মহামান্য আদালত, বাংলা বলুন, বাংলায় রায় লিখুন


আদালতে বাংলা ভাষা পুরাপুরি প্রবর্তন না হবার অর্থ সাধারন ভাবে আদালত, তবে বিশেষ ভাবে উচ্চ আদালত সংবিধান মানেন না এবং নিজেদের সংবিধান ও প্রজাতন্ত্রের অধীন গণ্য করেন না। উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে এই আভিযোগ গুরুতর, হাল্কা ভাবে নেবার কোন উপায় নাই।  সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ লিখিত থাকবার পরেও সংবিধান আদালতের জন্য কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। উচ্চ আদালতে বাংলার প্রচলন হয় নি। আদালত সংবিধান উপেক্ষা, অস্বীকার বা ভঙ্গ করতে পারে এই দৃষ্টান্ত বিচারব্যবস্থা ও রাষ্ট্র উভয়ের জন্য বিপজ্জনক। এর জন্য উচ্চ আদালতকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় নি বা হয় না। এই বাস্তবতা আমরা কী ধরণের রাষ্ট্র তৈরি করেছি তার একটি ভাল লক্ষণ।

দুর্ভাগ্য মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার এতো বছর পরেও আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় নি, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আমাদের আবেগের ফাঁপানো দিকটা এখানে হাতেনাতে ধরা পড়ে। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বাংলা ভাষার প্রতি যদি আমরা আদৌ কোন শ্রদ্ধা জানাতে চাই তাহলে আমাদের প্রথম কাজ হবে সকলে মিলে উচ্চ আদালতের কাছে সংক্ষুব্ধ নাগরিক হিসাবে এই ফরিয়াদটুকু জানানো যে উচ্চ আদালতের ভাষা বাংলা না হবার কারনে মহামান্য আদালত সুষ্ঠ ও স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া আমল করছেন না, এই উদ্বেগ আশংকাজনক ভাবে বাড়ছে এবং আদালতে বাংলাভাষা চর্চা উপেক্ষিত হবার কারনে নাগরিকদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাচ্ছে কিনা সেটা সংশয়ের মধ্যে পতিত হচ্ছে। এর আশু বিহিত হওয়া দরকার। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলে যে ভাষায় অভিযুক্ত অভিযোগ বোঝে সেই ভাষায় অভিযোগ ব্যাখ্যা ও বর্ণনা করা, যে আইনে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেই আইন সহজ ভাষায় জানানো ও বোঝানো নিশ্চিত করা, আদালতের সওয়াল জবাব সাক্ষি প্রমাণ বাদি ও বিবাদী উভয়ে যেন বুঝতে পারে সেই ভাষায় করা ও বিচারের রায় সাংবিধানিক ভাবে গৃহীত রাষ্ট্রভাষায় যথাসম্ভব বোধ্য ভাবে দেওয়া জরুরি। দেশীয় আদালতে সুষ্ঠ ও স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবার জন্য যেমন এসবের প্রয়োজন, তেমনি একই ভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের রীতিনীতি মান্য করে চলার জন্যও দরকার। কারন কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলে বা তাকে শাস্তি দিতে হলে অভিযুক্তকে অবশ্যই বুঝতে হবে অভিযোগটা কিসের? আর শাস্তি তাকে পেতে হবে কেন। এটা মানবাধিকারের অন্তর্গত। অতএব আদালতের ভাষা যদি বাংলা না হয়ে ইংরেজি হয় কিম্বা আদালত যদি সাধারণের বোধগম্য ভাষা চর্চা না করে তাহলে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠ বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা অসম্ভব। বিচারব্যবস্থার এই প্রকট অভাব অবিলম্বে নিরসন করা জরুরি। আদালতের সঙ্গে যুক্ত অল্প কিছু ব্যাক্তি যদি আদালতের ভাষার নামে অবস্কিউর, অস্পষ্ট, প্রাচিন, ঔপনিবেশিক, অপরিচ্ছন্ন এবং সর্বোপরি গতিশীল সমাজের জীবন্ত ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন পরদেশি ল্যাঙ্গুয়েজ চর্চা করে তাহলে ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র উভয়ই মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে।

