ফরহাদ মজহার


Tuesday 03 February 15

print

এক

জসীম উদ্‌দীন যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তাঁর বয়স একশ বছর পার হতো। মরে যাওয়ার পর বিখ্যাত মানুষদের এই রকম একশ বছর চলে যেতে থাকলে আমরা ঘটা করে কিছু একটা করার চেষ্টা করি। অনেকের বেলায়, যথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেটা তো করতেই হয়। রবীন্দ্রনাথকে আমরা এত চিনি এত জানি যে তাঁকে নিয়ে জাঁকজমক খুবই নরমাল ব্যাপার হয়ে ওঠে। নজরুলেরও একটা আসন আছে আমাদের মধ্যে, তবে রবীন্দ্রনাথ না নজরুল বড় এই বৃথা তর্ক সমাপ্ত হয় না। যার মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক ইতিহাস দুটো সম্প্রদায়ের বিভক্ত অভিজ্ঞতা ও সম্প্রদায়ের পরিচয় উঁকি দেয় । প্রতি বছরই আমরা বরীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী ইত্যাদি করি। করা উচিতও। তবে এতেই তাদের প্রতি আমাদের দায় শোধ হয় কিনা সেই তর্কও করা যায়।

তুলনায় জসীম উদ্‌দীন কখনই তেমন সমাদর পাননি। ঔপবেশিকতার বদৌলতে সাহিত্য বিচারের একটা ‘আধুনিক’ মানদণ্ড তৈরি হয়ে যাওয়া একটা কারন হতে পারে। তবে রবীন্দ্রনাথ কবিতা বিচারের নিক্তি হয়ে ততোদিনে সমাসীন, আর যুগপৎ ঠাকুরের ধারাবাহিকতা মেনে এবং প্রতিদ্বন্দী হয়ে তিরিশের কাব্যাদর্শের আধিপত্যও কারনের অন্তর্ভূক্ত। মধ্যে নজরুল ইসলাম। তবুও বাংলাদেশে তাঁর একশ বছর উপলক্ষে একটি উদ্যোগ লক্ষ্য করে দারুণ ভাল লাগছে। জসীম উদ্‌দীন সম্পর্কে যাঁদের কিছু করা উচিত ছিল তাঁরা কিছুই প্রায় করেন নি, কিন্তু ‘আলোকচিত্রী’ নাসির আলী মামুন ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের পক্ষে ‘শতবর্ষে জসীম উদ্‌দীন’ শিরোনামে একটি স্মারকপত্র প্রকাশ করেছেন (মামুন ২০০৩)। নাসির বলছেন, ‘যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি কবি জসীম উদ্‌দীনের জন্মশতবর্ষে ভাল একটি বই পাঠকের হাতে তুলে দিতে’। ভাল কাজ। যারা কাজটি করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই। এবং বইয়ের পেছনে যাঁরা পরিশ্রম করেছেন তাঁদের সবাইকে গভীর কৃতজ্ঞতা।

নজরুলের পরে জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্তকে আমরা যতটা আদর করেছি জসীম উদ্‌দীনকে তেমন করিনি। সমাজ, রাজনীতি ও কবিতার সম্পর্ক সন্বন্ধে আমরা এতকাল কী ধারণা নিয়ে চলেছি আর হামেশা চলি তার মধ্যে এই অনাদরের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। সেই ধারণা দিয়ে তৈরি নিক্তি জসীমউদ্দীনের ওজন কমিয়ে দেখায়। যে আড়তে তিনি বিক্রির জন্য ওঠেন সেখানকার বেপারিরা আলাদা। খদ্দের অন্যরকম, তিনি তো ভারে কম হবেনই। তাঁর সময়ে বাংলা সাহিত্য নিজেকে ইউরোপীয় ও নাগরিক অর্থে ‘আধুনিক’ বলতে ও ভাবতে শুরু করেছে। ফলে ‘আধুনিক’, ‘আধুনিকতা’ ইত্যাদিকে নানান দিক থেকে পর্যালোচনা করবার ক্ষমতা সমাজে গড়ে না উঠলে জসীম উদ্‌দীনের কদর নির্ণয় কঠিন। সে ক্ষমতা আমরা আজও অর্জন করেছি কিনা সেটা তর্ক সাপেক্ষ। ফলে তাঁর মূল্যায়ন এখনও ব্যক্তিগত রুচি বা অভিরুচির অধিক কোন তাৎপর্য বহন করবে না। আমাদের করোটির মধ্যে নতুন হাওয়া যদি প্রবেশ না করে, আমরা নতুনভাবে ভাবতেও পারি না। ফলে সাহিত্যের যে-বিচারে কবিদের বেঁটে বা দেবতা বানাই যদি সেই বিচারের মানদণ্ড, আইন বা সংবিধান না পাল্টাই বেঁটেরা বামনই থেকে যান আর বামন ক্রমে মহামানব হয়ে ওঠে। সব দেশেই এ ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ বিশেষ ব্যতিক্রম নয়; অন্যদের তুলনায় আমরা তেমন কিছু খারাপ জাতি নই।


Jasim


জসীম উদ্‌দীন আমাদের কাছে আজও বোধহয় বামন হয়েই আছেন। হোক সেটা। তাঁকে দেবতা বানানোর দরকার নেই। কিন্তু তাঁর প্রতি অবিচারে আমাদের সকলেরই খুব ক্ষতি হয়।  জসীম উদ্‌দীনের একশ বছর যখন আসছে আসছে করছিল তখন ভয় পেয়েছিলাম তাঁকে বোধ হয় একটা দায়সারাভাবে বিদায় দেয়া হবে। তাঁকে খালি হাতে বিদায় দেয়া হয় নি, এটাই আনন্দের। তাঁর প্রতি আমাদের আগ্রহ হয়তো বেড়েছে। ক্রমে আরও বাড়বে কি না সেটা শুধু জসীম উদ্‌দীনের ওপর নির্ভর করবে না। সমাজ ও রাজনীতির ওপরও নির্ভর করবে। সমাজ, রাজনীতি বা সংস্কৃতি শিল্প-সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্বকে পুরাপুরি রুচি বা নন্দনতত্ত্বের নিরিখে নির্ণয় করে না। যেমন কবিতা ভাল বলেই সেটা জনপ্রিয় হয় না। কিম্বা জনপ্রিয় হলেই ভাল হবে তারও কোন নিশ্চয়তা নাই। জনপ্রিয়তারও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মূল্য আছে। কবিতা ভালকিম্বা জনপ্রিয় হলেই তার সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রভাব যুগান্তকারী হবে এমন কোন কথা নাই। অনেক কবির কবিতাই যুগান্তকারী কারণ তাদের কবিতা সমাজ ও রাজনীতির আগাম পরিবর্তনের আভাস দিতে সক্ষম, কাব্যের নন্দনতত্ত্ব বা শৈলী নিয়ে কূটতর্ক করেও সেই প্রভাব ক্ষুণ্ণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। জসীম উদ্‌দীন সম্ভবত সেই কুলের কবি।

দুই

আমি কয়েক বছর ধরে জসীম উদ্‌দীন পড়ছিলাম। একদমই অন্য কারণে। আমি ও আমার অনেক সহকর্মীরা মিলে খানিক চাষাবাদ করি, চাষাভূষার সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। আমরা ‘নয়াকৃষি’ নামে চাষীদের সঙ্গে চাষাবাদের একটা ধরণ গড়ে তোলার চেষ্টা করছি যাতে কোন সার, বিষ বা ডিপ ওয়েলের পানি না লাগে।  ফলন ভাল অথচ পোকামাকড় আলাই-বালাই নাই। একে বিজ্ঞানীরা বলেন প্রাণবৈচিত্র্যভিত্তিক চাষাবাদ (Biodiversity-based Ecological Agriculture) । ইংরেজিতে গুরুগম্ভীর মনে হলেও এর সারকথা হচ্ছে বৈচিত্র প্রকৃতির নিজের বৈশিষ্ট্য, ঐ বৈশিষ্ট আছে বলেই ওর মধ্যে প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে, বৈচিত্রের নানান প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি নিজের শক্তি প্রদর্শন করে। এই বৈচিত্র রক্ষা একই সঙ্গে প্রকৃতির প্রাণ বা আন্তরিক শক্তিকেও রক্ষা করা। তাহলে কৃষির কাজ হচ্ছে এই প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশের মধ্য দিয়ে পরিমানগত ও গুণগত ভাবে প্রকৃতির কাছ থেকে মানুষের চাহিদা আদায় করে নেওয়া এবং একই সঙ্গে মানুষের কাছ থেকে প্রাপ্য প্রকৃতির চাহিদা, দেনা বা দাম মিটিয়ে দেওয়া।

