জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব


দুই হাজার চব্বিশ সালে  ঘটে যাওয়া অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে এসেছি আমরা। পুরানা গণবিরোধী সংবিধান ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করবার জন্য জনগণ অকাতরে শহিদ হয়েছে, অনেকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন এবং নানাভাবে জুলুমের শিকার হয়েছেন। দুই হাজার পঁচিশে এসে উপদেষ্টা সরকার জুলাই ঘোষণাপত্র পেশ করেছে। ড. ইউনূস গণঅভ্যুত্থানের নায়ক নন, তিনি তার ফল বা ফলভোগী মাত্র। ছেলে যেমন বাপের নাম দিতে পারে না, তেমনি ড. ইউনূসেরও জুলাই ঘোষণাপত্র পেশ করবার কোন‌ও এখতিয়ার নাই। শুধু তাই নয় ড. ইউনূস পুরানা সংবিধান ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রেখে নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়ে  দিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে গণঅভ্যুত্থানে ব্যক্ত জনগণের অভিপ্রায়কে ধারণ, লালন ও বাস্তবায়নে ড. ইউনূস আগ্রহী নন। তিনি দ্রুত একটি নির্বাচন দিয়ে নিরাপদে প্রস্থান করতে চান। 

গণঅভ্যুত্থান কোনো আইন বা সংবিধান মেনে ঘটেনি, বরং পুরানা আইন ও সংবিধান উৎখাত করে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের মধ্য দিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন করবার জন্যই জনগণ নিজেরা ফ্যাসিস্ট সংবিধান ও ব্যবস্থা উৎখাত করেছে। গণঅভ্যুত্থানের পরে ‘ঘোষণাপত্র’ হচ্ছে জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ের ‘ঘোষণা’, যার ভিত্তিতে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। 

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জনগণের এতো আত্মত্যাগের নীট ফল তাহলে কী? তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে এস আলম, বসুন্ধরা সহ লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণীর হাতে পুনরায় ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। এটা হচ্ছে গণঅভ্যুত্থান ও বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। 

৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরপরই গণঅভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করার জন্য ৮ অগাস্ট শেখ হাসিনার নিযুক্ত প্রেসিডেন্টকে বহাল রেখে এবং সেই প্রেসিডেন্টের হাতেই ফ্যাসিস্ট সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠন করা হয়।  এটা ছিল গণঅভ্যুত্থান নস্যাৎ করবার প্রতিবিপ্লবী চাতুর্য। যার কুফল দিন দিন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং উঠছে। ৫ অগাস্টের গণঅভ্যুত্থান সংবিধান মেনে হয় নি, এর ফলে পুরানা সংবিধান গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই বাতিল হয়ে গিয়েছে। ড. ইউনূস যদি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে থাকেন তাহলে তাঁকে শেখ হাসিনার সংবিধানের অধীনে শপথ নিতে হোল কেন? তিনি কি সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতায় এসেছেন? শেখ হাসিনার সংবিধান অনুযায়ী তাঁর ক্ষমতারোহন অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গণঅভ্যুত্থান এবং জনগণের গাঠনিক ক্ষমতাই (Constituent Power) তাঁর বৈধতার একমাত্র ভিত্তি। কিন্তু তিনি নিজেই ৮ অগাস্ট সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে ৫ অগাস্টের গণ‌অভ্যুত্থানকে অস্বীকার করলেন। এক জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। 

 

শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পর রাষ্ট্রপতি ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত চান, যাতে নতুন সরকারকে আইনী বৈধতা দেওয়া যায়। কিন্তু একটি  প্রশ্ন অমীমাংসিত বা রহস্যাবৃত রয়ে গিয়েছে। সেটা হোল সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে রেফারেন্স নিয়ে যে সরকার বানানো হোল সেই রেফারেন্সের সিদ্ধান্ত কিভাবে, কোথায়, কোন্‌ সাংবিধানিক যুক্তি বা বিধান অনুযায়ী নেওয়া হয়েছে? এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কারা কারা ছিলেন? সুপ্রিম কোর্ট কার কার সঙ্গে পরামর্শ করেছে? তাদের সাংবিধানিক বা আইনী যুক্তি কি ছিল? যেহেতু সংবিধান পুনর্বহাল করা হয়েছে, অতএব আজ হোক কিম্বা কাল – এর জন্য অবশ্যই আদালতে কিম্বা রাজনীতির মাঠে সংশ্লিষ্ট সকলকেই জবাবদিহি করতে হবে। 

