- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
খেয়ে না খেয়ে ধর্ম-বিরোধিতার ধারার পেছনে আসলে আধুনিক কালের একটি সস্তা অনুমান প্রকট ভাবে কাজ করে। শুরুতে তা কিছুটা উল্লেখ করেছি। বাংলাদেশে আমরা এরই প্রাবল্য লক্ষ করি। সেটা হোল, ধর্মের মধ্যে কোন চিন্তা নাই। ধর্ম, ধর্মভাব বা ধর্মচিন্তা বুঝি চিন্তাহীনতার নামান্তর। তাহলে চিন্তা করার অর্থ হচ্ছে চিন্তাহীনতা থেকে মুক্ত হওয়া। যেহেতু ধর্ম মানেই চিন্তাহীনতা তাই চিন্তাহীনতা থেকে মুক্ত হওয়ার পথ হচ্ছে ধর্মকে চিন্তার জগত থেকে বাদ দেওয়া, ধর্মের বিরোধী হওয়া। যদি ধর্মকে চিন্তাশূন্য গণ্য করা হয় তাহলে এই ধরনের সিদ্ধান্তই স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। ‘মুক্তচিন্তা’র অর্থ হয়ে ওঠে ধর্ম থেকে দূরে থাকা, ধর্মহীন হওয়া, ধর্মকে সমাজ ও রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করে প্রাইভেট ব্যাপারে পরিণত করা, ইত্যাদি। আর, এটা তো আমরা বাংলাদেশে হরদমই দেখি যে নাস্তিক হবার বালখিল্যতার মধ্যে তথাকথিত ‘মুক্তচিন্তা’(?) নিজের গৌরব আবিষ্কার করে।
তবে দর্শনের জগতে ধর্মের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছেন, ধর্ম সম্পর্কে কোন সস্তা ও অর্বাচীন অনুমান নিয়ে তাঁরা ধর্মের বিরোধিতা বা সমালোচনা করেন নি, কিম্বা আল্লার অস্তিত্বের তর্কে খামাখা জড়ান নি। তাঁরা ধর্মকে তার রূপ ও মর্ম সহ বুঝতে চেয়েছেন এবং সেই বোঝাবুঝির ওপর দাঁড়িয়ে ধর্মের বিরোধিতা, সমালোচনা বা পর্যালোচনা করেছেন।
ধর্ম সম্পর্কে আরেকটি প্রবল অনুমান রয়েছে। সেই অনুমান ধর্মে কোন চিন্তা নাই সেই একই ধারারই অনুবর্তী অনুমান, কিন্তু তার প্রকাশের রূপ আলাদা। বাংলাদেশে এই চিন্তাও অতি প্রকট। বিশেষত বাংলাদেশের বামপন্থি ও স্বঘোষিত কমিউনিস্টদের ধারার মধ্যে আমরা তার প্রাবল্য লক্ষ্য করি। একে সহজে শনাক্ত করা যায় না। কারন এরা যে কথার আড়ালে তাদের এই অনুমান জারি রাখে তার সঙ্গে মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন প্রমুখের ধর্ম সংক্রান্ত ভাষ্যের সঙ্গে বাহ্যিক, কিন্তু আংশিক মিল আছে। ফলে এদের বক্তব্য বাংলাদেশে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি করে বৈকি। ভাল করে পর্যালোচনা করলে দেখব, তারা আসলে ধ্রুপদি মার্কসীয় চিন্তার সম্পূর্ণ উলটা কথা বলছে।
এরা কী বলে? এরা বলে - “ধর্ম নিছকই শোষক শ্রেণির শোষণের হাতিয়ার”। একথাটা সত্যের অর্ধেক। কারণ এঙ্গেলস তাঁর ‘জার্মেনিতে কৃষক যুদ্ধ’ পুস্তিকায় দেখিয়েছেন বাস্তব ইতিহাসে কী ঘটেছে সেই আলোকে সঠিক ভাবে এই প্রশ্নের বিচার করতে হবে। এঙ্গেলস বলছেন,
“এমনকি ষোল শতকের যেগুলিকে বলা হয় ধর্ম যুদ্ধ সেগুলিতেও প্রধানত জড়িত ছিল বিভিন্ন স্পষ্ট-নির্দিষ্ট বৈষয়িক শ্রেণি স্বার্থ; সেগুলো ছিল শ্রেণি যুদ্ধও, ঠিক যেমন ছিল ইংলন্ড আর ফ্রান্সের পরবর্তী আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষগুলো। যদিও তখনকার শ্রেণি সংগ্রাম চলত ধর্মীয় বাগধারা অবলম্বন করে, যদিও বিভিন্ন শ্রেণির স্বার্থ, প্রয়োজন এবং দাবিদাওয়া থাকত ধর্মীয় পর্দার আড়ালে, তাতে বিষয়টার কিছুই বদলাত না, তদানীন্তন পরিবেশ থেকে সেটা বোঝা যায় সহজেই’ (‘জার্মেনিতে কৃষক যুদ্ধ’ ; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো (১৯৮১) থেকে মার্কস আর এঙ্গেলস’-এর লেখার সংকলন ‘ধর্ম প্রসঙ্গে’ দেখুন, পৃষ্ঠা-৯৬; (এঙ্গেলস, ১৯৮১, পৃ. ৯৬))।
