ছাত্র-জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থান: ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’ প্রতিহত করতে হবে

বাংলা ভাষার অন্যতম কবি, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার। সম্প্রতি বাংলাদেশ একটি বিশেষ কালপর্ব অতিক্রম করছে। শত শত ছাত্র-জনতার রক্তপাতের মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে। এই বিশেষ মুহূর্ত নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী।
দেশ রূপান্তর: শুভ জন্মদিন ফরহাদ ভাই। দেশের একটা বিশেষ মুহূর্তে (৯ আগস্ট) আমরা আপনার ৭৮তম জন্মদিন পালন করলাম। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা দেশের এই সন্ধিক্ষণকে আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ফরহাদ মজহার: যদি আমি সাধারণভাবে বলি, একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন দিক থেকে। বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আন্তর্জাতিক ধারণা সেটা বদলে গেছে। বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে এখানকার তরুণরা কতটা রাজনৈতিভাবে সচেতন। যতই তাদের দমন করা হোক না কেন, নতুন বাংলাদেশ গড়বার জন্য তাদের যে অদম্য সাহস এবং আত্মত্যাগের যে স্পৃহা এটা জগৎকে বিস্মিত করেছে। আমার সঙ্গে আমার ল্যাটিন আমেরিকার বন্ধু, আফ্রিকান বন্ধুদের সঙ্গে বারবার কথা হয়েছে। তারা যে জিনিসটা জানতে চায় যে, তোমরা করলে কী করে এটা, আমরাও তো পারিনি!
দেশ রূপান্তর: বিশ্বের নানা প্রান্তেই তো অভ্যুত্থান, আন্দোলন হচ্ছে। আমাদের এই ছাত্র আন্দোলনের সিগনিফিকেন্সটা কী?
ফরহাদ মজহার: প্রথম কথা হচ্ছে, এই যে তরুণদের হাতে একটা ফ্যাসিস্ট শাসক শুধু যে পদত্যাগ করেছে তা না, তাকে পলায়ন করতে হয়েছে। ঘটনার দিক থেকে, এটা বিরাট একটা ঘটনা। আর সিগনিফিকেন্সটা হলো অ্যাজ আ মডেল অফ দ্য মুভমেন্ট। যেখানে বিভিন্ন মতের যে পার্থক্য ছিল, এই পার্থক্যগুলো এবং বিভিন্ন মতকে পাশে রেখে বা বাদ দিয়েও একটা জাতীয় ঐক্য তৈরি হলো এবং সমাজের বিভিন্ন বিভাজনকে পাশ কাটিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে যে জাতীয় ঐক্যের মডেলটা তৈরি করা গেছে, এটা। মডেলের দিক থেকে এটা খুবই ইন্টারেস্টিং।
দেশ রূপান্তর: সংগঠন, গণঅভ্যুত্থান নিয়ে আপনি কাজ করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলছে তারা। তাদের আন্দোলনের মডেলের কথা বললেন আপনি। এই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নেতৃত্বকে পেছনে রেখে সংগঠিত হওয়া, আন্দোলনকে অভ্যুত্থান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াতক আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
ফরহাদ মজহার: নেতৃত্বের কথাটা বোঝাতে ব্যাক হিস্ট্রি বলতে হবে। আমাদের তরুণদের লড়াইয়ের মধ্যে প্রথম ছিল রাষ্ট্র মেরামতের লড়াই। এটা ছিল তাদের চেতনাগত জগতে দেশ নিয়ে প্রথম উপলব্ধি। ২০১৮ সালের বিষয়টা এটা তো ডেফিনেটলি হিস্ট্রি।
দেশ রূপান্তর: আপনি তো সড়ক আন্দোলনের কথা বলছেন?
