আরব সংস্কৃতি, কবিতা ও শ্রুতি
আরবদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য যা কিছু বলি না কেন, সবকিছুই ফুটে উঠেছে তাদের কবিতার ভিতর দিয়ে। বিশেষ করে প্রাচীন আরবরা কবিতা ছাড়া আর কিছু রচনা করতে জানতো না, বা করেনি। এমনকি কবিতা ছাড়া প্রবন্ধ-নিবন্ধ বা গদ্য রচনা করা যায়, সে ধারণাই তখনকার আরবদের ছিল না। তাই পুরো আরব সংস্কৃতি এই কবিতার ভিতর দিয়েই আজ অবধি পাচ্ছি। ইংরেজীতে বলা হয়, এ্যারাবিক পোয়েট্রি ইজ দা কোইনটিসন্স অফ এ্যারাব কালচার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আরবরা তাদের এই কাব্য সংস্কৃতি কখনও লেখালেখির মাধ্যমে পরবর্তীতে ধরে রাখার চেষ্টা করেনি, এমনকি লেখলেখির প্রচলনই তাদের ভিতরে ছিল না। সর্বোচ্চ সাবা’ মুয়াল্লাকার সাত কবির কবিতা তারা কাবা ঘরে ঝুলিয়ে রাখতো। এটুকুই বলে দেয়, প্রাচীন আরবদের কাব্য চর্চার ক্ষেত্রটি ছিল খুবই সমৃদ্ধ, শক্তিশালী, কিন্তু লেখালেখির মাধ্যমটি ছিল খুবই দুর্লভ। ইসলাম পরবর্তী যুগে এসময়টি জাহিলিয়া বা অজ্ঞানতার যুগ বলে পরিচিত হয়। এ অজ্ঞানতার সময়ে যে সমস্ত কবিতা রচিত হয়েছে, তা ওকাজ মেলাকে কেন্দ্র করে হোক বা কোন যুদ্ধ-বিগ্রহে সৈনিকদের উদ্দীপিত করাকে কেন্দ্র করে হোক সে সব কবিতার যতটুকুই আমাদের হাছে পৌছুক না কেন, তা এসেছে আরবদের শ্রুতি কাব্যচর্চাকে কেন্দ্র করেই। আরবদের ভিতরে লেখ্য সংস্কৃতির প্রচলন হয় তাদের ভিতরে একজন নবীর আগমন ও কোরান নাযীলের পর থেকে। তবে জাহিলী আরবী কবিতার যে অংশ আমাদের কাছে পৌঁছেছে তা সম্ভব হয়েছে আরবদের বাকপটুতা ও প্রখর মেধাশক্তির ফলে। কবির আবৃত্তি করা কবিতাটি শুনেই তা আয়ত্ত করে ফেলতো আরবরা। আর এভাবেই কবিতা পরম্পরাগত একটি প্রজন্ম থেকে আরেকটি প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যেত।
ইসলাম পূর্ব যুগের কবিতা অনেকটা সঙ্গিতধর্মী ছিল। আরবরা কবিতা বা গান পড়ে বা লিখে চর্চা করত না বরং শ্রুতি ছিল তাদের শেখার একক মাধ্যম। তাদের আবৃত্তি বা কবিতা পাঠের সংস্কৃতি তখন উন্নতির শিখরে অবস্থান করছিল। আবৃত্তির সময় তাদের গোটা শরীরটা নেচে উঠে এক প্রকার শরীরজ সঙ্গীত তৈরি করত। এক সময় তা মানুষের শারীরিক অনুভুতিকে ছাড়িয়ে ভিন্ন একটি পরিবেশ তৈরি করত, শ্রোতাকে মোহগ্রস্থ করে ফেলতো। এ বিষয়ে আল ফারাবী লিখেছেন, কবিতার ভাষার ভিতরে সঙ্গীতের সুর মেশানো ছিল আরবদের প্রকৃতিগত গুণাবলী। কারণ, কবিতার এ বৈশিষ্ট্য মানুষের স্মৃতিকে খুব স্বাভাবিকভাবে জাগাতে পারে,আকর্ষণ করতে পারে। এতে মানুষের জন্য আনন্দ, প্রশান্তি, চিন্তা শক্তি জাগ্রত করার বৈশিষ্ট্য থাকে। এর দ্বারা মানুষের আবেগ ও চিন্তাশক্তিকে লালন করা সম্ভব হয়।