বিষয়টিকে আইন ও বিচারের দিক থেকে বুঝতে হবে। রাষ্ট্রভাষা চেয়ে বাংলাদেশের জনগণ এক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় স্থাপন করেছে এবং যার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ধরা যাক সেগুলো আমাদের জাতীয় গৌরবের দিক, বিচারব্যবস্থার নিজস্ব তাগিদের বাইরের আবেগ। এটাও ধরা যাক সংবিধান যখন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা বলে ঘোষণা দেয় সেটাও জাতীয় আবেগেরই প্রক্ষেপ মাত্র। সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদের বিধান সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না দেখে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ (১৯৮৭ সনের ২নং আইন) জারী করা হয়েছিল। তর্কের খাতিরে ধরা যাক এই আইনটিও ভাষার জন্য আমাদের ভালবাসা, আত্মত্যাগ, আবেগ ও উদ্বেগের আরেক প্রকার অভিপ্রকাশ। ঠিক আছে।

কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা কিম্বা কোন জাতীয়তাবোধে্র প্রতি তাড়িত হয়ে বাংলাভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা বা না করা আদালতের দিক থেকে বাহ্যিক ব্যাপার। এগুলো বিচার ব্যবস্থার বাইরের দিক। বাংলাভাষার জন্য আমরা আন্দোলন সংগ্রাম না করলেও আদালতকে তা করতে হোত। সবার জন্য বোধগম্য ভাষায় আদালতকে বৈচারিক কর্মকাণ্ড নির্বাহ করতেই হবে। কেন করতে হবে?

ঠিক। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন করতে হবে। করতে হবে আদালতকে আদালত হবার জন্যই, নইলে আদালত বড়জোর এজলাসে বসা কিছু ব্যাক্তির হুকুম তামিল করবার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হয়ে টিকে থাকবে, কিন্তু তার নিজের মর্ম ও মহিমা নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। আদালত যে সিদ্ধান্ত দেয় এবং যেভাবে দেয় তা বলবৎ করা যায় বলেই সেটা রায়, বলবৎ না করা গেলে সেটা কথার কথা, বড় জোর পালিত না হওয়া নির্দেশ। আদালতের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ও রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের ভূমিকার কারনে বিচারক্র নির্দেশ বলবৎ হবার মধ্য দিয়ে আদালতের ‘রায়’ বলে গণ্য হয়। নিছক এজলাসে বসা কোন ব্যাক্তি বা ব্যাক্তিবর্গের সিদ্ধান্ত মাত্র হয়ে থাকে না। এমনও হতে পারে সমাজে এজলাসে বসা মানুষগুলো নিন্দিত বা সমালোচিত। কোন মামলা নিয়ে আদালতের বাইরে সমাজের যে কোন ব্যাক্তি সিদ্ধান্ত দিতেই পারে, যিনি সিদ্ধান্ত দেন আদালতের হাকিমের চেয়ে তিনি অনেক বড় পণ্ডিত হতে পারেন, কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্ত আদালতের ‘রায়’ হয় না। আদালতের সিদ্ধান্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য বলে – অর্থাৎ রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ তা কার্যকর করে বলেই আদালতের সিদ্ধান্ত শুধু সিদ্ধান্ত কিম্বা আক্ষরিক অর্থে আর ‘জাজমেন্ট’ থাকে না। আদালতের ‘জাজমেন্ট’ বা‘রায়’ হয়। ক্ষমতার সঙ্গে আইন ও আদালতের এই সম্পর্ক আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অচ্ছেদ্য ও অবিচ্ছিন্ন।

কিন্তু সমাজ শুধু বলপ্রয়োগ বা ক্ষমতা দিয়ে পরিচালিত হয় না। ক্ষমতা সমাজ থেকেই তৈরি হয় এবং সমাজ সেই ক্ষমতাকে ন্যায্যতা না দিলে তা টিকে থাকতে পারে না। তাহলে শুধু আদালতের রায় বলবৎ করবার চরিত্র দিয়ে আইন ও আদালতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ভূমিকা বোঝা যায় না।

সেটা বুঝব কি করে? আমাদের বুঝতে হবে আদালত শুধু একটি আইনী বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নয়, একই সঙ্গে সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক দ্বন্দ্ব মীমাংসারও ক্ষেত্র। বিশেষত এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে ব্যাক্তি ও সমষ্টির দ্বন্দ্ব ও বিরোধের সামাজিক মীমাংসা ও সেই মীমাংসাকে ন্যায্য বলে সমাজের উপলব্ধি করবারও ক্ষেত্র। আদালতের সিদ্ধান্ত বা মীমাংসা সমাজ শুধু আদালত রায় দিয়েছে বলে মানে না, একই সঙ্গে সেই সমস্যার সমাধান সমাজের নীতি, নৈতিকতা, বিবেকবুদ্ধি বা বিবেচনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হয়। বিদ্যমান আইনের কারনে আদালত যদি সংবিধান বা আইনের দ্বারা নিজেকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পতিত হয়েছে মনে করে, তাহলে সেই সীমা চিহ্নিত করা এবং নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তার দাবিও তুলতে পারে। আইনী পরিমণ্ডলে সমাজের চিন্তা চেতনা বিচার বিবেচনায় পরিবর্তন ঘটে, সেখানে বিবর্তন আছে। ক্ষেত্র বিশেষে আদালতের প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠার উদাহরণ থাকলেও সেই বিবর্তনেও আদালত ভুমিকা রাখে।

