পাশ্চাত্যে চিন্তা অর্থাৎ দর্শনের বিকাশ একই সঙ্গে খ্রিস্ট ধর্মের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে ঘটেছে। সেই দিক থেকে ইউরোপীয় চিন্তা ও সভ্যতা আদতে খ্রিস্টিয় – যদিও গ্রিক দর্শনের আশ্রয়ে তার রূপ ও গড়নের সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যও দৃশ্যমান। এতে অবশ্য অবাক হবার কিছু নাই। নানান মাত্রা, ধারা ও উপধারা আছে বটে তবে আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তা ও সভ্যতাকে প্রটেস্টান্ট চিন্তা ও সভ্যতারই সেকুলার রূপ বলা যায়। সাধারণভাবে এটাও লক্ষ্যণীয় যে ধর্ম ও দর্শনের যে স্পষ্ট বিভাজন আমরা পাশ্চাত্যে দেখি পাশ্চাত্যের বাইরে ইসলাম কিম্বা অন্যান্য অ-খ্রিস্টিয় বা অ-ইউরোপীয় সমাজে তা দেখা যায় না। এই পার্থক্য গড়ে ওঠার ঐতিহাসিক কারণ আছে, সেটা সমাজতত্ত্ব ও ইতিহাসের বিষয়। তবে দর্শন এই বিভাজনের গোড়ার অনুমান দর্শনের জায়গা থেকেই বুঝতে বিশেষ ভাবে আগ্রহ বোধ করে। তার জন্য পাশ্চাত্যে ধর্মের পর্যালোচনার ধারা কিভাবে গড়ে উঠেছে এবং কিভাবে ধর্ম ও দর্শনের পার্থক্য সংক্রান্ত তর্ক এখনও জারি রয়েছে সে সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থাকা জরুরী। তা না হলে উভয়ের মিল ও পার্থক্যের চরিত্র এবং তাৎপর্য বোঝা যাবে না। ইসলামি চিন্তাবিদরা কেন দর্শনকে সন্দেহ ও সংশয়ের চোখে দেখেন সেটা অনুধাবন করাও কঠিন হবে। আগ্রহীরা এ প্রসঙ্গে ‘তহাফুতুল ফলাসিফা’ গ্রন্থে ইমাম গাজ্জালি কোন্‌ দৃষ্টিকোন থেকে আল ফারাবি, ইবনে সিনা ও এরিস্টটলের চিন্তা মোকাবিলার তাগিদ বোধ করেছেন সেটা নজরে রাখতে পারেন। (Ghazali, 1997); লাহোর থেকে গাজ্জালির বইটির আরেকটি অনুবাদ হয়েছে, সেটাও কাজে লাগতে পারে (Ghazali, Thafat al-filosofa translated by Sabih Ahmed Kamali, 1958)। বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৬৫ সালে এর একটি বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। অনুবাদ করেছিলেন আবুল কাসিম মুহম্মদ আদমুদ্দিন। (গায-যালী, ১৯৬৫)

মুশকিল হচ্ছে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনার জন্য যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতির দরকার বাংলাদেশে তার প্রকট অভাব রয়েছে। সামর্থের ঘাটতি থাকলেও এ নিয়ে আলোচনা শুরু করা দরকার। ইসলামকে নতুন ভাবে দর্শনের ক্ষেত্র থেকে পাঠ করবার কিছু সূত্র আমরা আদৌ পাই কিনা সেই আশায় এখানে পাশ্চাত্য চিন্তার মধ্যে ধর্ম পর্যালোচনার তর্ককে বোঝার চেষ্টা করেছি। ঘোরা পথে– অর্থাৎ পাশ্চাত্য চিন্তার পর্যালোচনার সূত্র ধরে করবার কারণ হচ্ছে, ধর্ম ও দর্শনের সম্পর্ক বিচারের তর্ক পাশ্চাত্য দর্শনে যেভাবে হয়েছে অন্যত্র তেমন দেখা যায় না। এই বিতর্ক থেকে ‘চিন্তার নিজের স্বরূপে’ অর্থাৎ দর্শনের ভাষায় ইসলাম নিয়ে কথা বলার কিছু সুবিধা হয়তো পাওয়া গেলেও যেতে পারে। সেটা ছাড়া আমাদের আর কিছু শিক্ষণীয় আছে কিনা সেটা দর্শনের আলোকে ইসলাম প্রসঙ্গে কিছু প্রাথমিক প্রস্তাবনার সামর্থে বোঝা যাবে।