মানুষের বলা আর শোনা এ দুটো শক্তি একটি অপরটির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। মানুষের কণ্ঠ, প্রথমত মানুষের কানে গিয়েই তার আবেদনটি জানায়। যেহেতু আরবরা তাদের কবিতা লিখতো না, শ্রুতিই ছিল তাদের শেখার উপায়, তাই আরবদের আবৃত্তিশক্তি একটি অনবদ্য শিল্পের রূপ নিয়েছিল। যা কিছু বলা হচ্ছে তার চেয়ে বলার ভঙ্গিটাকে শ্রোতারা বেশি গ্রাহ্য করত। ইসলাম পূর্ব কাব্যসংস্কৃতির বিকাশ হয়েছিল ঠিক এমন করেই। আরবরা তাদের সকল প্রকার প্রথা, ঐতিহ্য, যুদ্ধে বীরদের বীরত্বগাথা, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিজয়োৎসব বা পরাজয় এই আবৃত্তি আর শ্রবণকে ঘিরে প্রকাশ করত। তাই আল জাহিজ বলেছেন, কবির চেয়ে কবিতা মানুষের কাছে প্রাধান্য পেত। উচ্চারণের শৈলীকে বেশি মূল্যায়ন করা হতো। আবৃত্তির নৈপুন্যের ওপর ভিত্তি করে কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব বাছাই হতো। জাহিলী যুগের কবিদের বৈশিষ্ট্য ছিল, তারা কখনও কবিতা নিজেকে ঘিরে রচনা করত না, কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ হতো কার কবিতা সহজেই শ্রোতার হৃদয় ছুঁতে সক্ষম হলো। কবিও তার কবিতা পাঠ করত দর্শকদের চাহিদা বিবেচনায় রেখে। আর এজন্য কবিকে তার বাগ্মীতার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হতো, আয়ত্তে করতে হতো সর্বোচ্চভাবে। শ্রোতার হৃদয় নাড়া দেয়ার জন্য তাদের বাকপটুতার উন্নতি সাধনে আপ্রাণ চেষ্টা করত। যাতে করে শ্রোতা কবিতার সবটুকু স্বাদ অনুভব করতে পারে। অনেক সময় প্রতিপক্ষকে উপহাস করেও কবিতা পড়তে হতো।
বলা হয়, আরবী কবিতায় উপাদান সংকট বা নির্দিষ্ট ক’টি উপাদানের ভিতরে সীমিত থাকার এটা অন্যতম কারণ। ইবনে খালদুন লিখেছেন, ‘শ্রবণ হলো ভাষাবৃত্তির জনক’। কবিরা যখন তাদের কবিতা আবৃত্তি করতো তখন তার আবৃত্তি শৈলীকে পাখির গানের সঙ্গে তুলনা করা হতো। কবি হাসসান বিন সাবিতের এ নিয়ে একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, তিনি বলেছিলেন, ‘গান হলো কবিতার আগাম বারিপাত’। তিনি এও বলেছেন, কবিরা নবীদের মতোই অনেকটা ভবিষ্যত কথক। এ নিয়ে তার দুটি কবিতার লাইন আছে, তা হলো, তুমি যদি প্রতিটা কবিতাকে একটি গানে পরিণত কর, সে গানই তোমার কবিতাকে জাগাতে পারবে। ইসলাম পূর্ব সময়ে গান আর কবিতা, একটিকে আরেকটির অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আরবরা তাদের কবিতাকে গান দিয়ে পরিমাপ করত। সমালোচক ইবনে রাশিক