পাক্ষিক চিন্তা ১৫ নভেম্বর ২০১০ সংখ্যা


সংবিধান সংশোধন ও পুনর্মুদ্রণ: নৈরাজ্যের দিকে ধাবমান বাংলাদেশ

সংবিধান, রাষ্ট্র ও আদালতের চৌহদ্দি ঘিরে সম্প্রতি এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা বাংলাদেশকে দ্রুতই একটা সংঘাতের মধ্যে নিয়ে যাবার পথ তৈরি করছে। রাজনৈতিক বিরোধ ও ভিন্নতা নিরসনের কোন উপায় আর অবশিষ্ট থাকছে না। সেই লক্ষণ বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে। দলবাজি এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে পুরা রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠান সমূহকে দলীয় অঙ্গসংগঠনের ভূমিকায় নামিয়ে আনা হচ্ছে। কোন প্রতিষ্ঠান আর জনগোষ্ঠীর সাধারণ ও সামগ্রিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে না, করার জায়গায় নাই। আরো পড়ুন..

  • বিশ্বের অতি ক্ষমতাবান শ্রেণীর ‘জনকল্যাণ’ ও সুশাসন কারবার
  • অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ইনডিয়াকে বিশ্বশক্তি বানাতে চান ওবামা
  • খসড়া কয়লা নীতি ২০১০: খোলামুখ পদ্ধতি ও রফতানির সুযোগ থাকছে
  • শান্তির খোঁজে শর্মিলার এক দশক অনশন: মনিপুরে বর্বর দখলদারির বিরুদ্ধে আত্মপ্রত্যয়ী প্রতিবাদ
  • দেশে যন্ত্রপাতি তৈরি করা গেলে সৌরবিদ্যুৎ সুলভ হবে
  • সেনাসদস্যদের ব্যক্তিস্বার্থে সেনাবাহিনী চড়াও হল নাগরিকদের জমিন ও জানের ওপর
  • ঢাকায় কাউন্টার টেররিজমের আঞ্চলিক কেন্দ্র : সন্ত্রাসবাদ বিরোধী এক অদৃশ্য যুদ্ধে শামিল বাংলাদেশ
  • ভাল মুসলমান হওয়ার সহজ উপায়
  • বান্দরবানে তামাক চাষের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণা: এক হাজার একরের বেশি জমিতে তামাক চাষ না করতে আদালতের নির্দেশ

যেখানে জনপ্রশাসন, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং আদালতের সাথে নাগরিক এবং রাষ্ট্রের সম্পর্কের কোন সূত্রই আর কার্যকর নয়। একমাত্র এবং অবধারিত নীতি হল দলীয় আনুগত্য। আবার সেই দলীয় আনুগত্যের মাপকাঠিও হল একজন ব্যক্তির ইচ্ছা ও পছন্দ নির্ভর। শুরুতে এটা সাংবিধানিকভাবে সংসদীয় কাঠামোর মধ্যে তৈরি করে রাখা হয়েছিল। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদে কার্যত দলীয় প্রধানের ইচ্ছা অনিচ্ছার বাইরে যাবার কোন সুযোগই কোন নির্বাচিত সংসদ সদস্যের জন্য বরাদ্দ নাই। এটা ব্যক্তি বিশেষের স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। স্বভাবতই তারই আছর পড়েছে রাজনৈতিক দলগুলার অভ্যন্তরীণ চর্চায়। যা এখন মহামারির মত রাষ্ট্রের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সবটাই হয়ে পড়ছে দলীয় কার্যালয়ের সম্প্রসারিত অংশ। সংসদ থেকে সচিবালয়, সেনাবাহিনী কিম্বা আদালত কোনটাই আর এই স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার রাহুগ্রাস মুক্ত নয়। ফলে সামরিক বা বেসামরিক যে আলখাল্লা নিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতায় যারাই আসীন থাকুক না কেন চরিত্রের দিক থেকে তারা স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক।

