'আমি বিডিআর বিদ্রোহে হতভম্ব নই কিন্তু মর্মাহত এত লোকের জীবন যাওয়াতে'


[ মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য বীরবিক্রম উপাধি পেয়েছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চকুরির সময় ১৯৭১ সালে মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। জয়দেবপুরে। ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে সংঘটিত প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের ইতিহাসে তিনি প্রথম ব্যাক্তি যিনি বাঙালিদের ওপর গুলি চালাতে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের দেওয়া নির্দেশ সরাসরি অমান্য করেছেন। ২৫ মার্চের পর জয়দেবপুর থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাঙালী সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। কামালপুরসহ আরও কয়েক স্থানে তিনি যুদ্ধ করেন। মইনুল হোসেন চৌধুরী মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। সেনাবাহিনীতে চাকরিরত থাকাকালে প্রেষণে বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হন। তিনি ১০ অক্টোবর ২০১০ মৃত্যুবরণ করেন। বি ডি আরের ঘটনাবলী সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ জানার জন্য তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি আমরা নিতে পেরেছিলাম। - সম্পাদনা বিভাগ]

নেসার : আপনি এর মধ্যে প্রেসক্লাবে গোলটেবিল বৈঠকে বলেছেন, গতদুবছরে জরুরি অবস্থায় যে শাসন ব্যবস্থাটা আমরা অতিক্রম করে এসেছি তার ফলশ্রুতিতে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাটা ঘটেছে।

মইন : এটাকে ফলশ্রুতি বলব না, তবে অন্যান্য কারণের মধ্যে এটা একটা বড় কারণ।

নেসার : আপনার এই মন্তব্যে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে এবং মানুষ জানতে চাচ্ছে আসলে কারণগুলো কি, আপনি যদি একটা বিশ্লেষণ দেন।

মইন : বিডিআর, আর্মি দুটোই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিগত দুবছরে তাঁরা বিশেষ করে বিডিআর, তাদের স্বাভাবিক দায়িত্ব থেকে অনেকটা সরে এসেছে। যেমন, চাল ডাল বিক্রি করা। এগুলো স্বভাবতই তাদের পেশাদারিত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু এ ধরণের কর্মকাণ্ডের ফলে বাহিনীর সদস্যের মধ্যে ঊশৃঙ্খলতা ও দুর্নীতির প্রবণতা বেড়ে যায়। আমরা বরাবরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এগুলো থেকে দূরে রাখতে চাই। বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও দোকানদারি করার মতো অপেশাদার সুলভ কর্মকাণ্ড থেকে। এই পেশার সাথে এ ধরণের কর্মকাণ্ড মানানসই নয়।

তারপরে আরেকটা ব্যাপার হলো, অফিসারদের সাথে সৈনিকদের যে মেলামেশা বা নিয়মশৃঙ্খলার যে সম্পর্কে তারা আবদ্ধ, তার মধ্যে কয়েকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। অধিনায়কত্ব, নেতৃত্ব এবং ব্যবস্থাপনা। সামরিক বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কারো না কারো আধীনেই তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকবে। বিশেষ করে বিডিআর বা আধাসামরিক বাহিনী; আধাসামরিক কারণ জাতীয় প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য উদ্ভূত সামরিক পরিস্থিতিতে বিডিআর সামগ্রিক অপারেশন বা দেশের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার ভেতর সম্পৃক্ত থাকে। এটা সবদেশেই হয়। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও বিএসএফ তাদের প্রতিরক্ষার জন্য গৃহীত অপারেশন পরিকল্পনায় সামগ্রিকভাবে সম্পৃক্ত থাকে। বিডিআরের ক্ষেত্রেও সেটা ব্যতিক্রম না। তাছাড়া, সবদেশেই হোম সিকিউরিটি বা বর্ডার সিকিউরিটি গার্ড--এরা আধাসামরিক বাহিনী নামে সুপরিচিত। তাদের পেশাদারিত্বের যেকাজ তা আসলে একটি নিয়মিত ব্যাপার, অভ্যাসের ব্যাপার--জীবনের একটা ধারা। সামরিক বাহিনী একটা নিছকই পেশাদার বাহিনী নয়; এটা একটা জীবনের ধারা। সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এটা হলো একটা চিন্তাধারা নির্মাণের প্রশিক্ষণ। মানুষের মূল্যবান সম্পদ হলো তার জীবন। যেটা সে চায় নি কিন্তু পেয়েছে। এই জীবনটাই সে দেশের প্রতিরক্ষার জন্য উৎসর্গ করে দিতে চায়। সে যখন আধাসামরিক বাহিনীতে ঢুকে, তখন ধরে নেওয়া হয় সে দেশের জন্য, দেশের প্রতিরক্ষার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। অন্য কোনো পেশায় প্রাণ দেবার প্রয়োজন হয় না। আর সৈনিকরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দেশের জন্য প্রাণোৎসর্গ করায়।

সৈনিকদের এই কাজগুলো তো ভাড়া করে হয় না। চোর-ডাকাত ভাড়া করা যায়। কিন্তু সৈন্যদের একটা দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণের মধ্যে নিলেই তার এই সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। প্রথমদিন থেকে শুরু করে, তাকে যখন প্রশিক্ষণে নেয়া হয়, সেদিন থেকেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। আর্মি-বিডিআর-এর অনেকেরই তো সবসময় যুদ্ধ করতে যেতে হয় না। কিন্তু তাদের যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণটা চাকুরির প্রথমদিন থেকে অবসরের আগ পর্যন্ত সবসময় চলতে থাকে। প্রাচীনকালে তো সৈন্যরা যুদ্ধ দিয়ে যুদ্ধ শিখত, কিন্তু বতর্মানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, একক ও সমষ্টিগতভাবে প্রশিক্ষণের মধ্যদিয়েই তার মনোভঙ্গি গঠন (Attitude adjustment) করা হয়। আর এই প্রশিক্ষণটা তার চারিত্রিক স্বভাবের মধ্যে আত্মীকৃত না হলেই সমস্যার শুরু হয়।

দাবি-দাওয়া সব পেশার ক্ষেত্রেই আছে। সরকারী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপিদেরও দাবি-দাওয়া আছে, ক্ষোভ আছে। কিন্তু সামরিক বাহিনীর দাবি-দাওয়া উত্থাপনের একটা শৃঙ্খলা আছে। সেখানে ‘দরবার’ ও অন্যান্য বিধিসম্মত পদ্ধতি আছে। এটা বিডিআরেও আছে। দরবারে প্রতিটি সৈনিক একএক করে তাদের সুযোগ-সুবিদার কথা বলবে। সবাই একসাথে দলপাঁকিয়ে নয়, তাহলে তো সেটা ট্রেড ইউনিয়ন হয়ে গেল। যা সামরিক বাহিনীতে মোটেই কাম্য এবং বৈধ নয়।

বিগত দুবছরে এই পুরো ব্যবস্থাটাই হয়ত বাধাগ্রস্থ হয়েছে। অফিসার আর সৈনিকের মধ্যে যে প্রাত্যহিক যোগাযোগ থাকে বিশেষ করে, অফিসাররা দিনের প্রায় বারঘন্টা কাটাতে হয় তাদের অধীনস্ত ব্যাটালিয়ানের সৈনিকের সাথে। সৈনিকরা যখন দুপুরে খেতে যায় তখন অফিসাররা দাপ্তরিক কাজকর্ম করে থাকেন। কিন্তু গত দুবছরে সৈনিকেরা যৌথবাহিনী বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও অন্য কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকার ফলে স্বাভাবিক যে অফিসার সৈনিক সম্পৃক্ততা সেটা ব্যাহত হয়েছে। অফিসার ও সৈনিকের মধ্যকার যোগাযোগ ও আদানপ্রদান কমে গেছে।

তারপর, ডাল-ভাত কর্মসূচির মাধ্যমে টাকা-পয়সা লেনদেন সম্পর্কে গুজব ছড়িয়েছে--যারা দেশের ভাল চায় নি।

নেসার : টাকা পয়সার লেনদেন মানে?

মইন : এই যে ডাল-ভাত নিয়ে যে টাকা-পয়সা লেনদেনের কথা পত্রপত্রিকায় বলা হয়েছে দেখেছেন। এইসব গুজব ছড়ানো হয়েছে যে অফিসাররা সবটাকা নিয়ে গেছে। গুজব ছড়ানো তো সহজ ব্যাপার। এর মধ্যদিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। আরেকটা কথা হলো, এইসব অপেশাদার কাজ থেকে সামরিক বাহিনীকে দূরে রাখতে হবে। আমি এরআগেও অনেকবার বলে এসেছি, মার্শাল ল এবং জরুরি অবস্থায় সামরিক বাহিনী যখন অপেশাদার কাজে সম্পৃক্ত হবে তখন এসমস্ত গুজব ছড়ানো স্বাভাবিক।

সামরিক বাহিনীর পেশাটাই অনেক পুরানো পেশা। সামরিক বাহিনী যুগে যুগে সার্বভৌমত্ব এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িত হয়ে আছে। দিনদিন এই পেশার আরো আধুনিকায়ন হচ্ছে। এছাড়াও মানুষ মাত্রই তার নিজের প্রতিরক্ষা, পরিবারের সুরক্ষা বা গোষ্ঠীর নিরাপত্তায় সচেষ্ট থাকে। এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এটা অত্যন্ত পুরানো পেশা। যুগযুগ ধরেই এর একটা বিকাশ ঘটেছে। এই পেশাদারিত্বে যে নেতৃত্ব কিংবা যে ব্যবস্থাপনা--যেটাকে আমরা অধিনায়কত্ব বলি, অনেকেই মনে করেন এই অধিনায়কত্বের ব্যাপারটা বোধ হয় খুব সহজ, যেন কোনো কলাগাছকে বসিয়ে দিলেই অধিনায়কত্ব সম্পন্ন হয়। অধিনায়কত্ব মানে একটা শিল্প, এটাতে পারদর্শী হতে হয়। নিজের চিন্তা, পেশাদারিত্ব সবকিছু মিলিয়ে। যেমন ধরুন, যুদ্ধের মাঠে সৈনিক কেন তার অফিসারের কথা শুনে। সৈনিক জানে যে সে মারা যাবে। কিন্তু অফিসারের আদেশ সে শুনে কারণ সে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে বৈধ আদেশ পালনে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ওঠে।

এই সমস্ত ব্যাপারগুলোতে বিগত দুবছরে ব্যাঘাত ও ছেদ ঘটেছে। এটা মেনে নিতেই হবে। এরপর বিগত দুবছরে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা--কিছু লোকতো আছেই দেশকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিতে চায়। আরেকটা কথা হলো, আমাদের দেশের যে গোয়েন্দা সংস্থা আছে, তার আগে বলে রাখি আমাদের দেশে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স লোকে বোঝেই না, অনেকসময় উল্টাপাল্টা কথা বা শব্দ শুনে থাকি আমরা। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স হলো বিদেশী গুপ্তচরদের প্রতিরোধ করাকে বুঝায়। কিন্তু আমরা শুনি যে পুলিশের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স--পুলিশ দুর্নীতি করেছে। এধরণের কথাবার্তাগুলো বাচালতা ছাড়া আর কিছু না।

কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এর কাজ হলো দেশের স্বার্থে বিদেশী গুপ্তচরদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা। এটা সবসময়ই চলে। এটা সবসময় দেশের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়েই করা হয়ে থাকে। অনেক ধরণের ইন্টেলিজেন্সই আছে যেমন ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স, ননমিলিটারি ইন্টেলিজেন্স। যেমন ধরুন জাপানিরা চায়নার উপর, চায়না অন্য রাষ্ট্রের উপর, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স করে যাবে। এছাড়াও বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের ভিতরও এটা হয়ে থাকে। NATO ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স করে থাকে বিভিন্ন রাষ্ট্রে। আমাদের দেশে এই কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সটা সক্রিয় বলে মনে হয় না। আর ইন্টেলিজেন্সটাতো সামগ্রিকভাবে দুর্বল, কারণ তা করাই হয় শুধু ক্ষমতায় থাকবার জন্য। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর থেকেই এটা হয়ে আসছে। আমি নিজেও ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসে একসময় সম্পৃক্ত ছিলাম। সরকারী কর্মকর্তার কাজ, যারা মসনদে আছে তাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা--এটাতো মোটামুটি প্রকাশিত সত্য। পত্রপত্রিকায়ও প্রকাশিত হয় যে, ঐ লোক অমুকের সময় পদোন্নতি পেয়েছে। তাহলে সে আমাদের লোক নয়। ঠিক একইভাবে যদি আমরা সামরিক বাহিনী গড়ে তুলি তবে হোঁচট আমরা খাবোই। খেতেই হবে। আগে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে অনেক ঘটনা।

বিডিআরের ক্ষেত্রে এই ঘটনাই প্রথম নয়; এর আগে ১৯৭২ এবং ৯২ সালেও হয়েছে। কিন্তু এই রকম জঘন্য বর্বরোচিত ঘটনা হয় নি। প্রথমবার ৭২ সালের ঘটনাটা ছিল যে, স্বাধীনতা পরবর্তী বিডিআর, বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী যেমন কাদেরীয়া বাহিনী এবং সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয়ে ন্যাশনাল মিলিশিয়া গঠন করার কথা ছিল। কিন্তু তারা সেটা মানে নি। যাকে ডিজি বানানো হয়েছিল তাকে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল বিডিআর সৈন্যরা। যার পরিচালক হবার কথা ছিল তিনি হলেন লে. কর্ণেল নুরুজ্জামান। তারই মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছিল। পরে তিনি রক্ষীবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার হয়েছিলেন। ১৯৯২ সালেও তারা ডিজি লতিফকে লাঞ্ছিত করে, তাদের দাবিদাওয়া সংক্রান্ত ব্যাপারে। তখন আমাকে ডাকা হয়। আমার বই ‘একজন জেনারেলের নিরব সাক্ষ্য’তে লেখা আছে এ ব্যাপারে। আমাকে তখন দায়িত্ব গ্রহণের জন্য বলা হয়। তখন আমি বলেছি বিডিআর চালালে আইন অনুসারে চালাব, কোনো রাজনৈতিক চাপ আমি মানতে রাজি না। এছাড়া রাজনৈতিক নিয়োগও আমি মানব না। যাই হোক, এই যে এধরণের একটা ঘটনা হয়েছে। তখনও সরকার আর যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা ব্যাপারগুলো আঁচ করতে পারেন নাই।

