অধিকার


Friday 26 June 09

print

নিষ্ঠুরতা বিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলন

১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৯৮৭ সালের ২৬ জুন সেই প্রস্তাব কার্যকর হয়। ১৯৮৭ সালে ১২ই ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদের গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতিবছর ২৬ জুন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক দিবস পালনের সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিবসটি পালিত হচ্ছে।

মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে নির্যাতনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে অবিলম্বে আইন করা বাংলাদেশের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ সরকার নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেছে। সেই কনভেনশন অনুযায়ী আইন প্রণয়ন ও তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দায় সরকারের।এই দিনে  সমাজের প্রতিটি স্তরের জনগণকে মানবাধিকার বিষয়ে সচেতন করার পাশাপাশি নির্যাতন বন্ধে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি এগিয়ে আসা দরকার

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সূচক অনুযায়ী বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ। বিভিন্ন সরকারের আমলে আটকাবস্থায় নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবকি আচরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। জরুরী অবস্থায় সময় নির্যাতনের মাত্রা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। সেনা সমর্থিত ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের জরুরী অবস্থার ২৩ মাসে মানবাধিকার কর্মীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি, সাংবাদিক, শিক্ষক এবং পেশাজীবী মানুষ নানাবিধ নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে।

বর্তমান নির্বাচিত সরকারের আমলেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনির হেফাজতে নির্যাতনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। অধিকার এর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, নির্যাতনের বিষয়টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের কাছে সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। নির্যাতনের বিষয়ে দীর্ঘদিনের দায়মুক্তি থাকার কারণেই এটি ঘটে আসছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সদস্যরা নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর অথবা অমানবিক আচরণ করাকে বিভিন্ন সময় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। যদিও সুদির্নিষ্টভাবে বলা মুশকিল যে, কতজন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এছাড়া নির্যাতনের ব্যবহার কোন্‌ কোন্‌ ক্ষেত্রে হচ্ছে তারও ধারণা পাওয়া কঠিন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুনরায় নির্যাতনের শিকার হওয়ার ভয়ে ভিকটিমরা মুখ বন্ধ করে রাখেন। তবে সাধারনত তথ্য আদায়ের সময়, স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি আদায়ের সময়, মিথ্যা বক্তব্য প্রদানের জন্য এবং কখনও কখনও বিরোধীমতের ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে নির্যাতন চালানো হয়ে থাকে। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী নির্যাতন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং তা কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্যাতন প্রতিরোধ করা অখণ্ডনীয় মানবাধিকার। কোন রাষ্ট্র সে অধিকার খর্ব করতে পারে না, হোক তা জরুরী অবস্থা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কিংবা অন্য কোন বিশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কিত।

বাংলাদেশে যে সমস্ত স্থানে সাধারণত মানুষ নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তির শিকার হয়ে থাকে সেগুলো- থানা, বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টার এবং কারাগার। থানা, ডিটেনশন সেন্টার ও কারা হেফাজতে মানুষ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণের শিকার হয়ে থাকে। ফলে আটক ব্যাক্তিদের সম্মান ও মর্যাদাহানি ঘটে এবং সমাজে তাঁরা নানভাবে হেয়প্রতিপন্ন  হন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কনভেনশন মতে কোন ডিটেনশন সেন্টার বা কারাগারে কোন পরিস্থিতি বা কোন অজুহাতেই কাউকে নির্যাতন অথবা নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তি দেয়া যাবে না।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারো সাথে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। এছাড়া ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ প্রণীত নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সনদ- ‘নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে কনভেনশন’ অনুমোদন করেছে। কনভেনশনে স্বাক্ষর দান ও অনুমোদনকারী প্রতিটি রাষ্ট্রপক্ষ তাদের জাতীয় আইনে নির্যাতনকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে সম্মত হয়েছে।

