কয়লা নীতি


বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং জ্বালানি নিরাপত্তায় কয়লা নীতি

দেশের চলমান জ্বালানি সংকট কাটাতে কয়লা ব্যবহারে এখনো কোন উদ্যোগ চূড়ান্ত করে নাই সরকার। কয়লা ওঠানোর উদ্যোগ এখনো নীতিগত স্তরেই আটকে আছে। জ্বালানি তেল আমদানি করতে হচ্ছে, ক্রমেই বাড়তে থাকা বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে শিল্পখাতের নিরাপত্তা হুমকির মুখে। আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতার কারণে একদিকে জ্বালানি নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা কাটছে না, অন্যদিকে ব্যয়ও বাড়ছে। কয়লা নীতি না থাকায় কয়লা ওঠানোর বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে দেশীয় কয়লা ওঠানো ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই। ফলে, কয়লা নীতি চূড়ান্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রতিবেদনটা তৈরি করেছেন নেছার আমিন।

বাংলাদেশের মোট জিডিপির বর্তমান ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে তা সাত শতাংশে উন্নীত হবে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে জ্বালানির প্রয়োজনও অনেক বাড়বে। কমপক্ষে ছাব্বিশ ঘনফুট অতিরিক্ত গ্যাসের দরকার হবে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ, সার, সিএনজি ও আবাসিক জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার জন্য গ্যাস সংরক্ষণ করা দরকার। সেজন্য জ্বালানির বিকল্প উৎস হিশাবে কয়লার ব্যবহার বাড়ানো জরুরি। বাংলাদেশের কয়লার মান দুনিয়ার যেকোন কয়লার চেয়ে উন্নত। দেশের ১ টন বিটুমিনাস কয়লার ‘প্রজ্জ্বলন ক্ষমতা’ বিদেশ থেকে আমদানি করা ২ টন কয়লার সমান। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য দেশের কয়লার চেয়ে দেশীয় কয়লার দামও বেশি। জার্মানি বা ইনডিয়ার কয়লার দাম যেখানে প্রতি টন ৫০ ডলার, সেখানে বাংলাদেশের কয়লার দাম ১০০ ডলার। পরিবেশের জন্যও এখানকার কয়লার ব্যবহার সুবিধাজনক। কারণ এই কয়লায় সালফারের পরিমাণ মাত্র ০.৫ ভাগ, যা পরিবেশের জন্য খুব ক্ষতিকর না। কয়লা ব্যবহার করে দেশে শতকরা ৩.৭৭ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যে মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট আসে কয়লা জ্বালানি থেকে। মজুদের পরিমাণ অনুযায়ী কয়লা থেকে বিদ্যুতের এ উৎপাদন খুবই কম। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯৪ শতাংশ, চীনে ৮১ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ৭৬ শতাংশ, ইনডিয়ায় ৬৮ শতাংশ ও আমেরিকায় ৪৯ শতাংশ বিদ্যুৎ শুধু কয়লা থেকেই তৈরি হয়। বাংলাদেশের একমাত্র কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বড়পুকুরিয়ায়। বড়পুকুরিয়ার কয়লা খনির কয়লা থেকেই ২৫০ মেগাওয়াটের এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সেখানে কেন্দ্রটি বছরের বেশিরভাগ সময় অচল থাকায় গড়ে ১৬৫ মেগাওয়াট এর মত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ গ্যাস মজুদ আছে তা দিয়ে ২০১৫ সালের পর আর চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না। কিন্তু কয়লা এমন পরিমাণ মজুদ আছে যে, তা থেকে দৈনিক ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ৫০ বছর পর্যন্ত অনায়াসে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু কয়লা নীতি না থাকায় কয়লা ওঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরকারকে কয়লা আমদানির উদ্যোগ নিতে হয়েছে। চট্টগ্রাম ও খুলনায় দুই হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের দুইটা আলাদা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। শুরুতে সাময়িকভাবে আমদানি করা কয়লা দিয়ে কেন্দ্র দুটির চাহিদা মেটানো হবে। এই সিদ্ধান্তের আগে থেকেই বাংলাদেশ ৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা বিদেশ থেকে আনে প্রতি বছর। তবে সাধারণত ইটভাটার জন্যই এসব কয়লা আমদানি করা হয়। কিন্তু এর ৮৩ ভাগই আসে আবার অবৈধ পথে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ইনডিয়া থেকে পরিবেশ দূষণকারী বেশি সালফারযুক্ত কয়লা আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এ ধরনের কয়লা আমদানির ওপর বাংলাদেশের আমদানি নীতিতে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা আছে।ইনডিয়া থেকে এই কয়লা আনা হবে আমদানি নীতির পুরাপুরি খেলাফ। কারণ ইনডিয়ার কয়লায় ১ শতাংশেরও বেশি সালফার রয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশ এবং কৃষি খাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এই আমদানি করা কয়লা।