এর একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক দিকও আছে। সেটা হোল, বৈজ্ঞানিকতা ও টেকনলজির নির্বিচার পূজা করতে গিয়ে প্রকৃতিকে ‘জয়’ করবার যে সংস্কৃতি ও জীবাশ্মভিত্তিক সভ্যতা গড়ে উঠেছে তাকে পর্যালোচনা করতে শেখা। প্রকৃতির ধ্বংসের ওপর যে সভ্যতা গড়ে উঠেছে সেটাই মানুষের একমাত্র গন্তব্য হতে পারে না। প্রকৃতি ধ্বংস করে মানুষ শুধু নয়, কোন প্রাণই বাঁচতে পারে না। উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতির চর্চা করে আমরা দেখাতে চেষ্টা করি বিকল্প সম্ভব। কৃষি আর ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশান সমার্থক নয়। যে শুধু ‘আধুনিক’ বলেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্বিচারে প্রয়োগ করতে হবে তার কোন কথা নাই। ধ্বংসাত্মক দিক সম্পর্কে সজাগ থেকে ও তা পরিহার করে প্রাণের বৈচিত্র ও বিকাশকে নিশ্চিত করতে পারে সৃষ্টিবান উদ্যোগ আবিষ্কার সম্ভব এবোং সেটাও বিজ্ঞান ও নতুন কৃৎকলা বটে। সেই নতুন বিজ্ঞান ও কৃৎকলা চাষাবাদে আত্মস্থ করা সম্ভব। এতে ফলন যেমন বাড়ে প্রকৃতির বিকাশও নিশ্চিত করা যায়। প্রাণ ও পরিবেশের কোন ক্ষতি হয় না। এই চাষাবাদ পদ্ধতি পুরানা কৃষিচর্চাকে ধরে রাখবার আবদার করে না। কারণ আধুনিক কৃষি না হলেও চিরাচরিত কৃষিচর্চা পরিবেশ ধ্বংস করে নি সেটা ঠিক নয়। মূল কথা হচ্ছে প্রকৃতির যে প্রাণশক্তি তাকে চেনা এবং সুরক্ষা ও বিকাশই মূল কথা। এ কালে এই চিন্তা যতো তীব্র ভাবে এখন পরিবেশ আন্দোলনের ফলে হাজির অতীতে তেমন ছিল না। অতএব যে কৃষির চর্চা আমরা করি সেটা পুরানা কৃষি নয়, নতুন ধরণের কৃষি। এর নাম তাই ‘নয়াকৃষি’।


nakshi


প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের একটা সহজ দিক আছে। সেই সহজের নিজস্ব প্রাণশক্তি আছে তাকে তত্ত্বে বা বৈজ্ঞানিক সূত্রে হাজির করা কঠিন। সেটা কৃষিচর্চার মধ্য দিয়েই – অর্থাৎ প্রকৃতিকে ‘জয়’ করবার বাসনা নিয়ে নয়, আপন করে নেবার মধ্য দিয়ে ‘ধরা’ যায়। বাংলার ভাবচর্চার সঙ্গে নয়াকৃষির সঙ্গে এখানে একটা গোড়ার মিল আছে। এই গোড়ার মিলটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে বাংলার সাধকদের জ্ঞান বা ভাবচর্চার সঙ্গে নয়াকৃষি হাত ধরাধরি করেই চলে।

এক হিশাবে কৃষিপ্রধান সব দেশের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যেরই নানা বৈচিত্র্য আমরা হদিস করতে পারি। বাংলাদেশের কৃষির এটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ কারনে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশের বন্ধুবান্ধব মিলে আমরা পরস্পরের কাছ থেকে জানার আর শেখার একটা বন্ধু সমিতি বনিয়েছি। ইংরেজিতে যাকে বলে নেটওয়ার্ক। এর নাম South Asia Network on Food, Ecology and Culkture (SANFEC) । এটা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর খাওয়া, প্রাণব্যবস্থা আর সংস্কৃতিকে কাছে থেকে, ভালবেসে কিন্তু আরও পর্যালোচনামূলক অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝার একটা চেষ্টা। আমরা ভালই করছি।

জসীমউদ্দীনকে পড়ছিলাম এরকম একদমই ভিন্ন একটা জায়গা থেকে। আমি দেখলাম জসীমউদ্দীনের কবিতা, নাটক আর গদ্য সবই আমি আমার কাজের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে পারছি, কিন্তু তাঁর সমসাময়িক কোন ‘আধুনিক’ কবি কিম্বা তাদের লেখালিখিকে পারছি না। তিনি গ্রাম নিয়ে লিখেছেন, সেই কারণে নয়। গ্রাম নিয়ে রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন। তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মহাশ্বেতা অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু জসীমউদ্দীন যে ‘গ্রাম’-কে লিখেছেন তার স্বাদ অন্যরকম। এই অনুভূতি বোধ হয় তাঁর সব পাঠকেরই হয়।

জসীমউদ্দীন ‘আধুনিক’ নন। এটা কে না জানে। যেমন, তিনি আর সুধীন দত্ত একদমই এক কাতারের নন। আর ঠিক এই জন্যই তিনি আমার কাছে দারুণ আরও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠেন। অন্য দিকে আমার মনে খালি জার্মান দার্শনিক হেগেলের একটা কথা কাদামাটিতে বাঁশের খুঁটির মতো গভীরভাবে বিঁধে আছে বহু দিন। সেটা হোল ইতিহাস মানে গদ্য, হিস্টরি ইজ প্রোজ। একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যখন গদ্যের জগৎ তৈরি হওয়া শুরু হয় তখন সে ইতিহাসের জগতে প্রবেশ করে, নিজেকে ঐতিহাসিকভাবে ভাবতে শুরু করে। মিথ সংস্কার, কল্পনার জগৎ পুঁথি সয়ফলমুলক ও বদিউজ্জামান বা গুলে বকাওলি কিংবা অন্য দিকে সত্য নারায়ণের পুঁথি, মঙ্গল কাব্য ইত্যাদির জগৎ থেকে ইতিহাসে বাঙালি মুসলমানের প্রবেশ ও হাজির হবার লক্ষণগুলো কী করে ধরব সে জিজ্ঞাসা আমার আছে। ঠিক এই জায়গা থেকে, অর্থাৎ একটি জনগোষ্ঠীর বেড়ে ওঠার ইতিহাসের দিক থেকেও জসীম উদ্‌দীন দারুণ ইন্টারেস্টিং।

একটু তর্ক লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। আমরা জসীমউদ্দীনকে প্রথাগত অর্থে ‘কবি’ বলে গণ্য করতে অভ্যস্ত। তিনি কবি অবশ্যই কিন্তু যদি বলি তাঁর কবিতা মূলত ছন্দে লেখা কাহিনী। তাহলে? অথচ তাঁর সময়ে কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা কবিতা বহুদূর এগিয়ে গিয়েছিল। তিনি কবিতার আদর্শ ‘আধুনিক কবিতা’ থেকে নিলেন না কেন? নাকি তাঁর জনগোষ্ঠীর জগৎ তখনো নগরায়নের অর্থ জানে না, বোঝে না। অথচ একই সঙ্গে তাদের মধ্যে ওহাবি, ফারায়জি এবং ইংরেজিবিরোধী সংগ্রাম চলছে। ওর মধ্য দিয়ে সাড়া দিচ্ছিল ইতিহাসবোধ। কবিতার জগতের ভেতরে একটা গদ্যের অঙ্কুর দেখা যাচ্ছিল। আর ঠিক এ কারণেই, এটা আরেক কারণ, জসীমউদ্দীন বোধ হয় অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ।

কবিতা প্রথাগত অর্থে একটা ভাব ধরার চেষ্টা করে। সেটা কবির দিক থেকে। কিন্তু পাঠকের দিক থেকে একটা রস সৃষ্টির কোশেশ চালায়। জসীমউদ্দীনও কবিতা লিখতে গিয়ে সেসবের জন্য প্রাণান্ত, বোঝা যায়। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে তাঁর কবিতার মধ্যে মৈমনসিংহ গীতিকার মতো একটা কাহিনীর ছাপ থেকে যায়। একে কী করে ব্যাখ্যা করব? তিনি কি মৈমনসিংহ গীতিকা মার্কা লেখালিখিরই ধারাবাহিকতা? এই কারণেই কি দীনেশচন্দ্র সেন তাকে এত পছন্দ করতেন? আসলেই মিথ, কল্পনা বা রূপকথার জগৎ থেকে তাঁর কবিতার জগৎ আলাদা কি? আমার তো মনে হয় আলাদা। কাহিনী, গদ্য বা একটি গল্প বলার জগতে যখন আমরা প্রবেশ করি তখনই কি আমাদের ইতিহাস-ধারণা দানা বাঁধতে শুরু করে? এই অর্থেই কি হেগেল বলেছিলেন, ইতিহাস হচ্ছে গদ্য। কবিতার জগৎ ইতিহাসের জগৎ নয় হেগেলের এই কথা খোলাসা করে বোঝার প্রয়োজনীয়তা এখনো শেষ হয়নি। প্রশ্ন আমারও রয়ে গেছে।

কিন্তু আমি যে কারণে তাঁকে পড়ছিলাম সেটা ঠিক এসব কারণেও নয়। এগুলো বলে রাখছি আমার অন্বেষণের দিগন্তটা বোঝার জন্য। আমি তাঁকে পড়ছিলাম বাংলাদেশের প্রাণের বৈচিত্র্য কিভাবে নিজেকে প্রকাশ করার ভাষা ও ভাব সন্ধান করেছে সে দিক থেকে। ‘প্রাণের বৈচিত্র্য’ কথাটার একটা পেশাগত মানে আছে। প্রাণবৈচিত্র্য চুক্তি (Convention on Biological Diversity) সম্পর্কে বা এসব বিষয়ে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন তাঁরা ‘প্রাণবৈচিত্র্য’ কথাটির অর্থ বুঝবেন। গাছাপালা পশুপাখি জীব-অণুজীব ইত্যাদির বৈচিত্র্য তো আছেই একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রাণ বা জীবনব্যবস্থার বৈচিত্র্য, তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ঘরসংসার, খাওয়াদাওয়া, চলাফেলা, জন্মমৃত্যু- ইত্যাদি সবই প্রাণবৈচিত্র্যের বিষয়। শুধু তাই নয়, প্রাণ ও অপ্রাণের সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্কের বৈচিত্র্যও প্রাণবৈচিত্র্যের অন্তর্ভুক্ত। বেশ বড় ব্যাপার। আমাদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণের বৈচিত্র্যের ভাষিক প্রকাশ -- অর্থাৎ কিভাবে ভাষার বৈচিত্র্য হিশেবে প্রাণ নিজেকে হাজির করে সেই সদানন্দ অভিপ্রকাশের সন্ধান করা ও স্বাদ নেয়া। জসীমউদ্দীনের কবিতার মধ্যে সেই স্বাদ পেয়ে আমরা একটু মুশকিলে পড়ে যাই। যে নান্দনিক রুচির কথা কয়ে ‘আধুনিক’ কবিতা নিজের জন্য স্থান করে নিতে চায় সেই রুচির সঙ্গে তার কবিতা মেলে না। অন্য দিকে তাঁর কবিতাকে ‘পল্লীকবিতা’ বলা যাচ্ছে না। পল্লীর আবহ, ছবি ও প্রতীক থাকলেই কি সেটা পল্লীকবিতা হয়? সেই আবহ ভিন্ন ভাবে জীবনানন্দেও আছে। পল্লীকবিতা বলে কিছু আছে নাকি? কবিতার এই শ্রেণীভেদ আর্থ-সামাজিক শ্রেণীভেদের সমান্তরালেই শুধু বেড়ে উঠতে পারে।

