- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
মানবিক সাহায্য আর আর্ন্তজাতিক আইনের ওপর ইজরাইলি গণহত্যা
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ত্রাণসামগ্রী বয়ে নিয়ে যাওয়া যাত্রী ও মালামালাবাহী নৌবহরে রাতের অন্ধকারে হামলা চালিয়ে যেভাবে কমপক্ষে কুড়িজন নিরীহ স্বেচ্ছাসেবককে হত্যা ও আরো কয়েকগুণ স্বেচ্ছাসেবীকে আহত করলো ইজরাইলি সেনাবাহিনী--তা ফিলিস্তিন ভূমিতে দখলদার ইজরাইলের ধারাবাহিকভাবে চালিত পদ্ধতিগত অনেকানেক গণহত্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। ফিলিস্তিনের ভূখন্ড জবরদখল করে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই বর্ণবাদী রাষ্ট্রটা অসংখ্যবার বেসামরিক নিরস্ত্র মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে; শরণার্থী শিবির, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর হাসপাতালে। আর এবার দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রায় সাতশত সেচ্ছাসেবী, সাহায্যকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, রাজনীতিক ও পেশাজীবীরা যখন ছয়টি বেসামরিক জাহাজে করে গাজা উপত্যাকায় তিন বছর ধরে অবরুদ্ধ অসহায় পনের লাখ মানুষের জন্য ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই জাহাজের একটাতে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালাল ইজরায়েল। দুনিয়ার কয়েকটি সাহায্য ও মানবাধিকার সংস্থার উদ্যোগে দশহাজার টন মানবিক সাহায্য নিয়ে তুরস্ক থেকে রওয়ানা দিয়ে সাইপ্রাস হয়ে ছয়টা ছোটো-বড়ো জাহাজের ওই নৌবহর--‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ তখন আর্ন্তজাতিক নৌসীমানায় ছিলো।
গাজা উপত্যকা অবরোধমুক্ত করার প্রচারাভিযানের দুই বছর
ফ্রি গাজা মুভমেন্ট--এই সংগঠনটা গাজা উপত্যকায় ইজরাইলি অবরোধ প্রত্যাহারের দাবিতে দুইবছর ধরে প্রচারাভিযান চালিয়ে আসছে দুনিয়াজুড়ে
দুই হাজার আট সাল থেকেই ফ্রি গাজা মুভমেন্ট সহ আরো কয়েকটি মানবাধিকার ফোরাম গাজার অবরোধের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালিয়ে আসছে, এবং গাজায় মানবিক সাহায্য পৌঁছাতে চেষ্টা করছে। ইসরাইলি দখলদারি ও অবরোধের মধ্যে বসবাসরত ফিলিস্তিনে বিশেষত গাজায় ত্রাণবাহী নৌযান পাঠাতে অথবা স্থলপথে ত্রাণ সরবরাহ করতে অন্যান্য সংগঠনের সাথে সমন্বয়ের কাজ করে আসছিল সংগঠনটি। অবরোধ অমান্য করে গাজা অঞ্চলের উদ্বাস্তুদের জন্য চিকিৎসা সামগ্রী, ঔষধপত্র ও নির্মাণ সামাগ্রী পাঠাতে চেষ্টা করছে ফ্রি গাজা মুভমেন্ট। এবার তারা সমন্বয় করে পাঠালো এযাবতকালের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সাহায্য--ছয়টা জাহাজের ত্রাণ ও মানবিক সাহায্যবাহী নৌবহর--ফ্রিডম ফ্লোটিলা।
‘আপনারাই হচ্ছেন বীর, গাজায় পৌঁছতে পারলেন কি পারলেন না তাতে কিছু আসে যায় না।’
