- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
এক
শামসুর রাহমানকে ফরিদা আখতার ও আমি যখন হাসপাতালে দেখতে যাই তখন তার গায়ে নানা যন্ত্রপাতি। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট খুঁজে পেতে আমাদের বোকামির জন্যই সময় লেগেছিল। দোষ কিছুটা ছিল আইয়ুব আলীর; ও গাড়ি চালাচ্ছিল। তাকে বোঝানো যাচ্ছিল না যে শামসুর রাহমান আমার কোনো ভাই বা রক্তের সম্পর্কের কেউ নন। তিনি কবি। আমাদের খুবই বিষণ্ণ মুখ দেখে সে অবশ্য নিশ্চিত ছিল যে, শামসুর রাহমান আলবৎ আমাদের কাছের কোনো আত্মীয় হবেন, কিন্তু কি কারনে জানি ওর ধারণা হয়েছিল আমাদের বিষণ্ণতায় ও যেন ভড়কে না যায় সে জন্যই বুঝি আমরা সত্যি কথা বলছি না।
সে শুধু একবার প্রশ্নের ভঙ্গিতে বলল, ‘কবি? কবি শামসুর রাহমান?’ এর নাম হয়তো সে শুনেছে, কাগজে নিশ্চয়ই তার অসুস্থতার খবরও সে জানে। কিন্তু এ কবি তার ঠিক চেনা নয়, তার কবিও নন। আইয়ুবদের কবি জালালউদ্দিন খাঁ, খালেক দেওয়ান, রজ্জব দেওয়ান, আব্দুল হালিম...। সত্যিই, শামসুর রাহমান নন। আধুনিক’ কবিতা নামক ব্যাপারটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে অতি রহস্যের ব্যাপার। কারণ কবিতা মানে তো কবিতাই, কবিরা নিজেদের বা নিজেদের কবিতাকে ‘আধুনিক’ দাবি করার মধ্য দিয়ে যে অহঙ্কার ও আভিজাত্য দেখান সেটা আইয়ুবদের কাছে সহজেই ধরা পড়ে। বাজারে চকচকে রাংতা মুড়ে দিয়ে হরেক রকম দাবিতে নানা জিনিস বেচা-বিক্রি হয়, কে না জানে! সেসব দাবি আমাদের মানতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। কবিতা যদি নিজেকে ‘আধুনিক’ দাবি করে রাংতামোড়া হয়, কারন হয়ে কাব্যের বাজারে তাকে বিকাতে হবে তাহলে একটা সন্দেহ তৈরি তো হয়ই।
হাসপাতাল অবধি সারাটা পথ আমার মধ্যে গুনগুনিয়ে বাজল খালেক দেওয়ানের একটি গান; ‘মা লো মা, ঝি লো ঝি, বোন লো বোন আমি করলাম কি/রঙে ভাঙা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙে’.../ভেবে কয় খালেক দেওয়ানে চিন্তা কর আপন মনে / একদিন মিশিবা মাটির সঙ্গে, ভাঙা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙে।’
মৃত্যু, কামনা, শরীর, সময় ও যৌনতা সংক্রান্ত দুর্দান্ত কাব্য। যেমন কথায় তেমনি সুরের। এই গানটি বহু আগে যখন আমি শুনি সেই দিন থেকেই মৃত্যু ও কামনার এই অনির্বচনীয় কাব্যময়তা আমাকে টানে। কেন গানটি মন আচ্ছন্ন করে? কেন গানটি এখন মনে পড়ল ভেবে মন দোষী হয়ে উঠল। কার মৃত্যুর কথা ভাবছি আমি? কাকে বলছি যে, একদিন মিশিবা মাটির সঙ্গে? নাকি এটা নিছকই কাকতালীয়? হয়তো মনে পড়ছে ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। কার কাব্য? কার গান? শামসুর রাহমানের। আধুনিক কবিতার মধ্যে আমার অত্যন্ত প্রিয় কবিতার বই। শামসুর রাহমানের কবিতায় যে ‘মৃত্যু’ আর খালেক দেওয়ানের কাব্যে ‘একদিন মিশিবা মাটির সঙ্গে’ -- এ দুইয়ের মধ্যে কি কোনো মিল আছে?