আমরা কবিকে নিয়ে কথা বলছি। যিনি মানুষ। ভাব ও ভাষা নিয়ে যার কারবার। প্রাণের বৈচিত্র্যকে মানুষের ভাব ও ভাষার বিষয় হিশাবে বুঝলে অনেক মজা পাওয়া যায়। এই অর্থে মজা যে আরও গভীর ভাবে ভাববার দরজা খোলা সহজ হয়। ভাবের কথাকেও পেশাগত জায়গা থেকে বলা যায়। কোন বিজ্ঞানই তো বিশেষ কোন ভাব ছাড়া নয়। সেই পেশাগত অবস্থান থেকে – অর্থাৎ চাষাবাদের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ ধরণের কৃষিবিজ্ঞান চর্চা করছি বলে জসীম উদ্‌দীনকে আমি বাধ্য হয়েই পড়েছি।

তাহলে খানিক ঘুরিয়ে বলে কথাটি পরিষ্কার করি। আমরা যখন প্রাণী হিশাবে জগৎসংসারে বাস করি তখন আমাদের জীবন হচ্ছে জীবের জীবন, পরমের নয়। মনে রাখা দরকার মানুষ আদৌ এই রকম দ্বিখণ্ডিত কিনা সেটা তর্কের বিষয় নয়। এখানে অন্তত না। নিজেদের বুঝবার জন্যই মানুষের নানান অনুমান এবং সেই বোঝাবুঝির জায়গা থেকে নীতিনৈতিকতা জীবনাচার নির্মাণ। জীবের জীবন হচ্ছে সেই জীবন রক্ষার জন্য আমাদের চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির জীবন। যে দিকটা আমরা বিভাজন মেনেও ভুলে যাই সেটা হোল আমাদের কথা বলা, ভাষা ইত্যাদিও প্রাণবৈচিত্র্যেরই অংশ।

‘জীব’ আর ‘পরম’ কথাটা শুনেই ‘আধ্যাত্মিক’ কোন ব্যাখ্যার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার দরকার নাই। কথাটা খুবই সোজা। জীবের জীবনে যে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা হয় তাকে কোন সার্বজনীন ব্যাখ্যা দেয়ার সচেতন চেষ্টা সাধারণ জীবের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। মানুষের মধ্যে আমরা দেখি। কিন্তু নিজেকে শুধু জীবসর্বস্ব ‘মানুষ’ গণ্য করলে জীবের দৈনন্দিন জীবন থেকে আমরা নিজেদের আর আলাদা করতে পারি না। জীবই থেকে যাই। ফলে জীব হিশাবে আমাদের অভিজ্ঞতাকে সার্বজনীন ব্যাখ্যা দেয়ার সচেতন চেষ্টা আমাদের থাকে না। যখনই আমরা জীবের জীবন থেকে নিজের চিন্তাশীল ‘আমি’-কে নিয়ে ভাবতে বসি আর সেই ভাবনা যখন প্রকাশ করি বা লিখি তখন সেটা আর জীবের জীবন থাকে না। সেটাই পরমের জগৎ। জীবের সঙ্গে পরমের এই দ্বন্দ্ব সবসময়ই চলে -- হেগেলের কাছ থেকে এই বিষয়ে নতুন করে পাঠ নেয়ার দরকার নেই। আমাদের দেশেও ব্যাপারটা জানা ছিল। বাইরের পড়াশোনার ফলে কথাগুলো আমরা আরও পরিচ্ছন্ন ভাবে, যেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয়েই বোঝে, তেমনি করে বলতে পারা শিখছি। ব্যস।

আমরা কখনোই জীবাবস্থার অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করতে পারি না। পারব না, এটা অসম্ভব। আমরা যা করি সেটা হচ্ছে আমাদের বয়ান বা ব্যাখ্যা। বাস্তবতা আর বাস্তবতাকে প্রকাশ করা এক কথা নয়। ‘বাস্তবতা’ বলে যে ব্যাপারটাকে আমরা লেখায় প্রকাশ করব বলে আগে থাকতেই সেই বাস্তবতা ‘আছে’ বলে ধরে নিই -- আমাদের কথায় বা সাহিত্যে যে ‘বাস্তবতা’ প্রকাশ করি বলে আমরা বলে থাকি বা দাবি করি --সেই ‘বাস্তবতা’ বলে কিছু নেই। কখনই কিন্তু থাকে না। যেটা থাকে সেটা হোল আমাদের বয়ানে তৈরি বাস্তবতা। চিন্তাশীল বা ভাবুক ‘আমি’ বা মানুষের মধ্যে যে মানুষটি লিখছে বা বলছে, তারই নির্মাণ, ভাষার মধ্যে নির্মিত বিষয়ের প্রকাশ। ওখানে বাস্তবতা সন্ধান করা বোকামি।

তাহলে জসীম উদ্‌দীনের ‘পরম’-টা কেমন পরম? আমার মনে হয়েছিল জসীমউদ্দীন এমন একজন যিনি শহরকেন্দ্রিক ‘আধুনিক’ শিক্ষার দ্বারা ‘নষ্ট’ হয়ে যাননি। (শহরে পড়লেই বা শিক্ষিত হলেই আমরা খারাপ হয়ে যাই একথা নিশ্চয়ই বলা হচ্ছে না। নষ্ট হওয়া শুরু হয় যখন আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে আধুনিক ও অনাধুনিক এই দুই ভাগে ভাগ করে প্রমাণ করতে প্রাণান্ত হই যে আধুনিক উপলব্ধিই উন্নত উপলব্ধি, উন্নত অভিজ্ঞতা। শহরের বাইরে যারা থাকে -- গ্রামে, বনে বা মফস্বলে -- তারা অনাধুনিক ও পশ্চাতপদ – নষ্ট হবার শুরুটা শুরু হয় এখান থেকে)। জসিম উদ্‌দীন শহরেই ছিলেন, কিন্তু ‘নষ্ট’ হন নি। এটা দারুন ব্যাপার।

অন্য দিকে প্রাণবৈচিত্র্যভিত্তিক বাংলার গ্রামের অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল এবং সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর ‘ভাবনা’ও ছিল। উৎসাহ ও আতিশয্যও ছিল বিস্তর, যাকে তিনি বলতেন, ‘জনসাধারণের সাহিত্য’ তার প্রতি। অর্থাৎ গ্রামে তাঁর যে জীবের জীবন কেটেছে তার একটা পরমার্থিক আখ্যান দেয়ার চেষ্টা তাঁর লেখালিখিতে আছে। ‘জনসাধারণ’ যে ভাষা নিত্যদিন তৈরি করছে, তাকে সাহিত্যে তুলে আনার বা তাঁর ভাষায় ‘সংগ্রহ’ করার প্রণোদনা তাঁর মধ্যে প্রবল ছিল। গ্রামের ভাষাটি তিনি সংগ্রহে তাঁর সাহিত্যে স্থান দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে পরমের একটি মুহূর্ত বোঝার জন্য। জসীমউদ্দীন খুবই ভাল একটি ঘড়ি।

এই দিক থেকে আমার পক্ষে আমি আবদুল মান্নান সৈয়দকে উকিল খাড়া করতে পারি। নাসির আলী মামুনের ‘শতবর্ষে জসীমউদদীন’ বইতে সৈয়দের গবেষণামূলক লেখা আমার নিজের জন্য খুব শিক্ষণীয় হয়েছে। জসীমউদ্দীন সম্পর্কে আবদুল মান্নান সৈয়দের মূল্যায়নটি আমার মনে ধরেছে।

“...জসীমউদ্দীন সর্বতোভাবে গ্রামীণ, সমগ্রভাবে গ্রামীণ, অবিচ্ছেদ্যভাবে গ্রামীণ। পাঁচ দশকের অধিককাল ধরে তার সমস্ত কবিতা তো এর সাক্ষ্য বটেই, তার তাবৎ গদ্যগ্রন্থ, প্রবন্ধ ও গবেষণা পল্লীগীতি, লোকসাহিত্য সংগ্রহ, লোকনাট্য এর সাক্ষ্য দেবে। সব মিলিয়ে জসীমউদ্দীন তার একাগ্র ও অনবচ্ছিন্ন ও অখণ্ড চরিত্র নির্মাণ করেছেন -- যার দ্বিতীয় কোন নজির আধুনিককালে কেন, কোনকালেই নেই। বিস্তার অনেক সময় শিল্পীর চরিত্রের সর্বনাশ ঘটায়। জসীমউদ্দীনের চারিত্র অমিশ্র, সুনির্দিষ্ট এক এবং অদ্বিতীয়”। (মামুন ২০০৩ : ৯৭ )

‘অমিশ্র, সুনির্দিষ্ট, এক এবং অদ্বিতীয়’ -- অতি প্রশংসা হলেও, জসীমের সব লেখাই যে গ্রামীণ বা গ্রাম্য সেটা আমি মানলাম। নগরকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতার মধ্যে দাঁড়িয়ে যারা লিখছেন তাদের মধ্যে গ্রাম এলেও ‘গ্রামীণ’ স্বাদটা পাওয়া যায় না। এই দিক থেকে জসীমউদ্দীন আর জীবনানন্দের তুলনা করলে আমার কথা খানিক স্পষ্ট হবে। জসীমউদ্দীনের প্রতি আমার গভীর আগ্রহের কারণ সেই দিক থেকে এমন কোন নুতন ব্যাপার নয়। আবদুল মান্নান সৈয়দের মতোই। এই বিষয়ে অন্য দিক থেকে রাজনৈতিকভাবে মহাসচেতন ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। কিন্তু এখানে তার সম্পর্কে বলার সুযোগ আমি নেব না। জসীমউদ্দীন সম্পর্কে যে কথা খাটে অন্যান্য বাঙালি মুসলমান লেখকের ক্ষেত্রে সে কথা খাটে না। আমি কিন্তু আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘গ্রামীণ’ কথাটি এখনই ধর্তব্য মনে করছি না। কারন এর সঙ্গে আধুনিকতার বিপরীতে অন্য যেসব অনুষঙ্গ চলে আসে তার প্রতি আমার সায় নেই। আমি বরং মান্নানের সাহসী মূল্যায়নের জায়গাটিকে খপ করে ধরতে চাই। ঠিক যে এমন এক অভিজ্ঞতার বয়ান জসীমউদ্দীনের মধ্যে আমরা পাই যার দ্বিতীয় কোন নজির আধুনিককালে কেন, কোন কালেই নেই। খুবই বড়সড় দাবি, যদিও শহর ও গ্রাম বিভক্ত হবার পর এবং গ্রামীনতা ও শাহরিকতার অভিজ্ঞতার পরেই কেবল এই মূল্যায়ন সম্ভব, তবুও আমি একমত। আধুনিকতা মানেই ভাল আর গ্রামীনতা মন্দ – এটা মান্নানের দাবি না। বরং জসম গ্রামীন বলেই ভালো, তাঁর অনন্যতা এখানে। এই মূল্যায়নের পর এই বিষয়ে নিজের কথা এখন আমার আর বিশেষ না বললেও চলবে। অনেক আরাম হয়েছে।