যে পরিমাণ কয়লা মজুদ আছে (পেট্রোবাংলার হিশাবে)

মোট কয়লাখনি 

 ১. জামালগঞ্জ ২. বড়পুকুরিয়া ৩. ফুলবাড়ী ৪. খালিসাপাড়া ৫. দীঘিপাড়া

৫ টি 

 মোট কয়লা মজুদ 

২৫০ কোটি মেট্রিক টন।

 খনিগুলার ওপর একনজর

বড়পুকুরিয়া

১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত হয়। এখানে সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ ৩০ কোটি ৩০ লাখ টন। ১১৮ থেকে ৫০৯ মিটার গভীরে এ মজুদ নিশ্চিত হওয়া গেছে। বর্তমানে এই খনি থেকে কয়লা তোলা হচ্ছে।

ফুলবাড়ী

১৯৯৭ সালে কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়। এই খনির গভীরতা ১৫০ থেকে ২৪০ মিটার। এখানে ১৫০ থেকে ২৪০ মিটার গভীরে ৫৭ কোটি ২০ লাখ টন কয়লা মজুদ আছে।

খালিসাপাড়া

১৯৮৯ সালে আবিষ্কৃত হয়। এখানে ৬৮ কোটি ৫০ লাখ টন কয়লার মজুদ নিশ্চিত হওয়া গেছে। এখানে কয়লার স্তর ২৫৭ থেকে ৪৮৩ মিটার মাটির গভীরে।

দীঘিপাড়া

১৯৯৪ সালে আবিষ্কৃত হয়। মজুদের পরিমাণ ৬০ কোটি টন। খনিটিতে ৩২৮ থেকে ৪০৭ মিটার গভীরে কয়লা স্তর রয়েছে।

জামালগঞ্জ

১৯৬২ সালে আবিষ্কৃত হয় । মজুদের পরিমাণ ১০৫ কোটি ৩০ লাখ টন। ৬৬০ থেকে ১ হাজার ১৫৮ মিটার গভীরে এ খনির কয়লার স্তর। তবে কয়লার স্তরটি তিন হাজার ফিট নিচে হওয়ায় সাধারণ প্রযুক্তিতে তা উঠানো সম্ভব না।

