আদালতের মর্যাদা রক্ষা করুন
কর্তৃত্ব থাকলেই ব্যবহার ঠিক না
‘আদালত অবমাননা সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ ও আদালতের রায়ে ‘আদালতের কর্তৃত্ব’ (authority) নিয়ে একটা কথা উঠেছে। এর অর্থ কী আসলে? এই প্রসঙ্গে ‘আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে একটি লেখা লিখেছিলাম। চিন্তা ওয়েবে তা খানিক সংস্কার করে তোলা আছে।
সেখানে দেখিয়েছিলাম জনগণকে বাদ দিয়ে কিম্বা জনগণের উর্ধে ‘আদালতের কর্তৃত্ব’ নামক বিমূর্ত বা ঐশ্বরিক কোন ক্ষমতা নাই। আদালত জনগণের অভিপ্রায়ের অধীন আর সেই অভিপ্রায়ের মূর্ত রূপ হচ্ছে সংবিধান। এই যুক্তিতে আদালত জনগণের অধীন কথাটার ব্যবহারিক অর্থ হচ্ছে আদালত সংবিধানের অধীন। সংবিধানে দেওয়া কর্তৃত্বের বাইরে আদালতে এমন কোন ক্ষমতা নাই যার দ্বারা তারা কোন নাগরিককে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত ও শাস্তি দিতে পারে। এর আগাম অনুমান হচ্ছে জনগণের অভিপ্রায়ের দলিল হিসাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি দেশে সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশে এই ধরণের সংবিধান রয়েছে কিনা সেটা ভিন্ন বিতর্ক। না থাকলেও বাংলাদেশ যেহেতু ইংরেজদের কমন ল অনুসরণ করে সে কারণে ঐতিহ্যগত যে অধিকার জনগণের ভোগ করবার কথা সেই অধিকার সংবিধানে থাকুক বা না থাকুক সেই অধিকার থেকে আদালত জনগণকে বঞ্চিত করতে পারে না।
তাছাড়া বাংলাদেশ মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘোষণা, সনদ ও চুক্তিতে স্বাক্ষর করছে। যার ফলে বাংলাদেশ মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের অধীন। আইন এবং আদালত আন্তর্জাতিক আইনে প্রদত্ত মানবাধিকার হরণ করতে পারে না। সে রকম আশংকা তৈরি হলে তা আন্তর্জাতিক 'স্টান্ডার্ড'-এর সঙ্গে সঙ্গিপূর্ণ নয় বলে অভিযোগ ওঠে। বলা বাহুল্য মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানবাধিকারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
জনগণ রাষ্ট্রের অন্য দুটি অঙ্গ নির্বাহী ও আইন প্রণয়ণী অঙ্গকেও শাসন করবার ও আইন প্রণয়ণের কর্তৃত্ব দেয়। সেই দুটো কর্তৃত্ব ভিন্ন। তাদের চরিত্র আলাদা। আইন কখনই হাওয়ার ওপর ভেসে বেড়াতে পারে না, কারন এতে এর বহুবিধ ব্যাখ্যার সুযোগ থাকে যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। কর্তৃত্ব কথাটাও আইনের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট বিষয়। রাষ্ট্রের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গের কর্তৃত্বও ভিন্ন। রাষ্ট্রের কোন অঙ্গই তাকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতে পারে না। সেই দিক থেকে আদালতের কর্তৃত্বও সীমাহীন বা অবারিত নয়। সেটাও সুনির্দিষ্ট।
সুনির্দিষ্ট ভাবে বিচার করলে আদালতের কর্তৃত্ব বিচারের। এটা আমরা কাণ্ডজ্ঞানেই বুঝি। নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে আদালত বিচার করে। কিন্তু এই কর্তৃত্ব আদালতের বাইরের দিক। তার মর্মের দিকটা আরও সুনির্দিষ্ট। আদালতকে ন্যায়বিচার বা ইনসাফ নিশ্চিত করতে হবে। সেটা নিশ্চিত করার দিক থেকে আদালতের কর্তৃত্ব স্রেফ বিচার করবার কর্তৃত্ব নয় – সুনির্দিষ্ট ভাবে প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুরক্ষা করবার কর্তৃত্ব। অর্থাৎ কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা ও বিচার করতে হলে আদালতকেই নিশ্চিত করতে হবে যে অভিযুক্তের নাগরিক ও মানবিক অধিকার বিচার প্রক্রিয়ার কোন স্তরে আদৌ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কিনা। এটা আদালতের বিশেষ একটি ক্ষমতা।
