আতাউর রহমান রাইহান


Saturday 03 July 10

print

ইজরাইল টিকে আছে হত্যালীলার আগে ও পরে সত্য খুন করার প্রপাগান্ডা কৌশলে

কমান্ডোদের বেপরোয়া গুলি

ফিডম ফ্লোটিলা'র যে নয়জন স্বেচ্ছাসেবীকে হত্যা করা হয়েছে তাদের প্রতি একবার দুইবার নয় ত্রিশবার গুলি চালিয়েছে ইজরাইলি কমান্ডোরা। গুলি ছোঁড়া হয়েছে খুব কাছ থেকে। মৃতদের শরীর পোস্টমর্টেম করে ডাক্তাররা এরকম প্রমাণই পেয়েছেন। দুজনকে গুলি করেছে চারবার, ছাব্বিশবার করা হয়েছে অন্য পাঁচজনকে, যাদের মাথার পেছনে গুলি ছুঁড়েছে কমান্ডোরা। তুরস্কের বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক ফোরকান দোগানের বয়স মাত্র ঊনিশ বছর। তার মাথার পেছনে, হাঁটুতে পাঁচ পাঁচবার গুলি করেছে ইজরাইলি কমান্ডোরা।

হেলিকপ্টার থেকে গুলি

আল-জাজিরা প্রতিনিধি জামাল ইলসহায়াল এ হত্যাযজ্ঞের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। বিমান থেকে ছোঁড়া গুলিতে সে একজনকে নিহত হতে দেখেছে। গুলিতে একজন মারা গেলে স্বেচ্ছাসেবীরা সাদা পতাকা ওড়ায়, যাতে কমান্ডোরা আর গুলি না ছোঁড়ে। একজন ইজরাইলি স্বেচ্ছাসেবক হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া গুলিতে আহত একজনকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে কমান্ডোদের অনুরোধ করেছে। কিন্তু কমান্ডোরা সে অনুরোধে পাত্তা দেয় নাই। ফলে আহত ব্যক্তিটি জাহাজেই মারা যায়।

বন্ধুত্ব ভাঙ্গার  হুমকি

তুরস্ক বলেছে ইজরাইল যদি ফ্লোটিলা হত্যালীলার পর কোনো অনুশোচনা না করে তবে ইজরাইলের সাথে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক টিকবে না। তুরস্ক চায় ইজরাইল গাজার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এর একটা নিরপেক্ষ স্বাধীন তদন্ত হবে। প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল তার ভাষণে এরকমই বললেন, ইজরাইলকে অন্তত অনুশোচনা করতে হবে এ দুষ্কর্মের জন্য। তিনি বোঝালেন এ হত্যাকাণ্ড ইজরাইলের বেশির ভাগ লোকের স্বার্থকে নষ্ট করে দিয়েছে, পৃথিবীতে ইজরাইল একটা সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের খেতাব পেয়েছে। তুরস্ক এ ঘটনা কোনোদিন ভুলবে না। আবদুল্লাহ গুল ইজরাইলকে মনে করিয়ে দেন তুরস্ক কখনোই তার নাগরিকের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের হামলা সইবে না। ইজরাইলের সাথে তুরস্কের বন্ধুত্বের সম্পর্ক এ হামলার পর আর সামনের দিকে এগুতে পারে না। ফ্লোটিলা হামলায় যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা কেবল তুরস্ক ও ইজরাইলের ভেতরকার নয়, বরং ইজরাইলের বিপরীতে এটি গোটা মানব সভ্যতার। এরপর তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায়ও থাকবে না। তবে এর ভিতরে একটা মজার ব্যাপারও আছে, তা হল ওরগানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এন্ড ডেভলেপমেন্টে (ওইসিডি) ইজরাইলের অন্তর্ভুক্তিকে তুরস্কই অনেকটা সহজতর করে দিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, দোগানের মৃত্যুর ব্যাপারটা তদন্ত করতে হবে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভাষ্যকার ফিলিপ ক্লউলি জোর দিয়েই বলেছেন, আমরা আমেরিকার নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনাটা পুরাপুরি তদন্ত করবো। এটা পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় হলে আমরা তাই করতাম।