কয়লা ওঠানোর পদ্ধতি

ভূ-গর্ভস্থ খনন বা খোলামুখ পদ্ধতির বিকল্প সম্ভব

বাংলাদেশে কোন পদ্ধতিতে কয়লা ওঠানো হবে তা নিয়ে দুটি মত দেখা যায়। অনেকে বলছেন, পরিবেশের ক্ষতির দিক বিবেচনা করে সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে কয়লা ওঠাতে হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, খোলামুখ পদ্ধতিতে কয়লা ওঠালে লাভের পরিমাণ বেশি হবে। আসলে কয়লা কোন পদ্ধতিতে ওঠানো হবে, তা নির্ভর করে খনির অবস্থান, গভীরতা, কয়লা স্তরের পুরুত্ব, ভূতাত্ত্বিক ও হাইড্রোলজিক্যাল পরিবেশের ওপর। সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে খুব কম কয়লা ওঠানো যায়। খনি বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পদ্ধতিতে দশ থেকে বিশ শতাংশ উঠানো যায়। তাতে সুবিধা হল, পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি নিচু পর্যায়ে রাখা সম্ভব। অন্যদিকে, খোলামুখ পদ্ধতিতে প্রায় শতকরা আশি থেকে নব্বই ভাগ কয়লা ওঠানো যায়। কিন্তু তাতে দেশভেদে, অঞ্চলভেদে নানা মাত্রার ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়।

ফুলবাড়ির কয়লা খনির অবস্থা

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুরে বছরওয়ারি তিন ফসলি জমির ব্যাপক চাষাবাদ রয়েছে। একইভাবে ফুলবাড়ির ওই খনি এলাকাটি ঘন জনবসতিপূর্ণ। সেখানে খনির ভেতরকার কয়লার ঘনত্ব, গভীরতা, এবং পানির স্তরের গভীরতা যে পরিমাণে আছে তাতে সব মিলিয়ে খোলামুখ পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শুধু ফুলবাড়ীতে খোলা পদ্ধতির খনির কারণে ভূগর্ভস্থ পানি বের করে আনলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৩১৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা। এই পদ্ধতিতে ভূপৃষ্ঠের পানির স্তরও নিচে নেমে যাবে। মোটকথা এর সার্বিক বিপর্যয়ে সেখানকার ক্ষতিগ্রস্তÍ মানুষের সংখ্যা দুই লাখ ২০ হাজারে গিয়ে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খোলামুখ পদ্ধতিতে কয়লা ওঠাতে শুরুতেই খনি এলাকাকে পানিশূন্য করতে হয়, যাতে খনির ভেতরটা পানিতে ডুবে না যায়। এজন্য খনির চারদিকে বিশাল বিশাল সব পাম্প মেশিন বসাতে হবে অর্থাৎ খনির গভীরে ঢোকার আগেই পানি তুলে ফেলতে হবে। তাই খনির প্রয়োজনেই বিশাল এলাকা জুড়ে মাটির স্তর পানিশূন্য করতে হবে। এ অবস্থায় তখন গভীর নলকূপ দিয়েও যথেষ্ঠ পানি পাওয়া যাবে না। ফলে পরিবেশ সহ কৃষির ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি হবে নি:সন্দেহে। খোলামুখের খনি মানেই খনি এলাকার পরিবেশের বিরাট ক্ষতি করে ফেলা। মাটির নিচের কয়লা পর্যন্ত পৌঁছাতে কোথাও কোথাও প্রায় হাজার ফুটও গর্ত করতে হবে। খনির ভেতরে চলবে ডিনামাইট বিস্ফোরণ, কয়লা ভাঙ্গার জন্য খনির ভেতরে বাইরে বসবে নানা যন্ত্রপাতি। চলবে বিশাল বিশাল ট্রাক, কয়লার ট্রেন। এসব থেকে শব্দদূষণ সহ আরো যেসব দূষণ হবে তার বাড়তি কিছু কুফল এমনিতেই ধরে নিতে হবে ৷ বায়ুদূষণ ঘটবে কয়লার ধুলা-ময়লা থেকে। মাটির উলোটপালট যেভাবে হবে তাতে সমস্ত অণুজীব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

