ডাকসু ২০২৫ : ছাত্ররাজনীতির নয়া সমীকরণ

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষার্থীদের অধিকার, আবাসন, পাঠ্যক্রম, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি সংগঠিত ছাত্র সংসদের প্রয়োজন দেখা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চা, নিজেদের নৈতিক বিকাশ, সমাজসেবা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে ১৯২৩ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (Dhaka University Student Union) গঠিত হয়। তখনকার শিক্ষার্থীরা সান্ধ্য বিদ্যালয়, সাহিত্য-সংস্কৃতি-শরীর চর্চা, খেলাধুলা, বস্তির গরিব শিশুদের পাঠদানসহ নানান সামাজিক কাজে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া রাজনৈতিকভাবে উপনিবেশবিরোধী চেতনা ও আন্দোলনে ডাকসুর ছাত্রনেতাদের অংশগ্রহণ ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ভূমিকা জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর এই ছাত্র সংসদ হয়ে ওঠে আন্দোলনের কেন্দ্র।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ডাকসু নেতৃবৃন্দ শহীদ মিনার নির্মাণ, শিক্ষার্থীদের মিছিল, ধর্মঘট ও আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে ডাকসুর প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ছিল। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ভিত্তি ‘ছয় দফা’কে জনগণের দফায় রূপান্তর করে গণআন্দোলনের ডাকসু নেতৃত্ব। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ডাকসুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এরপর আশির দশকে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বিশেষ করে এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনে ডাকসু সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। ডাকসু সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকরা তখন জাতীয় রাজনীতির প্রথম সারির নেতায় পরিণত হন। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে স্বৈরাচার পতনের পর ডাকসুর গুরুত্ব কিছুটা কমতে থাকে।
ব্রিটিশ আমল এবং পাকিস্তান আমলেও প্রতি বছর নিয়মিত ডাকসু আয়োজন আমরা দেখেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীন বাংলাদেশে ডাকসু হয়েছে অনিয়মিত। শিক্ষাঙ্গনে দলীয় রাজনীতির প্রভাব ও অস্থিরতার কারণে দীর্ঘ সময় ডাকসুর নির্বাচন বন্ধ থাকে। ১৯৯০ সালের পর থেকে প্রায় ২৮ বছর ডাকসুর কোনো নির্বাচন হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব, বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চা ও সাংস্কৃতিক বিকাশে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়।
প্রায় তিন দশক পর ২০১৯ সালে আবার ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আওয়াজ হয়ে উঠে আসে নুরুল হক নুরের ছাত্র অধিকার পরিষদ। নানান প্রেক্ষাপটে এই সংগঠনের আখতার-নাহিদ-আসিফদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি, পরবর্তীতে এদের হাত ধরেই ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। জন্মলগ্ন থেকে ডাকসুর ইতিহাস একদিকে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষার ইতিহাস, অন্যদিকে জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণআন্দোলনেরও ইতিহাস।
ডাকসুর গঠনতন্ত্র
ডাকসুর বর্তমান গঠনতন্ত্রে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট একচ্ছত্র ক্ষমতা রাখে ডাকসুর সংবিধান সংশোধনে। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীরা ডাকসুর প্রধান অংশ হয়েও গঠনতন্ত্র পরিবর্তন বা হালনাগাদের প্রক্রিয়ায় কোনো সরাসরি ভূমিকা রাখে না।
শিক্ষার্থীদের পক্ষকে এভাবে বাদ রাখার অর্থ সাধারণ শিক্ষার্থী, এমনকি ডাকসুর নির্বাচিত নেতারাও সংশোধনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারছে না। মানে যে সংসদ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হয়ে তাদের দাবি তুলে ধরে, সেই সংসদ নিজের কাঠামো বদলাতে অক্ষম। অথচ ষাট-সত্তর দশকের ধাঁচে তৈরি গঠনতন্ত্র অনেকাংশে পুরনো হয়ে গেছে, কিন্তু হালনাগাদ করার ক্ষমতা শিক্ষার্থীদের হাতে নেই।
ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান, সব জায়গায় ছাত্র নেতৃত্ব দেশকে বদলেছে। অথচ ডাকসুর বর্তমান গঠনতন্ত্র ছাত্রসমাজকে বর্তমান বাস্তবতা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে নিজেদের ভূমিকা নির্ধারণের সুযোগ দিচ্ছে না। এতে ডাকসু অনেকটা ‘প্রশাসনের অধীন ছাত্র সংসদ’ হয়ে গেছে, স্বতন্ত্র ছাত্রশক্তির পরিবর্তে।
ডাকসুর এ বছরের সংশোধিত গঠনতন্ত্রেও বলা হয়েছে, ভিসি সিন্ডিকেটের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেবেন, যেখানে কোনো ছাত্র প্রতিনিধি নেই। এর পরিবর্তে ভিসি সিনেটের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেবেন, এই নিয়ম চালু হলে প্রশাসনিক আধিপত্য কমতো। তাই পরবর্তীতে ডাকসুতে অবশ্যই সিন্ডিকেটের পাশাপাশি ছাত্র প্রতিনিধি রাখার বাধ্যবাধকতা, যেমন ডাকসুর নির্বাচিত সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে। নিয়মিত গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা ফোরাম তৈরি করতে হবে, যেখানে শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও মতামত দিতে পারবে। বড় কোনো সংশোধনের আগে শিক্ষার্থীদের অনুমোদন নিতে হবে। যেখানে শিক্ষার্থীরা গণভোটের (রেফারেন্ডাম) মাধ্যমে স্বাধীনভাবে নিজেদের অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে পারবে।
ডাকসু ঘিরে আমাদের চাওয়া
শিক্ষা, গবেষণা ও রাজনীতিতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপ কি হবে তার একটা গতিপথ ঠিক করে দিতে পারে এবারের ডাকসু। ক্যাম্পাসে এবং সারাদেশেই একটা তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও গঠনমূলক আমেজ ছিল ডাকসু ঘিরে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনীতি চর্চার প্রতিষ্ঠান থেকে জ্ঞান চর্চার প্রতিষ্ঠান আকারে গড়ে তোলাই ডাকসুর প্রধান লক্ষ্য হওয়া দরকার।
প্রথমত, ডাকসু নির্বাচন নিয়ন্ত্রণের নামে সেনাবাহিনীকে ঢাবিতে না ঢোকানোটা ছিল ভালো সিদ্ধান্ত। এমনকি রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর বাইরে নিজস্ব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কথা ভাবা জরুরি। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক প্যানেলের সদস্যরা মিলে একটা শান্তি-শৃঙ্খলা কমিটি গঠন করা দরকার ছিল । কারণ একটা স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিশাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা নিজেদের গঠন করতে পারে কিনা তার উপর নির্ভর করবে আগামী বাংলাদেশের জনগণের গঠন প্রক্রিয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবশ্যই বছরে নূন্যতম দুইটা আন্তর্জাতিক মানের ‘পিয়ার রিভিউড’ গবেষণাপত্রে গবেষণামূলক লেখা প্রকাশ বাধ্যতামূলক করতে হবে। ‘পিয়ার রিভিউ’ বলতে বোঝায় যে কোনও বিদ্যায়তনিক গবেষণামূলক কাজ প্রকাশের আগে তার গুণমান, বৈধতা এবং মৌলিকত্ব নিশ্চিত করার জন্য একই ক্ষেত্রের অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের দ্বারা জার্নালে প্রকাশিতব্য গবেষণা নিবন্ধটির মূল্যায়ন করা। এই প্রক্রিয়াটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জ্ঞানচর্চার পরিমণ্ডলে মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হিশাবে কাজ করে। যেখানে ‘পিয়ার’ – অর্থাৎ অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা কাজটির নির্ভুলতা, পদ্ধতির সুষ্ঠুতা এবং বিদ্যমান জ্ঞানে অবদানের জন্য যাচাই-বাছাই করেন। এই যাচাই-বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হওয়া কাজগুলিকেই একাডেমিক দিক থেকে নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য উৎস হিশাবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদ্ধতি না থাকার কারণ শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা নির্ধারিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দলবাজির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান মারাত্মকভাবে নীচে নেমে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সার্টিফিকেট বিতরণ বা ব্যবসার ক্ষেত্র নয়, জ্ঞানচর্চার জায়গা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে হবে।
শিক্ষকদের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিশাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো নিষিদ্ধ করতে হবে। যদি পড়াতেই হয় তিনি ফুল টাইম যে কোনো একটা প্রতিষ্ঠানেই পড়াবেন, শিক্ষকদের মূল ফোকাস থাকতে হবে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনে এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে পড়াশোনা ও গবেষণায়।