ইজরাইলের নৈতিকতার গালগল্প

ফ্লোটিলায় হামলা করে নয় স্বেচ্ছাসেবী হত্যা, আরও প্রায় ডজন খানেক লোক আহত করেও ইজরাইলের কোনো অনুশোচনার বালাই নাই। সাতচল্লিশের পর থেকে ফিলিস্তিনি জনগণের জাতীয় পরিচয়, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে শেষ করে দিতে ইজরাইল সবরকমের দমন-পীড়ন চালিয়েছে। ফিলিস্তিনি শিশুরা যাতে নিজেদের ইতিহাস জানতে না পারে, সেজন্য স্কুলে আরবদের ইতিহাস পড়ানো বন্ধ করে দিয়েছে। সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে কবিতা আবৃত্তি, গান গাওয়া। মাহমুদ দারবিশের মতো কবিকে তারা নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। ঔপন্যাসিক গাসাম কানফানিকে গাড়ি বোমায় হত্যা করেছে মোসাদ। ইহুদ বারাকের গুপ্ত হত্যার শিকার হয় কবি জামাল নাসের।  গুপ্ত হত্যা, মিসাইল হামলা, বোমা হামলা, অবরোধ, রাজনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনিদের বিভক্ত করে দেয়া সহ হেন কোনো কাজ নাই যা ইজরাইল করে নাই। এদিক দিয়ে ফ্লোটিলা হত্যাকাণ্ডের একটা ব্যাতিক্রমি দিক আছে। তা হল, আন্তর্জাতিক কোনো ত্রাণবাহী নৌবহরে ইজরাইলের এই প্রথম হামলা, যেখানে ইজরাইল সহ আরও চল্লিশটা রাষ্ট্রের নাগরিকরা ছিল। ছিল নোবেল ‍পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব, নেসেট অর্থাৎ ইসরায়েলের সংসদ সদস্য। এরা জাহাজ ভরে খাবার, চিকিৎসা দ্রব্য, নির্মাণ সামগ্রি নিয়ে অবরুদ্ধ গাজার দিকে যাচ্ছিল, গাজাবাসীকে বাঁচানোর আকুতি নিয়েই তারা এই উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ইজরাইল পৃথিবীকে দেখাল নিজের সিদ্ধান্তের বাইরে আর কোনো নৈতিকতার দাম নাই তার কাছে। সে যা করবে বা বলবে, তার বাইরে আর কোনো সত্য নাই।

ইজরাইল ফ্লোটিলায় হামলা করেছে সরাসরি ঘোষণা দিয়েই, নিজের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কারও চোখ রাঙানিকে সে ভয় করে না, তাই দেখাল। সংবাদ মাধ্যমের সুবাদে ইজরাইল তার অন্যায়কে ন্যায়ে পরিণত করে আসছে এতদিন। সাধারণত সকল প্রকার মন্দ কাজকে জায়েয করতে ইজরাইল একটা কাহিনী বানিয়ে তা সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করে। এবারও তাই করল। কাহিনীটা হল স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে লাঠি, মুগুর, ছুরির মত অস্ত্রপাতি ছিল, যা দিয়ে তারা কমান্ডোদের ওপর হামলা করেছে। তার মানে দাঁড়ায় কমান্ডোরা শান্তিপূর্ণ কাজে জাহাজে গিয়েছিল। দেখা গেল শেষ পর্যন্ত ইজরাইলের কোনো গল্পই আর ধোপে টেকে নাই। কিন্তু রাচেল কোরি বা টম হানডেলরা যখন ফিলিস্তিনের ওপর ইজরাইলের এই অবৈধ দখলদারিত্বের প্রতিবাদ করেছে, ইজরাইলের বুলডোজার তাদেরও রেহাই দেয় নাই।

ইজরাইলের সর্বশেষ হুমকি

ফিলিস্তিনের ভূমি গায়ের জোরে দখল করেই ইজরাইল রাষ্ট্রের জন্ম। তাই এ গায়ের জোরেই তাকে টিকে থাকতে হবে। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইজরাইল যে দমন-নিপীড়ন চালাচ্ছে, তা তারা করছে একান্ত বাধ্য হয়েই। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে এর বাইরে আর কোনো রাস্তা নাই। যাদের ভূমি তারা জবরদখল করেছে, তারা যখন প্রতিবাদ করে অথবা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই করে তখন এসব তাদের ভাষায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। যেহেতু এ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে গাজার অধিবাসীরা এগিয়ে, তাই এটাকে অবরোধ করে এর অধিবাসীদের তিলে তিলে শেষ করে দিতে হবে। তাতে পরমাণু অস্ত্র আর এটম বোমার দরকার হবে না। না খাইয়ে, না পরিয়ে মারলে খুব একটা বদনামও হয় না। ইজরাইলের পশ্চিমা বন্ধুরা তো আছেই, তার সকল মন্দ কাজে সহায়তা করতে। তুরস্কের উচিত ইজরাইলের শান্তি-প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তা করা। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার সকল পদক্ষেপকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তার একান্ত মিত্র রাষ্ট্র তুরস্কের নাগরিকরা জাহাজে করে ত্রাণ নিয়ে যায় গাজার মৃতপ্রায় লোকগুলাকে বাঁচাতে। এটা বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গার শামিল। তাই শেষ পর্যন্ত ইজরাইল ফ্লোটিলা হামলা দিয়ে তার মিত্র রাষ্ট্র তুরস্ককে একটা খবর পাঠিয়ে দিল। তা হল, নিজের স্বার্থের বেলায় কাউকে সে এক ফোঁটা ছাড় দেবে না। গাজা অবরোধ টিকিয়ে রাখতেই হবে। কারণ গাজা হামাসের সশস্ত্র স্বাধীনতাকামীদের নিয়ন্ত্রণে।