চিন্তার স্বরূপ কথাটা জর্মন দার্শনিক গেঅর্গ ভিলহেল্ম ফ্রিডরিখ হেগেল (১৭৭০ – ১৮৩১) মহাশয়ের। তাঁর দাবি ছিল এই যে ধর্ম ও দর্শনের বিষয় একই, পার্থক্য শুধু বিষয় উপস্থাপনের আঙ্গিকে (form) বা প্রকাশের রূপে। আলোচনার সূত্রপাতের জন্য তাঁর একটি উদ্ধৃতি ওপরে উল্লেখ করেছি। এই উদ্ধৃতির দিক থেকে ধর্মের পর্যালোচনা কথাটার অর্থ ধর্মের সত্যকে দর্শনের সত্য হিসাবে প্রকাশ করা। কিম্বা দর্শনের ভাষায় উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যে ধর্মের সত্য নিছকই বিশ্বাস বা ব্যাক্তিগত উপলব্ধি নয়, বরং দর্শনের মতোই সার্বজনীন (universal) ও অনিবার্য (necessary)। বলাবাহুল্য, হেগেল একারণে দর্শনকে ধর্ম কিম্বা ধর্মকে দর্শনে পরিণত করেছেন বলে তাঁর সমসাময়িক দার্শনিক ও ‘ইয়াং হেগেলিয়ান’ নামে পরিচিত বেশ কিছু অনুসারী ও মেধাবি ছাত্রদের কাছে নিন্দিত হয়েছিলেন। পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মধ্যে হেগেলের প্রতি আমাদের বাড়তি আগ্রহ এই নিন্দার কারনে। তাঁকে বুঝতে পারলে পাশ্চাত্যে ধর্ম ও দর্শনের ভেদ ও অভেদের তর্ক আমরা খানিক ধরতে পারব। এটাও বুঝব পাশ্চাত্য এনলাইটমেন্ট বা তথাকথিত ‘আলোকিত যুগ’-এর কেচ্ছা যেভাবে বিতর্কহীন সরলরৈখিক সত্য হিসাবে আমাদের কাছে হাজির করা হয় ব্যাপারটা ততো সরল না। চিন্তা বা দর্শনের জগতে পাশ্চাত্যের আধিপত্য পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বিশ্বাস, উপলব্ধি, সংস্কৃতি ও জীবন যাপনের ভেতর থেকে উপলব্ধ সত্যকে স্বীকার করে না। --- বিশেষত তাদের ধর্ম, দ্বীন ও ইমান-আকিদার লড়াইয়ের সত্যকে অস্বীকার করে। কিন্তু সে অস্বীকারের যুক্তি পাশ্চাত্য দার্শনিকদের একেকজনের একেক রকম। একাট্টা একরকম নয়। ‘আলোকিত’ হবার অর্থ ধর্মের বিরোধিতা করা এতেও সকলের সায় ছিল না। ফলে তাঁদের মধ্যে চিন্তার বিরোধ প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জায়গা থেকে বিচার করা জরুরী। এটা শুধু ইসলামের ক্ষেত্রেই সত্য নয়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠির অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কেও সমান সত্য। ইসলামের প্রতি আমাদের বিশেষ আগ্রহ এ কারণে যে বাংলাদেশে ইসলাম নিছকই বিশ্বাস, ধর্ম বা দার্শনিক চিন্তার মামলা নয় – সরাসরি রাজনীতিরও প্রশ্ন। এর সঙ্গে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বিশ্বসভায় টিকে থাকা না থাকার প্রশ্ন জড়িত।