আমাদের একটি জাতীয় প্রবণতা যেটা সবসময় প্রতিক্রিয়ার বশবর্তী হয়ে চলা। আমি যখন কাশ্মীরে যুদ্ধ করি ষাট-এর দশকে তখন একটা কথা আমরা সবসময় বলতাম তাহল, ‘‘প্রিকশন ইজ বেটা দ্যান প্রিভেনশন, প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান প্রসিকিউশন’’। আমরা কোনো সময়ই পূর্বসতর্কতা নেই না। যেমন ধরুন পানির সমস্যা। যখন পানি থাকে না তখন সেটা নিয়ে হইচই, পানি নাই, পানি নাই বলে হাহাকার করি। তারপর ধরুন সমস্যা সমাধানে কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এই সমস্যাটা তো বোঝা দরকার আগেই। তারপর ৭১ সালে পাকিস্তান আর্মি ক্রাকডাউন করবে এটা আমিও জানতাম। কিন্তু ক্রাকডাউন-এর পর সবাই রিঅ্যাক্ট করেছে। যে কথাটা বললাম যে আমরা কখনোই আগেভাগে সতর্ক (proactive) হই না, বরাবরই প্রতিক্রিয়া (reactive) দেখাই। সবকিছুতে প্রশাসনিকভাবে আমরা সবসময় দুর্বল ও অদক্ষ এই কারণে।

এটাতো গেলো বিডিআর-এর কথা। বিমান বাহিনীতেও বিদ্রোহ হয়েছে। আমি নিজেও সেটা দমন করার সাথে জড়িত ছিলাম। এখানে লক্ষ্য করবেন, আমি এগুলো বিদ্রোহ বলছি, সামরিক অভ্যুত্থান নয়। কারণ বিদ্রোহ আর সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে পার্থক্য আছে। ৭ই নভেম্বরেও বিদ্রোহ হয়েছে। আমি নিজেও এর সাথে জড়িত ছিলাম, মানে বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করার সাথে। এই বিদ্রোহটা সারা আর্মিতে হয়েছিল এবং এটা একটা শ্রেণী সংগ্রামে পৌঁছেছিল। সেখানে সাধারণ সৈনিকদের শ্লোগান ছিল সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই। এই বিদ্রোহটাতে বাহির থেকে উস্কানী ছিল। লিফলেটের মাধ্যমে কাজগুলো করা হয়েছে। অনেকেই বলেন ঢাকা থেকে ক্যান্টনমেন্ট উঠিয়ে দেওয়া হোক। এর ভিতর দিয়ে যেতে আমাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। আসলে এটা করা হয়েছে ৭৫ সালের পরে, যখন বাহির থেকে লিফলেট নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট-এর ভিতরে স্যুট-কোট পরে ভদ্রলোক বেশে রাজনীতি করতে এসেছিল। বিমান বাহিনীতে আবার ১৯৭৭ সালে বিদ্রোহ হয়েছে। বাহাত্তর সালে তারা সেনাপ্রধানকে আটক রেখেছিল, তখন বিদ্রোহ দমন করে তাকে উদ্ধার করি। এই যে ঘটনা এগুলো তো একদিনে হয় নি।

জহির : আপনি বলছেন সরকার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জাওয়ানদের সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেয় নি, এবারও আমরা তাই দেখলাম যে জাওয়ানরা তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের কথা বলছে।

মইন : আমি সারাজীবন আর্মির সাথে ছিলাম। এছাড়াও আমি কাশ্মীরে ৩০০ পাক-আর্মি ও মুজাহিদ পরিচালনা করেছি। ওখানেও তাদের অনেক ক্ষোভ ছিল। ছুটি পাই না, এই পাই না, কিন্তু তার জন্য তো আমাকে মেরে ফেলে নি তারা। এটাতো বুঝিয়ে চলতে হবে। আমি তো বললাম, সবারই একটা চাওয়া-পাওয়া আছে। ক্ষোভও আছে। এখানেই চলে আসে ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্ব আর অধিনায়কত্বের কথা।

জহির : আমাদের বিডিআর পরিচালনা করে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা।

মইন : হ্যাঁ তা করে।

জহির: তাহলে দুইটা প্রতিষ্ঠান, একটা ওটার ভিতর কাজ করে...

মইন : আমি এখানে তেমন কিছু সমস্যা দেখি না। সামরিক বাহিনী থেকে না এলে বাইরে থেকে আসতে হবে। বিডিআর-এর নিজস্ব ব্যবস্থাপনা করতে চাইলে, বা সবাই নিজস্ব কর্তৃত্ব চাইলে তো বেসামরিক প্রশাসন বলবে যে আমার এখানে ও সেক্রেটারি হবে কেন, আমার সেক্রেটারি হবে অমুক সার্ভিসের। আমি তাই এটাকে তেমন একটা সমস্যা বলে দেখি না। আমি বলব যে কিভাবে তার ব্যবস্থাপনা সেইসাথে সরকারের সামগ্রিক নীতি-পরিকল্পনা ঠিক করা যায়। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা দেখেছি সবকিছুরই তাড়াহুড়া জোড়াতালি সমাধান করতে চাওয়া হয়। আমি সবসময় এর বিপক্ষে ছিলাম। এতে কোনোদিন সুসংহত একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে না।

বিডিআরের প্রশিক্ষণের মেয়াদ আছে ছয়মাস, এটাকে কমপক্ষে নয়মাস করা উচিত। আমাদের দেশে এখনও সামরিক সংস্কৃতিটা গড়ে ওঠে নি। ধরেন, ইউরোপের রাজপরিবারের সদস্যদের সামরিক বাহিনীতে যেতেই হবে। কেন সেটা? কারণ সেখানে একটা সামরিক সংস্কৃতি আছে। এবং ইউরোপে বলা হয়, ‘ইফ য়ু ডোন্ট সার্ভড ডিফেন্স সার্ভিস অব দ্য কান্ট্রি, য়ু হ্যাভ নো রাইট টু টক এ্যবাউট পেট্রিয়টিজম’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্চিলকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে তিনি জনগণের নেতা। এই যে ব্রিটেনের যুবরাজদেরকে আফগানিস্তান, ইরাক-এ পাঠানো হয় কারণ তার দেশপ্রেমের প্রমাণের জন্য। দেশপ্রেম প্রমাণের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা যুদ্ধের মাঠ।

এ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হলে আমাদেরও নৈতিকতা, দেশপ্রেম আসতে হবে। দেশপ্রেম কিভাবে আসে? দেশপ্রেম আসলে একটা অহংকারের মতো। আপনি তখনই নিজেকে বাঙালি বলতে উৎসাহিত বোধ করবেন যখন তার সাথে গর্ব, আত্মমর্যাদাবোধ যুক্ত থাকবে। আমি পাঠানদের সম্পর্কে বলি, তারা পাঠান বলতে খুব গর্ববোধ করে। আমি দেখেছি তাদের মাঝে একটা আত্মগর্ব, আত্মসম্মান আছে। এটার জন্যই আমাদের চাই একটা জাতীয় চরিত্র, দেশপ্রেম। এটা আমাদের নানা কারণে স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাধাগ্রস্থ হয়েছে। এর কারণ হলো আমাদের মনোবৃত্তি, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে যে দেশের ক্ষতি করছি এটা আমরা দেখি না। যেমন, পিলখানার ঘটনায় বলা হলো সামরিক বাহিনীতে জঙ্গি ভর্তি। এটাতো রীতিমতো সাংঘাতিক কথাবার্তা। কোনো প্রমাণ ছাড়া এ ধরণের কথাবার্তার জন্য অন্যদেশে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত হতে পারত। এটা তো দেশদ্রোহীতার পর্যায়ে পড়ে।

জহির : আপনি টেলিভিশনে বলেছেন, আইএসপিআর থেকে বিবৃতি দিয়ে যেন বিষয়টার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, কিন্তু তা করা হয় নি। কেন করে নি, আপনার কি মতামত এ ব্যাপারে ?

মইন : আসলে এটাতো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের করার কথা। কেন করে নি এটা, আমি তো নিজেই অবাক হই। কি হয়েছে দেশে। পত্রপত্রিকায় আমি বলেছি এব্যাপারে। আর প্রমাণ ছাড়াই অনেক কথা বলা হচ্ছে। আমি দু একটি সেমিনারে বলেছি, টেলিভিশনে বলেছি, এই যে জঙ্গি জঙ্গি বলা হয়, কিসের জঙ্গি? কে জঙ্গি? জঙ্গি কোথায়?

আফগানিস্তানে যে জঙ্গি সমস্যা, সে ব্যাপারে আমেরিকান চীফ অব জয়েন্ট স্টাফ বলেছে, সেখানে দুটা-চারটা জঙ্গি বাকি সব ইকোনমিক জঙ্গি। আমেরিকানরা আফগানিস্তানের কথা বলছে যে সেখানে দারিদ্রতাই জঙ্গিবাদের প্রধান কারণ। আর পাকিস্তানের ফন্ট্রিয়ারে, আমি এ সমস্ত এলাকায় গিয়েছি। এখানে অধিকাংশ পয়সার জন্য জঙ্গি কর্মকাণ্ড করে। তারপর বলছে ওপিয়াম চাষাবাদ বন্ধ করলে জঙ্গি হবে ওরা। তাদের বিকল্প কিন্তু দিতে হবে। চাকুরি দিতে হবে। খালি পেটে থাকলে জঙ্গি হবে এরা, ধর্মের নামে করবে না হয় কর্মের নামে করবে। বলা হয় মতাদর্শের কথা, এটাতো নাই এতে। আগে নকশাল হতো, হতো দরিদ্র অঞ্চলে। হয়ত দু-একজন এখানে অনুপ্রাণিত, কিন্তু বাকীদের তো ব্যবহার করা হয় দারিদ্রতার সুযোগে। আমাদের দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে, বাজেটে বলা হচ্ছে ভর্তুকি দেওয়া হবে। এছাড়া প্রণোদনা প্যাকেজ দেবার কথা বলা হচ্ছে। আমার কথা হলো যাদের এটা দেওয়া হবে, বিদেশেও দিচ্ছে। দিয়ে কি বলছে, তোমাদের প্লেন প্রমোদতরী আছে এগুলো ছেড়ে দাও। ওনাদের বলেন এই পাজেরো জীপ, লেক্সাস জীপ এগুলো ছেড়ে দিতে। কোটি কোটি টাকার গাড়ি দৌড়ান। এগুলো আগে ছাড়–ন তারপর স্টিমুলাস। আমি নিজেও তো করদাতা, আমাকে কি স্টিমুলাস দেবে? ব্যবসা করে কোটি কোটি কামাবেন। বিগত দুবছরে তো সবকিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু আমার কি অবসরভাতা বেড়েছে? কোনো সাধারণ নাগরিক, কৃষকের কি কোনো লাভ হয়েছে? এই সমস্ত ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দেশের এত খারাপ অবস্থা। দেশের কতগুলো দায়িত্ব আছে নাগরিকদের প্রতি সেটা পালন না করলে নাগরিকরা আইন মানবে না, তখন নাগরিকদের সরকারের প্রতি আস্থা থাকে না। একটা আইন মেনে চলা, দেশের প্রতি আস্থা রাখা। সামগ্রিকভাবে সবদিক থেকে এগুলোকে দেখতে হবে। শুধু নিজের সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষা করবো আর জঙ্গিবাদ বলে চালিয়ে দেব, জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ করলে হবে না।

আমি তো জঙ্গিবাদের উত্থান বাংলাদেশে ওভাবে দেখি না। যারা জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ করে তারা কখনোই যুদ্ধ করে নাই, বারুদের ঘ্রাণ নেয় নি। তারা গোলাগুলি করে নি। এরা কিভাবে আত্মঘাতী হামলা করবে। কয়জন করেছে। কোথায় আত্মঘাতী হামলা হয়েছে? হামলা হলে পারবে ঠেকাতে বাংলাদেশ? সেই সক্ষমতা আছে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর?