ফরহাদ মজহার: হ্যাঁ। ওই মুভমেন্টের সময় যে ছেলেগুলো ছিল, তারা বুঝেছে যে সামথিং ইজ সিরিয়াসলি রং ইন দিস স্টেটক্রাফট। এই অভিজ্ঞতা কিন্তু তাদের পরবর্তী চেতনা ডেভেলপ করতে সহায়তা করেছে। এবং তার পরে কোটা সংস্কার আন্দোলন সফল হয়েছে। কোটা সংস্কার যখন গঠিত হয়েছিল তখন কিন্তু তাদের ট্যাকটিক্যাল পজিশন নিতে হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে কখনো মনে হচ্ছে যে তারা বুঝি হাসিনারই লোক, ওরা শেখ মুজিবের ছবি নিয়ে সামনে আসছে। কিন্তু পুরো আন্দোলনটা সফল হয়েছে এই কারণে যেহেতু বাংলাদেশে একটা পোস্ট শাহবাগ বিভাজন, সেক্যুলার বনাম রিলিজিয়াস, যেটা তৈরি হয়েছিল; তারা ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেটার বিলোপ ঘটিয়েছে।
দেশ রূপান্তর: কিন্তু নুর, ওরা তো পরে বিতর্কিত হয়ে গেছে।
ফরহাদ মজহার: এখন আমরা যদি আজ নুর বা রাশেদের পরবর্তী সময়ের ভূমিকা দেখি, সেখানে সমালোচনা থাকতেই পারে, ভুল করেছে তারা হয়তো। কিন্তু এই অবদান হিস্ট্রিক্যালি স্বীকার করতে হবে। তাদের এটাই ভিত্তি তৈরি করেছে পরবর্তীটার। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, প্রথমটা না হলে দ্বিতীয়টা হতো না। প্রথমটা নুরদের নেতৃত্বে হতে পারত, ওদের বিচ্যুতির জন্য সেটা হয়নি। কিন্তু তার তো অবদান আছে। যার যে হিস্ট্রিক্যাল অবদান আপনাকে কিন্তু তাকে সেটা দিতে হবে। কিন্তু ওখান থেকে আন্দোলনের মডেলটা তৈরি হয়েছে। এটা খুব ইম্পরট্যান্ট, এটা কিন্তু আইডিয়ালি, বই পড়ে তৈরি হয়নি। থিওরিটিক্যালি তারা যেটা ভেবেছিল যে বিএনপি হয়তো আন্দোলনটা করবে হাসিনাকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু বিএনপি তাদের পথে স্ট্যান্ড না নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করে বিদেশিদের স্যাংশনের মাধ্যমে বা যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। তখন বিএনপির প্রতি তাদের বিশ্বাস চলে যায়। কাজেই, বিএনপির প্রতি বিশ্বাস চলে যাওয়ায় তাদের অভিয়াসলি নির্দলীয় একটা চরিত্র ডেভেলপ করতে হয়েছে। এবং এই মডেলটা ইনোভেট করেছে ফ্রম দ্য ট্যাকটিক, এটা খাতায় লেখা ম্যানুয়াল থেকে হয়নি। তখনই তাদের নেতৃত্বটায় তারা এমন লোককে সামনে রেখেছে তাদের কোনো দলীয় পরিচয় নেই। মডেলটা করেছে তারা অভিজ্ঞতা থেকে। তারা ইনোভেট করেছে আন্দোলন থেকে কিন্তু অভিজ্ঞতা দিয়ে করেছে। এবং এই মডেলটা করতে পেরেছে বলেই তারা সফল হয়েছে। আরেকটা বিষয়, যেহেতু তারা পলিটিক্যাল ছেলে, তারা আমাদের পাঠচক্রেও এসেছে। আমাদের দেশের গণঅভ্যুত্থান, গঠন, কনসেপ্ট এগুলো তাদের কাছে পরিষ্কার। ফলে প্রত্যেকটা ট্যাকটিক্যাল প্রশ্ন মিলিয়ে তারা দেখতে পায় যে কোনটা কাজ করে, কোনটা করে না। গণঅভ্যুত্থান এবং এর গঠন সম্পর্কে তারা কনভিন্স হয়ে বুঝেছে যে এটাই পথ; নির্বাচন দিয়ে আমরা এটাকে সরাতে পারব না। আমি তো গণঅভ্যুত্থান নিয়ে আজ থেকে বলছি না, বহুকাল থেকেই বলছি। ইতিমধ্যেই সমাজে তরুণ শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যারা এসব তত্ত্ব গ্রহণ করেছে। তাদের সংগঠনের কনসেপ্টটা এখন ধীরে ধীরে পরিষ্কার হবে। এটা তারাই বুঝবে। হয়তো একটা ভুল করেছে, কিন্তু সেটা তারা শুধরে নেবে। ফলে এই আন্দোলনটা যখন নির্দলীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে এসেছে। এটা কিন্তু নির্দলীয় কিন্তু রাজনৈতিক; রাজনৈতিক হওয়ার জন্যই এটা নির্দলীয়।
দেশ রূপান্তর: তাদের এই নির্দলীয় কিন্তু রাজনৈতিক হয়ে ওঠার সঙ্গে কি আমাদের পুরনো রাজনৈতিক চর্চার ডিনায়েল আছে?
