- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
১. রূপগঞ্জ কি আরেক ‘সিঙ্গুর’?
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সেনা আবাসন প্রকল্পের জমি ক্রয়ের নামে সেনাবাহিনীর একধরনের জবরদস্তিমূলক কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে এলাকার গ্রামবাসীর সঙ্গে সেনা-পুলিশ-র্যাবের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে পুলিশ-র্যাব-সেনাসহ অর্ধশতেরও বেশি লোক হতাহত হয়েছে। এরমধ্যে ২০ জনেরও বেশি গ্রামবাসী গুলিবিদ্ধ হয়েছে। গুলিবিদ্ধ মোস্তফা জামাল নামের ২৮ বছরের এক যুবক মারা গেছে। তিন গ্রামবাসী নিখোঁজ রয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, তারাও নিহত হয়েছে এবং লাশ গুম করা হয়েছে। ঘটনায় পুলিশ অজ্ঞাতনামা তিন-চার হাজার এলাকাবাসীকে আসামি করে মামলা করেছে।
কেন এই সংঘর্ষ? গত পাঁচ-ছয় মাস আগে রূপগঞ্জ সদর ও কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ২৪টি গ্রামে সেনা আবাসন প্রকল্পের নামে জমি কেনার ‘অভিযান’ শুরু হয়। এটাকে অভিযান বলতে হয় এ কারণে যে, গত কয়েক মাসে রূপগঞ্জের এই এলাকার দুইটি ইউনিয়নে সেনাবাহিনী মোট চারটি সেনাক্যাম্প স্থাপন করে। তারা এখানে আর্মি ক্যাম্প স্থাপন করে কোনো যুদ্ধ বা যুদ্ধের মহড়ার জন্য নয়। চারটি ক্যাম্প তারা স্থাপন করেছে সেনা অফিসারদের ব্যক্তিগত আবাসিক প্লটের জমি ক্রয় করার জন্য। খুবই সঙ্গত কারণে প্রশ্ন ওঠে, ব্যক্তিগত আবাসিক প্লটের জমি ক্রয় করার জন্য এলাকায় চারটি ক্যাম্প বসিয়ে সেনা মোতায়েন করার প্রয়োজন দেখা দিল কেন? আর সেনাক্যাম্প শুধু গ্রামেই নয়, রূপগঞ্জ সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের পাশেও একটি সেনাক্যাম্প বসানো হয়েছে। কি উদ্দেশ্যে?
গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে--ঐসব ক্যাম্পে অবস্থানকারী ইউনিফর্মধারী সেনাসদস্যরা গ্রামবাসীদেরকে ঐ এলাকার জমি সেনাবাহিনী ছাড়া অন্য কারো কাছে বিক্রি না করার মৌখিক নির্দেশ জারি করেন। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, রূপগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রার নাজমুল আলম প্রধান সাংবাদিকদের বলেন--‘দুইটি ইউনিয়নের ২৪টি মৌজার জমি কেনাবেচনা না করার জন্য মৌখিক নির্দেশ জারি করেছিলেন সেনাসদস্যরা’। তিনি আরো বলেন--‘সেনাসদস্যরা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের ভেতরে বসে থাকতেন। তারা গ্রামের লোকদেরকে জমি দলিল করতে দিতেন না। কেউ দলিল করলে তাকে টিপসহি করতে দিতেন না। অথচ দেশের আইন অনুযায়ী জনগণকে এভাবে জমি কেনাবেচায় বাধা দেওয়া বে-আইনী।’ আরো জানা যায়--ঐ এলাকায় জমির বর্তমান বাজারমূল্য ৩০ থেকে ৭০ লাখ টাকা বিঘা। অথচ সেই জমি সেনাবাহিনীর কাছে ১৪-১৫ লাখ টাকা বিঘা দরে বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছিলো। অনেকের মতে এটাকে জমি ক্রয় না বলে বিনানোটিশে জনগণের জমি পানির দরে জবরদস্তিমূলক ‘অধিগ্রহণ’ বলাই যথাযথ।
