রায়… ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড, ইতিহাস খালাস
চিন্তা, বছর ৭, সংখ্যা ১৭-১৮, ৩০ নভেম্বর, ১৯৯৮
“কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।”
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান মৌলিক অধিকার (তৃতীয় ভাগ) অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত অনুচ্ছেদ ৩৫(৫)।
“আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িক ভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম ও সম্পত্তির হানি ঘটে।”
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান মৌলিক অধিকার (তৃতীয় ভাগ) অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত অনুচ্ছেদ ৩১।
“আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না”
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান মৌলিক অধিকার (তৃতীয় ভাগ) অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত অনুচ্ছেদ ৩২।
বাংলাদেশের ইতিহাস রক্তে ভেজা। দেশ হিশাবে জন্ম লাভের নয় মাসের রক্তপাতই শুধু নয়, রাষ্ট্র হিশাবে তার পত্তন এবং ভাঙাগড়ার ঘটনা প্রবাহও রক্তপাতের নদী আর লাশের গোরস্থান হয়েছে অনেকবারই। শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনা সেই ইতিহাসের খণ্ডাংশ মাত্র, পুরোটা নয়। সেই খণ্ডাংশেরও দৃশ্য ও অদৃশ্য দিক আছে। অপরদিকে দৃশ্যে সংঘটিত ঘটনাঘটনেরও প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নায়ক রয়েছে। প্রকাশ্য কয়েকজন নায়ককে শেখ মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরপরই হাজির করা হয়েছে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুলের এজলাসে, প্রধানত তাঁর পিতা ও পরিবারবর্গের হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্যে। একশ উনপঞ্চাশ দিন শুনানি ও বিচার প্রক্রিয়া অক্টোবরের ১৩ তারিখে শেষ হবার পর ফৌজদারি কার্যবিধির ১২০/বি এবং ৩০২/৩৪ ধারামতে গত ৮ নভেম্বর ১৯৯৮ তারিখে বিজ্ঞ বিচারক তাঁর রায় ঘোষণা করেছেন। রায়ে ১৯ জন আসামীর মধ্যে ৪ জনকে খালাস দিয়ে বাকি পনেরোজনকেই তিনি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। রায়ে তিনি বলেছেন:
“উল্লেখ্য যে, আসামীদের এই অপরাধ এমন এক ক্ষতির কার্য যাহা শুধু ব্যক্তি বিশেষের জন্য ক্ষতিকর নহে, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষেও মারাত্মক ক্ষতি। দেখা যায় যে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ পরিণতির বিষয়ে স্বজ্ঞানে জ্ঞাত থাকিয়াও ষড়যন্ত্র পরিকল্পিত ভাবে ঘটাইয়াছে। সুতরাং তাহাদের প্রতি কোন প্রকার সহানুভূতি ও অনুকম্পা প্রদর্শনের যুক্তি নাই। এই অনুকম্পা পাওয়ার কোন যোগ্যতাও তাদের নাই। তাহাদের কৃত অপরাধের জন্য তাহাদের প্রত্যেককে দণ্ডবিধি ৩০৩/৩৪ ধারা মতে মৃতুদণ্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত হইল। তাহাদের উক্ত চরম দণ্ড প্রদানের পর ১২০-ক ধারার অভিযোগে কোন শাস্তি প্রদান করা হইলো না।…”
চার্জশীট দেওয়া হয়েছিল ২৪ জনের বিরুদ্ধে। চার্জশিট দেবার তারিখ ছিল জানুয়ারি ১৫, ১৯৯৭ এবং বিচার শুরু হয় এপ্রিল ৬, ১৯৯৭ তারিখে। খোন্দকার মোশতাক আহমেদ ও আরো তিনজন বেঁচে নেই বলে ২০ জনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। তদন্তকারী অফিসাররা ৪৫০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এদের মধ্যে ৬১ জনকে সাক্ষী হিশাবে হাজির করা হয়। ৬১ জনের মধ্যে ৩৯ জনই হচ্ছে সেনাবাহিনী সদস্য, এবং ২২ জন অসামরিক নাগরিক। জোবাইদা রশিদ রিভিশন মামলায় হাইকোর্টের আদেশে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি পান। ফলে বিচার হয় ১৯ জনের।
অভিযুক্ত কয়েকজনের অপরাধ আদালতে প্রমাণ সাপেক্ষে রায়ে মৃত্যুদণ্ড অপ্রত্যাশিত ছিল না। প্রমাণের অভাবে চারজন খালাস হয়েছেন। কিন্তু বাকি সকলকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় পুরো বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে যে-প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তার উত্তরের জন্য উচ্চ আদালতে কীভাবে এখন পুরো মামলা ও রায়ের নিষ্পত্তি হয় সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন পথ আপাতত খোলা নেই। বিচারের দণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতি হিশাবে ফাঁসিতে টাঙানোর প্রচলিত পদ্ধতি ছাড়াও ফায়ারিং