বলেছেন, অন্তমিল এবং ছন্দের সূচনা হয় গান থেকে। আর ছন্দই হলো গীতিময়তার আসল ভিত্তি। কিতাব আল আগানি(গানের বই)’র লেখক আবুল ফারাজ আল ইসফাহানি লিখেছেন, ইসলাম পূর্ব সময়ের কবিতা হলো আবৃত্তি ও গানের প্রতিশব্দ। ইবনে খালদুনের বক্তব্য প্রায় তার মতোই। তিনি লিখেছেন, গান রচনা সে সময়ে সাহিত্যের একটি অনিবার্য অংশ। কবিতার ভিত্তিতেই সেসব গান রচিত হতো। অন্যভাবে বলা যায়, কবিতা আবৃত্তির ঢং কবিতাকে শুধু কবিতার ভিতরেই আটকে রাখতো না, বরং অন্তমিল এবং ছন্দ যুক্ত হওয়ায় সেটা অবিকল গানের মতো হয়ে যেত। কবিতার এই প্রকার এবং বৈশিষ্ট্যকে আয়ত্তে আনতে আব্বাসী আমলের কুলিন কবিরাও এই ধরনের কবিতা চর্চায় নিজেদেরকে নিবিষ্ট করেছিল।
কাব্য চর্চার এ রীতিটি -বৈশিষ্ট্য জাহিলী আরবদের গোত্রপ্রথা টিকিয়ে রাখাসহ যুদ্ধ-বিগ্রহ স্থায়ী করার জন্য ছিল অত্যবশ্যকীয় মাধ্যম। যেহেতু লেখার প্রচলন ছিল না, মৌখিক কাব্য চর্চাকে মাধ্যম করে আরবরা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়ছিল।
জাহিলি যুগের মহিলা কবি আল খানসা যখন কবিতা পড়ত তখন সে যেন মোহগ্রস্ত হয়ে যেত। তার শরীরে একপ্রকার ঢেউ খেলে যেত, যার ফলে শ্রোতাও কবিতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলত। কিছু কিছু কবি আবৃত্তি মঞ্চে আসত অ™ভ’ত পোশাকে সেজে, যেন সে কোনো বিয়ে বাড়ি বা উৎসব-পার্বনে আনন্দ লুটছে। জাহিলি যুগের আরেক কবি আল আয়শা আল কায়সী যার আবৃত্তির মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে আরবরা তাকে ডাকত আরবের মন্দিরা বলে। আল আয়শা আল কায়সী প্রশংসমূলক কবিতা রচনা করতে ভালবাসত। সঙ্গীতের ঢংয়ে তার কবিতা আবৃত্তি শ্রোতাকে অনেকটা মোহগ্রস্ত করে ফেলত। কবির কণ্ঠের মাধূর্য এবং সঙ্গীতের ঢংয়ে পাঠ করার জন্য শ্রোতার ভিতরে কবিতার প্রতি আগ্রহ জন্মে, আর এই আগ্রই আরবী কবিতাকে টেনে এনেছে সমৃদ্ধির স্তরে। কবি আব্বাদ আল আনবারীকে ফারাজদাক বলেছিলেন, তোমার আবৃত্তি থেকেই আমি কবিতার মাধুর্য উপলব্ধি করেছি।
প্রাচীন আরবরা কবিতা আর গানকে একাট্টা করে ফেলেছিল; ছন্দ, অন্তমিল ও গাথা কবিতার সমন্বয় ঘটেছিল তাদের কবিতায়। যেহেতু আরবী কবিতা ছিল শ্রবণনির্ভর, তাই এটার গ্রহণযোগ্যতার সবটুকু নির্ভর করতো মৌখিক উপস্থাপনের নৈপূণ্যে। এটাকে পরিশীলিত করতে যুক্ত হয়েছে ছান্দিক কাঠামো । গবেষকরা প্রায় সবাই এ ব্যাপারটিতে একমত হয়েছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ের ছন্দ, যেটি প্রাচীন আরবের সাজ (অন্তমিল) থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এটিই ছিল মৌখিক