মাহমুদুর রহমানের জামিন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার


মাহমুদ রহমান জামিনে ছাড়া পাবার পর প্যারিস, জেনেভা ও হংকং- থেকে দুটো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন যে সংবাদ ছেপেছে তার প্রথম লাইনটি ছিল এরকম: “অবশেষে ১৩২২ দিন পরে ‘আরবিট্রেরি ডিটেনশান’ থেকে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান জামিনে ছাড়া পেলেন’।

‘আরবিট্রেরি ডিটেনশান’ কথাটার এক শব্দে সহজ বাংলা করা কঠিন। এটি একটি আইনী পরিভাষা। এর মানে হোল খেয়ালখুশী মতো স্বেচ্ছাচারী কায়দায় একজন নাগরিককে কারাগারে বন্দী করে রাখা। একটি দেশে যখন আইন আদালত বলে কিচ্ছু থাকে না, তখন যাকে তাকে যখন খুশি তখন গ্রেফতার করা যায়, ফালতু ও মিথ্যা মামলা দেয়া যায়, র‍্যাব-পুলিশ-সেনাবাহিনী দিয়ে নির্যাতন করা যায়। এই খেয়ারখুশি স্বেচ্ছাচারের রাজত্ব -- যার দ্বারা নাগরিকদের অন্যায় ভাবে গেফতার ও নির্যাতন করা হয় -- তাকেই বলা হয় ‘আরবিট্রেরি ডিটেনশান’।

মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির মূর্ত প্রতীক হয়ে গিয়েছেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের আইন, আদালত, শাসন ব্যবস্থা মূল্যায়নের প্রধান মানদণ্ড হিসাবে হাজির হয়েছেন। বিভিন্ন দেশের আইন বিশারদ, মানবাধিকার কর্মী, বিচারকদের কাছে মাহমুদুর রহমান এখন একটি‘কেইস স্টাডি’। যাকে দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থা, বিচারকদের ভূমিকা, গণমাধ্যমের বিটলামি, সাংবাদিকদের নৈতিকতার অবক্ষয় ইত্যাদি সবকিছুর বিচার চলে। চলবে। যারা মাহমুদুর রহমানের চিন্তার সমালোচনা করেন, কিম্বা ঢোঁক গিলতে গিলতে তার মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারন করবার আগে তিনবার তার নিন্দা করেন, ইতিহাস শেষাবধি তাদের ক্লাউন ছাড়া অধিক কিছু গণ্য করবে না। 

বাংলাদেশের প্রধান ইস্যু মাহমুদুর রহমানের চিন্তা, রাজনীতি বা আদর্শ নয় – যে কোন মত নিয়েই পক্ষে বিপক্ষে তর্ক হতেই পারে। হবেও বটে। কিন্তু মূল প্রশ্ন হচ্ছে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ সাহস নিয়ে দাঁড়ানো এবং রাষ্ট্র, আদালত ও প্রশাসনকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করা। মাহমুদ সেই দুর্দান্ত কাণ্ডটির নৈতিক, আদর্শিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব যেভাবে ধরতে পেরেছেন এবং নিজের জীবন দিয়ে তার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছেন তার সমান কোন সম্পাদককে আমি তার পাশে দেখি না। মাহমুদুর রহমানকে আমি সে কারনে সব সময়ই নিঃশর্তে সমর্থন করেছি। করব। দেশে বিদেশের প্রতিটি মানবাধিকার কর্মীর এটাই কর্তব্য। ভাড়াখাটা রাজনৈতিক ক্যাডারদের বাদ দিলে এটা বাংলাদেশের প্রতিটি সংবাদকর্মীদেরও দায়।

যে দুইটি সংগঠন এই বিবৃতি দিয়েছে তাদের একটি হচ্ছে মানবাধিকার কর্মী সুরক্ষার আন্তর্জাতিক নিরীক্ষণ কেন্দ্র (Observatory for the Protection of Human Rights Defenders বা FIDH-OMCT); অন্যটি এশীয় মানবাধিকার কমিশন (Asian Human Rights Commission বা সংক্ষেপে AHRC)। তারা বলেছে তাঁর জামিন অনেক আগেই হওয়ার কথা ছিল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংঠনগুলো জানে যে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা সবগুলা মামলাই ভূয়া। অতএব তাঁরা আবেদন জানিয়েছে যেন অবিলম্বে তাঁর বিরুদ্ধে করা সকল ভূয়া মামলা তুলে নেওয়া হয়।

দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান জেলে আছেন ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল থেকে। পুলিশ দৈনিক আমাম্র দেশ পত্রিকায় জোড় করে ঢুকে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করে। বিগত প্রায় সাড়ে তিন বছরে তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ৭৪টি মামলা দায়ের করা হয়। এমনকি এমন সব মিথ্যা মামলায় তাঁকে জড়ানো হয় যখন তিনি স্বয়ং পুলিশের হেফাজতে বন্দী। তাঁকে আদালত বারবার জামিন দিলেও যখনই তাকে কারাগার ছাড়তে যায় তখনই নতুন আরেকটি ফৌজদারি মামলা দিয়ে তাঁকে আটকে রাখা হয়। নভেম্বরের তিন তারিখে আপিল বিভাগ তাঁর বিরুদ্ধে করা সর্বশেষ মামলায় তাঁকে জামিন দেয়। কিন্তু পুলিশ ও আদালত তাকে আরও তিন সপ্তাহ আটকে রাখে।

ঠিক যে অনেকেই মাহমুদুর রহমানের মতোই কারাগার বরণ করেছেন, নির্যাতীত হয়েছেন। তাঁদের গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়। কিন্তু বিচার বিভাগ যখন তাকে ‘চান্স এডিটর’ বলল, মাহমুদ বিচলিত হন নি। মাহমুদুর রহমান বিচার বিভাগের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আদালত তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনেছিলো। আমি সেদিন আদালতে হাজির ছিলাম। একজন বিচারক যখন মাহমুদুর রহমানকে ‘চান্স এডিটর’ বললেন, আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। আমার তখন সংবিধান অনুযায়ী বিচারকদের শপথের কথা মনে পড়লো: “আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহত আচরন করব”। বিচার চলছিলো আদালত অবমাননার। মাহমুদুর রহমান কিভাবে সম্পাদক হয়েছে্ন, কিম্বা আদৌ সম্পাদক কিনা সেটা আদালতের বিবেচ্য বিষয় নয়। এই ধরনের মন্তব্য সংবিধান অনুযায়ী ‘বিরাগের বশবর্তী’ হওয়ার মধ্যেই পড়ে। অথচ বিচারকরা সংবিধান ও শপথের অধীন। এই মন্তব্য একই সঙ্গে সংবিধান ও শপথ ভঙ্গের দোষে সর্বাংশে দোষী মন্তব্য। যে বিচারক এই মন্তব্য করেছেন তিনি ধারণা করতে অক্ষম যে এই ধরণের মন্তব্য বাংলাদেশের বিচারের ইতিহাসে একটি কলংক হয়ে থাকবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের কাছে এই একটি মন্তব্যই প্রমাণ হিসাবে রয়ে গিয়েছে যে আদালত অবমাননার যে দণ্ড বিচারকরা দিয়েছেন তা ‘বিরাগের বশবর্তী’ হয়েই দেয়া হয়েছে। আমরা এখন বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাস করি। কূয়ার ব্যাঙ হিসাবে থাকার দিন এখন আর নাই।

এরপর অন্যান্য নাগরিকদের ক্ষেত্রেও আদালত অবমাননা নিয়ে আদালতের ভূমিকা আমরা দেখেছি। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, মত প্রকাশ, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা মোটেও কাগুজে ব্যাপার নয় এটা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র অর্জনের সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত। নির্ভীক ও দৃঢ়চিত্ত ভূমিকার জন্য মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলনের সামনের সারিতে সে কারণেই অনায়াসেই চলে এসেছেন। নাগরিকদের বিশ্বাস, চিন্তা বা মতাদর্শ সাংবিধানিক বা বৈচারিক প্রক্রিয়ার জন্য অপ্রাসঙ্গিক। এটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। মাহমুদের লড়াই সেই দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বাধ্য করেছে। আপনি সেকুলার হলে আপনার প্রতি এক ধরণের আচরন আর ইসলামপন্থি হলে আপনার জন্য ভিন্ন নিয়ম – আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে এই রকম কোন বিধান নাই, মাহমুদ নিজেও আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘মুসলমানদের মানবাধিকার থাকতে নেই’। কথাটা অনেকের বুকে শেলের মতো বিঁধেছে। আপনার কথা আপনার মত করে বলা, আপনার চিন্তা আপনার বিবেক প্রকাশের পুর্ণ অধিকার আপনার রয়েছে। নাগরিক ও মানবিক অধিকারের এই ক্ষেত্রের ওপরই মাহমুদ দাঁড়িয়েছিলেন। এবং এই অবস্থানই জন্যই তিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠির নজর কেড়েছেন। এই লড়াই একই সঙ্গে ফ্যসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পড়াই। অনেকের ভুল অনুমান যে তথাকথিত ধর্ম বিদ্বেষী বাম বা প্রগতিশীল না হলে মানবাধিকারের জন্য লড়াই করা যায় না। মাহমুদ তাদের গালে চড় মেরে দিয়েছেন। তরুণদের কাছে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে নিরাপোষ লড়বার কোন আদর্শ ছিল না। তারা একটি নজির খুঁজে পেলো। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাঁর মধ্যে মানবাধিকারের পক্ষে এক বিরল লড়াকুকে আবিষ্কার করলো।  বিরল এ কারনে যে তিনি স্রেফ আইন ও আদালতের ময়দানে নিরস্ত্র ভাবে নীতিনৈতিকতার ক্ষেত্রের ওপর দাঁড়িয়ে লড়ছেন। কারন রাষ্ট্রের গোড়া তার গঠনতন্ত্রে, তার আইনী বিধানে। তিনি সেখানেই রাজনীটির কেন্দ্রবিন্দু বা ভরকেন্দ্রকে সাধারণ মানুষের জন্য স্পষ্ট করতে চেয়েছেন। এখানেই মাহ্মুদের রাজনৈতিক তাৎপর্য।