সমাজের সামগ্রিক যে বৈষম্য রয়েছে যেমন যে বেতন কাঠামো আছে এর একটা বিরূপ প্রভাব পড়বে সমাজে। আমরা যেটা করছি, তা হলো কয়েকলাখ লোক পালার জন্য দেশের সবসম্পদ নিয়ে আসছি। আমাদের চিন্তা হলো ঢাকা যদি ঠিক থাকে তাহলে সারাদেশ ঠিক থাকে। ঢাকায় যে শিক্ষিত, হোয়াইট কলার, আর্মি, সরকারি কর্মচারী এদের যদি ঠিক রাখা যায়, তুষ্ট রাখতে পারলেই দেশের সবঠিক থাকবে। এধরণের ঠিক রাখার সময়কাল ক্ষণস্থায়ী।

জহির : আপনি যেটা বলছিলেন ব্যবস্থাপনাগত ত্র“টির কারণে এগুলো হতে পারে।

মইন : ব্যবস্থাপনা হলো সামগ্রিক। দেশের ব্যবস্থাপনা, অধিনায়কত্ব, নেতৃত্ব এবং নিখাদ দেশপ্রেম দিয়ে করা যায়।

জহির : বিদ্রোহের ঘটনাটায় যেমন অভাব-অভিযোগের ব্যাপার আছে। অন্যায় আচার-আচরণের অভিযোগও আছে।

মইন : আমি একটি গল্প বলি। আমার তখন চাকুরি বোধ হয় ছয় মাস। একজন সিপাহী, বাড়ি ছিল সিলেটের ছাতক, তার নাম খতিব। ’৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে আমি মেহেরপুর দর্শনায় ছিলাম। আমি ব্যাটালিয়ন ইন্টেলিজেন্স অফিসার ছিলাম। আমার ইউনিট সদর দফতরে ফিরলাম, এই সময় খবর আসল এক সৈনিক অফিসারকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। অফিসার এর নাম ছিল মেজর মির্জা। মারার কারণ হলো, অফিসার সৈনিককে ডিউটির সময় ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়ার পর শাস্তিসরূপ তার মাথা ন্যাড়া আর মুখে কালি লাগিয়ে সবার সামনে ঘুরিয়েছে। পরদিন সৈনিকটি অফিসারকে মেরে ফেলে। ঐ লোকটির সাথে কথা বলার সৌভাগ্য হয় আমার। তারও বাড়ি সিলেট আমার বাড়িও সিলেট। মির্জা ভাল অফিসার ছিলেন। পরে আমি সৈনিককে জিজ্ঞাসা করলাম একাজ কেন করলে তুমি? ও বলল, ‘‘স্যার যদি আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে না পারি তাহলে বেঁচে কি লাভ! অফিসার আমাকে সবার সামনে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। আমি এদের সাথে বসবাস করব কি করে? সামরিক বাহিনীতে তো আপনারা আত্মমর্যাদার কথা শেখান’’। এখানে অধিনায়কত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে যাতে সৈনিকের আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন না হয়। এটা পয়সা কিংবা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে হবে না।

আমাদের সৈনিকদের আত্মমর্যাদার শিক্ষা দেওয়া হয়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাই তারা পালায় না, মিথ্যা কথা বলায় তাদের আত্মমর্যাদায় লাগে। সৈনিকরা লাভ-লোকসানের হিসাব করে লড়াই করে না। এখানে তারা টাকা-পয়সা কামাতে আসেনা। সৈনিকের দেশপ্রেম ও আত্মমর্যাদাই হলো আসল জিনিষ। সৈনিক সৈনিকই হয় আত্মমর্যাদার কারণে, এটাকে সবসময় গুরুত্ব দিতে হবে। নিজেদের পছন্দমাফিক কাউকে বসিয়ে দিলেই হয় না। এটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে সৈনিকের আত্মমর্যাদার ব্যাপারটা গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। পরে ঐ সৈনিকের শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে জিওসি তাকে ৫ বছর জেল দিয়েছিল। ঐ অফিসার আত্মমর্যাদা সম্পন্ন সৈনিককে সামরিক বিধির বাইরে শাস্তি দিয়েছে। মাথা ন্যাড়া আর মুখে কালি দেওয়া অনুমোদিত শাস্তির বিধান না। সিপাহীদের দিয়ে অনুমোদিত নয় এমন কাজ করাতে গেলে সিপাহীরা পছন্দ করবে না। এই যে চালডালের বস্তা টানানো আর মুদি দোকানদারি কি অনুমোদিত কাজ হয়েছে? চাল-ডাল বিক্রি করা এটা অনুমোদন যোগ্য নয়। এটা বিডিআর সিপাহীদের ভালোলাগে নি। কিন্তু বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের দিয়ে এ কাজ করিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যারা কর্তাব্যক্তি ছিলেন তারা কেউ এটি বোঝেন নাই। তারা বাংলাদেশের কোনো কিছুর ব্যাপারেই খবর রাখেন নি। আধডজন ডক্টরেট হলেই যে দেশ পরিচালনা করা যায় না সেটা ছিল বিগত সরকারের উদাহরণ।

তারপর ধরুন জরুরি অবস্থা, আমি আপনাদের সেমিনারেও বলেছি, প্রত্যেকটি জরুরি অবস্থা দেশে অশান্তি এনেছে। ১৯৭৪ সালের জরুরি অবস্থার পর ৭৫ সালের রক্তাক্ত দিন এসেছে। ৮১ সালের পর ৮২ সালে আবার মার্শাল ল এসেছে। এরশাদের পতন হলো দুইটা ইমারজেন্সির মধ্য দিয়ে। তারপর বিগত দুবছরের জরুরি অবস্থার পর বিডিআরের মধ্যে এই ঘটনা ঘটলো। আমি অনেক আগে থেকেই এই কথাগুলো বলে আসছি যে, জরুরি অবস্থা দিয়ে দেশর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যায় না। দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘমেয়াদি জরুরি অবস্থা কোনো সমাধান নয়।

১/১১তে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলে আমি জরুরি অবস্থার পরিবর্তে অন্যকিছু করার প্রস্তাব করতাম। কারণ গোলমালটা তো সারাদেশে হয় নি। হয়েছে ঢাকায়, ঢাকায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা কর। তাই সারাদেশে জরুরি অবস্থা জারির কোনো মানে হয় না। এখন পরিষ্কার যে দীর্ঘমেয়াদি শাসনের জন্য তারা এটা করেছে।

জহির : আসলে জরুরি অবস্থা জারির পেছনে আরেকটি কারণ ছিল, জাতিসংঘের স্থানীয় প্রতিনিধির চিঠির কথা বলা হয়েছে। এটাকে যুক্তি হিসাবে দেখানো হয়েছে।

মইন : এসবের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এগুলো অনেক ক্ষেত্রে আধাসত্য ও আধামিথ্যা কথা। যারা এসব যুক্তি এনেছিল তারা আমাদের বিপদগামী করতে চেয়েছেন। এছাড়া ফিজি, থাইল্যান্ড, পাকিস্তানে ঘনঘন মার্শাল ল দেওয়া হয়, তাদের সৈন্যবাহিনী তো মিশনে আছে। আমাদের মিসলিড করা হয়েছে। এতে দেশেরও কিছু তথাকথিত সুবিদাবাদী সুশীল সমাজ জড়িত বলে আমি মনে করি। নিজেদের সুবিধা হাসেলের জন্যই তারা এটা করেছে।

জহির : বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশ বহুদিন জাতিসংঘের কাজ করছে এবং জাতীয় স্বার্থের বা রাষ্ট্রের সাথে একটা বৈষয়িক স্বার্থের ফারাক বা সংঘাত তৈরি করেছে।

মইন : আমাদের সবসময়ই জাতীয় স্বার্থকে প্রধান্য দিতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থের গুরুত্ব অনেক বেশি। জাতীয় স্বার্থের সাথে সম্পৃক্ত যেকোনো দায়িত্ব পালনে আমার আপত্তি নাই, কিন্তু জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে, ব্যক্তি স্বার্থে কিছু করেছেন, দেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। ব্যক্তি স্বার্থ বড় নয়, দেশের স্বার্থ বড়। শুধু বৈষয়িক লাভ-লোকসানের দিকে ঝুঁকে পড়লে জাতীয়প্রতিরক্ষা বাহিনীর পেশাদারিত্ব কোনোদিন গড়ে উঠবে না।

নেসার : এখন যেমন ধরুন যে আর্মি আমাদের আছে তাকে কি আমরা জাতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনী (National Army) বলতে পারি?

মইন : দেখেন আর্মি তো দুরকমের। একটা কিংস আর্মি আর একটা জাতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনী। কিংস আর্মি হলো রাজা বাদশারা করে ওদের ধনসম্পদ রক্ষা করার জন্য। আর জাতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনীর কাজ হলো জনগণের স্বার্থরক্ষা করা। আমি এভাবে দেখি।

জহির : সেই আলোকে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কি অবস্থা বলে আপনি মনে করেন?

মইন : সংবিধানে কাগজেকলমে আমাদের এই আর্মি হলো জাতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনী। দেশের প্রতিরক্ষা, সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্যই এই আর্মি। আমাদের আবার আরেকটি জিনিষ মনে রাখতে হবে। আর্মির ব্যর্থতা রাজনৈতিক ও সামরিক দুই পরিস্থিতির উপর প্রভাব ফেলে। যদি কোনো রাজনৈতিক কুকীর্তি হয় তাহলে এর প্রভাব আর্মির উপর গিয়েও পড়ে। আবার আর্মির কোনো ব্যর্থতা রাজনীতির উপর প্রভাব ফেলে। এই সম্পর্কগুলো খুবই জটিল ব্যাপার। এটা ইচ্ছাকৃত নয়, বুঝতে হবে, লোকে বুঝে না।

রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও দ্বন্দ্ব ১/১১--আর্মির উপরে প্রভাব ফেলেছে। আবার আর্মির ভিতরকার দ্বন্দ্বের প্রভাব রাজনীতিতে পড়েছে। এর জ্বলন্ত প্রমাণ হলো পিলখানার ঘটনা। জরুরি অবস্থার মধ্যে দিয়ে এই সমস্যাগুলো ঘনীভূত হয়েছে।

জহির : এবার একটু বিচার প্রক্রিয়ার প্রসঙ্গে আসি। এখন বিডিআর বিচার প্রক্রিয়াটা বেসামরিক আদালতে হবে না সামরিক আদালতে হবে এ ব্যাপারে বির্তক আছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?

মইন : দেখেন বিডিআর-এরও আইন আছে। ১৯৫২ সালের আইনের কথাই বারবার উল্লেখ করে অনেকে। বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর আইনগুলো আমার হাত দিয়েই হয়েছে। আমি তখন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল ছিলাম। ১৯৫২ সালের বইটা হলো পাকিস্তানের এমপিএমএল। এখন আমাদের দেশের বেলায় ’৫২ বলা ঠিক না। আমারা ’৭২ সনের আইনের কথা বলতে পারি সেখানে আমরা ’৫২ সনের আইনটি গ্রহণ করেছি; ৫২ সনের আগে ব্রিটিশ আইন থেকে ওটা নেওয়া হয়েছিল। কেন যে ’৫২ সনের আইন ওরা বলে আমি জানি না। আমাদের আইনজীবীরা হয়তো পুরানো ইতিহাস বলতে খুব পছন্দ করেন, বলুক উনারা। কিন্তু আমার কথা হলো, এখন কোন আইনে বিচার করবেন? উনারা নিজেরাই একেকবার একেক কথা বলছেন। এতে আমার মতো লোকও দ্বিধাগ্রস্থ। কারণ প্রথমবার বলা হলো, কোর্টমার্শালের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ঠিক করা হয়েছে। তারপরে থেকে একেকদিন একেক কথা, আজ আবার বলছে আরেক কথা। আসলে উনারা মনস্থির করতে পারছেন না। কথায় আছে না অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট, পরিস্থিতি মূলত সেটাই দাঁড়িয়েছে। কারণ, অনভিজ্ঞ কিছু লোক দিয়ে আমরা একটা জটিল পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। একেতো তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নাই আবার পুরানো ইতিহাসও তারা দেখতে চান না। কিন্তু মানুষ অভিজ্ঞতার আলোকেই সামনের দিকে অগ্রসর হয়। এ ক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নাই।

জহির : সে ক্ষেত্রে আইনমন্ত্রী আগে যেটা বলেছিলেন...।

মইন : দেখেন, আইনমন্ত্রী বলেছেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন। সবাই বলেছেন কোর্টমাশার্ল। শুরু করেছেন একথা বলে। বলেছিলেন এটা গৃহীত হয়ে গেছে। এখানে মজার ব্যাপার হলো কোর্টমার্শাল হলে প্রসিকিউটর নিয়োগের প্রয়োজন নাই। এদিকে সরকার আবার প্রসিকিউটর নিয়োগ করেছে । আইনমন্ত্রী বলছেন আমি জানি না। কোর্টমার্শাল হলে প্রসিকিউটর হয় সেনা কর্মকর্তা। অভিযুক্তের পক্ষে যে কোনো আইনজীবী দাঁড়াতে পারে। কোনো সমস্যা নাই। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ডিগ্রিধারী আইনজীবীও আসতে পারে। আমাদের দেশেও তো ডিগ্রিধারী অভাব নাই। উনারা এসেও পক্ষাবলম্বন করতে পারেন। কোর্টমার্শাল স্বচ্ছ হতে হবে সবসময়, খোলামেলা হতে হবে সবসময়।

জহির : কোর্টমার্শালের ব্যাপারে একটু বিশদ বলুন, আমাদের মতো অনেকের মাঝে এটা নিয়ে অস্পষ্টতা আছে।