না, নেই। এটা তো পরিষ্কার, শামসুর রাহমানের ভাষা শিক্ষিতদের আর খালেক দেওয়ানের মধ্যে তথাকথিত বয়াতিদের বয়ান: গ্রাম্য। গ্রাম্যতার ভাষা শহরের মানুষের ভাষা নয়। শামসুর রাহমান ‘আধুনিক কবিতা’ লিখেছেন, সেটাই তার সাধনা ছিল। খালেক দেওয়ান ‘কাব্য’, যাকে আমরা দর্শন বা ভাববিচার বলে থাকি। একজন ছাপাখানা ও পড়ার জন্য কবিতা। অন্যজন কণ্ঠ ও শ্রুতির জন্য শব্দ ও ভাবের ভেদবিচার। দু’জন এসেছেন দুটো ভিন্ন শ্রেণী ও সামাজিক বাস্তবতা থেকে, দু’জনের অভিজ্ঞতাও আলাদা। একজন কবিতা শোনার জন্য বা শোনাবার জন্য লেখেননি, পড়ার জন্য লিখেছেন। ছাপা হয়েছে মুদ্রণযন্ত্রে। সেখানে শুনবার একটা অস্পষ্ট রেশ থেকে যায়, কিন্তু শুনতে হয় চোখে দেখে, মনে মনে। অন্যজন গাইবার ও সামনে শ্রোতাদের বসিয়ে শোনাবার জন্যই কবিতা লিখেছেন। একজন ‘আধুনিক’ হওয়ার সাধনা করেছেন, অন্যজন সেই ভেদবিচার মানেননি, কাব্যকে নিছকই কাব্য হিশাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা ও বাচনভঙ্গির মধ্যে চর্চা করেছেন। একজন লেখাপড়া শেখা আধুনিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে পঠিত এবং নিছকই সেই শ্রেণীর রাজনৈতিক শক্তির কারণে কবিতার জগতে প্রধান পুরুষ বলে বিবেচিত। আধুনিক গণমাধ্যমে নির্বিচার শক্তিও এই শ্রেণীরই হাতে; কবিতার বিচারকও একই শ্রেণীর অন্তর্গত। আধুনিক কবির খ্যাতি গণমাধ্যম, রাষ্ট্র, সরকার কিম্বা বাংলা একাডেমি ও বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় আধুনিক প্রতিষ্ঠানের সুনজর ও স্বীকৃতির ওপর নির্ভরশীল। এগুলো কাব্যচর্চার বাইরের অকাব্যিক শক্তি। অন্যজন গণমাধ্যম, রাষ্ট্র, সরকার বা কাব্যচর্চার বাইরের কোনো অকাধ্যিক শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে খ্যাতি অর্জন করেননি। তাঁর কাব্যই তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। শ্রেণিভেদ, মুদ্রণযন্ত্র ও তথাকথিত ‘আধুনিকতা’ কবিদের মধ্যে ভয়াবহ পার্থক্য কবিতার জগতে তৈরি হয়েছে। বলা বাহুল্য এর মীমাংসা বাংলা কাব্যকে করতেই হবে। কাব্যের এ বিচার আমরা এখনও শুরুই করিনি। সে কারণে শিক্ষিত শ্রেণী নিছকই রাজনৈতিক ও অনেক সময় দলবাজির তোড়ে যখন শামসুর রাহমানকে ‘আধুনিক’ বাংলা কবিতার ‘প্রধান কবি’ বলে সম্বোধন করেন, তখন তাকে সম্মান নয়, স্বীকৃতি নয়, বরং অপমানই করা হয়। কারণ তার এ শিরোপা জোটে নিছকই ‘আধুনিক’ কবিতার সংকীর্ণ এবং সম্ভবত বাংলা কাব্যের বিপুল ঐশ্বর্যের দিক থেকে, নগণ্য জায়গা থেকে। আমরা বাংলা কাব্যের বিশালতা থেকে প্রশ্ন তুলি না যে একজন আধুনিক কবি আসলেই কোথায় আছেন। সেই বিশাল ও বিপুল ধারার মধ্যে আধুনিক কবিদের জালালউদ্দিন খাঁ, খালেক দেওয়ান, রজ্জব দেওয়ান, আব্দুল হালিমদের সঙ্গেই প্রতিযোগিতা করতে হবে।নইলে তাদের টিকে থাকাটা অকাব্যিক ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানের জোরে, কবিতার হিম্মতে নয়।