স্কোয়াডে সকলকে খাড়া করানোর যে-নির্দেশ রায়ে দেয়া হয়েছে তাতেও সমাজে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চ আদালতে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এর ফলে একটা পরীক্ষার মধ্যে পড়ে গিয়েছে। কারণ সমগ্র বিচার বিভাগের পক্ষে উচ্চ আদালতকে এখন নিজের ন্যায্যতা প্রতিপাদনের জন্য প্রমাণ করে দেখাতে হবে নিম্ন আদালতে রায় যাই হোক না কেন বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা প্রতিহিংসা এবং বিচারের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম। দেখাতে হবে যে আদলত বাদী বা বিবাদী কোন পক্ষেরই প্রতিহিংসা চরিতার্থের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে না। দ্বিতীয়ত অপরাধী যতো নৃশংস ও নিষ্ঠুর অপরাধই করুক না কেন আদালতের বিচার প্রক্রিয়া, দণ্ড দান এবং দণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতির কোন ক্ষেত্রেই অপরাধীর প্রতি ঘৃণা বা নৃশংসতা প্রকাশ করা চলে না। এতে আদালতের মর্যাদা মারাত্মক ভাবে ক্ষুন্ন হয়। আদালত বাদীর পক্ষ নেয় না। বিবাদীর পক্ষ গ্রহণ করারও কোন প্রশ্ন ওঠে না।
আদালতের এজলাসে বিচারক সংবিধান ও আইনের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থেকে সমাজের সকলের পক্ষ হয়েই দুই পক্ষের বক্তব্য শোনেন। নিজের আবেগ এবং ব্যক্তিগত মূল্যায়নের ভিত্তিতে আদালতের বাইরে বিচারক অবশ্যই মনে করতে পারেন যে অপরাধীদের প্রতি “সহানুভূতি ও অনুকম্প্য প্রদর্শনের যুক্তি নাই”। কিন্তু সেটা যখন রায় হিশাবে লেখা হয়ে যায় তখন সেটা নাগরিকদের জন্য প্রবল ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ গণতান্ত্রিক সংবিধান যে আত্মিক শক্তির ওপর দাঁড়ায় এবং যে কারণে মানবেতিহাসে এখনও তার গ্রহণযোগ্যতা অন্য যে কোন সংবিধান বা আইনের চেয়ে বেশি সেটি হোল এই “অনুকম্পা ও সহানুভূতি” প্রদর্শনের শক্তি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার (তৃতীয় ভাগ) অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে সেই অনুকম্পা ও সহানুভূতিই ব্যক্তির মৌলিক মানবিক অধিকার হিশাবে লিখিত হয়েছে। বলা হয়েছে, “কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।”
ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের আলোকে বিচার করার প্রয়োজন রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, সংবিধানের এই নীতিকে যদি আমরা উর্ধে তুলে ধরি তাহলে মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কেও প্রশ্ন ওঠে। কোন দণ্ডকে আমরা “নিষ্ঠুর” ও “অমানুষিক” দন্ড বলব? ফাঁসির দড়িতে জীবন্ত মানুষকে টাঙিয়ে দেওয়াকে আমরা কিভাবে দেখব? পৃথিবীর নানাদেশে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট বা মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে শক্তিশালী জনমত রয়েছে। এই জনমত বাড়ছে। বাংলাদেশের আইনে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান রয়েছে। অতএব সেই বিষয়ে এখানে আমরা এখন প্রশ্ন তুলব না। কিন্তু ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রকাশ্যে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান নেই।
অবশ্য ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল নিজেও বলেছেন, “মামলার বিচারের এখানেই শেষ নয়। এরপর আরো আদালত আছে। আদালত ভুল-ভ্রান্তি করলে আপনাদের সেখানে যাওয়ার সুযোগ আছে। তিনি বলেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ, জেরা, বাদী-বিবাদীর মুক্তি আলামত ইত্যাদির ভিত্তিতে পর্যালোচনা-বিশ্লেষণ করে যে জাজমেন্ট আজ আমি এখানে উপস্থিত করতে যাচ্ছি তা স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাকে তৈরি করতে গিয়ে যথেষ্ট পরিশ্রম ও কষ্ট করতে হয়েছে (দৈনিক দিনকাল ৯/১১/৯৮)।
তিনি আরো বলেছেন, “এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ মামলার সিদ্ধান্ত নিতে হলে অনেক সময়ের দরকার। কিন্তু আমাকে সেই সময় দেয়া হয় নি” (দৈনিক দিনকাল ৯/১১/১৮)। দৈনিক দিনকালে প্রকাশিত তাঁর এই মন্তব্যও যে কোন সচেতন নাগরিককে ভাবাবে। কে তাঁকে সময় দেয় নি সেটা অবশ্য পত্রিকায় খোলাসা করে বলা হয় নি। কিন্তু বিচারক হিশাবে তাঁর যদি সময় নেওয়া জরুরী হয়ে থাকে তাহলে তিনি কেন সময় নিলেন না? সেই দায়টাও তো আদালতের ঘাড়েই এসে বর্তায়।
ফায়ারিং স্কোয়াড অথবা ফাঁসি বিতর্ক?
