বাংলাদেশে ধর্ম সম্পর্কে আমাদের প্রধান অনুমান হচ্ছে ধর্ম-বিশ্বাস কিম্বা ধর্মচর্চা কোন চিন্তা নয়। এসবের মধ্যে চিন্তা বলে কিছু নাই। কোন দিক থেকেই ধর্মের মধ্যে 'চিন্তা' নামক কোন পদার্থ আছে এটা আমরা বিশ্বাস করি না। ধর্মে চিন্তা থাকবার কথা না। ধর্ম-বিশ্বাস কিম্বা ধর্মচর্চা চিন্তা প্রক্রিয়ার বাইরের একটা ব্যাপার, বিশ্বাস মাত্র ।  বিশ্বাস আর চিন্তা পরস্পর বিরোধী ব্যাপার, আর বিশ্বাস তো আর কোন ভাবেই চিন্তা হতে পারে না --  --  প্রায় প্রত্যেকের মধ্যেই এই বদ্ধমূল ধারণাই প্রকট। যাঁরা ধর্ম নিরপেক্ষ কিম্বা ধর্ম মানেন না কিম্বা ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপার মনে করেন এই অনুমান শুধু তাঁদের মধ্যে রয়েছে তা নয়। ধর্মে বিশ্বাসী এবং আন্তরিক ভাবে যাঁরা ধর্ম চর্চা করেন তাঁদের মধ্যেও প্রবল ভাবে এই অনুমান হাজির রয়েছে।

ধর্ম নিয়ে তর্ক না করবার ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা সমাজে থাকতে পারে। বিশেষত যখন ধর্ম নিয়ে যা খুশি মন্তব্য করবার স্বেচ্ছাচার ব্যক্তি স্বাধীনতার পরাকাষ্ঠা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপার, ধর্ম নিয়ে তর্ক ঠিক না – এই মনোভাবের মধ্য দিয়ে ধর্মকে চিন্তার বাইরে রাখবার ধারাটাই আমাদের সমাজে প্রবল। এতে অবশ্য ধর্ম নিয়ে তর্ক বা হানাহানি কমে নি বা কমে না। ধর্মের ব্যাখ্যার মধ্যে ভিন্নতা ও দ্বন্দ্ব তৈরিও এতে বন্ধ হয় না। সেটা চিন্তা প্রক্রিয়ার চরিত্র, কিম্বা চিন্তার সিদ্ধান্তেরই ফল। চিন্তার জগতে ভিন্নতা ও দ্বন্দ্ব ধরতে পারা ও তার মীমাংসার সদর রাস্তা ধর্মকে চিন্তার বাইরে রেখে হতে পারে না। চিন্তার পরিমণ্ডলে ধর্মের পর্যালোচনাই সদর রাস্তা। তাহলে ধর্মের পর্যালোচনা করতে গিয়ে দর্শনকে প্রথমেই মেনে নিতে হয় ধর্ম মানুষের সজীব ও সক্রিয় চিন্তার বাইরের কিছু নয়। ধর্ম চিন্তারই একটি ধরণ। কিন্ত এই অভেদ মেনে নিয়ে চিন্তা সন্তুষ্ট বোধ করে না। উভয়ের ফারাক ব্যাখ্যা করবার তাগিদও বোধ করে। সেই দিক থেকে প্রশ্ন ওঠে নিশ্চিত সত্যের ধরণ হিসাবে  'বিশ্বাস' নামে আমরা চিন্তার যে বিশেষ রূপকে হাজির দেখি তার সঙ্গে তথাকথিত যুক্তিবুদ্ধির দ্বারা সিদ্ধ চিন্তার ফারাক কোথায়? ধর্মের পর্যালোচনা তাহলে বিশ্বাস ও বুদ্ধির ভেদ ও অভেদ বিচার দিয়েই শুরু হয়।

শুধু চিন্তার জগতে মীমাংসা সমাজকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে মুক্তি দেয়, এই দাবিও আমরা করতে পারি না। চিন্তার মীমাংসা আর বাস্তবে মীমাংসার মধ্যে পার্থক্য আছে অবশ্যই। পর্যালোচনার গুরুত্ব স্বীকার করলেও চিন্তা ও বাস্তবতার পারস্পরিক সম্পর্কের প্রাচীন তর্ক তারপরও থেকেই যায়। এই যুক্তিতে মানুষ চিন্তা করা ছেড়ে দিয়েছে এমন নজির নাই। যে সংঘাত চিন্তার জগতে মীমাংসার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করা সম্ভব, সেই ভাবে তার মীমাংসার চেষ্টা না করার চেয়ে আহাম্মকি আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু বাস্তবের সংঘাত বাস্তবেরই সংঘাত এবং চিন্তা জগতের সমাধান সেই ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয় স্বীকার করলেও চিন্তা কোন বায়বীয় ব্যাপার নয়। মানুষ চিন্তাশীল এবং চিন্তা তার দৈনন্দিন জীবন এবং সামাজিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ইত্যাদি সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে সবসময়ই ক্রিয়াশীল। চিন্তা ও বাস্তবতার সম্পর্কের বিচারও শেষাবধি চিন্তারই বিষয়। অতএব চিন্তা করা অর্থাৎ পর্যালোচনার ক্ষমতা অর্জন ভিন্নতা ও দ্বন্দ্ব মীমাংসার সদর রাস্তা এই দাবি আমরা মেনে নিতে পারি।