ব্যাক্তি সামাজিক। তাই সমাজের পক্ষে আদালত ব্যাক্তিকে শাস্তি দিয়ে একই সঙ্গে সমাজ ও ব্যাক্তির স্বার্থের সীমা সমাজকে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু আদালত নিজে সমাজের সীমা লংঘন করলে সেটা সমাজের বিপদের কারন হয়। সমাজের বিচার বুদ্ধি ও বিবেকের বিপরীতে দাঁড়ালে আদালতকে নিন্দা ও বিরোধিতার মুখোমুখি হয়। সমাজের সপ্রাণ বিবেক ও সজ্ঞান বিচারবুদ্ধির বাইরে আদালত যদি এমন কোন রায় দেয় যা সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষতির কারন হতে পারে বলে সমাজ মনে করে তাহলে বিচারক ও আদালত নিন্দিত হয়। সম্প্রতি কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেওয়া সহ বেশ কয়েকটি রায় বিতর্ক তৈরি করেছে।এর পরিণতিতে নির্বাচন কেন্দ্র করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় নাগরিকদের মৃত্যু আদালতের ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন করবার সুযোগ করে দেওয়াই বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতার কারন – এই অভিযোগ এড়ানো আদালতের পক্ষে মুশকিল। এই সব ক্ষেত্রে সমাজে আদালতের জবাবদিহিতার কোন প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ না থাকলেও কোন না কোন ভাবে আদালত কিম্বা বিচারককে সমাজের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। সমাজের নীতিনৈতিকতা ও সামষ্টিক প্রজ্ঞার বিপরীতে সমাজ আদালত রায় দিয়েছে বলেই সেই রায় সঠিক বলে মেনে নেয় না। তার অভিপ্রকাশ ঘটে সমাজে নানান সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে। আদালত সমাজকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে। এই সম্ভাবনা থাকে বলেই সমাজের নীতিনৈতিকতা ও সামষ্টিক প্রজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গতি রচনার প্রয়োজনীয়তা থাকে। বলা বাহুল্য, সামাজিক নীতিনৈতিকতা কিম্বা বাস্তব বা ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে জাত প্রজ্ঞা সংবিধান বা আইন প্রণয়ণে ভূমিকা রাখে, কিন্তু তারা আইনের অন্তর্গত হয়ে থাকে না। আইনী বৃত্তের বাইরে আরও বৃহৎ সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তা সবসময়ই সক্রিয় থাকে। এই সপ্রাণ পরিমণ্ডলের সঙ্গে আদালতকে আদালতের পরিসরেই সম্পর্কিত থাকবার দরকার হয়।

ওপরের কথাগুলো যদি আমরা বুঝে থাকি তাহলে এই সত্য বোঝাও কঠিন নয় যে আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলন না করার কারনে আদালত শুধু সংবিধানের তিন অনুচ্ছেদ লংঘন কিম্বা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন কার্যকর করা থেকে বিরত থাকছে না, বরং একই সঙ্গে সমাজের নীতি নৈতিকতা ও সামষ্টিক প্রজ্ঞা চর্চার সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রের অবক্ষয় ঘটিয়ে চলেছে। বাংলাভাষায় সহজবোধ্য ভাবে আদালতের কর্মকাণ্ড পরিচালনা না করার অর্থ শুধু উচ্চ আদালতকে সংবিধান বা আইনের বাইরে রাখা নয়, একই সঙ্গে সমাজের বাইরে রাখাও বটে। কারন সমাজ ভাষার মধ্যেই বাস করে, ভাষার মধ্যেই হাজির থাকে ও ভাষার মধ্যেই সমাজের চিন্তা, প্রজ্ঞা ও বিবেকের বিকাশ ঘটে। উচ্চ আদালতে ইংরেজির চর্চা সংবিধান বিরোধী, আইন বিরোধী এবং ওপরের যুক্তিতে একই সঙ্গে সমাজ বিরোধীও বটে। বাংলাভাষায় সমাজের চিন্তাচেতনার বিকাশে আদালত সহায়ক নয়, প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে। – যে বিকাশের সঙ্গে সামাজিক শৃংখলা এবং স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত শাসনব্যবস্থা জারি রাখার প্রশ্ন সরাসরি জড়িত। সর্বোপরি যেখানে সুষ্ঠ চিন্তা ও নীতিনৈতিকতার পর্যালোচনা এবং জনগণের সহজবোধ্য ভাষায় সমাজে সেটা সম্প্রচার করা জরুরী আদালত তাকে সজ্ঞানে উপেক্ষা ও অবহেলা করছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।