তিন

আহমদ ছফা বাংলা ভাষার বিকাশের দিক থেকে রায় দিয়েছিলেন যে বাঙালি মুসলমান লেখকরা ‘কলকাতাকেন্দ্রিক ভাষারীতি গ্রহণ করে সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন’ (মোরশেদ ২০০২ : ১২৮)। কিন্তু ছফা ঠিক বলেন নি। ছফার রায়ের বিরোধী বলেই জসীমউদ্দীন আরও ইন্টারেস্টিং। কারণ জসীম উদ্‌দীন সেটা করেননি। বাঙালি মুসলমান লেখকের মধ্যে তিনি প্রতিনিধিত্বশীল একজন, এ ব্যাপারে সন্দেহ নাই। এমন নয় যে, জসীম উদ্‌দীন ব্যাপারটি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথের মতোই লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সচেতন ভাবে কেন গ্রাম বিষয়ে গ্রাম্য ভাষায় লিখতে গেলেন? তার বয়ানেই শোনা যাক :

‘পূর্বে রবীন্দ্র রচনার পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া যাহা লিখিতাম, বহু কাগজে তাহা ছাপা হইয়াছে। এমনকি প্রবাসী কাগজে পর্যন্ত আমার লেখা প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু গ্রাম্য জীবন লইয়া গ্রাম্য ভাষায় যখন কবিতা রচনা করিতে আরম্ভ করিলাম, কেহই তাহা পছন্দ করিল না। কাগজের সম্পাদকরা আমার লেখা পাওয়া মাত্র ফেরৎ পাঠাইয়া দিতেন। সবটুকু হয়তো পড়িয়াও দেখিতেন না। সেই সময় আমার মনে যে কী দারুণ দুঃখ হইত, তাহা বর্ণনার অতীত।’

 ( ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়/পৃ. ১৩১)।

যখন রবীন্দ্রনাথ নজরুল তিরিশের কবিতার দাপট, মুসলমান লেখকরা কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা ভাষা ও গদ্য আত্মস্থ করতে তৎপর, জসীম উদ্‌দীন তখন তথাকথিত ‘পল্লী কবিতা’ লিখতে গেলেন কোন দুর্বুদ্ধিতে? তাঁর গদ্যও ‘আধুনিক’ গদ্য হোল না কেন? কেন বুদ্ধদেব বসুর মতো স্মার্ট গদ্য জসিম উদ্‌দীনের হোল না? কিংবা তিনি কেন শরৎচন্দ্র বা বঙ্কিমের অনুসরণ করতে গেলেন না ? এই কথা আমি তুলছি বাঙালি মুসলমানের বিকাশ বনাম কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চবর্ণের বাংলা সাহিত্যের ভেদ ও অভেদের লড়াই বোঝানোর পুরনো কাসুন্দি নিয়ে ঘাঁটার জন্য নয়। সেটা ভিন্ন বিষয়। আলাদা ভাবে বিচারের দরকার আছে। সেই দিকটা এখনো কিন্তু পরিচ্ছন্ন হয়নি, সেটাও মনে রাখতে হবে।

সাধারণত বলা হয়ে থাকে বাংলাভাষী মুসলমান শিক্ষায়, সমাজে, অর্থনৈতিক অবস্থা সব দিক থেকে পশ্চাৎপদ ছিল বলে হীনমন্যতায় ভুগত, কলকাতার ভাষা ও সাহিত্য আত্মস্থ করার চেষ্টা করত। আহমদ ছফা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ নিবন্ধের গোড়ায় রয়েছে এই অনুমান যে বাঙালি মুসলমান হীনমন্যতায় ভোগা একটি জনগোষ্ঠি। এই কথাটা কি ঠিক? নাকি অন্য কারণও আছে? সম্প্রদায়-চিন্তার বাইরে ভিন্ন বলয় থেকে দেখার ব্যাপার কি নেই? জসীমউদ্দীন কলকাতায় গিয়েছেন, কলকাতার শিল্পসাহিত্য, গবেষক, নাটকপাড়া ইত্যাদি স্থানে বিচরণ করেছেন। তাহলে তার কবিতা জীবনানন্দের মতো হোল না কেন? তিরিশের পরের বাংলা কবিতা তো তিরিশের পথেই আজ অবধি চলছে। জসীমউদ্দীন অন্য রকম হলেন কেন?

আমার প্রস্তাব হচ্ছে জসীম উদ্‌দীনকে বোঝার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। হয়তো জসীমউদ্দীনকে বোঝার এটাই মোক্ষম সওয়াল। এই প্রশ্নকে পুরোনো খাপে ফেলে উত্তর দেয়া চলবে না। আহমদ ছফা এই ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি। জসীমউদ্দীনকে লোকে ভালোবাসে, এই সত্য তিনি জানতেন। তার প্রতিভা সম্পর্কে তিনি পাক্কা ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি নিজে ব্যক্তি জসীমউদ্দীনকে কতটা পছন্দ করতেন সেটা তার লেখা পড়েই পাঠক বুঝবেন। (দেখুন 'জসীমউদ্দীন কথা', মামুন ২০০৩, পৃ. ৮৮-৯২)। যে প্রশ্ন আমি তুলছি ছফা সেটা তোলার সময় পাননি। ফলে এই প্রশ্নও তার হয়তো জাগে নি যে জসীম উদ্‌দীনকে কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্য ও ভাবের ইতিহাসে বাঙালি মুসলমানের স্বীকৃতি আদায়ের লড়াইয়ের দিক থেকে বিচার করলে হিশাবে ভুল হয়ে যায়। কারণ জসীমউদ্দীন কেন মুসলমান হয়েও বাংলা ভাষার ‘সর্বাধিক বিকশিত রূপ’ গ্রহণ করলেন না? আহমদ ছফা বেঁচে থাকলে ভালো হোত, কারণ এই বিষয়ে বিস্তর তর্ক করেছি এবং নতুন ভাবে তর্ক করা যেত। অন্যান্য মুসলমান লেখকের মতো জসীম উদ্‌দীনের ‘সুবুদ্ধি’ ছিল না কেন? তার গ্রাম্য হওয়ার এই দুর্বুদ্ধি কেন? কেন তার মধ্যে হীনমন্যতা ছিল না। জসীম উদ্‌দীন আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমানের হীনম্যতার থিসিসকে সাপোর্ট করে না।

তাছাড়া, একে জসীমের ‘দুর্বুদ্ধি’ বলি কী করে? কারণ আজ দেখছি অন্য মুসলমান সাহিত্যিকরা যেখানে রয়েছে তার চেয়ে জসীম উদ্‌দীন গণস্বীকৃতির দিক থেকে তাদের চেয়ে বিস্তর কদম সামনে। জসীমউদ্দীনের বুদ্ধি ছিল তুলনায় বড়। অন্য মুসলমান সাহিত্যিকরা কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের যে ধারায় নিজের জন্য স্থান করে নিতে চেষ্টা করেছেন, জসীম উদ্‌দীন সেই পথে অগ্রসর হন নি । তিনি ব্যাপক মানুষের মনের মধ্যে জায়গা করে নেয়ার মতলব এঁটেছিলেন। জসীম উদ্‌দীন যে ধারায় গিয়েছেন সেই ধারাকেই বাংলাদেশের মানুষ ভালোবেসেছে, স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি শুধু কি বাংলা ভাষার মূলধারার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন? তাতো নয়। তাকে তো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও স্বীকৃতি দিয়েছিল। আমরা শহুরে শিক্ষিতরা স্বীকার করি আর না করি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে কবি এখনও তিনজন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর জসীমউদ্দীন।

আরেকটি কথা, বাঙালি মুসলমানের মন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ছফা, মীর মশাররফ সম্পর্কে যে সকল কথা বলতে পেরেছেন সেই কথা জসীমউদ্দীন সম্পর্কে খাটে না। জসীমউদ্দীনের জগৎ তো পুঁথির বা মধ্যযুগীয় আখ্যানের জগৎ নয়। হজরত মুহম্মদ, হজরত আলী, বিবি ফাতেমা, হাসান-হোসেন, বীর হানিফা, আমির হামজা, হাতেম তাঈ, রুস্তম ইত্যাদি চরিত্রের মধ্য দিয়ে ছফার ভাষায় ‘রসালো কাহিনী’ তো জসীমউদ্দীন শোনান নি। কথা হোল, জসীমউদ্দীন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে আছেন। জসীমউদ্দীনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ তত্ত্বটি আর খাঁটছে না।