হাইকোর্টের আপীল বিভাগের শুনানীর আগে রায়ের পুংখানুপুংখ বিষয় নিয়ে আলোচনা সঙ্গত কারণেই কেউ করছেন না। তবে ফায়ারিং স্কোয়াড অথব্য ফাঁসির বিতর্ক ক্ষমতাসীন সরকারকে যথেষ্ট বেকায়দায় ফেলেছে। আইন বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ১৫ আসামীর মূল সাজা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। কি পদ্ধতিতে তা কার্যকর হবে, সেটা খুব বড় কথা নয়” (দৈনিক জনকণ্ঠ ৯/১১/৯৮)। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম জনকণ্ঠের কাছে বলেছেন, “এই রায় অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিষয়টি তিনি এখনও পরীক্ষা করে দেখেন নি। তাই চূড়ান্ত মত দিতে পারছেন না”। তবে তিনি বলেন, “ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড যদি কার্যকর করা না-ও যায় তথাপি ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে আইনগত কোন বাধা নেই। কি পন্থায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে, তার ওপর মৃত্যু দণ্ডাদেশের আইনগত বৈধতা নির্ভর করে না” (দৈনিক জনকণ্ঠ ৯/১১/৯৮)।
ভোরের কাগজের (৯/১১/১৮) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তাকে গতকাল আইনসংক্রান্ত বিভিন্ন বই ঘাঁটতে দেখা গেছে। একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের বক্তব্য দেওয়ায় গোটা বিষয়টি খানিকটা জটিল হয়ে পড়লো। ফৌজদারি বিধির ৩৬৮ ধারায় মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের কথা রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অতীতে কখনো ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল না, এখনো নেই। পৃথিবীর কোথাও এই ব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় না। তবে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে ইসলামি আইন অনুযায়ী পাথর ছুড়ে হত্যা এবং পশ্চিমা কোনো কোনো দেশে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিধান রয়েছে।” ভোরের কাগজের প্রতিবেদক আরো লিখেছেন, “আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুকে গতকাল টেলিফোনে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে এর উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।”
বিচারক তার রায়ে অবশ্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দুটি পদ্ধতির কথা বলেছেন। রায়ের আদেশে বলা হয়েছে, “একটি ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রকাশ্যে তাহাদের প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ হইলো। নির্দেশ মোতাবেক তাহাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করিতে কর্তৃপক্ষের কোনো অসুবিধার কারণ থাকিলে তাহাদের মৃত্যুদণ্ড প্রচলিত নিয়মানুসারে ফাঁসিতে ঝুলাইয়া কার্যকর করার নির্দেশ রইলো।”
আইন মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ভোরের কাগজ লিখেছে সেই কর্মকর্তা অবশ্য বলেছেন, “ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের কথা বলায় বিছুটা জটিলতার সৃষ্টি হলেও রায়ে দ্বিতীয় বিকল্প হিশেবে ফাঁসির কথা থাকায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।”
ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ বলেছেন, “মামলার রায় এবং তা কার্যকর করার পদ্ধতি এক কথা নয়। এই রায় কার্যকর করার দুটি বিকল্পের উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের জেল কোড বা সিভিলিয়ান ক্রিমিনাল কোডে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কোন বিধান নেই। এতে মৃত্যুদণ্ড ফাঁসিতে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃতুদণ্ড কার্যকর করার বিধান আছে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩৪ এ ধারায়। তবে এই ক্রয় বিশেষ ক্ষমতা আইনে হয় নি। বিচারক এত দিন শুনানির পর এই রায় দিয়েছেন। তিনি রায় কার্যকর করার দুটি বিকল্পের কথা বলেছেন। হাইকোর্ট একটি রাখতে পারেন। মৃত্যুদন্ডের রায় কার্যকর করতে হাইকোর্টের কনফার্মেশন লাগে। সাজাপ্রাপ্তদের আপীল করার সুযোগ রয়েছে। আপীল না করলেও হাইকোর্টের কনফার্মেশন লাগবে। এরপরও সুপ্রীম কোটের আপীল বিভাগে আপীল করার সুযোগ থাকবে। রাষ্ট্রপতির কাছে ‘মাসি পিসিটশন’ করার সুযোগ থাকে। সব সভ্য সমাজে এসব সুযোগ থাকে। এক্ষেত্রেও তা থাকবে।” (দৈনিক জনকণ্ঠ ৯/১১/৯৮)
ভোরের কাগজের কাছে (১০/১১/৯৮) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একই ভাবে দণ্ড এবং দণ্ড প্রয়োগ বা কার্যকর করার পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য টেনেছেন। তবে এখানে তাঁকে সুনিদিষ্ট ভাবে প্রশ্ন করা হয় যে, “ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার যে আদেশ মাননীয় আদালত দিয়েছে জনৈক আইনজীবী রায়ের ঐ অংশকে ‘বেআইনী’ বলেছেন— এ প্রসঙ্গে আপনার মন্তব্য কি?” ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ উত্তর দিচ্ছেন:
“এ ধরণের বক্তব্য দেওয়া মোটেই সমীচীন নয়। এই মামলা শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে যাবে। এবং তারাই চূড়ান্ত মতামত দেবেন ফৌজদারি আইনে যে দণ্ড দেওয়া হয় তার দুটো দিক আছে। একটি হচ্ছে দণ্ড itself। অর্থাৎ দণ্ডটা কি। এখানে মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে দণ্ড। আর একে কার্যকর করার পদ্ধতি কি, সেটা আরেকটা ব্যাপার, Execution of the sentence. এটা ফায়ারিং স্কোয়াডে হবে না ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হবে— এটা দণ্ড নয়। দণ্ডটাকে কার্যকর করার পদ্ধতি। এখানে তো মাননীয় আদালত দুটো অপসনই দিয়েছেন। ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ থাকার জন্য sentence টা অশুদ্ধ হয়ে যাবে এটা আমি মনে করি না। এ ধরণের আদেশ বেআইনি নয়। ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডে কতোগুলো বিষয় আছে যেগুলোকে illegal বলা যেতে পারে। আর কতোগুলো বিষয় আছে যেগুলো irregular. Irregularity টা কোনো অনিষ্টকর বিষয় নয়, এটা সারানো যায়। আর illegality টা সারানো যায় না। এটা বড়জোড় irregaular হতে পারে। আর বিচারক যেখানে দুই ধরণের পদ্ধতির কথা বলেছেন সেখানে আইনগত সমস্যা হওয়ার কোনো কথা নয়।” জাতীয় আইনজীবী পরিষদ ঢাকা ইউনিটের সভাপতি এডভোকেট হাবিবুর রহমান শওকত এক বিবৃতিতে বলেছেন, প্রকাশ্য স্থানে গুলী করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কোন বিধান ফৌজদারী কার্যবিধি আইনে নেই। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সম্পর্কে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের একমাত্র বিধান ৩৬৮ (১) ধারায় বলা হয়েছে— “When any person is sentenced to death the sentence shall direct that he be hanged by the neck till his death” বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, আইন-আদালতের রায় সর্বক্ষেত্রেই আইনসম্মত হওয়া বাঞ্ছনীয়, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক রায় কাম্য নয়। (দৈনিক ইনকিলাব ৯/১১/৯৮)
ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান না থাকার কারণে সরকার পক্ষ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের এখন বলতে হচ্ছে দণ্ডাদেশের আইনগত বৈধতা দণ্ডাদেশ কার্যকর করার পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। কেন নয়? কেউ অবশ্য কোন যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দেন নি। কোন দণ্ডাদেশের আইনগত বৈধতা যদি না থাকে তাকে ‘বেআইনী’ বলা কেন সমীচিন নয়, কেন তাকে ইরেগুলারিটি বলে গণ্য করতে হবে, সেটাও ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদের বক্তব্যে স্পষ্ট নয়। যতোদূর জানা যায়, বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টে একটি শাস্তির আদেশ আর সেই শাস্তি কার্যকর করার ধরণের সম্পর্ক নিয়ে কোন মামলা কখনো হয় নি। অতএব এই বিষয়ে উচ্চ আদালতে কখনো কোন মীমাংসাও হয় নি। উচ্চ আদালতের কোন নজির এই ক্ষেত্রে অন্তত কেউ দেন নি। এই মামলাটিও এখনো হাইকোর্টে যায় নি। তাহলে কিসের ভিত্তিতে দাবি করা হচ্ছে যে একটি শাস্তির আদেশ আর সেই শাস্তির আদেশ কার্যকর করার পদ্ধতির সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই? যদি শাস্তি কার্যকর করার পদ্ধতি সংবিধানের মানবিক মৌলিক অধিকার বিরোধী এবং একই সঙ্গে ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানের বাইরে হয়ে থাকে তাহলে সেই আদেশ সংবিধান ও আইনের দিক থেকে অবৈধ গণ্য হবে না কেন। তাহলে যাঁরা অভিমত দিচ্ছেন তাঁরা নিছকই তাঁদের ব্যক্তিগত অভিমত পত্রপত্রিকায় পেশ করছেন। নিরপেক্ষ আইন বিশেষজ্ঞের বক্তব্য হিশাবে এই অভিমতগুলো গ্রহণ করা যায় না। বরং একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবান্বিত করার জন্যে একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারের অধিক মূল্য এই মন্তব্যগুলোকে দেওয়া ঠিক নয়।
ব্যক্তিগত মতামতের প্রশ্ন বাদ দিলে এবং উচ্চ আদালতের নজিরের অনুপস্থিতিতে এই রায়টিকেই তার অন্তর্গত যুক্তির বিন্যাসের আলোকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। দেখতে হবে বিচারক নিজে তাঁর রায়ে আদেশ আর শাস্তির পদ্ধতির মধ্যে কোন পার্থক্য টেনেছেন কিনা। বিজ্ঞ বিচারক স্পষ্ট করে বলেছেন,
এক: আসামীদের এই অপরাধ এমন এক ক্ষতির কাজ যা শুধু ব্যক্তি বিশেষের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষেও মারাত্মক ক্ষতি।
দুই: অপরাধীরা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ পরিণতির বিষয়ে স্বজ্ঞানে জ্ঞাত থাকিয়াও ষড়যন্ত্র পরিকল্পিত ভাবে ঘটিয়েছে।
তিন: যেহেতু স্বজ্ঞানে এই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে অতএব অপরাধীদের প্রতি কোন প্রকার সহানুভূতি ও অনুকম্পা প্রদর্শনের যুক্তি নাই।
পাঁচ: অনুকম্পা পাওয়ার কোন যোগ্যতাও তাদের নাই। দেখা যাচ্ছে অপরাধীর প্রতি সহানুভূতি ও অনুকম্পা প্রদর্শনের কোন যুক্তি নাই, এটাও রায়ের অংশ। শুনানী ও আলামত পরখ করে বিচার প্রক্রিয়ার নিজস্ব গতি থেকেই বিজ্ঞ বিচারক এই সিদ্ধান্ত টেনেছেন। যেহেতু সহানুভূতি ও অনুকম্পা প্রদর্শনের কোন যুক্তি নেই এবং অপরাধীদের অনুকম্পা ও সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্যতাও নেই সেই কারণেই ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। পুরো রায় থেকে মৃত্যু দণ্ডাদেশকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন করা যায় না। যাঁরা আলাদা বা বিচ্ছিন্ন ভাবে মৃত্যুদণ্ডাদেশকে মূল রায় থেকে পৃথক গণ্য করে তাকে আলাদা রায়ের মর্যাদা দিতে চাইছেন তাঁরা বিজ্ঞ বিচারকের ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতি পরায়ন নন। এটা পরিষ্কার। তাছাড়া এটাও পরিষ্কার যে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কিভাবে কার্যকর করা হবে সেই বিষয়েও তিনি দুটো পন্থা নয়, একটি পন্থাই উল্লেখ করেছেন। সেটা প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করা। দ্বিতীয় পন্থার নির্দেশ তিনি একটি অথবা অন্যটি কার্যকর করার নির্দেশ হিশাবে দেন নি। পরিষ্কার বলেছেন, “নির্দেশ মোতাবেক মৃত্যুদণ্ড প্রচলিত নিয়ম অনুসারে কার্যকর করিতে কর্তৃপক্ষের কোন অসুবিধার কারণ থাকিলে তাহাদের মৃত্যুদণ্ড প্রচলিত নিয়মানুসারে ফাঁসিতে ঝুলাইয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ রইল”। অর্থাৎ প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। শুধুমাত্র “কর্তৃপক্ষের কোন অসুবিধার কারণ থাকিলে” প্রচলিত নিয়মে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। অর্থাৎ নিদেশ এখানে একটি, দুটি নয়। এখানে কোন "অথবা" নেই। আইনের দিক থেকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর যাঁরা করবেন সেই কর্তৃপক্ষকে প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হলে কর্তৃপক্ষকে প্রমাণ করতে হবে প্রকাশ্যে আদেশ কার্যকর করার অসুবিধা আছে। কারণ বাদি পক্ষ যে-বিচার আদালতের কাছে পেয়েছে সেই মোতাবেক আদেশ কার্যকর করার দাবি তোলার আইনী অধিকার এখন তার আছে। অতএব ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করলে কর্তৃপক্ষকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করার অধিকার বাদী পক্ষের রয়েছে। আদালতে অসুবিধার কারণ কর্তৃপক্ষকে প্রমাণ করতে হবে। রায় অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ এক তরফা সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।
কেন রায়টিকে আমরা এতো ঘনিষ্ঠভাবে পাঠ করছি? কারণ হোল, প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসা থেকে একটি স্বাভাবিক বিচারের প্রক্রিয়া ও চরিত্র লক্ষণ আলাদা করার সামর্থের ওপর আগামি দিনে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। গরিব, খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ, শ্রমিক, কৃষক ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আওয়ামী-বাকশালী শাসনের অত্যাচার দেখেছে। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারবর্গকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে যে একনায়কতান্ত্রিক সামরিক সরকারগুলো একের পর এক ক্ষমতায় এসেছে তাদের শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতাও তাদের আছে। একদিকে ফ্যাসিবাদ অনাদিকে সামরিক একনায়কতন্ত্র এই দুইয়ের টানাপোড়েনে বাংলাদেশের মানুষ রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করে এমন একটি কার্যকর সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম এবং নির্বাহী ও সংসদীয় ক্ষমতার অধীনস্থতা থেকে মুক্ত সক্রিয় বিচার ব্যবস্থার জন্য দীর্ঘ দিন এই দেশের মানুষ সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বারবারই তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডসহ সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক এই প্রশ্নে এক বিন্দু আপোষ চলতে পারে না। কিন্তু যদি বিচার বলতে আমরা বুঝি যেভাবে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে সেই একই কায়দায় অপরাধীদের ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যা করা তাহলে বিচার ব্যবস্থা কতোটুকু নিজের গৌরব বৃদ্ধি করতে পারবে?
বাংলাদেশ এক অদ্ভুত দেশ যেখানে ফ্যাসিবাদী ও একনায়কতন্ত্রী উভয়েই নিজেদের ‘গণতন্ত্রী’ বলে দাবি করে। অথচ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অর্থ হচ্ছে এই দুই অপশক্তির বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম জোরদার করা। এই সংগ্রামের নীতি ও কৌশল নিবারণের ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে একনায়তান্ত্রিকতার একটা বড়ো পার্থক্য সবসময়ই মনে রাখতে হবে। একনায়কতান্ত্রিকতার কোন আদর্শগত ভিত্তি থাকে না। নগ্ন ও জবরদস্তিমূলক উলঙ্গ শক্তি বা নিছক সামরিক ক্ষমতাই তার ক্ষমতার উৎস। ক্ষমতায় এসে একনায়কতান্ত্রিক সরকারগুলো নানান কিসিমের তত্ত্ব ও আদর্শ ক্ষমতায় থাকার দরকারে ফেরি করে বেড়ায়, কিন্তু সমাজে তা কখনই দানা বাঁধে না। কিন্তু ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে এই কথা খাটে না। কারণ তার শ্রেণী ভিত্তি থাকে ক্ষুদে উৎপাদক, টাউট মাস্তান ও সমাজের ওপরের সিড়িতে ওঠার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা নিম্ন মধ্যবিত্তের একটা বিশাল অংশ। হিটলার বা মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদের একটা আদর্শগত ভিত্তি ছিল। তাদের পেছনে জনসমর্থন ছিল। পাতি বুর্জোয়ার জাতীয়তাবাদী অহংকার এবং বর্ণবাদী উষ্মা এবং একপার্টি ভিত্তিক ‘সমাজতন্ত্র’ ছিল সেই সমর্থনের আদর্শগত ভিত্তি। ফলে একনায়কতান্ত্রিকতাকে মোকাবিলা করা যতো সহজ ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা ততো সহজ নয়।
বাংলাদেশের জনগণ বাকশালী শাসনের অত্যাচার থেকে মুক্তি চেয়েছে কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারবর্গের করুণ মৃত্যুকে কখনই ভালো চোখে দেখে নি। ঘটনা ঘটবার সময় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনগণের বিবেক যে-পরিমাণ নাড়া খাওয়ার কথা ছিল চতুর্থ সংশোধনী ও বাকশালী আমলের নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে সেই সাড়াটুকু দেখা যায় নি। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল এই দাবিও মিথ্যা। অন্তত ইতিহাস তা মিথ্যা প্রমাণ করেছে। বড়োজোর একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার রেশ ছাড়া আর কিছু আবিষ্কার করা দুঃসাধ্য। অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের নায়ক ও ষড়যন্ত্রকারীদের এটা খুবই করুণ এক ঐতিহাসিক ট্রাজেডি যে জনগণ তাদের কোন অভ্যুত্থানের নায়ক হিশাবে যেমন স্বীকৃতি দেয় নি, তেমনি সামরিক অভ্যুত্থানের হোতা বলেও স্বীকার করে নি। ফলে যড়যন্ত্র ও হত্যাকাণ্ডের ফলাফল হিশাবে সেই একনায়কতান্ত্রিক শাসকের উত্থানকেই জনগণ মেনে নিয়েছিল যাঁকে সরাসরি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয় বলে তাদের মনে হয়েছে। উঠে এসেছেন জেনারেল জিয়া। জেনারেল জিয়াউর রহমান বহু সৈনিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেও প্রবল দাপটের সঙ্গে সামরিক একনায়কতন্ত্র কায়েম রেখে দীর্ঘদিন ক্ষমতা ভোগ করতে পেরেছেন। বাকশালী আমলের তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতি এর পেছনে যথেষ্ট কাজ করেছে। অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের নায়কদের কপালে ভাড়াটিয়া খুনির গৌরব ছাড়া আর কোন তিলক জনগণ পরাতে কখনই রাজি ছিল না। জনগণ বাকশালী শাসন, নির্যাতন ও অত্যাচার থেকে মুক্তি চেয়েছে কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারবর্গের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড মেনে নেয় নি। তাছাড়া হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করার জন্য ইনডেমনিটি বিল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি বিশাল প্রতিবন্ধকতা হয়ে দীর্ঘকাল বহাল ছিল। সেটাও ক্রমে ক্রমে একটা ক্ষোভের কারণ হয়ে উঠছিল। বাকশালী আমল ফ্যাসিবাদী আমল হিশাবে চিহ্নিত হয়ে ওঠার কারণ ছিল একে নিছকই অস্ত্রের জোরে কিম্বা নিছকই রক্ষী বাহিনীর শক্তির বলে শাসন বলা যায় না। শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত ক্যারিসমা, ছয় দফার রাজনীতি ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের উত্থান ও বিকাশ এবং সর্বোপরী সংবিধানের চার নীতির পক্ষে পেটিবুর্জোয়ার একটা বড়ো অংশের সমর্থন ছিল। এই শ্রেণী সংগঠনে পটু ও অভিজ্ঞ। তাছাড়া জিয়াউর রহমানের বিএনপির মতো ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগের জন্ম হয় নি। জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগের একটা ভিত্তি ছিল। এটাও আশ্চর্যের যে শেখ মুজিবুর রহমানের করুণ মৃত্যু ও তাঁর আওয়ামী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ফ্যাসিবাদ নতুন ভাবে সংগঠিত হয়ে ওঠার শর্ত বাংলাদেশে এখনও নিশ্চিহ্ন হয় নি। তাকে জাগিয়ে তোলার জন্যই ব্যক্তির প্রতি অন্ধ আবেগ, নির্বিচার আনুগত্য, যথেচ্ছা দলীয়করণ ও স্তাবকতার চর্চা এতো প্রকট ভাবে আমরা লক্ষ করছি।
এটা সত্যি যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ফলাফল হিশাবেই এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার বিএনপি এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। এই দুটো দলের একটিকেও গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী দল বলা যায় না। ফলে আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণ যা কিছু অর্জন করেছে তাকে বানচাল করে দেওয়ার চেষ্টা আমরা বিএনপির আমলে যেমন দেখেছি, আওয়ামী আমলেও দেখছি। বিএনপি সেই কাজ করেছে মাথা মোটা মিলিটারী মার্কা গায়ের জোর আর মাস্তানী খাটিয়ে। আওয়ামী লীগ গায়ের জোর আর মাস্তানীর সঙ্গে যুক্ত করেছে জাতির পিতা আর বঙ্গবন্ধুর নাম। মানুষের অন্ধ আবেগ ও নির্বিচার অনুগত্যই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পুঁজি। আর ঠিক এ কারণেই পুরানো ফ্যাসিবাদী প্রবণতাগুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত এই প্রবণতাগুলো দানা বেঁধে উঠতে পারবে কিনা তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে জনগণের সতর্কতা, সচেতনতা ও সংগ্রামী মনোবলের উপর।
ইনডেমনিটি বিল বাতিল এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারবর্গের হত্যাকাণ্ডের বিচার একদিক থেকে অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। কারণ, বিচার ব্যবস্থাকে যদি তার নিজস্ব শক্তিতে আমরা দাঁড়াতে দিতে চাই তাহলে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠ বিচার প্রয়োজন। শেখ হাসিনা সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যদিও সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেন নি। সে যাই হোক, শেখ মুজিবুর রহমান নিছকই একজন ব্যক্তি নন। তাঁর হত্যাকাণ্ডকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো মানে একই সঙ্গে সেই সময়ের সামাজিক টানাপোড়েন, ইতিহাসের দ্বন্দ্ব, রাজনীতি এবং ক্ষমতার লড়াইও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য। বিজ্ঞ বিচারক এই দিকটি ঠিকই টের পেয়েছিলেন, ফলে “বিচারকার্যের এক অবিসস্মরণীয় নীতি” তিনি রায়ের শুরুতেই স্মরণ করেছেন। রায়ের শুরুতেই বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ডটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা সত্ত্বেও বিচার কার্যের ক্ষেত্রে আদালতের কাছে অন্যান্য হত্যা মামলার ন্যায়— ইহাও কেবল একটি হত্যার মামলা, কারণ— “We have to dispense justice in accordance with law and not according to our moral conviction with regard to the occurance. The strict requirement of law is that the onus lies on the prosecution to prove its case beyond reasonable doubt. When human life pends in the scales, caution becomes the primary duty of any tribunal called upon to assess the evidence of the case having regard to this statutory rule of caution”.