ধর্মের পর্যালোচনার অর্থ ধর্মের দার্শনিক বিচার। দর্শন বলতে আমরা কি বুঝি সে সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা শুরুতে আমরা দিয়ে রাখছি। আলোচনার মধ্য দিয়ে যা আরও স্পষ্ট হবে বলে আমরা আশা রাখি। ধারণাটি আসলে হেগেলের। হেগেল তাঁর লজিক বইয়ের শুরুতে লিখছেন,

“অ্ন্যান্য বিজ্ঞানের যে আরাম সেই সুবিধা ভোগ দর্শনের ভাগ্যে নাই। ওদের মতো কোন কিছুর অস্তিত্ব চেতনার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ওপর আস্থা রেখে দর্শন স্বীকার করে নিতে পারে না।এমনকি ধরে নিতে পারে না তাদের জানার পদ্ধতিও ইতোমধ্যেই গৃহীত হয়ে গিয়েছে। বিষয়কে জানার শুরু কিভাবে হোল সেটা যেমন গৃহীত হয়েছে ধরে নিতে পারে না, তেমনি সিদ্ধান্তও না”। (দেখুন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত উইলিয়াম ওয়ালেসের অনুবাদ (G.W.F.Hegel, 1975) ।

অন্যান্য বিজ্ঞান বা শাস্ত্রের সঙ্গে দর্শনের ফারাক আছে। দর্শন ছাড়া অন্যান্য শাস্ত্র তাদের জ্ঞানচর্চার বিষয় সম্পর্কে আগে থাকতেই অনুমান করতে পারে, কিম্বা কি বিষয় নিয়ে তাদের কারবার সেটা জানে অর্থাৎ তাদের ক্ষেত্রে বিষয়পূর্বনির্দিষ্ট; যে বিষয় নিয়ে তারা ভাবতে চায় বা চর্চা করে সেই বিষয় কোন বিশেষ প্রয়াস ছাড়াই তারা স্বীকার করে নিতে পারে। বিষয় নিয়ে – তার সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র কিম্বা তার ন্যায্যতা নিয়ে তাদের ভাবতে হয় না। বিষয়ের অস্তিত্ব বা উপস্থিতি আপনা পানি স্বাভাবিক ভাবেই তারা সেই মেনে নিয়ে শুরু করতে পারে। কিন্তু দর্শনের এই সুবিধাটুকু নাই। বোটানি বা উদ্ভিদবিদ্যা জানে তার চর্চার বিষয় হচ্ছে উদ্ভিদ বা গাছপালা, পদার্থবিজ্ঞান পদার্থ বা বস্তুজগত;রসায়ন শাস্ত্র কারবার করে রাসায়নিক ব্যাপার স্যাপারের, তার জানার বিষয় রসায়নের জগত, রাষ্টবিজ্ঞানের বিষয় রাষ্ট্র, সমাজবিজ্ঞানের সমাজ, ইত্যাদি।এভাবে চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতির সুবিধা নিয়ে যেভাবে অন্যান্য বিজ্ঞান তাদের চর্চা চালিয়ে যেতে পারে, দর্শনের সেই আরামটুকু নাই। এখানেই শেষ নয়, যেভাবে বা যে পদ্ধতিতে কোন বিষয় সম্পর্কে জানবার প্রক্রিয়ার শুরু বা শেষ – সেই পদ্ধতিকেও দর্শন নির্বিচারে মেনে নিতে পারে না। আলোচনার এই প্রাথমিক পর্যায়েই আমরা ধর্ম আর দর্শনের ফারাক টের পাই। সত্যের যে নিশ্চয়তার ওপর ধর্ম বিশ্বাস মানুষের চেতনার স্বাভাবিক স্বীকৃতির ওপর দাঁড়ায় দর্শনের সেই নির্বিচার আরামটুকু নাই।

