিংসতা বা বলপ্রয়োগ — সন্ত্রাসের এই দুই প্রকার ভূমিকা আইনের বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতা বা পটভূমির আলোকে সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব।

আইনের চোখে ব্যক্তি তার প্রাকৃতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সন্ত্রাস ব্যবহার করলে তাকে অনুমোদন না দেবার প্রবণতা আমরা আইনব্যবস্থার মধ্যে দেখি। যেমন সন্তানকে শাসন করবার জন্য বাবা মাও যদি অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেন তবে আইন সেটা সাধারণত বরদাশত করে না। হয়তো বলপ্রয়োগ সন্তানের জন্য মঙ্গল হতে পারে। বাবা মায়ের সঙ্গে সন্তানের স্বাভাবিক প্রেম ও শাসনের সম্পর্কের মধ্যে ইতিবাচক দিক থাকলেও ব্যক্তি হিশাবে বাবা কিম্বা মা সন্তানের ওপর বলপ্রয়োগের জন্য আইনের কাছেও জবাবদিহি করতে বাধ্য হতে পারে। যতোই যুক্তি থাকুক আইনের সীমানার বাইরে সন্ত্রাস অনুমোদিত নয়। সন্ত্রাসের প্রয়োগ একমাত্র আইনের আশ্রয়েই হতে হবে এবং আইনী লক্ষ্যেই পরিচালিত হতে হবে। এমনকি সেই সব ক্ষেত্রেও আইনের সীমানার বাইরে প্রাকৃতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য বল প্রয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়না যেখানে নীতিগত ভাবে বলপ্রয়োগ লক্ষ্য অর্জনে কাজে লাগে। যেমন শিক্ষা। স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের ওপর বলপ্রয়োগের ওপর আইনী সীমানা টানা বা নিষেধ থাকে। আসলে ব্যক্তির হাতে সন্ত্রাস, সহিংসতা বা বলপ্রয়োগের ক্ষমতা বা অধিকার আইনী ব্যবস্থা সবসময় বিপজ্জনক গণ্য করেছে।

বিপদটা কী? ব্যক্তির বলপ্রয়োগের অধিকার কি আইনী বলপ্রয়োগের ন্যায্যতা কিম্বা বলপ্রয়োগের নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রশ্নবোধক করে? নাকচ করে দেয়? মোটেও না। যদি তাই হোত তাহলে সন্ত্রাসকে আমরা সাধারণ ভাবে নিন্দা করি কেন? যে ধরনের সন্ত্রাস আইনী বৈধতার বাইরে, কেবল তাকেই আমরা শুধু খারাপ বলতাম। আইনী লক্ষ্য অর্জনের জন্য সন্ত্রাসের বাইরে যদি প্রাকৃতিক লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সন্ত্রাস চালানো হয় তাহলে আইনী লক্ষ্য অর্জনের জন্য বৈধ সন্ত্রাসের ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব এই যুক্তি ঠিক না। আমরা বরং দেখি যে আইন সবসময়ই চায় সন্ত্রাসের ওপর ব্যক্তির বিপরীতে নিজের নিরঙ্কুশ একচেটিয়া। এই একচেটিয়ার উদ্দেশ্য আইনী লক্ষ্য অর্জনের উপায়কে রক্ষা নয়, বরং স্বয়ং আইনকেই রক্ষা করা। ধরা যাক গ্রামে একটি লোক অপরাধ করেছে এবং আইন আদালতের বাইরে গ্রামীণ ব্যবস্থার মধ্যে তাকে গ্রামের মানুষ শাস্তি দিয়েছে, আইনী লক্ষ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে তাকে একই ধরনের শাস্তিই হয়তো দেয়া হোত। কিন্তু আইন এটা মানবে না। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবার জন্য হলেও আইন কেউ নিজের হাতে তুলে নিতে পারবে না— এই হচ্ছে আইনের কথা। যদি আইনী লক্ষ্য বাস্তবায়নই আইনের লক্ষ্য হয় তাহলে একই লক্ষ্য আইনের বাইরে অর্জিত হলে আইন নিজের বিপদ দেখে কেন?

বেনজামিন বলছেন, আইনী লক্ষ্য সংরক্ষণই যেমন দোষীকে শাস্তি দেওয়া, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি আইনের উদ্দেশ্য— এই দাবি ঠিক না। আইনী লক্ষ্য সংরক্ষণই যদি আইনের উদ্দেশ্য হয় তাহলে দোষীকে আইনের বাইরে একই শাস্তি দিলে আইনের কী অসুবিধা? আইনের বাইরে যদি ন্যায়বিচার অর্জন সম্ভব হয় তাহলে আইন সেখানে আপত্তি তোলে কেন? আসলে দোষীকে শাস্তি দেওয়া বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই বলপ্রয়োগের ক্ষমতা একমাত্র আইনের হাতেই থাকতে হবে এই দাবির কোন সত্যতা নাই। আইনের হাতে বলপ্রয়োগের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আর ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক একরৈখিক নয়। ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে আইনের হাতে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা থাকা-না-থাকার প্রশ্ন আদৌ জড়িত কিনা সেও এক প্রশ্ন — অথচ আইন তো প্রায়ই এই কথাই দাবি করে। আসল কথা হোল সন্ত্রাস, সশস্রতা, সহিংসতা বা বলপ্রয়োগের ক্ষমতার ওপর যদি আইনের একচেটিয়াত্ব না থাকে তাহলে আইন আর আইন হিশাবে টিকে থাকতে পারে না। আইনের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে। আইন, রাষ্ট্র বা কর্তৃত্ব মাত্রই বলপ্রয়োগের ওপর একচেটিয়া ক্ষমতা। সে কারণে আইনের বাইরে সন্ত্রাস, সহিংসতা বা বলপ্রয়োগের ক্ষমতা কারো থাকতে পারে না।

রাষ্ট্রের বাইরে একক সন্ত্রাস নিষিদ্ধ ও নিন্দিত। রাষ্ট্রের বাইরে বাক্তি বা গোষ্ঠির সন্ত্রাস অনুমোদিত নয়, য়ুরোপীয় আইনের এটা গোড়ার কথা। বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাস অমুক আইন কি তমুক বিধান লংঘন করে সেই কারণে এই নিষেধাজ্ঞা নয়, আসলে রাষ্ট্রের বাইরে যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠির সন্ত্রাস খোদ আইনী ব্যবস্থাটিকেই (জর্মন ভাষায় বেনজামিন লিখেছেন rechtordnung বা ইংরেজিতে the legal system) নড়বড়ে করে তোলে। আইনের নিজের একটা স্বার্থ আছে। নিজেকে সে হাজির যখন করে, নিজের আবির্ভাব সে যখন ঘটায়, সেই ঘটনার মধ্যেই নিহিত থাকে নিজেকে সংরক্ষণ বা রক্ষার তাগিদ, প্রবণতা বা স্বার্থ। ‘আইনের স্বার্থ’ কথাটা বেনজামিনের। বেনজামিনের লেখাটি পর্যালোচনা করতে গিয়ে জাক দেরিদা বলছেন, কথাটা শুনতে অবাক লাগে। ‘আইনের স্বার্থ’ আবার কী? কিন্তু আসলেই তো ‘আইনের স্বার্থ’ বলে একটা ব্যাপার আছেই নইলে আইন বিদ্যমান থাকে কী করে? আইনের প্রকৃতির মধ্যেই আছে তার স্বার্থ রক্ষা করবার তাগিদ, প্রবণতা বা স্বভাব। ফলে তাকে এই ভঙ্গী নিতেই হয় যে আইনের বাইরে কোন সন্ত্রাস চলতে পারবে না। সেটা কোন বিশেষ আইন ভঙ্গ হচ্ছে কি না হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর ব্যাপার হচ্ছে সন্ত্রাসের ওপর আইনের, কর্তৃত্বের বা রাষ্ট্রের একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠার অন্তর্গত প্রয়োজনীয়তা। সেই কারণে বেনজামিনের gewalt আদতে শুধু সন্ত্রাসের বিচার নয়, একই সঙ্গে কর্তৃত্বেরও। এই দিক থেকেই বেনজামিনের কথা যে ‘সন্ত্রাসের ওপর একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠায় আইনের একটা স্বার্থ আছে’। সন্ত্রাসের ওপর আইনের, কর্তৃত্বের বা রাষ্ট্রের এই একচেটিয়া থাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠা বা কোন আইনী উদ্দেশ্য সাধনের (Rechtszwecke) দরকারে নয়, নিছকই আইনী ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখবার দরকারে। কর্তৃত্ব সংরক্ষণের প্রয়োজনে।

সন্ত্রাসের সঙ্গে আইন, রাষ্ট্র বা কর্তৃত্বের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক দেখিয়ে দেবার পর বেনজামিন বলছেন, উদ্দেশ্য হাসিলের উপায় হিশাবে সন্ত্রাস, সহিংসতা, সশস্রতা, বলপ্রয়োগ অর্থাৎ সব ভায়োলেন্সই হয় আইন তৈরি করে, অথবা আইন রক্ষা করে। সন্ত্রাসের এই সাধারণ চরিত্র মনে না রাখলে সন্ত্রাসের পর্যালোচনা অসম্ভব। যদি এই দুইয়ের একটির মধ্যেও সন্ত্রাস খাপ না খায় তাহলে সন্ত্রাস বৈধতা হারায়। সন্ত্রাস শুধু সন্ত্রাস হিশাবে আইনের চোখে বৈধ হতে পারে না। তাকে হয় আইন রক্ষা করতে হবে অথবা আইন তৈরি করতে হবে। আইনী সংস্থাগুলোর মধ্যে সন্ত্রাসের অদৃশ্য উপস্থিতি কিন্তু হাজির থাকে ঠিকই। অর্থাৎ আইন প্রয়োগের জন্য আইনী সংস্থাগুলো বলপ্রয়োগের ক্ষমতা রাখে — এই বাস্তবতা যদি না থাকে বা এই উপলব্ধির যদি ক্ষয় হয় তাহলে আইনী সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা আর থাকে না।

বিপ্লবী সহিংসতা আর সাধারণ সন্ত্রাসের মধ্যে আইনের দিক থেকেও পার্থক্য এখানে। যে কারণে রাষ্ট্রকেও বিপ্লবী সহিংসতার সঙ্গে প্রয়োজনে আপোষ করতে হয়। যেমন, শান্তি বাহিনীর সঙ্গে শান্তিচুক্তি। বেনজামিন বলছেন, ‘সংঘাতের সম্পূর্ণ অহিংস মীমাংসা কখনই কোন আইনী চুক্তিতে পর্যবসিত হতে পারে না’। কেন পারে না? সেই চুক্তি যতোই শান্তিপূর্ণভাবে সম্পাদিত হোক, শেষাবধি তার সহিংস রূপ নেবার সম্ভাবনা থেকেই যায়। কারণ অপর পক্ষ যদি চুক্তির শর্ত না মানে তাহলে হাতে আবার অস্ত্র তলে নেবার অধিকার থাকে দুই পক্ষেরই। যে কোন আইনী চুক্তি তার জন্মচিহ্ন হিশাবে সন্ত্রাস ধারণ করে রাখে, সন্ত্রাসের দিকে তার ইঙ্গিত থেকেই যায়। চুক্তির বাক্যে অনুচ্ছেদে দাঁড়ি কমার মধ্যে সহিংস রক্তপাতের চিহ্ন না থাকতে পারে, কিন্তু নতুন সহিংসতার সম্ভাবনা হিশাবে চুক্তির মধ্যেই থাকে সন্ত্রাস। যেমন সন্তু লারমা চুক্তিভঙ্গের অজুহাতে বারবারই আবার অস্ত্র তুলে নেওয়ার হুমকিধামকি দিয়েই যাচ্ছেন।

জাক দেরিদা: আইনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের রহস্য

Zur Critique der Gewalt নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে জাক দেরিদা মনে করিয়ে দিচ্ছেন বেনজামিনের এই বয়ান য়ুরোপের বুর্জোয়া, উদারনৈতিক, সংসদীয় গণতন্ত্রের সংকটের প্রতিফলন, এবং কাজে কাজেই এই সংকট থেকে অবিচ্ছিন্ন আইন (droit) সংক্রান্ত ধারণারও সংকট। পরাজিত জার্মানি হচ্ছে এই সময়ে সেই দেশ যেখানে এই সংকট সবচেয়ে তীব্র…’। বেনজামিনের আলোচনা আইন নিয়ে— বেনজামিন হয়তো আইনের দর্শনের (Philosophy of Law) একটা সূচনা করতে চেয়েছিলেন। বেনজামিন দারুন সব প্রশ্ন তুলেছেন যাতে আমরা আলোড়িত হই উত্তেজিত হই, প্রশ্ন করতে শিখি। কিন্তু শেষাবধি — জাক দেরিদা বলছেন, ‘অমীমাংসার মৌলিক সংকট’ (radically problematic) থেকেই যায়। এটাও তাহলে মনে রাখা দরকার যে সন্ত্রাসের যে ‘মূল্যায়ন’ করছেন বেনজামিন সেটা য়ুরোপীয় চিন্তা, বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার পরিসরে। ফলে তার সীমা সম্পর্কে আমাদেরও যেন হুঁশ থাকে।