ঘটনার ঐতিহাসিকতা বিজ্ঞ বিচারক অস্বীকার করেন নি। কিন্তু তাঁর আদালতে এটিকে নিছকই একটি খুনের মামলার বেশি কোন মর্যাদা তিনি দিচ্ছেন না, সেই কথা পরিষ্কার করে বলে নিয়েছেন। বিচারকার্য পরিচালনার এই নীতিগত প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে তিনি শুরুতেই ঘটনাটিকে ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে কয়েকজন কতিপয় ব্যক্তির ষড়যন্ত্র ও পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কেন হত্যাকারীরা এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করলো সেই মোটিভ সংক্রান্ত প্রশ্নটিকেও তিনি তাঁর আটটি বিচার্য বিষয়ের মধ্যে সবার শেষে অন্তর্ভুক্ত করেছেন ঠিকই কিন্তু পরিষ্কার বলেছেন, “মামলার মোটিভ প্রমাণ করিতে প্রসিকিউশন আইনত বাধ্য নহে”। তবুও তিনি মোটিভের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, “সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি, পোস্টিং, দলাদলিসহ আরও সৃষ্ট কারণে অসন্তোষ, অস্ত্র উদ্ধারের সময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে গোলমাল, খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীত্ব যাবার কথাবার্তা, বাকশাল গঠন, জেলা গভর্নর নিয়োগ ইত্যাদি কারণে আসামিগণ ক্ষোভ-দুঃখে যৌথ ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে একই অভিপ্রায়ে পরিকল্পনামতে এই ঘটনা করিয়া থাকিবে”। দেখা যাচ্ছে মোটিভের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি সেই সময়ের ইতিহাস, শ্রেণী ও গোষ্ঠির দ্বন্দের উল্লেখ করেছেন। তাঁর রায়ের মধ্যেই তিনি এই হত্যাকাণ্ডকে নিছকই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তির খুনখারাবি আকারে দেখান নি। ঘটনার পেছনে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক কালপর্বের একটা দ্বন্দ্বসংকুল পর্বের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বিজ্ঞ বিচারক নিজেই তুলে ধরেছেন।
তাহলে কি দৃশ্যমান ঘটনাঘটনের কতিপয় নায়ককে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আদালত আমাদের ইতিহাসের দায় থেকে খালাস করতে সক্ষম। কিম্বা এই ক্ষেত্রে আদালতের পক্ষে কি ইতিহাসকে বিবেচনায় না নিয়ে নিছকই কতিপয় ব্যক্তি কর্তৃক অন্য কয়েকজন ব্যক্তিকে খুনের মামলা হিশাবে এই বিচার সম্পন্ন করতে সক্ষম। প্রশ্ন হচ্ছে যে বিচারের নীতি আদালত গ্রহণ করেছে তাতে কি আদালত ইনসাফ বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। এই গুরুতর প্রশ্নগুলো হাইকোর্ট বিভাগকে উত্থাপন করতে হবে। বিচার বিভাগের জনা এটা একটা শাঁখের করাত হয়ে উঠতে বাধ্য। কারণ একদিকে বিজ্ঞ বিচারক ঠিকই ইঙ্গিতে বলেছেন ইতিহাসের বিচার আদালতের কাজ নয়। আদালতের কাজ হচ্ছে সুনির্দিষ্ট ভাবে একটি ঘটনাকে ইতিহাস বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিশাবে বিচার করা, কোন নৈতিক বিশ্বাস নয়, কেবল আইনের আলোকেই পরখ করা, আলামত ও প্রমাণপত্রাদি পরীক্ষা করে সেই ঘটনার আলোকেই বিচার কাজ সমাধা করা। কিন্তু অন্যদিকে ইতিহাসের খোঁজখবর যদি আদালত না রাখে এবং হত্যাকাণ্ডের মোটিভ বিচার করতে গিয়ে সেই মোটিভের পেছনে ব্যক্তি-নিরপেক্ষ ইতিহাসের ভূমিকাকে যথাযোগ্য স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে পুরো বিচারই ন্যায়বিচার বা ইনসাফের প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে নৈতিকতা বর্জিত নিষ্ঠুর শাস্তি প্রদানে পর্যবসিত হতে পারে। নীতি ও আইনের সীমারেখা কি আদৌ টানা সম্ভব? আইনের ন্যায্যতা কি নীতিশূন্য লিগাল প্রসিডিউরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে? এই সকল মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে হাইকোর্ট বিভাগে এই মামলা একটা অনন্য চ্যালেঞ্জ হিশাবে হাজির হবে। এই চালেঞ্জ হাইকোর্ট বিভাগ কীভাবে মোকাবিলা করে তার ওপর আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করবে।