খালেক দেওয়ানের গানটি শোনার পর থেকে আমি প্রায়ই ভাবতাম খালেক দুর্ধর্ষ এ কারণে যে, তিনি যাকে সম্বোধন করে নিজেকে ‘একদিন মিশিবা মাটির সঙ্গে’ বলে শাসাচ্ছেন তিনি মা, মেয়ে এবং বোন; প্রেমিকা নন। আর ঠিক এখানেই খালেক দেওয়ানের অসাধারণ ভাবের শক্তি। কেন মাকে, ঝিকে কিংবা বোনকে এ কথা বলা? কারণ ‘কামনার সাগরে’ ভাঙা নৌকা বাইতে এসেছে খালেক। জীবন-শরীর-সময়কে কবি অন্য ভাবে ব্যবহার করতে শেখে নি। সেই না পারার হাহাকার আর কাকে বলা যায়? কার কাছেই বা আর ‘আমি করলাম কী!’ বলে ভুল স্বীকার করা যায়? যার প্রতি কামনার্ত হয়ে এ ভুল সেই প্রেমিকাকে বলার মধ্যে কোনো কাব্যময়তা নাই। যাঁর লীলা বিচিত্র এবং বহু এবং যার রূপ সম্পর্ক চর্চার ভেদ অনুযায়ী বিভিন্ন তাকে যখন শুধুই প্রেমিকায় পর্যবসিত করি তখন তার অন্য রূপ আড়াল হয়ে যায়। যখনই প্রেমিকাকে আমি শুধু প্রেমিকা গণ্য করি, তখ তাকে পর্যবসিত করি স্রেফ কামনায়। সে জন্যই ‘মা লো মা, ঝি ও লো ঝি, বোন লো বোন আমি করলাম কী!’ কী করলাম আমি এই জীবনে! কামার্ত আমার এ জীবনে আর সত্যিকারের প্রেম করা হলো না। কারণ প্রেমকে আমি কামের কাঁটায় বিদ্ধ করে রেখেছি। যদি মনে রাখতাম যে, একদিন মাটির সঙ্গে মিশে যাব তখন নিজের কামময় শরীরের রূপান্তর ঘটাতে পারতাম অমর প্রেমময় দেহে। কিন্তু সেটা তো হোল না।
শামসুর রাহমানের খানিক আগে আসা খালেক দেওয়ান বাংলার কাব্যজগতে নিঃসন্দেহে প্রধান প্রধান কবিদের একজন। বড় মাপের মানুষ। বলাবাহুল্য, তিনি একা নন, বাংলা কাব্য ও ভাবের বিপুল সমৃদ্ধি এবং বৈচিত্র্যের তল পাওয়া এখনও যেমন কঠিন তার কিনারাও বহু বিস্তৃত। আধুনিক বাংলা কবিতা বা আধুনিক বাংলা ভাষার কবিদের কাছে সে খবর আজো গরহাজির। এটা বাংলা কবিতা ও বাংলা ভাবচর্চার ধারার নিদারুণ দুর্ভাগ্য। সে কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে খালেক দেওয়ান যতটা কাছের, তার কাব্যে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ যত উত্তেজিত, উদ্বেলিত ও আকুল বোধ করে আধুনিক কবিরা ঠিক ততটাই দূরের।
আমরা যখন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে পৌঁছলাম তখন শামসুর রহমানের নাক বা মুখ দিয়ে টিউব ঢুকিয়ে নার্স কিছু একটা কঠিন চিকিৎসার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। আমি দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে শামসুর রাহমানের গলা দিয়ে একটা আর্ত গোঙানির শব্দ শুনে পিছিয়ে ভাবলাম নাক হোক কি মুখ হোক তাতে এ মুহূর্তে আমার কী এসে যায়! একজন কবির মুখ দিয়ে কিংবা নাক বরাবর টিউব ঢোকানো হোল কি হোলো না সেই অনাকাংখিত গবেষণায় কবি কিংবা কবিতার বিশেষ কিছুই যে আসে যায় না, সে হুঁশটুকু আমার ছিল। তবু ডেকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করল, ‘রাহমান ভাই, কষ্ট কি খুব!’ সেটা যে খুবই হাস্যকর হতো সন্দেহ নেই। কিম্বা ‘ক্যামন আছেন রাহমান ভাই’ গোছের কার্টেসি কপচাবার সময় নয় ওটা। লেকচার দেওয়া যেতো যে ‘আধুনিকতা’ এক ধরনের ইউরোপমুখী মানসিকতা এবং তার দ্বারা অনুপ্রাণিত কবিতার আদর্শ পরমুখাপেক্ষি বলে সীমিত হতে বাধ্য। কবিতা সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ বাংলা ভাষায় নেই বললেই চলে। এসব প্রসঙ্গ উঠলে শামসুর রাহমান শুনতে পছন্দ করতেন, নিজে বলার চেয়েও। কিন্তু কবিতার মধ্যে বাস করেন বলে বাংলা কবিতার ইতিহাসের মধ্যে নিজের কবিতাকে স্থাপন করার লড়াই ছিল তাঁর। অতএব এসব প্রশ্ন তিনি হয়তো খোদ কাব্যেই মীমাংসা চেয়েছেন, নিছকতত্ত্বে দিয়ে নয়। ফরিদা কাছে থাকলে জিজ্ঞাসা করা যেত টিউবটা এত লম্বা কেন, কবির কতটুকু ভেতরে এ যন্ত্র জবরদস্তি প্রবেশ করছে। কিন্তু আমাদের দুজনকে একসঙ্গে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট যারা পাহারা দিচ্ছিলেন তারা ঢুকতে দিলেন না। ইতিমধ্যে আওয়াজ আরো বাড়ল এবং একই সঙ্গে বুকের ভেতর থেকে গড়গড় একটা আওয়াজ। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। উপায় ছিল না।
টের পেলাম দ্বার রক্ষার দায় ছিল যার তিনি আমাদের সত্যি কথা বলেননি। যারপরনাই যত্নে যে রোগীরা তাদের কক্ষে প্রবেশ বারণ। তিনি বলেছিলেন, একজন একজন করে দেখে আসুন। একজনের বেশি কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না। কিন্তু এখন দেখছি অনেকেই আছেন। দাঁড়িয়ে দেখলাম শামসুর রাহমানকে দূর থেকে। পলকে দূর থেকে একটা শব্দ আমার কানে আবার বাজল, ‘ধার্য’।
দুই
একদিন মিশিবা মাটির সঙ্গে। মৃত্যু। শামসুর রাহমানের সঙ্গে কম বয়সী কবি হিশাবে আমার পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে ‘ধার্য’ কথাটির ইতিহাসে আছে। ’৭০ সালে ১২ নভেম্বর যে ঝড় হয়েছিল সে ঝড়ে মৃত্যু সম্পর্কে আমার নতুন এক অভিজ্ঞতা হয়। আমার দেশ নোয়াখালী। লাশের পর লাশ পড়ে থাকার দৃশ্যে আমি বিচলিত হয়ে যে কবিতা লিখেছিলাম তার মধ্যে একটি পংক্তি ছিল এই রকমঃ ‘পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি জমি আমার জন্য ধার্য করো’। মানুষের লাশ শেয়াল কুকুর-চিল-শকুন খাচ্ছে, এ দৃশ্য ছিল ভয়াবহ ও অসহ্য। অতএব আমার জন্য যেন পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি জমি ‘ধার্য’ করা হয়। বলাবাহুল্য ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তারিখ। এ সময় তুফান ও তুফান-পরবর্তী পরিস্থিতির মোকাবিলায় সরকার ও রাষ্ট্রের যে ব্যর্থতা তার কারণে তৎকালের পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল বিক্ষোভ জমে ওঠে।
