মানুষ, রুহানিয়াত ও মক্কা বিজয়


এক

মানুষকে মুক্ত বা স্বাধীন ভাবতে পারা মানবেতিহাসে খুব বড়সড় ঘটনা। ইতিহাসের একটা কালপর্ব পার হয়ে এসে সবে মাত্র আধুনিক কালে আমরা ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ বা ‘ব্যক্তির মুক্তি’র কথা বলি। কিন্তু ভাবা দরকার একটি গোত্রবাদি, গোষ্ঠবাদি, রক্তের সম্পর্কের ওপর দাঁড়ানো সমাজে মানুষ স্বাধীন বা মুক্ত এই ধারণার আবির্ভাব কিভাবে ঘটল? বিস্ময়কর! শুধু তাই না, আল্লা ছাড়া ইহলোকে সেই স্বাধীন ও মুক্ত মানুষের দেশ কাল পাত্র দ্বারা সীমিত কোন ইহলৌকিক বস্তু বা ব্যক্তির অধীনস্থতা মেনে নেওয়া ঘোরতর অধর্ম, বা ইসলামের ভাষায় ‘শির্ক’ বা শেরেকি – এই রুহানি ধারণাটিও কিভাবে তৈরি হোল? কিভাবে হাজির হল? এই তাকবির ঘোষণা কিভাবে সম্ভব হোল? মানুষের মহিমা কিভাবে এমন উচ্চকন্ঠে উচ্চারিত হতে পারল?

এই অভূতপূর্ব জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে হলে সবার আগে সাধারণ ভাবে ধর্ম এবং বিশেষ ভাবে ইসলাম নিয়ে পর্যালোচনার হিম্মত অর্জন জরুরি। প্রাথমিক পদক্ষেপ হচ্ছে প্রথাগত বা প্রচলিত ইসলাম কিম্বা ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন বিশ্বাস, মজহাব বা তরিকার বেড়া দ্বারা সংরক্ষিত নানান বদ্ধমূল ধারণা ও আত্মঘাতি গোঁড়ামি থেকে বের হয়ে আসতে পারা। অন্যের আরোপিত চিন্তা বা চিন্তার অভ্যাসের গোলামি না করে নিজের বিবেক, বুদ্ধি, পর্যালোচনার ক্ষমতা সহ আল্লা মানুষকে যে সকল বৃত্তি দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন তার সদ্ব্যবহার করতে শেখা। কেবল তখনই মানুষের সঙ্গে মানুষের দিব্য সম্বন্ধ স্থাপনের শর্ত তৈরি হয়; একই ভাবে ভাবা একই ভাবে কাজ করবার ক্ষেত্র ও তরিকা স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন হয়।

নিজের বুদ্ধি ও বৃত্তির বিকাশ ঘটানো সহজ কাজ নয়। এর জন্য মানবেতিহাসের শত শত বছর কেটে যেতে পারে। ব্যক্তি মানুষের পক্ষেও দুই একদিনে কয়েক মাসে বা বছরে সম্ভব না। কিন্তু কোন না কোন জায়গা থেকে কথা শুরু করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। মানুষ, রুহানিয়াত ও মক্কা বিজয় সেই কথোপকথন শুরুর একটা উসিলা মাত্র।

যিনি ‘মোমিন’ অর্থাৎ নিঃশর্তে গায়েবে আত্মসমর্পণ করার তাৎপর্য ও কর্তব্য বোঝার মধ্য দিয়ে মরণশীল মানুষের সীমিত অস্তিত্বের তুচ্ছতা টের পেয়ে গিয়েছেন, তিনি আমার কথা বুঝবেন। যিনি গায়েব, তিনি সদা সর্বদা ‘নাই’ – অর্থাৎ তিনি কখনই দেশকালপাত্রে ধরা দেন না, সেই নিত্য অনুপস্থিতির স্মরণ ও শরণ ছাড়া মানুষের পক্ষে নিজের রুহানি বিকাশ সম্ভব না। তাই যাঁরা গায়েবে আত্মসমর্পনের মর্ম ও মাধুর্য বোঝেন – এবং নিঃশর্তে গায়েবে আত্মসমর্পন করে নশ্বর ইহলৌকিক অস্তিত্বের ভার মুক্ত হয়েছেন, তাঁরা আমার কথা বুঝবেন। তাঁরা রুহানি আগুনের জ্বালায় জ্বলে পুড়ে নিজেকে শুদ্ধ করবার কঠিন পরীক্ষায় রত। আর যারা ঈমানকে ‘বিশ্বাস’ বোঝেন এবং ‘বিশ্বাস’-এর নামে আসলে আল্লাকে না, আদতে নিজের বিশ্বাসকেই ‘বিশ্বাস’ করেন – এ লেখা তাদের জন্য নয়। ইসলামের ইতিহাস নির্মোহ ভাবে পর্যালোচনার হিম্মত অর্জন করবার সাহস অর্জন করা কঠিন কাজ। যিনি দাতা তাঁর কাছে আমরা সেই তৌফিক প্রার্থনা করি। বিসমিল্লাহের রাহমানুর রাহিম।

দুই

মানুষ মাত্রই মুক্ত ও স্বাধীন। রুহানি আলোর ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে এই মুক্তির স্বাদ বা স্বাধীনতা উপলব্ধি করা আর রাজনৈতিক সত্য হিশাবে সমাজে ও ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে মানুষের হাজার বছরের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। ইউরোপ মাত্র আধুনিক জামানায় এসে স্বাধীন ‘মানুষ’ আবিষ্কার এবং তাকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লবের তাগিদ অনুভব করেছে। কিন্তু তারও বহু আগে; আরও গভীর এবং আরও রুহানি অতলতা থেকে যে ঘোষণা দিয়ে ইসলাম যাত্রা শুরু করেছিল, সেটা ছিল খুবই সহজ এবং সরল—মানুষ মুক্ত, মানুষ স্বাধীন, সে ইহলোকে কারও কাছে মাথা নত করে না, শুধু যিনি ‘গায়েব’ ’ অথচ সর্বত্র বিরাজমান, যিনি আছেন বলে দেশকালপাত্রে বিশ্বজগত বর্তমান হয়, বাস্তবে হাজির থাকতে পারে – মানুষ শুধু তাঁর কাছেই নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করে। মানুষ সম্পর্কে এটা একদমই নতুন কথা।

এই সেই ‘এক’ বা অদ্বিতীয়, যা একই সঙ্গে গায়েব। এই ধারণা জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemological) ধারণা বা সিদ্ধান্ত হিশাবে গড়ে ওঠে নি। ইসলামের আগেও একত্ববাদ ছিল, ইসলামের বাইরেও একত্ববাদের নানান রূপ, ধরণ, বয়ান বা ফেরকা রয়েছে। কিন্তু ইসলামের একত্ববাদ আলাদা। যে ‘এক’এর ঘোষণা গোত্রবাদ, গোষ্ঠবাদ, রক্তবাদ ও অভিজাততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ইসলাম ঘোষণা করেছিল তার উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। সেটা ছিল গোত্রে গোত্রে গোষ্ঠে গোষ্ঠে, রক্তে, বর্ণে লিঙ্গে জাতিতে জাতিতে বিভক্ত ও খণ্ড খণ্ড মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করবার আহ্বান। মানুষ এক – অতএব ‘এক’-এর অধীন হওয়াই মানুষের ধর্ম-ভাবনার চূড়ান্ত রূপ হওয়া উচিত। গোত্রবাদ, গোষ্ঠবাদ, বর্ণবাদ ও জাতিবাদ ইত্যাদি নির্মূল করবার আদর্শ হিশাবে ইসলাম হাজির হয়েছিল। এই আদর্শেরই রাজনৈতিক বিজয় ঘটেছিল মক্কাবিজয়ের মধ্য দিয়ে। যে অর্থে প্রাক-ইসলামি ধর্মগুলো প্রথাগত অর্থে ধর্ম, কিন্তু ইসলামকে তাদের কাতারে ফেলা যায় না। বিপরীতে মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা, উম্মাহ বা বিশ্বসমাজ কায়েম এবং এই গ্রহকে মনুষ্য প্রজাতির আবাসভূমি বা বেহেশতে রূপান্তরিত করবার জন্যই একটি ঘোর ট্রাইবাল বা বেদুঈন সমাজে একজন এতিমের নেতৃত্বে মানুষকে নতুন রাজনীতি ও জীবনের স্বপ্ন দেখাবার জন্যই আরব দেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে। ইসলাম তার আগে আসা সকল নবি রসুল আল্লার তরফে এসেছেন মানে। শুধু তাই নয় প্রতিটি জনগোষ্ঠির জন্য আল্লা পথপ্রদর্শক পাঠিয়েছেন এটাও দাবি করে। ভুলত্রুটির মধ্য দিয়ে মানবেতিহাস অগ্রসর হয় এবং ধর্মের ঐতিহাসিক বিবর্তন ঘটে স্বীকার করে।

কিন্তু মোহাম্মদ (সাঃ) আখেরি বা শেষ নবি। এই ঘোষণা দেবার মধ্য দিয়ে শেষ নবির পর আর কোন মানুষকে আল্লার তরফে কথা বলা এবং নবি-রসুলদের কর্তৃত্ব দাবি করে কোরান ব্যাখ্যা করবার অধিকার ইসলাম রদ বা রহিত করে দিয়েছে।