ফরহাদ মজহার: আমরা এখনো শিওর না।
দেশ রূপান্তর: আমার মাঝে মধ্যেই মনে হচ্ছে পুরনো রাজনৈতিক দল ও এস্টাবলিশমেন্ট এই ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বকে সাইড করার চেষ্টা করছে। আপনার কী মত?
ফরহাদ মজহার: অবশ্যই, অবশ্যই। আমি আমার লেখায় বারবার বলেছি ছাত্র নেতৃত্বকে রক্ষা করতে হবে এটা এক নম্বর। সেকেন্ডলি কেউ যদি মনে করে, এদের বয়স ২৫-২৬ বলে এরা জগৎ সম্পর্কে কিছু জানে না; এই রকম যদি কেউ ভুল ভেবে থাকে আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই ‘দে আর স্টুপিড’। তারা সারা পৃথিবীর খবর জানে, এই ছেলেগুলো থিওরিটিক্যালি কমপিটিটিভ এবং তারা অর্গানাইজেশনটা ইনোভেট করে ফেলছে। এদের দমন করা এত সহজ না। ফলে এদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কেউ যদি আবার দলীয় শাসন কায়েম করতে চায়, হাসিনার জায়গায় আরেকটা মাফিয়া বসানোর কথা ভাবে সেটা ইজি হবে না। কেন হবে না? ওরা তো ইনোভেট করে সফল হয়েছে, আপনি এই নেটওয়ার্ককে কীভাবে দখল করবেন, এটা তো পপুলার নেটওয়ার্ক হয়েছে। এটা গণ-অভ্যুত্থানের স্বাদ পেয়ে গেছে, আপনি কীভাবে এটাকে দমন করবেন। আপনি তো সেই চান্সটা মিস করেছেন। সেকেন্ডলি আপনি নির্বাচন চান।
দেশ রূপান্তর: কিন্তু নির্বাচন তো চেয়ে বসছে অনেকে..., নির্বাচিত নন বলে তারা জনপ্রতিনিধি নন, এমন আলাপও উঠছে।
ফরহাদ মজহার: তারা তো প্রথমে নির্বাচনকে গণতন্ত্র বানাল। যারা এদের বলছেন অনির্বাচিত তারা স্টুপিড এবং মূর্খ। কেন? কারণ পলিটিক্যালি এবং থিওরিটিক্যালি, রাজনৈতিক সাহিত্য তত্ত্বে এটি গণ-অভ্যুত্থান। আর গণ-অভ্যুত্থান হলো জনগণের অভিপ্রায়ের সর্বোচ্চ প্রকাশ। এটাই বৈধ, তার নির্বাচন লাগে না। এটা নির্বাচনের চেয়েও বৈধ। এখন যদি বিএনপি এই বৈধ জনগণের সোভেরিন অথরিটিকে প্রশ্ন করে তাহলে সে গণশত্রুতে পরিণত হবে। আমি বিএনপির কর্মীদের প্রতি বিনীতভাবে অনুরোধ করব, এই থিওরিটিক্যাল কনসেপ্টটা তাদের বুঝতে। তাদের এখন কাজ হলো যে এই অভ্যুত্থানকে পূর্ণাঙ্গ করা, বিপ্লবকে কমপ্লিট করা। আওয়ামী লীগও যে আবার ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে এবং জয়ের যে বক্তব্য ও বিচারকদের প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা সেটাও আমরা বুঝতে পেরেছি।
দেশ রূপান্তর: আজ যখন আমরা কথা বলছি, তখন সারা দেশে ‘জুডিশিয়াল ক্যু’ নিয়ে আলোচনা চলছে। শিক্ষার্থীদের আদালত ঘেরাও কর্মসূচি দিতে হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এমন ঘটনা আরও দেখা দিতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, সার্বিক বিবেচনায় এমনসব পরিস্থিতির সম্ভাবনা নিয়ে অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