হেগেলের ‘লজিক’ এভাবেই শুরু হয়েছে। দর্শনের দিক থেকে বিচার করলে কথাগুলো এমন কোন নতুন কথা না। কিন্তু হেগেল এ কথা বলে থেমে থাকেন নি। তিনি উভয়ের পার্থক্য মেনে নিয়েও খুবই গুরুতর একটি দাবি করেছেন। ধর্ম ও দর্শনের মিল ও অমিল সম্পর্কে হেগেল বলছেন:

“এটা ঠিক যে দর্শনের বিষয় সামগ্রিক ভাবে বিচার করলে ধর্মেরই বিষয় – উভয় ক্ষেত্রে সেটা হোল, সত্য। কথাটা এই চূড়ান্ত অর্থে যে আল্লাহ এবং একমাত্র আল্লাহই হচ্ছেন সত্য। উভয়েই তাই প্রকৃতি ও মানুষের এই সীমিত জগতকে পরস্পরের সম্পর্ক এবং তাদের সত্য আল্লার সত্যে বিচার করে”। (G.W.F.Hegel, 1975, পৃষ্ঠা ৩);

হেগেলের উদ্ধৃতি এ কারণে যে ধর্ম পর্যালোচনার যে-তাগিদ আমরা বোধ করছি তা কিছুটা হেগেলের প্রস্তাব দ্বারা তাড়িত। আসলেই। ধর্মের সত্য কোন্‌ অর্থে দর্শন? কোন্‌ অর্থে দর্শনেরও সত্য? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের মধ্যে ধর্ম ও দর্শনের পার্থক্য ও মিল হয়তো আমরা উপলব্ধি করব। নিদেন পক্ষে হেগেল কেন কথাটি বলেছিলেন তার মানে ধরতে পারব। বিশ্বাসের স্তরে আমরা যে সত্য সম্পর্কে নিশ্চিত বোধ করি সেই একই নিশ্চয়তা দর্শন দিতে পারে বলে হেগেল দাবি করেছেন। সজীব ও সক্রিয় চিন্তা তো ধর্ম বিশ্বাস নয়, তাহলে তা কী করে সম্ভব?

‘চিন্তার নিজের স্বরূপে সত্য প্রকাশ’ – হেগেলের কথাটাকে অনেক সময় সহজে বোঝানোর জন্য বুদ্ধির ভাষায় কথা বলা বা প্রকাশ করা বলা হয়। এর মানে হচ্ছে কোন বিষয়ের সত্যমিথ্যা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মানুষের নিজের বুদ্ধি --- অর্থাৎ নিজের অনুমান, যুক্তি বা প্রমাণের বাইরে অন্য কোন বরাত না দেওয়া। যেমন, কোন সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি বলি কোরানুল করিম বা হাদিসে এই কথা বলা আছে, তাহলে আমরা কোরান ও হাদিসের বরাতে কথার সত্যতা দাবি করছি। সেই দিক থেকে সত্যের দাবি করা হচ্ছে ধর্মের ভাষায়। হেগেলের দাবি ছিল ধর্মের ভাষায় উপলব্ধির সত্য প্রকাশিত হলেই সেটা মিথ্যা হয়ে যায় না। দর্শন সেই সত্য দর্শনের আঙ্গিকে কিম্বা বুদ্ধির ভাষাতেও প্রকাশ করতে পারে। আর এটাই দরশনের কাজ। তাঁর সারা জীবনের সাধনা ছিল প্রটেস্টান্ট খ্রিস্ট ধর্মের সত্য দর্শনের ভাষায় হাজির করা। যাতে খ্রিস্টিয় সত্যই সকল চিন্তাশীল ও বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্য সার্বজনীন ও অনিবার্য সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা বিচার করে দেখার চেষ্টা করব এই বিতর্ক পাশ্চাত্যে এখন কোথায় কিভাবে জারি রয়েছে এবং পাশ্চাত্যের বাইরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির এই বিতর্কের কোন ফায়দা আছে কিনা, কিম্বা এই বিতর্ক থেকে তারা আদৌ কোন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে কিনা।