১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে, কোনো আইনি প্রশ্ন জনগুরুত্বপূর্ণ এবং সুপ্রিম কোর্টের মতামত প্রয়োজন, তাহলে তিনি সেই প্রশ্ন আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারেন। আপিল বিভাগ শুনানির পর রাষ্ট্রপতিকে মতামত দিতে পারে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও সেটা একান্তই পরামর্শমূলক (advisory), এর কোন আইনী বা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নাই। অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা বা না করা একান্তই শেখ হাসিনার নিয়োজিত রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের মতামত সংবিধানিকভাবে সরকার গঠনের কোন অনুমোদন দেয় না। এই দিকটি আমাদের কাছে স্পষ্ট থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে, ইতোমধ্যে ৫ অগাস্টে শেখ হাসিনার পলায়ন অনুসরণ করে  স্পিকার, সংসদ সদস্য সকলে একযোগে পলায়ন করেছে এবং সংসদ বিলুপ্ত হয়।  রাষ্ট্র কার্যত সরকারহীন। এই পরিস্থিতেতে শেখ হাসিনার রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখবার জন্য গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা মূলত সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠন করে। বাংলাদেশকে  আরও গভীর সাংবিধানিক সংকটে নিক্ষেপ করা হয়। 

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের মনে রাখা উচিত। ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত করা হয় বটে, তবে তিনি ছিলেন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি, ফলে সংবিধান অনুযায়ী তিনি সরকারপ্রধান হতে পারেন না। এই বাধা দূর করতে দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচার বিভাগ, এবং আইন মন্ত্রণালয় সক্রিয়ভাবে তাঁর দণ্ডাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়। একদিকে শেখ হাসিনার সংবিধান পুনর্বহাল করা অন্যদিকে সেই আইনের অধীনে সাজাপ্রাপ্তদের সাজা মওকুফ করা – এই স্ববিরোধিতারও খেসারত একদিন বাংলাদেশকে দিতে হবে। আমরা ড. ইউনূসের সাজা পাওয়ার পক্ষে নই। একদিকে আমরা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা, সংবিধান, আইন ও আইনী প্রক্রিয়া ইত্যাদির কথা বলবো, অন্যদিকে আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করবো তা হতে পারে না। সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ঘিরে যেসকল গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক উঠে এসেছে তা আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনীতি ও আইনের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠবে। 

১০৬ অনুচ্ছেদে সরকার গঠনের অনুমোদন আছে কি? নাই। এটি শুধুমাত্র পরামর্শমূলক। দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি কি সরকারপ্রধান হতে পারেন? না। সংবিধান অনুযায়ী দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন না। রাষ্ট্রপতির ভূমিকা কি ছিল? তিনি সাংবিধানিক অভিভাবক কিন্তু সেনাবাহিনীর সহায়তায় তিনি যে উপদেষ্টা সরকার গঠন করেছেন তা সাংবিধানিক ভাবে অবৈধ। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা সরকার গঠনের কোন আইনী  বা সাংবিধানিক ভিত্তি নাই। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাজির হওয়া জনগণের অভিপ্রায় ও গণঅভিপ্রায়ের গাঠনিক ক্ষমতাই এই ক্ষেত্রে একমাত্র রাজনৈতিক ও আইনী বৈধতার ভিত্তি। কিন্তু শেখ হাসিনার সংবিধান রক্ষার শপথ ছিল সংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নামে খোদ গণঅভ্যুত্থান ও জনগণের গাঠনিক ক্ষমতাকে অস্বীকার করা। এই জন্যই ৮ অগাস্ট আদতে ছিল গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে একটি সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব। অর্থাৎ সংবিধান রক্ষার নামে গণ‌অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করা। 


ইতোমধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভূরাজনৈতিক হস্তক্ষেপও এখন স্পষ্ট। ১৮ অগাস্ট ২০২৪ জেফরি স্যাকস (Jaffrey Sachs) বলেন, আদতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশে শুধুমাত্র সরকার বদল (Regime Change) ঘটেছে। তাহলে সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকারের ভেতরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত আরেকটি সরকার রয়েছে। সরকারের ভেতরে সরকার রয়েছে এই অভিযোগ তুলেছেন অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অন্যদিকে এই ধরনের সরকারের পক্ষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল  সাফাইও গেয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করায় তিনি বলেছেন, “পৃথিবীতে কোন দেশে সরকারের ভেতর সরকার থাকে না? পৃথিবীর সব সরকারের ভেতরে সরকার থাকে, যাকে ‘কিচেন কেবিনেট’ (যাদের প্রভাব বেশি) বলা হয়।”

আইন কিম্বা রাজনীতি, যে দিক থেকেই আমরা বিচার করি না কেন গণঅভ্যুত্থানের পর সেনাসমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠন বৈধ ছিল না। তাহলে অবৈধ সরকারের ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দেবারও কোনো রাজনৈতিক বা আইনী বৈধতা নাই। সেদিক থেকে ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে’ কি আছে বা কি নাই সেই তর্ক অর্থহীন। যদি গণঅভ্যুত্থান এই সরকারের আইনী বৈধতার ভিত্তি না হয়, অন্যদিকে যদি শেখ হাসিনার সংবিধানে যা নাই তেমন ‘অবৈধ’ সরকার গঠন করা হয়, তাহলে সে সরকারের কোনো ঘোষণারই আইনী বা সাংবিধানিক বৈধতা নাই।

অনেকের দাবি, যারা গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন ড. ইউনূসের জুলাই ঘোষণা তাদের সংবিধান লংঘনের জন্য ‘দায়মুক্তি’ (Indemnity) দিয়েছে। শেখ হাসিনার সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে এবং সেই সংবিধানের অধীনে গণ‌অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া থেকে দায়মুক্তি সম্পূর্ণ অসম্ভব। শেখ মুজিবর হত্যার বিচার এড়ানো যায় নি। অতএব দায় এড়ানোর একমাত্র উপায় সংবিধান সম্পূর্ণ বাতিল করা এবং নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে সরকার গঠন করা। আর কোন বিকল্প নাই। 

ড. ইউনূস নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন বটে, কিন্তু অবৈধ সরকারের অধীনে নির্বাচনও অবৈধ। শেখ হাসিনার সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের অধীনে নিবন্ধন পাওয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আদৌ ‘বৈধ’ কিনা সেটাও তর্কের বিষয়। নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং নতুনভাবে নির্বাচনী বিধিমালা প্রণয়ন ছাড়া বাংলাদেশের সংকটের কোন সুরাহা হবে না। আমাদের সমাজে সংবিধান, সরকার, রাষ্ট্র, গণঅভ্যুত্থান, বিপ্লব ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও আইনী বর্গ সম্পর্কে ধারণা অতিশয় অস্পষ্ট এবং  অপরিচ্ছন্ন। সমাজে পশ্চাৎপদ পেটিবুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা-চেতনারই আধিক্য। তাই সহজ কথা আমরা সহজে বুঝতে চাই না।

ড. ইউনূসের সামনে শেখ হাসিনার সংবিধান বাতিল এবং পূর্ণ ক্ষমতা সম্পন্ন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ছাড়া কোন‌ও বিকল্প নাই। ফ্যাসিস্ট সংবিধান অবশ্যই বাতিল করতে হবে এবং বাংলাদেশের জনগণকে আজ হোক বা কাল নতুন গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে হবে। নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং নতুন গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে নতুন সরকার গঠন ছাড়া ছাড়া ড. ইউনূসের পক্ষে নিরাপদ প্রস্থান কঠিন। 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।