শামসুর রাহমান কবিতাটি পছন্দ করেছিলেন। কবিতাটি ছাপা হওয়ার পর দেখা হওয়া মাত্রই বললেন। ‘ধার্য’ ধ্বনিটির ব্যবহার তার খুবই ভালো লেগেছে। তিনি কবিতার বিষয় নিয়ে আমাকে যত প্রশংসা করলেন তার চেয়ে বেশি তারিফ করলেন কবিতার গড়ন নিয়ে। আমাকে অনেক পরামর্শ দিলেন। আজ যখন পেছনের কথা ভাবছি তখন স্বীকার করি সে পরমার্শ ছিল কারিগরের। কবি নিঃসন্দেহে কারিগরও বটে। কবিতা আপসে আপ আসে এটা বাজে কথা। কবিতার একটা নিজস্ব কারিগরি আছে যেটা জানা, শেখা ও চর্চার দরকার। লেখালিখির শুরুর দিকে এ উপদেশটুকু দারুণ দরকারি ছিল আমার।
তার সঙ্গে নানা বিষয়ে নানা সময়ে কথা বলেছি। তিনি যেহেতু আধুনিকতাকেই একমাত্র আরাধ্য ধরে নিয়েছিলেন সেই কারণে কাব্যের ভাব বা বিষয় নিয়ে আমার কথা হয়েছে কম। তুলনায় কবিতার গড়ন ও গড়নের ইতিহাস নিয়ে তিনি বলতে আনন্দ পেতেন। ‘আধুনিকতা’কে ঐতিহাসিকভাবে বিচার করার রেওয়াজ আমাদের নেই। এর সঙ্গে বর্ণবাদ, ঔপনিবেশিকতা, সাম্রাজ্যবাদের যোগ বিচারও পারতপক্ষে আমরা করি না। সাধারণ ধারণা হচ্ছে যা কিছু ইউরোপীয় নয়, তাই ‘পশ্চাৎপদতা’। আধুনিকতা মানে প্রধানত ইউরোপীয় কবিতার আদর্শ।
আমার চেনা যেকোন কবির সঙ্গে যদি শামসুর রাহমানের তুলনা করি তাহলে আজ আমাকে প্রকাশ্যে বলতেই হয় যে, তাঁর মতো নির্ভার ও সরল প্রকৃতির কোন আধুনিক ‘কবি’ আমি দেখিনি। অত্যন্ত সরলভাবে নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করা এবং কিছু কূটতর্ক না করে অন্যের অহংকার খর্ব করারা অসাধারণ ক্ষমতা ছিল এ মানুষটির এবং তাঁর সঙ্গে সলজ্জ শিশুর মতো হাসি। আমি প্রায়ই ওই হাসির পেছনে সবজান্তা হওয়ার প্রিটেনশনের প্রতি উপেক্ষা দেখেছি। ওই উপেক্ষায় আমি সাংঘাতিক আমোদ বোধ করতাম। কথার ফাঁকে ফাঁকে ইংরেজি বলতেন, যেমন আই এম নট সিওর, আই এম নট কক সিউর এবাউট ইট। ‘কক সিওর’ কথাটির ব্যবহার আমি তার কাছেই প্রথম শুনেছি। তার নিজের কবিতার গড়ন নিয়েও কথা বলতে তিনি ভালোবাসতেন।
আর দশ জনের মতোই কবি শামসুর রাহমানও দোষেগুণে মানুষ। কিন্তু সুপুরুষ ছিলেন। তাঁর সঙ্গ ছিল আনন্দময়। তাঁর মুখ এখন আমার মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাবরি চুল মৃদু নাড়িয়ে তিনি যখন কোন বিষয়ে নিজের মত দিতে গিয়ে ‘আমি ঠিক জানি না, ফরহাদ’ বলতেন সেই মুখ আমার মনে পড়ছে। ‘আমি ঠিক জানি না’ কথাটা ছিল একদমই প্রতীকী, কাব্যময়, অর্থদ্যোতক। কারণ তিনি ঠিক জানেন না কথাটা সত্যি নয়। জানেন কিন্তু প্রকাশ্যে বলবেন না। কিংবা আসলেই যে জানেন না সেটা জানেন, কিন্তু অজানাকে নিয়ে তার বিস্ময়টা তিনি ভাঙতে রাজি নন, সেই কারণে যা জানেন না তা নিয়ে তাঁর উৎকণ্ঠা ছিল না। বিচলিত নন