খোলামুখ পদ্ধতির পক্ষে দুটি যুক্তি

অনেকে যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশ জার্মানি, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং প্রতিবেশী দেশ ইনডিয়াতেও খোলামুখ পদ্ধতিতে কয়লা উঠানো হয়। তাই বাংলাদেশেও এ পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। কথা হল, জার্মানিতে খোলামুখ পদ্ধতিতে তোলা হচ্ছে তাই বাংলাদেশেও একই পদ্ধতিতে তুলতে হবে এরকম যুক্তি গ্রহণযোগ্য না। কারণ জার্মানির পরিবেশ-পরিস্থিতি আর বাংলাদেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি এক না। জার্মানিতে খোলামুখ পদ্ধতিতে কয়লা ওঠানো সম্ভব। কারণ সে দেশের কয়লা খনি এলাকায় খুব কম মানুষ বসবাস করে। তাছাড়া বসবাস করা এবং চাষাবাদের জন্য জমিজমারও অভাব নাই। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা সেদিক থেকে একদমই আলাদা। বাংলাদেশের খনি এলাকায় রয়েছে মানুষের প্রচুর ঘনবসতি, প্রচুর ফসলি জমি। একইসাথে আছে খনির স্তরের গভীরতা। আবার এদেশে মাটির খুব অল্প নিচেই পানির স্তর। খোলামুখ পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে আরেকটা যুক্তি দেখানো হয় যে, এ পদ্ধতিতে আশি থেকে নব্বই শতাংশ কয়লা ওঠানো সম্ভব। তাতে এ পদ্ধতিতে ওঠানো কয়লার আশিভাগই রপ্তানি হবে। কোল এশিয়া (সাবেক ‘এশিয়া এনার্জি’) সহ অন্যান্য কোম্পানিগুলাও এ পদ্ধতিতে কয়লা তোলার প্রতি জোর দিচ্ছে। কারণ তারা এতে কয়লা রপ্তানি করার সুযোগ পাবে। তাতে তারা লাভও বেশি পাবে। এখন আশিভাগ কয়লা রপ্তানি হয়ে গেলে দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটানো এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ কাজটাই বিপর্যস্ত হবে।

বিকল্প পদ্ধতি: আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন (ইউসিজি) প্রযুক্তি

খোলামুখ ও সুড়ঙ্গ পদ্ধতি ছাড়াও আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন (ইউসিজি) প্রযুক্তি ব্যবহার করে কয়লা ওঠানোর সুযোগ আছে। ইউসিজি প্রযুক্তির মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড, হাইড্রোজেন, মিথেন ইত্যাদি জ্বালানি ব্যবহার করে কয়লাকে প্রথমে গ্যাসে রূপান্তর করা হয়। সে গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয় বিদ্যুৎ। অন্য দুই পদ্ধতিতে কয়লা উৎপাদন পরিবেশ এবং মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও এ পদ্ধতিতে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে তুলনামূলকভাবে পরিবেশবান্ধব। ইউসিজি পদ্ধতিতে খোলা পদ্ধতির চেয়ে বেশি পরিমাণে কয়লা ওঠানো যাবে। তাতে খরচও পড়ে অনেক কম। খোলা পদ্ধতিতে খনি এলাকার মানুষের ক্ষয়ক্ষতি এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকলেও গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতিতে এ ধরনের আশঙ্কা থাকবে না। বিশ্বের প্রধান কয়লা উৎপাদনকারী দেশগুলা বর্তমানে এ প্রযুক্তি অনুসরণ করছে। ১৮৬৮ সালে ইউসিজি প্রযুক্তির ধারণা সর্বপ্রথম নিয়ে আসেন জার্মানির দুই সহোদর প্রকৌশলী ওয়ার্নার ও উইলহেম সিমেন্স। ১৯২৮ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রাথমিকভাবে এ প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করে। তবে তারা এ পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা ওঠানো শুরু করে ১৯৩৭ সাল থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ প্রযুক্তি অনুসরণ করে ১৯৭০ এর দশকে। চীন ১৯৮০ সাল থেকে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত চীন ১৬ টি কয়লা খনিতে এ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ, অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন উৎপাদন করেছে। জাপানও এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সম্প্রতি ভারত, পাকিস্তান এবং পূর্ব ইওরোপের ইউক্রেন, রোমানিয়া এবং নিউজিল্যান্ড এ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য জোর আগ্রহ দেখিয়েছে। জামালগঞ্জ কয়লাখনি থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন (ইউসিজি) প্রযুক্তির মাধ্যমে কয়লা ওঠানোর ব্যাপারে সম্প্রতি বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছে আমেরিকার একটা বেসরকারি কোম্পানি ‘ক্লিন কোল’। সরকার তাদের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করার কথা বলেছে। ‘ক্লিন কোল’ কোম্পানি আমেরিকা, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, ভিয়েতনাম, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া সহ দুনিয়ার বহু দেশে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে কয়লা উঠিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ‘ক্লিন কোল’ ছাড়াও অনেক কোম্পানিই ইউসিজি প্রযুক্তি সরবরাহ করে।