রসুল নাই, কিন্তু মানুষের হেদায়েতের জন্য কোরান এবং তাঁর স্মৃতি ও ইতিহাস রয়েছে। মানুষকে অবশ্যই এখন যুক্তি, বিবেক, বিবেচনা, তত্ত্ব ও ইতিহাস পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে প্রজ্ঞার শিখর স্পর্শ করতে হবে। ধর্মের নামে অজ্ঞতা, মূর্খতা ও পশ্চাতপদতার সুযোগ রাসুলকে ‘শেষ নবি’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে রদ বা রহিত করা দেওয়া খবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। নিজ নিজ রুহানি স্বভাব ও বৃত্তির বিকাশই মানুষকে সামষ্টিক ভাবে সকলের কল্যাণের জন্য একই ভাবে ভাবতে, একই দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা কায়েমে অনুপ্রাণিত করতে পারে। নতুন বিশ্বসমাজ গড়ে তুলবার পথ ও পদ্ধতি নির্ণয় করবার ক্ষমতা সম্পন্ন করেই আল্লা মানুষকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। আর মানুষ নামক জীবকে আল্লা শুধু ‘মানুষ’ বলেন নি, বলেছেন ‘খলিফা’। মানুষের দিব্য মহিমা ঘোষণার এই ঘটনা অভূতপূর্ব।

বুঝতে হবে, ইসলাম অবশ্যই রাজনৈতিক। ইসলামে প্রাচীন ও প্রচলিত ধর্ম নয় বরং ইসলামে খোদ ধর্ম ধারণারই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

তিন

মক্কা বিজয়। যদি বছরের হিশাব করি তাহলে বলতে পারি সেটা প্রায় ১৪৪১ বছর আগের ঘটনা। ফরাসি বিপ্লব হয়েছিল ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে। ফরাসি বিপ্লবেরও ১১৬০ বছর আগে মক্কাবিজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের মহিমা প্রথম রাজনৈতিক সত্য হিশাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। হুদায়বিয়ার সন্ধির পরে রাসুলে কারিম সাঃ যোদ্ধা এবং সেনাপতি হিশাবে মক্কাবিজয়ের ক্ষেত্রে যে অসাধারণ দূরদর্শিতা প্রদর্শন করেছিলেন, তা নিয়ে নতুন করে বিশাল বই লেখা সম্ভব। লেখা কর্তব্যও বটে। মক্কাবিজয় হচ্ছে বিশ্ব-ইতিহাসে ইসলামের প্রবেশ। মানুষকে দেওয়া আল্লাপ্রদত্ত অপার মহিমার বিজয় ঘোষণার দিন। তাহলে এবার নিজেকে সততার সঙ্গে বুকে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করুন, ইসলাম এই মহিমা ধরে রাখতে পারল না কেন? কেন হারাল? কীভাবে হারাল?

মানবেতিহাসের অভিমুখ যদি গায়েবের সঙ্গে কর্তাসত্তা-সম্পন্ন মানুষের রুহানি সম্বন্ধ রচনার কর্তব্য হিশাবে বুঝতে চাই, তাহলে এই পথ হারানোর ইতিহাস খুঁজতে হবে। কোথায় আমরা ভুল করলাম? সমূহ পরাজয়, অভিমান, সংকীর্ণতা ও আত্মম্ভরিতা বাদ দিয়ে নির্মোহ অন্বেষণে নামতে হবে আমাদের।

মানুষ শুধু স্বাধীন বা মুক্তই নয়, ইহলোকে যিনি সতত গায়েব কিন্তু সর্বত্র বিরাজমান, মানুষ তাঁরই ‘খলিফা’। ‘মানুষ’ অতএব পরমার্থিক ‘আয়াত’ বা চিহ্ন। পরমার্থিকতার জীবন্ত সাক্ষী। বিস্ময়কর ঘোষণা। এখানেই সমগ্র পাশ্চাত্য এমনকি প্রাচ্যের সঙ্গেও ইসলামের দুস্তর ফারাক ঘটে যায়। অথচ ‘খলিফা’ ধারণাটিকে আজ অবধি মর্মার্থবিহীন ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা হিশাবে মুখস্থ করা হয়। এর দার্শনিক ও রাজনৈতিক মর্ম নিয়ে পর্যালোচনার কোনো হিম্মত অর্জনের চেষ্টা হয়নি বললেই চলে। ‘মানুষ আল্লার খলিফা’–ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে বিশ্ব-রাজনীতির সূচনা হয়েছিল, পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে তার মর্ম নিয়ে নতুন করে ভাবার জন্যই কথাগুলো তোলা, ভুলে যাওয়া আয়াতগুলো আবার বলা।

প্রাথমিকভাবে এটা পরিষ্কার যে, ইসলামে ‘মানুষ’ চিহ্নের অর্থ গভীর। সহজ মনে হয়, কিন্তু ধরতে পারা এত সহজ নয়। মানুষকে ‘আল্লার খলিফা’ বলার অর্থ হচ্ছে মানুষ স্রেফ জীবজন্তু নয়; বরং বোঝানো হয়েছে দিব্য-সম্ভাবনা হিশাবে মানুষই পরম রুহানি শক্তির অধিকারী। আর এই রুহানি শক্তির অধিকারীদের হাতেই রাব্বুল আলামিনের অপূর্ব সৃষ্টি বা ‘কুল মখলুকাত’ নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে ‘খলিফা’ শব্দচিহ্নের সংকেত দিয়ে আমাদের যা বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল, তার কিছুই আমাদের কানে এসে পৌঁছায়নি। অতএব আমাদের সবকিছু নতুন করে শুনতে হবে, নতুন করে পড়তে হবে, নতুন করে ভাবতে হবে।

চার

মানুষের মহিমা নিয়ে আমাদের কথা শুরু। মানুষ মুক্ত এবং স্বাধীন—এই উপলব্ধি গভীর রুহানি উপলব্ধি। মানুষকে আল্লার খলিফা ঘোষণা দিয়ে ইসলাম মানুষকে রুহানি স্তরের সম্মান দিয়েছে। আজকাল আমরা কথার কথা হিশাবে এসব বলি। কিন্তু যে মানুষ প্রথমে নিজেকে মুক্ত ও স্বাধীন সত্তা হিশাবে উপলব্ধি করেছিল, সে নিশ্চয়ই এই হঠাৎ অনুভূতিতে শিহরিত হয়েছিল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখবেন, অনেকে ঘরদোর ছেড়ে পাগল, উন্মাদ, মাস্তান, ফকির, দরবেশ হয়ে গিয়েছিল। তাদের কাছে দুনিয়া তুচ্ছ মনে হয়েছে। কারণ, মানুষ যখন আপন মহিমার স্বাদ নিজে একবার টের পেয়ে যায়, তখন আল্লা ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো শক্তি নাই যে, তাকে কোনো বিধিবিধানের নিগড়ে বেঁধে রাখতে পারে। জীব জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে রাস্তায়-অরাস্তায়, পথে-অপথে নানানভাবে নানান নামে, এদের আমরা ইতিহাসে দেখি। অতীতে যেমন, এখনো। মানুষ বিচিত্র।

কিন্তু সমাজ তো ব্যক্তির পাগলামির ওপর চলতে পারে না। ব্যক্তি নিয়েই সমাজ। মানুষই যদি না থাকে তাহলে ‘সমাজ’ কথাটার কোনো অর্থ হয় না। অথচ ব্যক্তি আর সমাজ সমার্থক নয়। সমাজ অনেক ব্যক্তির যোগফলও নয়। তাহলে ব্যক্তি আর সমাজের মধ্যে সম্পর্ক বিচার করার সঠিক পদ্ধতি কী হবে? ‘সমাজ’ কথাটা বুঝব কী করে? এটাও মানবেতিহাসে হাজার বছরের তর্ক। সেই তর্কের নানান দিক আছে। যেমন, একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ব্যক্তি কি সমাজের ঊর্ধ্বে নাকি সমাজের ভেতরে? ব্যক্তির মধ্যে কি সমাজ নাই? সমাজের ভেতর কিংবা বাহির কি বা কোথায়? আর কীভাবে-বা ভেতর-বাহির বিচার করব?

আমরা যে নিরিখ থেকে আলোচনা করছি, সেই দৃষ্টিতে মানুষের মহিমা কথাটা কি স্রেফ ব্যক্তির মহিমা? নাকি সামাজিক ব্যক্তির অভিপ্রকাশ? এর একটাই উত্তর—মানুষ সামাজিক জীব, একমাত্র সামাজিকতার মধ্যেই মানুষের মহিমা রূপ লাভ করতে পারে, আর সমষ্টি বা সমাজের মধ্যে মানবেতিহাসের বিকাশ ঘটে। রবিনসন ক্রুসো হয়ে সমাজবিচ্ছিন্ন দ্বীপে কেউ শয়তান হলো, নাকি মানুষ হলো, তাতে কারও কিচ্ছুই যায় আসে না।

কিন্তু এখন অধিকাংশের কাছে ‘মানুষ মুক্ত এবং স্বাধীন’ জাতীয় বাক্য একদমই ভোঁতা উচ্চারণ। অর্থহীন। কিন্তু আমি নিশ্চিত, নিজেকে মুক্ত এবং স্বাধীন সত্তা হিশাবে উপলব্ধির শিহরণ থেকে কোনো মানুষই বঞ্চিত নয়। কিন্তু অধিকাংশের ক্ষেত্রে এই উপলব্ধি কালেভদ্রে ঘটলেও একটু ঢেউ তুলেই তা আবার মিলিয়ে যায়। নিরানব্বই ভাগ মানুষ সেই উপলব্ধির স্বাদ জীবনের কোনো-না-কোনো মুহূর্তে অনুভব করলেও বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায় এই উপলব্ধিকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু গণ্য করেন না। বরাবরের মতো অনেকে এখনো স্বাধীনতার ভার সহ্য করতে পারেন না। তাঁরা ঘরছাড়া দিশেহারা হয়ে পড়েন।