আমি এখন আহমদ ছফার কোন লেখাই ব্যক্তিগত স্মৃতি আর আবেগ বাদ দিয়ে পাঠ করতে পারি না। এটা আমার দোষ। ছফার ‘জসীম উদ্‌দীন কথা’ পড়তে গিয়েও আমার অসুবিধা হয়েছে: বিচারমূলক মনের সঙ্গে বন্ধুস্মৃতির দ্বন্দ প্রবল হয়ে ওঠে। তবুও এই লেখাটি লেখার আগে কয়েক দফা মনোযোগ দিয়ে আবার পড়লাম। এই লেখাটি জসীমউদ্দীনের তাৎপর্য সম্পর্কে ছফার কোন মূল্যায়ন নয়, জানা কথা নতুন করে বলা মাত্র। সার কথা হচ্ছে, ব্যক্তি জসীমউদ্দীন যাই হোক, কবি জসীমউদ্দীনকে লোকে ভালোবাসে। যে মানুষটির চেহারা দেখে আহমদ ছফার ‘ডুকরে কেঁদে উঠতে’ ইচ্ছা করে, যাকে দেখে রাগে ছফা বোতলের সমস্ত কালি মেঝেতে ঢেলে দিয়েছেন -- যে ‘কবিসাহেব কৃপণ ছিলেন : হাতের ফাঁক দিয়ে পানি গলত না’ -- যিনি ভাপা পিঠা খেতে খেতে মস্ত কদম ফেলে রথখোলা থেকে বাহাদুর পার্ক অবধি হেঁটে যান, যিনি ক্ষুধা ও তৃষ্ণা নিয়ে তার বাসায় গেলে দুইটা নাইস বিস্কুট আর চা খাইয়ে বিদায় জানান। সেই জসীমউদ্দীনের বাগান থেকে ফুল ছিঁড়লে তার চোখ পানিতে ভরে যায়। এই হোল জসীমউদ্দীন সম্পর্কে ছফার ভালোবাসার বয়ান। ছফার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ‘ফুলের শোকে যিনি শিশুর মতো কাঁদতে পারেন, তার কাব্য লোকে ভালোবাসবে না কেন?’ (খান ২০০৩ : ১১)।

বলাবাহুল্য, ছফার লেখার সাহিত্যগুণ অসাধারণ। কিন্তু ফুলের শোকে জসীমউদ্দীন শিশুর মতো কাঁদেন বলেই কি তার লেখা লোকে ভালোবাসে? আমি নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারি, এতে জসীম-তর্কের মীমাংসা হয় না। আমরা করতেও পারি নি। ছফা নিজেও প্রশ্নটি যুৎ মতন তোলার সময় পাননি। এক হিশাবে প্রশ্নটি তার নজর এড়িয়ে গেছে কিংবা বাঙালি মুসলমানের মন সংক্রান্ত তার থিসিসের সঙ্গে জসীমউদ্দীন পুরোপুরি মেলে না বলে তিনি প্রশ্নটা এড়িয়েই গেছেন।

কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা আর তার সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের প্রতিযোগিতার সাফল্য আর ব্যর্থতার একটা খতিয়ান আমরা আহমদ ছফার লেখার মধ্যে পাই, অন্যদের লেখাতেও আছে। সেটা এক ধরনের ইতিহাস পাঠ। কিন্তু ‘ভদ্র’-সাহিত্য আর ‘লোক’-সাহিত্য কিংবা সংখ্যালঘুর অধিপতি ভাষা ও ভাব আর সংখ্যাগরিষ্ঠের জগৎ ও তার সরল প্রকাশের মধ্যে একটা লড়াই তো চলছেই। চলে। আমরা কি সেই দিক নিয়ে খুব একটা ভেবেছি? ছফাও ভাবেন নি। বাংলা ভাষার ইতিহাসের মধ্যে কি সে লড়াইয়ের ছাপ নেই? অবশ্যই আছে। সেই ইতিহাসটাও লেখা দরকার। শুধু জসীমকে পড়লে জসীমউদ্দীনকে বোঝা যাবে না।

দীনেশচন্দ্র সেন সম্পর্কে আমাদের জানাজানি পরিষ্কার। নতুন করে বলার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে জসীমউদ্দীনের ‘স্মরণের সরণী বাহি’ বা দীনেশচন্দ্র সেন স্মরণ করে জসীমউদ্দীন যে পুস্তিকাটি লিখেছেন সেখান থেকে বড় একটা উদ্ধৃতি দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না :

“আমার ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ বইখানা ছাপা হইলে দীনেশবাবুকে পড়িতে দিলাম। পড়িয়া তিনি প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইলেন। ‘সাহিত্যসেবক সংঘের’ একটি অধিবেশনে একদিন বিশেষ করিয়া এই পুস্তকের বিষয়ে আলোচনা হইল। এই সভায় দীনেশবাবু সভাপতির আসন গ্রহণ করিয়াছিলেন। সভাপতির আসন হইতে তিনি আমার বইয়ের প্রায় ষোল-সতেরো পৃষ্ঠাব্যাপী এক সুদীর্ঘ সমালোচনা পাঠ করিলেন। সেই প্রবন্ধে তিনি রায়দীঘির পাড়ের বনজঙ্গলের বর্ণনা হইতে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করিয়া উহা উত্তররাম চরিত্রের শম্বুক কর্তৃক দণ্ডকারণ্যের বর্ণনার সমতুল্য বলিয়া মত প্রকাশ করিলেন। বলিলেন, এই পুস্তকে গ্রাম্য কাহিনী বর্ণনা করিতে লেখক অনেক ভূতপ্রেতের নাম উল্লেখ করিয়া নতুন প্রকাশভঙ্গিতে যে বীররসের সমাবেশ করিয়াছেন, তাহা বাংলা সাহিত্যে অভিনব”।

তিনি আরও উল্লেখ করিলেন, “আমি হিন্দু। আমার কাছে বেদ পবিত্র, ভাগবত পবিত্র। কিন্তু ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ পুস্তকখানি তাহার চাইতেও পবিত্র। কারণ ইহাতে আমার বাংলাদেশের মাটির মানুষগুলির কাহিনী আছে।”

এই সভায় আরও কয়েকজন লেখক বইখানির প্রশংসা করেন। একমাত্র পরলোকগত নরেন্দ্র দেব মহাশয় উঠিয়া বলেন, “এই পুস্তকে বহু আরবী-পার্শী শব্দ আছে। তাহা প্রয়োগ করিয়া লেখক বাংলা সাহিত্যকে কলঙ্কিত করিয়াছেন। একটি হিন্দু মেয়ের সঙ্গে একটি মুসলমান যুবকের প্রেমকাহিনী বর্ণনা করিয়া লেখক সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় দিয়াছেন। আমি এই জঘন্য মনোবৃত্তির প্রতিবাদ করি।”

উত্তরে দীনেশবাবু বলিলেন, “আরবী-পার্শী কিছু প্রয়োগ করে লেখক কোন অপরাধের কাজ করেননি। ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর কাব্যে বহু আরবী-পার্শী শব্দ আছে। সাহিত্যে আরবী-পার্শী শব্দ আমদানি করে মুসলমান লেখকেরা বঙ্গসাহিত্যের শব্দভাণ্ডার বাড়াচ্ছেন। আমরা হিন্দুরা যদি আরবী-পার্শী শব্দ ব্যবহারের আপত্তি করি, মুসলমানেরাও হিন্দু লেখকদের বহু লেখায় প্রচলিত সংস্কৃত শব্দের ব্যবহারে আপত্তি করতে পারেন। লেখক তার বইয়ে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলমান যুবকের প্রেমকাহিনী বর্ণনা করেছেন। এজন্য যদি লেখককে দোষী করা যায় তবে সে দোষ তারও আগে আমাদের বিখ্যাত লেখকেরা বহুবার করেছেন। বহু উপন্যাসে মুসলমান মেয়েকে হিন্দু নায়কের প্রেমাসক্ত করে কাহিনীর ঘটনাজাল বিস্তার করেছেন।”

এই সভার পরদিন ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ পুস্তকের সমালোচনার জন্য আমি ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সম্পাদক সত্যেন্দ্র মজুমদারের নিকট গিয়াছি। দেখিলাম, সেখানে আমার শিক্ষক শ্রীসুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় বসিয়া। তিনি আমাকে দেখিয়াই সত্যেন্দ্রবাবুকে শুনাইয়া বলিয়া উঠিলেন, “নরেন্দ্রবাবুর কাছে শুনতে পেলাম আপনি নাকি একখানি সাম্প্রদায়িক পুস্তক লিখেছেন?”

আমি বিনীতভাবে বলিলাম, “স্যার, আপনি আমার বই পড়েছেন?”

তিনি বলিলেন, “না পড়িনি। তবে নরেন্দ্রবাবুর সাহিত্যিক-রুচি বড়ই নিষ্ঠাবান। তার কথা অবিশ্বাস করি কেমন করে?”

আমি বলিলাম, “স্যার, আপনি আমার বইখানা পড়ে যে যে জায়গা সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পাবেন দাগ দিয়ে রাখবেন। সেই সেই পাতাগুলি ছিঁড়ে ফেলে নতুন করে লিখে আবার বই ছাপাতে দেব। আজীবন আমি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়েছি। এই পুস্তকের অন্যতম উদ্দেশ্য হিন্দু-মুসলমানের প্রীতির সম্পর্ককে আরও নিবিড় করা। আপনি আমার গুরু। আপনার বিচারে যদি এই পুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা ধরা পড়ে তবে এর বিক্রি বন্ধ করে দেব।

এই কথা বলিয়া সমালোচনার জন্য সম্পাদকের নিকট বই রাখিয়া চলিয়া আসিলাম।

সেদিন সন্ধ্যায় শিশিরবাবুর অভিনয় দেখিতে ‘নাট্য নিকেতন’-এ যাইয়া তাঁহার বসিবার ঘরে ঢুকিয়াছি : দেখিলাম সুনীতিবাবু ও হরোকেষ্টবাবু খুব উত্তেজিত হইয়া কি আলোচনা করিতেছেন। সুনীতিবাবুর মুখে খুব জসীমউদ্দীন কথাটি শুনিলাম। আমাকে দেখিয়া তাঁহারা নীরব হইলেন।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘স্যার, জসীমউদ্দীন বলেই যে থেমে গেলেন : কি কথা বলছিলেন?