দর্শনের দিক থেকে হেগেলের এই দাবির একটা অনুমান আছে। সত্য আমরা শুধু বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়ে নির্ণয় করি তা নয়, সত্য একই সঙ্গে উপলব্ধিরও ব্যাপার। কিন্তু সত্যের উপলব্ধি এবং ‘সার্বজনীন’ ও ‘অনিবার্য’ সত্য হিসাবে তাকে দর্শন বা বুদ্ধির ভাষায় অনেকের কাছে প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা এক কথা নয়। সত্যের উপলব্ধি ও বিশ্বাসীর কাছে তার নিশ্চয়তা যথেষ্ট নয়, তাকে সার্বজনীন ও অনিবার্য সত্য হিসাবে হাজির করবার চ্যালেঞ্জ আলাদা। ধর্মের পর্যালোচনার অর্থ হচ্ছে ধর্মের সত্যকে দর্শন বা বুদ্ধির ভাষায় হাজির ও প্রকাশ করা। ধর্মকে শুধু বিশ্বাস, উপলব্ধি – এমনকি সদর্থে স্বজ্ঞা (intuition) জ্ঞান করলেও বুদ্ধির তুলনায় উপলব্ধি হীনাবস্থায় থেকে যায়, যদি না বুদ্ধি অর্থাৎ দর্শন ধর্মের সত্যকে দর্শনেরই নির্ণয় হিসাবে আত্মস্থ না করে। কেউ ধর্মকে দর্শনে কিম্বা দর্শনকে ধর্মে পরিণত করেছেন কিনা তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বুদ্ধির সর্দারি মানতে গিয়ে বুদ্ধির তুলনায় উপলব্ধিকে হীন অথবা গৌণ করা, উপলব্ধির সত্যকে অস্বীকার করা, ইত্যাদি। এই অস্বীকৃতির বিরুদ্ধেই হেগেল দাঁড়িয়েছিলেন। এই ক্ষেত্রে তাঁর উৎকন্ঠা আসলে কী ছিল তা আমাদের বোঝা দরকার।

ধর্মের পর্যালোচনার নগদ ফল হচ্ছে ঈমান ও আকিদার জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন ধর্ম প্রাণ মানুষ জীবন ও জগত সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা ও ধ্যানধারনার কথা যখন বলেন তখন তাঁর ধর্মের অনুসারী না হয়েও আমরা যেন তাঁর উপলব্ধির সত্যটুকু গ্রহণ করতে পারি। দর্শন নিজের বক্তব্যের সিদ্ধতা প্রমাণের জন্য বুদ্ধি বা যুক্তির বরাত মানে। এতে দর্শন উচ্চস্তরের সত্য হয়ে যায় না। সত্যের কোন স্তরভেদ বা উচ্চনীচ ভেদ নাই। বুদ্ধির ভাষায় কথা বলতে পারার মধ্যে কোন আভিজাত্যের গোমর নাই। শুরুর দিকে এতোটুকু খেয়াল রাখলেই যথেষ্ট।

তবে মনে রাখা দরকার আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন একই ভাবে রাজনৈতিকও বটে। দার্শনিক কায়দায় সার্বজনীন সত্যের দাবি ও প্রতিষ্ঠা পাশ্চাত্যের ক্ষমতা ও আধিপত্য কায়েম রাখবার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। বুদ্ধির ভাষাকে সার্বজনীন দাবি করারও রাজনীতি আছে। এই দিকগুলো আমরা মনে রাখব। দর্শনে সার্বজনীনতা ও যুক্তি পরম্পরার দাবি বুদ্ধিকে মানুষের অন্য সকল বৃত্তির সর্দারে পরিণত করে। আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের বাহ্যিক দাবি হচ্ছে, বুদ্ধির তৎপরতাই সত্য নির্ণয়ের একমাত্র পথ। অর্থাৎ বুদ্ধির ওপরই আমাদের নিরংকুশ বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। কিন্তু পাশ্চাত্য বুদ্ধির ওপর নিরংকুশ বিশ্বাসকে সার্বজনীন সত্য আবিষ্কারের পথ হিসাবে কিম্বা সার্বজনীনতা নির্ণয়ের একমাত্র চাবিকাঠি হিসাবে কায়েম করতে পেরেছে কিনা সেটা এখনও প্রশ্ন সাপেক্ষ রয়ে গিয়েছে। ইন্দ্রিয়োপলব্ধি ও বুদ্ধির মধ্যে যে ফারাক আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন অনুমান করে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে। সেই তর্কটিও আমরা বিস্তারিত করার চেষ্টা করব। ধর্মের পর্যালোচনার তর্ক আমাদের উপলব্ধি ও বুদ্ধির সম্পর্কের মর্মার্থ ধরিয়ে দিতে সক্ষম হবে আশা করি। ফলে ধর্মের পর্যালোচনা থেকে আমাদের লাভ ছাড়া ক্ষতির কিছু নাই।