ধর্মের যে ব্যাখ্যা বিপ্লবী কৃষকেরা খাড়া করেছিল সেটা সেই সময়ের সামন্ততান্ত্রিক চিন্তা ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে লড়বার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। ‘সামন্ততন্ত্রের প্রতি বৈপ্লবিক বিরোধিতা চলেছিল সমগ্র মধ্যযুগ জুড়ে’ (একই বই, পৃষ্ঠা ৯৭)।
ধর্ম সকল ক্ষেত্রেই শোষকের হাতে শোষণের হাতিয়ার – এর চেয়ে বিরক্তিকর আর বাজে কথা কিছুই হতে পারে না। মতাদর্শ হিসাবে ধর্ম সর্বকালে সর্ব ক্ষেত্রে শোষকদের হাতিয়ার এই দাবির কোন ভিত্তি নাই। মতাদর্শ হিসাবে ধর্ম একটি জনগোষ্ঠির মধ্যে কী ভূমিকা পালন করছে সেটা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে বিচার করতে হবে। সমাজ যখন বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত সেখানে কোন্ শ্রেণী কিভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা করছে পদ্ধতি হিসাবে সেই দিকে মনোযোগী থাকাই ধ্রুপদি মার্কসবাদের শিক্ষা। ধর্মকে নির্বিচারে শোষকদের মতাদর্শ গণ্য করা একান্তই ভূয়া মার্কসবাদীদের দাবি। এই কথাগুলো আমাদের বারবার বলতে হচ্ছে কারণ বাংলাদেশে কমিউনিস্ট নামের সংগঠনগুলোর ধর্ম বিরোধিতা -- বিশেষত ইসলাম বিদ্বেষী অবস্থান-- মার্কস, এঙ্গেলসসহ ইউরোপীয় চিন্তার বৈপ্লবিক ধারা থেকে বাংলাদেশের জনগণকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এটা বিপজ্জনক। স্থানীয় বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেও গোলকায়নের এ কালে বৈপ্লবিক রূপান্তর মাত্রই বৈশ্বিক চরিত্রের। ফলে ইউরোপীয় বা পাশ্চাত্য চিন্তার সীমাবদ্ধতা যেমন বাংলাদেশের বাস্তবতার জায়গা থেকে বোঝা দরকার, একই সঙ্গে ইউরোপীয় – বিশেষত খ্রিস্টিয় চিন্তাচেতনার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মের পর্যালোচনা বলতে মার্কস-এঙ্গেলস কী বুঝিয়েছিলেন সে সম্পর্কে আমাদের সঠিক মূল্যায়ন জরুরী। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন বা মাও জে দং – কারো চিন্তাই একালে পর্যালোচনার বাইরে থাকতে পারে না। সেটা আমাদের করতেই হবে। কিন্তু ধর্মের পর্যালোচনা করতে গিয়ে তাঁরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন সে সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা জারি না রেখে তাঁদের চিন্তার পর্যালোচনা অসম্ভব।
আমাদের আলোচনা প্রধানত ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে, ধর্মের সমাজতত্ত্ব বা ধর্মের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা নয়। আমরা যে কাজ করতে চাইছি তার তুলনায় সেটা হয়তো সহজ। তারপরও তার দরকার অবশ্যই রয়েছে। তবে আমাদের দাবি হচ্ছে সক্রিয় ও সজীব চিন্তার দিক থেকে ধর্মের পর্যালোচনা সাঙ্গ করা জরুরী। এটাই মার্কসেরই প্রস্তাবনা। ‘ধর্মের পর্যালোচনা যে কোন পর্যালোচনার পূর্বশর্ত’ – এটা তাঁরই কথা হেগেলের অধিকার ও রাষ্ট্রতত্ত্ব (A Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Right) সম্পর্কে লেখা একটি নিবন্ধের প্রথম বাক্যই এটা। তাছাড়া ইউরোপের মধ্যযুগের চিন্তাবিদদের সম্পর্কে ফ্রিড্ররিখ এঙ্গেলসের বিখ্যাত নিরীক্ষণও আমরা মনে করতে পারি। এঙ্গেলস বলেছিলেন,