সোমবার রাতের শেষ দিকে নৌবহরের সবচেয়ে বড়ো জাহাজ--এমভি মারমারা যখন ইজরাইলের নৌসীমানা থেকে চল্লিশমাইল দূরে আর্ন্তজাতিক নৌসীমানায় ছিলো তখন হেলিকপ্টারে করে ইজরাইলি নৌকমান্ডোরা জাহাজটাতে হামলা করে। এর আগে দখলদার বাহিনী ‘নেটওয়ার্ক জ্যামিং’ প্রযুক্তির মাধ্যমে জাহাজগুলার ওয়ারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দেয়। ফলে শেষরাতের হামলার পর দীর্ঘসময় ধরে জাহাজগুলা এবং আরোহীদের ভাগ্য সর্ম্পকে বেশি কিছু জানা যায় নাই। তুরস্কের একটা টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা ছিল এমভি মারমারা’য়। যাত্রার পর থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছিল ওই টিভি চ্যানেলটাতে। সেখানকার ভিডিওতে সর্বশেষ বেশ কিছু রক্তাক্ত দেহ দেখা যায়। তারপর সেই ক্যামেরাটাও বন্ধ হয়ে যায়। সংবাদসংস্থা আল জাজিরা’র একজন সাংবাদিক তখন ওই জাহাজে ছিলেন; তিনি ঘটনার আগে আগে তার প্রতিষ্ঠানকে জানান যে, ইজরাইলি নৌ কমান্ডোরা হেলিকপ্টারে ও গানবোটে করে নৌবহরের খুব কাছ থেকে ঘিরে রেখে চলছে--যার ফলে ত্রাণবাহী নৌবহরের জাহাজের নাবিকরা খুব ধীরে জাহাজ চালাচ্ছেন। এরপর ওই সাংবাদিকের সাথেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আল-জাজিরা’র। পরে দুপুরের দিকে ইজরাইলি সংবাদ মাধ্যমের সূত্রে জানা যায়; ছয়টা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ দখল করে ওগুলাকে নিজেদের দখলে থাকা একটা বন্দরে নিয়ে গেছে ইজরাইলি সেনাবাহিনী। দীর্ঘ তিন বছর ধরে বাইরের দুনিয়া থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন; জীবনধারণের ন্যূনতম উপকরণবিহীন জীবনযাপনে বাধ্য গাজাবাসীর কাছে আর পৌঁছলনা ত্রাণসামগ্রী। অবশ্য গাজা থেকে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়া স্বেচ্ছাসেবকদের অভিনন্দন জানান। হানিয়া স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্দেশ্যে বলেন; ‘আপনারাই হচ্ছেন বীর, গাজায় পৌঁছতে পারলেন কি পারলেন না তাতে কিছু আসে যায় না।’
এক নজরে ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’
ছয়টি জাহাজের একটা নৌবহর ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা’, মানে মুক্তির নৌবহর। এই নৌবহরটা ইজরায়েলি অবরোধ অমান্য করে গাজায় যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরের আর্ন্তজাতিক নৌসীমানায় ইজরাইলি সেনারা হামলা চালিয়ে থামিয়ে দেয়। এবং জোরপূর্বক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটা বন্দরে নিয়ে যায়।
ত্রাণবাহী নৌবহর:
বহরের সবচেয়ে বড়ো জাহাজ তুরস্কের পতাকাবাহী--এমভি মারমারা, যাত্রীবাহী জাহাজ। তাতে তুরস্কের একটি বিশাল পতাকা টানানো। প্রায় সাড়ে সাতশ স্বেচ্ছাসেবক যাত্রী। দুটি মালবাহী জাহাজ। এবং সাথে আরো তিনটা ছোট নৌযান। জাহাজগুলার মধ্যে দুটা ছিল গ্রিসের পতাকাবাহী এবং একটা যুক্তরাষ্ট্রের। উল্লেখ্য বেসামরিক যাত্রী বা মালবাহী নৌযান যেই দেশের বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধিত থাকে ওই জাহাজ সেই দেশের পতাকা বহন করে।
বহরে আরেকটা জাহাজ ছিল যেটা এখনো পৌঁছাতে পারে নাই, গাজার উদ্দেশ্যে আয়ারল্যান্ড থেকে রওয়ানা করে এখনো গ্রিসের পথে রয়েছে, আয়ারল্যান্ডের পতাকাবাহী জাহাজ রাসেল কোরি। বারোশটন ওজনের জাহাজটার নাম রাখা হয়েছে এক আমেরিকান বালিকার নামে--রাসেল কোরি--২০০৩ তিন সালে গাজায় বসতি স্থাপনের প্রতিবাদ করতে গেলে যাকে কিনা ইজরাইলি সেনারা ইজরাইলি বুলডোজার চাপা দিয়ে হত্যা করে, সেই বালিকার স্মৃতিতে ওই নাম রাখা হয়েছে।