মইন : শুনেন, আমাদের দেশে সামরিক কোনো আচার-আচরণ--সংস্কৃতি নাই। বাহাত্তর সালের পরে আমাদের সামরিক সংস্কৃকি গড়ে উঠতে শুরু করে, তাও যুদ্ধের ধারাবাহিকতায়। আবার এটা ধাপে ধাপে ব্যাহত হচ্ছে। রাজনীতিকরণের কারণে সেটা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। আশির দশক থেকে এই সমস্যাগুলোর শুরু। রাজনীতি থেকে সামরিক বাহিনীকে দূরে না রাখলে সমস্যাগুলোর সমাধান হবে না। আশির দশক থেকেই অফিসারদের চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেবার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছে। একদল রাজনৈতিক কারণে একে ওকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয়। আমি বলবো এর চেয়ে জঘন্য ও ক্ষতিকর কাজ আর অন্য কিছুতে হয় নি। কাউকে চাকুরি থেকে বের করতে হলে বিচার করুন। দেশে আদালত আছে, তার বিরুদ্ধে তদন্ত করুন। জনগণের সামনে বলা হোক, এই জেনারেল বা এই বিগ্রেডিয়ার এই অপকর্মগুলো করেছে। কথা নাই বার্তা নাই, সেনাআইনে একটা ধারা আছে, ৪৮ ধারা বলে কারণ দর্শানো ছাড়া চাকুরি থেতে অব্যহতি দিয়ে দেওয়া হয়। অন্যকোনো চাকুরির বেলায় এটা করতে পারে না কারণ তারা মামলা করে দিতে পারে। আমি নিজেও এর ভুক্তভোগী। আমাকে বিদেশে পাঠানো হয়, কিন্তু আমি যেতে চাই নি। আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। আমি সামরিক বাহিনীতে চাকুরি করতে চেয়েছি। আমাকে ষোল বছর বিদেশে রাষ্ট্রদূত হিসাবে রাখা হলো। আমি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে দরখাস্ত করলাম। আদালতে গেলাম, কোনো বিচার পাই নি। এভাবে সামরিক বাহিনীতে একটা অস্থিরতা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। আপনারা মানবাধিকারের কথা বলেন, মানবাধিকারটা আসলে কী? ভয় এবং সকল অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি। তো চাকুরির ক্ষেত্রেও সবাই অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত থাকতে চায়। কিভাবে চাকুরি করবে বলেন। কাল সকালে সেনাবাহিনীর যেকোনো কর্মকর্তা একটা চিঠি পেতে পারে আপনার চাকুরি নাই। এটার জন্য অনেক অস্থিরতা হয়েছে। তাদের জন্য আমার অভিজ্ঞতার আলোকে উপদেশ থাকবে তারা এগুলো করবেন না। যারা এগুলো করছেন তারাও পরবর্তীতে জঘন্য সব অপকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন। বিনা কারণে তাদের চাকুরি যাবার কারণে তারা জাতীয়পর্যায়ে জঘন্য সব অপরাধ করেছেন। আমি কয়েকজনের নামও বলতে পারি। এটা মনে রাখতে হবে। এভাবে বিনাকারণে চাকুরি যাবার কারণে বহু ঝামেলা হয়েছে। দেশের জন্য যুদ্ধ করলাম, দেশকে স্বাধীন করলাম তারপর কথা নাই বার্তা নাই চাকুরি চলে গেল। যদি কেউ দোষী হয়ে থাকে তাকে সেটা বলা উচিত। কিন্তু কথা নাই বার্তা নাই প্রতিদিন দেখবেন দুই চারজন অবসরে যাচ্ছে। এগুলো করলে সামরিক বাহিনীতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। যারা এগুলো করছেন তাদের সৎসাহস নাই আইন অনুযায়ী তদন্ত করে শুনাশুনি দিয়ে বৈধভাবে বরখাস্ত করার। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ভাল হয় না।

জহির : বিডিআর বিচার প্রক্রিয়াটা কোর্টমার্শালের মাধ্যমে হলেও খোলামেলাস্বচ্ছ বিচার হবে বলে যেটা বলছিলেন...।

মইন : স্বচ্ছবিচার হতে পারে, নিয়ম বইতে লেখা আছে। আপনি থাকতে পারেন, সাংবাদিকরা আসতে পারেন। মানে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে। আমিই প্রথম ব্যক্তি যে কোর্টমার্শাল উন্মুক্ত করেছি। উদাহরণ আছে তো। কর্ণেল নুরুন্নবীর মামলা দেখতে পারেন। সেসময়কার হলিডেতে রিপোর্ট আছে, দেখতে পারেন। ঘটনাটি ছিল ১৯৮১ সালের। দেশদ্রোহী কাজের জন্য তার এবং একজন বেসামরিক নাগরিকের বিচার হয়েছিল। আইনজীবী আমিনুল হক যিনি পরে অ্যার্টনি জেনারেল হন, তিনি তার আইনজীবী ছিলেন। দুই বছর জেল হয়েছিল। উন্মুক্ত বিচার ছিল, পত্রিকায় বিচারের খুঁটিনাটি সব উঠে এসেছিল। ব্যাপারটা অন্যরা কেউ বুঝতো না, হলিডে বুঝতো বলে ধারাবাহিকভাবে বিচারের বিষয়টা রিপোর্ট করেছিল। এই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেই আমার আদেশেই সেই উন্মুক্ত বিচারটা হয়েছিল।

জহির : সেখানে এভিডেন্স অ্যাক্ট যেটা...?

মইন : এভিডেন্স অ্যাক্ট আমাদের যেটা আর বেসামরিক এভিডেন্স অ্যাক্টও একই। এখানে কোনো কিছু এদিক ওদিক নাই, একটা শব্দও না। সেনাবাহিনীর আলাদা কোনো এভিডেন্স অ্যাক্ট নাই। আর্মিতে ঐটাই প্রযোজ্য যেটা বেসামরিক আদালতে প্রযোজ্য। একেবারে একই পদ্ধতি। ঐ এভিডেন্স ছাড়া অন্য এভিডেন্স দিলে হবে না। আর্মির জন্য আলাদা কোনো এভিডেন্স দিতে পারবে না। এখন তো বুঝতে পারছি না, সরকার একেকবার একেক কথা বলছে। আবার শুনছি কিছু চুড়ান্ত হয় নি। সরকার আবার প্রসিকিউটর নিয়োগ করেছে। আবার প্রসিকিউটর নিজেই বলছেন, আমার তো এই মামলায় প্রসিকিউটর হওয়ার কথা নয়। তবে উনি ডিফেন্স কাউন্সিলর হতে পারেন। অবশ্য উনি ওটা বলেন নাই। আমি হলে বলতাম আপনি উল্টাটা হন, মানে ডিফেন্স কাউন্সিলর হন। কোর্টমার্শালে প্রসিকিউট করে থাকে আর্মি অফিসাররা।

জহির : আমি আপনার কাছে একটি জিনিষ জানতে চাচ্ছি, কোর্টমার্শাল হলে তো সাধারণত সামারি ট্রায়াল হয়...?

মইন : না, না। কোর্টমার্শাল তিন চার রকমের আছে। সামারি ট্রায়াল হয়ে থাকে ছোটখাট অপরাধে। এটা যেমন ছুটি ব্যতিরেকে অনুপস্থিতির জন্য সর্বোচ্চ ৩০দিন থেকে ১বছরের জেল দিতে পারে। এগুলো পরিচালনার ভার বেশিরভাগই সিওদেরকে দেওয়া হয়। ওটাকেই সামারি কোর্টমার্শাল বলা হয়। আবার জিসিএম, এফজিসিএম, ডিসিএম আছে। ওগুলো মেজর এবং তার উপরের কয়েকজন কর্মকর্তার একটা বোর্ড বসে করে।

নেসার : বিডিআর বিদ্রোহের সময় লিফলেট বিলি করা হয়েছিল।

মইন : আমি দেখেছি, এক সাংবাদিক আমাকে দেখিয়েছেন। তবে খবরের পরে পর্যাপ্ত পরিমাণ সতর্কতা নেওয়া হয় নি। কর্তৃপক্ষ যারা ছিলেন তাদের আরো সতর্কতা অবলম্বন করার দরকার ছিল। আমি এর আগেও এধরণের জিনিষ দেখেছি, বিশেষ করে ৭ই নভেম্বরে লিফলেট বিতরণ হয়েছিল। ওরা এক রাতই যাকিছু গন্ডগোল করতে পেরেছিল। তারপরে পারে নি। নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা যা নেবার তা নেওয়া হয়েছিল।

এখন তদন্তে বের হয়ে আসছে যে তারা আগেই লিফলেট পেয়েছিল। তাহলে এ ব্যাপারে জানার পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার দরকার ছিল। দেখেন, একটা সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনীতে উপায়-উপকরণ হলো মানুষ এবং অস্ত্রসস্ত্র, একেবারে প্রস্তুত সবকিছু তার উপরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকজন।

বিদ্রোহ কিন্তু তেমন একটা কিছু না। বিদ্রোহ ব্রিটিশ আর্মিতেও হয়েছে ইন্ডিয়ান আর্মিতে হয়েছে। শিখরাও বিদ্রোহ করেছে--ইন্দিরা গান্দির সময় স্বর্ণমন্দিরে সামরিক অভিযান চালানোর পর দুটো শিখ ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছিল। শিখদের স্বাধীন-ভূমি খালিস্তান আন্দোলনের সময়কার কথা। এরকম বিদ্রোহের ঘটনা সারা পৃথিবী জুড়েই আছে। আমার মনে হয়, কেন বিদ্রোহ ঘটে এবং কিভাবে তা সমাধান করা যায় তার মধ্যে অনেক কিছু শেখার আছে। এগুলো মোকাবেলা করতে অনেক ভুলত্রুটি হয়েছে। ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সে জন্য শিক্ষা নেওয়া উচিত।

নেসার : একটু বিস্তারিত বলবেন কি ঠিক কি ধরণের ভুলত্রুটির কথা বলছেন?

মইন : প্রথমত, যেটা বলছিলাম যে পূর্বসতর্কতা যেগুলো নেওয়া হয়েছিল সেগুলো হয়তো সরকারের কাছে পাঠানোও হয়েছিল। দরকার ছিল এগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে নজর দেওয়া। সরকার বলতে এখানে আমি সবাইকে বুঝাচ্ছি, বিশেষত যারা এরসাথে সংশ্লিষ্ট--সব কর্তৃপক্ষকে। গোয়েন্দা বাহিনীসহ সবাই। আমি হলে তাই করতাম। আমার এ ব্যাপারে কিছু অভিজ্ঞতা আছে, আমি খুব খারাপ সময়ে সৈনিকদের পরিচালনা করেছি। দেশে তখন খুব অস্থিরতা চলছিল। বাহাত্তর থেকে চুয়াত্তর পর্যন্ত আমি ঢাকা বিগ্রেডের অধিনায়ক ছিলাম। ঐসময় সেনাবাহিনীর মধ্যকার অনেক রিপোর্ট আসতো, আমরা তখন খুব সতর্কতার সাথে বিষয়গুলো মোকাবেলা করেছি। ফলে ঐসময় কিন্তু এরকম কোনো ঘটনা ঘটে নি। কোনো তথ্য আসলে আমি রাতে হলেও অফিসে চলে যেতাম, কথা বলতাম। দেখা যেতো সেটা হয়তো গুজব তবুও আমরা গুরুত্বের সাথে নিয়ে পরীক্ষা করতাম। কোনো হেলাফেলা করতাম না, কারণ এখানে জীবন জড়িত। তাই আমরা বলতাম, ‘প্রিকসন ইজ বেটার দ্যান প্রিভেনসন এন্ড প্রিভেনসন ইজ বেটার দ্যান প্রসিকিউসন’। এখন তো আমরা প্রসিকিউসনে যাচ্ছি, আগের দুটো ধাপে নজর দেওয়া হয় নি। পত্রিকায় যেটা এসেছে, আগেই লিফলেট বিতরণ করা হয়েছিল; সেক্ষেত্রে তো জানার পরে সতর্কতা নেয়া উচিত ছিল। আসলে হয় কি এইসমস্ত জিনিষের নিয়ম হলো যাদের নাম আমার কাছে এসেছে তাদেরকে ডেকে কথা বলা, জিজ্ঞাসাবাদ করা, তৎপর থাকা। আমি যদি অধিনায়ক হই আর কোনো বিষয়ে যদি আমার সন্দেহ হয়--সেখানে লিফলেট কে দিয়েছে না দিয়েছে সেটা নিয়ে অস্থির হয়ে যেতাম। আমি তো শুনেছি প্রশাসনিক ভবন থেকে শুরু করে অনেক মন্ত্রীসহ সবাইকে লিফলেট দেওয়া হয়েছে। আমরা তো একটা ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে চাকুরিতে এসেছি, অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝি, আমার হয়তো শান্তি মিশনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নাই কিন্তু দুইটা যুদ্ধের ভালো অভিজ্ঞতা আছে। আমি শুধু বাংলাদেশি না যুদ্ধকালীন সময়ে কাশ্মীরী সৈন্যও পরিচালনা করেছি দুই বছর। সেটা শান্তিকালীন মহড়া না। ঐযে আনুগত্যতার প্যারেড, লেফট রাইট করা, আনুগত্যের মহড়া দেওয়া সোজা। কিন্তু সেনাবাহিনীর পরীক্ষা হলো বা সেনা কর্মকর্তাদের আনুগত্যের পরীক্ষা হলো সংকটকালে তার ভূমিকা। এ জন্যই বলা হয়, অধিনায়কত্ব ধারণা হিসেবে সহজ হলেও বাস্তবে সফল প্রয়োগ দেখানো যথেষ্ট কঠিন।

বিপদকালীন সময়ে আপনি কি প্রতিক্রিয়া দেখান। এটা হলো তার পূর্বসর্তকতা। তারপরে কি হলো, যখন ঘটনা ঘটছিলো তখন আমরা কি করেছি? সেটা নিয়েও অনেক ব্যাপার আছে যেগুলো প্রশ্ন হিসেবে এসেছে। সেখানে অনেক অভিমত আছে, আমারও অভিমত আছে। স্বাভাবিকভাবে এগুলো নিয়ে তর্কবিতর্ক হতে পারে। কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলব, কি করার ছিল। প্রথম কথা হলো, ওখানে নিরাপত্তা বাহিনী ও সেনাবাহিনী যাওয়ার পরও কিভাবে এতলোক পালিয়ে গেল? ওখানে অধিনায়ক কে ছিলো, সরকার কি কাউকে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব দিয়েছিল? ওখানে র‌্যাব, পুলিশ, আর্মি ছিল; কিন্তু সর্বোপরি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার দায়িত্ব কার ছিল? ঠিক আছে, বুঝলাম ওরা না হয় ভিতরে গেল না কিন্তু পুরা জিনিষটাই--ওখানে ওইযে তামাশা হচ্ছিল, সাংবাদিকরা, আপনারা যাচ্ছেন আসছেন সেখানে আমি হলে এটা দিতাম না। কারণ আপনাদেরও তো জীবনের ঝুঁকি আছে। আমার দায়িত্ব হলো নাগরিকদের রক্ষা করা, সামাল দেওয়া। এটা ইরাকেও দিবে না, এমবেডেড সাংবাদিকদেরও দিবে না। কোনো দেশের বেলায় আমি এটা দেখি নাই, যেখানে গোলাগুলি হচ্ছে সেখানে সাংবাদিক বা সাধারণ নাগরিকরা ভেতরে যাওয়া-আসা করছে। সাংবাদিক বা অন্যরা তো যেতে চাইবেই কিন্তু আটকানোর দায়িত্ব আসলে কার ছিল? কোনো কিছুর নিয়ন্ত্রণ নাই, এজন্য বললাম আসলে অধিনায়কত্ব কার ছিল? মূলত আমি সেখানে কোনো অধিনায়কত্ব দেখি নাই। কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল, কার দ্বারা কে পরিচালিত হচ্ছিল? ঠিক আছে প্রধানমন্ত্রী যমুনায় বসে নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু ঘটনাস্থলে কে ছিল? ফলে অস্ত্রসস্ত্র নিয়েই অনেকে পালিয়ে যেতে পেরেছে। একটা ঘটনা ঘটলে তো পর্যবেক্ষণ করতে হবে, কে কোথায় যাচ্ছে না যাচ্ছে কি করছে না করছে, তাই না? প্রথমে এই বিষয়গুলোই তো আমরা নিয়ন্ত্রণে আনবো, ভেতরে না গেলাম। বাইরে থাকলেও তো কাজের একটা পরিধি থাকবে তাই না? এটা হলো তিনটার মধ্যে দুই নাম্বার ধাপ। জানার পরে সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ সবার দায়িত্ব ছিল পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। তার মানে ভিতরে ও বাইরে কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই।