সুনীতিবাবু সুর বদলাইয়া বলিলেন, ‘এই আপনার বইখানার কথা হচ্ছিল।’

আমি তখন বেপরোয়া হইয়া বলিতে লাগিলাম, ‘স্যার আমি একজন আপনার নগণ্য ছাত্র। দেশে-বিদেশে আপনার কত খ্যাতি। এইমাত্র আপনি আনন্দবাজার অফিসে আমার বই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যাত করে এসেছেন। এখানে এসে আবার এদের কাছে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে লেগেছেন। আমার বই আপনি না পড়েই জায়গায় জায়গায় এমন বিরূপ সমালোচনা করেছেন! আপনার লজ্জা করে না?’

আমার কথা শেষ না হইতেই সুনতিবাবু আর হরে কেষ্টবাবু সেখানে হইতে উঠিয়া চলিয়া গেলেন।”

আমি জসীম উদ্‌দীনের বই থেকে বড় উদ্ধৃতি দিচ্ছি। কারণ বাংলা সাহিত্যের অন্দরমহলে যে সকল বিতর্ক শুধু সাহিত্যকে নয়, এমনকি লেখকের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ককে নির্ণয় করেছে, -- যে লড়াই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্তর্গত তাগিদ তৈরি করেছে – সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিষ্কার থাকা চাই।

জসীমউদ্দীন সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সেন আর সুনীতিবাবুর বিরোধ ছিল। সংখ্যালঘুর অধিপতি সাহিত্য আর সংখ্যাগরিষ্ঠের জাতীয় সাহিত্যের মধ্যে দ্বন্দ বড়ই জীবন্ত, বড় বেশি তিক্ত ছিল। সেই ইতিহাস আমরা কতটুকুই বা আর জানি? বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বড় বড় পণ্ডিতদের মতবিরোধ যেমন আমরা দেখছি তেমনি সাহিত্যিকদের মধ্যে একই দ্বন্দ্ব নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। হরপসাদ শাস্ত্রী ও দীনেশচন্দ্র সেনকে তাঁদের চিন্তার জন্য যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়েছে। শেষ জীবনে দীনেশচন্দ্র সেন এক হিশাবে উপেক্ষিত জীবনই যাপন করেছেন। শুধু দুই ধারার দুই লেখকের মধ্যেই নয়। একজন লেখকের মধ্যেও একই দ্বন্দ্ব কাজ করেছে। কাজ করে। বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথ যেমন। এই বিষয় নিয়ে আমরা কেউই বিশেষ কিছুই কাজ করি নি।

বাংলা গদ্যের বিবর্তনে সাহেব আর ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের হাতে তৈরি গদ্যের তর্ক তো হরপ্রসাদ-রবীন্দ্রনাথের বরাতে আমরা জানি। তারপর কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চবর্ণের হিন্দু সাহিত্যিকদের হাতে তৈরি গদ্য আর সেই গদ্যকে আদর্শ ধরে নিয়ে বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের গদ্যচর্চা। এই পথ -- যে পথে জসীমউদ্দীন কোন ফাঁকে আবার গ্রামে হারিয়ে গেলেন বোঝা মুশকিল হয় --সেই পথ বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের জন্য ছফা অনুমোদন করেছেন। কিন্তু আবুল মনসুর আহমদ করেন নাই। যাঁরা আবুল মনসুর আহমদ এই বিষয়ে কী মত পোষণ করতেন জানতে চান তাঁরা বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত তর্কটা পড়ে দেখতে পারেন (চিন্তা ১৯৯৪)।

বাংলা ভাষায় ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী লিঙ্গ নির্বিশেষে ভদ্রলোকের ভাষা বা আভিজাত্য আর স্বাতন্ত্র্যের গোমর নিয়ে চলা একটা ‘ভাষা’ আছে। যে ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চা হয়, বাংলা গদ্য, বাংলা পদ্য ইত্যাদি লেখা হয়। আর তার বিপরীতে আছে সাধারণ মানুষের ভাষা। ঔপনিবেশিকতার ঔরসে যে গদ্য তৈরি হয়েছে সেই গদ্যের বিপরীতে সাধারণ মানুষের ভাব আর ভাষার যে জগৎ তাকে লোকভাষা, লোকসাহিত্য বলে শনাক্ত করলে আমাদের উপকার বৈ অপকার হয় না। ভাষার মধ্যে শ্রেণির, বর্ণের এমনকি নারীপুরুষ ভেদের চিহ্ন ও সংগ্রাম আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘লোক’ থেকে সংখ্যালঘু ‘ভদ্র’ যখন আলাদা হয়ে যায় আর ভদ্রের ভাষাই অধিপতি ভাষা হয়ে ওঠে তখন তার বিপরীতে সাধারণ মানুষের ভাষাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও ‘খাঁটি’ ভাষা বলেছেন। হরপ্রসাদ কবিতার উদাহরণ দিয়ে যে ‘বিশুদ্ধ বাংলার’ নজির হাজির করতে চেয়েছেন সেটা খুবই তাৎপপূর্ণ। যদি হরপ্রসাদকে আমরা বুঝি তাহলে জসীমউদ্দীনের ভাষা পুঁথির পাতা থেকে তৈরী হয় নি, কিম্বা উচ্চকোটির ভাষা থেকেও নয়। কিন্তু শুধু এতটুকু বললে সরলীকরণের ভয় আছে বলে মনে করি। আমরা যদি প্রশ্নগুলোকে আলাদা করি তাহলে মূল তর্কটা আরও জমে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস।

এক. ভাষার মধ্যে জাত, বর্ণ, শ্রেণী ও লিঙ্গের একটা লড়াই আছে। বাংলা সাহিত্যে এই লড়াইটা কীভাবে ঘটেছে তার একটা ইতিহাস জানা দরকার। ভাষার মধ্যে তার দাগগুলো কিভাবে আমরা শনাক্ত করব? ‘খাঁটি বাংলা’ সংক্রান্ত তর্ক এবং তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভাষার সম্পর্কের তর্কের প্রধান দিক এটাই।

দুই. ‘খাটি বাংলা’ বলে স্থির নির্দিষ্ট কিছু নাই। বাংলা সাহিত্যের অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে যে ধারাটি সাহিত্যের গুণে নয় বরং জাত, বর্ণ, শ্রেণী, লিঙ্গ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার গুণে এখনো অধিপতি তাকে প্রশ্ন করার দরকার আছে। সেই প্রশ্নের মধ্য দিয়ে যে ধারাগুলো আমরা বিস্মৃত হয়েছি তাকে চেনা সহজ হয়, ভাষার বৈচিত্র্য নজরে পড়ে এবং এখনকার সাহিত্যের সঙ্গে সজীব সংযোগ ঘটানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়। বাংলা সাহিত্যকে আরও সৃষ্টিশীল করার জন্য এই লড়াইয়ের ইতিহাস বোঝা এখন কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিন. মুখের জবান আর লিখিত ভাষার মধ্যে দ্বন্দ্বের ইতিহাসটা ওপরের ইতিহাস থেকে আলাদা। তাকে আলাদা করে বিচার করাই বিধেয়। নইলে এই দ্বন্দ্বের বিশেষ চরিত্র আড়ালে থেকে যেতে পারে। উচ্চ শ্রেণীর অভিজাত সাহিত্যও মুখের জবান থেকে রসদ সংগ্রহ করে। কিন্তু সংকটটা তখনই আমরা ভাল ধরতে পারি যখন ‘প্রমিত’ ভাষার দাপটে বিচিত্র ও বিভিন্ন মুখের ভাষা বা মাতৃভাষার ভাঁড়ার থেকে রসদ সংগ্রহ সীমিত হয়ে যায়। কিংবা তার প্রভাবে বাক্য গঠন ও পদবিন্যাসের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে বাংলা সাহিত্য বঞ্চিত হয়। হরপ্রসাদের ‘খাঁটি বাংলা’ নিয়ে তর্কের প্রয়োজনীয়তা এই কারণেই যে প্রমিত বাংলা ভাষায় সাহিত্য যে খোপের মধ্যে বন্দি হয়ে গেছে -- শুধু শব্দ ব্যবহার নিয়ে নয় বাক্য গঠন বা পদবিন্যাসের অভ্যাসে -- তার নিগড় থেকে বেরিয়ে আসার একটা সংকল্প এখন আমাদের খুবই দরকার। জীবন্ত ভাষার জিহ্বার সঙ্গে কালিকলমের আঁকাবুঁকি ঝালিয়ে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা এবং তাগিদ দুটোই উপস্থিত হয়েছে। যেন সেটা বিশৃঙ্খলা ও স্বেচ্ছাচারিতা না হয় সেজন্য জসীমউদ্দীনের গদ্যকে নজির ধরলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধা হয়।

চার. ভাষার সম্প্রদায়গত ভেদ নিয়ে আলোচনা আজকের নয়, বহু দিনের। আরবি-ফারসি কতটা ব্যবহার হোল বা কতখানি বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন হোল সেই কথা সম্প্রদায়গত ভেদ থেকে আলাদ করে বুঝতে হবে। তবে জাত, বর্ণ শ্রেণী, লিঙ্গের ভেদের সঙ্গে সম্প্রদায়গত ভেদের পার্থক্য আছে। মোট কথা হোল, বিভিন্ন দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের বিচার ও বিবর্তন বোঝার কাজ আমাদের বাকি রয়ে গেছে। তবে এটা পরিষ্কার অনুমান, অভিমান বা অহংকার বাদ দিয়ে যদি জসীমউদ্দীনের পদ্যের দিকে আমরা আরও নজর দেয়ার অভ্যাস করি এবং এর সম্ভাবনা চর্চার মধ্য দিয়ে পরখ করে দেখি তাহলে বাংলা সাহিত্যের উপকার বৈ ক্ষতি হবে না, সেটা নিশ্চত। সম্প্রদায়গত ভেদ বাংলা ভাষায় আছে, কিনতি জসীমউদ্দীন নিজেই ১৯৬৩-৬৪ সালের দিকেবলছেন, এদেশের সাহিত্য শুধু হিন্দুর সাহিত্য হইবে না, পৃথক করিয়া মুসলমানের সাহিত্যও হইবে না। হিন্দু-মুসলমান এক ভাষায় কথা বলে তাই এই দেশের সাহিত্য হইবে হিন্দু-মুসলমানের সাহিত্য। সকলের সাহিত্য। সকলের ভাষা।