তিনি। তাঁর এ জেনেও না জানার ভাব আর সিধা চোখের দিকে তাকিয়ে সদানন্দময় কৌতুক -- এই মুখচ্ছবি আমার চিরকাল মনে থাকবে। অনেকের মধ্যে থেকেও কারো প্রশ্নে তিনি এই ‘আমি ঠিক জানি না’ কথাটা উচ্চারণ করেই আমার দিকে সোজা-সিধা দৃষ্টিতে তাকাতেন। আমি বুঝে নিতাম তিনি টের পেয়েছেন আমি তাকে বিশ্বাস করিনি। আসলে জগতকে জানা বা বোঝার সাধনা নয় কবির, বরং জগতে তার নিজের নতুন অভিজ্ঞতা জানান দেওয়াই কবির কাজ। ওই বিনয় বচনের মধ্যে দিয়ে কবি শামসুর রাহমান কবিদের এ সঠিক কবিস্বভাব রপ্ত করবার দরকার জানান দিতেন সম্ভবত।
কবি সমাজ বা রাজনীতির ঊর্ধ্বে নন। ফলে শামসুর রাহমানকে নিয়ে নানা তর্ক-বির্তক হবে ভবিষ্যতে। আমি নিশ্চিত শেষটা হবে কবিতা ও রাজনীতি উভয় দিক থেকে ইতিবাচক। আজ আমি শুধু তাকে আমার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য একটি হাসপাতালে বসে এ লেখাটি লিখছি। কিছুক্ষণ পরই আমার চোখের অপারেশনের জন্য আমাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতে হবে। লেখাটি যখন লিখছি, তখন শামসুর রাহমান নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে।
জীবিতাবস্থায় তাঁকে অনেক সময় দুঃখ দিয়েছি। কারণ হচ্ছে বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎকারে হয়তো তাঁর সম্পর্কে ঠিক যেভাবে বলেছি সেভাবে ছাপা হয়নি বা মুখে বলতে গিয়ে যা বলতে চেয়েছি তাঁর মধ্যে একটা নেতিবাচক ভাব ফুটে উঠেছে। তিনি সস্নেহে সব ক্ষমা করে দিতেন। আমি একটা লেখায় আমার নিজেরই ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে যখন একটি দৈনিক পত্রিকায় লিখি এবং তাঁর প্রতি আমার ভালোবাসা জানাই, তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন। সে লেখাটি লিখে আমি নিজেও খুবই খুশি হয়েছি। আরো বেশি খুশি হয়েছি এ কারণে যে, তিনি টেলিফোন করে লেখাটি সম্পর্কে আমাকে নিজের খুশির কথা জানিয়েছিলেন এবং আমি তারপর তাঁর বাসায় দীর্ঘ সময় নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি।
নিজের শক্তি ও অর্জন সম্পর্কে নিশ্চিত যে কোন মানুষের মতোই শামসুর রাহমান কারো সমালোচনায় রুষ্ট হতেন না। তিনি সমালোচনার নামে নোংরামি পছন্দ করতেন না। মিজানুর রহমানের সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর কবিতার রাজনৈতিক পাঠে তিনি খুশি হননি। সত্য। কিন্তু তার জন্য তিনি কখনোই কোন রাগ প্রকাশ করেননি। শুধু একবার বলেছিলেন, আপনার বিচারে রাজনৈতিক বিচারটাই প্রধান হয়ে উঠেছে। কবিতার বিচার তো আরও অপরাপর দিক থেকে হতে পারে। কথাটা সত্য। ফলে আজ একটা কর্তব্য আমার থেকেই যাচ্ছে যে, তাঁর কবিতাকে কাব্যের দিক থেকে বিচার করব কীভাবে আমরা? বাংলা কাব্য ও ভাবের ইতিহাস ও বিবর্তনের জায়গা থেকে? কিভাবে?