ফরহাদ মজহার: তাদের সঙ্গে তো কনসেপ্টচুয়াল কথা হচ্ছে, বলছি, শুনছি এখনো তারা কৌশলগত আছে। ফলে কোনো পরামর্শটা হয়তো ট্যাকটিক্যাল, কোনোটা এখনো হয়তো তত্ত্বের দিকে আছে, যেটা হয়তো সামনে ফেস করতে হবে... আমার পরামর্শ হচ্ছে তারা যেন তৈরি হয়ে যায়। আমি সবাইকে সাবধান করে দিতে চাই, তারা যদি এই ছেলেমেয়েদের বাচ্চা বলে মনে করে যদি ভাবে যে ওদের শিক্ষা নিতে ফিরে যেতে হবে, তারা দিবাস্বপ্ন দেখছে। দে ক্যান রান ইউনিভার্সিটি অন পলিটিক্যাল সায়েন্স। মেনি অফ দেম। আমি চ্যালেঞ্জ করি, আমাদের ছেলেদের ওই স্তরের কনসেপ্টচুয়াল ক্লারিটি আছে। এখন ওদের সাপোর্ট দেওয়া অনেক ইম্পরট্যান্ট।
দেশ রূপান্তর: বিএনপির প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
ফরহাদ মজহার: বিএনপির সবচেয়ে বড় অবদান হবে যদি ছাত্রদের এটাকে কমপ্লিট করতে দেয় এবং নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের যেই ইচ্ছা ছেলেরা প্রকাশ করেছে এটাতে একটু সহযোগিতা করে। কারণ গঠনতন্ত্র প্রণয়নের পরই নির্বাচন। তুমি সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে, তো তুমি অস্থির হচ্ছো কী নিয়ে! এখন তুমি দেশি-বিদেশি শত্রুদের মোকাবিলা করতে ছেলেদের সঙ্গে থেকে আগে অভ্যুত্থানকে সফল করো। অভ্যুত্থান না করে যদি কনস্টিটিউশনালি সরকার করতে যাও, তাহলে কিছুই কিন্তু বের হবে না। কারণ পুরনো কনস্টিটিউশনের অধীনে তোমার বিচার হয়েছে, তুমি নির্বাহী আদেশ দ্বারা মুক্তি পাবে না। বিএনপির মনে রাখা উচিত অভ্যুত্থানের শক্তি দ্বারা খালেদা জিয়া মুক্ত হয়েছেন।
দেশ রূপান্তর: কিন্তু এখানে খালেদা জিয়াকে মুক্তির যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেই মিটিংয়ে তো ছাত্রদের ডাকা হয়নি। এটা নিয়ে তো বিতর্ক আছে।
ফরহাদ মজহার: না, কোনো বিতর্ক নেই। এখানে তাদের ডাকার দরকার নেই তো। কেননা ছাত্রদের দাবির মধ্যেই তো ছিল সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি, আর তো দরকার নেই। ছাত্রদের পরামর্শ ছাড়া যে ঘটনা ঘটেছে সেটা হলো, প্রেসিডেন্টের অধীনে শপথ গ্রহণ করা। এটার ফলেই আমাদের এই জুডিশিয়ারি প্রতিবিপ্লবের কন্ডিশন তৈরি করে দিয়েছে, যেটা আমার লেখায় আমি বারবার প্রকাশ করেছি। যারা করেছে তাদের আমরা চিনেছি। এখন আমাদের বিভক্তির সময় না, আমাদের এই বিপ্লবকে রক্ষা করা দরকার। ফলে বিএনপির নেতৃত্ব এবং বেগম খালেদা জিয়াকে জানাতে চাই যে, আপনি কিন্তু মুক্ত হয়েছেন গণঅভ্যুত্থান দ্বারা, আপনি আদালতে মুক্ত হননি এবং আপনার দলও মুক্ত করতে পারেনি। তার প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, বিএনপিকে আপনি থামান; বিএনপি যে কাজটা করছে তাতে বিদেশি শক্তি এখানে তাদের ক্ষমতা তৈরির সুযোগ তৈরি করছে। আপনার প্রথম কাজটা হচ্ছে, আমাদের এই বিপ্লবটা কমপ্লিট করতে দেন। ফলে আমরা চাই না কোনো হঠকারী ভূমিকা বিএনপি নিক। বিএনপি নির্যাতিত দল, বিএনপির কর্মীই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছে। বিএনপির ছেলেদের অবদান ছাড়া এটা সফল হয়নি। কাজেই যখনই এটার সত্যিকারের সুফলটা আমরা পেতে যাচ্ছি তখন এমন কিছু কেউ করবেন না যাতে বাইরের শক্তি এসে আমাদের এটা ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