ধরুন, মানুষ মুক্ত এবং স্বাধীন—এই উপলব্ধি যদি এক বা অল্প কয়েকজন ব্যক্তির না হয়ে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যে অনুভূত হতে শুরু করে, তখন কী হয়? সোজা উত্তর—সমাজ বদলায়। সেই বদল প্রথমে নিজেদের স্বাধীন সত্তা হিশাবে উপলব্ধির সামাজিক চর্চার মধ্যে ফুটে উঠতে শুরু করে। যেমন : শিল্প, সাহিত্য, সংঙ্গীত ইত্যাদি। সমাজের অন্তরের অভিপ্রকাশ কিংবা আন্তরিক (Subjective) দিক মানুষের গভীর নান্দনিক বৃত্তির মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে শুরু করে। অনুভূতি বা উপলব্ধির প্রকাশ সবসময়ই বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। তা ছাড়া বুদ্ধি আমাদের একমাত্র বৃত্তি নয়। তখন উপমা, কল্পনা, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীক ইত্যাদি নানান চিহ্নে উপলব্ধিকে মানুষ যথাসাধ্য ধরার এবং প্রকাশ করার চেষ্টা করে; কিন্তু আন্তরিক দিক ক্রমশ স্পষ্ট, দৃঢ় ও ব্যাপ্ত হলে তা আর আন্তরিক রূপ মাত্র হয়ে থাকে না; বরং মানুষ মুক্ত এবং স্বাধীন তার একটা যৌক্তিক, সর্বজনীন ও নৈর্ব্যক্তিক রূপ তৈরির চেষ্টা চলে। মানুষের অন্য সকল বৃত্তির চেয়ে বুদ্ধি যখন সর্দারি করতে শুরু করে, তখন সামাজিক উপলব্ধির সত্যকে সর্বজনীন এবং যুক্তি পরম্পরায় অনিবার্য প্রমাণের তাগিদ তৈরি হয়। পাশ্চাত্য এর নাম দিয়েছে ‘দর্শন’। এখন আমরা যা ‘দর্শন’ হিশাবে বুঝি, তা অতি সাম্প্রতিক কালে বুদ্ধির সর্দারি কায়েম করবার দোকানদারি। মানুষের অন্য সকল বৃত্তিকে উপেক্ষা করে বুদ্ধির সার্বভৌম আধিপত্য কায়েম সভ্যতাকে বিমানবিকীকরণের দিকে ধাবিত করে। যেখানে প্রেম, ভালবাসা, মহব্বত, সামাজিক সম্পর্কের কোন গুরুত্ব থাকে না। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক মোমের মতো গলে যায়।

যৌক্তিক, সর্বজনীন এবং নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার সাধনা করলেও দর্শনও আদতে আন্তরিক নির্মাণ বা আদর্শ। সমাজ দর্শনেও সন্তুষ্ট হয় না; বরং আপনকার অন্তরের একটা দৃশ্যমান, প্রত্যক্ষ রূপ দেখতে চায়। বুদ্ধি ও যুক্তির শৃঙ্খলা দিয়ে উপলব্ধির সর্বজনীন ও অনিবার্য রূপ সমাজ খাড়া করার চেষ্টা করে। এই তাগিদে প্রণোদিত হয়ে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের একটি শক্তিশালী ধারা আধুনিক রাষ্ট্রকে মানুষের আন্তরিক (Subjective) উপলব্ধির নৈর্ব্যক্তিক (Objective) রাজনৈতিক রূপ হিশাবে দাবি করতে শুরু করে।

মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন, এবং তার নৈর্ব্যক্তিক রূপ হচ্ছে খ্রিস্টিয় পাশ্চাত্যের আধুনিক রাষ্ট্র। অর্থাৎ, ইউরোপে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, তার মধ্যেই মুক্ত ও স্বাধীন মানুষের আবাস ও বিকাশ সম্ভব-- বুদ্ধির বলে বলিয়ান হয়ে মানুষ এই দাবি তুলল। দাবি উঠল, যা যৌক্তিক তা-ই নৈর্ব্যক্তিক, তাই সত্য বা বাস্তব (What is rational is actual, what is actual is rational)। কিন্তু পাশ্চাত্যের আধুনিক রাষ্ট্র কি আদৌ মুক্ত ও স্বাধীন মানুষের নৈর্ব্যক্তিক রূপ হতে পেরেছে? এর একটি মীমাংসা বা জবাব খ্রিস্টিয় ইউরোপের বাইরে থেকে আমাদের দরকার। ইসলাম যদি রাজনৈতিক হয়ে থাকে তাহলে তার জবাব ইসলামকেই দিতে হবে। যে রুহানিয়াতের জমিন থেকে ইসলামের আবির্ভাব তার নৈর্ব্যক্তিক পরিণতি কিংবা গন্তব্য কি আধুনিক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্র? এটাই এ কালের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

ইউরোপ ও ইউরোপের দেখাদেখি আটলান্টিক রোমান আইন, গ্রিক দর্শন, খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্ব দিয়ে মানুষকে যেভাবে বুঝেছে, আধুনিক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। আধুনিক খ্রিস্টিয় পাশ্চাত্য মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতাকে যেভাবে বুঝেছে, আধুনিক রাষ্ট্রের রূপের মধ্যে সেভাবেই ইউরোপ ও আমেরিকা মানুষকে প্রতিষ্ঠা করেছে। নিজেকে তারা যেভাবে বুঝেছে, সেভাবেই তারা নিজেকে আধুনিক রাষ্ট্রের মধ্যে প্রকাশ করেছে। এই বোঝাবুঝির সীমাবদ্ধতা আমরা এখন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। এই রাষ্ট্রে মানুষ আবার নিজের পায়ে নিজেই শৃঙ্খল পরেছে। এই রাষ্ট্র আইন করে মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে। এখন রাষ্ট্রের একমাত্র কাজ হচ্ছে স্বাধীন ও মুক্ত মানুষকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির মধ্যে রাখা যায়, তার জন্য নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করা। এটা এখন স্পষ্ট যে, এই রাষ্ট্র মুক্ত মানুষের নৈর্ব্যক্তিক রূপ হতে পারে না। মানুষ নিজের পায়ে নিজে বেড়ি পরে নিজেই কারাগারে নিজেকে আসামি গণ্য করে বাইরে থেকে তালা মেরে দিচ্ছে।

অন্যদিকে পুঁজি হাজির হয়েছে সার্বভৌম শক্তি হয়ে, মানুষকে পুঁজির গোলামে পরিণত করাই যুগপৎ রাষ্ট্র এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একমাত্র কাজ হয়ে উঠেছে। মানুষের মধ্য দিয়ে যে কর্তাকে আমরা সক্রিয় দেখি, সে স্বাধীন ও মুক্ত মানুষ নয় আর। কর্তা এখন ‘পুঁজি’ স্বয়ং। আমরাই পুঁজিকে সচল রাখছি, পুঁজির বিচলনই বাস্তবায়িত করছি। ফলে রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হয়ে উঠেছে এই প্রক্রিয়াকে সচল ও সজীব রাখা, পুঁজির বিচলন, বিনিময়, বিতরণসহ পুঁজির পুনরুৎপাদন নিশ্চিত করা। তাই কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসম্পন্ন আধুনিক রাষ্ট্র উৎখাত করা ছাড়া মানুষের মহিমা কায়েমের আর কোনো গত্যন্তর নেই।

কিন্তু আজ আমাদের চতুর্দিকে যে ইসলাম আমরা দেখি, তার পক্ষে কি মানুষের মহিমা নিয়ে আদৌ কোনো গভীর চিন্তা করা সম্ভব? পাশ্চাত্যের নজিরের পরিবর্তে কোন ধরনের সমাজ গড়ে তোলা দরকার, তার কোনো স্বপ্ন কি ইসলাম দেখাতে পারে? ইসলাম কি তার কোনো নজির হয়ে উঠতে পারে?

ভাবুন, কিন্তু কীভাবে ভাববেন?

মক্কাবিজয়ের মধ্য দিয়ে যে বীজ তাওহিদের সেনাপতি রাসুলে কারিম সাঃ ঐতিহাসিকভাবে বপন করেছিলেন, সেটা কি রাষ্ট্রকে খোদা বানানোর জন্য? রাষ্ট্রকে সার্বভৌম শক্তি হিশাবে কায়েম করার জন্য? রাষ্ট্রের নিগড়ে মানুষকে ফার্মের মুরগির মতো খাঁচাবন্দি করে মানুষের মহিমা ম্লান করে দেওয়ার জন্য? মানুষকে সার্বভৌম পুঁজির গোলামে পরিণত করাই কি মানুষের কাজ?

আজ আমরা চোখের সামনেই দেখছি পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং কোভিড-১৯ মহামারির মধ্য দিয়ে পুরানা রাষ্ট্র ভেঙে পড়ছে। গড়ে উঠছে বিশ্বপুঁজির সরাসরি হুকুমদারির অধীন ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ ও নজদারির বৈশ্বিক কেন্দ্র। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষমতার এই বৈশ্বিক কেন্দ্রীভবন—এটাও কি তাহলে ইসলামেরও অভীষ্ট? ইসলামও কি বিশ্বক্ষমতা চায়? পুঁজির রূপ ধারণ করতে চায়? বিল গেইটস হতে চায়? বহুজাতিক কোম্পানির সিইও হওয়াই কি মোমিনের কাজ? নাকি তার কাজ ইহলোকে আল্লার খলিফা হওয়া? মুক্ত ও স্বাধীন মানুষের রুহানি বিকাশের সহায়ক হওয়া? আল্লার খলিফা হিশাবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডসহ সকল প্রাণের হেফাজতকারী হওয়া? যেন ভাইরাস নামক কোনো মহামারি আল্লার গজব হিশাবে কোনো দিনই মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারে। নাকি?

খ্রিষ্টান, হিন্দু, ইহুদি বা তথাকথিত ‘কাফের’-দের হটিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রে মুসলিমদের ক্ষমতায় বসিয়ে দিলে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম হয়ে যাবে? নাকি ইসলাম নিয়ে আমাদের নতুন করে আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। ‘মানুষ’ কী – ইসলাম কি তা মনে রেখেছে, নাকি ভুলে গিয়েছে? কেন কোরানুল কারিমে মানুষকে ‘আল্লার খলিফা’ বলা হলো? সেটা তো মুসলিমদের সম্পর্কে বলা হয়নি; সকল মানুষ সম্পর্কেই বলা হয়েছে। কিন্তু শয়তানের ফুসলানিতে মানুষ সব ভুলে গিয়েছে। যে শুধু অন্যের ওপর ক্ষমতা কায়েম করতে চায়, মানুষকে শৃঙ্খলিত করতে চায়, অপরকে দাস বানাতে চায়—সেই মানুষের কথাই কি কোরানুল কারিমে বলা হয়েছে? কোরান কি তাদের কথাই বলেছে, যারা নিজেরাই খোদা বনে যেতে চায়?