পাঁচ . ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে বাংলা গদ্য এবং বাংলা সাহিত্যের সম্পর্ক বিচার। কলকাতাকেন্দ্রিক যে বাংলা সাহিত্যের কথা আমরা বলি তাকে ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস থেকে আলাদা করে বিচার করা মুশকিল। এই ব্যাপারটা আমরা জানি। কিন্তু এই দিকেও বিশেষ কোন কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। বাঙালি মুসলমান প্রায় একশ বছর ইংরেজি শেখেনি, সেই একশ বছরের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ইংরেজি শিক্ষা এবং তার প্রভাবে বাংলা গদ্য ও সাহিত্যের যে উৎকর্য ঘটেছে এবং বঙ্গীয় ‘আধুনিকতা’ তার আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে তাকে শুধু হিন্দু-মুসলমান ভেদবুদ্ধি দিয়ে বোঝা যাবে না। হিন্দু কি মুসলমান উভয়েরই সাহিত্যের চর্চা ঔপনিবেশিক গতি-প্রক্রিয়ার মধ্যে। এই হুঁশ মাথায় নিয়ে বাংলা গদ্যের বিচার করতে বসলে জসীম উদ্‌দীনের গদ্যে একটু হোঁচট খেতে হয়। সহজ, সরল নির্ভান গ্রামীণ অভিজ্ঞতা তাঁর গদ্যে উঠে আসছে। জসীমউদ্দীনের গদ্য বা কবিতা পড়লে এই রকম অভিজ্ঞতা হয় যে, এই দেশে ইংরেজ শাসন বলে প্রবল ও প্রতাপান্বিত কিছু একটা ঘটেছে তার কোন চিহ্ন নাই। বুঝি বাংলা নিজের কথা নিজে বলতে বসেছে। ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসের বাইরে বাংলার নিজের একটা ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা আছে। যাকে ‘আধুনিকতা’, কলকাতাকেন্দ্রিকতা বা তার প্রতিক্রিয়ায় সম্প্রদায়গত সাহিত্য ইত্যাদি কোন খাপেই ফেলা যায় না। বুঝি এই অর্থেই জসীমউদ্দীনের বাংলা বাংলা ভাষার নতুন এক নমুনা।

ছয়. আগের কথার আবহে এবার কিছু নতুন কথা বলে শেষ করব।

সংখ্যালঘু ভদ্রলোকের ধ্যানধারণার আধিপত্য ঔপনিবেশিকতার ফল। তার মানে জাতীয় সাহিত্যের ভাব ও ভাষা নিয়ে তর্কটা একই সঙ্গে ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে বাহাসও বটে। কিন্তু ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসের বাইরে আমাদের নিজেদের আরও অনেক বিচিত্র ইতিহাস নিশ্চয়ই আছে। এই কথা আগে বলেছি। সেটা শুধু জসীম উদ্‌দীনের মতোই হতে হবে এমন কোন কথা নাই। কেউ দাবি করতে পারেন বাউল ফকিরদের গানও তেমন একটি নজির। যাই হোক, জসীম উদ্‌দীন একটা নজির এবং অন্য উদাহরণ থেকে ভিন্ন রকমের নজির আমরা চাইলে দিতে পারি।

আমি যে অভিজ্ঞতা, ‘পরমের মুহূর্তে’ বা ঘড়ির কথা বলেছি, সেই বিষয়ে দু’একটা নজির দিয়ে শেষ করব। ‘মায়ের সংসার’ নিয়ে জসীমউদ্দীন লিখেছেন : ‘আমার কোন ভাই হওয়ার আগে মা গোপনে কিছু চিঁড়া কুটিয়া ঘরের মাচার মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন।’ মায়ের সংসার নিয়ে এইভাবে কথার শুরু। আসলে লিখছেন তাঁর মায়ের আমলে গাঁয়ের পোয়াতি মেয়েদের জীবন। জসীমউদ্দীন মাচায় লুকিয়ে রাখা কুটিয়া রাখা চিঁড়া খেয়ে ফেলে টের পেয়েছিলেন তিনি কী কাণ্ডটি করেছেন।

‘তখনকার দিনে আঁতুড়ঘরের পোয়াতিরা শুধু একবেলা ভাত খাইতে পাইত। রাতে চিঁড়া ভাজা ছাতু ঝালসহ খাইবার নিয়ম ছিল। আঁতুড়ঘরে বসিয়া ঝালের ছাতুও মা একা খাইতেন না। আমাদিগকে ভাগ দিতেন। মায়ের সেই দুর্দিনের অবলম্বন চিঁড়াগুলি খাইয়া মাকে যে কী অসুবিধায় ফেলিলাম তখনকার বালক বয়সে তাহা বুঝিতে শিখি নাই।’ (জসীম ২০০১ ; ৬১)

ঔপনিবেশিক টানাপড়নের ইতিহাসের বাইরে একটা আরেক ইতিহাস, অন্যধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে বাস করা আর এই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লেখার মধ্যে পার্থক্য আছে। যখনই আমরা লিখছি তখনই আমরা ইতিহাসের জগতেও প্রবেশ করছি। আমার জিজ্ঞাসা ওখানে যে শুধু বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক ইতিহাস লিখলে সেটা একটি জনগোষ্ঠীর একমাত্র ইতিহাস হবে কেন? ইতিহাসেরও তো বিচিত্র দিক আছে। তার বাঁক আর মোড়ও বিস্তর আর বিভিন্ন। ইতিহাস সরলরৈখিক, এটা কে বলল? তাছাড়া ইতিহাস যদি এই কালে বয়ান হয় তো নানানজনের বয়ানের বিষয় আর মুন্সিয়ানার মধ্যেও ফারাক থাকবে। বাংলার পোয়াতি মেয়েদের ইতিহাসও ইতিহাস। এই দিকগুলো জসীমউদ্দীনের চোখে পড়েছে। আশ্চর্য!

‘মা আঁতুড়ঘরে যাইয়া মাত্র ছয়দিন কাটাইতেন। সেই ছয়দিনও আঁতুড়ঘরে বসিয়াই মা আমাদের খাওয়া-দাওয়ার তদারক করিতেন। ছয়দিন পরে আঁতুড়ঘর লেপিয়া-পুছিয়া মা বাহির হইতেন। নতুন ভাইকে পাইয়া আমরা নতুন খেলনার মতো আদর করিতাম। এই ছয়দিন আমাদের আঁতুড়ঘরে যাওয়া নিষেধ ছিল। যদিবা হঠাৎ কোনদিন সেখানে ঢুকিতাম বাহিরে আসিয়া স্নান করিতে হইত। নতুবা পাড়ার কেহই আমাদিগকে ছুঁইত না। কেদারির মা হাত-পা ধুইয়া ভালোমতো পরিষ্কার করিয়া সেই হাত-পা আগুনে সেঁকিয়া ঘরে ঢুকিত। সকাল হইলে আঁতুড়ঘর ইহতে বাহির হইয়া স্নান করিয়া তবে আমাদের অন্যান্য কাজকর্ম করিত। আঁতুড়ঘরখানির দরজা প্রায়ই বন্ধ থাকিত। ঘরের সামনে একটা মরা গরুর মাথার হাড়, একজোড়া ছেঁড়া জুতা ও পিছা রাখা হইত, যেন কোনো অপদেবতা আসিয়া শিশুর ক্ষতি না করে -- কোনো আটকুড়ো মায়ের বদদৃষ্টি যাতে শিশুর উপর না পড়িতে পারে। যদি বা পড়ে তাহাতে শিশুর কোনো ক্ষতি হইবে না। কারণ তার পরই ঘরের সামনে লটকানো সেই হাড়, ছেঁড়া জুতা আর পিছার উপর চাহিলেই তাহার কুদৃষ্টি নষ্ট হইয়া যাইবে।’

এই অভিজ্ঞতাগুলো ঔপনিবেশিকতার নজরে নৃতাত্ত্বিক উপাদান হিসেবে পড়াই রেওয়াজ। কিন্তু আমাদের পড়তে হবে আমাদের নিজেদের ইতিহাস হিশাবে, নিজেদের অভিজ্ঞতা হিশাবে। আরও বিস্ময়ের যে জসীমউদ্দীন লিখেছেন তাঁর মায়ের সংসারের কথা -- যে সংসারের তখনও হিন্দু ও মুসলমানের ভেদ ততটা প্রকট হয়ে ওঠেনি। যদিও হিন্দু পোয়াতির অবস্থা তুলনায় আরও শোচনীয়।

‘হিন্দুপাড়ায় পোয়াতিদের অবস্থা বড়ই শোচনীয় ছিল। তাহারা উঠানের মধ্যে একটি কুঁড়েঘর তুলিয়া দিত। সেখানে এক মাসের জন্য সদ্যোজাত শিশু ও পোয়াতিকে কাটাইতে হইত। বৃষ্টি-বাদলে উঠানের পানি-গড়াইয়া সেই ঘরে প্রবেশ করিত। সেই কুঁড়েঘর পোক্ত না বলিয়া অনেক সময় ঝড়ে উড়াইয়া লইয়া যাইত। তখন অসহায় মা ও শিশু নিউমোনিয়া হইয়া মারা যাইত। এক মাস এইভাবে সেই কুঁড়েঘরে থাকিয়া মা বাহির হইয়া আসিত। নবাগত শিশুর জন্মের জন্য সেই ঘর অশুচি হইয়াছে বলিয়া গৃহবাসীরা তাহা ভাঙিয়া নদীর তীরে লইয়া গিয়া পোড়াইয়া আসিত। তারপর স্নান করিয়া পবিত্র হইয়া ঘরে ফিরিত। আজও গ্রাম্য হিন্দুসমাজ হইতে এই পদ্ধতিটি উঠিয়া যায় নাই।’

সংস্কার বা কুসংস্কারের উদাহরণ দেয়ার জন্য জসীমউদ্দীন এই ছবি আঁকেননি। তিনি স্পষ্টতই এইভাবে সন্তান জন্ম দেয়ার মন্দ দিকটা সম্পর্কে পরিষ্কার ছিলেন।