দেশ রূপান্তর: আমাদের রাজনীতি ও সমাজ কাঠামোতে প্রতিহিংসার একটা চর্চা জিইয়ে রাখা হয়। আমরা জানি আপনি আনসার বিদ্রোহের সময় খালেদা সরকার দ্বারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং হাসিনা সরকারের সময় নিগ্রহ এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তরুণরা কি এখানে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে?
ফরহাদ মজহার: অবশ্যই! এটাই একমাত্র পথ, আর কোনো পথ নেই। কেন সেটা আপনাকে বলি। আমাদের এখানে ফ্রাঙ্কলি বলতে গেলে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। যে দল আছে এরা হচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে হানাহানি এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ দল আর সেখানে স্টেইট হচ্ছে এদের ব্যবসায়িক ক্ষেত্র। দেখা যায় আপনি ব্যবসা না, আপনি স্টেইটের মাধ্যমে প্রজেক্ট করে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছেন। আমাদের এখানে স্টেইট নেই এখন, স্টেইটটা হচ্ছে ব্যবসার ক্ষেত্র মাত্র। আমাদের কোনো পলিটিক্যাল স্পেসও নেই যেখানে আমরা তর্কবিতর্ক করে একটা কমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব। ফলে এখানে গু-ামি আছে, হামলা আছে, প্রতিহিংসা আছে। আমাদের তো পলিটিক্যাল স্পেসও তৈরি করতে হবে। মানে তরুণরা যেটা করছে। ফলে যখন তারা কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির কথা বলে, এটা হচ্ছে রিকনস্টিটিউশন অফ দ্য পলিটিক্যাল স্পেস দ্যাট হ্যাস বিন ডিস্ট্রয়ার। মানে যে রাজনৈতিক স্পেসটাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের মধ্যে নতুন কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গঠনের প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে এটাকেই গড়ে তুলবার জন্য তারা চেষ্টা করছে। ফলে যেসব সংগঠন নিজেদের রাজনৈতিক দল বলে দাবি করছে এরা সিম্পলি স্ক্র্যাবস। কিন্তু এদেরই কর্মীরা কিন্তু পলিটিক্যাল, তারা নতুন কিছু করতে চায়। ওদেরই নেতারা ওদের ভুলপথে নিয়ে যায়। এই তরুণরাই কিন্তু আবার আরেকটা রাজনৈতিক দল, যেটা বা যেগুলো এখনো হয়নি। কিন্তু পুরনো, যাদের স্ক্র্যাবস বললাম তাদের রাজনীতিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য কিন্তু এই রক্তদান হয়নি, এটা একদম ক্লিয়ার। যেই ছেলেগুলো বিপ্লব করল, তারা করতে পেরেছে যেহেতু তারা পলিটিক্যাল এডুকেশন পেয়েছে; বিএনপি পারেনি, তারা পলিটিক্যাল এডুকেশন নেয়নি, আমরা যখন কথা বলেছি তারা সেটা শোনেওনি। তারা মনে করেছে রাজনীতি মানে পার্টি করা, যেকোনো মুহূর্তে ক্ষমতা দখল করা।
দেশ রূপান্তর: অন্তর্বর্তী সরকার যদি সংস্কারে হাত দেয়...