এতবড় একটা ঘটনা, এটা তো হঠাৎ একদিনে হয় নি। শুনলাম অনেক আগে থেকেই এরা মিটিং করেছে। আমার এখন হাসি পায়, আমি নিজেও ২৬শে মার্চের আগে ১৯শে মার্চ ’৭১ সালে বাস্কেটবল মাঠে গিয়ে সৈনিকদের সাথে কথা বলেছি--যেটা আমার বইতে লিখেছি। মিটিং করেছি বিদ্রোহ করার জন্য। এরকমই সবকিছু, আমরাও তো বিদ্রোহ করেছিলাম পাকিস্তান আমলে। তখন পাকিস্তান আর্মি টঙ্গিতে ছিল, ঢাকায় ছিল। ঠিক আজকের মতোই কিছুটা। আসলে আমি নিজেই তো বিদ্রোহ করেছি ১৯৭১ সনে। এইজন্য বলছি যে আমার কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু না। স্বাভাবিক, কারণ আমি নিজেও এভাবে বাস্কেটবল মাঠে গিয়ে গোপনে মিটিং করেছি। ওরাও সায় দিয়েছে কিভাবে কি করা যায় পাকিস্তানিদের। সবাইকে কিন্তু বিদ্রোহের বিষয়টা বলা হয় না, একটা কোর গ্রুপ থাকে। সবাই জানলে তো বিষয়টা আর গোপন থাকে না। একটা কোর বা ভিতরে একটা সেল থাকবে, সেলে ২০-৩০ জন থাকতে পারে।

তো এক্ষেত্রে অধিনায়কত্বের অভাব ছিল। সাধারণ লোকজন তামাশা দেখছিল। কাউকে না কাউকে তো কমান্ডটা নিতে হবে। আমাকে ওখানে পাঠানো হলো আর আমি গিয়ে বসে থাকবো তা তো হতে পারে না। আমি নিয়ন্ত্রণভার তুলে নেব। কিন্তু এক ধরণের অপেশাদারিত্ব ফুটে উঠেছিল--সামরিক, আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে অপেশাদারিত্বের ছাপ ছিল সামগ্রিক ব্যাপারটাতে।

যাওয়ার পরে কি করবে এই অনুপুঙ্খ তো অন্য ব্যাপার। কিন্তু ঐ জায়গায় পৌঁছানোর পর কিভাবে অবরুদ্ধ করবে এই যে, পাঁচ-দশ হাজার সৈন্য পালিয়ে গেল কেন? কারণ পিলখানার চেয়ে সরল জায়গা তো আর নাই। ক্যান্টনমেন্ট তো জটিল জায়গা। কিন্তু ৭ নভেম্বর যে বিদ্রোহ হয় সেখানে আমরা পুরো সেনানিবাস অবরুদ্ধ করে ফেলেছিলাম যাতে একটি লোকও বের হতে না পারে, বের হয়ে গন্ডগোল করতে না পারে। সব গেটগুলো বন্ধ করেছি। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট অনেক বিস্তৃত এলাকা, পিলখানা থেকে অনেক জটিল। কিন্তু আমরা অস্ত্র নিয়ে পালাতে দেই নি। কারণ আমরা জানি কোন দিক দিয়ে পালাতে পারে। এইসমস্ত ব্যাপার মোকাবেলা করতে হলে আগাম সতর্ক হতে হবে। সেটা ছিল না। ওরা কিছু করার পরে তার পিছু পিছু ধাওয়া করে চলা।

তারপরে আসে তদন্তের প্রশ্ন। তদন্ত নিয়ে আমার অনেক কথা আছে। এটার টার্মস অব রেফারেন্স...

জহির : তদন্তের লক্ষণীয় দিকটা আপনি একটু বিস্তারিত বলেন?

মইন : তদন্ত বলতে যে আসলে কি হচ্ছে আমি জানি না, তদন্তের তো একটা অভিমুখ থাকে, টার্মস অব রেফারেন্স ঠিক করে দিতে হয়। সেদিন একজন মন্ত্রী বললেন মিডিয়ার ভবিষ্যতে কি করা উচিত। কি করা উচিৎ মানে! কী হয়েছিল আগে সেটা বলেন। বলল না মিডিয়ার সাথে বৈঠক করেছে। আমি তো এ কথার কোনো মানে বুঝলাম না। ভবিষ্যতে কি করা উচিত সেটা তো দেখা যাবে পরে। ঘটনাটা আগে বের কর। মিডিয়া সেখানে কেন গিয়েছিল, কি আগ্রহ তাদের? মিডিয়া যদি দোষ করে থাকে তাকে তদন্তের আওতায় আনতে হবে। এটা যে করলেন আপনি কার আদেশে, কে আপনাকে এসএমএস পাঠিয়েছিল? কে খবর দিয়েছিল? মিডিয়াতে যদি কোনো বিদ্রোহীরা খবর দিয়ে থাকে এসএমএস করে থাকে, তার রেকর্ড বের করেন। কিন্তু দেখলাম তদন্ত কমিটিতে বসে উনারা মিটিং করছেন মিডিয়ার আগামীতে কি করা উচিত এটা নিয়ে। ভবিষ্যতে চলে গেলাম অতীত ও বর্তমানকে ফেলে? এটা কোন ধরণের তদন্ত?

জহির : আপনি যেটা বলছিলেন, টার্মস অব রেফারেন্স-এ কি কি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে একটু বুঝিয়ে বলেন?

মইন : এখানে যে টিমটা তদন্ত করবে সে বিষয়গুলো পরিষ্কার না করে তিনটা তদন্তকারী সংস্থা কাজ করছে। সিআইডিকে আমি তদন্ত কমিটি বলব না। মূলত দুইটা তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু সিআইডি এমনভাবে কথা বলছে যেন তারা সহায়ক নয়, স্বাধীন তদন্ত করবে। পত্রপত্রিকা পড়ে মনে হচ্ছে তারাও একটা আলাদা তদন্ত করবে। তারা জাতীয় তদন্ত যে করছে বা আর্মির তদন্ত যে করছে তারা তাদের সহায়ক হবে। কিন্তু সিআইডি তদন্ত করছে ঠিক যেভাবে একটা অপরাধ তদন্ত করা হয় এটাকে বিদ্রোহ আকারে তদন্ত করছে না।

জহির: মানে একটা ফৌজদারি অপরাধের তদন্তের মতো?

মইন: হ্যাঁ। কিন্তু তারা এটা করবে সহায়ক হবার জন্য। কারণ, তথ্যপ্রমাণাদি যখন নথিভুক্ত হবে, যদি কোর্টমার্শাল হয়, কোর্টমার্শালে সামারি এভিডেন্সটা নথিভুক্ত হয়। তখন কিন্তু এই যে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি নেওয়া হয় এইগুলো অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে বাতিলও করে দিতে পারে। কোর্টমার্শাল বিচার প্রক্রিয়ায় একটু ব্যবধান আছে কিন্তু তথ্যপ্রমাণাদি একই। বিচার প্রক্রিয়ায় চার্জশীট দিতে হবে এবং ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী আছে তার উপর সামারি দিতে হবে। তখন যৌথ বিচার হবে না আলাদা বিচার হবে তা ঠিক হবে। সামারি কোর্টমার্শালে যৌথ বিচারে ২০ থেকে ৩০ জনের এক সাথে বিচার করা হবে। এ সমস্ত নানান টেকনিক্যাল দিক আছে। সরকারের কথাবার্তায় তো আমি বুঝতে পারছি না যে কিভাবে কি হবে।

জহির: আপনার কাছে কি মনে হয়, এ ধরণের তদন্তে কোন কোন দিকগুলোতে মূলদৃষ্টি দেওয়া হয়?

মইন: দৃষ্টি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানত কিছু ব্যাসিক জিনিষ রয়েছে। কারো গাফিলতি আছে কিনা, কারো উস্কানি আছে কিনা, অবহেলা মানে বিদ্রোহের সময় কিংবা আগে গোয়েন্দা বিভাগের যে দায়দায়িত্ব ছিল সেটাতে গাফিলতি হয়েছে কিনা। তারা কেন বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে নাই। লিফলেট হওয়ার পরে তারা বসে থাকলো কেন? তারা কি ৭ নভেম্বরের কথা জানে না, ৫ তারিখ সকালে লিফলেট বিতরণ হলো আর ৬ তারিখ যাওয়ার পর ৭ তারিখে বিদ্রোহ শুরু হয়। ইতিহাস পড়ে না কেউ। কোথাও মনে হয় কোনো মানসম্পন্ন লোক নাই।

বিদ্রোহ অনেক জায়গাতেই হয়েছে। বিদ্রোহের ব্যাপারে আমাদের অনেক কিছু জানার ও শিখবার আছে। এবং বিডিআর বিদ্রোহের পরে আমাদের অনেক ভুলত্র“টি হয়েছে। এ জন্য ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে, মনোযোগের সাথে বিশ্লেষণ করতে হবে। আর আমরা যদি রাজনীতি করি, করতে চাই, সেটা হবে--কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করতে চাইলে সেটাও হবে। আমরা কতটুকু আন্তরিকতার সাথে দেশের স্বার্থ এবং সংস্থার স্বার্থে অগ্রসর হতে পারব সেটাই বিবেচ্য হওয়া উচিত।

জহির : আপনি তদন্তের যে দিকগুলো উল্লেখ করলেন...?

মইন : এই নিয়েই তো চিন্তা, এগুলো দেখতে হবে। দোষী হলে স্বাভাবিকভাবে বিচার প্রক্রিয়ায় যাবে, সে ক্ষেত্রে তদন্তটা তো পরিষ্কার হতে হবে স্বচ্চতা থাকতে হবে। তা না হলে তো গুজবের ছড়াছড়ি চলবে। যেখানেই শূন্যতা থাকবে অস্বচ্ছতা থাকবে সেখানেই কিন্তু গুজব ছড়ায়। আর গুজব কিন্তু দেশের জন্য, সংস্থা বা জাতীর জন্য ভালো না। এখন পত্রপত্রিকায় একেকজন একক তত্ত্ব আওড়াচ্ছে। কেন আওড়াচ্ছে? কারণ, টার্মস অব রেফারেন্স, তদন্তের স্বচ্ছতা নাই।


mainul


জহির : বিডিআরের নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে আপনার অভিমত?

মইন : শুনেন, এগুলোতো কসমেটিক। যদুরে মধু বলবেন নাকি মধুরে যদু বলবেন সেটা অন্যকথা। নাম বদলানো--আমার মনে হয় রাগ অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী হয়ে কিছু করা ঠিক হবে না। ঠান্ডা মস্তিস্ক চাই। যাই করেন দেশের স্বার্থের জন্য, সংস্থার স্বার্থের জন্য করবেন। কারণ আমি মনে করি বিডিআর আগেও ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। আমি তাদের নিজে কমান্ড করেছি। আমার ব্যাটালিয়নে বিডিআরের প্রায় ৪০ শতাংশ সদস্য ছিল। দুইটা ব্যাটালিয়নকে আমি ঐসময় পরিচালনা করেছি। তখন নাম ছিল ইপিআর। এছাড়াও তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর। এটাতো অনেকে জানে না। প্রতিরক্ষা আবার কি, তারা তো শুধু সীমান্ত পাহারা দেয়। না, দেশে যখনই কোনো বিপর্যয় অথবা আমাদের সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে তারা কিন্তু ঐসময়ে আমাদের অপারেশনাল টিমের অংশ। আমাদের যে সামগ্রিক অপারেশন প্লান রয়েছে বিডিআর কিন্তু সরাসরি তার সাথে সম্পৃক্ত। ডিফেন্স কিংবা অফেন্স যাই বলি না কেন তারা সরাসরি সম্পৃক্ত। আর বিশেষ পরিস্থিতিতে তারা সেনাবাহিনীর অঙ্গ হয়ে যায়, সেনাবাহিনীর পরিচালনায় চলে আসে। আনসারের ক্ষেত্রেও তাই। ফলে বিডিআর শুধু সীমান্তে পাহারাদার এভাবে দেখাটা ভুল। দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হলে আমাদের সুযোগও একবার। হয় দেশকে রক্ষা করবেন, না পারলে দেশ পরাধীন হবে।

জহির: এক্ষেত্রে তো বিডিআর প্রতিনিয়ত যুদ্ধাবস্থার মধ্যে থাকে...।

মইন : এজন্যই তো ধরেন, পূর্বে বিডিআর সেনাবাহিনীর সাথে, মানে শীতকালীন যে মহড়া হতো তিন মাসের, তাতে সম্পৃক্ত থাকতো। আমি জানি না এখন এই যৌথমহড়া হয় কিনা। আমি নিজেও ঐ মহড়াগুলোতে অংশ নিয়েছি। অর্থাৎ যুদ্ধকালীন সময়ে অথবা দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে তারা কিভাবে আর্মির সাথে অংশ নিবে এটাই ছিল ঐ মহড়ার বিষয়। বিশেষ করে এটাকে বলা হয় সম্মিলিত প্রশিক্ষণ। একটা ব্রিগেড়ের অধীনে থেকে এটা হতো।