দর্শনে ধর্মের পর্যালোচনার কথা ওঠে কারন ধর্মকে চিন্তার বাইরে রেখে বা বাইরের ব্যাপার গণ্য করে মানুষের সক্রিয় ও সজীব চিন্তা সন্তুষ্ট থাকে না। থাকতে পারে না। চিন্তা মানুষের স্বভাব, ধর্মকে চিন্তার বাইরে গণ্য করলেও বাইরে রাখা সেই স্বভাবের কারণেই অসম্ভব। ধার্মিকের পক্ষেও সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, কারন তার অর্থ দাঁড়ায় চিন্তার তুলনায় ধর্মকে গৌণ, খাটো বা হীন গণ্য করা। এটাও স্বীকার করে নেওয়া যে চিন্তার দিক থেকে ধর্মের কোন যুক্তি বা ন্যায্যতা নাই। তাই ধর্ম নিয়ে চিন্তা করবার বা তার পর্যালোচনার কোন ফায়দা নাই। কোন সক্রিয় বা সজীব চিন্তার পক্ষে এটা মেনে নেওয়া কঠিন। ধর্মের পর্যালোচনার দায় অতএব আমরা ধার্মিক হই বা না হই কেউই এড়িয়ে যেতে পারি না।

তারপরও ধর্মের পর্যালোচনার কথা শুনলে আমরা খুব সাবধানী ও সতর্ক হয়ে যাই। এর কারণ ধর্ম এখনও আমাদের সমাজে আবেগ কিম্বা আত্মপরিচয়ের অহংকারের অধিক হয়ে উঠতে পারে নি। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা – যাকে অনেক সময় সম্প্রদায়বাদ বা সেক্টেরিয়ানিজম বা ভেদমূলক গোষ্ঠিবাদ বলা হয় -- ইত্যাদির গোড়ার জায়গাটা এখানে। সাম্প্রদায়িকতা আদতে জাতিবাদি ধারণা, ফলে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের গরিমা অহংকারি বর্ণবাদি ধারণাও হয়ে উঠতে পারে, বিশেষত যখন নিজ সম্প্রদায়ের মহিমা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে  সাম্প্রদায়িকতা বা জাতীয়তাবাদ ‘অপর’ বা ‘অন্য’ কে ঘৃণা করতে শেখায়। নিজের আভিজাত্য বা অন্যের তুলনায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠার মুশকিল তো রয়েছেই। ধর্মের পরমার্থিক আকুতির সঙ্গে এই অপরায়নের বিরোধ রয়েছে। জীবন ও জগতের সার্বজনীন ব্যাখ্যা ও মানুষের ইহলৌকিক কর্তব্য নির্ধারণের আকুতি ধর্মের পেছনে কাজ করে। ধর্মের এই বিশেষ বৈশিষ্ট ভুলে গিয়ে তার জায়গায় কেবল ধর্ম-বিশ্বাসের ভিত্তিতে আত্মপরিচয়ের অহংকার গঠিত হলে তার মধ্যে কোন ধর্মীয় চরিত্র থাকে না। ধর্মীয় পরিচয় তখন জাতিবাদী চরিত্র পরিগ্রহণ করে এবং একটি জাতির আত্মপরিচয়ের নির্ধারক হয়ে ওঠে। সেখানে জাতিসত্তায় বিশ্বাস আর ধর্ম বিশ্বাস একাকার হয়ে যায়।

ধর্মকে জাতিবাদী কাজে ব্যবহারের কারণে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা ধর্মের শত্রু হয়ে ওঠে। একালে ধর্মকেন্দ্রিক জাতিবাদী অহংকার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে যে বিরোধ তৈরি করছে তার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক গৌণ। এই বিষয়টি আমাদের আলোচনার শুরুতেই স্পষ্ট ভাবে বুঝতে হবে। সে কারণে ধর্মের পর্যালোচনা বলতে আমরা যে বিষয়ে প্রবেশ করতে চাইছি তা ধর্মের জাতীয়তাবাদী তর্ক থেকে আলাদা। আধুনিকতা – বিশেষত পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক কিভাবে জাতিবোধের উন্মেষ ঘটায় এবং ইসলাম তার দ্বারা কিভাবে দূষিত হয় সেটা অন্যত্র আলোচনা করা যেতে পারে। সেটা এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। জাতিবাদী আত্মপরিচয়ের অহংকার ও সাম্প্রদায়িক বিরোধের উৎপত্তি আধুনিকতা, জাতিবাদ এবং বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে বিভিন্ন জনগোষ্ঠির মধ্যে অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিচারের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ‘মুসলমান’দের স্বার্থ রক্ষার রাজনীতি রয়েছে। তার নানান প্রকাশ বা নানান ধারা রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সামাজিক ও ঐতিহাসিক ন্যায্যতা অস্বীকার করার সুযোগ নাই। কিন্তু তার বিচার বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার চরিত্রের মধ্যে অনুসন্ধান করতে হবে, দর্শনের জায়গা থেকে ইসলামের পর্যালোচনার কর্তব্যের দিক থেকে আমাদের আলোচনার জন্য সেই সব গৌণ প্রসঙ্গ। তাই এখানে সেই সকল বিষয় আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করছি না।