আদালত এই হত্যাকাণ্ডে তৃতীয় পক্ষের যুক্ত থাকার দাবি নাকচ করে দিয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, “ইহাতে কোন তৃতীয় পক্ষ জড়িত ছিল কিনা সেই বিষয়টির ওপর কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ রেকর্ডে আসে নাই”। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লীফশুলৎজ অগাস্ট হত্যাকাণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছিলেন। এটা সত্যি যে তৃতীয় বিশ্বে সামরিক ক্যূদেতা, অভ্যুত্থান বা হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা পরিবর্তন নিছক আভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে ঘটে না। এর পেছনে বাইরের মদদ থাকে। আদালত তৃতীয় পক্ষকে অভিযোগ থেকে খালাস করে দিয়ে দৃশ্যমান ঘটনার দৃশ্যমান নায়কদের ওপরও পুরো অপরাধের দায় তুলে দিয়েছেন।
লরেন্স লীফশুলৎজ বিবিসি বাংলা সার্ভিসের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলেছেন, “অনেক রাঘব বোয়ালই বাইরে রয়ে গিয়েছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে চক্রান্তের এই দাবাখেলার সৈন্যদেরই শুধু বিচার হয়েছে, কিন্তু তাদের পেছনে যে রাজা বা রুজার হাতি ছিল তাদেরকে ছোঁয়া যায়নি।”
বাংলাদেশ: দ্য আনফিনিশড রেভলিউশন গ্রন্থের লেখক লিফশুলৎজ বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের দায়দায়িত্বের যে প্রশ্ন সেটি পুরোপুরি বিবেচিত হয়নি বলেই তিনি মনে করছেন। ফলে বিচার প্রক্রিয়াটি অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। তিনি বলেন, “এটা অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার যে এ হত্যা এবং অভ্যুত্থানের পেছনে কেউ কলকাঠি নাড়িয়েছিল কি না তা বের করার জন্য বাদীপক্ষ থেকে জোরালো কোনো চেষ্টা হয়নি। কেন হয়নি এটি আমার কাছে একটা বড়ো প্রশ্ন।”
বাংলাদেশ: দ্য আনফিনিশড রেভলিউশন গ্রন্থে লিফশুলজ উল্লেখ করেছিলেন, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ছিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অনেক কর্মকর্তার কাছেই এ ব্যাপারে হ্যা সুচক উত্তর পেয়েছিলেন তিনি। বাদীপক্ষের প্রধান কৌসুলি সিরাজুল হক এ প্রসঙ্গে বিবিসিকে বলেছেন, এতোদিন পর সাক্ষ্য প্রমাণ যোগাড়ে অসুবিধা ছিল। এ জন্য তারা বেশি দূর এগুতে চাননি।
লিফশুলৎজ আরো বলেন, আমি বলছি না যে ইরান, চিলি ও ওয়াতেমালার মতো বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র সে সময় সরাসরি কোনো ভূমিকা রেখেছিল কিন্তু বিভিন্ন মার্কিন কর্মকর্তা এবং অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপে আমি জেনেছি, দুপক্ষের মধ্যেই আগে থেকে একটা যোগাযোগ ছিলো। মার্কিন কর্মকর্তাদের এক পক্ষ থেকে অস্পষ্ট একটা নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল যে অভ্যুত্থানে সফল হলে তারা সঙ্গে থাকবেন, কিন্তু ব্যর্থ হলে তারা কিছু জানেন না। বাদীপক্ষের প্রধান কৌসুলি সিরাজুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, বহিঃশক্তির জড়িত থাকার ব্যাপারে আঁচ পেলেও যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে এ নিয়ে কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। রাজনৈতিক কারণে পরাশক্তির সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নটি উত্থাপনেও সমস্যা আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। (দৈনিক ভোরের কাগজ ১৩/১১/৯৮)।
বিজ্ঞ বিচারক ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে শুধু ইতিহাসকেই খালাস করেন নি, অনেক রাঘব বোয়ালকেও বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইনসাফ বা ন্যায়বিচারের প্রশ্ন উচ্চ আদালতে উত্থাপিত হয় কিনা সেটাই এখন আমাদের দেখার বিষয়।
[ আজ থেকে ২৬ বছর আগে এই লিখাটি পাক্ষিক চিন্তা, বছর ৭, সংখ্যা ১৭-১৮, ৩০ নভেম্বর, ১৯৯৮ তারিখে প্রথম ছাপা হয়েছিল। বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টির দিকে নতুন ভাবে তাকাতে আমাদের সহায়ক ভেবে আবার ছাপা হোল। ]