নেসার : এবার আপনাকে আরেকটা বিষয় জিজ্ঞাসা করবো, বিদ্রোহের পর একটা অভিযোগ এসেছে যে তাদেরকে দিয়ে বাসা-বাড়ির অনেক কাজ করানো হতো যেটা তাদের ডিউটির মধ্যে পড়ে না।

মইন : অভিযোগ কতটা সত্য আমি সে আলোচনায় যাবো না। তবে এধরণের কাজ করানোটা ঠিক নয়, যেটা তার পেশাদারিত্বের মধ্যে পড়ে না। তাদের আত্মমর্যাদার উপরে আঘাত করে। দেখুন ৭ নভেম্বরের সময় এসব অভিযোগ কিন্তু উত্থাপন হয়েছিল। ব্যাটম্যানের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে, সে সেনাবাহিনীর মধ্যে নির্দিষ্ট কতগুলো দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু তাদেরকে দিয়ে ঘর মোছাবে, কাপড় ধোঁয়াবে, বাথরুম পরিষ্কার করাবে এটা চলবে না। অনেকেই ব্যাটম্যানদের নিয়মবর্হিভূতভাবে খাটিয়েছে। ৭ নভেম্বর বিদ্রোহে ব্যাটম্যান প্রথা অপসারণ করার একটা বড় দাবি ছিল।

জহির : বিডিআর জাওয়ানদের দাবি তাদের মধ্যে এসমস্যাটা এখনো রয়েছে।

মইন : এগুলো যদি থেকে থাকে, তাহলে খতিয়ে দেখতে হবে। এবং ভবিষ্যতে যেন আর না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আসলে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাকে ফিরে যেতে হবে ৭ নভেম্বরের ইতিহাসে, যেটা একটা দুঘর্টনা বলব। প্রথম যারা বিপ্লব করেছে তারা এ বিষয়টা তুলেছিল। সকালে তারা অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে বিদ্রোহ করে। আমি তাদের সাথে গিয়ে বসি। আমার দায়িত্ব ছিল এটা। আমি একাই যাই ওদের সাথে। তারপরে আসেন চীফ অব স্টাফ। আমি তখন তাদের উদ্দ্যেশে বক্তব্য রাখি। তাদের তখনো বন্ধুক হাতে--খুন করেছে, গুলিও আছে। ঐ ব্যাটম্যানদের নিয়মবর্হিভূতভাবে খাটানো ১৯৭৫ সনে ৭ নভেম্বর সৃষ্টি হওয়ার পিছনে একটা বড় ইস্যু ছিল। আমি নিজেও জানতাম তাদেরকে দিয়ে অসম্মানজনক কাজ করানো হয়। যা কোনো অবস্থাতেই সৈনিকের পেশাদারি কাজ নয়। তারা কি কাজ করবে তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। যুদ্ধের সময়ও ব্যাটম্যান থাকে। তার কাজ হলো ইউনিফর্ম দেখা, সাথে থাকা এবং দেহরক্ষী হিসাবে কাজ করা। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমারও ব্যাটম্যান ছিল। সে আমার সাথে থাকত। বডির্গাড আকারে ব্যাটম্যান ব্যবহার হতো। ব্যাটম্যান-এর প্রথা তো এখন উঠে গেছে।

নেসার : এখন ধরেন, প্রথাটা যদি নাও থাকে তারপরও তাদের দিয়ে এসব কাজ করানো হয়।

মইন : এ প্রথা থাকার কথা নয়। থাকলে সেটা অনৈতিক হবে। এগুলো তো আপনার আমার সবারই শোনা কথা, তাইনা?

জহির : এগুলো যদি দীর্ঘদিন থেকে হয়ে থাকে এবং দরবারের মধ্যদিয়েও সমাধান না হয়, তাহলে?

মইন : তা হয়ে থাকলে অধিনায়কের কাজ এগুলো বন্ধ করা। আমাদের এসব বাহিনী তো সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুদ্ধ করবে। তাদের দিয়ে অপেশাদার কাজ করাবেন কেন? তারা তো ডোমেস্টিক এইড নয় যে আপনার পারিবারিক কাজে তাদের ব্যবহার করবেন। তার কাজ তো লিখিত আইনের মধ্যেই আছে। এগুলো যারা করায় তারা সামরিক বাহিনীর আইন ভঙ্গ করে। এবং সে আইন ভঙ্গ যদি খোদ অধিনায়কও করে থাকে তাহলে তারও শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। আসলে এবারে বিডিআর বিদ্রোহের পেছনে কারণ হিসাবে এসব ছিল কিনা তা তদন্তের মাধ্যমে পরিষ্কার হওয়া উচিত।

জহির : বিদ্রোহের কারণ হিসাবে এগুলো যদি উঠে আসে তখন কি হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

মইন : এগুলো অবশ্যই তদন্তের মধ্যে উঠে আসা উচিত। এজন্যই তো বললাম, কারণ বললে তো এগুলো উঠে আসবে সিরিয়াসলি। আমি তো ৭ নভেম্বরের তদন্ত দেখেছি। তারপর ১৯৭৭ সালের তদন্ত রিপোর্ট আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এসব তদন্ত করেই তো আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এগুলোতে অভিজ্ঞতার প্রশ্ন। কিন্তু বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে যারা তদন্ত করছে এদের কথাবার্তা তো সামঞ্জস্যহীন।

জহির : সেনাবাহিনীও একটা তদন্ত করছে। তদন্তের পরে ...

মইন : হ্যাঁ, তবে আমি জানি না তাদের তদন্তের টার্মস অব রেফারেন্স কি । সেনাবাহিনীকে তো একটা তদন্ত করতেই হয়। কারণ পারিবারিকভাতা ও অন্যান্য সুবিধার একটা ব্যাপার আছে, আগেও হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর একটা তদন্ত তো এরশাদ সাহেব করেছে, তারপরে আরেকটা আমাকে করতে হয়েছে। আরেকটা বেসামরিক তদন্ত হয়েছে। বিশ্বাস সাহেব তদন্তটা করেছিলেন। দেখা গেছে এসব রিপোর্টের মধ্যে অনেক তারতম্য ছিল। এরশাদের সরকারি তদন্তে অনেক জিনিষ গোপন করা হয়েছিল। আবার আমার তদন্তের আওতায় অনেক জিনিষ আনা হয়েছিল। তাতে অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছিল। আমার এখনো মুখস্থ আছে। আর উনারাতো রাজনৈতিকভাবে কিছু বিষয় আড়াল করতে চেয়েছিল। যেমন তাদের রিপোর্টে মঞ্জুরকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ রিপোর্টে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে মঞ্জুর কিছুই জানতো না। ঐসময় সৈনিকরা লিখিত বিবৃতি দিয়েছে আমার কাছে। এসব বিষয় আমার বইতে উল্লেখ আছে। তো, এই যে বললাম না অসামঞ্জস্যপূর্ণ...। সেনাবাহিনী তদন্ত করছে করুক।

জহির: সেনা তদন্তের আইনি ভিত্তি কি?

মইন: পারে। সেনাবাহিনীও তদন্ত করতে পারে যদি সরকার বলে। তবে একটাই তদন্ত হতে হবে। যদি বিচার বিভাগীয় তদন্ত না হয় তবে সেনাবাহিনী তদন্ত করতে পারে। আইনে তো আছেই, তাছাড়া তাদের লোক মারা গেছে। শুধু বিদ্রোহের ঘটনা নয়, কোথাও যদি তাদের অফিসার দুর্ঘটনায় মারা যায় অথবা বাইরে যদি তাদের গাড়িরও কোনো দুর্ঘটনা ঘটে সেখানেও তদন্ত হয়ে থাকে।

নেসার : পত্রপত্রিকায় আমরা রিপোর্টে যেটা দেখছি, পিলখানার ঘটনার দিন যে ৭৭ জন অফিসার বেঁচে আসতে পেরেছেন, ভিতরের প্রত্যক্ষদর্শী তো তারা, তাদের কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না।

মইন : ওরা তো ঘটনার সাক্ষী।

নেসার : তাদের জিজ্ঞাসাবাদের খবর তো আমরা পাচ্ছি না।

মইন : আসলে এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।

নেসার : আপনার কি মনে হয় উনাদের জিজ্ঞাসাবাদের দরকার আছে?

মইন : হ্যাঁ, অবশ্যই। আসল তথ্যপ্রমাণাদি তো ওদের কাছ থেকে আসবে। কারণ ঘটনার দিন তো ওরা ওখানে ছিল। যদি ওদের সাক্ষ্য আমি না দেখি তাহলে আমি তো বলব এটা কি এভিডেন্স হলো! শুধু সৈনিকদের নিলে তো হবে না, তাদেরও নিতে হবে। পত্রপত্রিকায় পরিষ্কারভাবে কিছুই পাচ্ছি না। তাছাড়া দেখছেন না একেক পত্রিকা একেক রকম রিপোর্ট প্রকাশ করছে। আমি প্রতিদিন বাংলাদেশের চার-পাঁচটা জাতীয় পত্রিকা পড়ি। সেখানে আমার নিজের কাছেও কোনো বিষয় পরিষ্কার না। নিচ্ছে বোধহয়। তবে আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না।

নেসার : তদন্ত চলাকালে দেখা যাচ্ছে যে, নির্যাতনের একটা ব্যাপার আসছে। যেমন বিডিআরের জাওয়ানরা মারা যাচ্ছে, অনেকের চোয়াল ভাঙ্গা, হাত পাত-পা ভাঙ্গা অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে...।

মইনুল : হ্যাঁ, আমিও এগুলো পত্রিকায় দেখেছি। এককথায় এগুলো বেআইনি। এটা আইনের মধ্যে পড়ে না বরং আইন ভঙ্গের মধ্যে পড়ে। তাদের উপরে নির্যাতন করা--আমেরিকার গুয়ান্তানামো বেতে যা হচ্ছে সেরকম। এগুলো অনৈতিক কাজ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা গোয়েন্দা বিভাগ জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন করা গুরুতর অপরাধ। এগুলো যারা করছেন তাদেরকে একটা কথা বলবো, তাদের তো কোনো অভিজ্ঞতা নাই। এগুলোর কিন্তু একটা ফলআউট হবে পরে। ঐযে আগে একটা উদাহরণ দিয়েছি, খতিব নামে এক সৈনিকের সেটা তাদের মনে রাখা উচিত। কিভাবে মেজরকে গুলি করে মারলো, কেন মারলো সেটা বোঝা উচিত। কারণ যদি তদন্তের নামে অত্যাচার করা হয় তাহলে পরে তার প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

জহির : সেনাবাহিনীর তো একটা বিবেচ্য থাকবেই, তার বাইরে আমরা নাগরিক হিসেবে কিভাবে পুরো বিষয়টা দেখব?

মইন : নাগরিকদের দিক থেকে এটা অমার্জনীয়। মানবাধিকার ইত্যাদি বড় কথা বলে লাভ নাই। এটা অমার্জনীয়, এটা বর্বরতা। এরকম কোনো বর্বরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।

জহির : এই যে তদন্ত চলাকালে যেসব জাওয়ানরা মারা গেলেন, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, এর বিচার হবার কোনো সুযোগ আছে?

মইন : যেকয়জন এ ঘটনায় মারা গেছে তার প্রত্যেকটার তদন্ত, ময়নাতদন্ত হওয়া দরকার। কিভাবে কি জন্য মারা গেল তা খতিয়ে দেখা দরকার। দেখুন অমি একটা ঘটনার কথা বলি, আমি যখন সিও ছিলাম দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নে, তখন আমার অধীনে একজন বেসামরিক লোক ধরা পড়ে সেনানিবাসের ভিতরে। অস্ত্রাগারের আশপাশে ঘুরছিল বলে সন্দেহে তাকে ধরে নিয়ে আসে। আমার যে আরপি হাওলদার তাকে মারধর করেছে এবং লোকটা মারা যায়। এতে আমার বিরুদ্ধে তদন্ত হলো এবং আমাকে সাবধান করা হলো। বলা হয়, তোমার খামখেয়ালিতে ঐ লোকটি মারা গেছে। আমি তাকে মারধর করতে বলি নি। সে তাকে মেরেছে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। লোকটা অসুস্থ ছিল। ফলে আমার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে একজন বেসামরিক লোক মারা গেছে বলে। আমি তখন অধিনায়ক, ঢাকা সেনানিবাসে ঘটনাটি ঘটেছিল। আমি মনে করেছিলাম লোকটাকে হাজতে দিয়েছে, দেখিও নাই বেচারাকে। সে মারা যাবার পরে কবরও দিয়ে দেওয়া হয়। তদন্তের জন্য কবর থেকে লাশ উঠিয়ে পরীক্ষা করা হয়। শরীরে ক্ষতচিহ্ন ছিল।

জহির : আমাদের দেশে নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে নির্যাতনের সমস্যাটা রয়ে গেছে।

মইন : এটা শুধু এক্ষেত্রে নয় অনেক আগে থেকেই চলছে। ঐযে অপারেশন ক্লিনহার্টের বিরুদ্ধে আমি জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। আমি আমার বই: ‘দেশটা কেমন করে এমন হলো’ তে এ ব্যাপারে লিখেছি। আর্মিকে দিয়ে এ ধরণের অপারেশন করানো ঠিক নয়, এবং তাদের দায়মুক্তি দেওয়া উচিত হয় নি।