“মাত্র কয়েকখানা ছেঁড়া নেকড়া, পুরাতন কাঁথা ছাড়া প্রসূতিরা আগে কিছুই সংগ্রহ করিয়া রাখিত না। সন্তান হইলে একজন দৌড় পাড়িত, বাঁশের ঝাড় হইতে ‘নেইল’ (বাঁশের ধারালো ছাল) কাটিয়া আনিবার, অপরজন দৌড়াইয়া যাইত ও-বাড়ি সে-বাড়ি হইতে একটু মধু আনিয়া সেই মধু সদ্যোজাত শিশুর মুখে দিতে। প্রসূতি যদি বেদনায় অজ্ঞান হইয়া পড়িত তখন তাহার মাথায় তেলপানি দেওয়া হইত। সেই তৈল যদি বাড়িতে না থাকিত অপর বাড়ি হইতে তৈলের বাটি লইয়া তৈল আনিবার জন্য কোনো লোকের দৌড়াইতে হইত। আনাড়ি দাইয়ের অপরিষ্কার হাতে নাড়ি কাটাইতে কত শিশু ধনুষ্টষ্কার হইয়া মারা যাইত। লোকে বলিত, শিশুকে পেঁচোয় পাইয়াছে। এজন্য ওঝা ও ফকির বৈষ্টমেরা সুর করিয়া মন্ত্র পড়িয়া সরলপ্রাণ গ্রামবাসীদের নিকট হইতে বেশ কিছু আদায় করিয়া লইত। আমার ছোট ছোট দুইটি ভাই আঁতুড়ঘরেই মারা যায়। একটি ভাইকে কাফনে সাজাইয়া যখন কবর দিতে লইয়া যায় মা তখন কাঁদিয়া আমার চাচিকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিয়াছিলেন, ‘দেখ বু! আমার বাছা সাজিয়াগুজিয়া বিবাহ করিতে চলিয়াছে।’ সেই কথাটি আজও আমার মনে আছে।”

সন্তান প্রসব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কিন্তু জন্ম সম্পর্কে সমাজের যে-দৃষ্টিভঙ্গি-জন্মমাত্রই পূর্ব জন্মের পাপের ফল( অতএব জন্মের স্থান, কাল ও পাত্র ছিল অশুচি, অপবিত্র। সেটা হিন্দু সমাজে যেমন, মুসলমান সমাজে তেমনই ছিল। খুব বেশি দিনের কথা তাহলে নয়। মাত্র জসীমউদ্দীনের আগের প্রজন্মের কথা। জন্ম সম্পর্কের এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং আঁতুড়ঘরের এই বাস্তবতার মধ্যেও সন্তানের জন্ম হয়েছে এমনকি মায়েরা সকলে অসুস্থ হননি। অনেকে দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।

‘আমার মায়ের সংসার ছিল একার। ছয়দিন আঁতুড়ঘরে থাকিয়া সাতদিনের দিন গোসল করিয়া মা বাহির হইয়া আসিতেন। তখন হইতে আমাদিগকে রান্নাবান্না করিয়া খাওয়াইতেন। আমার এক দূরসম্পর্কের চাচী ছিলেন। তিনি সন্তান প্রসবের পরদিন হইতেই সংসারের কাজকর্ম করিতেন। সাতদিন পরে ঢেঁকিঘরে যাইয়া ধান ভানিতেন। তাঁর একটি সন্তানও নষ্ট হয় নাই।’

এর মধ্যেই হিন্দু পোয়াতি আর মুসলমান ঘরের পোয়াতির মধ্যে ফারাক ছিল।

‘আমাদের মুসলমান পাড়ায় কিন্তু সবচাইতে ভালো ঘরখানিই পোয়াতি মায়েদের জন্য রাখা হইত। এখনো তাহাই হয়। শিশুর জন্মের ছয়দিন পরে ‘ছয় হাটুরে’ হয়। এইদিন আঁতুড়ঘর লেপিয়া-পুছিয়া পরিষ্কার করা হয়। সামান্য ঝাল মিশাইয়া গুড় দিয়া সেমাই পাক করিয়া ও মুরগি রান্না করিয়া পোয়াতিকে খাইতে দেওয়া হয়। এই উপলক্ষে আÍীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের লইয়া একটি ছোটখাটো ভোজ হয়। যাহারা গরিব মানুষ তাহারা অভ্যাগত প্রতিবেশীদের পান-তামাক সাজিয়া দিয়া হাসিয়া গাহিয়া আঁতুড়ঘরখানিকে আনন্দমুখর করিয়া যায়। এই ধরনের একটি গান নিম্নে দেওয়া হই্ল --

জন্মিল জন্মিল গোপাল
আমির আলির ঘরেরে,
গোপাল জন্মিল কার ঘরে!

চাচির কোলে যায়া গোপাল জামা জুতা চাহেরে
গোপাল জন্মিল কার ঘরে।

খালার কোলে যায়া গোপাল মোহন বাঁশি চাহেরে
গোপাল জন্মিল কার ঘরে।

বাপের কোলে যায়া গোপাল মাথার টুপি চাহেরে
গোপাল জন্মিল কার ঘরে।

বোনের কোলে যায়া গোপাল রাঙা সুতা চাহেরে
গোপাল জন্মিল কার ঘরে।’

গানটি উদ্ধৃত করে কিভাবে হিন্দুর ঘরের গান মুসলমান ঘরে প্রবেশ করেছিল সেই দিনটির প্রতি জসীমউদ্দীন খেয়াল রেখেছেন।

‘এই গানটি হয়তো প্রথমে কোনো হিন্দুবাড়িতে গীত হইয়াছিল। কারণ গোপালের জন্ম হিন্দুবাড়িতেই হওয়া সম্ভবপর। প্রথমে কোনো মুসলমানি বধূ হয়তো, গানটি সেখান হইতে শিখিয়া আসিয়া আমির আলির নবজাতকের জন্ম-উৎসবে ইহাকে সামান্য পরিবর্তন করিয়া গাহিয়াছিল। সেই হইতে এই গান মুসলমান সমাজে চালু হইয়াছে। এরূপ আদান-প্রদানের ছাপ আমাদের পল্লীসঙ্গীতগুলিতে বহু আছে। গানগুলি বহু রীতিনীতিসম্পন্ন দুই ধর্মের লোকদের মধ্যে একটি সুন্দর মিলনসেতু রচনা করিয়া দেয়।’

আমাকে বড় উদ্ধৃতি দিতে হোল। আমার তর্ক হচ্ছে যে এখানে শুধু ভাষার বিষয় নিয়ে আলোচনার সীমা বেঁধে দিলে হবে না। কিভাবে নিজের অভিজ্ঞতা জসীমউদ্দীন বলছেন, কী তাঁর চোখে পড়ছে, কিভাবে তিনি বলছেন ইত্যাদি। তাঁর জীবনকথা বইতে এই ধরনের বহু উদাহরণ আছে। একই সঙ্গে তুলনা করে দেখতে হবে তাঁর সময়ের অন্য লেখকদের নজর কোথায় ছিল। বলাবাহুল্য, যে-অভিজ্ঞতা তাঁর মধ্য দিয়ে আমরা উপলব্ধি করি তার কোন তুলনা চলে না। তার বৈশিষ্ট্যই আলাদা। একে আধুনিকতা বা অনাধুনিকতা এই দুইয়ের কোন মানদণ্ডেই ফেলা যায় না। সত্যি বলতে কি আধুনিকতা আর অনাধুনিকতা দিয়ে বিচার এতই সেকেলে আর বস্তাপচা জিনিস যে, এসব নিয়ে সাহিত্যের বাজারে না ওঠাই ভাল।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে উকিল ধরে ‘খাঁটি বাংলা’ কেমন তা নিয়ে তর্ক আছে। সেটা ভাষায় সংস্কৃত আরবি ফারসির সংখ্যা কতটুকু সেই তর্ক মাত্র নয়। ভাষার গঠন প্রণালী, তার পদবিন্যাস তার চলন ইত্যাদি সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমি তার সঙ্গে যোগ করতে চাইছি আরও কয়টি দিক। যেমন (ক) লেখকের নজর কোন দিকে, (খ) সামাজিক অভিজ্ঞতা লেখকের বর্ণনার মধ্যে যেভাবে উঠে আসে পাঠক হিশাবে আমাদের বর্তমান সময়ে সেই সব কী ধরনের অর্থ তৈরি করে? (গ) লেখক কি পাঠককে তাঁর লেখা পড়াতে চান নাকি তাঁর রচনার আভিজাত্য প্রমাণ করতে চান ইত্যাদি।

এই তালিকাগুলো সবাইকে বিপদে ফেলার জন্য দিলাম। এটা বোঝানোর জন্য যে সাহিত্য বা ইতিহাস বোঝার জন্য নানান প্রশ্ন আমরা নানান ভাবে করতে পারি। ওতে আমাদের উপকার, অপকারের তো প্রশ্নই আসে না। জসীমউদ্দীনকে নিয়ে আরও মজার জিজ্ঞাসা জাগুক, খুবই আনন্দ হবে।

এই নিবন্ধটি ২০০৩ সালে কবির শতবার্ষিকী উদযাপনের উসিলায় লিখা। এখন প্রকাশের জন্য খানিক পরিমার্জনা করা হয়েছে। কিছু কথা মূল আলোচনার জন্য বেহুদা বলে এখন বাদ দিয়েছি।


বইপত্রের হদিস

জসীম ২০০১ । ‘জীবনকথা’, জসীমউদ্দীন, পলাশ প্রকাশনী, ঢাকা-১২১৭: ২০০১

জসীম ২০০২ । ‘স্মরণের সরণী বাহি’, জসীমউদ্দীন, পলাশ প্রকাশনী, ঢাকা-১২১৭: ২০০০

মামুন ২০০৩। ‘শতবর্ষে জসীমউদ্দীন’, নাসির আলী মামুন সম্পাদিত, ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ, মুজিব সড়ক, ফরিদপুর; ২০০৩

মোরশেদ ২০০২। ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’, সম্পাদনা মোরশেদ শফিউল হাসান, ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স।

 


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)

Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 7094 Leave comments (0) Bookmark and Share


Go Back To Arts & Culture
EMAIL
PASSWORD