আজকাল চতুর্দিকে অনেকের কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, তারা নিজেরাই নিজেদেরকে আল্লা জ্ঞান করেন। তাঁরা এমন ভাবে ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা হাজির করেন তাতে মনে আল্লা স্বয়ং বুঝি কোরান বা হাদিস ব্যাখ্যা করছেন। তাঁরা বলেন, ‘আল্লা অমুক কথা বলেছেন, হাদিসে অমুক কথা আছে, ইত্যাদি। কোরান হাদিস উদ্ধৃত করা এক কথা কিন্তু এর যে তাফসির তাঁরা করেন সেটা তাঁদেরই ব্যাখ্যা। আল্লার নয়। অবশ্যই আমরা আলেম ওলেমা বা জ্ঞানী ব্যক্তিদের ব্যখ্যা শুনি এবং শুনব। যারা ইসলামের দীর্ঘ তর্কবিতর্কের ঐতিহ্যের ধারা অনুসরণ করে কথা বলেন তাঁদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আমাদের জন্য আমানত, তাঁরা আমাদের সম্পদ। কিন্তু যাঁরা ফতোয়া দিয়ে থাকেন যে তাঁর কথাই আমাদের নির্বিচারে মানতে হবে, কারণ তার ব্যাখ্যা স্বয়ং আল্লাই নাকি করছেন, অতএব সেই ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত সত্য হিসবে আমাদের মানতে হবে। ইসলাম এরকম কোন অথরিটি বা ক্ষমতা কাউকে দেয় নাই।

কোরানের ব্যাখ্যা বা তাফসির জীবন্ত মানুষই করে, কোরান নিজের ব্যাখ্যা নিজে করে না। কোরানের বাক্যকে আমরা ‘আয়াত’ বা চিহ্ন বলি। অর্থাৎ যার অর্থ জীবন্ত মানুষকে তার জীবন্ত বাস্তবতা এবং ইতিহাসের মধ্যে বসেই – ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতেই পাঠ ও অর্থোদ্ধার করতে হয়। তাই যুগে যুগে দেশকালপাত্র ভেদে অবস্থা ও বাস্তবতা অনুযায়ী জ্ঞানী ব্যক্তিদের ব্যাখ্যার মধ্যে আমরা ফারাক বা পার্থক্য দেখি। কিন্তু তাঁরা কোরানের কাছে হেদায়েতের জন্য গিয়েছেন আল্লার তরফ থেকে চিরকাল হাজির শ্বাশ্বত ‘আয়াত’ বা চিহ্ন হিশাবে পাঠ করেছেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের সময়কালের প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের স্তর অনুযায়ী ব্যাখ্যা করেন বা করছেন। তাঁদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাঁদের ব্যাখ্যাই কোরানের ব্যাখ্যা হবে এমন কোন কথা নাই। কিন্তু তাঁদের ব্যাখ্যা ‘আল্লা বলেছেন’ বলে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় এবং যেভাবে সত্যের দাবি নিয়ে একেকেজন সমাজে খাড়া হয়ে থাকেন ইসলামের দৃষ্টিতে সেটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না কার্যত তাঁরা আল্লার আসনে বসে আছেন এই ভাব করেন। এমনকি তাদের অনেকে যে আসনে বসে ফতোয়া দিয়ে থাকেন, সেটা নমরুদের সিংহাসনের মতোই। সেই আসনে বসে ফতোয়া দানকারী ঠিক করে দিচ্ছেন কে বেহেশতে যাবে, আর কার কপালে জাহান্নাম খচিত রয়েছে। এদের হাত থেকে আল্লা যেন আমাদের রক্ষা করেন!

মক্কাবিজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের যে রুহানি সফরের শুরু, সেই কাফেলার গন্তব্য বহুদূর। মানুষের মহিমা কায়েম করাই সেই সেনাপতি মুহাম্মাদ সাঃ-এর সেনাবাহিনীর রুহানি সংকল্প। রুহানি রাজনীতি। জিহাদ। এটা থেমে যাবে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই।

যে বুঝেছে সে বুঝে গিয়েছে, যে বোঝেনি তার কানে সিসা এবং বুকে মোহর মারা হয়েছে। তারা খেঁকি কুকুরের মতো রাস্তার পাশে চিৎকার করুক। এগিয়ে যাক কাফেলা।

পাঁচ

মক্কাবিজয় নিয়ে লিখছি। মক্কাবিজয়ের লক্ষ্যে রাসুল সাঃ বেরিয়েছিলেন ১০ রমজান। রাসুলুল্লাহ এবং তাঁর সেনাবাহিনী পুরো দিনই রোজা রাখেন। আর কুদায়েদে পৌঁছে তাঁরা ইফতার করেন। দেখা যাচ্ছে জালেমদের বিরুদ্ধে লড়াই রমজানের রোজা, পরহেজগারি ও ইবাদত-বন্দেগি থেকে আলাদা কিছু নয়। তুলনা করুন, আমরা রমজানকে এখন কী বানিয়েছি!

মক্কা বিজয়ের দিন জোহরের নামাজের পর তিনি কাবার সামনে দাঁড়ালেন। হাতে একটি লাঠি। তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘সত্য হাজির, মিথ্যা পলাতক আর মিথ্যাকে অবশ্যই এভাবেই পালাতে হয়।’ [সুরা বনি ইসরাইল : ৮১]। কিন্তু সত্য নিজ গুণে হাজির হয়নি; মিথ্যার বিরুদ্ধে দ্বীনের সেনাপতিকে সশস্ত্র লড়তে হয়েছে, আল্লা রাব্বুল আলামিন তাঁর সহায় ছিলেন।

কী ছিল মক্কার সেই সত্য? মানুষে মানুষে, রক্তে রক্তে, গোত্রে গোত্রে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, জাতিতে জাতিতে কোনো ভেদ নেই। সবাই মানুষ; কিন্তু রক্তের ভিত্তিতে তারা নিজেদের বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছে। মানুষের সমাজ গঠন না করে তারা ঝগড়া, হানাহানি ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে মানুষের অস্তিত্বই বিপন্ন করে তুলেছে। নিজ নিজ রক্ত, বর্ণ, গোষ্ঠী, গোত্র, জাতির জন্য আলাদা আলাদা মূর্তি বানিয়ে সেই মূর্তিকেই তারা খোদা বানিয়েছে, সেই খোদারই তারা পূজা করে। নিজেদের গড়া নানান প্রকার মূর্তিকে আল্লার অংশীদার বানিয়েছে তারা।

শিরক মানুষের রুহানি মহিমার বিনাশ ত্বরান্বিত করে। নিজের মহিমা ভুলে গিয়ে মানুষ নিজেকেই নিজে ভূলুন্ঠিত করে। নিজ নিজ গোত্র বা গোষ্ঠীর মূর্তি বানায়। পরস্পরের মধ্যে ফ্যাসাদ, যুদ্ধবিগ্রহ ও হানাহানিতে নিজেদের বিনাশ নিজেরাই ত্বরান্বিত করে।

এটাই ছিল তখনকার রক্তবাদী, গোত্রবাদী ও গোষ্ঠীবাদী আরবদের অবস্থা। রাসুল সাঃ বললেন, মানুষে মানুষে এই বিভক্তি ও বিভাজন চলবে না। মানুষের জাতি একটাই, তার নাম ‘মানুষ’। মানুষের মধ্যে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য থাকবে, কারণ মানুষের মহিমা নানাভাবে প্রকাশের জন্যই এই ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য দরকার। তাদের প্রতিপালক তাই সবাইকে একরকম তৈরি করেননি। কিন্তু রক্ত, গোষ্ঠী, গোত্র, বর্ণ, জাতি বা সম্প্রদায়ে মানুষ বিভক্ত থাকতে পারে না। কারণ, সত্য এসেছে, মিথ্যা পালিয়েছে; আর মিথ্যাকে এভাবেই পালাতে হবে।

পৌত্তলিকতা স্রেফ বাইরের মূর্তি বানিয়ে পূজা নয়, অন্তরের পুতুল বানানোও বটে। তখন সেই পুতুলও বাইরের মূর্তির মতো মানুষে মানুষে ভেদ ও বিভাজনের কারণ হয়ে ওঠে। যুদ্ধ-বিগ্রহে মানুষের বিনাশ ত্বরান্বিত করে। এই বিভেদ ও বিভাজন মূর্তিপূ্জার চেয়েও ভয়ানক। বাইরের পুতুল ভাঙা যায়, কিন্তু মনের মূর্তি ভাঙা দুঃসাধ্য। এখন যেমন যার যার মনের মূর্তি অনুযায়ী মানুষ সম্প্রদায়, জাতি, দেশ, ভূখণ্ড ইত্যাদিতে বিভক্ত, তেমনি নিজ নিজ মতাদর্শের পূজাতেও পরস্পরের সঙ্গে মানুষ যুদ্ধে লিপ্ত, হানাহানিতে রত, রক্তপাতে ভেজা। পুতুল বাহ্য জগতে মাটি, পাথর, লোহা, ব্রোঞ্জ বা অন্য যেকোনো কিছু দিয়েই বানানো যায়; কিন্তু কল্পনার, বাসনার, বুদ্ধির বা স্বপ্নের মূর্তি যখন-তখন বানানো যায়, সেসব মূর্তিও হয় হাজার হাজার। লক্ষ লক্ষ। মানুষ যদি চোখে দেখার মূর্ত পুতুল বানাতে পারে, তাহলে অদেখা কোটি কোটি মূর্তিও বানাতে সক্ষম। তারপর পরস্পরের বিরুদ্ধে নিজ নিজ পুতুলের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ভাগ হয়ে যেতে পারে মানুষ। বিভক্ত মনুষ্যসমাজ তখন তাদের নিজ নিজ মূর্তিকে বলে ‘বিশ্বাস’। দাবি করে তার মূর্তিই সত্য, অন্যের মূর্তি মিথ্যা।