“মধ্যযুগে যারা স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতেন তাঁদের আমল থেকে আঠারো শতকের এনলাইটনারদের (অর্থাৎ পাশ্চাত্যের এনলাইটমেন্ট পর্বের চিন্তাবিদরা) সহ পুরা কালপর্বে ধর্ম সম্পর্কে জোরদার মত ছিল এরকম যে সব ধর্মই, কাজেই খ্রিস্ট ধর্মটাও, প্রতারকদের ব্যাপার, হেগেল যখন দর্শনের কাঁধে বিশ্ব ইতিহাসের যৌক্তিক ক্রম বিকাশ দেখাবার কাজ গছিয়ে দিলেন তারপর থেকে এই রকম ব্যাখ্যা আর যথেষ্ট বলে পরিগণিত হোল না” (এঙ্গেলস, ১৯৮১, p. ১৯১)। এঙ্গেলসের ১৮৮২ সালের দিকে লেখা Bruno Bauer and Early Christianity মার্কস-এঙ্গেলস-এর ‘কালেক্টেড ওয়ার্কস’-এর ৪২ খণ্ডেও পাবেন; ৪২৭ -৮৩৫ পৃষ্ঠা )
এখানে যে ইঙ্গিত আমরা পাচ্ছি তা হোল হেগেলের আবির্ভাবের পর থেকে ধর্ম সম্পর্কে যে অনুমান ইউরোপীয় এনলাইটমেন্ট বা তথাকথিত ‘আলোকিত যুগ’-এর দার্শনিকরা করতেন সেটা আর কাজে লাগছে না। তাহলে ধর্ম সম্পর্কে এনলাইটমেন্টের দার্শনিকদের সঙ্গে হেগেলের পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য আমাদের বোঝার দরকার আছে। দ্বিতীয়ত হেগেল নিজে ধর্ম সম্পর্কে কি ভাবতেন সেটাও জানা দরকার। তৃতীয়ত পাশ্চাত্যে ধর্মের পর্যালোচনা থেকে আদৌ আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কিছু আছে কিনা তার খোঁজ খবর নেওয়াও আমাদের জন্য জরুরী।
এই হিসাবনিকাশ নেবার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে পাশ্চাত্য দার্শনিকরা ধর্ম বলতে প্রায় সবসময়ই খ্রিস্ট ধর্ম বুঝেছেন। মার্কস এবং এঙ্গেলসও তার ব্যতিক্রম নন। ল্যাটিন ‘রিলিজিয়ন’ বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে ‘ধর্ম’ কিম্বা ‘দ্বীন’-এই উভয় ধারণার পার্থক্য আছে। কিন্তু খ্রিস্ট ধর্ম সংক্রান্ত পর্যালোচনার এই প্রাথমিক আলোচনাগুলো সেরে না নিলে সেই ভেদ বিচার এবং বাংলাদেশে ধর্ম পর্যালোনার সম্ভাব্য পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা কোন ফলপ্রসূ আলোচনা করতে পারব না। ধর্মের অন্দরমহল অর্থাৎ ধর্মচিন্তার মর্মে প্রবেশ কঠিন হবে। মার্কস, এঙ্গেলস বা লেনিনের ধর্ম নিয়ে আলোচনার সময়ও আমাদের মনে রাখতে হবে যে তাঁরাও ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনার সময় খ্রিস্ট ধর্মকেই মনে রেখেছেন। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। গোড়ার খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে এই লেখাটি আরেকজন জর্মন দার্শনিক ব্রুনো বয়েরের মৃত্যু উপলক্ষে এঙ্গেলস লিখেছিলেন। এঙ্গেলস ব্রুনো বয়েরকে এই বলে তারিফ করছিলেন যে খ্রিস্টধর্মের ঐতিহাসিক উৎপত্তি সম্পর্কে ব্রুনো বয়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। এঙ্গেলস-এর দাবি খ্রিস্ট ধর্মের ঐতিহাসিক উদ্ভবের প্রশ্নে কমিউনিস্টরাও সমান আগ্রহী। সেই জন্য বয়েরের মৃত্যু উপলক্ষে খ্রিস্ট ধর্মের ঐতিহাসিক উদ্ভবের প্রশ্নটি কিভাবে আছে তার একটা হদিস নেবার চেষ্টা করছিলেন।