কেন আমরা আলোড়িত আর উত্তেজিত বোধ করি। কেন আমরা নতুনভাবে প্রশ্ন তুলতে শিখি? প্রথমত আইনের ভেতর থেকেই এবং আইনের সঙ্গেই সম্পর্কিত থেকে দুই ধরনের সন্ত্রাসের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখি আমরা (এক) যে সন্ত্রাস গাঠনিক, স্থপতি, নির্মাণকর্তা, প্রতিষ্ঠাতা, founding violence যে সন্ত্রাস তৈরি করে, নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করে, যে সন্ত্রাসের মধ্যে সংবিধান ও আইনের অধিষ্ঠান ঘটে, উদ্বোধন ঘটে, আইনের অবস্থান বা নিরিখ নির্দেশিত হয় (‘die rechtsetzende Gewalt’ বা ইংরেজিতে Law Making Violence) আর (দুই) যে সন্ত্রাস আইন সংরক্ষণ করে, আইন বজায় রাখে, বহাল রাখে, নিশ্চিত করে, আইন যে আছে তা প্রদর্শন করে, দেখায়, জাহির করে এবং আইন প্রয়োগ ও তাকে কার্যকর করে (die rechtserhaltende Gewalt বা ইংরেজিতে Law Preserving Violence)। দেরিদা সাবধান করে দিয়েছেন বেনজামিনের জর্মন নিবন্ধটির অনুবাদে Gewalt-এর ইংরেজি Violence করা হলেও এর ধারণা আরো বিস্তৃত। ভায়োলেন্স বা যাকে আমরা বাংলায় সন্ত্রাস বলছি সেই অনুবাদ ভুল নয়, কিন্তু সতর্ক থাকা দরকার এর অর্থের পরিসর অনেক বিস্তৃত। ভায়োলেন্স বা সন্ত্রাস বললেই আমরা তাকে যে সংকীর্ণ অর্থের দিক থেকে বুঝি বা আক্ষরিকভাবে নিন্দার্থে ব্যবহার করি সন্ত্রাসের দার্শনিক রাজনৈতিক আলোচনায় তার ঠাঁই নাই। দুই নম্বরে আছে গাঠনিক বা প্রতিষ্ঠাতা সন্ত্রাস আর ধ্বংসাত্মক

আইনের সর্বলোপকারী সন্ত্রাসের মধ্যে পার্থক্য। গাঠনিক বা প্রতিষ্ঠাতা সন্ত্রাসকে (founding violence), বেনজামিন বলছেন Mythic Violence। আর, ধ্বংসাত্মক আইনের সন্ত্রাস। (Rechtvernichtend) হচ্ছে তার ভাষায় ঐশ্বরিক বা ‘divine’। দেরিদার মনে হয়েছে মিথিক অর্থে বেনজামিন গ্রীক ধারণাই বুঝিয়েছেন আর দৈব বা ডিভাইন কথাটির মধ্যে ইহুদি চিন্তার রেশ আছে। তিন নম্বরে আছে ইনসাফ (Gerechtigkeit বা ইংরেজিতে Justice) আর ক্ষমতার (Macht বা ইংরেজিতে Power) মধ্যে পার্থক্য। ইনসাফকে বেনজামিন দেখেছেন ‘as the principle of all divine end making’ - ‘উদ্দেশ্য সাধনের সকল দৈব সমাপন’ হিশাবে। আর ক্ষমতাকে দেখেছেন as principle of all mythical law making- ‘আইন তৈরির রূপকথা’ হিশাবে।

ভায়োলেন্স প্রাকৃতিক হতে পারে না। প্রকৃতি সন্ত্রাসী এটা যদি আমরা বলি তাহলে প্রতীকী অর্থে বলি— কাব্য করবার জন্য বলা। সত্যি যে ঝড়, তুফান, ভূমিকম্প, বন্যা, খরা, ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিম্বা অসুখবিসুখও তো এক ধরনের ‘সন্ত্রাস’। কিন্তু প্রাকৃতিকতার ক্ষেত্রে ‘সন্ত্রাস’ কথাটা খাটে না এই কারণে যে সন্ত্রাস আইন ও ইনসাফের বুলি, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের ভাষা। প্রকৃতিকে সন্ত্রাসের জন্য আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় না। দেরিদা বলছেন আইন রাজনীতি ও নীতিনৈতিকতার যে বয়ান ও ব্যাকরণ আমরা তৈরি করি সন্ত্রাস সেই চিহ্নব্যবস্থার (symbolic order) অন্তর্গত বিষয়।

সন্ত্রাস, আইন ও ইনসাফ সম্পর্কে দেরিদার ভাষ্য সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা দরকার। কিন্তু এখানে কয়েকটি প্রাথমিক ইঙ্গিত দিয়ে আমরা শেষ করব। ভায়োলেন্স, আইন ও ইনসাফের বিচার ভাষা, অপর ও অপরের মুখ সম্পর্কে দেরিদার ভাষ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। অপরের সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনযাপনের মুখোমুখি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আমরা সবসময়ই এমন অবস্থায় পড়ি যখন একজনের মুখ অন্যদের চেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়, আর বহু মুখ আড়াল হয়ে যায়, আমাদের দৃষ্টির পর্দা থেকে মুছে যায়। এর ফলে যাদের আমরা দেখি কেবল তাদের কথাই আমরা বলি বা বলা হয়ে যায়। এই অনিবার্য পরিস্থিতি যাদের মুখ আমরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে মুছে ফেলি তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস হয়ে ওঠে। এই মুছে যাওয়া মুখগুলো তখন আমাদের কাছে ইনসাফের দাবি নিয়ে হাজির হয়। আমাদের ভাষার মধ্যে যাদের কণ্ঠস্বরকে আমরা নিঃশব্দ করে দিয়েছি তারা তখন ন্যায়বিচারের দাবি জানায়। তারা চায় তাদের কণ্ঠস্বরের স্বীকৃতি এবং তারা যে সাধারণ ভাবে ভাষায় নিজেদের প্রকাশ করতে সক্ষম এবং কাজে কাজেই সমাজের ভাষাব্যবস্থায় নতুন অর্থোৎপাদনে সক্ষম সেই দাবি। এই দিক থেকে পরিপূর্ণ ইনসাফ কখনই সম্ভব নয়, কারণ সবসময়ই কারো না কারো কথা বা কণ্ঠস্বর অন্যদের গলার তলায় চাপা পড়ে যাবেই। যখনই আমরা দৃশ্যমান মুখগুলোর কণ্ঠস্বর শুনি তখন অন্যদের কণ্ঠস্বর নিঃশব্দ হয়ে যায়।

আইন দাবি করে যে-কণ্ঠস্বর আমরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে মুছে ফেলি তার আওয়াজ আইন-আদালত শোনাবে, তার কথা সে দৃশ্যমান করে তুলবে। এটা আইনেরই কাজ। কিন্তু আইনের কিছু ধাঁধা বা paradox আছে। নতুন আইন তৈরির প্রক্রিয়া বা বিপ্লবী বলপ্রয়োগ দেরিদার কাছে কথা শোনাবারই একটা রাজনৈতিক রূপ। যে কথা আমরা আর শুনছি না, যে কথা আমাদের ভাষা বা ডিসকোর্সে নাই, যাকে আমরা নীরব ও নিঃশব্দ করে ফেলেছি বা আমাদের ভাষার আধিপত্যে যে কথা শোনা যাচ্ছে না— বিপ্লবী বলপ্রয়োগ হচ্ছে সেই কথা শোনাবার জন্য নতুন আইন বা বিধান তৈরির ব্যাপার। আইন তো ডিসকোর্সই নয় কি? কিন্তু নতুন আইন তৈরির বা নতুন কথা শোনাবার বিপ্লবী ঘটনা ন্যায় নাকি অন্যায় তার বিচার অসম্ভব। কারণ ইনসাফের কোন ধারণা, পুরানা কোন আইন বা সংবিধান দিয়ে নতুন আইন বা সংবিধানের বিচার চলে না, যার আবির্ভাব ঘটে বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে।