বিদ্যমান সংবিধান বা রাষ্ট্রের এই চরিত্র অটুট রেখে নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র আমদানির কসরত বারংবার হয়েছে। কেউ কেউ এর ভেতরে নিদান দিচ্ছে রাজনৈতিক দলের সংস্কার, যার খোলস ছাড়া উদ্দেশ্যটা দেখা গিয়েছিল মাইনাস ফর্মুলা নিয়ে সেনাসমর্থিত সুশীল সমাজের দৌড়ঝাঁপে। সাময়িকভাবে যদিও তারা সে চেষ্টায় ক্ষান্তি দিয়েছে। তবে যেভাবে ও যে প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে, তাতে খুঁটি-দড়ি তারাই বেঁধে দিয়েছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সরকারি দলের জানার কথা তাদের ক্ষমতা কতটুকু বা তার উৎস কোথায়? সেটা যে সরাসরি জনগণ নয় বা গণক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত ভিত্তির জোরে তারা এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন নি সেই হুঁশ মনে হয় ক্ষমতার মাদকতায় তাদের কাছে বেমালুম হয়ে পড়ছে। ফলে একের পর এক এমন ধরনের কাজে হাত দিচ্ছে যা সামলানো এই সরকারের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে কি না সেই মূল্যায়ন তাদের আছে বলে মনে হয় না।

মুন সিনেমা হল বা জনপ্রিয় অর্থে পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় বর্তমান সরকার যেভাবে দলীয় এজেন্ডাভুক্ত করেছে তাতে সংকট শুধু ঘনীভূতই হবে না ঘোরতর বিষ্ফোরণের দিকে ঠেলে দেবে। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই সংবিধান প্রবর্তন নিয়ে যে সকল মৌলিক প্রশ্নসমূহ উঠেছিল তাও আবার সামনে চলে আসবে। কারণ, রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের ভিত্তিই ছিল সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি। রাষ্ট্রকে জনসমষ্টির সামগ্রিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্বের ভেতর দিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে গড়ে তোলার পথ অনুসরণ করা হয় নি। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আবির্ভাব ঘটা একটা রাষ্ট্রের সংবিধান এমন কায়দায় তৈরি করা হয়েছে যার সাথে জনগণের চেতনায় ইতিমধ্যে জাগ্রত ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির কোন ছাপ রাখতে দেওয়া হয় নি। পাকিস্তানের সংসদের জন্য নির্বাচিতরাই পরে নিজেদেরকে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা বা গণপরিষদ সদস্য বলে ঘোষণা করে বসে। সে সময় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে অনেক ব্যক্তি এবং দলকে রোষের শিকার হতে হয়েছে। প্রক্রিয়াগত এবং ভাবনাগত উভয় দিক থেকে সম্পূর্ণ দলবাজিতার ফসল হিশাবে বেরিয়ে আসে বাহাত্তর সালের সংবিধান। জনগণের দিক থেকে বাহাত্তর সালের সংবিধান কোন আদর্শ বা চেতনার পরিচয়বাহী নয় যাতে তাদের মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। বরং এটা আওয়ামী লীগের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির আদলে রচিত একটি দলিল, যেখানে তারা সংবিধানের ওপর দলের মালিকানা নিশ্চিত করেছে। ফলে, বাহাত্তর সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার নাম কোন আদর্শ বা চেতনার দিকে অগ্রসর হওয়া নয়। এটা স্রেফ আওয়ামী লীগের একচেটিয়া কায়েমের কৌশলগত রাজনৈতিক শ্লোগান। এমনকি, দল হিশাবে এখন আওয়ামী লীগ নিজেও বাহাত্তর সালের সংবিধানের পুরাটা অটুট রাখতে চায় না। সংবিধান এবং রাষ্ট্রকে নিজ দলের একছত্র প্রভাব কায়েমের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিশাবে ব্যবহার করা ছাড়া এর আর অন্য কোন প্রায়োগিক মূল্যও অবশিষ্ট নাই। হ্যাঁ, মুন সিনেমা হল মামলার রায়ের পরও।

