বেনজীন খান


Sunday 13 September 09

print

পানি আগ্রাসন রুখে দিন, সোচ্চার হোন

ফারাক্কা

এ বছর বাংলাদেশের সর্বাধিক তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে যশোরে ৪৩.৭ ডিগ্রী। ১৯৯৫ সালের ২৪ মার্চ বিশ্বের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো বাংলাদেশের ঈশ্বরদীতে। অর্থাৎ বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চলেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধি। এর জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার পানি একতরফা প্রত্যাহার।

১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল মাত্র দু’সপ্তাহের জন্য ভারত ফারাক্কা বাধঁ চালু করার সময় বাংলাদেশকে অনুরোধ করে তার ফিডার ক্যানেলের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য মাত্র ১১ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহারের অনুমতি দিতে। সেই শুরু। তারপর ধিরে ধিরে উধাও হয়ে গেল বাংলাদেশের লাবন্য, সুখ। ৭৫ ফুট উঁচু ১০৯টি স্তম্ভের ওপর ১০৯টি গেট সম্বলিত ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রতিভাত হলো মরন ফাঁদ হিসাবে। সেই থেকে ভারত আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতি লংঘন করে একের পর এক একতরফা পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। ফলে শুকিয়ে গেছে আমাদের পদ্মার ধারা। মানুষ্যসৃষ্ট এই বিপর্যয় বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চলেও ধ্বংসাত্মক আঘাত হেনেছে। ৪০ মিলিয়ন মানুষ হয়েছে বিপর্যস্ত। প্রকৃতির উপর পড়েছে বিরুপ প্রভাব। বিপন্ন হয়ে পড়েছে পরিবেশ। বিধ্বস্ত হয়েছে কৃষি, অর্থনীতি। মারা যাচ্ছে গাছ। বেড়েছে লবনাক্ততা। শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। আর এভাবেই তাপমাত্রা বেড়ে বেড়ে এই অবস্থায় পৌছেছে। সর্বাধিক ক্ষতি হয়েছে কৃষির। গঙ্গার পানি কমে যাওয়ায় ষাটের দশকে চালু হওয়া দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প (জিকে প্রজেক্ট) বন্ধ হয়ে গেছে ১৯৯৩ তে। এ প্রকল্পের অধীনে ৩ লাখ একর জমি সেচ সুবিধা পেত। এতে ক্ষতি হয় ১০০ কোটী টাকার ফসল। রবি ও খরিপ ফসল হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। গাঙ্গেয় প্রবাহের ২০০ প্রজাতির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ী চাষ হয়েছে ব্যাহত। হাজার হাজার ধীবর পরিবার দিন গুনছে মৃত্যুর। প্রায় ২০০ মাইল নৌপথ শুস্ক মৌসুমে বন্ধ হয়ে গেছে। শত শত মাঝি মাল্লা ছেড়ে দিয়েছে পেশা। ভূগর্ভস্থ পানি নিঃশেষ হবার পথে। পানির গুন কমছে। জমি হারিয়ে ফেলেছে উর্বরতা। মোট কথা কৃষি, মৎস্য, বনায়ন, শিল্প, নৌপথ সব ক্ষেত্রে মোট লোকসানের পরিমাণ সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার (১৯৯৫)। বাংলাদেশের একাংশের জনগন পৌঁছে গেছে দারিদ্র ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যা মানবাধিকার ও ন্যায় বিচারেরও পরিপন্থী।