কাব্য চর্চার প্রথম কাঠামে। এই সাজ বা অন্তমিলের আবিস্কার রাজাজ থেকে। রাজাজ হলো এক প্রকার ছন্দ, এ রীতিতে এককভাবে একটি শ্লোক রচনা করা হতো। পরবর্তীতে আরবী কবিতা তার উৎকর্ষতার যুগে স্বরসাদৃশ্যের ওপর ভিত্তি করে সাজ ও রাজাজ দুটো ছান্দিক রূপে পরিগণিত হয়। ইসলামের আগমনের পর সাজ রীতিতে কবিতা রচনা নিষিদ্ধ হয়েছিল। হাদীস থেকে জানা যায়, মুহাম্মদ সা. বলেছেন, তোমরা সাজ রীতিতে কবিতা রচনার ব্যাপারে সতর্ক হও। পরবর্তীতে প্রার্থনা ও বক্তৃতায় সাজ প্রয়োগের বিষয়টি নিষিদ্ধ করা হয়। ইসলাম পরবর্তী মাকামা, ধর্মীয় স্তুতি ও পত্র সাহিত্যে এ রীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কবিতায় এটা প্রয়োগের ফলে কবিতা হয় উঠত কখনও কবুতরের বাকবাকুমের মতো মাধুর্যময়, আবার কখনও এটা হতো উষ্ট্রীর একঘেয়ে বিলাপের মত। তিনটি প্রকরণে সাজ প্রয়োগ হতো, প্রথমত, কবিতার চরণের প্রতিটি অংশে ভারসাম্য থাকত, অভিন্ন স্বর-সাদৃশ্য এবং একই বিন্দুতে গিয়ে কবিতাটি শেষ হতো। দ্বিতীয়ত, কবিতাটি দুটি ভাগে রচিত হতো, প্রথম অংশের প্রতিটি শব্দের মধ্যে স্বর-সাদৃশ্য থাকত দ্বিতীয় অংশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। অলঙ্কার শাস্ত্রে এটাকে বলা হয়, সাজ’র সবচেয়ে সহজ ও ভারসাম্যপূর্ণ রীতি। তৃতীয় পদ্ধতিতে স্বর-সারদৃশ্যতায় ভারসাম্য থাকে না, বিক্ষিপ্ত কিন্তু চরণে অ™ভ’ত মিল আছে।
আরবরা কবিতা বা কাসিদা রচনা করত সাধারণত প্রতিটি লাইনকে দুটি সমান ভাগে ভাগ করে। প্রতিটি ভাগকে এক একটি শ্লোকে পরিণত করত। আল জাহিজ কবিতার এই ধরণটি সম্পর্কে বলেছেন, এটা হলো, হৃদয়ের প্রয়োজন অর্থাৎ নতুন বিষয় তুলে ধরতে, গান ও আবৃত্তির আবেদনটি শ্রোতার কানে এটি সহজে পৌঁছতে পারে।
ইসলাম পুর্ব যুগে আরবী কবিতার বৈশিষ্ট্যকে পরবর্তী সময়ের সমালোচকরা তাত্ত্বিক ব্যাখা করে মৌখিকতার রূপগুলো আলাদাভাবে উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন আরবী কবিতার এই রীতিনীতি এবং বৈশিষ্ট্য কবিতার কাঠামোর সঙ্গে কবিতার স্বাদ-আস্বাদ, ভাবনা ও জ্ঞানের পরিসীমাকেও নিয়ন্ত্রণ করেছে। যে কারণে এ সময়ে এসে আরবী কবিতার একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস পাওয়া যাচ্ছে। আরবী কবিতার প্রচলিত এই শ্র“তিময়তা তিন বিষয়ের ভিতর দিয়ে বিস্তার লাভ করেছে, তা হলো, ই’রাব(পূর্ব হরফের আমেল অনুসারে শেষাক্ষরে পরিবর্তন), ছন্দ, এবং কবিতা শোনার সার্বিক সংস্কৃতি। প্রাচীন আরবী কবিতাকে বুঝতে হলে এই তিনটি বিষয়কে সামনে রাখতে হবে। সা¤প্রতিক সময়ে এসে যখন অন্যান্য কবিতার সঙ্গে