ঔপনিবেশিক চেতনার গোলামি থেকে বের হয়ে আসতে হলে ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক জ্ঞান ছাড়াও আমাদের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার মৌলিক স্তরে অবদান রাখবার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। যেমন, পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন, প্রাণবিদ্যা, আবাসবিদ্যা, অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি। নতুন জ্ঞান উৎপাদনে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে চিঠি লিখেছিলেন, যেখানে তিনি আলো ও অন্যান্য কণা সম্পর্কিত একটি গাণিতিক তত্ত্ব হাজির করেন, যা পরবর্তীতে কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের জন্ম দেয়।
শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষকদের দৈনিক ক্লাসের ব্যাপারে মূল্যায়ন করতে পারে সেরকম ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের সময় যেসব শিক্ষক নৈতিকভাবে শিক্ষার্থীদের তথা গণমানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, তারা এখনো ক্লাস নিচ্ছেন বলে আমরা শুনেছি। তারা এখন কি শিক্ষা দিচ্ছেন, আর শিক্ষার্থীরা কি শিখছে সেটাও আগামীর বাংলাদেশ গঠনের দিক থেকে গুরুতর একটি প্রশ্ন। পূর্ণ বৃত্তি না পেয়েও যারা ‘গবেষণা সহকারী’ হিশাবে ছুটি নিয়ে বিদেশে যান তাদের বেতন বন্ধ করতে হবে। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় যোগ দিলে বেতন চালু হবে।
উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষক ও অধ্যাপকদের জন্য আন্তর্জাতিক প্রকাশনা এবং জার্নাল ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্যই ডিজিটাল লাইব্রেরির ব্যবস্থা করতে হবে। সব শিক্ষার্থীরা যেন তার আইডি দিয়ে যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো গবেষণাপত্র পড়তে পারে, লেকচার শুনতে পারে এই ন্যূনতম সুযোগগুলো নিশ্চিত করবার উদ্যোগ নিতে হবে। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শসর্বস্ব ও দলীয় এজেন্ডার বাইরে এবং বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা জ্ঞানচর্চার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবো।
বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে যে ধরনের রাজনৈতিক চর্চা হয়েছে, তার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকট বিরাজনৈতিক মনোভাব তৈরি হয়েছে। বিরাজনীতিকরণ কখনোই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে গড়ে ওঠার অনুকুল নয়। কিন্তু এর দায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের নয়; বরং ছাত্র সংগঠনগুলোরই। তাই ডাকসুতে জয়ী এবং অংশগ্রহণকারী সব প্যানেলগুলোকে ক্ষমতা ও দলীয় রাজনীতির বাইরে গঠনমূলক, সুস্থ ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির বিকাশে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কিভাবে নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। তাই শুধু ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার গড়া না, বরং একেকজন শিক্ষার্থীকে হাজির হতে হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নির্মাতারূপে। বিশ্ববিদ্যালয়কে স্রেফ ডিগ্রি দেবার ব্যবসায়ে পরিণত করা যাবে না।
বাংলাদেশের জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। শুধু নির্বাচনকালীন সময়ে নয়; তর্ক-বিতর্ক-আলাপ-আলোচনা-বাহাসের পরিবেশ সবসমইয়ই ধরে রাখতে হবে। সচল, সজীব ও সক্রিয় চিন্তার এই গতিশীল ধারা জাতীয় ক্ষেত্রে সকল স্তরে প্রভাব ফেলবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির ময়দানে উপনিবেশবাদবিরোধী রাজনৈতিক চেতনার সম্প্রসারণ জরুরি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জনগোষ্ঠী হিশাবে গড়ে না উঠবার ফলে আমরা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখনো ঔপনিবেশিক প্রভুদের নামগুলো বহন করছি। উদাহরণস্বরূপ, কার্জন হলের কথাই ধরা যাক। কেন এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে এই কলোনিয়াল নামগুলো রেখে দেওয়া হল? তাই ডাকসুর অন্যতম রাজনৈতিক কর্মসূচি হওয়া দরকার এই নামগুলো পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া। এই ভবনের নাম অনেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সূত্রধর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিরাজুল আলম খানের নামে করার প্রস্তাব করেন। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমাদের বেড়ে ওঠার ভুলত্রুটি বিনয়ের সঙ্গে স্বীকার করেও আমরা বলতে চাই, তিনিই বাংলাদেশের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যিনি আমাদের মনোজগতের ‘আভ্যন্তরীন গোলামি’ – অর্থাৎ ঔপনিবেশিক পাশ্চাত্যকে নির্বিচারে গ্রহণ ও মান্য করার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের এই মেধাবি ছাত্রকে আমরা ভুলে যেতে পারি না। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে তার নাম সবসময় যুক্ত থাকবে, বিশেষত যার নাম আওয়ামী লীগ ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল এবং তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে অস্বীকার করেছে।
এবারের ডাকসু
যখন আমরা এই লেখাটা লিখছি, ততক্ষণে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। আবাসিক-অনাবাসিক বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ব্যাপক উৎসাহে ভোটদানে অংশগ্রহণ করেছে। ভোট দেওয়া শুরু হওয়ার পর থেকে নানা মহল থেকে আপোষ-সন্ধির খবর পাচ্ছিলাম আমরা।
আপোষ ও সাজানো নির্বাচন হলে সেটা হতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তামাশা। গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রতারণা। সহিংসতা ও পেশিশক্তির ভয় দেখিয়ে ফলাফল বদলানোর চেষ্টা যে হয়নি, তা না। তবে শিবির-সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট এতে যুক্ত হয়নি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তারা বেঈমানী করেনি। নানামুখি বাধা সত্ত্বেও তারা গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দাঁড়ায়নি।
এবারের নির্বাচনে সবগুলো প্যানেলের ইশতেহারই গঠনমূলক ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীরা মতবাদ দেখে নাই। বরং যাকে কাছের মানুষ গণ্য করেছে তাদেরকেই ভোট দিয়েছে। মতবাদিক বিতর্ক প্রত্যাখ্যান করে ছাত্রসমাজ আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের আভাস দিয়েছে।
বিজয়ী ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট যদি নিজের ৩৬ দফা ইশতেহার বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারে তাহলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান হিশাবে দাঁড়িয়ে যাবে। ভিপি সাদিক কায়েম, জিএস এস এম ফরহাদ এবং এজিএস মহিউদ্দিন সবাই এই ইশতেহারকে সাধারণ শিক্ষার্থীর ‘আমানত’ বলে উল্লেখ করেছেন, আমরা তাঁদের আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করতে চাই। মতবাদিক বিতর্কের উর্ধ্বে উঠে এই আমানতটা যদি তারা রক্ষা করতে পারেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন করে গঠন করবার প্রক্রিয়া শুরু করেন তাহলে বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের গঠন ত্বরান্বিত করতে পারবে।
আমরা আনন্দিত যে, যারা মার্কস-লেনিনকে তাঁদের শিক্ষক ও দিশা মনে করেন তাঁরা আশাব্যঞ্জক ভোট পেয়েছেন। মনোজগতে ঔপনিবেশিক গোলামি ও সাম্রাজ্যবাদসহ পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা তাদের সহকর্মী। প্রতিরোধ পর্ষদের মেঘমল্লার বসু ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারী হামিমের প্রায় সমান ভোট পেয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে ধর্ম বনাম সেকুলারবাদিতার যে ভূয়া বিতর্ক আমরা জারি রেখেছি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে তা নিরর্থক। মতাদর্শিক পার্থক্য ও বিতর্ক অবশ্যই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমাদের বিকাশের পূর্বশর্ত। আমরা মেঘমল্লার বসু এবং তাঁর সমর্থক তরুণ নেতাদের সঙ্গে আন্তরিক মৈত্রী আশা করি, যেন আমরা প্রমাণ করতে পারি পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিলয় নিছকই মতবাদ বা আকাশকুসুম কল্পনা নয়। লক্ষ্যণীয় যে, ডাকসুর অন্যান্য পদগুলাতে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের একক আধিপত্য থাকলেও দুই বা তিন নম্বরের অবস্থান বামপন্থীরা ধরে রাখতে পেরেছেন।
ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থীদের জোট সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে প্রাণ খুলে মিশছে। তারা পারসোন টু পারসোন, ডোর টু ডোর ধর্ণা দিয়েছেন। নেতা না, ভাই-বন্ধুর মত প্রতিটা শিক্ষার্থীর পাশে তাঁরা আছেন, এই নিশ্চয়তা দিতে চেয়েছেন। মতবাদিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে থেকে সামষ্টিক কল্যাণকে মুখ্য জ্ঞান করে নতুন রাজনৈতিক চর্চার ধারা গড়ে তোলা বাংলাদেশের আগামী রাজনীতির জন্য ভাল নজির। খাবার-আবাসনের দাবি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শুধু সেই দাবিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালইয়ের ছাত্র রাজনীতি। ঢাকা বিশ্ববিধ্যালয়কে উচ্চ শিক্ষার একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিশাবে গড়ে তোলার একটা অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে, যা আশাব্যঞ্জক। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার ঘটেছে। ছাত্রদলের আবিদ, হামিমের প্রচারণাকেও আমরা ইতিবাচক মনে করি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের প্রচারণা প্রশংসা পেয়েছে।
এবারের ডাকসু নির্বাচন শিক্ষণীয়। ছাত্রছাত্রীরা এই বার্তাই দিয়েছে যে, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ, বাঙালি বনাম মুসলমান এসব বাইনারি আর সামনে না আনাটাই আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রাথমিক শর্ত। মতাদর্শিক তর্ক অবশ্যই থাকবে। থাকবেই। কিন্তু গোড়ার প্রশ্ন হচ্ছে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের গঠন করবার ব্যবহারিক কৌশল রপ্ত করা। কিসে সকলের মঙ্গল রাজনীতির এই প্রাচীন ও পুরানা জিজ্ঞাসা বারবারই ইতিহাসে নতুন ভাবে হাজির হয়। বাংলাদেশ ব্যতিক্রম নয়।
গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতৃত্ব আব্দুল কাদের, আবু বাকেররা ফলাফলে পিছিয়ে থাকলেও রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ ছিলেন। যদিও এটা বাগছাসের জন্য দুর্ভাগ্যজনক যে, এনসিপির নির্বাচনবাদী রাজনীতি এবং ব্যর্থতার দায় বাগছাসের তরুণদের বহন করতে হচ্ছে। তবে বাগছাসকে স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। একাত্তরের চেতনা-জুলাই চেতনার বিতর্ক কিম্বা ‘বাঙালি’ বনাম ‘বাঙালি মুসলমান’ বিতর্ক দিয়ে নতুন বিভাজন তৈরির ফাঁদ এড়িয়ে আমাদের বাস্তব ও সুনির্দিষ্ট সমস্যা কিভাবে সমাধান করব সেই দিকেই নজর দিতে হবে। সেই ক্ষেত্রে ঐক্যের জায়গা হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের সেরা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবার কঠিন ও শ্রমসাধ্য লড়াইয়ে নিয়োজিত হওয়া। সেই জন্য প্রতিটি ছাত্র সংগঠনের ভেতর পাঠচক্র, সেমিনার আয়োজন যেমন জরুরি; তেমনি দরকার চিন্তা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, সর্বোপরি পাঠ ও গবেষণার প্রতি মনোযোগী হওয়া।
স্বীকার করতে হবে যে, এবারের ডাকসুতে প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন। তিনি একা যে মানের বয়ান ও আলাপ তুলেছেন বাকি সব প্যানেল মিলেও তাঁর কাছাকাছি দাঁড়াতে পারেনি। গণমানুষের রাজনীতি যে দলীয় কোটা ছাড়া করা যায়, তারই উদাহরণ হয়ে থাকবেন শামীম। যে মুখস্ত লাইনে রাজনৈতিক দলগুলা চলে তাকেও চ্যালেঞ্জ করেছেন তিনি।
বলাই বাহুল্য ডাকসুর ফলাফল সামনের দিনে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। আমাদের সকলের রাজনৈতিক চর্চায়ও পরিবর্তন আসবে। এখানকার রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য এটা কিছুটা অস্বস্তিকর তো বটেই। তবে একই সঙ্গে এই পরিস্থিতি আমাদের সকলের জন্য নতুন পরীক্ষার ক্ষেত্র। ক্যাম্পাসে বিরোধী মতগুলোর আস্থা, নিরাপত্তা ও কথা বলার অধিকার সবাইকে রক্ষা করতে হবে। প্রচণ্ড উচ্চাশা নিয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা তাদের নেতা নির্বাচিত করেছে। জেতার জন্য যতটা কাজ করতে হয়েছে, তার চেয়ে দ্বিগুণ সক্রিয় কাজ করে যেতে হবে নিজ নিজ দলে ঘোষিত ইশতেহার বাস্তবায়নে।
আমরা বাংলাদেশের জন্য এক ঝাঁক তরুণ নেতৃত্বকে পেয়েছি। আমাদের আশা তরুণ নেতৃত্বের সংখ্যা বাড়বে বৈ কমবে না। আমরা সবাইকে নিয়ে গর্বিত হতে চাই। বিশেষভাবে আমরা আশা করি ডাকসুর নির্বাচিত নেতৃত্ব শিক্ষা ও রাজনৈতিক পরিসরে গতিশীল প্রজ্ঞার নজির রাখবেন, যেন আমরা সকলে এগিয়ে যেতে পারি।