পাকিস্তানের সংবিধান বা আইনের মধ্যে আমাদের কণ্ঠস্বর মুছে নিয়েছিল, নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের বা দেরিদার প্রতীকী ভাষায় আমাদের মুখাবয়বের' স্বীকৃতি ছিল না। ফলে সশস্ত্র সংগ্রাম বা বলপ্রয়োগের মাধামে আমাদের কণ্ঠস্বর শোনাবার, আমাদের মুখের স্বীকৃতি আদায় করবার জন্য আমাদের লড়াই করতে হয়েছে। তাহলে এই যে নতুন সংবিধান, আইন বা নতুন রাষ্ট্রের আবির্ভাব তার বিচার কি পাকিস্তানের আইন, সংবিধান বা রাষ্ট্র দিয়ে করা সম্ভব? এই ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গাঠনিক, নির্মাণের। বৈপ্লবিক বলপ্রয়োগ নির্মাণ করে। গড়ে। নতুন আইন বা সংবিধান প্রতিষ্ঠা করে। অতএব তা বৈধ নাকি অবৈধ, ন্যায় কি অন্যায়, ইনসাফ মেতাবেক হোল কি হোল না সেই বিচারের খাপে ধরা পড়ে না। এই ধরনের গাঠনিক বা নির্মাণমুখী সন্ত্রাস পুরানা আইনের কাছ থেকে তার বৈধতা চাইতে পারে না। এটাই হচ্ছে ইনসাফের ধাঁধা। ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা যায় না, কিন্তু ইনসাফ আসবে এই প্রতিশ্রুতির ওপর বিপ্লবী সন্ত্রাস দাঁড়ায় বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে নতুন আইন প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু কোন আইনে তাকে ন্যায় সঙ্গত বলা যাবে? পুরানা আইন? নাকি নতুন ?

আইন অন্যদিকে আইন রক্ষা বা সংরক্ষণের সন্ত্রাস হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। বিদ্যমান আইনী ব্যবস্থা ও সংবিধান টিকিয়ে রাখা তার কাজ। তার মানে যে মুখগুলো মুছে গিয়েছে, মুছে যায়, কিম্বা যাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে বা হয়ে যাচ্ছে তাদের স্বীকৃতির দাবি অস্বীকার করাই এই ভায়োলেন্সের কাজ। নতুন আইন তৈরির বিপ্লবী সন্ত্রাসকে নির্মিত আইন রক্ষা ও সংরক্ষণের কর্তব্যও পালন করতে হয়। দেরিদার কথা হচ্ছে ইনসাফ সবসময়ই সম্ভাবনা হয়ে বিরাজ করে, ফরাসি ভাষায় তিনি একে বলছেন avenir বা ইংরেজিতে to come। যা আসে কিন্তু আসে না। এই ধাঁধার মধ্যে সন্ত্রাস, আইন ও ইনসাফের ভাষ্য তৈরি হতে থাকে।

এই কালের ভাবুকদের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে বিপ্লবী রাজনীতির পার্থক্য ওখানে নয় যে বিপ্লবী সহিংসতা বা সশস্ত্রতার নিন্দা বা প্রশংসা তাঁরা করেন বা করেছেন। নিন্দা বা প্রশংসা করবার যেকোনো ডিসকোর্সই অন্য মুখ বা কণ্ঠস্বরকে আড়াল ও নিঃশব্দ করে ফেলে। যে দিকটা পরিষ্কার সেটা হোল বিদ্যমান ভাষা, ডিসকোর্স, আইন বা সংবিধান দিয়ে বিপ্লবী সহিংসতার বিচার বা পর্যালোচনা যেমন সম্ভব নয়, অন্যদিকে রাষ্ট্র নিজের আইন ও সংবিধান রক্ষার জন্য যে সন্ত্রাস চালায় তার ভিত্তি তার গাঠনিক সন্ত্রাসের মধ্যেই নিহিত আছে। অর্থাৎ যেদিন রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে সেই মুহূর্তেই নিজের আইন ও সংবিধান রক্ষার জন্য বলপ্রয়োগের কর্তব্যও রাষ্ট্রের ধারণার মধ্যে নিহিত। গাঠনিক সন্ত্রাসের মধ্যেই রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের কর্তব্য নিহিত এইদিকটি এখন অনেক পরিচ্ছন্ন।

কেন বড় অপরাধীর প্রতি আমরা গুপ্ত আকর্ষণ বোধ করি?

বড়ো বড়ো অপরাধীদের প্রতি সমাজে এক ধরনের আগ্রহ, এক প্রকার গুপ্ত ভালোবাসা আমরা লক্ষা করি। সন্ত্রাস, আইন ও কর্তৃত্বের আলোকে বেনজামিন ব্যাপারটির প্রতি নাজর দিয়েছেন। ধরা যাক বাংলাদেশে সম্প্রতিকালের এরশাদ শিকদারের কথা। এরশাদ শিকদার বক্ত মানুষের কাছে ‘প্রতিনায়ক’ হয়ে উঠেছিল। পত্রপত্রিকার প্রথম পাতায় তার সম্পর্কে খবরাখবর যেমন ছাপা হোত তাকে নিয়ে গুজব ও কেচ্ছারও কোন কমতি ছিল না। কেন আইনের চোখে এই ধরনের ভীষণ অপরাধীর প্রতি মানুষের তীব্র আকর্ষণ? বেনজামিন বলছেন, এটা ভুল হবে যদি আমরা একে অপরাধের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা বা আকর্ষণ মনে করি। অপরাধ বা অপরাধের মাত্রা এখানে আকর্ষণের কারণ নয়। আকর্ষণ ওখানে যে অপরাধী আসলে আইন ও কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে আইনের ভালোমানুষিটাকে সবার সামনে ন্যাংটা করে ছেড়ে দেয়। তখন সবাই দেখে আইন বা কর্তৃত্ত্বও আসলে সন্ত্রাসের ওপরই দাঁড়ানো। আইনের বাইরের মুখোশটা খসে যায়, তার চেহারা দেখে ফেলে সবাই। সন্ত্রাসের সম্মুখে আইন হিশাবে যাকে দেখতে আমরা অভ্যস্ত, অপরাধী দেখিয়ে দেয় ওর পেছনে আসলে আছে সন্ত্রাস, বলপ্রয়োগের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সেই রূপ যা সহিংসভাবে যে নিজের বাইরের সন্ত্রাসকে দমন করছে, সন্ত্রাসের ওপর নিজের একচেটিয়াত্ব কায়েম করছে।