ধর্ম প্রতারণা মাত্র, নবি রসুলরা প্রতারক – এই ধরণের বালখিল্য থার্ড ক্লাস মূর্খতার যে বাড়াবাড়ি ‘মুক্তচিন্তা’, ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ চিন্তা নামে বাংলাদেশে আমরা দেখি সেই সবের বিরুদ্ধে সক্রিয় ও সজীব চিন্তার জায়গায় দাঁড়িয়ে কঠোর ও শক্তিশালী ভাবে রাজনৈতিক বিরোধিতা সংগঠিত করবার জন্যই আসলে ধর্ম পর্যালোচনার মর্ম পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসের ভেতর থেকে আমাদের বোঝা দরকার। পাশ্চাত্যে এই তর্ক কিভাবে হয়েছে তা জানা জরুরী। তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জানা দরকার যে মার্কস বা এঙ্গেলস ইসলাম সম্পর্কে কিছু প্রাচ্যবাদী (orientalist) লেখালিখির সঙ্গে পরিচয় ছাড়া কিছুই প্রায় জানতেন না। খ্রিস্টধর্ম বিজয়ী হয়ে দুনিয়াজোড়া আধিপত্য কায়েম করতে পেরেছে এঙ্গেলসের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রবল ছিল। তাঁর লেখায় এর জন্য বেশ আত্মতৃপ্তিও আমরা লক্ষ্য করি। খ্রিস্ট ধর্ম তার আগের ধর্মগুলোর তুলনায় কিভাবে এই বৈশ্বিক সাফল্য লাভ করল তার একটা সারমর্ম ব্রুনো বয়েরের লেখালিখির মধ্য থেকে এই নিবন্ধে এঙ্গেলস দাঁড় করিয়েছেন। যা আগ্রহী পাঠকদের জন্য উপভোগ্য হতে পারে। কিন্তু খ্রিস্ট ধর্মের পরে আরেকটি ধর্ম কিভাবে খ্রিস্ট ধর্মের বিপরীতে গড়ে উঠেছে সে সম্পর্কে এঙ্গেলসের কোন বক্তব্য নাই। কোন ধারণাও নাই। এই অভাব এঙ্গেলসের লেখাকে গুরুত্বহীন করে না। বরং তার ঐতিহাসিক অবস্থান শনাক্ত করতে আমাদের সহায়তা করে। এঙ্গেলস নিবন্ধের এক জায়গায় প্রশ্ন তুলেছেন,
“যে ধর্ম রোমের বিশ্ব সাম্রাজ্যকে নিজের অধীনে নিয়ে এসেছিল এবং ১৮০০ বছর ধরে সভ্য মানুষের বড় অংশের ওপর নিজের আধিপত্য কায়েম রেখেছিল তাকে স্রেফ প্রতারকদের জড়ো করা ভূয়া ব্যাপারস্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যে ঐতিহাসিক অবস্থায় এর আবির্ভাব এবং বিকাশ ঘটেছিল এবং আধিপত্য জাহির করবার জায়গায় পৌঁছেছিল তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সম্পন্ন না করে একে চুকিয়ে ফেলা যাবে না। একথা বিশেষ করে খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কে প্রযোজ্য” (দেখুন পৃষ্ঠা ৪২৮)।
প্রশ্ন হচ্ছে একথা শুধু খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে কেন প্রযোজ্য তার কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা এই নিবন্ধে কিম্বা অন্য কোন লেখায় এঙ্গেলস দিতে পারেন নি। কারণ তিনি যে যুক্তি দিয়েছেন তা সাধারণ ভাবেই সব ধর্মের উদ্ভব সংক্রান্ত সামাজিক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা হিসাবে খাটে। তিনি বলছেন:
“যে প্রশ্নের সমাধান করতে হবে সেটা হোল রোম সাম্রাজ্যের বিশাল জনগোষ্ঠি (খ্রিস্ট ধর্মের) এই ভূয়া ব্যাপার স্যাপার অন্য সব ধর্মের তুলনায় পছন্দ করলো কেন? যা দাস ও নিপীড়িত শ্রেণির সঙ্গে দর কষাকষির সময় ওয়াজ করে বেড়ানো হোত? যাতে উচ্চাকাংখী কন্সটান্টিয়ানও শেষ পর্যন্ত দেখল এই ভূয়া ব্যাপারস্যাপারকে ধর্ম হিসাবে মেনে নিয়েই তিনি নিজেকে রোমাকে সাম্রাজ্যের এরকচ্ছত্র শাসকে উত্তীর্ণ করতে পারেন” (একই নিবন্ধ, পৃষ্ঠা ৪২৮)।