অথচ যিনি মূর্তি নন, নিরন্তর গায়েব বা অনুপস্থিত, তার প্রতি ঈমান বা নিঃশর্তে আশ্রয় প্রার্থনার কথা তারা ভুলে যায়। নিজেদের তৈরি মূর্তি রক্ষার জন্য তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। মূর্তিতে ‘বিশ্বাস’ আমাদের কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে যে, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন চিন্তা বা মতাদর্শের মানুষকে আমরা আর মানুষ বলে গণ্যই করি না। মুসলমান নিজেদের সম্পর্কে যে মানসিক ও কাল্পনিক মূর্তি বানিয়েছে, তার ফলে তারা নিজেদের মধ্যেই হানাহানিতে ব্যস্ত। নিজেদেরই তারা দিন দিন ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা ভুলে গিয়েছে যিনি নিরন্তর গায়েন , যিনি সর্বত্র বিরাজ করেন, তাঁর বাহ্যিক মূর্তি যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি কল্পনার, বাসনার, আকাঙ্ক্ষার কিংবা বুদ্ধি দ্বারা মূর্তি তৈরিও নিষিদ্ধ, মানুষ বুদ্ধির মূর্তিরও দাস হয়ে পড়ে। ধর্মীয় ও মতাদর্শিক অন্ধতা মানুষের সর্বনাশ ঘটায়। ভেতরে বাইরে তিনি সর্বত্রই গায়েব ; অথচ তিনি আছেন বলেই আমরা সকলেই আছি। যিনি গায়েব , তাঁর কোনো মূর্তি হয় না।

ইসলামে ‘গায়িবের ওপর ঈমান’ কথা হিশাবে যেমন কঠিন, ধারণা হিশাবেও গভীর। রুহানিয়াতের ভিত্তি এখানে। যিনি গায়িব, অথচ সবসময়ই আছেন, তাঁর সালাত কায়েম করাও সোজা ব্যাপার না। খুব সোজা ধারণাও নয়।

মানুষকে অন্তর-বাহির সকল প্রকার মূর্তি ও পৌত্তলিকতা থেকে নিরন্তর মুক্ত ও স্বাধীন রাখার জন্যই নিঃশর্তে গায়েবে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দিয়েছে ইসলাম। মানবেতিহাসে এটি এক বিশাল বৈপ্লবিক ঘটনা। মানুষ যেন কখনো নিজের পায়ে নিজে নিজেকে শেকল না পরায়, নিজের স্বাধীনতা ও মুক্তির মহিমা বুঝতে পারে, তার জন্যই ইসলাম পৌত্তলিকতাবিরোধী। নিজে পৌত্তলিক থেকে পৌত্তলিকতাকে ‘কুফর’ বলার তামাশা ইসলামে নেই। সেই হুঁশও অনেকের নেই। এ জন্য নিজেকে আগে কুফরি থেকে মুক্ত করতে হবে।

ছয়

মানুষকে স্বাধীন ও মুক্ত রাখাই ইসলামের রাজনীতি। মানুষের এই রুহানি সফর রুদ্ধ করা অসম্ভব। মুক্ত ও স্বাধীন মানুষের ধারণাকে ইসলাম রুহানিয়াতের অতি উঁচু স্তরে নিয়ে গিয়েছে। ভোগবাদী সমাজে কামনা-বাসনার মূর্তি ভাঙা খুবই দুঃসাধ্য। এই সমাজে মানুষ নিজেই নিজের কামনা-বাসনার দাসে পরিণত হয়। বিশেষত পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায়। তাই পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই পর্বে মক্কাবিজয়ের তাৎপর্য নিয়ে নতুন করে ভাবনার সময় হয়েছে। কোনো রক্ত গোষ্ঠী, গোত্র, বর্ণ, জাতি বা সম্প্রদায়ে মানুষ বিভক্ত থাকতে পারে না। ঘোষণা হলো, ‘সত্য হাজির, মিথ্যা পালিয়েছে, মিথ্যাকে এভাবেই পলায়ন করতে হয়’।

কিন্তু পৌত্তলিকতা বিরোধিতার রাজনৈতিক মর্ম কি আমরা মনে রেখেছি? বুঝেছি? ইসলাম কি নিজেকে সকল মানুষের দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা হিশাবে হাজির করার সামর্থ্য অর্জন করতে পেরেছে? আমরা কি আদৌ চিন্তা করতে সক্ষম? আমরা ইতিহাস পাঠ করি? ইতিহাস বুঝি?

সেই সময়ের কাবার পরিস্থিতি বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিরই আদি প্রতিরূপ মাত্র। কাবায় তখন মজুদ ছিল ৩৬০টি মূর্তি। রাসুল সাঃ হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়ালেন। একেকটি মূর্তির দিকে তাঁর লাঠি তাক করে ধাক্কা দিলেন, মূর্তিগুলো পেছনে হেলে পড়ল। রুহানিয়াতের পথ হচ্ছে মানুষের ভেতর-বাহিরের মূর্তিকে এভাবেই হেলিয়ে দেওয়া, অপাসারণ করা।

মক্কার দরজায় দাঁড়িয়ে রাসুল সাঃ বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লার কোনো শরিক নেই।’ আল্লা তাঁর খাদিমকে সাহায্য করেছেন। তিনি কেবল দুষ্কর্মে সহযোগীদের পলায়নে বাধ্য করেছেন। মক্কার উপাসনালয়ের হেফাজত এবং হাজিদের পানি পান করানো ছাড়া অন্য সব সুবিধা, রক্ত অথবা সম্পত্তি মালিকানার দাবি আমি বিলোপ করলাম।

অর্থাৎ, রাসুল সাঃ সর্বপ্রকার রক্ত ও আভিজাত্যের দাবি বিলোপ করেই ক্ষান্ত হননি, সম্পত্তি মালিকানার দাবিও বিলোপ করেছেন। আল্লার সৃষ্ট দুনিয়ায় মানুষসহ প্রতিটি জীব বা প্রাণের জৈবিক ও আত্মিক চাহিদা মেটানোর ‘হক’ বা অধিকার আছে। মানুষ তার রুহানি সত্তার বিকাশের জন্য আল্লার সৃষ্টির বরকত আস্বাদনের অধিকার রাখে। কিন্তু আল্লা কোনো মানুষকে জমি বা ধনসম্পত্তি রেজিস্ট্রি করে দুনিয়ায় পাঠাননি। রাসুল ও খুলাফায়ে রাশিদিনের জীবনযাপন থেকে এই বিষয়ে আমরা অনায়াসে শিক্ষা লাভ করতে পারি। মক্কায় গোত্রে গোত্রে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে হত্যা, হানাহানি বন্ধ করতে রাসুল সাঃ রক্তপণ কঠোর করলেন। বললেন, হে কোরাইশ, আল্লা তোমাদের মধ্য থেকে পৌত্তলিকবাদের ঔদ্ধত্য এবং পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা তুলে নিয়েছেন। মানবজাতি আদম থেকে আসা এবং আদম মাটি থেকে। অতএব, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ থাকতে পারে না। এরপর তিনি কোরানুল কারিম থেকে পাঠ করলেন,

‘হে মানুষ, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যেন তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো’। অর্থাৎ, রক্তবাদ, গোত্রবাদ বা গোষ্ঠীবাদের বিলুপ্তি ঘোষণা দিয়েও মানুষকে বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতার নিরাকরণ ঘটানোর কথা বলেননি; বরং বৈচিত্র্য এবং ভিন্নতার মধ্য দিয়েই মানুষ ‘এক’-কে উপলব্ধি করুক, ‘এক’-এর সাক্ষী হোক—আল্লার রাসুল সেটাই বলেছেন।

এরপর তিনি বললেন, ‘হে কোরাইশ, তোমাদের নিয়ে আমি এখন কী করব বলে তোমাদের মনে হয়’? তারা জবাব দিলো, ‘ভালো, আপনি একজন সদাশয় ভ্রাতা, এক সদাশয় ভ্রাতার পুত্র’। তাঁর উত্তর ছিল অসীম ক্ষমার; তিনি বললেন, ‘তোমরা যার যার কাজে যাও, কারণ তোমরা এখন মুক্ত’। যে কোরাইশরা তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা কবার হেন কোনো ষড়যন্ত্র নেই করেনি, যারা তাঁকে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য করেছে, তিনি তাদের ক্ষমা করে দিলেন।

মানুষের মহিমা ঘোষণা এবং মহিমা কায়েমের আলোকে মক্কাবিজয়ের ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পর্কে ইঙ্গিত দিতে আমরা ইতিহাস থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছে মাত্র। বলা বাহুল্য, এই মহিমা স্রেফ রোমান্টিক কল্পনা বা ধারণা নয়। এর রাজনৈতিক মর্ম সুদূরপ্রসারী। আমরা তিনটি পয়েন্ট উল্লেখ করে আপাতত আলোচনা শেষ করব।