আমাদের আলোচনার শুরুর জন্য এতোটুকু আপাতত যথেষ্ট যে ‘মুসলমান’ বলতে আমরা কোন জাতিবাদী বা সম্প্রদায়গত পরিচয় বোঝাচ্ছি না, মুসলমান তাদেরকেই বোঝায় যারা আল্লার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পন করেছে, ফলে জাতিবাদী অহংকার তো অবশ্যই, তার মধ্যে কোন প্রকার অহংকারের ছিঁটেফোঁটাও থাকার কথা না। আর, আল্লার অর্থ হচ্ছে যিনি গায়েব বা যিনি নিরন্তর দেশে ও কালে অনুপস্থিত – অথচ তিনি সর্বত্র বিরাজমান। আল্লার ‘বিরাজ’ করবার এই সত্য মানুষের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভরশীল। যে কারণে ইসলামে বিশ্বাসী বা ‘মোমিন’ মাত্রই আল্লাহকে সত্য হিসাবে উপলব্ধি করে -- এই ‘সাক্ষ্য’ দেয়া বা এই সত্যের সাক্ষী হওয়া ইসলামের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

দর্শনের দিক থেকে সাক্ষ্য দেওয়া বা সাক্ষী হওয়ার তাৎপর্য অসাধারণ। দেশ কালের অতীত এবং নিরন্তর গরহাজির সত্তার কাছে নিঃশর্তে নিজেকে সঁপে দেওয়া এবং সেই নিরন্তর অনুপস্থিতির সাক্ষী দেবার চরিত্র চর্চা – মানুষের নিজের অস্তিত্বকে এক বিশেষ অবস্থায় উন্নীত করা --  সেই বিশেষ বিরাজমানতা আস্বাদন -- মুসলমান সম্প্রদায়ের একচেটিয়া নয়। অর্থাৎ  জন্মসূত্রে মুসলমান বলেই এই স্বভাব আপসে আপ অর্জন করা যায়, দর্শন, বলাবাহুল্য, তা মনে করে না।  ইসলামও নয়, যে কারণে ইসলাম আত্মস্বার্থ, নফসানিয়াত বা আত্মপরিচয়ের রাজনীতির বিরোধী। নফসানিয়াতের বাইরে রুহানিয়াতের চর্চাই ইসলামের পরমার্থ।  রুহানিয়াতের চর্চার আবেদন সার্জনীন। রুহানিয়াতের অধিকারীরা ‘মোমিন’। অস্তিত্ব যাপনের বিশেষ ধরণের কারণে সতত সম্প্রদায়গত আত্মপরিচয়ের সঙ্গে মোমিনের ফারাক ইসলামও স্বীকার করে। দর্শন রূহানিয়াতের এই শক্তির জায়গাটি সম্পর্কে জানতে বিপুল ভাবে আগ্রহী, একথা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। মানুষ হিসাবে রুহানিয়াতের চর্চাকারীরা আর দশজন মানুষের চেয়ে ভিন্ন – ইসলামও তা স্বীকার করে। এটা স্রেফ বিশ্বাস বা ভিন্ন ভিন্ন মজহাবের আকিদা অনুযায়ী জীবন যাপন নয়।  কিন্তু নফসানিয়াত থেকে রুহানিয়াতে নিজেকে উত্তীর্ণ করার জন্য বাড়তি যে উপলব্ধি দরকার তা দর্শন বা প্রজ্ঞার চর্চা ছাড়া অসম্ভব।

‘মুসলমান’ যদি আত্ম-পরিচয় না হয় তাহলে দর্শন ‘মুসলমান’ নামক এই বিশেষ অস্তিত্বকে কিভাবে বোঝে? সেটা হোল, দেশকালে উপস্থিত সত্তার সঙ্গে দেশকালে্র অতীত সত্তার সম্পর্ক চর্চার সূত্র হিসাবে। দর্শন এই সম্পর্কের তাৎপর্য আলোচনা করতে বিশেষ ভাবে আগ্রহী। মানবেতিহাসের বর্তমান কালপর্ব অতিক্রম করে যাবার জন্য ইসলাম মানুষের মধ্যে নতুন কোন কর্তাসত্তার উদ্বোধন ঘটাবার সামর্থ রাখে কিনা তাকে বিচার করবার এটাই প্রথম কাজ। একালে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রশ্ন হচ্ছে এটা কি মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা বিচার করে বোঝা যাবে?  মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক বিচার বা তাদের বর্তমান দুর্দশার কারণ ঐতিহাসিক পদ্ধতি দিয়ে বিশ্লেষণ করলে ইসলাম বোঝা যাবে কিনা সে সম্পর্কে দর্শন সন্দিহান। এতে মুসলমানদের আশা আকাঙ্ক্ষা, লড়াই-সংগ্রামের  তাৎপর্য বোঝা যাবে, কিন্তু এর মধ্যে ইসলামের সম্ভাবনা বোঝা কঠিন।  বরং প্রথমে দরকার  ধর্মভাবনা হিসাবে ইসলামের পর্যালোচনা। ধর্মের পর্যালোচনা সেই সম্ভাবনার ওপর আলোক ফেলতে পারে। ধর্মের পর্যালোচনার অর্থ হচ্ছে মানুষের চিন্তার নিজস্ব স্বভাবের ক্ষেত্র থেকে ইসলামের মৌলিক প্রস্তাবনাকে বোঝা। ইসলামকে চিন্তার নিজস্ব স্বভাবের জায়গা থেকেই বোঝা একালে সে কারনে জরুরী।