ধর্মঘট, সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রদ

শ্রমিক ধর্মঘট সম্পর্কে বেনজামিন বলছেন, শ্রেণীসংগ্রামের এটা একটা ফল এবং একই সঙ্গে সংগ্রামের ধরনও বটে রাষ্ট্র যাকে স্বীকৃতি দেয়। সাধারণত আমরা মনে করি ধর্মঘট কোন সহিংস বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়, একান্তই শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি যার মধ্য দিয়ে শ্রমিক পক্ষ মালিক পক্ষ বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিজেদের দাবি আদায় করে নিতে পারে। কিন্তু বেনজামিন তা মনে করেন না। তিনি বলছেন শ্রমিকরাই হচ্ছে রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র ছাড়া একমাত্র আইনী কর্তাসত্তা রাষ্ট্র যাদের সন্ত্রাসের অধিকার দেয়। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে সন্ত্রাসের একচেটিয়ায় রাষ্ট্রের সঙ্গে শ্রমিকও ভাগ বসায়।

ধর্মঘট মানে কী? কাজ না করা। এটা কী করে সন্ত্রাস করবার আইনী অধিকার হোল? কাজ না করা না মানে তো কাজই না— সন্ত্রাস তো দূরের কথা। ঠিক এই কারণেই রাষ্ট্র শ্রমিকদের এই অধিকার দেয় বা এই কনসেশান দেবার ক্ষেত্রে আপত্তির কিছু দেখে না। সন্ত্রাস যদি ঘটেও তবে সেটা ঘটতে পারে মালিক পক্ষের তরফে, আর শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকের যদি আপোষে রফা না হয় তারা অহিংস ভাবে কাজে বিরতি দিতে পারবে। কারখানার ব্যবস্থাপনা ও মেশিনপত্রের কাছ থেকে নিজেদের অহিংসভাবে বিচ্ছিন্ন, বিচ্যুত করতে পারবে শ্রমিকরা নিজেদের। সেটাও অহিংসভাবে। কিন্তু বেনজামিন তবুও ধর্মঘটকে অহিংস ব্যাপার বলে মনে করেন না, সেখানেই তাঁর দার্শনিক বিচারের প্রতিভা। কারণ কী?

শ্রমিকরা তো দাবিদাওয়া পেশ করে। একটা লিস্টি বা দাবিনামা দাখিল করে, যা কর্তৃপক্ষ না মানলে তারা কাজে প্রত্যাবর্তন করবেনা বলে ঘোষণা দেয়। এই দাবিনামাকে কেন্দ্র করেই ঘাটতে শুরু করে পারস্পরিক বলপ্রয়োগের মুহূর্ত। ধর্মঘটের অধিকারকে তার শেষ সীমায় নিয়ে গেলে সেটা রূপ নেয় সাধারণ ধর্মঘটে। সব কারখানায় সব শ্রমিকদের একসঙ্গে কাজে বিরতি, কাজের ক্ষেত্র সাময়িক ত্যাগ। আর রাষ্ট্র ঠিক এই সীমাটাই অতিক্রম হোক এটা চায় না, এটা মানেও না। রাষ্ট্র তখন দাবি করে ধর্মঘটের অধিকার থাকতে পারে শ্রমিকদের কিন্তু একটা ভুল বোঝাবুঝি আছে এখানে। শ্রমিকরা সব কারখানায় এক সঙ্গে ধর্মঘট ডাকতে পারে না। সাধারণ ধর্মঘট ডাকবার অধিকার আছে শ্রমিকদের এই স্বীকৃতি তো রাষ্ট্র দেয় নি। রাষ্ট্র তখন সাধারণ ধর্মঘটকে ‘বেআইনী’ ঘোষণা করে। আর তখনই ঘটে যাকে আমরা বলি— ‘বিপ্লবী পরিস্থিতি'। এই পরিস্থিতিই হচ্ছে সেই এক ও একমাত্র মুহূর্ত যখন আইন অথবা অধিকার আর সন্ত্রাসকে আমরা একাট্টা হয়ে যেতে দেখি। সন্ত্রাস, সহিংসতা বা বলপ্রয়োগ তখন হয়ে যায় আইন বা কর্তৃত্ব, আর আইন বা কর্তৃত্ব হয়ে যায় সন্ত্রাস। অর্থাৎ আইন বা কর্তৃত্বের ব্যবস্থার মধ্যে সন্ত্রাস বাইরের কোনো উপাদান নয়, ওর ভেতরেরই জিনিশ। সন্ত্রাস আইন বা কর্তৃত্বকে ভেতর থেকেই হুমকির মুখে ফেলে দেয়। অমুক কি তমুক লক্ষ্য হাসিলের জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ বা নির্মম সহিংসতার মধ্যে সন্ত্রাসের সারকথা নিহিত নাই, বরং আইন বা অধিকারের খোদ ব্যবস্থাকেই বিপদাপন্ন করে তোলা বা ধ্বংস করার মধ্যে তার স্বভাবকে আমরা শনাক্ত করতে পারি। এই ক্ষেত্রে বিদ্যমান যে আইন ধর্মঘটের অধিকার দিয়েছে সাধারণ ধর্মঘট সেই আইন বা কর্তৃত্বকেই চ্যালেঞ্জ করছে। এখানেই রাষ্ট্রের আপত্তি।