এই ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই আজ প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে রূপগঞ্জ কি আরেক ‘সিঙ্গুর’? না সিঙ্গুরই বা বলা যায় কিভাবে? ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ করতে চেয়েছিল ঐ এলাকায় বৃহৎ শিল্পকারখানা গড়ে তোলার জন্য, আর সে অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল প্রকাশ্য নোটিশ জারির মাধ্যমে আইনী প্রক্রিয়ায়। অন্যদিকে রূপগঞ্জে হাজার হাজার কৃষকের শত শত একর জমি পানির দরে ক্রয়ের নামে একধরনের ‘অধিগ্রহণের’ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল সেনাসদস্যদের ব্যক্তিগত আবাসন প্লটের জন্য এবং সেটি করা হচ্ছিল খুবই এক অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। সে হিসেবে বলা যায়, রূপগঞ্জের পরিস্থিতি সিঙ্গুরের চেয়েও খারাপ।
রূপগঞ্জে সেনাবাহিনীর এই জমিক্রয়ের ঘটনাকে অনেকেই ‘সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বিনষ্ট করার একটা নেপথ্য ষড়যন্ত্র’ বলে মনে করছেন। এই পরিস্থিতি তৈরির পেছনে ‘দেশের শাসকশ্রেণীর স্থূল রাজনৈতিক স্বার্থের অন্তর্গত অসুস্থতা, সেনাবাহিনীর একশ্রেণীর কর্মকর্তাদের উচ্চাভিলাষ এবং সুযোগসন্ধানী নানান বিদেশী রাষ্ট্র ও সংগঠনের নানান অপতৎপরতা দায়ি’--বলেও অনেকে মতামত ব্যক্ত করেছেন। এসব মতামত শুধু যথার্থই নয়, খুবই প্রণিধানযোগ্য বলেই মনে হয়।
২. রূপগঞ্জের ঘটনায় সরকার কি একঢিলে
দুই পাখি মারতে চায়?
সেনাসূত্র থেকে জানা যায়, বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গতবছর অক্টোবরে সেনাবাহিনীর বিপুলসংখ্যক অফিসারদের আবাসন সঙ্কট মেটাতে ‘সেনা আবাসন প্রকল্প’ (আর্মি হাউজিং স্কিম) নামে একটি বিশাল প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। জানা যায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত জানুয়ারি মাসে এ প্রকল্পটি অনুমোদন করেন। প্রকল্পের স্থান নির্ধারণ করা হয় রূপগঞ্জ উপজেলার দুইটি ইউনিয়নের ২৪টি মৌজায়। এর আয়তন ধরা হয় ১৩ হাজার বিঘা।
বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশের একটি জনবহুল এলাকায় ১৩ হাজার বিঘা জমির ওপর আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার অর্থ হলো, প্রায় এক লাখ মানুষের নিজ বাসভূমি, চৌদ্দপুরুষের ভিটা এবং কৃষিজমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া। তাছাড়া রূপগঞ্জের ঐ এলাকার জমিও খুব উর্বর। এ ধরনের একটা উর্বর ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ২৪টি গ্রামের প্রায় ১ লাখ মানুষকে ভিটেছাড়া করে ১৩ হাজার বিঘা জমির ওপর সম্পূর্ণ অনুৎপাদনশীল খাতে আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন দেশের প্রধানমন্ত্রী কীভাবে দিতে পারেন একটি সত্যিই এক অবিশ্বাস্য ও প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার বটে!