ফরহাদ মজহার: কী সংস্কার করবে? ঘরই তো নেই সংসার কী করে করবে। ঘর না বানালে সংসার হয় নাকি? প্রথম কাজ হলো ঘর যে বানাবে সেই ঘরামির ক্ষমতাকে বলা হয় কনস্টিটিউশনাল পাওয়ার, এই পাওয়ারকে আগে এস্টাবলিশড করাকে বলা হয় বিজয়ী গণঅভ্যুত্থান। গণঅভ্যুত্থান অ্যানাফ না, এটাকে বিজয়ী হতে হবে। যারা বিজয় অর্জন করে তারাই তখন একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে। সেই সরকারের প্রধান ড. ইউনূস। কিন্তু তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান না বানিয়ে তাকে পুরনো সংবিধানের উপদেষ্টা বানানো হয়েছে। এখানেই বিপদে পড়েছি আমরা। এই লড়াইটা চলছে, এই লড়াইয়ে আবার লিপ্ত হবে অনেকে। তাকে আমরা অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকারের প্রধান বানাতে চাই। তার আনুগত্য কোনো দলের কাছে না, তার আনুগত্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে। তিনি শহীদ মিনারে গিয়ে আবারও শপথ নেবেন যে, ‘আমি এই দ্বিতীয় বিপ্লবের, দ্বিতীয় স্বাধীনতার কাছে আনুগত্য ঘোষণা করলাম, আমি শপথ নিলাম। কারণ আমি জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিনিধি ফলে আমার ওপর কোনো আইন নেই।’ যতক্ষণ পর্যন্ত আরেকটা গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে না পেরেছি সমস্ত জনগণের সঙ্গে কথাবার্তা আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্ক চলবে।
দেশ রূপান্তর: এই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা কি যথার্থ সাড়া দিতে পেরেছে? পেরে থাকলে শিল্পভাষা ও উপস্থাপনায় নতুন কী পেলেন?
ফরহাদ মজহার: না, বিচ্ছিন্নভাবে ঘটেছে। র্যাপাররা তো অবশ্যই। কিন্তু কালেক্টিভলি তারা দাঁড়াতে পারেনি। কেন পারেনি জানেন? গ্রাফিতি দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি। গ্রাফিতি ইজ আ পার্ট অফ আওয়ার আর্ট ফর্ম। তাহলে আপনি গ্রাফিতি মুছছেন কেন আন্দোলনের? প্রত্যেকটা সেøাগান তো এখন হিস্ট্রি, আপনাকে মুছতে বলছে কে? তার মানে শিল্প সম্পর্কে ধারণা নেই। গ্রাফিতি হচ্ছে সবচেয়ে লিভিং আর্ট। দেখেন ফ্যাসিজম কিন্তু আমাদের অবচেতনে কাজ করে, আমাদের আর্টের ধারণার মধ্যেও ফ্যাসিজম আছে। মানে ওই যে আর্ট হতে হলে সুন্দর কিছু হতে হবে এমন। আরে ভাই, শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই, শেখ হাসিনার পতন চাই, ফ্যাসিবাদের পতন চাই; এখানে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলাটাও তো আর্ট। কালেকটিভ এক্সপ্রেশনগুলো অভ্যুত্থানের সময় আর্টের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সেটা কেন হয়নি? কারণ আমাদের এখানে শিল্প-সাহিত্যের সম্পর্কে অদ্ভুত অদ্ভুত আইডিয়া আছে। এজ ইফ পলিটিক্স থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট, কিন্তু হওয়ার কথা দল থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট, পলিটিক্স থেকে নয়। কারণ শিল্প-সাহিত্য, এখানে সহিত, মানে হলো সম্পর্ক করা। শিল্প-সাহিত্যই রাজনৈতিক পরিসর তৈরি করে। শিল্প-সাহিত্যই নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করে। তারা দলের কোনো দালালি করে না। তারা এসব মুছে ফেলছে কারণ শিল্প সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই।
দেশ রূপান্তর: সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ফরহাদ মজহার: আপনাকেও ধন্যবাদ।
অনুলিখন: মোজাম্মেল হৃদয়
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৪; দেশ রূপান্তর