রাষ্ট্র ভয় পাচ্ছে কিসের? বিশাল সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট, মাদক ব্যবসায়ীদের রিং বা মাফিয়া চক্রকে রাষ্ট্র ভয় করে না। তারা আইন ভঙ্গ করছে, রাষ্ট্র সেটা জানে, কিন্তু সেটা করছে তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক স্বার্থে। কিন্তু রাষ্ট্র ভয় পায় মৌলিক বা গাঠনিক সন্ত্রাসে begrunden বা ইংরেজিতে ‘to found’ - যে সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে নতুন আইন নতুন বিধান নতুন কর্তৃত্বের জন্ম হয়। তার মানে সেই সন্ত্রাসকে রাষ্ট্র ভয় পায় যে-সন্ত্রাস নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার পর নিজেকে নিজে বৈধ বলে ঘোষণা দিতে পারে, নিজেই নিজের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে পারে, শুধু নিজের আবির্ভাব ঘটিয়ে, কিম্বা সেই আবির্ভাব যে ন্যায্য সেটা নিজেই ঘোষণা দিয়ে। কিম্বা সেই সন্ত্রাসকে রাষ্ট্র ভয় পায় যে সন্ত্রাস আইনের বা কর্তৃত্বের সম্পর্ক ও শর্তকে বদলে ফেলে এবং কাজে কাজেই আইন বা কর্তৃত্বের ওপর তার অধিকার আছে বলে নিজেকে হাজির করে। এই সন্ত্রাসকে তাহলে বিদ্যমান আইন বা কর্তৃত্বের ভেতর থেকে বোঝা যাবে না, বিচারও করা যাবে না। বিদ্যমান আইন বদলাবার জন্য বা নতুন আইন বা কর্তৃত্বের জন্ম দানের জন্য যেন আগাম বাইরে সে হাজির থাকে। একমাত্র এই সন্ত্রাসকে যদি আমরা চিনি-বুঝি, জানি কেবল তখনই সন্ত্রাসের বিচার হতে পারে। ক্রিটিক অব ভায়োলেন্স কথাটার তখন একটা মানে দাঁড়াতে পারে। কারণ এই জানা-বোঝা চেনার মধ্য দিয়ে আমরা দেখব এই সন্ত্রাস নিছকই প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক কোনো সন্ত্রাস নয়। অর্থাৎ ক্ষমতা বা বলপ্রয়োগের একটা প্রাকৃতিক শক্তি নয়। যদি কেউ সন্ত্রাসের পর্যালোচনা বা বিচার করতে চায়— অর্থাৎ সন্ত্রাসের একটা ব্যাখ্যামূলক ও অর্থোৎপাদক মূল্যায়নের ইচ্ছা যদি থাকে, তাহলে সেটা কেবল তখনই সম্ভব যদি সেই অর্থ সে শনাক্ত করতে সক্ষম হয় যে সন্ত্রাস আইন বা কর্তৃত্বের বাইরে থেকে হঠাৎ হাজির হওয়া কোন দুর্ঘটনা নয়। বরং যা বিদ্যমান আইন, কর্তৃত্ব ও রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে যাকে আমরা আইন, কর্তৃত্ব ও রাষ্ট্র বলি — আগাম সেই আইনে তারও অধিকার আছে, সেও আইনের আইন তৈরির আইন বা সংবিধান হয়ে উঠতে পারে, সে নতুন রাষ্ট্র, কর্তৃত্ব বা আইনের জন্ম দিতে পারে।

সাধারণ ধর্মঘট সেই দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি নজির হতে পারে, যেহেতু ধর্মঘট রাষ্ট্রেরই দেয়া অধিকার প্রয়োগ করে বিদ্যমান আইনকে অস্থিতিশীল করে দিতে এবং একটি বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সক্ষম, যে-পরিস্থিতিতে নতুন আইন, নতুন কর্তৃত্ব বা সবসময় না হলেও নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভবের শর্ত হাজির করে ফেলতে পারে। বেনজামিনের এই কথার সূত্র ধরে জাক দেরিদা বলছেন, “সকল বিপ্লবী পরিস্থিতি, সকল বিপ্লবী বুলি— সেটা বাম হোক আর ডান হোক (এবং ১৯২১ সালের পর থেকে জর্মানিতে এই ধরনের বহু নজির আছে, যাদের পরস্পরের মধ্যে অস্বস্তিকর মিলও ছিল বেনজামিন প্রায়ই নিজেকে এই দুইয়ের মাঝখানে পেয়ে যাচ্ছিলেন) — নতুন আইন প্রতিষ্ঠা, বা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া বা আবির্ভাবের দাবিতে। সন্ত্রাসকে ন্যায্য বলে। সকল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এমন পরিস্থিতির মধ্যে ঘটে যাকে আমরা এই কারণে বিপ্লবী বলতে পারি। তারা নতুন আইনের উদ্বোধন ঘটায়, এবং সবসময়ই সেটা ঘটে সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে। সবসময়ই, এমন কি যখন কোন দৃশ্যমান গণহত্যা কিম্বা দেশত্যাগ বা জোর করে মানুষকে বের করে দেবার ঘটনা ঘটে না— ছোট বড়, নতুন পুরাতন, আমাদের অতি কাছে বা দূরের যে কোন রাষ্ট্র গঠিত হবার ক্ষেত্রে যেসব ঘটনাগুলো ঘটে” (পৃ. ৩৫)।

দেরিদা এখানেই শুধু থেমে থাকেন নি। তিনি বলছেন, এই উদ্বোধনের, গাঠনিক, প্রতিষ্ঠিত করণের মুহূর্ত, যদি আমরা সেই মুহূর্তগুলোকে আলাদা করে দেখি— ভয়াবহ ও ভয়ংকর। কারণ এর সঙ্গী থাকে মানুষের অকথ্য কষ্ট, নির্যাতন ও বিবিধ অপরাধ সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। কিন্তু অতোটুকুই, সন্ত্রাসের সেই রূপের মধ্যে তাদের ব্যাখ্যা চলে না, তারা অপাঠা (indecipherable)। সেই জন্যই আমি একে বলছি ‘মিস্টিক’ (বা রহস্য)। বেনজামিন যেভাবে হাজির করছেন এই সন্ত্রাস অবশ্যই পাঠ করা যায় (legible) কারণ এমনকি বুদ্ধিরও গ্রাহ্য, কারণ এটা আইনের বাইরের কিছু নয়। No more than polemos or eris is alien to all the forms and significations of dike, কিন্তু আইনের মধ্যেই আইন নিজেকে স্থগিত করে। অন্য আইন কায়েম করবার জন্য প্রতিষ্ঠিত আইনে আইন নিজেই হস্তক্ষেপ করে। সাসপেন্সের এই মুহূর্ত, এই সন্ধিক্ষণ (epockhe), আইনের এই গাঠনিক বা বিপ্লবী মুহূর্ত বিরাজ করে আইনের মধ্যেই আইনহীন মুহূর্ত হয়ে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাই হচ্ছে আইনের সমগ্র ইতিহাস। এই মুহূর্ত সবসময়ই ঘটে কিন্তু কখনই কোন উপস্থিতির সামনে হাজির থেকে ঘটে না (This moment always takes place and never takes place in a presence)। এই সেই মুহূর্ত যখন আইনের ভিত্তি শূন্যে বা কোনো এক অতল গহ্বরে ঝুলে (suspended) থাকে, ঝুলে থাকে এমন এক বিশুদ্ধ কর্মসম্পাদক ক্রিয়া হিশাবে যাকে কারো কাছে বা কারো সামনে জবাবদিহি করতে হবে না। এই কর্মসম্পাদক ক্রিয়ার যিনি ঘটক তাঁকে আর কখনোই আইনের সামনে দাঁড়াতে হবে না, অথবা এমন এক আইনের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে যে আইন এখনো প্রণীত হয়নি, আইনের সামনে এই অর্থে যে এমন এক আইন যে আইনের কোন অস্তিত্বই নাই, এমন এক আইন যে এখনো হাজির হওয়া বাকি, (encore devant et devant venir)।