১. কোনো বিশেষ সুবিধা ভোগের অধিকার কারও নেই। সম্পদের ব্যবহার কিংবা সম্পদ অর্জন নিষিদ্ধ নয়; কিন্তু বিশেষ সুবিধা ভোগের হাতিয়ারে পরিণত করার জন্য সম্পদ বা সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা নিষিদ্ধ। অর্থাৎ, বিশেষ সুবিধা ক্ষমতার দ্বারা হোক, কিংবা হোক আইনি হাতিয়ার দিয়ে সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েম করা—ইসলাম সহ্য করে না। কিন্তু সুস্থ-সবল ও রুহানি জীবনযাপনের জন্য ভোগের অধিকার ইসলাম অস্বীকার করে না, অস্বীকারের প্রশ্নই আসে না। জীবনযাপনকে আরও উন্নত ও আনন্দময় করার চেষ্টা মানুষের থাকবেই; কিন্তু সফলতার ফল ব্যক্তিগত মালিকানার নামে অল্পকিছু ব্যক্তির কুক্ষিগত হবে, এটা ইসলামের নীতি হতে পারে না। তাই সকলের উপকার নিশ্চিত করার জন্য জমি, পুঁজি, জ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির ওপর আইনি মালিকানার অধিকার ইসলাম যে মানে না, তা মক্কাবিজয়ের মধ্য দিয়েই ঘোষিত হয়ে রয়েছে।

যা কিছু সৃষ্টি সবই আল্লার, তাঁর কোনো শরিক নেই। মালিকানা দাবির তর্ক শিরকির সঙ্গে যুক্ত। শিরক ইসলামে গর্হিত অপরাধ। মক্কায় মানুষের অধিকার কায়েমের জন্য রাসুলে কারিম সাঃ লড়েছেন। কিন্তু আইন করে সম্পত্তির মালিকানা-ব্যবস্থা কায়েম করা বিলুপ্ত করেছেন। ভোগের অধিকার আছে; কিন্তু আল্লার সৃষ্টির ওপর ব্যক্তির মালিকানা আইন করে প্রতিষ্ঠা আল্লার সঙ্গে শিরকি। দুনিয়ার ‘মালিক’ একজন, তাঁর কোনো জমি বা সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করার অধিকার নেই। তাঁর সৃষ্টির ওপর সকল মানুষের অধিকার সমান। সেই অধিকার সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার নামে বঞ্চিত করা যাবে না। তাই মক্কায় অভিজাত কোরাইশদের বিশেষ সুযোগ বিলোপের ঘোষণার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। অভিজাত ও ধনিক শ্রেণির বিশেষ সুবিধা বিলোপ করা হয়েছে। সম্পত্তি মালিকানা ব্যবস্থার বিলোপ ঘটানো হয়েছে, মানুষ যেন নিজের রুহানি শক্তির স্বাদ উপলব্ধি করে। এই অল্পদিনের দুনিয়ায় মানুষ কোনোকিছুরই মালিকানা দাবি করতে পারে না। কারণ, মৃত্যু সেই মালিকানাকে তামাশায় পর্যবসিত করে। আল্লার রাহে সব উৎসর্গ করে দেওয়া অর্থেও মানুষ রুহানিয়াত উপলব্ধি করতে সক্ষম। ত্যাগের চেয়ে মহৎ আনন্দ মানুষের আর কিছুই হতে পারে না।

২. ইসলামে কোনো রক্তবাদ, গোত্রবাদ, গোষ্ঠীবাদ, জাতি, বর্ণ, ভেদাভেদ নেই। একই যুক্তিতে কোনো জাতীয়তাবাদ, ভূখণ্ডবাদ, ভাষাবাদ, সংস্কৃতিবাদ ইত্যাদিও নেই। কিন্তু ভাষা, সংস্কৃতি ও এলাকাভেদে নানান প্রকার জীবনযাপন—ইত্যাদির ভিন্নতা বা বৈচিত্র্য আছে, যেন আমরা পরস্পরকে জানতে পারি, পরস্পরের সঙ্গে কথোকথনে নিষ্ঠ হতে পারি। ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্নতা এবং বৈচিত্র্য দ্বারাই আমরা পরস্পরকে চিনি, জানি, ভালবাসি, সম্পর্ক গড়ে তুলি; কিন্তু মনুষ্যসমাজে কোনো ‘অপর’ নেই। পরস্পরে ভেদ নেই–সকলেই বাপের ঔরসে মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছে।

৩. অতএব, ইসলামে রুহানি রাজনৈতিক কর্মসূচি হচ্ছে সকল মানুষকে এক করা। ঐক্যের পথের সকল বৈষয়িক বা আত্মিক বাধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। আল্লা যে রুহানি গুণসম্পন্ন মানুষকে তাঁর খলিফা ঘোষণা করেছেন, সেই রুহানি মহিমাকে জয়ী করা এবং রুহানিয়াতকে অন্তরের আলো হিশাবে শুধু নয়, বাইরে নৈর্ব্যক্তিক সত্য হিশাবে কায়েম করা। এসবই মানুষের আত্মিক ও রাজনৈতিক পরমার্থ। অতএব সত্য হাজির, মিথ্যা পলায়ন করতে বাধ্য। আর এভাবেই, মিথ্যা পলায়ন করে।

সাত

‘কালো মানুষদের জীবনও জীবন’ (Black Lives Matter)। আমি একটি ঐতিহাসিক ছবি মনের মধ্যে আঁকার চেষ্টা করছি। রাসুলে কারিম সাঃ মক্কাবিজয়ের অভিযানে। তিনি সবার আগে উটে করে যাচ্ছেন। কিন্তু রাসুলের সঙ্গে একই উটে কাকে বসা দেখছি? একজন কৃষ্ণ মানুষ। কালো মানুষ। কেন? ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। না, ইসলাম অন্তঃসারশূন্য ঘোষণায় কিংবা স্লোগানে সন্তুষ্ট নয়। মক্কাবিজয়ে রাসুলে কারিমের সঙ্গে একই উটে চড়ে কালো মানুষ মক্কা জয় করেছে। বিজয়ের পর রাসুলের সঙ্গে দুজন কালো মানুষ কাবায় প্রথম প্রবেশ করে। কোরাইশের কোনো অভিজাত নয়। ইয়েস, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। আমাদের জগত জয় করতে হবে।

রাসুলে কারিম সাঃ-এর মক্কাবিজয়ের বহু বছর পর যখন ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার স্লোগান প্রথম কানে এসেছিল, তখন মনে মনে বলেছিলাম, وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا [সুরা বনি ইসরাইল: ৮১] নিজেকে বার বার বলেছি, ‘“সত্য” হাজির, “বাতিল” পালিয়েছে, যা “বাতিল”, তাকে অবশ্যই এভাবে পালাতে হয়।’

আয়াতে ‘আল হাক’ বা অর্থাৎ, যিনি একমাত্র সত্য, ‘এক’, যিনি একই সঙ্গে বিশেষ এবং সামান্য, তিনি স্বয়ং হাজির। ‘হক’ এসেছে, অর্থাৎ আল্লা স্বয়ং হাজির, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উপলব্ধি হিশাবে মানুষের মধ্যে তিনি উপস্থিত। মানুষের রুহানি আত্মবিশ্বাস ও জালেমের বিরুদ্ধে সংগ্রামের রূপ নিয়ে তিনি স্বয়ং প্রমাণ করছেন তিনি আছেন। তিনি কোনো রক্ত, বর্ণ, আভিজাত্য, শ্রেণি কিংবা নারী-পুরুষ ভেদ মানেন না। বিভিন্নতা এবং বৈচিত্র্য তাঁর কুদরত, তাঁর আনন্দ, তাঁর সৃষ্টিশীলতা। কিন্তু বিশেষ কোনো প্রাকৃতিক ভিন্নতাকে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক ‘সুবিধা’ তিনি কখনোই দেন না। বরদাশত করেন না। রক্ত, বর্ণ বা লিঙ্গের জন্য কাউকে বিশেষ ক্ষমতা দেননি, ক্ষমতা জাহির বা প্রয়োগ করার অধিকারও দেননি।

অতএব, কালোমানুষদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের হাজার হাজার বছরের নৃশংস-পীড়নের বিরুদ্ধে জিহাদ ন্যায়সঙ্গত। বর্ণবাদী সমাজ, রাষ্ট্র, চিন্তা, সংস্কৃতি ইত্যাদির বিনাশ ও বিলুপ্তির সময় হাজির হয়েছে। সত্য হাজির, মিথ্যা এখন পালাতে বাধ্য। আমাদের রুহানি উপলব্ধি আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে তিনি আছেন। আমাদের মধ্যেই। আমাদের আমল, আমাদের সক্রিয়তা, আমাদের জিহাদ, আমাদের রুহানি প্রজ্ঞার মধ্য দিয়েই তাঁর প্রকাশ ঘটছে। এভাবেই ঘটে। তাই ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার—কালো মানুষদের জীবনও জীবন, আল্লা কৃষ্ণাঙ্গদেরও স্রষ্টা—এটা আবার চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানোর সময় হয়েছে। যা কিছু ‘বাতিল’, যা কিছু এতদিন আমাদের ‘দৃষ্টি আচ্ছন্ন’ করে রেখেছিল, যা কিছু আমাদের ‘সাদা-কালো’ বিভাজন ঘটিয়েছিল, আমাদের ‘অন্ধ’ করে রেখেছিল, আজ সেই অন্ধকার কাটতে বাধ্য। দিব্য নুরে জগত আবার উদ্ভাসিত হোক।

‘ব্লাক লাইভ ম্যাটার’স’ স্লোগানটি দেওয়া শুরু হয়েছিল ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে ট্রেইভন মার্টিনকে গুলি করে হত্যার দায় থেকে জর্জ জিমারম্যানকে খালাস দেওয়ার প্রতিবাদে। হ্যাশট্যাগ দিয়ে ডিজিটাল জগতে হাজির হয় #Black_Lives_Matter স্লোগান। বোঝার সুবিধার জন্য একে বাংলায় আপনি নানানভাবে অনুবাদ করতে পারেন। যেমন : বলতে পারেন কালো মানুষদের জীবনকেও হিশাবে গুণতে হবে। তাদের বাদ দিলে হবে না। তারাও ইতিহাস। যিনি সাদা, কালো, শ্যামল, হলুদ, নাক বোঁচা, নাক লম্বা, বেঁটে দীর্ঘ ইত্যাদি নানান ধরনের মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তিনি মহান কারিগর। যিনি স্রষ্টা, তিনি বৈচিত্র্যেরও স্রষ্টা। এমন এক ‘বিশ্ব বাগান’ আমাদের জন্য তিনি তৈরি করেছেন, যেন সেই বাগানে আমরা পরস্পরকে জানি, বুঝি, সম্পর্ক পাতাই এবং তাঁর গুণ গাইতে পারি। বৈচিত্র্য আছে বলেই ‘এক’-এর উপলব্ধি সম্ভব। নইলে তিনি একটি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কারখানা বানাতেন, আর আমরা সব একই রকম একই মাপের একই সুরত নিয়ে সারি সারি একই সিলছাপ্পড় মারা হয়ে বের হয়ে আসতাম।