পর্যালোচনা – অর্থাৎ কোন বিষয়কে সজীব ও সক্রিয় চিন্তার অধীনে আনা – এই পাশ্চাত্য ধারণাকে মেনে নিয়েই শুরুর দিকে আলোচনা করেছি। চিন্তার এই চর্চা মানুষের বুদ্ধির শক্তি ও সীমা উভয় দিক মূল্যায়নের সম্ভাবনা তৈরি করে। ফলে পর্যালোচনা বিরোধিতা করবার কোন যুক্তি নাই। কিন্তু এই চর্চার গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতাকে আমরা যেহেতু ইসলামের দিক থেকে বিচার করবার প্রস্তুতি হিসাবে নিতে চাইছি সে কারণে বলে রাখা যায় যে পর্যালোচনার তাৎপর্য ইসলামের দিক থেকে বুদ্ধির কের্দানি প্রদর্শন নয়, বরং তা এবাদতের ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর অর্থ নিজের বিভিন্ন বৃত্তির চর্চার মধ্য দিয়ে দিব্যসত্তা হিসাবে মানুষের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে জাগ্রত ও শক্তিশালী করা। ইসলাম মানুষকে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসাবে অন্য প্রাণীকুল বা সৃষ্টি থেকে আলাদা করে না। এটা ইসলামের কাজ বা পথ হিসাবে গৃহীত না। বরং ইসলামের কাছে মানুষের মহিমা অন্যত্র। মানুষ আল্লার খলিফা এবং সৃষ্টির সেরা (আশরাফুল মখলুকাত)। জ্বিন বা ফেরেশতাদের এই মহিমায় অভিষিক্ত করা হয় নি। আল্লার খলিফা হিসাবে কোরানুল করিমে মানুষের দিব্যসত্তার মহিমা ঘোষণা ও স্বীকার করা দর্শনের দিক থেকে নতুন প্রস্তাবনা। এই প্রস্তাবনার ইঙ্গিত হচ্ছে জ্বিন বা ফেরেশতাদের মতো মানুষ আগুন থেকে সৃষ্ট নয়, তার সৃষ্টি, উৎপত্তি ও পুনরুৎপাদন ‘মাটি’ থেকেই। ‘মাটি’ – অর্থাৎ প্রকৃতি জগত থেকেই তার উদ্ভব, বৃদ্ধি ও বিলয়, আবার মাটিতেই প্রত্যাবর্তন। কিন্তু এই প্রত্যাবর্তন দৃশ্যত মাটিতে হলেও তাঁর কাছেই ফিরে যাওয়া যার জন্য মানুষ দুনিয়ায় 'বর্তমান' হতে পেরেছে। উৎপত্তি, পুনুরুৎপাদন ও বিলইয়ের এই চক্র -- এই সফর বা ভ্রমণ শুধু তাঁর জন্যই যিনি মানুষকে খলিফা হিসাবে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। 'আল্লার খলিফা' হওয়া -- অর্থাৎ দিব্যসত্তার এই মহিমা দৃশ্যমান করাই তোলার মধ্য দিয়ে মানুষ জ্বিন বা ফেরেশতাদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য প্রমাণ করে।