আরবী কবিতার তুলনা করা হয়, তখন কয়েকটি বিষয় খুবই স্পষ্টভাবে সাহিত্যে আরবদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্টগুলো স্পষ্ট করে দেয়। সঙ্গীতিকভাবে এবং অলঙ্কারের ব্যতিক্রমি ব্যবহার এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে এ সময়ে শব্দের ভুল প্রয়োগ ও উচ্চারণ বিভ্রাট হচ্ছিল ব্যাপকহারে। ইসলামের আগমনের পর আবুল আসওয়াদ আদ দোয়াইলী প্রথম উদ্যোগ নেন আরবী ভাষাকে নিয়মতান্ত্রিকতার ভিতরে নিয়ে আসতে। তিনি আরবী ব্যকরণের একটি খসড়া তৈরি করেন, তিনি ভয় করছিলেন যে, মানুষ না জেনে কোরান ভুল পড়তে পারে। আদ দোয়াইলীর কাজ ছিল অনেকটা অসম্পূর্ণ। আল খলীল এসে দোয়াইলীর রেখে যাওয়া কাজটিকে সম্পন্ন করেন। তার আগে পারস্য থেকে কিছু শব্দ ও ব্যকরণের রীতির সঙ্গে আরবরা পরিচিত হয় এবং সে অনুসারে অনেক কবিতা গান রচিত হয়েছে। ত্বাহা হুসাইন দাবি করেন, গ্রীক সংস্কৃতি ছিল আদতে ঔষধ বিজ্ঞান ও দর্শনকে কেন্দ্র করে। কিন্তু প্রাচ্য সংস্কৃতি পারস্য, ভারতীয় ও ইরাকের সেমিটিক ভাষাগোষ্ঠীর সংস্কৃতির শাখা হয়ে বিস্তার লাভ করে। কিন্তু ইসলাম আসার পর কোরান ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত জ্ঞানকে ভিত্তি করেই আরবী ভাষার সাহিত্য, শব্দবিজ্ঞান ও ব্যকরণ তার সামগ্রিক উন্নতি লাভ করেছে।
ইবনে খালদুন তার মুকাদ্দামা গ্রন্থে ভাষাবিজ্ঞান ও মৌখিক কাব্যচর্চা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন আরবদের এই সঙ্গীতধর্মী ও আবৃত্তির বৈশিষ্ট্য একমাত্র তাদেরই স্বভাবজাত। এটা কোনো রীতিনীতিকে অনুসরণ করে নয়, বরং তাদের পারিপাশ্বিক পরিস্থিতিই এরকম কাব্যচর্চা গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। এটা খুবই সত্যি কথা। কারণ, অজ্ঞানতা পর্বের আরবদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখতেই এটা করতে হয়েছে। আরবরা তখন গোত্রে গোত্রে বছরের পর যুদ্ধ করতো, কোনো কোনো যুদ্ধ চল্লিশ বছর কিংব তারও চেযেও অধিক সময় ধরে চলত। শত্রুগোত্রের হত্যযজ্ঞের প্রতিশোধ নিতে তারা শত্রুর প্রতি বিদ্বেষ করে কবিতা লিখত, সৈনিকদের প্ররোচিত করত, ভীতিপ্রদর্শন করত প্রতিপক্ষকে। সে কবিতায় থাকত তাদের অতীত ইতিহাস, শৌর্য-বির্য।