কৃষ্ণাঙ্গ ট্রেইভন ১৭ বছরের কিশোর। হাঁটছিল রাস্তায়, তাকে জর্জ জিমারম্যান গুলি করে। জিমারম্যান দাবি করে, সে আত্মরক্ষার জন্য গুলি করেছে, ফলে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। পরে বিক্ষোভের মুখে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, কিন্তু বিচারে জুরি তাকে খালাস দেয়। ফুঁসে ওঠে মানুষ, স্লোগান তৈরি হয় ‘কৃষ্ণাঙ্গের জীবনও জীবন’—ব্লাক লাইভস ম্যাটার। পুলিশের হাতে এভাবে গুলি খেয়ে মরেছে বহু কালো মানুষ।

২৫ মে যখন জর্জ ফ্লয়েডকে গলার ওপর হাঁটু দিয়ে প্রায় নয় মিনিট চেপে ধরে পুলিশ ডেরেক শেভিন শ্বাস বন্ধ করে মারল। হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে শ্বাস বন্ধ করে মারার ভিডিও যখন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে গেল—মার্কিন জনগণ ফুঁসে উঠল। জর্জ ফ্লয়েরডকে হ্যান্ডকাফ পরা পেছন মোড়া অবস্থায় রাস্তায় উপুড় করে শোয়ানো। পুলিশের হাঁটুর চাপে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ার আগে জর্জ বার বারই বলেছিল, ‘আই কান্ট ব্রিথ’, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

যে ব্যবস্থার মধ্যে আমরা এখন বাস করছি, আমরাও দুনিয়ার কোথাও নিশ্বাস নিতে পারছি না। আমাদের গলার ওপর হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে আছে আইন-শৃঙ্খলার হিংস্রতা, মাটিতে ফেলে মারছে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রব্যবস্থা। তাই আমরাও ‘নিশ্বাস নিতে পারছি না’। মৃত্যুর আগে কালোমানুষ জর্জের সকাতর আর্তিও সারা দুনিয়ার সকল মজলুমের অসহনীয় অবস্থার আর্তনাদ হয়ে উঠেছে।

একইভাবে হয়তো কোভিড-১৯ যেভাবে আমাদের ফুসফুস চেপে ধরে মারছে, তার কারণেও আমরা ‘নিশ্বাস নিতে পারছি না’। এই অবস্থার অবসান হতে হবে। জর্জ ফ্লয়েডের ‘কালো মানুষের জীবনও জীবন’—এই কথাটা শুধু মানবাধিকারের ভাষ্য হিশাবে নয়, ‘জীবন’ নামক ধারণার মধ্যে আমরা কাকে অন্তর্ভুক্ত করি আর কাকে বাদ দিই—সেই প্রশ্নটিই আবার নতুন করে আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছে। যাদের আমরা ‘মানুষ’ বলে গণ্য করি না, তাদের জীবনও জীবন। তারাও মানুষ। ‘মানুষের মহিমা’ কথাটাকে আমাদের নতুন করে আবিষ্কার করতে হচ্ছে।

আট

ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন গড়ে তোলার পেছনে তিনজন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার। তাদের বয়েস চল্লিশেরও কম। এলিসিয়া গার্জিয়া (Alicia Garza), পাত্রিসে কালরস (Patrisse Cullors) এবং ওপাল তোমেতি (Opal Tometi)। নামগুলো দিচ্ছি, কারণ আশা করব বাংলাদেশের তরুণরা এদের সম্পর্কে জানার জন্য আরও আগ্রহী হবেন। কিন্তু ইসলাম এবং মক্কাবিজয়ের সঙ্গে এর সম্পর্ক কি? সম্পর্ক একদমই গোড়ার জায়গায়। ইসলাম গড়ে উঠেছে কালো মানুষদের জন্য, মুহাম্মাদ সাঃ-কে আল্লার রাসুল হিশাবে আরবে যারা শুরুতে মেনে নিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন দাস-দাসী। প্রথম ৪০ জনের মধ্যে ৩০ জনের বেশি ছিলেন তাঁরাই, কৃষ্ণাঙ্গ। মুহাম্মাদ সাঃ আমিনা বিনতু ওয়াহাবের গর্ভে আসার আগে তাঁকে সন্তানস্নেহে সর্বপ্রকার স্নেহমমতা দিয়ে গড়ে তোলার জন্য যাঁকে আল্লা দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন, আবদুল্লাহ যাঁকে মক্কার ক্রীতদাসদের বাজার থেকে আমিনার দেখাশোনার জন্য কিনে এনেছিলেন, তিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ।

বিয়ের দুই সপ্তাহ পর আবদুল্লাহর বাবা আবদুল মুত্তালিব তাঁকে সিরিয়ার সওদাগরি কাফেলায় পাঠালেন। নববধূকে সেই বিরহ-কাতর প্রতিটি মূহূর্তে সঙ্গ দিয়েছিলেন আর কেউ নয় এই কৃষ্ণাঙ্গ রমণী। রাসুলের জননী আমিনা বিনতু ওয়াহাব যখন গর্ভবতী হয়েছিলেন, সে আল্লার সেই সুসংবাদ যিনি প্রথম পেয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন উম্মে আইমান বারাকা। রাসুলের আবির্ভাবের ব্যাপারে যিনি নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন, তিনিই কৃষ্ণাঙ্গ উম্মে আইমান বারাকা। আমিনা গর্ভবতী হয়েছেন, সেটাও আমিনাকে তিনিই নিশ্চিত করেন। তিনি সেই নারী, যিনি অসুস্থ আমিনাকে আদর-যত্নে সুস্থ রাখতে কোনো প্রকার কার্পণ্য করেননি।

সওদাগরি কাফেলা ফিরে আসতে শুরু করল মক্কায়। যিনি গোপনে খোঁজ নিতেন আবদুল্লাহ ফিরেছেন কি না, তিনিও এই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। আবদুল্লাহর মৃত্যুর খবর পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে যিনি ঘরে ফেরেন তিনিও এই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। আমিনা স্তব্ধ হয়ে যান। কিন্তু যাঁর শুশ্রূষায় তিনি নিরাপদে আল্লার রাসুলকে জন্ম দিতে পেরেছিলেন, তিনি এই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। শিশু মুহাম্মাদের জন্মের পর নবজাতককে দুহাতে তুলে আমিনা বিনতু ওয়াহাবের পাশে যিনি রাখেন, তিনি য়ার কেউ নন তিনি এই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। শুধু কি তাই?

অভিজাত গোত্রবাদী কোরাইশরা সন্তানকে দুধ খেয়ে বড় করতে ধাত্রী হিশাবে মক্কার বাইরে মরুবাসী বেদুইন মায়েদের কাছে লালনপালনের জন্য দিত। মুহাম্মাদও হালিমার দুধ খেয়েছেন। গোত্রবাদী কোরাইশরা যে ইতিহাস লেখে, সেটা গোত্রবাদী ও বর্ণবাদীদের ইতিহাস; এর ফলে আমরা ইসলামের ইতিহাস হিশাবে হালিমার কথা যতোটা জানি, কিন্তু বারাকার কথা ততোটা জানি না। কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস থেকে জ্ঞানে বা অজ্ঞানে বাদ যায়। যেহেতু আমরা এখনো প্রধানত গোত্রবাদী আরবদের ইতিহাসকেই ইসলামের ইতিহাস হিশাবে পড়ি, তাই সেই ইতিহাসের বাইরে আর কোনো খবর নিই না। গোত্রবাদী কোরাইশদের ইতিহাসের বিপরীতে রক্ত ও বংশবাদী ইতিহাসের ধারাও আল্লার রাসুলের বেড়ে ওঠার ইতিহাস সম্পর্কে ভিন্ন কিছু শেখায় না। একটি এতিম শিশু কৃষাঙ্গ দাসীর কোলে পিঠে মানুষ হওয়ার তাৎপর্য অপরিসীম। আমরা হালিমার নাম জানি; কিন্তু ইয়াতিম মুহাম্মাদকে যিনি তাঁর জন্মের আগে থেকেই মৃত্যু অবধি লালনপালন করেছেন, তাঁর নাম জানি না।