যারা আয়োজন করলো:
নৌবহর আয়োজনের জোটে ছিল অনেকগুলা সংগঠন। এগুলার মধ্যে আছে ফ্রি গাজা মুভমেন্ট, দ্য ইওরোপীয়ান ক্যাম্পেইন টু এন্ড সিজ অফ গাজা, তুরস্কের মানবাধিকার জোট--ইনসানি ইয়ারদিন ভাকফি, গ্রিসের সংগঠন--শিপস টু গাজা, সুইডেনের সংগঠন-- শিপ টু গাজা, মালয়শিয়াভিত্তিক সংগঠন--পারদানা গ্লোবাল পিস অর্গনাইজেশন এবং দ্য ইন্টারন্যাশনাল কমিটি টু লিফট দ্য সিজ অন গাজা। পুরো আয়োজন সমন্বয় করেছে ফ্রি গাজা মুভমেন্ট।
আক্রান্ত যাত্রীরা:
বহরটিতে প্রায় সাড়েসাতশ যাত্রী ছিল। যারা সবাই বিশ্বের বিভিন্ন বেসরকারী সংগঠনের সদস্য, বিভিন্ন জাতীয়তা এবং ধর্মামলম্বী। তবে অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যক সদস্য তুরস্কের, বাকিরা দুনিয়ার অন্যান্য চল্লিশটা দেশের নাগরিক।
যেসব সাহায্য নিয়ে যাচ্ছিলেন স্বেচ্ছাসেবীরা:
সংগঠকের বর্ণানুসারে জাহাজগুলো প্রায় একহাজার টন ত্রাণসামগ্রী বহন করছিল। যার ভিতরে ছিল মেডিকেল উপকরণ, খাদ্য, পোশাকাদি, শিশুদের খেলনা সামগ্রী, ঘরের আসবাবপত্র, সিমেন্ট এবং লৌহজাত দ্রব্য। তুরস্কের নিরাপত্তা ও শুল্ক কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে যে, জাহাজগুলাতে কোনো প্রকার অস্ত্র থাকা তো দূরের কথা জাহাজে কোনো রেজর বা ছুরি পর্যন্ত ছিল না। মানবিক সাহায্যসামগ্রী নিয়ে জাহাজ বহর যাত্রা করছিল।
অধিকার কর্মী কিম্বা স্বেচ্ছাসেবী থেকে ‘সন্ত্রাসী’ : ঢাকার ভাসানটেক থেকে ভূমধ্যসাগর
সম্প্রতি ঢাকার ভাসানটেকে ছিন্নমূল লোকেদের আন্দোলনের সংগঠক শাখাওয়াত হোসেন ওরফে দুলালকে (৪৫) র্যাব গ্রেফতার করলো--কিছু দিন পরে সংবাদ মাধ্যমের সামনে তাকে হাজির করলো নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হরকাতুল জিহাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিশাবে। আর ফ্রিডম ফ্লোটিলায় হামলা চালিয়ে ঠাণ্ডামাথায় পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে জাহাজগুলার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর ইজরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এখন বলছেন, যে জাহাজটায় হামলা চালানো হয়েছে সেটাতে আর্ন্তজাতিক ইসলামি সন্ত্রাসীরা ছিলো। ইজরাইলের দাবি, তারা আগে ইজরাইলের সেনাদের ওপর ছুরি আর লোহার রড দিয়ে হামলা করেছিল। একটি অত্যাধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত কমান্ডো বাহিনীর উপর মামুলি ছুরি দিয়ে আঘাতের খোড়া যুক্তি। যদিও এ পর্যন্ত যেসব ছবি ও ভিডিও পাওয়া গেছে তাতে তার বক্তব্যের উল্টাই প্রমাণিত হয়। আরো লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, ইজরায়েল বাকি জাহাজগুলাতে ‘সন্ত্রাসী’ থাকার কথা বলছে না। অর্থাত যেহেতু ওই জাহাজটিতে সেনা হামলায় নিরীহ ত্রাণকর্মীরা মারা গেছেন, তাই তাদের সন্ত্রাসী বানিয়ে জায়েজ করার চেষ্টা। সেখানে সবাইকে হামাস সমর্থক আর আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট ‘জঙ্গি’ বানিয়ে দেবার কায়দা। ভাসানটেক আর এমভি মারমারা--একই আদলে যুক্তি বিস্তার ও আগ্রাসী হিংস্রতার বৈধতা তৈরির প্রচারণা।