যদি ব্যাপারটা এমন না হত তাহলে শুধু মাত্র আদালতের রায় বা নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠার কোন কারণ অন্তত আওয়ামী লীগের জন্য ঘটত না। সংবিধান বা উচ্চ আদালতের নির্দেশনার প্রতি তাদের অঙ্গীকার বা দায়বদ্ধতা প্রমাণের জন্য তারা মরিয়া হয়ে আদর্শিক চেতনা থেকে মাঠে নেমেছে এটা বিশ্বাস করার জন্য যথেষ্ট উন্মাদ হতে হয়। কিন্তু মৌলিক প্রশ্ন হল, সংবিধানের প্রশ্নে আদালতের একটি রায় কি করে একটা দলের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার বনে গেল? কিভাবে সেই সুযোগ সৃষ্টি হল? এটা কি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সংকীর্ণতা? নাকি খোদ রায়ের মধ্যে যেভাবে সংবিধানকে বিচার করা হয়েছে তার মধ্যেই নিহিত? রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিশাবে, সংবিধানের ব্যাখ্যা এবং রক্ষাকর্তা হিশাবে আদালতের ভূমিকা যদি রাজনৈতিক বিরোধ এবং বিভক্তির রসদ হয়ে ওঠে সেটা যে কোন সমাজের জন্যই বিপদের কারণ। প্রশ্নটা যদি আইনের শাসন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আদালতের একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনই হবে, তাহলে তা সকলের সাধারণ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার সেতুবন্ধ হয়ে উঠতে পারল না কেন? এটা কি রাজনীতির সমস্যা না কি আইন ও আদালতের নিরাপোষ দৃঢ়তার সাথে সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক? যদি এইসব সওয়ালের জবাব পেতে হয় তাহলে নাগরিকদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং আইনশাস্ত্র--উভয় দিক থেকে বিচার করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একইসাথে ক্ষমতা, আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্গত সম্পর্কের সকল বিমূর্ত অনুমান ত্যাগ করে বিশ্লেষণে নিয়োজিত হতে হবে।

তাহলেই আমরা বুঝতে পারব, আদালতের সীমা কোথায়। কোথায় আইনের সাথে বলপ্রয়োগ ও নতুন কর্তাসত্তা নির্মাণের সম্পর্ক রচিত হয়। আইনের আওতায় প্রাপ্ত ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আর ক্ষমতার নিজস্ব ন্যায্যতায় আইন তৈরির বৈধতা কিভাবে নিষ্পন্ন হয়। কেন ইতিহাসে বিপ্লবী ক্ষমতা মাত্রই তার পূর্বে অবস্থিত আইনি-ব্যবস্থার বাইরে এসে নিজেকে বিশুদ্ধ আইনি সত্তা হিশাবে অভিষিক্ত করে। কোন আইনই ক্ষমতা তৈরি করে না, শুধুমাত্র দায়িত্ব বা এখতিয়ার বণ্টন করে। ক্ষমতাই আইন তৈরির একক এবং একমাত্র নির্ধারক উপায়। আইনের অস্তিত্বের আগেই ক্ষমতাকে অস্তিত্ব লাভ করতে হয় বা ক্ষমতার নিজস্ব সাংগঠনিক কাঠামো আইনি ব্যবস্থা হিশাবে ক্রিয়াশীল থাকে। বাংলাদেশে যারা আইনের বাইরে থেকে ক্ষমতা নির্মাণ করেছে এবং যারা বিদ্যমান বা প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার আইনি আচ্ছাদনে সৃষ্ট এখতিয়ারে বিচার কার্য পরিচালনায় নিয়োজিত হয়েছে--উভয়ই এই সহজ সত্য ভুলে যায়। ফলত, জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের তোয়াক্কা না করে যে যার মত সংবিধান সংশোধনের দলবাজিতে ব্যস্ত থেকেছে।

সবকিছুই একটা চক্রে এসে শেষ হয়। বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে কামড়াকামড়ি অর্থাৎ যে যার দলীয় আদর্শের সিলছাপ্পড় মারার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে সংবিধান নামক চিজটাকে এতটাই ব্যবহার অযোগ্য করে তুলেছে যে, এখন সম্ভবত তার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এবার শেষ ধাপে, এতদিনকার রাবার স্ট্যাম্প সংসদকেও পাশ কাটিয়ে সংশোধনীর পুরা আয়োজন পুনর্মুদ্রণে শেষ করার তোড়জোড় চলছে। কিন্তু শেষটা এখানে হবে বলে মনে হয় না। কাটাছেঁড়া এই সংবিধানও আর টিকিয়ে রাখা যাবে না। কিন্তু সমস্যা হল দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এবং সামগ্রিক পরিস্থিতিতে গাঠনিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নেতৃত্ব দানে সক্ষম কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু নৈরাজ্যের পথই উন্মুক্ত হচ্ছে...।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।