পাক্ষিক চিন্তা ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ সংখ্যা
ক্ষুদ্রঋণ, পিকেএসএফ ও আমাদের উন্নয়ন দর্শন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে আলোচনা ছিল সরগরম। সেখানে সব কিছু ছাপিয়ে, ইউনূস তহবিল তছরুপ করেছেন বা নিয়ম ভঙ্গ করে টাকা সরিয়েছেন কি না এটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। ইউনূসের পক্ষে-বিপক্ষে সংবাদ মাধ্যম পাল্লা দিয়ে প্রচারে নামে। পুরা আলোচনাই ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক নীতিগত অবস্থানের জায়গা থেকে সরিয়ে অতিমাত্রায় ব্যক্তি ইউনূসের প্রতারণা ও বন্দনার সংকীর্ণ খাতে আটকে ফেলা হয়। এতে মূল প্রসঙ্গ থেকে আলোচনা সরে যায়। ড. ইউনূস নোরাডের কাছ থেকে পাওয়া গ্রামীণ ব্যাংকের অনুদান স্থানান্তরিত করেছেন। এ ব্যাপারে নোরাড আপত্তি তুলেছিল এবং নিজেরাই তা আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করেছে।[আরো পড়ুন..
- কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার ওপর কোম্পানির বিপরীতে জনগণের সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই
- মাশুল ছাড়াই চালু হল ট্রানজিট
- বাড়ি ‘উচ্ছেদ’র কৌশল ব্যবচ্ছেদ :ইনডিয়ার নিরাপত্তা ভাবনা এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিঘাংসা ও বিভাজন
- ক্যাটালিস্টের কৃষিপণ্য বাজারজাত করছে বাংলালিংক
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার উপযোগী স্থানীয় জাতের ধান
- বিএসএফের বাংলাদেশের ভূখণ্ড দখলে উদ্বেগ ও প্রতিবাদ]
এখানে তবু প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে যে, গ্রামীণ ব্যাংকের অনুদান ব্যয় হচ্ছে একটা ভিন্ন খাতে। দ্বিতীয়, গুরুতর প্রশ্নটা চলে আসে গ্রামীণ ব্যাংকের নিজস্ব স্বীকারোক্তি থেকেই। স্পষ্টতই তহবিল সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে নোরাডকে লিখিত চিঠিতে জানানো হয় সরকারকে কর না দেয়ার জন্য তারা এটা করেছে। এখানে পরিষ্কার যে, গ্রামীণ ব্যাংক এবং তাদের সহযোগী বিভিন্ন অনুদান ও ঋণদাতা সংস্থাগুলা বাংলাদেশের শুল্ক আইন হরহামেশা লঙ্ঘনের জন্য একত্রিত হয়ে কাজ করছে। নোরাড বা অন্য কারও কাছে শুল্ক তছরুফ করার যুক্তিকে অন্যায় কিছু মনে হয় নাই। রাষ্ট্রকে আয় বঞ্চিত করে নাগরিকদের ঠকানোর মাধ্যমে জনকল্যাণের কি মহান দর্শন তারা প্রয়োগ করছেন তাই জোরালোভাবে তুলে ধরা উচিত ছিল। কিন্তু প্রায় কোন সংবাদ মাধ্যমই এ দিকটাতে যেতে আগ্রহী না। কেউ এই পুরা ঘটনার সাথে নোরাড বা আন্তর্জাতিক এইসকল সংস্থার যোগসাজশকে প্রশ্ন করে নাই। যদিও এ ঘটনা অহরহ ঘটছে, শুধু গ্রামীণ ব্যাংক একা নয়, আরও অনেকেই একই তরিকা অবলম্বন করে থাকে। এদের মধ্যে অনেকেই সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হয়ে নাগরিকদের আয়কর দেবার জন্য সবক দেয়। যে তথ্যচিত্র নিয়ে এবারে আলোচনার সূত্রপাত সেটার মূল প্রতিপাদ্য--ক্ষুদ্রঋণের কুফল। অনুসন্ধানী সাংবাদিক টমের ‘কট ইন মাইক্রো ডেট’ প্রতিবেদনের মূল বক্তব্যই হল--দারিদ্র্যবিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের সাফল্যের সাফাইয়ের পক্ষে বাস্তবতার কোন মিল নাই। কিন্তু আমাদের মিডিয়া ক্ষুদ্রঋণের কুফলের এই দিকটি এড়িয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের টাকা স্থানান্তর নিয়ে বিতর্ক জুড়ে দিয়েছে। আবার এরই ফাঁকে মূলত হারিয়ে গেছে, গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়াও অপরাপর ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসার সাথে জড়িত বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম এবং ভয়াবহতার আলোচনা। সামগ্রিকভাবে, এই ধরনের একটি প্রসঙ্গের উছিলায় আমরা সবদিক থেকে মাইক্রোক্রেডিট নিয়ে একটি জাতীয় পর্যালোচনার সুযোগ তৈরি করতে পারতাম। মতামত তৈরিসহ নিয়ন্ত্রণমূলক পরামর্শগুলা অন্তত এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারত। অথচ পুরা বিষয়টাই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিদ্বেষ ও আক্রমণের রসদ বানানোতে শেষ হয়েছে।
বর্তমান সরকার বা খোদ প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন, ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তারা আসলে ‘গরিবের রক্ত চোষা’ তাহলে তো তাঁর অবশ্যই এই কার্যক্রম চলতে দেওয়া উচিত না। এখনই তা বন্ধ করা উচিত। নিদেনপক্ষে, একটা জাতীয় পর্যায়ের কমিটি করে নীতিমালা ঠিক করা পর্যন্ত স্থগিত রাখা উচিত। কিন্তু সে দিকে তারা যাবে না, সেটা নিশ্চিত। শুধু মাঠ ময়দান গরম করার মত কিছু জনতুষ্টিকর কথামালার রাজনীতি এটা। এর ভেতরে নীতগত কোন অবস্থান নাই।
মনে রাখতে হবে, গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম এবং দারিদ্র্য বিমোচন মডেল কিন্তু খোদ বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত নিজস্ব দর্শন। বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে এই আদলে সরকার পিকেএসএফ বা পল্লী কর্ম সংস্থান ফাউন্ডেশান গঠন করেছে। রাষ্ট্র যেখানে নিজেই এই কার্যক্রমকে বৈধতা দিয়ে আরও ব্যাপক এবং বিস্তৃত পরিসরে এই কর্মসূচি চালানোর বন্দোবস্ত করেছে, সেখানে শুধুমাত্র ব্যক্তি ইউনূসের দিকে আঙ্গুল তুলে লাভ নাই। ‘রক্ত চোষার’ এই বন্দোবস্তে সব সরকারই সমান মাত্রায় নীতিগতভাবে অংশীদার। এটাই বাংলাদেশের বিপুলাংশের গরিবী হটানোর একমাত্র দাওয়াই বলে গৃহীত। প্রধানমন্ত্রী দোষ দিচ্ছেন কাকে?
ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যবিমোচন করে না--বরং সামন্তসমাজের ভূমিদাসের মত একধরনের চক্রাকার ঋণদাসে পরিণত করে। দারিদ্র্যবিমোচনের এই পথ অনুসরণ করে এখনও চরম গরিবী হালে বসবাসকারী চল্লিশ শতাংশ মানুষের উন্নতির দিশা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আমরা টিকিয়ে রাখছি তার মধ্যেই গুটিকয় ধনী ও বিশাল অংশের গরিব হওয়ার প্রক্রিয়া নিহিত। এই অসহনীয় ব্যবস্থা বহাল রেখে গরিবদের ঋণ দিয়ে ও উচ্চহারে সুদ নিয়ে কিভাবে গরিবী মোচন হবে? সমাজের সম্পদ ব্যবহারের সুবিধা বঞ্চিত অংশের জন্য এই অস্বাভাবিক ও দুর্বিসহ পেষাইকলের মডেল জারি রাখছি আমরা সদলবলে। আমরা আমাদের নিজস্ব স্বাস্থ্য শিক্ষা কৃষি ও উৎপাদন ব্যবস্থার প্রতি অমনোযোগী থেকে দাবি করেছি-- গরিবকে ঋণ দিয়ে দারিদ্র্যমোচন হবে! এই মারাত্মক ভ্রান্ত নীতির ফলে আমাদের আরও ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে। এ অবস্থার আশু বদল না ঘটলে, মধ্যম আয়ের দেশ কিম্বা দুইহাজার তিরিশ সালের মধ্যে বিশ্বের তিরিশতম অর্থনৈতিক শক্তির অবস্থানে যাবার সব আশাই দূরাশা থেকে যাবে।