ঠিক একই প্রশ্ন ইসলাম কিম্বা অন্য ধর্ম সম্পর্কেও করা যায়। কেন আরবে দাস ও নিপীড়িত শ্রেণির বিশাল অংশ ইসলামের পতাকা তলে জড়ো হয়েছিল? এঙ্গেলসের আলোচনা আমাদের এটাই শেখায় যে ধর্মের উদ্ভবের সামাজিক ও ঐতিহাসিক শর্তগুলো জানা দরকার। ধর্ম পর্যালোচনার জন্য এটা জরুরী। তবে সেটা সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রয়োজন মেটায়, কিন্তু চিন্তার সন্তুষ্টি বিধান করে কিনা সে বিষয়ে হেগেলের সন্দেহ ছিল। ধর্মের সামাজিক-ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় সজীব ও সক্রিয় চিন্তা পুরাপুরি সন্তুষ্ট হতে পারে না। আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব হেগেল কিভাবে এই তর্ককে একই ভাবে ঐতিহাসিক এবং তারই সমান্তরালে সক্রিয় ও সজীব চিন্তার নিজস্ব স্বভাবের তর্কে বা দ্বান্দ্বিক ধারাবাহিকতার চরিত্র দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন। মার্কস তরুণ বয়সে ‘ইয়ং হেগেলিয়ান’দের খপ্পরে পড়ে হেগেলের ভাববাদিতা থেকে নিজেকে সযত্নে দূরে রেখেছেন বটে, কিন্তু পরিণত বয়সে তাঁকে প্রকাশ্যে গুরু ঘোষণা দিয়েছিলেন।
হেগেল, বোঝা যাচ্ছে ,পাশ্চাত্য দর্শনে ধর্মের পর্যালোচনার তর্ক বোঝার জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক। অন্যদিকে তথাকথিত বস্তুবাদের কী ঘাটতি বা কী গাফিলতির জন্য ভাববাদ চিন্তার নৈর্ব্যাক্তিক প্রক্রিয়া হিসাবে গড়ে উঠেছে ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিস তৈরি করতে গিয়ে মার্কস সে বিষয়ে পরিষ্কার সতর্ক করে গিয়েছিলেন। ইতর বস্তুবাদীদের ( ভালগার মেটেরিয়ালিস্ট গালিটা আমার না, মহামতি মার্কসের) কানে সেটা পৌঁছাবার কথা ছিল না, তথাকথিত মার্কসবাদীদের কর্ণকুহরে আজ অবধি তা প্রবেশ করেছে বলা মুশকিল। সেই প্রসঙ্গেও আমরা পরে আসব। তবে মার্কসবাদের যে ঐতিহাসিক রূপ ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেছে তার প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। কিন্তু চিন্তার নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়া হিসাবে ভাববাদ কিভাবে গড়ে উঠেছে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেবার জন্য মার্কস দর্শনের জগতে আর সরাসরি প্রত্যাবর্তন করেন নি। তবে মানুষের সঙ্গে বাইরের প্রাকৃতিক জগতের সম্পর্ক বিচার বা মার্কসের ভাষায় উৎপাদন সম্পর্কের ইতিহাস পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে এই ভাবের জগত মানুষের নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস হিসাবে গড়ে ওঠে বা মানুষের কাছে দৃশ্যমান হয়। মার্কস তা দেখিয়েছেন। সম্পর্ক বিচারের মধ্য দিয়ে মার্কসের হাতে গড়ে ওঠা সম্পর্কশাস্ত্রে তাঁর অন্তদৃষ্টির সার্থকতা আমরা সন্ধান করতে পারি। তারপরও আমরা আপাতত বলে রাখতে পারি জার্মানিতে ধর্মের পর্যালোচনা শেষ হয়েছে তাঁর মার্কসের এই দাবিও পুরাপুরি সঠিক নয়। নিদেন পক্ষে নতুন ভাবে পর্যালোচনা ছাড়া মেনে নেওয়া সম্ভব না। পরে হেগেলের দর্শন পর্যালোচনার সূত্র বিচার করতে গিয়ে এ বিষয়ে আমরা ফিরে আসব। তবে হেগেল কেন গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝাবার জন্য এঙ্গেলসের কাছ থেকেই আরেকটি উদ্ধৃতি দিয়ে এই পর্ব শেষ করছি। এঙ্গেলস বলেছেন:
“আরেকটি বিষয় আমাদের ভুলে গেলে চলবে না: হেগেলীয় চিন্তার স্কুল (বা চিন্তার অনুবর্তী ধারা) ভেঙেচুরে গিয়েছে, কিন্তু হেগেলের দর্শনকে শুধু পর্যালোচনা করে অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব হয় নি। স্ট্রাউস (ডেভিড স্ট্রাউস ১৮০৮ – ১৮৭৪) আর বয়ের ( ব্রুনো বয়ের ১৮০৯ -১৮৮২) তার কোন একটি দিক এক পেশে ভাবে নিয়ে তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তর্ক করবার জন্য ব্যবহার করেছেন। ফয়েরবাখ তার পদ্ধতিকে চুরমার করে দিয়েছে এবং স্রেফ বাতিল বলে ত্যাগ করেছে। কিন্তু কোন দর্শনকে শুধু মিথ্যা বললেই তাকে অপসারণ করা যায় না। দুর্দান্ত শক্তিশালী হেগেলের দর্শন – যা একটি জনগোষ্ঠির ওপর বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে তাকে উপেক্ষা করে সরিয়ে দেওয়া যায় না। তাকে ‘অতিক্রম’ (sublated) করে যেতে হবে তার শর্তেই। তার মানে হোল পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে তার রূপের নিরাকরণ যেমন ঘোটাতে হবে তেমনি ওর মধ্য দিয়ে যে মর্মের জয় ঘটবে, তাকে সংরক্ষণ করতে হবে”।
এঙ্গেলসের বরাতে এই দাবি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এতে আমরা আগাম এই ইঙ্গিত পাই যে ধর্মের বিষয় আর দর্শনের বিষয় একই, উভয়ের পার্থক্য রূপে, মর্মে নয় – হেগেলের এই দাবিকে যতো সহজে পাশ্চাত্য চিন্তা থেকে অপসৃত হয়েছে বলে আমরা ভাবি, তা ঠিক নয়। খোদ এঙ্গেলসই তার সুরক্ষার পক্ষপাতি। তুলনায় খ্রিস্টধর্মের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য সজীব ও সক্রিয় চিন্তার মর্ম যতোটুকু এবং যেভাবে ধরে রাখতে পারছে সক্রিয় চিন্তার ক্ষেত্র থেকে অ-খ্রিস্টিয় ধর্মসমূহ পর্যালোচনার কাজ -- সেই তুলনায় হয় নি বললেই চলে। যদি সাম্প্রতিক কালের ফরাসি দার্শনিক ইম্মেনুয়েল লেভিনা ও জাক দেরিদাকে নজির ধরি সম্ভবত ইহুদি ধর্ম এই ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যাতিক্রম।
২৪ জুলাই ২০১৫। ৯ শ্রাবন ১৪৯২
বইপত্রের হদিস
Frederick Engels. (n.a). Ludwig Feuerbach & the End of German Classical Philosophy. In K. M. Engels, Marx & Engels Collected Works Volume 26. Moscow: Progress Publishers.
Frederick Engels. (2010). Bruno Bauer & Early Christianity. In K. M. Engels, Marx & Engels Collected Works Volume 24. England: Laurence & Wishart.
G.W.F.Hegel. (1975). Encyclopaedia of Philosophical Sciences (1830) Translated by William Wallace. Oxford: Oxford University Press.
Ghazali, A. (1958). Thafat al-filosofa translated by Sabih Ahmed Kamali. Lahore: Pakistan Philosophical Congress.
Ghazali, A. (1997). Thafut Al-falasifa (The Incoherence of the Philosophers) translated by Michel E.Murmura. London: Bringham Young University Press.
Marx, K. (1975). Early Writings. New York: Vintage Books.
গায-যালী, আ. (১৯৬৫). তহাফুতুল ফলাসিফা. ঢাকা: বাঙ্লা একাডেমি.
ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস. (১৯৮১). জার্মানিতে কৃষক যুদ্ধ, মার্কস-এঙ্গেলস, ধর্ম প্রসঙ্গে. মস্কো: প্রগতি প্রকাশন.
লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)