অথচ জ্বিন, ফেরেশতা বা নিছক জীব হওয়াও পরের কথা, মানুষ মাটি বা প্রকৃতি মাত্র। অথচ এই মাটির তৈরি মানুষেরই সম্ভাবনা অপার। প্রকৃতির পরমার্থ মানুষের মধ্য দিয়েই বাস্তবায়িত হবার সম্ভাবনা। দেশকালে মানুষের সত্তা সীমিত হলেও দেশকালের সীমার মধ্যে সে আল্লার বা অসীমের উপলব্ধি ও প্রতিনিধিত্ব করবার ক্ষমতা রাখে। বুদ্ধিসহ তার সকল বৃত্তি নিয়ে মানুষ জীবন ও জগত এবং আল্লার সঙ্গে তার সম্পর্কের ধরণ নিয়ে ভাবতে ও সেই মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কর্মযোগে সক্ষম। সেভাবেই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, গায়েবের প্রতিনিধি বলে মানুষই অনুপস্থিতির এবাদত বা গায়েবের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পনে রাজি হয়। এখানে পাশ্চাত্যের ‘মানুষ’ সংক্রান্ত যাবতীয় ধারণার সঙ্গে ইসলামের মৌলিক পার্থক্য। ধর্মের পর্যালোচনা, আশা করি, এই দিকগুলো বুঝতে আমাদের সহায়ক হবে।

কোন বিষয়কে চিন্তার অধীন এনে পর্যালোচনার সময় মনে রাখতে হবে চিন্তার বৈচিত্র্য, দ্বন্দ্ব ও দেশকালপাত্র ভেদে বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী অবস্থান বা ‘মত’ অস্বাভাবিক নয়। দ্বন্দ্ব বা মতের পার্থক্য মানেই বিপজ্জনক কিছু নয়। বরং দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে চিন্তার গতি ও সচলতার প্রক্রিয়া বুঝতে না পেরে কোন অবস্থান বা মতকে নির্বিচারে শ্বাশ্বত ও চিরস্থায়ী গণ্য করাই বিপদের জায়গা। চিন্তাশীলতার বিভিন্ন মুহূর্তগুলোর মধ্য দিয়ে চিন্তা নিজেই কিভাবে নিজের পথ নিজে সন্ধান করে, নিজের তৈরি দ্বন্দ্ব মীমাংসা করে এবং নিজের ধারাবাহিকতা চিহ্নিত ও নিশ্চিত করে সেটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। সেই চিন্তা নিজের কি অন্যের তাতে কিছুই আসে যায় না। কারণ সবার মধ্যে ‘চিন্তা’ নামে যে কর্তা নির্মাণের কাজটি করেন তিনি বাইরে খণ্ড খণ্ড বা ভিন্ন ভিন্ন হিসাবে হাজির থাকলেও তিনি একই কর্তা।

চিন্তা কোন বিমূর্ত ব্যাপার নয়। মানুষই চিন্তা করে। মানুষই সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই সিদ্ধান্ত সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের মর্ম ও রূপ নির্ণয়ে ভূমিকা রাখে। চিন্তার দ্বন্দ্ব কিম্বা স্ববিরোধিতা মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব বা সংঘাত হিসাবে হাজির হয়। বিশেষ বিশেষ দেশকালে চিন্তা কিভাবে কোথায় কোন্‌ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে তার খবর নিয়ে আমরা একটি জনগোষ্ঠির হালহকিকত বুঝতে পারি। তাহলে সেই দ্বন্দ্বের চরিত্র এবং চিন্তার দিক থেকে মীমাংসার ক্ষেত্রগুলো চিন্তার পর্যালোচনা ছাড়া বোঝা সম্ভব নয়।

২৪ জুলাই ২০১৫। ৯ শ্রাবন ১৪২২

 

 

 


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)

Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 9042 Leave comments (0) Bookmark and Share


Go Back To Arts & Culture
EMAIL
PASSWORD