কনভেনশন এগেইস্ট টর্চার এর ১ ধারায় বলা হয়েছে- “এই কনভেনশনের প্রয়োজনে ব্যবহার্য ‘নির্যাতন’ শব্দটির অর্থ যে কোন কাজ যা দৈহিক বা মানসিক ব্যথা বা দুর্ভোগ বৃদ্ধি করে এবং যা অন্য কোন মানুষ বা তৃতীয় কারো কাছ থেকে কোন তথ্য বের করার কাজে বা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করা হয়; নির্যাতিত ব্যক্তি বা তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে কোন অপরাধ করে থাকলে বা করেছে বলে সন্দেহবশত শাস্তি প্রদান করা হলে; অথবা ভয় দেখানোর জন্য বা আতংক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কোন সরকারি কর্মকর্তার নির্দেশে, সম্মতিক্রমে বা অন্য কোন পন্থায় এ ধরনের যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী নির্যাতন যে কোন যুক্তিতে বা যে কোন ধরনের বৈষম্যের কারণে চাপিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য আইনগতভাবে কার্যকর কোন দণ্ডজনিত যন্ত্রণা বা দুর্ভোগ এর আওতায় পড়বে না।”

নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক (আইসিসিপিআর) সনদে বাংলাদেশ সরকার অনিস্বাক্ষর করেছে ২০০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এই সনদের ৭ ধারায় বর্ণিত আছে- “কাউকে নির্যাতন অথবা কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক কিংবা মর্যাদাহানিকর আচরণের শিকার করা যাবে না অথবা অনুরূপ শাস্তি প্রদান করা চলবে না। বিশেষ করে কাউকে তার অবাধ সম্মতি ব্যতিরেকে ডাক্তারি কিংবা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণের পাত্র করা যাবে না।”

নির্যাতন শারীরিক বা মানসিক হতে পারে। হতে পারে বিভিন্ন পদ্ধতি-পন্থায়। যেমন- বৈদ্যুতিক শক, পায়ের তালুতে পিটানো, যন্ত্রণাদায়ক ভঙ্গিতে ঝুলিয়ে রাখা, পিটানো, ধর্ষণ, শ্বাসরোধ, সিগারেট দিয়ে পোড়ানো, অভুক্ত বা অনাহারে রাখা, ঘুমাতে না দেয়া, স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া, ভীতিপ্রদর্শন, প্রতিকী ফাঁসি ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল নির্যাতনকে মানুষের সম্মান/মর্যাদাহানিকর অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং অগ্রহণযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যা বিশ্বের কোনও অঞ্চলই এর আওতামুক্ত নয়। নির্যাতন প্রতিরোধে কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক মতবাদ গড়ে উঠেছে, যা যুদ্ধাবস্থা কিংবা জাতীয় নিরাপত্তাজনিত কোন অবস্থাতেই খর্ব করা চলবে না। মানবাধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি কোন সরকার অনুমোদন করুক বা না করুক নির্যাতনের ওপর নিঃশর্ত নিষেধাজ্ঞা জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের ওপর বাধ্যবাধকতা হিসেবে স্বীকৃত। যদিও বাংলাদেশ সরকার এ সংক্রান্ত প্রতিটি আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর এবং অনুমোদন করেছে তা সত্ত্বেও অনেকেই আটকাবস্থায় নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তির শিকার হচ্ছেন। তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশে নির্যাতনকে এখনও অপরাধ হিসেবে গণ্য না করা। জাতীয় পর্যায়ে আমাদের কোন নির্যাতন বিরোধী আইন না থাকায় এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক নির্যাতন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।

ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে নির্যাতনকে এখনও ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা হয়নি। নির্যাতন বিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে (ক্যাট) স্বাক্ষরিতদেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখনও নির্যাতন বন্ধে আইনী বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করছে না। অথচ নির্যাতন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং এটিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশেও নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। মানবাধিকার সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, অপরাধীকে শাস্তিদান এবং ভিকটিমকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে আন্তর্জাতিক কনভেনশন মেনে চলা উচিত।

 


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 1469 Leave comments (0) Bookmark and Share

Go Back To Issues
EMAIL
PASSWORD