ইসলামে সম্পর্কে দর্শনের বিশেষ আগ্রহের বাড়তি কারন এই যে একে স্রেফ মতাদর্শে কিম্বা জ্ঞানতত্ত্বে পর্যবসিত করা যায় না। কারন এই সম্পর্ক একই সঙ্গে বিশেষ প্রকার চিন্তার চর্চা যা একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে বিশেষ এক কর্তাসত্তার উদ্বোধন ঘটাবার নির্দেশ দেয়। যেমন, আল্লাহ নিরাকার, আল্লাহ গায়েব বা আল্লহ অনুপস্থিত -- এই সকল জ্ঞানতাত্ত্বিক বাক্যের মধ্যে আল্লার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মর্ম ইসলামে শুরু হয় না, শেষও নয়। ইসলামের আগে অনেক ধর্মই একথা বলেছে এবং তা ইসলাম তা মেনে নিয়েছে। ইসলামের পরিণতি এই প্রকার জ্ঞানতত্ত্বে নয়। বরং ইসলাম আদেশমূলক বা ঔচিত্যের দাবির ওপর দাঁড়ায়। ইসলামের দাবি, গায়েবই মানুষের উপাস্য। এটা মানুষের পক্ষে উচিত আর অনুচিতের তর্ক, কোন বিষয়কে জ্ঞানের বিষয় হিসাবে বিচারের মামলা মাত্র নয়। ধর্মের পর্যালোচনা করতে গিয়ে সীমিত মানুষ বনাম অসীম পরব্রহ্মের সম্পর্কের বিচার দর্শনে প্রচুর রয়েছে। জ্ঞানতত্ত্বের বিষয় বলেই তারা পরিচিত। কিন্তু আল্লা ইসলামে নিছকই জ্ঞানচর্চার বিষয় হিসাবে হাজির থাকেন না। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রচনার জন্য বিশেষ কর্তাসত্তার (subjectivity) উদ্বোধনের চর্চা ইসলাম দাবি করে। সেই দাবির সারকথা হচ্ছে: মানুষের উচিত গায়েবের এবাদত করা – এই নির্দেশের মধ্যে আল্লা নিরাকার বা গায়েব বলা যথেষ্ট নয়, তিনিই মানুষের একমাত্র উপাস্য এই ঔচিত্যবোধকে জাগ্রত রাখা এবং সেই মোতাবেক নিজেকে হুঁশিয়ার রাখা ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের কি করা উচিত বা কি করা উচিত নয় তার সম্পর্ক নৈতিক-রাজনৈতিক (ethico-political) বিষয়। এ কারনে অন্যান্য একেশ্বরবাদী ধর্ম সম্পর্কে দর্শন যেভাবে আলোচনা করে, ইসলামের ক্ষেত্রে তা পুরাপুরি খাটে না। ইসলামকে দার্শনিক ভাবে বুঝতে হলে তার নৈতিক-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের গুরুত্ব মুখ্য হয়ে ওঠে।

যদি আমরা মনে করি ধর্ম আর চিন্তা আলাদা ব্যাপার, ধর্ম কেবল বিশ্বাসের ব্যাপার, ইসলাম নিয়ে তর্ক ঠিক নয়, তাহলে ইসলামের গভীর মর্মার্থ কিম্বা একালে তার তাৎপর্য আমরা কখনই অনুধাবন করতে পারব না। কুতর্ক কেউই চায় না, ফলে তা পরিহার করা সঠিক। তবে তা করতে গিয়ে নফসানিয়াত আর রুহানিয়াতের ভেদ বিচারের জন্য ধর্মের পর্যালোচনা করা যাবে না, সেটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তবে ধর্ম পর্যালোচনা সম্পর্কে সাবধানী ও সতর্ক হয়ে ওঠার দ্বিতীয় আরেকটি কারন রয়েছে। সেটা হোল, পর্যালোচনা বললে আমরা সাধারণত সমালোচনা বুঝি। আর সমালোচনার অর্থ হচ্ছে ধর্মের বিরোধিতা। যা আমাদের আবেগ ও অহংকারকে আহত করতে পারে বলে আমরা আগাম সতর্ক হয়ে যাই। এই দিকটি তাহলে পরিষ্কার হওয়া দরকার।

প্রথমেই স্পষ্ট থাকা দরকার, পর্যালোচনার অর্থ সমালোচনা বা বিরোধিতা নয়। ওপরের এক ঝলক আলোচনায় আমরা যা অনায়াসেই বুঝতে পারব আশা করি। কোন কিছুকে পর্যালোচনার অধীন করার অর্থ হচ্ছে যে রূপে বিষয়টি হাজির সেই রূপের খোসা ভেদ করে তার অন্তর্গত চিন্তাটিকে চিন্তার নিজের স্বরূপে চেনা ও বোঝা। এই অর্থেই হেগেল বলেছিলেন ধর্মের সত্য আর দর্শনের সত্য একই, তাদের ভেদ কেবল প্রকাশের ধরণে। চিন্তা নির্বিচারে কোন সত্য মানে না বা মেনে নিতে পারে না। তাহলে ধর্ম যাকে সত্য বলে দাবি করে দর্শনের কাজ হচ্ছে তাকে চিন্তার স্বরূপে প্রদর্শন করে দেখানো। দেখানো যে ধর্ম চিন্তারই একটি ধরণ।