সে ধারণা দেওয়ার জন্য মানবজমিন পত্রিকার জন্য আমি তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নেই। সেখানে আমার কিছু কথা আছে। এখানে আর তুলব না। এখানে কয়েকটি কথা তালিকার মতো বলে রাখব, যাতে আগামী দিনে এ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যায়।
এক. কবি হিশাবে আমি শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদকে বাংলাদেশের ‘আধুনিক’ কবিতার পার্থক্যসূচক নতুন আরম্ভ বলে মনে করি, এবং একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজনকে আমাদের কবিতার ‘প্রধান কবি’ বলতে নারাজ। ঘোরতর অন্যায়ও বটে। এ দুজনের কবিতাকে একসঙ্গে অনুধাবন, তাদের ব্যর্থতা ও সফলতার বিচার এবং তারা বাংলা কবিতার ইতিহাসের মধ্যে কোথায় কবিতাকে তাঁদের সমকালীন বাংলা কবিতা থেকে আলাদা করে ফেলেছেন তা শনাক্ত করার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের কবিতা নিজের পথ তৈরি করতে পারবে।
দুই. শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ ছাড়া বাংলাদেশে তাৎপর্যপূর্ণ কোন কবি এখনও আসেনি, এর কারণ হচ্ছে তারা কবিতার যে পথটা বাংলাদেশের জন্য বাঁধতে চেয়েছিলেন তরুণ কবিরা সেই পথে যায়নি। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তনগন্য দুই একজন ছাড়া তরুণরা কলকাতার কবিদেরই উপাস্য মনে করেছেন। বাংলাদেশে অনেক ভালো ও শক্তিশালী কবি আছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাঁদের অবদানও অনেক। কিন্তু আমি সজ্ঞানে কেন এ দু’জনকে একসঙ্গে বাঁধলাম কারণ এ দু’জনেরই কাব্যে এক নতুন জনগোষ্ঠীর আবির্ভাবের ইঙ্গিত আছে। ‘আধুনিক’ কবিতার নতুন ভাষা তৈরির যে প্রয়াস আমরা দেখি অন্যদের মধ্যে আমরা তা পাই না। এ ভাষা মানুষের অনেক কাছের এবং একটি জনগোষ্ঠীর উত্থান-পতনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত।
তিন. এই দুজন কবির কাব্যাদর্শ বিচার করলে এবং তথাকথিত ‘আধুনিকতা’র মানদণ্ডের বাইরে বাংলার ভাববিচারের জায়গা থেকে পর্যালোচনা করলে আমরা বাংলা কাব্যের বিভাজন রেখা চিহ্নিত করা ও তা ভাঙার প্রক্রিয়া সম্ভবত শুরু করতে পারব। পরানের গহিন ভেতরের কবি সৈয়দ শামসুল হক এ কাজটা শুরু করেছিলেন, সেলিম আল দীন তাঁর নাটকেও। কিন্তু কাজটা গুরুত্ব আমরা এখনও বুঝি না। ফলে সেই কাজ গুছিয়ে করা হয় নি।
চার. কবিদের প্রতি আমার বিনীত আবেদন যে, তাঁরা যেন দলবাজি ত্যাগ করেন, কবিতাকে কবিতার শক্তিতে বলীয়ান করেন এবং এখন কবিতার কাজটা আসলে কী সে বিষয়ে কথাবার্তা, তর্ক-বিতর্ক শুরু করেন। কাব্যহিংসা ও কবিতা নিয়ে দলাদলি হোক; কিন্তু দলবাজি করে কাউকে বড়ো কবি, কাউকে প্রধান কবি ঘোষণা দেওয়া বিরক্তিকর।
পাঁচ, বাংলাদেশের কবিতা শুধু বাংলাদেশের কবিতা হবে না। সেই দিন আর নাই যেখানে লোকাল আর গ্লোবালের মধ্যে দুস্তর ফারাক অতিক্রম করা যাচ্ছিল না। আমরা আমরাও এই দূরত্ব অনতিক্রম্য গণ্য করতাম। এখন যিনি বাংলা ভাষার বড় কবি হবেন, তিনি একই সঙ্গে দুনিয়ার কবিকুলেরই অন্তর্ভূক্ত হবেন। তাঁর কাব্য পৃথিবীর কাব্যচর্চারই অংশ হবে। অবশ্যই।
সেটাই যেন আমাদের সাধনা হয়।
লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)