জহির : এটা একটু বিস্তারিত বলেন।

মইন : ক্লিনহার্ট অপারেশনের পরে ওদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। আসলে এই ধরণের দায়মুক্তি সেনাবাহিনীর যে শৃঙ্খলা তাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। আমি নিজেও তো হাজারো ডিউটি করেছি। খালিশপুরে ডিউটি করেছি, গুলি করেছি, কই আমাদের তো কোনো দায়মুক্তি দেওয়া লাগে নি। কারণ, আমরা যেগুলো করেছি আইনের আওতায় থেকেই করেছি। দায়মুক্তি কেন, কিসের জন্য দায়মুক্তি। দায়মুক্তি তো দেয়া হয়েছিল মেজর ডালিম, রশিদ, ফারুক গয়রহকে দিয়েছিলেন খন্দকার মোস্তাক। যেটা ক্রিমিনাল। সেটা নিয়েই তো আমরা সমালোচনা করছি। অথচ অপারেশন ক্লিনহার্টের জন্যও দায়মুক্তি দেওয়া হলো বিএনপি আমলে, হাসান মশহুদ যেটা নিল। কেন মশহুদ দায়মুক্তি নেবে? তুমি কি মার্ডার করেছ? বেআইনিভাবে? আর তোমার সৈনিকরা করলে তোমার সাহস নাই তাদের বিচার করার? আমি তো দায়মুক্তি নেই নাই। ঐ যে উদাহরণ দিলাম, আমার হেফাজতে লোকটা মারা যাওয়ায় আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো। যদিও আমি তাতে সম্পৃক্ত না। বলি নাই জিজ্ঞাসাবদ করতে। অর্থাৎ আমি এতক্ষণ যেটা বলছি, দায়মুক্তি নেওয়া মানে সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। কেউ যদি শৃঙ্খলাভঙ্গ করে তা হলে অবশ্যই তার শাস্তি হতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এধরণের কোনো কর্ম করার সাহস না পায়। ঐযে ঐসময়ে দায়মুক্তি না দেওয়া হলে যৌথবাহিনীতে যারা গিয়েছিল তারা হুশিয়ার থাকতো। দুইএকজন অফিসারের কোর্টমার্শাল হয়ে দুইতিন বছরের সাজা হলে সেটা উদাহরণ হয়ে থাকতো। তাহলে বিগত দুই বছরে জরুরি অবস্থার সময়ে যা হয়েছে তা হতো না। এজন্য আমি বরাবরই বলি, দেখেন এগুলো কিন্তু ইতিহাস। তখন যদি দায়মুক্তি না দিয়ে, সে যে কেউই হোক না কেন, যদি অতিরিক্ত কিছু করে থাকে কিংবা কাউকে মেরে ফেলে তার বিচার হওয়া দরকার ছিল। অবশ্যই অভিযোগ গঠন করতে হবে। হয় চাকুরি থেকে বরখাস্ত নয়তবা জেলে দিতে হবে। তখন এই অফিসাররা সতর্ক থাকতো। তা না হলে তারা তো পার পেয়ে যাবে সবাই।

জহির : রাষ্ট্র যখন সেনাবাহিনীকে কোথাও কোনো কাজে পাঠায় যেমন ধরুন পার্বত্য চট্টগ্রামে, সেখানেও আর্মির বিরুদ্ধে এ ধরণের গুরুতর অভিযোগ আছে।

মইন : পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন, নির্যাতনের বিষয় আর্মির কোনো বইতে নাই।

জহির : তারপরেও নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে, তার কোনো প্রতিকার হয় নি?

মইন : প্রতিকার না হলে তো শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সামরিক বাহিনীর সামগ্রিক শৃঙ্খলা নষ্ট হবে।

নেসার: ক্রসফায়ারের ঘটনাকে কিভাবে দেখবেন?

জহির : র‌্যাব তো সামরিক বাহিনীর সদস্যরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিচালানা করে থাকেন।

নেসার: সেখানে অনেক সেনাঅফিসার ক্রসফায়ারের ঘটনায় সরাসরি যুক্ত।

মইন : আমি বলব এগুলো ঊশৃঙ্খলতা, সবক্ষেত্রে ঊশৃঙ্খলতা। এটা দেখার দায়দায়িত্ব সরকারের। আমি তো নিজে কখনো কোনোদিন এসবের সাথে একমত পোষণ করতাম না। সামরিক বাহিনীকে এভাবে দায়মুক্তি দেওয়াটা যদি আমি সরকারে বা সামরিক বাহিনীতে থাকতাম তবে এটা কখনোই করতাম না। দায়মুক্তি এটা কোন আর্মিতে আছে? কিসের দায়মুক্তি। তারা যদি এমন কোনো কাজ করে থাকে..., তারা আইনের নির্দেশ পালন করে, ইন এইড অব সিভিল পাওয়ার, এটা তো আইনি দায়িত্ব। আর্মি আইনে এসব ব্যাপার লেখা আছে। এরা তো জানেও না কিছু। আমাদের আর্মিতে অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। আমরা দশবছর চাকুরির পাঁচ বছর বিদেশে কাটাই। বাকি পাচঁ বছর বিবিএ-এমবিএ করে বেড়াই। অর্থাৎ বস্তুত, সেনাবাহিনীর কোনো নিয়মের মধ্যে আমি নাই।

এই যে দায়মুক্তির প্রশ্ন। সেখানে আছে, যদি একজন অফিসারের বিচার হয় সেনাআইনে তাকে আর সিভিল কোর্টে বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না। যদি একজন অফিসার নির্যাতন করে আর আর্মি কোর্টে বিচারের পর যদি বলা হয় না তুমি নির্যাতন কর নাই, তাহলে আপনি তার বিরুদ্ধে সিভিল কোর্টে কোনো মামলা করতে পারবেন না। কোনো আইনেই আর দ্বিতীয়বার বিচার অনুমোদিত নয়। সিভিলে ট্রায়াল হলে আবার আর্মির কোর্টে ট্রায়াল করতে পারবেন। মিলিটারি আইনও সংবিধানের অধীনে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা সভ্য দেশে দু’ ধরণের আইন আছে--সামরিক ও বেসামরিক আইন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনের কিছু হেরফের থাকলেও মৌলিক নীতিগুলি একই। যাকে বলা হয়েছে আইনের শাসন। আর্মিও আইনের শাসনের অধীনে বা তাকে সেটা রক্ষা করতে হবে।

নেসার : বিডিআর ঘটনাকে কেন্দ্র করে পত্রপত্রিকায় কিছু ব্যক্তির কাছ থেকে আমরা শুনছি যে, ঘটনার সাথে বিদেশীদের একটা ষড়যন্ত্র আছে, এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?

মইন : বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে। আসলে এটা বিশ্বাসযোগ্য না যে আমাদের দেশে বিদেশীরা গুপ্তচরবৃত্তি করে না। কিন্তু আজ পর্যন্ত শুনেছেন কি কোনো বিদেশী গুপ্তচরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাছাড়া বেসামরিক লোকজনের মধ্যেও অনেক গুপ্তচর রয়েছে। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স কি অনেকে বোঝেই না। বাইরের লোক যেমন গুপ্তচরবৃত্তি করতে পারে, সাথে সাথে দেশের লোকও করতে পারে। আপনারা শুনেছেন কখনও বিদেশী গুপ্তচরদের ট্রায়াল-এর কথা? কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বলতে কোনো কিছুই নাই আমাদের দেশে। শুধু শত্রু রাষ্ট্রের মধ্যে নয়, বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যেও হয়। শুনেন না, চায়না, জাপান, আমেরিকা তারা একজন আরেকজনের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করে। নানান রকম গোয়েন্দা তৎপরতা আছে। নানান ধরণের ফাইলপত্র নিয়ে যায়, তারা দেখে কি আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা। এ ব্যাপারে তথ্যাদি চুরি করতে পারে। যেটা বাইরে হয়। তাদের ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স আছে।

রাষ্ট্র তো শুধু সামরিক না। এখানে স্বার্থের ব্যাপার আছে। এটাতো ধরে নেওয়া হয় এক রাষ্ট্র তার স্বার্থের কারণে অন্য রাষ্ট্রের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করবেই। আমেরিকা বৃটেনে করে, বৃটেন ফান্সের উপর করে। এটাতো চলবেই। বিদেশীরা কেউ বাংলাদেশের মধ্যে গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে এটা আমি শুনি নাই। কথা বলে সব অনুমানের উপরে। এটা প্রতিরোধ করতে গেলে আমাদের ম্যাকানিজম দরকার, প্রশিক্ষণ দরকার। রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করে তাদের পারদর্শীতা দরকার। তাদের মনস্তাত্ত্বিক উন্নতি দরকার। কারণ, তাদের দিক থেকে বোঝা উচিত রাষ্ট্রের স্বার্থ কি? এগুলো তো নীতিপ্রণয়নের বিষয়। এগুলো শুধু জেনারেল সাহেব, কর্ণেল বা মেজর সাহেব করতে পারে না। রাষ্ট্রের সামগ্রিক নীতির উপর বিষয়টা নির্ভর করে।

অনেকদেশ থেকে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য কূটনীতিকদের বের করে দেয়, অথবা শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বা কূটনীতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজের জন্য। কূটনীতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত--ভিয়েনা কনভেনশন বিরোধী কাজ বাংলাদেশে যে রকমের হয় দুনিয়ার কোথাও আমি তা দেখি নাই। আমি এটা হলফ করে বলতে পারি। আমাদের রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করছেন তাদেরও বলতে পারি, বাংলাদেশে কূটনীতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত যতকাজ হচ্ছে মনে হয় আইভোরি কোস্টেও তা হয় না। লাইবেরিয়াতেও হয় না।

জহির : তাহলে তো প্রশ্নটা আসে আদৌ আমাদের রাষ্ট্র আছে কিনা?

মইন : আসলে আমাদের জাতীয়চরিত্র কি সেটা বোঝার দরকার। জাতীয়চরিত্র শুধু আমার একার চরিত্র নয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমষ্টিগত চিন্তাধারা থেকে জাতীয়চরিত্র গড়ে ওঠে। জাতীয়চরিত্র বলতে আমরা কী বুঝি? এর প্রথম কথা হলো রাষ্ট্রের প্রতি আমার কতটা আনুগত্য আছে। আমরা কি আদৌ আমাদের দেশের প্রতি আনুগত্যশীল? রাজনৈতিক নেতাদের, আমাদের বা সমষ্টিগতভাবে সবার দেশের প্রতি আনুগত্য আছে কিনা সেটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এটা শুধু কথাবার্তা বলে প্রমাণ করা যায় না। আনুগত্য হলো কাজের প্রশ্ন। আমার আপনার কর্ম দিয়েই সেটা প্রমাণ হবে। আমরা অনেক কথাই শুনেছি ও শুনছি। আর আমার দুর্ভাগ্য অথবা সৌভাগ্য বলতে পারেন, আমি একদম প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশের সাথে সম্পৃক্ত নানাভাবে। দেশে ভালো অবস্থানে থেকে চাকুরিও করেছি। বাংলাদেশে কেউ মেজর জেনারেল হিসেবে ১৮ বছর বোধহয় চাকুরি করেন নাই। কিন্তু আমাকে একই র‌্যাঙ্কে রাখা হয়েছিল আঠারো বছর। আমি যখন মেজর জেনারেল তখন আর্মিতে ১০-১১জন মাত্র মেজর জেনারেল। তো আঠারো বছর মেজর জেনারেল থেকে এবং বাইরে ষোল বছর রাষ্ট্রদূত থেকে অনেক কিছু দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, অনেকের সাথে মেলার সৌভাগ্য হয়েছে। এই অভিজ্ঞতার আলোকেই বলছি যে, আমাদের বাংলাদেশের প্রতি সমষ্টিগত আনুগত্যের অভাব রয়েছে। যা আছে সেটা হলো ব্যক্তির প্রতি আনুগত্য। অনেকদিন আগে নিরদ চন্দ্র চৌধুরীর একটা বই পড়ে ছিলাম, তিনি লিখেছেন, বাঙালির একটা খারাপ স্বভাব হলো একটা প্রভু নিঃস্ব হয়ে গেলে, আরেকজনকে প্রভু বানায়। এই চরিত্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমরাই আমাদের প্রভু। আমাদের বাইরের প্রভুর দরকার নাই। আমরা কারও সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাত করতে ইচ্ছুক নই। আর আমরা বিদেশীদের শিষ্টাচার বহির্ভূত কোনো কাজ ও কথার প্রতিবাদ করতে পারি না, কিন্তু নিজেদের মধ্যে সেটা খুব পারি। এটা হলো আমাদের আরেকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

নেসার : সেনাবাহিনীর সৈনিক আর বিডিআর সৈনিক উভয়েই মধ্যে বেতন বা রেশন নিয়ে কোনো বৈষম্য আছে কিনা?