বিষয়টা সহজ করে বোঝাতে গিয়ে দার্শনিকরা বলে থাকেন, পর্যালোচনার মানে হোল চিন্তার নিজেই নিজেকে নিজের চিন্তার বিষয়ে পরিণত করা। এটা চিন্তার দিক থেকে নিজেকে নিজের পরীক্ষা কিম্বা নিজের কাছে নিজের পরীক্ষা দেবার মতো ব্যাপার। এই কাজ আমরা হরদমই করি। গত কালের চিন্তা নিয়ে আজ আবার ভাবি। কখনও কখনও গতকাল যা ঠিক মনে হয়েছিল, আজ তা ভিন্ন ভাবে ভাবি। গতকাল যা বুঝি নি, অথবা যেভাবে বুঝেছিলাম, আজ তা আবার নতুন ভাবে বুঝি, ইত্যাদি। কোন বিষয় ফের ভেবে দেখা পর্যালোচনার প্রাথমিক পদক্ষেপ। প্রাথমিক অবস্থায় চিন্তার “বিষয়ের” প্রতি আমাদের ঝোঁক থাকে। কিন্তু ক্রমে আমরা বুঝি সেটাই যথেষ্ট নয়। কিভাবে আমরা ভাবছি, কিভাবে বিভিন্ন ধারণা ও যুক্তি ব্যবহার করছি তাকেও নতুন করে আবার ভাবতে হচ্ছে। অর্থাৎ শুধু বিষয় নিয়ে নয়, চিন্তার পদ্ধতি নিয়েও আমরা ভাবি। এভাবে পর্যালোচনা আরেক ধাপ বা আরেক স্তরে পোঁছায়। ক্রমে ক্রমে চিন্তা প্রক্রিয়ার সকল দিক নিয়ে চিন্তা নিজেই বাছবিচার করে, নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় এবং নিশ্চিত বা সন্তুষ্ট না হওয়া অবধি এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চিন্তা কিভাবে চিন্তা করে তার গলিঘুঁজিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধর্মের পর্যালোচনার অর্থ হচ্ছে ধর্মের অন্তর্গত মর্মকে চিন্তার নিজের স্বরূপে হাজির করা। এ অর্থেই হেগেলের দর্শন,  আগেই বলেছি, প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টতত্ত্বের দার্শনিক ভাষ্য হিশাবে জারি রয়েছে।

পর্যালোচনার চর্চা না থাকলে সজীব চিন্তা কিভাবে সক্রিয় থাকে তার মর্মও আমরা বুঝবো না। চিন্তার বিভিন্ন ‘মত’, ‘অবস্থা’ বা ‘সিদ্ধান্ত’ ইত্যাদির মধ্যে কোন ধারাবাহিকতা বা যোগসূত্র আছে কিনা সেটাও আমরা ধরতে পারবো না। পর্যালোচনার শক্তিকে বৃত্তি হিসাবে বিকশিত না করলে চিন্তাকে সক্রিয় ও সজীব রাখা কঠিন হয়ে ওঠে। চিন্তা মরে যায়। সেটা ব্যাক্তির ক্ষেত্রে যেমন ঘটে, তেমনি একটি জনগোষ্ঠির ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। পর্যালোচনার হিম্মত অর্জনের চর্চা না করলে চিন্তার দিক থেকে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো না। কোন কিছু প্রশ্ন হিসাবেও আমাদের উৎসুক করবে না। এ কারণে চিন্তার নিজেকে নিজে পর্যালোচনার হিম্মত অর্জনের অভাবের সঙ্গে বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দুর্দশার সম্পর্ক রয়েছে। এই দিকটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।

চিন্তা ও রাজনীতি উভয় দিক থেকে ধর্মের প্রশ্ন প্রতিটি সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ; রাজনৈতিক বাস্তবতার কারনে ধর্মের পর্যালোচনা বাংলাদেশে অতিশয় জরুরী হয়ে উঠেছে। একাত্তরে ধর্মের নামে ‘বাঙালি’ হিসাবে এই দেশের মানুষ যে নির্যাতন ভোগ করেছে সেই ট্রমা তারা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারি নি। সে কারণে ধর্ম – বিশেষত ইসলাম সম্পর্কে ধর্ম চর্চার প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোন আলোচনা এড়িয়ে চলাই দস্তুর হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ইসলাম নিয়ে যে কোন আলোচনার প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাস ও সংশয় পদে পদে বাংলাদেশে চিন্তার বিকাশকে রুদ্ধ করে চলেছে। এই অবস্থা থেকে আশু মুক্তি জরুরী।