যে সন্ত্রাস গাঠনিক, গড়ে, নতুন আইন রাষ্ট্র বা কর্তৃত্ব সৃষ্টি করে সেই সন্ত্রাসকে সমালোচনা করা সহজ, কারণ তার আবির্ভাবের আগে বিদ্যমান বা আগে থাকতেই হাজির কোনো আইন দিয়ে তাকে ন্যায্য প্রমাণ করা যায় না। সে কারণে দেরিদা বলছেন বিপ্লবী সন্ত্রাসকে সব সময়ই ‘বর্বর’ মনে হতে পারে। অন্যদিকে, উল্টো দিক থেকে দেখলে এই সন্ত্রাসকে তার আবির্ভাবের আগের কোনো আইনের সামনে আদালতে শমন জারি করে হাজির করা যায় না। ফলে এটা শুধু অসম্ভব বা কঠিন কাজই নয়, অবৈধও বটে। যে আইন বা রাষ্ট্রকে এই সন্ত্রাস ভেঙে নিজের উদয় ঘটিয়েছে সেই আগের আদালতে বা আগের রাষ্ট্রের সামনে তাকে দাঁড় করানোর বৈধ ভিত্তি আর থাকে না। আগের রাষ্ট্রই যদি না থাকে তো ঐ সন্ত্রাসের বিচার প্রাক্তন রাষ্ট্রের ভূতের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হতে পারে না। বিপ্লবী সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে যার আবির্ভাব ঘটল সে তো পুরাতনকে — বিপ্লবের আগের ব্যবস্থাকে আর স্বীকার করে না। দেরিদা বলছেন, “এই স্ববিরোধিতার দুই প্রান্তে আছে বুদ্ধির অগম্য সেই বিপ্লবী মুহূর্ত যা কোনো ঐতিহাসিক, সময়ের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার মধ্যে ধরা দেয় না, তথাপি যার মধ্যে নতুন আইনের ভিত্তি লীলাময়তায় বিরাজ করে”। বলা যায় এই আইন তার আগের আইনকেই (anterior) যেন সম্প্রসারিত করে, বিপ্লবী করে তোলে, বদলায়, প্রতীকায়িত করে, নতুন অর্থোৎপাদন করে ইত্যাদি। সেই লীলাই যুদ্ধের বা সাধারণ ধর্মঘটের রূপ নিয়ে হাজির হয়। (‘Between two limits of this contradiction, there is the question of this ungraspable revolutionary instant that belongs to no historical, temporal continuum but in which the foundation of a new law nevertheless plays, if we may say so, on something from an anterior law that it extends. radicalizes, deforms, metaphorizes or metonymizes, this figure here taking the name of war or general strike.’) কিন্তু এই রূপ আবার দেরিদার ভাষায় সংক্রমণও বটে (contamination)। কেন? কারণ ‘গাঠনিক ও সংরক্ষণের কর্তব্যের মধ্যে বিশুদ্ধ ও সরল পার্থক্য এখানে মুছে যায়, ঝাপসা হয়ে যায়’ (It effaces or blurs the distinction, pure and simple, between foundation and conservation)

রাজনৈতিক সন্ত্রাসের যে নৈতিক সমালোচনা করা হয় তার বিরোধিতা করেছেন দেরিদা। নিজের প্রতি ও অন্য মানুষের প্রতি নৈতিক দায়দায়িত্বের যে মধুর কথাবার্তা বলা হয়, দেরিদা বলছেন। সেই সব শুনতে অতি চমৎকার এবং সুস্বাদু কিন্তু সন্ত্রাসের দার্শনিক বিচারে তারা কোন কাজে আসে না। কেন আসে না। কারণ হোল আইনের লক্ষ্যই তো হচ্ছে মানুষ। মানুষের জন্যই সংবিধান, আইন, ফলে সন্ত্রাস যখন গাঠনিক কিম্বা সংরক্ষণের ভূমিকা পালন করে মানুষই তার কাজের লক্ষ্যবিন্দু। ফলে নতুন করে আইন বা রাষ্ট্রের জন্য (কাজে কাজেই সন্ত্রাসের বিচার করতে গিয়ে) মানুষের অজুহাত তোলা দেরিদার ভাষায় ইমপোর্টেন্ট। অকাজের। নপুংসকের কেচ্ছা। এমনকি মানুষের মুক্তির জন্য বিপ্লব বা ইত্যাদি কল্পকাহিনী দিয়েও আমরা সন্ত্রাসের পর্যালোচনা করতে পারবো না। দেরিদা পরিষ্কার বলছেন: “Law in very violence claims to recognise and defend said humanity as end, in the person of each individual. And so purely moral critique of violence is as unjustified as it is impotent. For the same reason, we can not provide a critique of violence in the name of liberty, of what Benjamin here calls “gestaltlose Freiheit” “formless freedom”, that is in short, purely formal, as empty form, following a Marxist-Hegelian vein that is far from absent throughout this meditation”

কিন্তু সন্ত্রাসের এই ধরনের সমালোচনা আইনী বিদ্যার দিক থেকে অকাজের কারণ সন্ত্রাসের আইনী সত্তাকে এই ধরনের সমালোচনা স্পর্শ করতে পারে না। এই সকল সমালোচনা আইনের বাইরেই থেকে যায়।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রশ্ন

বলাবাহুল্য সন্ত্রাসের এই বিচার সম্পর্কে আমরা বাংলাদেশে ওয়াকিবহাল নই। ফলে এই বিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে আরো অনেক কথাবার্তার প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশে নানান জঙ্গি আন্দোলন ইসলামী হোক বা অন্য কোন মতের হোক সেটা ন্যাযা কি অন্যায্য বিচার করবার ক্ষেত্রে যে সরলীকরণ আমরা করি তার যে কোন দার্শনিক বা রাজনৈতিক ভিত্তি নাই, ওপরের আলোচনা থেকে সেটা পরিষ্কার। নতুন ক্ষমতা, সংবিধান, আইন, বা রাষ্ট্র তৈরি যদি রাজনীতির ব্যবহারিক লক্ষ্য হয় তাহলে সন্ত্রাস নিয়ে আমাদের দেশে যেসব আলোচনা চলছে তা নিতান্তই আবর্জনা ছাড়া কিছুই নয়। সন্ত্রাসের যে গাঠনিক ভূমিকা বা বৈপ্লবিক ভূমিকা আছে এ কালের দার্শনিকরা সেটা অস্বীকার করছেন না। কিন্তু তার বিচার কোনো নৈতিক বা তার উদ্দেশ্যের ন্যায্যতা দিয়ে বিচার করা যায় না এতোটুকু অন্তত আমরা পরিষ্কার করতে পেরেছি। যেমন, জিহাদি জঙ্গিরা ন্যায্য না অন্যায্য এটা যেমন কোন নৈতিক মানদণ্ড দিয়ে বিচার করলে সেটা একালের ভাবুক বা দার্শনিকদের কাছে গ্রাহ্য নয় বা তাকে রাজনৈতিক বিচার বলা যাবে না, তেমনি বাংলাদেশের বামপন্থীরা তাদের সংগ্রামের উদ্দেশ্য সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা কিনা — সেই মানদণ্ড দিয়ে যদি তার বিচার করেন তাহলে তারও কোন মূল্য নাই। কারণ এই ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য বিবেচনা করে উপায়কে ন্যায্য কি অন্যায্য বিচার করার পরিত্যক্ত পদ্ধতিটাই ব্যবহার করা হচ্ছে। কে কাকে শত্রু আর কে কাকে মিত্র গণ্য করছে সেটা প্রত্যেকের নিজ নিজ শ্রেণী অবস্থান দ্বারা স্থির হবে, সন্দেহ নাই— তবে নতুন কর্তৃত্ব সৃষ্টি বা আইনের বিচারের দিক থেকে এই ধরনের মানদণ্ড সন্ত্রাসের বিচার সম্পন্ন করবার ক্ষেত্রে, না রাজনীতির, না দর্শনের কোনই কাজে লাগে না। জাক দেরিদার ভাষায় এই ধরনের সমালোচনা বা মানদণ্ড থেকে কিছুই তৈরি হবে না।