অবরুদ্ধ গাজা
ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক ফ্রন্ট ২০০৫ সালে জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে। তার পর থেকেই মূলত গাজায় ইজরাইলি অবরোধ শুরু হয়। পরে ইজরাইল ও পরাশক্তিগুলার তরফে হামাসকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। কিন্তু গাজা উপত্যকায় হামাসের নির্বাচিত সরকার নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে সক্ষম হয়। অবশেষে ২০০৭ সালের জুন মাসের দিকে গাজা উপত্যকায় ইজরাইল সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে। মূলত ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী দল হামাসকে দুর্বল করতে এ অবরোধ আরোপ করা হয়। কিন্তু বাইরের দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকায় উপত্যকায় বসবাসরত পনেরো লক্ষ বেসামরিক ফিলিস্তিনি মানবেতর জীবনযাপন করছে। মানবাধিকার সংস্থা এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর নাম দিয়েছে, যৌথ সাজাভোগ। এমনিতেই দীর্ঘদিনের দখলাদারি-ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার শিকার গাজাবাসী, তার ওপর এই অবরোধের ফলে গাজার সংকট আরও তীব্র হচ্ছে।
এবারের অবরোধের শুরু: জুন ২০০৭
অবরুদ্ধ বেসামরিক ফিলিস্তিনি: ১৫ লক্ষ
টিনজাত মাংস, মিনারেল ওয়াটার, চা কফি ছাড়া খুব কম খাদ্যদ্রব্যই গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেয় দখলদার ইজরাইল। প্রায় কোনো চিকিৎসা উপকরণ বা ঔষধসামগ্রীই এবং শিক্ষাউপকরণ ‘অনুমোদিত দ্রব্যের তালিকা’য় নাই। হালকা কাচ এবং বোর্ডশিট ছাড়া আর কোনো নির্মাণ সামগ্রী গাজায় প্রবেশ করতে দেয় না ইজরাইল। সবমিলিয়ে এখন মাত্র ৮১ টি দ্রব্য ‘অনুমোদিত’ তালিকায় আছে। অনুমোদিত তালিকা আবার প্রতিদিন যাচাই বাছাই করা হয়।
এই ৮১ ধরনের দ্রব্যাদি তাও আবার অনেক সীমিত মাত্রায় প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। যেমন, ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে যেখানে এইসব মালবাহী ১০,০০০ ট্রাক প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছিল-২০০৯ এর জানুয়ারিতে তা কমিয়ে মাসে ৩,০০০ ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। ২০০৮ সালে আর্ন্তজাতিক রেড ক্রস কমিটি এক রিপোর্টে জানায় যে, গাজার শতকরা সত্তরভাগ মানুষের প্রতিদিন খাবার পাবার কোনো নিশ্চয়তা নাই। আর্ন্তজাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, চিকিৎসার অনেক প্রাথমিক উপকরণই গাজায় নাই। দুই হাজার আট সালের শুরুতে গাজার হাসপাতালগুলাতে প্রতি একলাখ লোকের জন্য মাত্র ১৩৩ টি বেড ছিল। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে গাজায় তিন সপ্তাহব্যাপী ইজরাইলি সর্বাত্মক আক্রমণের পর অনেক হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে গেছে অর্থাত চিকিৎসা সুবিধা আরো কমেছে।
অবরুদ্ধ গাজা বিষয়ে তাদের সর্বশেষ রিপোর্টে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, দীর্ঘদিনের ধ্বংসযজ্ঞ আর অবরোধে অঞ্চলটির উৎপাদনব্যবস্থা ও অবকাঠামো এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, আর্ন্তজাতিক সাহায্য নিশ্চিত করা ছাড়া শতকরা আশিভাগ মানুষকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