অনেকে একাত্তরের ঘটনাকে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধ বা দ্বন্দ্ব হিসাবে হাজির করেন। কিম্বা করার চেষ্টা করছেন। আসলে বাস্তবের রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইকে ইসলামের পক্ষ-বিপক্ষের লড়াই বলে দাঁড় করিয়ে রাখার কারনে ধর্মকে চিন্তা বা দর্শনের দিক থেকে পর্যালোচনার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে রয়েছে। এর অর্থ হোল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চিন্তাকে শাসন করেছে, চিন্তা নিজের জমিনে দাঁড়াতে পারছে না। যার ফলে চিন্তার স্বাভাবিক বিকাশ বাংলাদেশে ঘটেনি। ‘মুক্তচিন্তা’ তো দূরের কথা। এই দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলার জন্যই ধর্মের আলোচনা অনেকে সাধারণত এড়িয়ে চলেন। ইসলাম নিয়ে কোন কথা বলার অর্থ হয়ে দাঁড়ায় একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তিকে মদদ দেওয়া। যদি সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে ইসলাম আলোচ্য বিষয় হয় তাহলে সেই সব আলোচনা প্রায় সবসময়ই একাত্তরের অভিজ্ঞতার কারণে পর্যালোচনার পথে না গিয়ে অন্ধ গলিতে পথ হারায়। কারও কারও ক্ষেত্রে সেটা চরম একপেশে আবেগ ও ক্রোধের বিষয়ে, এমনকি বর্ণবাদিতায় পর্যবসিত হয়। এই সকল কারনে বাংলাদেশে ইসলামের দার্শনিক ও ঐতিহাসিক পাঠের অভাব মারাত্মক। সমাজের স্বাভাবিক চিন্তার বিকাশের জন্য এই পরিস্থিতি প্রায় অনতিক্রম্য বাধা হয়ে আছে।

ধর্মের প্রশ্নে চিন্তার এই গতিরুদ্ধ অবস্থা ক্রমে ক্রমে বিকৃতিতে রূপ নিয়েছে। মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, নাস্তিকতা ইত্যাদি নানান নামে ও নানান কিসিমে এই বিকৃতি সমাজে আমরা এখন হাজির দেখি। ‘স্বঘোষিত’ এই সকল ‘মুক্তচিন্তা’র সঙ্গে স্বাধীন, সজীব, সক্রিয় চিন্তার কোনই সম্পর্ক নাই। এই সকল চিন্তার ধারা মূলত ইসলাম বিদ্বেষী। একাত্তরে ইসলাম বিদ্বেষ গড়ে উঠেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ছদ্মবেশে। নিপীড়িত জনগোষ্ঠিকে ঐক্যবদ্ধ করবার জন্য বাহান্ন থেকে একাত্তর অবধি ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উত্থান আমরা দেখেছি। তার ঐতিহাসিক ন্যায্যতা অনস্বীকার্য। কিন্তু এই জাতীয়তাবাদ একই সঙ্গে উপমহাদেশের ঔপনবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ইসলাম যে মতাদর্শিক ভূমিকা রেখেছে তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেই গড়ে উঠেছে।

দ্বিতীয়ত জাত-পাত এবং বাংলাদেশে ইংরেজ প্রবর্তিত জমিদারতন্ত্র এবং কলোনিয়াল আমলে গড়ে ওঠা মহাজনি প্রথার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামকেও ইসলাম বিদ্বেষী বাঙালি জাতীয়তাবাদ অস্বীকার করে। অথচ মতাদর্শ হিসাবে সেই লড়াইয়ে ইসলামের ভূমিকা ছিল নির্ধারক। ঐতিহাসিক কারণে ‘মুসলমান’ হিসাবে আত্মপরিচয়ের ন্যায্যতা ঔপনিবেশিক ভূমি ব্যবস্থা উচ্ছেদের আন্দোলনের মধ্যে নিহিত রয়েছে। বাংলাদেশে ইসলাম প্রশ্ন মূলত ঐতিহাসিকভাবে ঔপনিবেশিক ভূমি ব্যবস্থা এবং তার বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংগ্রামের ইতিহাস। বাঙালি জাতীয়তাবাদ যা অস্বীকার করে, বাংলাদেশের জনগণের ইতিহাস রচনায় যাকে আমলে নেয় না। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে জ্ঞানে বা অজ্ঞানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিক আমলে গড়ে ওঠা হিন্দু জাতীয়তাবাদের অধীনস্থ একটি ধারার, উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের জমিদারি হারানোর দুঃখিত ও ক্রোধান্বিত ধারার অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারে নি। এই সংকীর্ণ জাতিবাদ দক্ষিণ এশিয়ার এই অংশে জাতপাত বিরোধী লড়াইয়ে হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত লড়াইকেও অস্বীকার করেছে এবং ইসলামের সঙ্গে লোকায়ত ধর্ম অর্থাৎ সনাতন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সম্বন্ধকেও ছিন্ন করেছে। এর ফলে ইসলাম উপমহাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাইরে নিছকই একটি ধর্ম বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইতিহাসবিচ্যূত বাঙালি জাতীয়তাবাদ শেকড়হীন ধারা হয়ে টিকে রয়েছে বা টিকে থাকতে পারছে একান্তই দিল্লির রাজনৈতিক বা পররাষ্ট্রনীতির আনুকুল্যে, অথবা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সহযোগী হয়ে। অন্যদিকে ইসলাম উপমহাদেশে তার কংক্রিট ইতিহাস ভুলে গিয়ে নিজের যোগসূত্র সংকীর্ণ করেছে ফেলেছে মধ্য প্রাচ্যে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে ইসলামের বিচ্ছেদ ইসলামকে পরিণত করেছে নিছকই সমাজ ও ইতিহাস বিচ্ছিন্ন ধর্ম বিশ্বাসে। যেন বাংলাদেশের চিন্তা ও সংস্কৃতির জগতে তার দেবার কিছু নাই। এভাবে নিজের গৌরব সে নিজেই অস্বীকার করে। যেদিক থেকেই দেখিনা কেন এই পরিণতি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হতে পারে না। বাংলাদেশে ধর্মের – বিশেষত ইসলামের পর্যালোচনার গুরুত্ব আমরা এই দিক থেকেও বুঝতে পারি।