আরবী কবিতা শ্রুতি সংস্কৃতির ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল হওয়ায় এক সময় দেখা যায়, আরবী কবিতা উপাদান স্বল্পতা ও গোটাকয়েক নির্দিষ্ট উপাদানের ভিতরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে । মদ, নারী শরীরের রূপ বর্ণনা, রাজা- বাদশা’র প্রশংসা এ রকম সামান্য ক’টি উপাদান ছাড়া উল্লেখ যোগ্য কোনো উপাদান নাই। শ্রুতি সংস্কৃতির প্রভাব কবিতার ওপর খুব বেশি পড়ায় মৌলিক চিন্তা-ধারণা থেকে কবিতা হয়ে পড়েছিল আলাদা। কবিতায় চলে এসেছে একধরনের অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতা, অতিরঞ্জন ও উদ্ভটভাব। ফলে, সত্যবাদিতা ও সমালোচনা রীতি কবিতায় স্থান পাওয়া তো দূরের কথা এসব ছিল অনেকটা কল্পনাতীত ব্যাপার। এমনকি আবুল আলা আল মায়ারির আগে এ প্রশ্ন কেউ তুলে নি, ভাবেও নি। পরবর্তীতে আবু তামাম বিষয়টিকে পরিষ্কার করে গেছেন।
সপ্তম শতকে এসে কবি বাসার বিন বুরদ যিনি কবিতার এই প্রচলিত শ্রুতি সংস্কৃতিকে নিরুৎসাহিত করেন এবং লেখালেখির ব্যাপারে জোর দেন। তিনি কবিতায় বেদুইনদের ভাষা ও সংস্কৃতির পরিবর্তে শহুরে ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচলন করেন। পরে কবি আবু নুউয়াস কবিতায় প্রমিত ভাষার প্রয়োগ করেন ও পুরোনো কবিতার উপাদান থেকে বেরিয়ে আরবী কবিতার নতুন যুগ সৃষ্টিতে করেন। আরবী কবিতার আধুনিক লেখ্যরূপটি শুরু হয় তখন থেকে। তখন থেকেই শ্রোতাদের মনে কবিতার তাত্ত্বিক বিষয়াদি, কবিতার বিষয়বস্তু কি তা খোঁজ করার আগ্রহ জাগে। জাহিলিয়া যুগের কবিতায় যেখানে কবি বা কবিতার চেয়ে শ্রোতা কবির কণ্ঠ, উচ্চারণ, উপস্থাপনার প্রতি অধিক নজর দিত।
কোরান নাযিলের পরে কবিতায় নতুন এক নান্দনিকতা চলে আসে ও আলাদাভাবে কবিতার ওপরে কোরানিক প্রভাব পড়ে। যার ফলে কবিরা ইসলাম পূর্ব সময়ের কবিতার শ্র“তিনির্ভরতা থেকে সরে এসে লেখালেখির প্রতি নতুন করে জোর দেয়। সে সময়ে প্রবাদের মতই ছড়িয়ে পড়ে যে, পুরাতন সকল প্রকার অনুকরণ বাদ দিয়ে কবিদের উচিত কবিতা লিখে রাখা। ফলে, ইসলাম পরবর্তী যুগের কবিরা যাবতীয় পুরানো রীতিনীতির অনুসরণ ত্যাগ করে নতুন কাঠামোয় কবিতা লেখা শুরু করে। বলা হয়েছে, কোরান যে শুধু একটি জীবনব্যবস্থা, তাই নয়, বরং এটা মানুষকে পৃথিবী ও মানবজাতী সম্পর্কে নতুন করে জানতে ও বুঝতে শিখেয়েছে। জাহিলি যুগের সকল মৌখিক রীতি-নীতি ভেঙে দিয়ে জ্ঞানতত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে লেখালেখির প্রচলন করেছে এবং সকল গৎবাধা জীবনপদ্ধতিকে ভেঙে দিয়ে একটি মৌলিক ও পূর্ণ জীবন ব্যবস্থার প্রচলন করেছে। কোরান অবর্তীর্ণ হওয়ার পরই মৌখিক কাব্যচর্চার রীতি থেকে মানুষ সরে এসে লেখ্যসংস্কৃতির প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। মোটাদাগে বলতে গেলে, বলতে হয়, আরবদের ভাষা-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবকিছুতেই একটি নতুন আদর্শের ছাপ পড়েছে।