বাংলাদেশে কোন জিহাদি বা জঙ্গি তৎপরতা মার্কসীয় অর্থে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কিনা সেই জায়গা থেকে বিচার করে তার সঠিকতা বা ভুল নির্ণয় করা হয়। এই পন্থাই প্রবল। (অবশ্য যারা ইসলাম মাত্রই ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য মনে করে তাদের চিন্তা অপ্রাসঙ্গিক, অনর্থক ও ঘোরতর সাম্প্রদায়িকও বটে।) এই যে লক্ষ্য বিচার করে উপায়ের ন্যায্যতা প্রতিপাদনের পদ্ধতি তাকেই বেনজামিন ও দেরিদা সমালোচনা করছেন। এরা যদি সন্ত্রাসের সঙ্গে আইন, কর্তৃত্ব বা রাষ্ট্রের সম্পর্কই ধরতে না পারেন তাহলে রাজনীতি করবেন কী করে? ক্ষমতাসীন শ্রেণী তাদের সংবিধান ও আইন রক্ষার জন্য সন্ত্রাসের মূল্য বোঝে ও নগদানগদি ব্যবহার করে। যারা গাঠনিক সন্ত্রাসের ভূমিকা বুঝতে অক্ষম এদের স্থান সমাজে ন্যুইসেন্স তৈরি ছাড়া আর কী হতে পারে?

অন্যদিকে এডওয়ার্ড সাঈদ, একবাল আহমেদ ও জাক দেরিদা যেখানে এসে মিলেছেন সেটা হচ্ছে অন্যের কণ্ঠস্বর শুনতে দেবার বা শোনাবার শর্ত তৈরির জায়গায়। আমরা সেটা কতোটুকু তৈরি করতে পারছি? তাঁরা সন্ত্রাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে পাক্কা ওয়াকিবহাল, কিন্তু এর পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো নৈতিক মানদণ্ড নিয়ে দাঁড়াচ্ছেন না— এটাই আমাদের শেখার বিষয়। কিন্তু সন্ত্রাসের কারণ ও তার ভয়াবহ প্রকাশ প্রশমনের উপায় হিশাবে তাঁরা সবসময়ই যাদের কণ্ঠস্বর আমরা টিপে ধরেছি, কথা বলতে দিচ্ছি না, জিহ্বায় পেরেক মেরে দিয়েছি যাদের তাদেরকে কথা বলতে দেবার কাজটাই বিপ্লবী কর্মী ও ভাবুকদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য বলে মনে করেছেন। আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান এই ধারার সঙ্গে। চাপা পড়া কন্ঠ, আমাদের সামনে থেকে হারিয়ে যাওয়া মুছে যাওয়া মুখ নিজেদের জানান দেবার জন্য সন্ত্রাসের পথ গ্রহণ করে, একবাল আহমদ এই জায়গা থেকে কথা বলার সুযোগ তৈরি ও অপরের প্রতি দায়িত্বশীল হবার যে ডাক দিয়েছেন, দেরিদার মধ্যে সেই ডাকের ন্যায্যতা আমরা খুঁজে পাই। কিন্তু দেরিদা সাবধান করে দিচ্ছেন, সন্ত্রাস কখনই মুছে যাবার নয়, মোছা অসম্ভব। কারণ ভাষা মাত্রই অন্যের কণ্ঠস্বর দাবায়, দাবিয়ে রাখে, দাবিয়ে রাখার ক্ষমতা আছে ভাষার। তাহলে সন্ত্রাসের মাত্রা আমরা কমাতে পারি কিন্তু তার শর্ত থেকে ভাষাসম্পন্ন মানুষের মুক্তি আছে কিনা এই ব্যাপারে দেরিদার সন্দেহ আছে।

তাহলে আমাদের কর্তব্য কী? সেটা হচ্ছে যাদের মুখ আমরা মুছে ফেলছি, যাদের কণ্ঠস্বর আমরা দাবিয়ে রেখেছি তাদের মুখ দৃশ্যমান করে তোলা এবং তাদের কণ্ঠস্বর সরব করে তোলা। দেরিদা মনে করেন বলপ্রয়োগ পুরাপুরি বন্ধ করা যাবে না, কিন্তু এই কাজ যদি আমরা করি তাহলে সন্ত্রাসের যে রূপ আমরা দেখছি সেই রূপ হয়তো থাকবে না, হয়তো কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা নতুন ভাষা ও কথা বলবার সুযোগ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে রক্তাক্ত ও সহিংস সন্ত্রাসের অনেকটাই আমরা মোকাবেলা করতে পারব।

এতোটুকু যদি আমরা বুঝি বাংলাদেশে সন্ত্রাস মোকাবেলার ক্ষেত্রে আমাদের কর্তবা আমরা বুঝে যাব। এই কর্তব্যটুকু যদি বোঝাতে পারি তাহলে আমার লেখাটির কোন ফল হয়েছে বলে আমি ধরে নেব।

তথ্যসূত্র

IPICT 2005 International Policy Institute for Counter Terrorism, 2005 http://www.ict.org.il/

Schmidt et al 1988 : Alex P. Schmidt and Albert 1 Jongman et al., Political Terrorism : SWIDOC Amsterdam and Transaction Books, 1988.

Ahmad 1988: Eqbal Ahmad, On Terrorism A Presentation at the University of Colorado, Boulder, October 12, 1998.

খান ২০০৫: সলিমুল্লাহ খান, এডোয়ার্ড সায়ীদ, এসলাম ও সন্ত্রাসবাদ দেশবমালা, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০।

Benjamin 78 : Walter Benjamin, ‘Critique of Violence’ in Reflections, New York, 1978.

Derrida 92 : Jacque Derrida, Force of Law The ‘Mystical Foundation of Authority’, in Deconstruction and the Possibility of Justice ed. Drucillla Cornell. Michel Rosenfeld, David Gray Garlson, Rouletge, New York, 1992

Chomsky 01 : Noam Chomsky, ‘The Evil Scourge of Terrorism’, http://www.unet.univie.ac.at/-a9504438/ Uni/c-terrorism.htm (5 Dec. 2001)

চিন্তা, সংখ্যা ১, নভেম্বর, ২০০৫


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।