মইন : আছে বোধ হয়। বিমান বাহিনী আর সেনাবাহিনীর মধ্যেকার ছিল। বিমান বাহিনী একটু বেশি রেশন পেত। আমি থাকতেও ছিল। পরে শুনেছি সমান সমান করে দেওয়া হয়েছে। দেখেন আমি যখন সামরিক বাহিনীতে ছিলাম তখন আমি অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল ছিলাম। আমার কাজ রিক্রুটিং, আইনশৃঙ্খলা, বিচার-আচার করা। ১৯৭৬-এর দিকে ছিলাম। আমি একবার বগুড়ায় এক দরবারে গিয়েছিলাম। সেখানে দরবারে বলেছিলাম দেখেন আপনাদের বেতন বড়ানোর ব্যাপারটা সরকারের সিদ্ধান্ত। আমরাও বিষয়টি নিয়ে সুপারিশ করব। কিন্তু আপনারা যদি মনে করেন দাবিদাওয়া দিয়ে বেতন বাড়িয়ে নিবেন তাহলে আমি একাজে নাই। আমি এর বিরোধিতা করব। কারণ আপনারা এখানে চাকুরিতে আসার আগে পত্রিকায় দেখেছেন কত বেতন। ভয় দেখিয়ে বেতন নিবেন? আমি কিন্তু ভয় পাওয়ার লোক না। সেকরম রেশনের ব্যাপারটা তারা জানত না--এটা ঠিক না। তাদের সেটা জেনেই ঢোকার দরকার ছিল। যেখানে রেশন বেশি পাবে সেখানেই তারা যেত। আমি তখন ওদের বলেছি আপনারা ফ্যাক্টরিতে যান। কারণ ওখানে দাবিদাওয়া আদায় করা যাবে। আপনারা তো আসছেন ভলান্টিয়ার আর্মিতে। অবশ্য সময় তো একই রকমের থাকে নি। আর্মির মধ্যেও শস্তা জনপ্রিয়তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা করে আর্মির সর্বনাশ করা হয়েছে। যেমন এটা দিয়ে দিমু, ওইটা দিয়া দিমু, যা চাইবে সেটা দিয়া দিমু। আর এগুলো করে আর্মিকে যেমন শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানো যায় না, তেমনি সত্যিকার অর্থে অধিনাকত্ব করা যায় না। অধিনায়কত্ব করতে গেলে লাগে সততা ও নিষ্ঠা। আসলে মূল কথাটা হলো আপনাকে আগে দেশের সার্বিক অবস্থা দেখতে হবে। খন্ডিতভাবে দেখলে চলবে না। আর খন্ডিতভাবে দেখলেই আপনি ঝামেলায় পড়বেন। আপনাকে প্রথমেই মনে রাখতে হবে আমাদের আর্মি পাকিস্তানি আর্মি নয়। আর্মি আমাদের সমাজেরই অংশ। আর্মি তখনই ভাল থাকতে পারবে, যখন দেশের জনগণ ভাল থাকবে। আর্মির সৈনিকরা তো আমাদের এই উর্বর মাটি থেকেই এসেছে।

নেসার : দেখুন আমি প্রশ্নটা অন্যদিক থেকে করেছি। যেমন ধরুন, আমাদের নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী, আর্মি ও বিডিআর এদের বেতন কাঠামো ও রেশনে বৈষম্য কেন ?

মইন : হ্যাঁ, ওই যে বললাম বৈষম্য তো আছে। আর্মির সাথে বৈষম্য ছিল বিমান বাহিনীর আবার নৌ বাহিনীরও। এটা আজকের বিষয় নয়। অনেকদিন আগ থেকে।

নেসার : এধরণের বৈষম্য থাকা উচিত কিনা এটাই আমার জিজ্ঞাসা।

মইন : এটা নানান কারণে ছিল। এখন ধরেন একজনকে দিলে তো আরেকজনকেও দিতে হবে। যেমন ধরেন ওই যে বিডিআর ফুটাইছে কিছু গুলি, পুলিশরে সব দিয়ে দিলেন। এই দেওয়াটা যদি ন্যায্য হয় তাহলে আগে দিলেন না কেন? এখন দিলে তো খারাপ উদাহরণ সৃষ্টি হবে। কালকে চতুর্থশ্রেণীর কর্মচারীরা বলবে আমাদেরও দিতে হবে। দাবির তো শেষ নাই।

দেখুন আর্মিতে একটা বিশেষ ব্যাপার আছে। যেমন অফিসার হিসাবে আপনি যদি দায়িত্বশীল হন, আপনি যদি অন্যায় না করেন আপনাকে কিন্তু সবাই পছন্দ করবে। আজকে জিয়ার জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা দরকার। জিয়া খুব শক্ত লোক ছিল। আর্মির মধ্যে সবচেয়ে বেশি শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন, অধিনায়ক হিসাবে। এ কারণে তো আর্মি দাঁড়িয়েছে। তারাও জানে একাজগুলো জিয়া করেছে। যাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, সেও তাকে শ্রদ্ধা করেছে। কিন্তু আপনি অধিনায়ক হয়ে বলেন একটা করেন আরেকটা। নিজের জন্য আরেকটা অবস্থান নেন। তাহলে তো আর্মি দাঁড়াবে না। এগুলোতো আর্মির মধ্যে গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের দেশে আর্মির মধ্যে ব্যাটম্যান প্রথা নিয়েই কিন্তু লেগেছিল। তাহের তো ব্যাটম্যান প্রথা দিয়েই আর্মিকে উস্কাতে পেরেছিল। এটা কলোনিয়াল প্রথা। এই প্রথা, সেই প্রথা ইত্যাদি। ব্যাটম্যানের কাজ তো আর্মি অফিসারের ওয়াইফের কাপড় ধোয়া, বাচ্চাদের প্রসাব-পায়খানা পরিষ্কার করা নয়। এগুলো করিয়ে থাকে কিছু কিছু অফিসার। যেমন করিয়েছে, তেমনি শাস্তিও হয়েছে। মূলত আর্মির মতো সংস্থায় যদি অধিনায়কত্ব ঠিক না থাকে, তাহলে, নিচের স্তরের অফিসারদের মধ্যে এগুলো ঘটবেই। এবং বিদ্রোহও হবে। আমি কিন্তু হতভম্ব নই, বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে। কিন্তু আমি মর্মাহত; এত লোকের জীবন যাওয়াতে। আমাদের যে অবস্থা চলছে তাতে বিদ্রোহ যে হবে না এটা ভাববার কারণ নেই। আমার জন্য এ ধরণের বিদ্রোহ কোনো খবর না। আমার জন্য খবর ওটাই এত লোকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বিদ্রোহটা প্রথম ধাপে হবেই। সেটা যাতে না হতে পারে সেজন্য দৃঢ় অধিনায়কত্ব দরকার।

আমি নিজেও তো স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেখেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরেও দেখেছি। আর ওই যে ব্যাজ না পরা ড্রেস না পরা একই নাটক হয়েছে। আর এখন বিডিআর নিয়ে করছে, ব্যাজ পরে না তাদের অফিসাররা কেউ।

জহির : আপনি আর একটা কথা বলছিলেন যে, দুটোর তদন্ত প্রক্রিয়া এবং বিচার প্রক্রিয়াতে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের একটা বিবৃতি থাকা দরকার।

মইন : হ্যাঁ, এটা তো দরকার। স্বাভাবিকভাবেই, তদন্ত তো নিরপেক্ষ হওয়া দরকার। উনারা ওই সময়ে কি নির্দেশ দিয়েছিলেন না দিয়েছিলেন তার রেকর্ড থাকবে না? এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। এটা যদি জুডিশিয়াল ডিপার্টমেন্টে ঘটত, তাহলে করত না? ন্যায়বিচার করতে চাইলে বলতে হবে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। প্রধানমন্ত্রীও না। কিন্তু আসলে নো বডি ইজ এভাব ল বাট একস্পেট প্রাইমিনিস্টার এন্ড চীফ অব স্টাফ! ওই যে, বলি না আইন নিজের প্রক্রিয়ায় চলবে। আমরা বলি, আইন নিজের গতিতে চলবে তাই না? আসলে আইন আমি যেভাবে চাই সেভাবেই চলবে--এটাকেই বলে নিজস্ব গতি। ফলে তদন্ত হচ্ছে আবার নানা ধরণের গুজবও ছড়াচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা থাকলে গুজব ছড়াবে। আর এসব সমস্যাকে ভালভাবে বোঝার চেষ্টা না করলে ভবিষ্যতে আরো বিদ্রোহ ঘটবে।

নেসার : এখন ধরুন বিডিআর বিদ্রোহের পরে অনেকগুলো টিম পিলখানায় যাচ্ছে। এবং তদন্ত চলাকালীন সময়ে বিডিআর-এর নিজস্ব ক্যামেরায় ধারণকৃত তৎকালীন ছবি বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

মইন : না এটা ঠিক না। সরকারের উচিত প্রেসরিলিজ দেওয়া--এগুলো আমরা বলি নাই। এর অর্থ হলো তদন্ত টিমগুলোর মধ্যে সমন্বয় নাই। এর আগে, যে সমন্বয়ক ছিল সে তো বলেই বসল জঙ্গিরা একাজ করেছে। আমি তো তার কথা শুনে হাসলাম। মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি লোকটার। সে জঙ্গি কোথা থেকে দেখল। তদন্তের আগে কি দেখা যায়। এগুলো হলো দায়িত্বহীন কথাবার্তা। এতে বোঝা যায় আমরা কত অপরিপক্ক জাতি। অথবা আমরা যে পদে আছি সেই পদের জন্য যোগ্য না। একটা কথা আছে কি জানেন, কাক কত বড় উচু মিনারে বসেছে সেটাতে কিছু আসে যায় না। কারণ সে বাজপাখি হতে পারবে না। কাকই থাকবে। কা কা করবে। আর বাজপাখি কিন্তু চুপচাপ থাকবে। আসলে কাকে মন্ত্রী বনাচ্ছেন কি বানাচ্ছেন এতে হয় না। তারা তো অপরিপক্ক। আমি নিজে বড়মন্ত্রী ছিলাম, তিন মাসের জন্য। ওটা নিয়ে কিছু মনেও করি না। কিন্তু অনেক কিছু দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য হলো ১৬ বছর ধরে দেশে-বিদেশে অনেক কিছুই দেখেছি। এজন্যই বলছি- আমাদের মধ্যে দায়িত্বহীনতা রয়েছে।

আর নির্যাতন যেসব হচ্ছে, সে সম্পর্কে তো বলেছি। ওই ক্লিনহার্ট করার পরে আমি বলেছিলাম এতে আর্মির শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হবে। এটা লিখিত বলেছি। কি হয় নাই? ওইদিন দুইটা-চারটা কোর্টমার্শাল যদি হতো, তাহলে, আর্মি অফিসাররা ভয়ে থাকত। সেদিন থেকে যৌথবাহিনী উল্টা-পাল্টা কাজ করার সাহস পেত না। তখন বলতো না আমি আইনসম্মত কাজ করব। উনি বললেন আর আমি করে ফেললাম এটা ঘটত না। এদের সাহস চড়েছে ওই ক্লিনহার্ট অপারেশনের সময় থেকে।

আর ক্রসফায়ারের ঘটনা, আমরা বহুত দেখেছি এগুলা। আমি বললাম না আমার বিরুদ্ধেও ইনকোয়ারি হয়েছে একটা অপ্রকৃতস্থ লোক মারা যাওয়ায়। সেটা তো ঠিকই করেছে। কারণ দায়িত্ব তো আমার। আমার অধীনস্ত লোকেরা তো করেছে। আমি এটা নিয়ে সতর্কতা পেয়েছি। এটা তো দোষের কিছু নয়। শৃঙ্খলা রক্ষা করতে গেলে অফিসার হিসাবে এসব কিছুরই আমাদের মুখোমুখি হতে হবে।

নেসার : আমার আর একটি প্রশ্ন আছে। যেহেতু বিষয়টি বেশ কয়েকবার উঠে পড়েছে। সেটা হলো--আমাদের দেশে পুলিশ, বিডিআর-আর্মির মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলোকে শক্তিশালী না করে র‌্যাবের মতো কিছু বাহিনী তৈরি করছে। এগুলোর কি আদতেই প্রয়োজন রয়েছে?

মইন : শুনেন আসলে হয়েছে কি, একটা কথা বলি। খুবই সত্যি কথা। আমরা জাতি হিসাবে খুবই আনপ্রফেশনাল। সবকিছুর মধ্যে এটা পাবেন। আসলে এদেশের বহুত দুর্গতি আছে। দেশের সবকিছু শেষ করে ফেলা হয়েছে। সেখানে র‌্যাব কেন আরো অনেক কিছুই বানাতে পারে। নিজেদের রক্ষা পেতে হবে তো!

জহির : এতো অব্যবস্থাপনার পরেও এখন আমাদের দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেমন হওয়া দরকার?

মইন : একটা জিনিষ আমি বলি--দেশের ভিতরে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সবসময় বাইরের আগ্রাসন ডেকে আনে। যে কোনো দেশের ক্ষেত্রে এটা সত্য। দেশের মধ্যে যখন আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকবে তখন বাইরের আগ্রাসন আসবে। এটা কিন্তু নিয়ম। যুগ যুগ ধরে এটা হয়েছে। ব্রিটিশরা একারণ ধরেই ভারতবর্ষ দখল করতে পেরেছিল। মোগলরাও এভাবেই এসেছে। এটাই তো ইতিহাস। তো দেশের প্রতিরক্ষার প্রশ্নটি হলো, যদি আপনি বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে থাকেন, তাহলে বাংলাদেশের প্রতি আপনার আনুগত্য রয়েছে কিনা সেটাই মৌলিক বিষয়। দেশপ্রেম আরো পরের বিষয়। ঠিক না। ফলে দেশের প্রতি সকলের আনুগত্য আছে কি না এটা আজ বড় প্রশ্ন। এটা নিয়ে আমার নিজেরও সংশয় আছে। আর অনেকেই মনে করে এদেশ বেশিদিন টিকবে না। যতপার কামিয়ে নাও এদেশ থেকে। অধিকাংশের এটাই হলো মনোভাব। এদেশের জীবন শেষ হয়ে আসছে। ফলে তারা টাকা পয়সা বানিয়ে সিকিউর হতে চাচ্ছে।

জহির : মানে ব্যর্থ রাষ্ট্র ?

মইন : ব্যর্থতা মানে কি? আমরা কি সফল? আমরা তো নিজেরাই বেহুদাই মনে করি বিরাট একটা জাতি। কিন্তু আত্মবিশ্লেষণ করি না। আত্মসমালোচনা করি না। আসলে আত্মবিশ্লেষণ করতে না পারলেই সমস্যা হয়। একটা সমস্যার নিখুঁত সমাধান পেতে হলে আগে সমস্যাকে জানতে হবে।

জহির : আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের দীর্ঘ সময় দেওয়ার জন্য।

মইন : আপনাদেরকেও ধন্যবাদ। আসলে অনেক কথাই বলা হলো।

 বিডিআর বিদ্রোহের মাসখানেক পরে নেওয়া সাক্ষাতকার। সাক্ষাতকার নিয়েছেন, নেসার আহমেদ ও মুসতাইন জহির


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।