সেনাবাহিনীর ওপর দোষ চাপিয়েই বা লাভ কি? রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের লাখ লাখ সরকারি-আধাসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চরম আবাসিক সঙ্কটে ভোগেন। রাজধানী ঢাকা নগরীতেই বহু সরকারি কর্মকর্তাদের ১৫ হাজার টাকা মাইনে পেয়ে ১২ হাজার টাকায় বাড়িভাড়া করে থাকতে হয়। হাজার হাজার নিম্নপদে চাকরিরত কর্মচারীদের মাসে ৮ হাজার টাকা মাইনে পেয়ে ৬ হাজার টাকার ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়। আবাসনের এই সঙ্কট সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যেও রয়েছে। সে হিসেবে সেনাকর্মকর্তাদের আবাসন সমস্যা সমাধানে সেনাবাহিনী উদ্যোগ নিতেই পারে। আর সেনাবাহিনী রূপগঞ্জ গিয়েছিল সরকারেরই অনুমোদনক্রমে।
কিন্তু এমন বিশাল বড় আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন যেহেতু সরকার দিয়েছিল, তাই প্রকল্পের বিপুল পরিমাণ জমি ক্রয় বা ‘অধিগ্রহণের’ দায়িত্ব নেওয়া উচিত ছিল সিভিল সরকারেরই। সাধারণ জনগণের বিপুল জমি (তা অধিগ্রহণের মাধ্যমে হোক বা ক্রয়ের মাধ্যমেই হোক) দখলের কাজটি সেনাবাহিনীর মত একটি স্পর্শকাতর সংস্থার কাঁধে অর্পণ করার সরকারি সিদ্ধান্তটি ছিল খুবই অপরিণামদর্শী এবং বিভ্রান্তিকর। এর ফলে জমি ক্রয়কে কেন্দ্র করে রূপগঞ্জে যা ঘটলো তার দায় সরকারের ওপর না পড়ে, পড়লো সেনাবাহিনীর ওপর। আর সেইসাথে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হলো।
এদিকে রূপগঞ্জের ঘটনা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক খেলা। খেলা যে ইতিমধ্যে জোরেশোরেই শুরু হয়ে গেছে তার আলামত খুবই স্পষ্ট। রূপগঞ্জের ঘটনা ঘটেছে ২৩ অক্টোবর শনিবার। ঐ দিনই, অর্থাৎ শনিবারেই ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ রংপুরে এক সমাবেশে ঘটনার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রীকে দায়ি করে বলেন--‘রূপগঞ্জে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে খালেদা জিয়ার উস্কানিতে।’ ঘটনার কোনো তদন্ত, এমনকি প্রাথমিক অনুসন্ধান ছাড়াই শনিবারের রূপগঞ্জের ঘটনা নিয়ে শনিবারেই রংপুরে বসে আওয়ামী লীগ নেতা যে বক্তব্য দিলেন--তা না করে তিনি যদি ঘটনার একদিন আগে শুক্রবারে রংপুরে বসে বলতেন--‘আগামীকাল রূপগঞ্জে সেনাবাহিনীর সঙ্গে এলাকাবাসীর একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হবে এবং সে সংঘর্ষে উস্কানি দিবেন খালেদা জিয়া’--তাহলে মনে হয় তাঁর বক্তব্য আরো বেশি বিশ্বাসযোগ্য (?) হতো!
ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের এ ধরনের লাগামহীন (অথবা পরিকল্পিত?) কথাবার্তায় স্বাভাবিকভাবেই জনমনে এরকম প্রশ্ন উঠতে পারে--তাহলে কি সরকার কর্তৃক রূপগঞ্জে বিশাল আকারের সেনা আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন প্রদান এবং প্রকল্পের জমিক্রয়ের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর কাঁধে অর্পণ করার বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলক ছিল? জনগণ এরকমটি ভাবলেও মনে হয় দোষের হবে না যে, আট মাস আগে রূপগঞ্জের জনবহুল এলাকায় ১৩ হাজার বিঘা জমির ওপর সেনা আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন দিয়ে এবং প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ বা ক্রয়ের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর কাঁধে অর্পণ করে সরকার যে ‘বিষবৃক্ষ’ রোপণ করেছিল, সেই বৃক্ষ এখন ফল দিতে শুরু করেছে। জনমনে এখন এই প্রশ্নও উঠতে পারে যে--রূপগঞ্জের ঘটনায়, একদিকে সেনাবাহিনীকে নাজুক অবস্থায় ফেলে এবং অন্যদিকে অপপ্রচার চালিয়ে সেনাবাহিনীকে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও তাঁর দলের মুখোমুখি করে তোলে--সরকারের কি এখন একঢিলে দুই পাখি মারার মওকা তৈরি হলো?