মানবিক সাহায্যের প্রতি ওই রাষ্ট্রের সহানুভুতি থাকবে--এমনটা আশা নিশ্চয় খোদ সাহায্যকর্মীরাও করেন নাই। কিন্তু ইজরাইল এমনকি আর্ন্তজাতিক নৌসামানায় বেসামরিক লোকেদের ওপর বলপ্রয়োগে ন্যূনতম সামরিক নৈতিকতাও পালন করে নাই। তারা যদি মনে করে তারা ক্ষুদ্ধ সাহায্য কর্মীদের আক্রমণের শিকার হতে পারতো সেক্ষেত্রে তো তাদের নানাভাবে নিবৃত্ত করার সুযোগ ছিল কোনোরুপ মারাত্মক আঘাত না করে। সোমবার সারাদিন ধরে খোড়াসব যুক্তিতে যেভাবে সাহায্যকর্মীদের অভিযুক্ত করতে ব্যস্ত ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সহ সরকারের কর্তব্যক্তিরা, তাতে মনে হচ্ছে নিরস্ত্র লোকেদের ওপর অগ্রহণযোগ্য বলপ্রয়োগের বিষয়টা তারা বেমালুম ভুলে গেছে।
ইজরাইলে এখন বলছে, তারা সাহায্যকর্মীদের স্রেফে গাজায় যাওয়া থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিল। এবং তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছে। অথচ কিছু স্থিরচিত্র ও ভিডিওতে দেখা গেছে, ইজরাইলি সেনারা হেলিকপ্টার থেকে জাহাজে গুলি করছে। যদি স্বেচ্ছাসেবী সাহায্য কর্মীদের গাজায় পৌঁছানো থেকে বিরত রাখাই রাষ্ট্রটির উদ্দেশ্য হতো, তবে তো তারা স্রেফে নিজেদের যুদ্ধজাহাজ দিয়ে জাহাজের পথ রোধ করে দিতে পারতো। যেমনটা খবর এসেছে যে, খানিকটা সময় তারা যুদ্ধজাহাজ দিয়ে ত্রাণবাহী জাহাজগুলার খুব কাছ থেকে ঘিরে চলছিলো--ওই সময় বেসামরিক জাহাজগুলা বাধ্য হয়ে নিজেদের গতি একেবারে কমিয়ে চলতে বাধ্য হয়েছিল। আরো লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, হামলাটি ইজরাইল চালালো আর্ন্তজাতিক নৌসীমানায়।
আর্ন্তজাতিক আইনের অব্যাহত লঙ্ঘনের সর্বশেষ নজির
তুরস্কের ইস্তাম্বুল বন্দর থেকে চারদিন আগে রওয়ানা হবার পর থেকেই ইজরাইল বলে আসছিল তারা নৌবহরটাকে বাঁধা দেবে। গাজায় যেতে দেবে না। অথচ গাজা উপত্যকার স্থলভাগের মতোই নৌসীমানাও দখলদার ইজরাইলের বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে পড়ে না। এবং ভূমধ্যসাগরের আর্ন্তজাতিক নৌসীমানা হয়ে গাজা’র নৌসীমানার দিকে যাচ্ছিল ফ্রিডম ফ্লোটিলা। কাজেই আর্ন্তজাতিক আইনের মধ্যে এমন একটা নৌবহরকে বাঁধা দেয়ার কোনো এখতিয়ার নাই ইজরায়েলের। সেক্ষেত্রে বাঁধা দেয়া তো কমই, এবার আর্ন্তজাতিক নৌসীমানায় বিভিন্ন দেশের বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করলো বর্ণবাদী খুনি রাষ্ট্রটা। নৌবহরে চারটা দেশের--আয়ারল্যান্ড, ব্রিটেন, গ্রিস ও তুরস্কে নিবন্ধিত জাহাজ ছিল। জাহাজগুলাতে দুনিয়ার চল্লিশটা দেশের নাগরিকরা ছিলেন। ইজরাইলের আরব জনগোষ্ঠীর নেতা রিয়াদ সালেহ, জর্মানির দুইজন বামপন্থী সংসদ সদস্য, সুইডেনের জনপ্রিয় সাহিত্যিক হেনিং মানকেল, জেরুজালেমের সাবেক ক্যাথলিক ধর্মগুরু, আয়ারল্যান্ডের মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠক এবং নোবল পুরস্কার বিজয়ী আইরিশ ব্যক্তিত্ব মেইরিড করিগান মেগুইর সহ আরো অনেক সুপরিচিত লোকজনও ছিলেন নৌবহরে। বাংলাদেশের কোনো নাগরিক ছিলেন বলেন এখনো জানা যায় নাই।