পাঁচ বছরে চূড়ান্ত হয় নাই কয়লা নীতি

বিগত কয়েকটা সরকারই উদ্যোগ নেয়ার পরও কয়লানীতি চূড়ান্ত করার কাজটা এগিয়ে নেয় নাই। খসড়া নীতির ওপর পর্যালোচনা পর্ষদ করা হয়েছে কয়েকবার। এবং পরিষদের দেয়া সুপারিশগুলাও বাস্তবায়ন করা হয় নাই। বর্তমান সরকার কয়লানীতি আবার পর্যালোচনা করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নাই।

চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে প্রথমবারের মতো কয়লা নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। খসড়া নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয় ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলেটেশন সেন্টারকে (আইআইএফসি)। ২০০৬ সালে সংস্থাটি বিশেষজ্ঞদের সাথে শলা-পরামর্শ করে খসড়া কয়লা নীতি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। খসড়া নীতিতে ঢালাও রপ্তানি ব্যবস্থার পরিবর্তন করে রপ্তানী সীমিত করা হয়। একইসাথে সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশের আগের ৬ শতাংশের (রয়্যালিটির) হার পরিবর্তন করে কয়লার আন্তর্জাতিক দামের সাথে সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশ সমন্বয় করার প্রস্তাব করা হয়। এর ফলে জায়গাবিশেষে সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশের হার প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। ২০০৬ সালে ফুলবাড়ী কয়লা খনি এবং এশিয়া এনার্জিকে ঘিরে আন্দোলন গড়ে ওঠে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের দুই শিক্ষকের কাছে খসড়া নীতিমালা পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়। তারা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে খসড়াটি আবার পর্যালোচনার জন্য একটা পর্ষদ গঠনের প্রস্তাব দেন। এরই মধ্যে জোট সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। সামরিক বাহিনী সমর্থিত ফখরুদ্দিন সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর ২০০৭ সালে বুয়েটের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আবদুল মতিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটা পর্যালোচনা পর্ষদ গঠন করে। ওই পর্ষদ পর্যালোচনা প্রতিবেদন জমা দেয় ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি। প্রতিবেদনে বিতর্কিত খনন পদ্ধতি ও সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশ সম্পর্কে সরাসরি কোন মতামত দেয়া হয় নাই। এ প্রতিবেদনের আলোকে খসড়া নীতি উপদেষ্টা পরিষদে পেশ করা হলেও কয়লা নীতির অনুমোদন দেয় নাই পর্ষদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়টা নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেয়। মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার আগে কয়লানীতি চূড়ান্ত করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু গত দেড় বছরে এ ব্যাপারে কোন কাজই দেখা যায় নাই। জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিনকে প্রধান করে একটা পর্যালোচনা পর্ষদ গঠন করা হয়। বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে করা ‘কয়লানীতি-২০০৮’ পর্যালোচনা করে নীতিটা চূড়ান্ত করবে এই পর্ষদ। এখনো পর্যন্ত কয়লানীতি আগের অবস্থাতেই আছে। ফলে কবে নাগাদ এ কয়লানীতি চূড়ান্ত হবে সেটা ঠিক করে বলা যাচ্ছে না।