নাইন-ইলেভেনের পর থেকে পরিস্থিতির আরও গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। ইসলাম বিদ্বেষ – বিশেষত মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, নাস্তিকতা ইত্যাদি উপদ্রব রাজনৈতিক ভাবে বাংলাদেশকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ময়দানে সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগাণ্ডা ও হামলার মুখে ঠেলে দেয়। জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে এই সকল ধারা দুষমনের সঙ্গে হাত মেলায়। দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদী সরকার কায়েম হবার পর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় এই ধারাগুলো বাংলাদেশের জনগণের জন্য আগের চেয়েও আরও ভয়ানক ও শতগুণ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, নাস্তিকতা ইত্যাদি নামে ইসলাম বিদ্বেষী ধারাগুলো সরব ও সক্রিয় থাকার পেছনে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির হস্তক্ষেপ রয়েছে, এগুলো রাজনৈতিক বিষয়, ফলে রাজনৈতিক ভাবেই এসবের মোকাবিলা সঠিক। এই ধারাগুলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সহযোগী, ফলে বাংলাদেশে এর পরিণতি প্রায়ই ঘটে বল প্রয়োগ ও সহিংসতায়।

রাষ্ট্র ইসলামপন্থাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দিয়ে মোকাবিলা করতে চায়, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের এই কালে আইন, রাষ্ট্র, নীতিনৈতিকতার দাবির অনুমান হচ্ছে আধুনিক কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রই আইন প্রণয়ণের, শাসনের, কাউকে অভিযুক্ত করবার ও শাস্তি দেবার একমাত্র বৈধ প্রতিষ্ঠান। সমাজ এখানে গৌণ। এমনকি মানবাধিকার ও নীতিনৈতিকতাও গৌণ। সমাজ থেকে উদ্ভূত হয়ে সমাজের বিরুদ্ধে যখন রাষ্ট্র সন্ত্রাস ও বল প্রয়োগের প্রতিষ্ঠান হিসাবে হাজির হয়, তখন সমাজের ভেতর থেকে তার বিরোধিতাও বল প্রয়োগের মধ্য দিয়েই ঘটতে বাধ্য। এটা অনিবার্য। আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণার মধ্যে চিন্তার যে মুশকিল রয়েছে, সেটা পর্যালোচনার হিম্মত আমরা অর্জন করি নি, ফলে পাশ্চাত্য চিন্তা ও পাশ্চাত্য চিন্তার অনুকরণে আমরা সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র গড়ে তুলছি। একে প্রশ্ন করছি না। একই ভাবে চিন্তার এই হিম্মতও আমরা অর্জন করি নি যাতে বিচার করতে পারি ইসলামের মধ্যে আদৌ কোন দার্শনিক প্রস্তাবনা আছে কিনা যা বিশ্বব্যাপী চিন্তার সংকট মীমাংসার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম। বিশেষত সমাজের উর্ধে দাঁড়িয়ে যে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্র সমাজের টুঁটি টিপে ধরেছে তার হাত থেকে মুক্ত হয়ে নতুন ধরণের সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে ইসলাম আদৌ কোন অবদান রাখতে সক্ষম কিনা তাকে আমরা আজো চিন্তার বিষয়ে পরিণত করতে পারি নি। ইসলাম নিছকই একটি ধর্ম বিশ্বাস এবং ‘মুসলমান’ পরিচয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে নিতান্তই একটি জাতিবাদী ধারণার - অধিক কিছু বাংলাদেশে হয়ে উঠতে পারে নি।

আগেই বলেছি, ইসলামপন্থি ও ইসলাম বিরোধী উভয়েই ইসলামকে নিছকই ধর্মীয় বিশ্বাসের অধিক কিছু গণ্য করে না। চিন্তা ও বাস্তব উভয় জগতে আমাদের হীনাবস্থা বা সংকট কাটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামের কোন মৌলিক দার্শনিক প্রস্তাবনা আছে কিনা পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে যার আবির্ভাব অনিবার্য – এই প্রশ্ন আমরা তুলি নি। কিন্তু এই প্রশ্নই এখ তুলবার সময় হয়েছে। তুলবার শক্তি বিদ্যমান ইসলাম চর্চায় আছে কিনা সেটাও আমরা জানি না। ইসলামকে সক্রিয় ও সজীব চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন নিছকই ধর্ম বিশ্বাস করে রাখার কারনে এই সকল গুরুতর বিষয় তর্ক সাপেক্ষই রয়ে গিয়েছে। অথচ একালে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রশ্ন। ধর্মের পর্যালোচনা সম্পর্কে এই লেখাটি সেই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরের প্রস্তুতি বলা যেতে পারে।