আদালত মাহমুদুর রহমানকে ‘চান্স এডিটর’ বলায় গণমাধ্যমের মুচকি মুচকি হাসিও আমরা দেখেছি। এই ইতিহাসগুলো ভুলবার নয়। বিভিন্ন সম্পাদকীয় পাতায় পরিতৃপ্তির ঢেঁকুরও শুনেছি: যাক আমরা হৈলাম সাচ্চা সম্পাদক, আর মাহমুদ চান্সে এডিটর – এটা আদালতই বলে দিল। মাহমুদ তাঁর লড়াই দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন স্বাধীন সংবাদপত্র এবং মেরুদণ্ড সম্পন্ন সম্পাদক বলতে কী বোঝায়, এবং তার ভূমিকা কী হতে পারে। তখনও মাহফুজ আনাম কিম্বা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার রুষ্টতার প্রমাণ আমরা দেখি নি। আদালত অবমাননার খেসারত তাদেরকেও দিতে হয়েছে। কিন্তু দিতে হয়েছে ভেজা বেড়ালের মতো। মেরুদণ্ডসম্পন্ন মানুষের মতো নয়। মাহমুদুর রহমান সবাইকে যার যা প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। মেরুদণ্ড সম্পন্ন মানুষ আর অমেরুদণ্ডী প্রাণির ফারাক তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। শুধু একারনেই মাহমুদুর রহমান সংবাদপত্রের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

মাহমুদ জামিনে ছাড়া পেয়েছেন, বিচার চলছে। আশা করি মিথ্যা মামলা আদালতে মিথ্যা বলেই প্রমাণিত হবে। জানা কথা, লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে লড়াইয়ের ময়দানও নতুন ভাবে বিন্যস্ত হয়। এখানে বলা দরকার, উচ্চ আদালত এখন যে ভূমিকা নিয়ে ও সুনির্দিষ্ট রায় দিয়ে তাঁকে জামিনে মুক্তির আদেশ দিয়েছেন আমাদের অবশ্যই তাকে সাধুবাদ জানাতে হবে। তদুপরি আদালত স্বীকার করেছেন বিদেশে তাঁর বিশেষ চিকিৎসা দরকার। কাশিমপুর কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে মাহমুদুর রহমান সরাসরি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি গুরুতর অসুস্থ। এখন দরকার তাঁর সুচিকিৎসা। আশা করি আদালত রায় অনুযায়ী সেই ব্যবস্থা যেন নেওয়া যায় তা ত্বরান্বিত করবেন।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চোখে তিনি শুধু আর সাংবাদিক নন, মানবাধিকার রক্ষার যোদ্ধা। তারা বলছে তাঁর বিরুদ্ধে যেসব মামলা দেওয়া হয়েছে সেগুলোর কোন ভিত্তি নাই। ভূয়া। এটা বিচার ব্যবস্থার ঘোরতর অন্যায়। অতএব বিচার ব্যবস্থার উচিত অবিলম্বে সেইসব মামলা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা এবং ভুয়া অভিযোগের হার রহেকে মাহমুদুর রহমানকে নিষ্কৃতি দেওয়া। ওএমসিটির সেক্রেটারি গিরাল্ড স্টেইব্রক খুবই কড়া ভাষায় বলেছেন,

“We strongly condemn the judicial harassment that led to the prolonged arbitrary detention of Mahmudur Rahman and the ill-treatment he suffered in this framework. We call upon the authorities of Bangladesh to order an immediate, thorough, effective and impartial investigation into the above mentioned facts, and to stop criminalising human rights defenders with the clear aim to muzzle them”।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভূমিকার জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

 


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।