খসড়া কয়লা নীতিতে যা আছে

সর্বশেষ তৈরি করা খসড়া কয়লা নীতিতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এতে ‘কোল বাংলা’ নামে একটা কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা কয়লা ওঠানোর সার্বিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। কয়লা উন্নয়ন তহবিল নামে একটা স্থায়ী তহবিল গঠনের কথাও বলা হয়েছে এতে। এ খসড়া নীতিতে বলা হয়েছে, বিদেশী সাহায্যের প্রয়োজন হলে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যৌথমূলধনী উদ্যোগ নেয়া যাবে। এতে পরীক্ষামূলকভাবে খোলামুখ পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিধান রাখা হয়েছে। এবং বলা হয়েছে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তর দিকে পরীক্ষামূলকভাবে একটা খোলামুখের কয়লার খনি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সন্তোষজনকভাবে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে ভবিষ্যতে খোলামুখ খনন পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা ওঠানো যাবে। খসড়া নীতিতে কয়লা রপ্তানির কোন সুযোগ রাখা হয় নাই। তবে উন্নতমানের ‘কোকিং কয়লা’ থেকে কোক তৈরি করে তা রপ্তানি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ, দেশে এ কয়লা ব্যবহারের সুযোগ নাই। এতে বলা হয়েছে, কয়লা খনির সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার তার প্রাপ্য লভ্যাংশের হার নির্ধারণ করবে। সরকার কয়লা খনি ভেদেই এ প্রাপ্য লভ্যাংশ নির্ধারণ করবে। তবে ‘কোল বাংলা’ কয়লা ক্ষেত্র উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করলে এবং সরকারি মালিকানা বা যৌথ মালিকানায় কয়লা তোলা হলে সেটা সরকারের প্রাপ্য লভ্যাংশের পরিবর্তে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হতে পারে। খনি উন্নয়নকারীকে খনি মুখে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। সার উৎপাদন ও সিএনজি ছাড়া সব ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে গ্যাসের পরিবর্তে কয়লার ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ কয়লা নীতিতে খনি এলাকার বাসিন্দাদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। পরিবেশের ওপর সৃষ্ট প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশ অধিদফতর তার আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

কয়লা নীতিতে দুধরনের বিতর্কের মাঝেও কাজ করা সম্ভব

দুধরনের বির্তকে কয়লা নীতি চূড়ান্ত করার কাজ থেমে আছে। প্রথমত, খোলা না সুড়ঙ্গ--কোন পদ্ধতির খনি হবে--এই নিয়ে বিতর্ক। দ্বিতীয় বিতর্ক, খসড়া কয়লা নীতিতে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কয়েকটা ধারার সংযোজন। এধারাগুলা করা হয়েছে বিদেশী বিশেষ কোম্পানিকে সুবিধা দেয়ার জন্য। তবে খসড়া কয়লানীতির একটা ধারায় পরীক্ষামূলক খোলা পদ্ধতিতে কয়লা ওঠানোর প্রস্তাব দেয়া আছে। সরকার চাইলে এই প্রস্তাব অনুসরণ করে পরীক্ষামূলকভাবে এবং অবশ্যই স্বল্প পরিসরে কয়লা ওঠানোর কাজ শুরু করতে পারে। সেখান থেকে পাওয়া ফলাফল বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব। দ্রুত সিদ্ধান্ত না নিলে পরে ক্রমশ বাড়তে থাকা জ্বালানি সংকটের কারণে দেশের শিল্পখাত সহ সকল খাতের ঝুঁকি বাড়বে। গ্যাস বাদ দিলে দেশে কয়লাই একমাত্র জ্বালানির উৎস। ফলে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে খুব দ্রুত।

Fulbari anti-open pit coal mining protest

ফুলবাড়িতে এশিয়া এনার্জির খোলামুখ খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের বিক্ষোভ(২০০৬)

............................

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।