মুহাম্মাদ সাঃ ছয় বছর বয়সে যখন পৌঁছালেন, আমিনা মনস্থ করলেন তিনি আবদুল্লাহর কবর দেখতে মদিনায় যাবেন। সেটা ছিল খুবই কষ্টকর সফরের সিদ্ধান্ত, কিন্তু আমিনা কারও নিষেধ মানলেন না। মদিনায় আবদুল্লাহর কবর দর্শন শেষে একটি কাফেলার সঙ্গে ফেরার পথে আমিনা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অসুস্থ আমিনার জন্য কাফেলা একদিন অপেক্ষা করল, তারপর কাফেলা আমিনা আর তাঁর ছয় বছর বয়সি শিশু মুহাম্মাদকে মরুভূমিতে রেখে মক্কায় চলে গেল। কিন্তু যিনি রয়ে গেলেন, তিনি সেই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। আমিনা শেষ বারের মতো যখন কথা বলতে পেরেছিলেন, তখন তাঁকেই বললেন—আমি যাচ্ছি, আজ থেকে তুমিই মুহাম্মদের মা। তুমি আমার দেখাশোনা করেছ, এখন মুহাম্মাদকে লালনপালনের ভার আমি তোমার ওপরই ন্যস্ত করলাম। বারাকা আমিনাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কোনোদিনই ভঙ্গ করেননি। মুহাম্মাদ সাঃ সারা জীবন সেই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাকেই ‘মা’ বলে ডেকেছেন। যিনি এলে আল্লার রাসুল সম্মান জানিয়ে বসা অবস্থা থেকে উঠে যেতেন, কপালে চুমু খেতেন। ইসলামের গোত্রবাদী, বর্ণবাদী ও রাজতান্ত্রিক ইতিহাস তাঁর নাম নিতে ভুলে গিয়েছে। কার্যত মুছে ফেলেছে। বারাকার নাম অনেকে হয়তো কোথাও পড়েন। খুঁজলে তাঁর নাম পাওয়া যায়। কিন্তু নাম পাওয়া আর নাম নেওয়ার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান রয়েছে। স্মৃতি, ইতিহাস এবং ইসলামের সার্বজনীন তাৎপর্য বিচারের দিক থেকে বোঝার পার্থক্য আছে। এমনকি একটি ধর্মের অন্তর্নিহিত রাজনীতি কেন সকল প্রকার বর্ণবাদ ও আভিজাত্য বিরোধী সেটা বোঝার জন্যই মুহম্মদের শৈশব ও কৈশরের ইতিহাস অত্যন্ত অর্থপূর্ণ। আল্লার রাসুলকে একজন কৃষাঙ্গ দাসী কোলেপিঠে আপন সন্তান হিশাবে বড় হয়েছেন, যিনি কখনই তাঁকে ছেড়ে যান নি – এই ইতিহাসের তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। তাঁর নাম কি আমরা আদৌ মনে রেখেছি? আমরা নিজেরা কি জানি?

কে এই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা? যাঁর উত্তরসূরি কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের নেতৃত্বে আজ বর্ণবাদবিরোধী জনগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শহরে শহরে লড়ছে? মার্কিনিরা জুলুমবাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে? তাঁর নাম বারাকা। মুহাম্মাদ সাঃ-এর জননী। যাঁর মাধ্যমে আল্লা তাঁর রাসুলকে লালনপালন করেছেন। যাঁর সুশিক্ষা ও জননীমূলক ভালোবাসায় সিক্ত রাসুলে কারিম ‘মানুষের মহিমা’ কথাটিকে প্রতিদিন উপলব্ধি করেছেন। কোরাইশদের বর্ণবাদ, গোত্রবাদ ও সকল প্রকার ‘বিশেষ’ সুবিধা ও আভিজাত্য ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন, আবার মক্কাবিজয়ের পর সেই বর্ণবাদী ও গোত্রবাদী কোরাইশদের ক্ষমা করে দিতেও কসুর করেননি। কারণ, ইসলাম দয়া এবং শান্তির ধর্ম। কিন্তু রাসুলের মৃত্যুর পর তারাই আবার গোত্রবাদ, গোষ্ঠবাদ, রক্তবাদ, বর্ণবাদ, ও আত্মঘাতী হানাহানিতে ফিরে গিয়েছে। যার গহ্বর থেকে ইসলাম আজ অবধি মুক্ত হতে পারে নি। স্বাধীন ও মুক্ত মানুষের যে আলোকিত ও রুহানি পথে ইসলামের জয়যাত্রা ঘটবার কথা তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। গোত্রবাদ, গোষ্ঠবাদ, রক্তবাদ, বর্ণবাদ ও আত্মঘাতী হানাহানি থেকে মুক্তির অথ নির্ণয় করতে হলে সাহাবায়ে একরামদের প্রতি সম্মান এবং তাঁদের অব্দান অকুন্ঠ চিত্তে স্বীকার করে ইসলামের ইতিহাস নির্মোহ ভাবে পাঠ করবার ক্ষ্মতা আমাদের অর্জন করতে হবে। ইসলামকে রাজতান্ত্রিক ধর্ম এবং শাসনে পরিণত করেছে।

খাদিজা বিনতু খুওয়াইলিদকে বিয়ে করার পর বারাকাকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। মুক্ত করে দেওয়ার পরও উম্মু বারাকা মুহাম্মাদ সাঃ-কে ছেড়ে যাননি। তাঁর যুক্তি ছিল, সন্তানকে ছেড়ে তিনি কোথায় যাবেন? ফলে রাসুলের জীবনের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের ভূমিকা লেপটে রয়েছে। কালো মানুষদের মুক্তির লড়াই থেকে ইসলামকে কার্যত আলাদা করা দুঃসাধ্য। দাসপ্রথা, বর্ণবাদ এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সকল প্রকার ভেদ ও অসাম্য থেকে মুক্তির জন্যই ইসলাম। বর্ণবাদ, গোত্রবাদ, রাজতন্ত্রের অবসান হতেই হবে। জালেমকে তার ক্ষমতা ও আভিজাত্যের অহংকার থেকে উৎখাত করে মানুষের মহিমা কায়েম করতেই হবে। ইসলামে এর অন্যথা হতে পারে না। তাই অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে, মক্কাবিজয়ের সময় রাসুলের সঙ্গী ছিলেন জননী বারাকা এবং উসামা ইবনু জায়েদ। তাই মক্কাবিজয় একই সঙ্গে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মানুষের মহিমার বিজয়, সেখানে কোনো সাদা-কালো নেই; আছে শুধু দিব্য সম্ভাবনায় পূর্ণ মানুষ। এ জন্য মক্কাবিজয়ের দার্শনিক ও রাজনৈতিক মর্ম বুঝতে হবে, রাসুলের মৃত্যুর পরে গড়ে ওঠা গোত্রবাদী কোরাইশদের গোত্রবাদী ব্যাখ্যা দিয়ে ইসলাম বোঝা যাবে না।

আরও মনে রাখুন, মক্কাবিজয়ের পর রাসুল সাঃ কাবাঘরে কোনো অভিজাত কোরাইশকে নিয়ে প্রবেশ করেননি; যাঁদের নিয়ে প্রবেশ করে ছিলেন, তাঁরা উভয়েই ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ–কালো মানুষ। একজন ছিলে বিলাল, অপরজন উসামা। জি, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’। মানুষের মহিমা মক্কাবিজয়ের মধ্য দিয়ে ঘোষিত হয়েছে। কালোমানুষের জীবনও জীবন, শুধু এই ঘোষণা দিয়ে ইসলাম ক্ষান্ত থাকেনি; বরং কালোমানুষদের সঙ্গে নিয়েই মক্কা জয় করেছে, তাঁদের নিয়েই রাসুল মক্কাবিজয়ের পর কাবায় প্রবেশ করেছেন। ধর্মের নামে যাঁদেরকে আল্লার ঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই দাস ও মজলুমের বিজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের মহিমা রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম কায়েম করেছেন। ইসলাম সকল প্রকার দাসত্ব থেকে মানুষকে মুক্ত রাখতে কিম্বা মুক্ত করতেই হাজির হয়েছে। সাদা, কালো, হলুদ, শ্যামল—সকল মানুষের মহিমা ধারণ করেই ইসলাম মানুষের ‘দ্বীন’ বা জীবনব্যবস্থা হয়েছে। আল্লা মানুষকে তাই দুনিয়ায় তাঁর খলিফা হিশাবে পাঠিয়েছেন, কারও দাস হওয়ার জন্য নয়।

রাসুলে কারিম সাঃ আরবদেশে জন্ম নিয়েছেন, কিন্তু তিনি শুধু আরবদের রাসুল নন, শুধু তাদের নবি নন; বরং সারা দুনিয়ায় সকল মানুষের সকল মজলুমের রাসুল। অথচ আজ ইসলাম গোত্রবাদী, বর্ণবাদী ও রাজতন্ত্রী আরবদের ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামের ইতিহাস পড়লে এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়। মনে হয় ইসলাম যেন শুধু আরবদের ব্যাপার! ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’–কালোদের ইতিহাসও ইতিহাস, তেমনি অন্যদেরও। উপমহাদেশে বর্ণবাদ, জাতপাত, রাজতন্ত্র, রানিতন্ত্র, ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইও ইসলামের ইতিহাস।

ইতিহাস পড়ুন। পড়ুন কীভাবে গোত্রবাদী ও বর্ণবাদী কোরাইশদের দম্ভ চূর্ণ করা হয়েছে। মানুষের মহিমা কায়েমের এই ইহলৌকিক লড়াই থেকে ইসলামকে আলাদা করা ভুল এবং অনৈতিহাসিক। রাসুলের ইন্তেকালের পর গোত্রবাদী এবং বর্ণবাদী কোরাইশদের ইতিহাসকে প্রাধান্য দিয়ে আজ অবধি ইসলামের ইতিহাস লেখা হয়েছে। মানবেতিহাসের রুহানি সফর এগিয়ে নিতে হলে গোত্রবাদী, বর্ণবাদী এবং সকল প্রকার রাজতন্ত্রী বয়ানের কলঙ্ক থেকে ইসলামকে মুক্ত করতে হবে। ‘ইসলাম’ সম্পর্কে যেসব বাতিল, কুফরি ও মিথ্যা আমাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সেসব অন্ধকার বা জাহিলিয়াত থেকে মুক্তির দিনকে আসন্ন করে তুলতে হবে।

ভাবুন, রাসুলের সঙ্গে আগে আগে একই উটের পিঠে বসে মক্কায় প্রবেশ করছেন উসামা ইবনু জায়েদ রা.। কাবাঘরে রাসুলের সঙ্গে প্রবেশ করছেন উসামা ও বিলাল ইবনু রাবাহ। রাসুলের নির্দেশে বিলাল আজান দিচ্ছেন—লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এই ইসলামকে চিনুন। প্রতিটি জীবনই আল্লার মহিমায় গুণান্বিত। দিব্যতা-সম্পন্ন। অতএব ব্ল্যাক লাইভস ম্যটার।

এই লেখাটি কালান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়: মে ২০২৪, সংখ্যা : ৩


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।