আদালতকে প্রশ্ন করতে হবে সংবিধান, আইন, আদালত ও বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে ভাষার সম্পর্কটা কি? এটা কি বাহ্যিক? নাকি আন্তরিক? স্বচ্ছ ও সুষ্ঠ বিচার মাতৃভাষা অর্থাৎ সাধারণের বোধগম্য ভাষায় পরিচালনা ছাড়া নিশ্চিত করা অসম্ভব, এটা বৈচারিক বিধান আকারে মান্য গণ্য করলেও এর মর্ম কতো গভীর সেটা আমরা ওপরের আলোচনা থেকে বুঝতে পারি। আইনচর্চার সঙ্গে ভাষাচর্চার এবং ভাষাচর্চার মধ্য দিয়ে পুরা সমাজের সামষ্টিক চৈতন্য ও প্রজ্ঞা চর্চার ক্ষেত্রে আদালত যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে সমাজের অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।

কিন্তু ভাষার সঙ্গে উচ্চ আদালতের আরেকটি গভীর সম্পর্ক আছে সেই দিকটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। সংবিধান ও আইনের ভাষ্য বা ব্যাখ্যার ওপর আদালত – বিশেষ ভাবে উচ্চ আদালতের একচ্ছত্র এখতিয়ার মেনে নেওয়া হয়। মেনে নেবার রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় এবং আইনী কারন রয়েছে। কারন ভাষার অর্থ বিবিধ। অর্থাৎ সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদ, বাক্য বা শব্দের নানান অর্থ হতে পারে। যদি অর্থ বিবিধ হয় তাহলে বিচার যেমন অসম্ভব একই সঙ্গে বিবিধার্থ গুরুতর রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট তৈরি করতে পারে। এ কারণে সংবিধান বা আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ – এমনকি কোন শব্দ বা বাক্যের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতেরই একমাত্র এখতিয়ার। অন্য কোন ব্যাখ্যা রাষ্ট্রের কাছে এবং সমাজের দিক থেকে বলবৎ যোগ্য নয়, গ্রহণযোগ্যও নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফাউন্ডিং ফাদার’ আলেকজান্ডার হ্যামিল্টনের একটি কথা মনে পড়ছে। তিনি লিখেছিলেন সংবিধান ব্যাখ্যার একচেটিয়া এখতিয়ার চর্চা ও জুডিসিয়াল রিভিউর মধ্য দিয়ে আদালত এই সত্যই নিশ্চিত করে যে লিখিত সংবিধানের মধ্য দিয়ে জনগণ যে ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করে সেটা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ণী সংস্থা – অর্থাৎ সিনেট বা জাতীয় সংসদের চেয়েও উর্ধে। অর্থাৎ জাতীয় সংসদও এই ব্যাখ্যা মানতে বাধ্য। এটা ‘সুপ্রিম’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ আদালতকে ‘সুপ্রিম কোর্ট’ বলার গভীর অর্থ এখানেই নিহিত। সুপ্রিম কোর্ট ধারণাটি মার্কিন। উচ্চ আদালত ভাষা চর্চার মাধ্যমে সংবিধানের যে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, যার এখতিয়ার একান্তই সুপ্রিম কোর্টের – সেই চর্চা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যাখ্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আর সে কারণেই রাষ্ট্রের সকল অঙ্গসহ প্রত্যেকে তা মানতে বাধ্য। ভাষার বিবিধার্থ এখানে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কারন সংবিধানকে সাহিত্যের বই হিসাবে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করা গেলেও সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। সুপ্রিম। হ্যামিল্টন বলছেন আইন প্রণয়নী সংস্থা বা জাতীয় সংসদ জনগণের সাময়িক বা জনগণের খণ্ডিত অংশের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু সংবিধানের মধ্য দিয়ে যে সামষ্টিক ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত হয় তা ব্যাখ্যার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের। এই দিক থেকে সংসদ উচ্চ আদালতের অধীন, তার উর্ধে নয়।