টিপাইমুখ

ফারাক্কার অভিশাপে মর-মর মানুষের জীবনে ভারত এবার চাপিয়ে দিতে যাচ্ছে টিপাইমুখী বাঁধের অভিশাপ। টিপাইমুখ উত্তর-পূর্ব ভারতের মুনিপুর রাজ্যের ছেরাছাজের জেলায় অবস্থিত। যেখানে এসে মিলিত হয়েছে আন্তর্জাতিক নদী বরাক ও তুইডি। বলাচলে এই বরাক ও তুইডি নদীর সঙ্গমস্থলের নাম টিপাইমুখ। এখান থেকে বরাক পুনরায় দুই ধারায় সুরমা ও কুশিয়ারা নাম নিয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট জেলায় অমলসিদ নামক স্থানে প্রবেশ করেছে। পরে সুরমা ও কুশিয়ারা মিলিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী মেঘনায়। ভারত সরকার সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারত বিশেষ করে মনিপুর, মিজোরাম ও আসাম রাজ্যের লাখ লাখ আতংকিত, ক্ষুদ্ধ জনতা এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহের কোটী কোটী উদ্বিগ্ন মানুষের মতামত ও প্রতিবাদ উপেক্ষা করে গত ডিসেম্বর (২০০৮) মাসে এই টিপাইমুখ বাঁধ বাস্তবায়নে সম্মতি প্রদান করেছে। এটির নক্সা চুড়ান্ত। প্রস্তুতিমূলক কাজও শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। সিলেটের জাকিগঞ্জ সিমান্ত থেকে ১০০ কি.মি দূরে নির্মিত হবে এই নদী সংহারক বৃহৎ বাঁধ। এর দৈঘ্য হবে ১৫০০ ফুট ও উচ্চতা ৫০০ ফুট। আগামী ২০১২ সালের মধ্যে বাধের নির্মাণ কাজ শেষ হবে। খোদ ভারতীয় জনগনই এই বাঁধ নির্মানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কারণ এর ফলে মনিপুর, মিজোরাম, আসামের মানুষ ও পরিবেশ ব্যাপক ক্ষতির সন্মুখীন হবে, বরাক এবং অন্যান্য নদীর পানি প্রবাহ হ্রাস পাবে ১৭,৩৫৪ কিউসেক। বাঁধ সংলগ্ন ১৬টি গ্রাম সম্পূর্ণ জলমগ্ন হবে। আরো ৭৩টি গ্রামের সকল স্থান বন্যার্ত হবে, উৎখাত হবে ১৩২০টি আদিবাসী পরিবার, বিনষ্ট হবে তাদের ২৭,২৪২ হেকটর বন ও পাহাড়ী ভূমি। আর এই টিপাইমুখী বাঁধ বাংলাদেশের জন্য ডেকে আনবে মহাবিপর্যয় কারণ এই বরাক নদীই বাংলাদেশে সুরমা-কুশিয়ারা পরবর্তিতে এই দুই নদী মিলে হয়েছে মেঘনা ফলে বরাক-সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা একই পানি প্রবাহ যা সর্বমোট ৯৪৬ কিলোমিটার এলাকায় বি¯তৃত হয়ে আছে। এর মধ্যে ভারতে রয়েছে ২৭৭ কিলোমিটার আর ৬৬৯ কিলোমিটার বাংলাদেশে। এই বাঁধ নির্মিত হলে এই দীর্ঘ এলাকার পানি সরবরাহ হ্রাস পাবে, পাহাড়ী ও সমতল বন, গাছ-গাছালী, ফল-ফসল, কৃষি উৎপাদন, জলাশয় অন্যান্য ছোট বড় শাখা নদী সমূহ পানি বঞ্চিত হবে, বিনষ্ট হবে নৌ-পথ, শুরু হবে মরুকরণ, উপরের দিকে উঠে আসবে সমুদ্রিক লোনা পানি, জমি হবে লবনাক্ত, সৃষ্টি হবে পানিয় জলের সংকট, বিপর্যস্ত হবে বাংলাদেশের পরিবেশ ও লাখো কোটি জনতা।

টিপাইমুখী বাঁধ বানাতে যেয়ে ভারত আন্তর্জাতিক নীতি ও কনকভেনশনও লংঘন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে (ক) জাতিসংঘ জলপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭ এর পানি সমব্যবহার, অন্যের প্রতি ক্ষতি নয়, সংশ্লিষ্টদের মধ্যেম তথ্য বিনিময় সংক্রান্ত ধারাসমূহ (খ) বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার ফারাক্কা চুক্তি ১৯৯৬ এর সমতা, স্বচ্ছতা ও অন্যের ক্ষতি না করার শর্ত (গ) বিশ্ব ব্যাংকের পরিবেশ নীতিমালা (ঘ) বিশ্ব বাঁধ কমিশন নীতিমালা (ঙ) আন্তর্জাতিক জীব-বৈচিত্র সংরক্ষন ঘোষনা (চ) জাতি সংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষনা (ছ) উন্নয়ন বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষনা ও (জ) সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনা ১৯৪৮। ভারত আমাদের বন্ধু প্রতীম প্রতিবেশী দেশ। নিু অববাহিকার দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি, কনভেনশন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার পানি চুক্তি এবং ভারতীয় মন্ত্রীদের আশ্বাস মোতাবেক বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোন নদী-ভিত্তিক কার্যক্রম ভারতের করার কথা নয়, কিন্তু বাস্তবে তারা করেছে।