ধর্ম বনাম দর্শন কিম্বা ধর্ম বনাম বিজ্ঞানের মধ্যে নানান তর্ক আজ অবধি চিন্তাকে গতিশীল রেখেছে। সমাজ ও রাজনীতির বাস্তব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছে ও রাখছে। কি বাংলাদেশে বর্ণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগান্ডার যে ধারাগুলোর সঙ্গে আমরা পরিচিত তার সঙ্গে কোন ইতিবাচক বিতর্কের সম্পর্ক নাই। এগুলো বাইরের অপ্রাসঙ্গিক উপদ্রব। অপ্রাসঙ্গিক এ কারণে যে তাদের উদ্দেশ্য চিন্তার কোন অমীমাংসিত ক্ষেত্র চিহ্নিত করা, কিম্বা চিন্তার প্রক্রিয়ার ভেতর থেকে কোন প্রশ্ন ও তার মীমাংসার সন্ধান করা নয়। এর উদ্দেশ্য ইসলাম বিদ্বেষ - এর প্রকাশ ঘটছে রাজনৈতিক নিপীড়নে ও দমনমূলক কর্মকাণ্ডে। ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠির ওপর পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার আধিপত্য অক্ষূন্ন রাখাই তার প্রধান মতলব। বিশ্ব বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় নৈতিকতার ক্ষেত্র থেকে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠা স্বাভাবিক ও অনিবার্য। একে দমন ও নিশ্চিহ্ন করাই বাংলাদেশে ইসলাম বিদ্বেষী বর্ণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগান্ডার প্রধান উদ্দেশ্য।

এই দিক থেকে বাংলাদেশে ধর্মের পর্যালোচনার তর্কে তথাকথিত ‘মুক্তবুদ্ধি’, ‘মুক্তচিন্তা’, ‘বিজ্ঞান মনস্কতা’ ইত্যাদির কোন দার্শনিক প্রাসঙ্গিকতা নাই। এখানে সেই সকল বিষয়ে আলোচনা করে সময়ের অপচয় করব না। এই সকল বাগাড়ম্বের সাময়িক প্রাবল্য শুধু এটাই প্রমাণ করে যে ধর্মের পর্যালোচনাকে আমরা ক্রমাগত উপেক্ষা করেই চলেছি। এই দার্শনিক কর্তব্য সম্পন্ন না করার অর্থ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশের ভিত্তিকে বিপদের মুখে ফেলে দেওয়া। সজীব ও সক্রিয় চিন্তার দিক থেকে নিজেদের ঐতিহাসিক উপস্থিতির ন্যায্যতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলে গোলকায়নের কালে নিজেদের আলাদা ও স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠি হিসাবে টিকিয়ে রাখা মুশকিল। ধর্ম – বিশেষত ইসলাম এবং একই ভাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সম্মিলন জীবন ও জগত সম্পর্কে আমাদের আদৌ কোন চিন্তাশীল অবস্থান নেবার ক্ষেত্রে সহায়ক নাকি প্রতিবন্ধক এই তর্ক আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি। অথচ একে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। বাংলা ভাষায় ধর্মের পর্যালোচনার প্রধান রাজনৈতিক-দার্শনিক গুরুত্ব এখানেই।

দর্শনের কর্তব্যের দিক থেকে দৃশ্যমান রাজনৈতিক আপদ্গুলোর মোকাবিলার দায় তবুও থেকেই যায়। এ কারণে যে আপাত দৃষ্টিতে আলাদা ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও কোন কিছুই চিন্তার বাইরের ব্যাপার নয়। সব কিছুর সঙ্গেই চিন্তার সম্পর্ক গভীর। কিছুই চিন্তার বাইরে থাকে না। সমাজে হস্তক্ষেপের শর্ত এবং জনগণকে সহজে বিভক্ত করাকে তাই শুধুমাত্র বাইরের হস্তক্ষেপ ভাবা ঠিক হবে না। আমাদের চিন্তাশূন্যতা কিম্বা সজীব ও সক্রিয় চিন্তার অভাবের মধ্যে তার শর্ত নিহিত রয়েছে। সেই অভাব না মেটালে এই হস্তক্ষেপ নিরন্তর বিভাজন ও সংঘাত তৈরি করতে থাকবে। সেই আবর্ত থেকে আমাদের সহজে মুক্তি পাবার সম্ভাবনা কম।

চিন্তা চর্চা বা দর্শনের দিক থেকে এইসকল বিপদ মোকাবিলার সম্ভাব্য পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে আগাম হুঁশিয়ার থাকা দরকার। প্রকট রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন মত বা মতাদর্শের সম্পর্ক রয়েছে। সামগ্রিক ভাবে সমাজে চিন্তার যে হাল তা অবশ্যই পর্যালোচনার দাবি রাখে। নইলে আমরা অতি সাধারন বিষয়গুলোও বুঝবো না ;যেমন, খেয়ে না খেয়ে ধর্মের বিরোধিতা তথাকথিত ‘মুক্তচিন্তা’ বা ‘বিজ্ঞানচিন্তা’ তো নয়ই, বরং সক্রিয় ও সজীব চিন্তার অভাবের কারনেই বিভিন্ন বালখিল্য ধারা সামাজিক ও রাজনৈতিক উপদ্রব হিসাবে হাজির হয়। যে কোন পর্যালোচনার আগে ধর্মের পর্যালোচনা সম্পন্ন করবার গুরুত্বও এখানে।

২৪ জুলাই ২০১৫। ৯ শ্রাবন ১৪২২

 


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)

Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 9467 Leave comments (0) Bookmark and Share


Go Back To Arts & Culture
EMAIL
PASSWORD