বলাবাহুল্য, জনগণ ইংরেজিতে কথা বলে না। ভাগ্য ভালো ইংরেজিতে লিখলেও আমাদের সংবিধান বাংলা অনুবাদকেই প্রাধান্য দিয়েছে, ইংরেজিকে নয়। সুপ্রিম কোর্ট বাংলা ভাষায় রায় না লিখলে তাদের রায় জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করে – এটা দাবি করা যায় না। মহামান্য আদলতকে আমার প্রশ্ন, সুপ্রিম কোর্টের ইংরেজি রায় জনগণ মানতে বাধ্য কিনা।

তাহলে আমরা বুঝতে পারছি, উচ্চ আদালতসহ আদালতের সকল স্তরে বাংলাভাষা প্রচলনের দাবি মোটেও হাল্কা কোন দাবি নয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করবার দাবির সঙ্গে কিম্বা সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা বলা কিম্বা ১৯৮৭ সালের সকল স্তরে বাংলাভাষা প্রচলের আইনের চেয়েও অধিক গুরুতর প্রশ্ন। বিচার ব্যবস্থা ও আদালতের নিজের দিক থেকে, নিজের জন্য। ইংরেজি ভাষা জানে না বলে সংবিধান, আইন, অভিযোগ ও সওয়াল জবাব যদি বাদি ও বিবাদি বুঝতে না পারে তাহলে উভয়কেই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়। কেউ কোন অপরাধে অভিযুক্ত হলে কি কারনে এবং কোন আইনে অভিযুক্ত হয়েছেন সেটা অভিযুক্তের কাছে বোধ্য ভাষায় বুঝিয়ে বলা আদালতের দায়। ইংরেজিতে লেখা আদালতের রায় জনগণ যদি পড়তে ও বুঝতে না পারে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের রক্ষাকর্তা হিসাবে আদালতের ভূমিকা জনগণ বিচার করবে কিভাবে?

উচ্চ আদালতের কাছে এই প্রশ্ন আমি অভিযোগ হিসাবে পেশ করতে চাই না, কারন ওর মধ্যে আদালতের ভাষা বাংলা করবার ব্যবহারিক ও বাস্তব জটিলতা অস্বীকার করে তাকে নিছকই একটি সাংবিধানিক অনুচ্ছেদ ও আইন পালনের বিষয়ে পরিণত করা হয়। এটা আমার ইচ্ছা নয়। শুধু আইন দিয়ে আদালত চলে না, জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে সম্পর্ক চর্চার ক্ষেত্র পরিচ্ছন্ন রাখা চাই। উচ্চ আদালত তাকে আমলে নিচ্ছেন কিনা সেটাই নাগরিক হিসাবে আমার জানবার বিষয়। ফলে একে আমি অভিযোগ হিসাবে নয়, ফরিয়াদ হিসাবে হাজির করতে চাই। ফরিয়াদ কথাটিকে আমরা বাংলা ভাষায় যেভাবে আত্মস্থ করেছি তার মাধুর্য্য বিপুল এবং তার আইনী তাৎপর্যও অসাধারন। আদালতের কাছে ফরিয়াদ জানাবার মানে আদালতকে অভিযুক্ত করা নয়, কিম্বা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে বিচার চাওয়াও নয়, সেটা হোল নাগরিক হিসাবে নিজের সংক্ষুব্ধি এমন ভাবে প্রকাশ করা যাতে আদালত বুঝতে পারে এই ফরিয়াদ একজন ব্যাক্তির নয়, বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের। একই সঙ্গে, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – আদালত আসলেই বাংলাদেশের বাংলাভাষী নাগরিকদের আদালত কিনা তার পরিক্ষার ক্ষেত্রও বটে।

উচ্চ আদালতের ইংরাজি রায় অসাংবিধানিক, ১৯৮৭ সালের বিধান অনুযায়ী বে-আইনি – এটা আদালত বোঝেন না, এটা হতে পারে না। ইংরেজি চর্চার পক্ষে আদালতের একটি রায়ও আছে। যা আদালতের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষুন্ন করে বলে এখানে তুলতে চাই না। কিন্তু আশা করি, উচ্চ আদালত দ্রুত একটি জাতীয় ভাষা কমিটি গঠন করবেন এবং এই ক্ষেত্রে জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবেন। এবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে নতুন প্রধান বিচারপতির কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

আমার এ লেখাটিকে বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের পক্ষে একুশের শহিদদের স্মৃতি ধারণ করে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও আইনী মর্মের সুরক্ষার নিশ্চিত করবার আকাংখা হিসাবে উচ্চ আদালত পাঠ করবেন, এটাই আমার মিনতি।

২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, ৮ ফাল্গুন ১৪২১। শ্যামলী। ঢাকা


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।