riverlinking project

আন্ত:নদী সংযোগ

ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্প বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের বিরোধী। ৩০টি সংযোগ খাল দিয়ে ব্রহ্মপুত্রসহ অন্ততঃ ৩৭টি নদী সংযোগের মাধ্যমে ভারত ১২৪ বিলিয়ন ডলারের একটি আন্তঃসংযোগ প্রকল্প গ্রহন করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর অর্ধেক পানি প্রত্যাহার করে ভারতের দক্ষিনাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হবে। এই প্রকল্প পরিবেশ বিপর্যয়সহ আমাদের অর্থনীতি ও সমাজ জীবনকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।

এই নদী সংযোগ প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশের ফসলের উৎপাদন কমে যাবে। আর্সেনিক দূষন বাড়বে। মরুকরণ বাড়বে। বনাঞ্চল ধ্বংস হবে। পানি সংকট বাড়বে। স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়বে। সামুদ্রিক লবনাক্ততা বাড়বে। বিদ্যুৎ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নদী ব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট হবে। প্রাণ-বৈচিত্র হারিয়ে যাবে। এছাড়া আরো নানা রকমের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় এই ধরণের আগ্রাসী প্রকল্পের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরী।

আমাদের বারবার মনে রাখা দরকার- বাংলাদেশ আজ ভারতের দানবীয়, উন্মাদীয়, উদ্ভট নদীসংযোগ পরিকল্পনায় পুরোপুরি ধ্বংসের মুখোমুখী।

আমরা এখন কি করবো? আমাদের নিজস্ব রাজনৈতিক বিভাজন ও মতপার্থক্যের মধ্যেও বাংলাদেশ বাঁচানোর স্বার্থে আজ ঐক্যবদ্ধ আর্তনাদ ও চিৎকার চাই। এই চিৎকার শুধু সার্ক মঞ্চে নয়, জাতিসংঘ এবং বিশ্ব ব্যাংকের দ্বারপ্রান্তেও পৌঁছাতে হবে। জাতিসংঘকে বলতে হবে- তোমরা একটি জাতি ধ্বংস করার ভারতীয় পরিকল্পনা ঠেকাও। বিশ্ব ব্যাংকে বলতে হবে-ভারতের নদীসংযোগ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ভারত তোমার কাছে ১২৪ বিলিয়ন ডলার অর্থের জন্য ধরণা দিচ্ছে, তোমরা এই মহাবিপর্যয় সৃষ্টিকারী নদী সংযোগ পরিকল্পনায় অর্থ দিও না। এই চিৎকার বিশ্ব ব্যাংকের সদর দপ্তরে পৌঁছে দিতে হবে। ইউনেস্কো ঘোষিত ‘হেরিটেজ অঞ্চল’ বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে নদী সংযোগ পরিকল্পনায়। ইউনেস্কোকে বলতে হবে তোমরা ভারতের নদী সংযোগ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হও।

এই চিৎকার আজ জাতিসংঘে পৌঁছাতে হবে।

এ চিৎকার বিশ্ব ব্যাংক, ইউনেস্কোতে পৌঁছাতে হবে।

এ চিৎকার পৌঁছাতে হবে বিশ্ববাসীর কাছে।

টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, হোক্কাইডো থেকে হনুলুলু, হংকং থেকে হাম্বুর্ক

যে যেখানেই আছেন সেখানেই এই চিৎকার দিন।

আসুন ভারতের পানি ডাকাতির বিরুদ্ধে সবাই রুখে দাঁড়াই, গড়ে তুলি আন্দোলন।-

বেনজীন খান, যশোর-১৬ মে ২০০৯


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 2571 Leave comments (1) Bookmark and Share

Dr.1

I believe that Chintaa and similar organizations can launch an e-mail campaign for collecting signatures against India's water aggression against Bangladesh and appeal to the world bodies for taking necessary steps to stop India from such evil designs. Indian Green Peace campaign against its government's actions harmful to the environment may be an example of such campaign.

Only words will not bring us any benefit, I understand!

Sunday 21 March 10
Kalam A. Mir
Go Back To Issues
EMAIL
PASSWORD