৩. রূপগঞ্জের ঘটনা থেকে শিক্ষাগ্রহণ এবং
সেনাবাহিনীর বিচক্ষণতাই এখন কাম্য
প্রথমত: রূপগঞ্জের মত ঘটনা কারো কাম্য না হলেও এই ঘটনা থেকে জনগণের শক্তিটা কী তা অনুধাবন করতে পারি আমরা। জনগণ যখন দেখে, তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, তখন নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এমনি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে যে--নিরস্ত্র জনগণ তখন পুলিশ-র্যাব-সেনাবাহিনীর সম্মিলিত সশস্ত্র শক্তিকেও গুঁড়িয়ে দিতে পারে। এটা অতীতেও বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। রূপগঞ্জেও খন্ডিতাবে হলেও সেটাই প্রমাণিত হলো।
দ্বিতীয়ত : রূপগঞ্জের ঘটনা থেকে আমাদের আরেকটি অভিজ্ঞতা হলো--বাংলাদেশের সেনাবাহিনী মনে হয় হুবহু আর পাঁচ-দশটা দেশের প্রতিক্রিয়াশীল বাহিনীর মত নয়। একাত্তরে জনগণের সাথে এককাতারে শামিল হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন-- হয়তো এ জন্যই মুষ্ঠিমেয় উচ্চাভিলাষীদের দ্বারা অনেকসময় নানা প্রলোভন ও উস্কানি সত্ত্বেও এবং কখনো কখনো জনগণের ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করলেও তা মনে-প্রাণে তারা মেনে নিতে পারেন না। রূপগঞ্জেও দেখা গেছে, সেনাবাহিনী জনরোষে আক্রান্ত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালালেও অকুস্থলে সেনাশক্তি বৃদ্ধি না করে হেলিকপ্টারের সাহায্যে জনতার ঘেরাওয়ে আটকে পড়া সেনা সদস্যদেরকে ত্বরিত প্রত্যাহার করার কাজকেই প্রাধান্য দিয়েছে। অর্থাৎ সেনাবাহিনী জনগণের মুখোমুখি হতে চায়নি।
রূপগঞ্জে আবাসন প্রকল্পের জমি ক্রয়ের ঘটনায় সেনাসদস্যদের বাড়াবাড়ির ব্যাপারটিও দায়িত্বশীল সেনাকর্মকর্তারা অনুধাবন করতে পেরেছেন বলেই মনে হয়। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, আবাসন প্রকল্পের সাথে যুক্ত কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যদের বাড়াবাড়ি ও অপরিপক্ক কর্মকান্ডের কারণেই জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে--একথা দায়িত্বশীল সেনাকর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন।
শুধু তাই নয়--একটি জনবহুল এলাকায় ১৩ হাজার বিঘার বিশাল আবাসন প্রকল্প অনুমোদনের অপরিণামদর্শী (অথবা উদ্দেশ্যমূলক?) সরকারি সিদ্ধান্তের ভয়াবহ পরিণতির কথা বুঝতে পেরে এখন আবাসন প্রকল্প ছোট করার চিন্তা করছেন তারা। পত্রপত্রিকার খবরের মাধ্যমেই জানা গেছে, সরকার অনুমোদিত ২৭ হাজার প্লটের মধ্যে ২০ হাজার প্লট বাদ দিয়ে এখন মাত্র ৭/৮ হাজার বা আরো কম সংখ্যক প্লটের কথা ভাবছেন তারা। আমরা আশা করবো, স্থানীয় জনগণ না চাইলে সেনাবাহিনী ওই এলাকায় আবাসন প্রকল্প বাতিল করবেন। কারণ আমরা মনে করি, আবাসন প্রকল্পের জমি ক্রয় এবং দালান-কোঠা তৈরির চেয়ে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব আরো অ-নেক অ-নেক বড়। বাংলাদেশের আকাশে আজ যে কালোমেঘের ঘনঘটা, তাতে আজকে অথবা আগামীকাল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে সেনাবাহিনীকেই এবং তা করতে হবে জনগণকে সঙ্গে নিয়েই।
সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে এটিও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন যে, রূপগঞ্জের ঘটনা ছিল এলাকাবাসীর স্বত:স্ফূর্ত বিক্ষোভ, তাদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন - এর মাঝে বিরোধীদলীয় নেত্রী বা অন্য কারো উস্কানির অভিযোগ অবান্তর ও উদ্দেশ্যমূলক। সুতরাং আমরা আরো মনে করি, রূপগঞ্জের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে মহল বিশেষের যে ‘খাটাশ রাজনীতি’ (খাটাশের মত দুর্গন্ধযুক্ত রাজনীতি) শুরু হয়েছে তা বন্ধ করতে সেনাবাহিনীর বিচক্ষণতাই যথেষ্ট।
রইসউদ্দিন আরিফ : রাজনীতিক, কলামিস্ট
তারিখ : ০১-১১-২০১০
Available tags : সেনা আবাসন প্রকল্প, সেনাক্যাম্প, রূপগঞ্জ