অবাঁধ তথ্য প্রবাহে যখন বাঁধ পড়ে
ফ্রিডম ফ্লোটিলায় হামলার পরে এ পর্যন্ত আর কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে পরিস্থিতির খবর পাওয়া যায় নাই। ইজরাইলি পত্রিকা হারেট্জ এর ওয়েবাসাইট থেকে জানা গেছে, জাহাজগুলার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরে ইজরাইলি সেনারা সেগুলাকে কাছাকাছি অবস্থিত নিজেদের বন্দরে--আশদদ বন্দরে নিয়ে গেছে সোমবার সন্ধ্যার কিছু আগে। সেখানে কোনো সংবাদকর্মীকে মুক্তভাবে খবর প্রকাশে ঢুকতে দেয়া হয় নাই। কয়েকজন বাছাইকৃত সাংবাদিককে একটা বোটে করে বন্দরের বর্হিনোঙরের কাছে যেতে দেয়া হয়, কিন্তু সবার কাছ থেকে সব রকমের সংবাদযন্ত্র রেখে দেয় কর্তৃপক্ষ। কাগজ-কলম, অডিও রেকর্ডার, ভিডিও ক্যামেরা থেকে শুরু করে সব। কিন্তু ইজরাইলি দৈনিকটা নিজেদের সরকারকে তারপরও অবহেলার দায়ে অভিযুক্ত করছে যে, কেন সবার মোবাইল ফোন রেখে দেয়া হয় নাই। উল্লেখ্য, বাছাইকৃত সাংবাদিকদের মধ্যে কারো একজনের মোবাইল ফোন ছিল, এবং তার মোবাইলে তোলা অস্পষ্ট ছবি’ই পরে ইন্টারনেটে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত জাহাজগুলা ইজরাইলি বন্দরে নিয়ে যাওয়ার পরে ওই মোবাইলে তোলা ছবিগুলা ছাড়া আর কোনো মুক্তভাবে নেয়া ছবি বা সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না।
আর্ন্তজাতিক বেশিরভাগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিগুলা হচ্ছে এমন যে--গুরুতর আহত কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীকে একটা ইজরাইলি হেলিকপ্টারে করে সেনারা হাসাপাতালে নিয়ে আসছে। ইজরাইলি সেনাঘাটির ভেতরে তোলা ছবি--‘উদ্ধারকর্তা’ সেনাদের ছবি--বাছাইকৃত সাংবাদিক অর্থাত বিশেষ অনুমতি প্রাপ্ত সাংবাদিকদের তোলা। অধিকাংশ সংবাদ মাধ্যম আক্রান্ত এবং বর্তমানে ইজরাইলি কর্তৃপক্ষের কাছে জিম্মি সাহায্যকর্মীদের বক্তব্য সংগ্রহের কোনো চেষ্টা করেছেন বলে, খবরগুলাতে কোনো আলামত পাওয়া যায় না। প্রায় সবাই দখলদার রাষ্ট্রটির কর্তাব্যক্তিদের-মুখপাত্রদের বক্তব্য ফলাও করে প্রচার করছেন।
এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক গণমাধ্যমের চেয়ে আরো বেশি মুক্ত বলে প্রচারিত--ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কিং সাইটের বিরুদ্ধে--টুইটারের বিরুদ্ধে সারাদিন প্রচুর অভিযোগ এসেছে যে, ব্যবহাকারীদের আপলোড করা ফ্রিডম ফ্লোটিলা সংক্রান্ত খবর ও বিশ্লেষণের লিংকগুলা সাইটটা সরিয়ে ফেলছিলো বারবার। যাকে বলে অঘোষিত সেন্সরশীপ। ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ানের টেকনলজি ব্লগ এ অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ দিয়া লেখা প্রকাশ করছে বিকালে। বর্ণবাদী রাষ্ট্রটা আটককৃত সাহায্যকর্মীদের বিষয়ে তথ্য দিতে নারাজি জানিয়েছে সারাদিন। এবং সোমবার রাত সাতটার দিকে স্থানীয় দৈনিক জেরুজালেম পোস্টের ওয়েবাসাইট থেকে জানা যায়; সেচ্ছাসেবীদের মধ্য থেকে ৩২ জনকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার করেছে দেশটার কারা কর্তৃপক্ষ। গ্রেফতারকৃতদের পরিচয় জানানো হয় নাই।
Available tags : গাজা, ইজরাইলি, ত্রাণবহরে হামলা, অবরোধ