প্রচার যুদ্ধে ইজরাইল

গাজা অভিমুখী তুরস্কের জাহাজ মাভি মারমারা থেকে সবকিছুই সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিল। ইজরাইলি কমান্ডো হামলার খানিক পর তা বন্ধ হয়ে যায়। কাজেই তারপর জাহাজের ভিতরে কী হয়েছে, বাকি দুনিয়ার তা জানার আর সুযোগ রইল না। জাহাজের মধ্যে সাংবাদিকরা ও তুরস্কের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আইএইচএইচ যা কিছু ছবি তুলছে, তাও প্রায় অস্পষ্ট। খুব একটা স্পষ্ট দেখা যায় না। সেসব ছবিতে আবছাভাবে কিছু যাত্রীকে আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু কিভাবে তারা আহত হলো ছবি দেখে তা বোঝা সম্ভব না। স্বেচ্ছাসেবীরা যা কিছু ভিডিও করেছে, কমান্ডোরা তা ছিনিয়ে নিয়ে নষ্ট করে দিয়েছে। কাজেই ঘটনার পরপরই ইজরাইল যে ভিডিও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করেছে সেটাই এখন সবাই দেখছে। সবখানে পাওয়া যাচ্ছে। ইজরাইল সমর্থিত প্রচার মাধ্যমগুলা এতটুকু বলেই অশ্লীল কায়দায় মিথ্যা প্রচার করছে।

ঘটনাটির পর ইজরাইল ইউটিউবে একটা ভিডিও প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় কমান্ডোরা বিমান থেকে রশি বেয়ে মাভি মারমারায় নামছে, তখন স্বেচ্ছাসেবীরা মুগুর, ছুরি এবং অস্ত্র হাতে জাহাজে অপেক্ষা করছে। এটা ইজরাইল আগ থেকেই জানতো, জাহাজে সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর হামলা করবে, তাই কোনোদিকে না তাকিয়েই তারা গুলি করতে থাকে। ফলে কমান্ডোরা যা করেছে তাতে অন্যায় কিছুই নাই। ভিডিওটি প্রকাশের পর প্রায় তেইশ লাখের মত দর্শক ওটাকে এখন পর্যন্ত দেখেছে। তারা ইজরাইলের এ সাজানো মিথ্যাচার গিলেছে। কারণ, মিডিয়াকে বাগে আনতে ইজরাইল অসংখ্য পয়সা খরচ করছে। এ খরচের সূত্র ধরে বাংলাদেশের কিছু পত্রিকা ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের জঙ্গী, সন্ত্রাস আরও অনেক কিছু বলে খবর ছেপেছে । আসলে, এসব পত্রিকা খরচের কোনো ক্ষুদ্র অংশও হয়তো পাচ্ছে। কিন্তু ইজরাইলের সকল মিথ্যাচার ফাঁস হয়ে যায়, যখন স্বেচ্ছাসেবীরা ইজরাইলের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে সংবাদ মাধ্যমে তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। আমরা জেনেছি, কমান্ডোরা দড়ি বেয়ে নামার আগেই জাহাজ গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। বোমার ধোঁয়ায়, টিয়ার গ্যাসে গোটা পরিবেশ অন্ধকারে ঢেকে গেছে । সেখানে লাঠি, মুগুর, ছুরি নিয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা ডেকে অবস্থান করে কী করে? অবস্থান করলেও ভিডিওতে এত পরিস্কার ছবি আসার কথা না।


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  


Available tags : প্রজার যুদ্ধ, ইজরাইল, গাজা, ত্রাণবহর

View: 5958 Leave comments (0) Bookmark and Share

Go Back To Issues
EMAIL
PASSWORD