তাহলে নাগরিক ও মানবিক অধিকার সুরক্ষার দায় আছে বলেই আদালতের ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব আদালতকে জনগণের সঙ্গে এক গভীর নৈতিক বন্ধনে আবদ্ধ রাখবার কথা। এখানেই এই কর্তৃত্বের মহিমা, যা বৈচারিক ক্ষমতা ও নৈতিকতার মধ্যে এক অদৃশ্য সন্ধিসূত্র নির্মাণ করে রাখে যা রাষ্ট্রের অন্য দুটি অঙ্গ থেকে একদমই আলাদা। এটা পরিষ্কার যে সেই কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার মর্যাদা রাখবার দায়িত্ব একান্তই আদালতের। আমরা নাগরিকরা চাই বাংলাদেশের আদালত নিজেদের মহিমা উপলব্ধি করুক, তাদের ক্ষমতাকে নয়। সাম্প্রতিক আদালত অবমাননা মামলার রায়ে আদালত বারবার ‘আদালতের কর্তৃত্ব’ (authority), ‘আদালতের মর্যাদা’(dignity), রাজকীয়তা (majesty) ইত্যাদি শব্দ বা শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছে। নিজেদের কর্তৃত্ব সম্পর্কে আদালতের এই অতিমাত্রার আত্মসচেতনতা ন্যায়বিচার ও নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষার জন্য প্রতিবন্ধক হতে পারে। তবে যে শব্দ বা শব্দবন্ধই ব্যবহার করুক, আদালত মূলত শব্দগুলো আদালতের নিরংকুশ কর্তৃত্ব অর্থেই ব্যবহার করেছে। যেমন, কর্তৃত্বের মর্যাদা, কর্তৃত্বের রাজকীয়তা (majesty), ইত্যাদি। ম্যাজেস্টি বা রাজকীয়তার ধারণার মধ্যে সামন্ত অনুরণন থাকলেও আমাদের প্রত্যাশা আদালত নিজেদের সামন্ত শক্তির প্রতিনিধি হিসাবে রাজকীয়তা বোঝান নি, কর্তৃত্বের মহিমাকেই বুঝিয়েছেন। কর্তৃত্ব কথাটির মর্ম আমাদের সকলকেই আসলে বুঝতে হবে।
‘আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ লেখাটিতে লর্ড ডেনিং-এর একটি উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম। এটা দেবার কারণ ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ যেসব নাগরিকদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ তুলেছিলেন সওয়াল জবাবে অভিযুক্তদের অনেকে তাঁদের লিখিত বক্তব্যে ডেনিং-এর উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করেছেন। উদ্ধৃতিটি হচ্ছে: “আমি সাফ সাফ বলে রাখতে চাই, আমাদের নিজেদের মর্যাদা উর্ধে তুলে ধরবার উপায় হিসাবে আমরা কখনই আমাদের এই বৈচারিক এখতিয়ার ব্যবহার করবো না। এমনকি যারা আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলে তাদের শাস্তি দেবার জন্যও কখনই না। সমালোচনাকে আমরা ভয় পাবোনা, এমনকি এতে ক্ষুব্ধও হবো না। কারণ এর চেয়েও আরও অনেক অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায় আমাদের রয়ে গেছে, আর সেটা কম কিছু নয় তো বটেই বরং খোদ মত প্রকাশের স্বাধীনতা”।
লর্ড ডেনিং ‘আদালত অবমাননা’ প্রসঙ্গে বিচারকদের অবশ্য পালনীয় নীতির কথা বলছেন। বিচারকরা কখনই তাঁদের ক্ষমতাকে নিজেদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করবেন না। কারণ তার চেয়েও আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়ে গিয়েছে, বিচারকের মর্যাদার চেয়ে তা কোন অংশেই কম নয়। আর সেটা হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। কর্তৃত্বের যে মর্মের কথা বলছিলাম ডেনিং সেই মর্মই উর্ধে তুলে ধরেছিলেন। বিচারকরা তাদের মর্যাদার কথা ভাববার আগে নাগরিকদের নাগরিক ও মানবিক অধিকারের কথা ভাববেন। সাধে তিনি স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ বিচারকের স্বীকৃতি পাননি।
অভিযুক্ত নাগরিকরাও চেয়েছিলেন আদালত যেন বিচারকদের মর্যাদা রক্ষার অজুহাতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে না দাঁড়ায়। ডেভিড বার্গম্যানকে আদালত অবমাননার অপরাধে যে রায় ও শাস্তি দেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে নাগরিকদের উদ্বেগ প্রকাশে বিচারকরা ক্ষুব্ধ হতে পারেন। কিম্বা বিচারকরা ভাবতেই পারেন তাদের মর্যাদা হানি হয়েছে, কিন্তু তারপরও নাগরিকদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনবার ক্ষমতা প্রয়োগ বিচারকদের নীতির আলোকে সঠিক হয়েছে কি? বিচারকরা এই দিকটি নিয়ে আরও বড় পরিসরে যতো ভাববেন ততোই বিচার বিভাগের মর্যাদা ও মহিমার মর্ম উপলব্ধি সহজ হবে। নাগরিকদেরও তাঁরা আদালতের মর্যাদা রক্ষার বিষয়টির গুরুত্ব বোঝাতে পারবেন। বাংলাদেশের ৪৯ জন নাগরিকের বিবৃতি অস্বস্তির হলেও তার ব্যাখ্যা চেয়ে ব্যখ্যা পাবার পর সৎ বিশ্বাস ও ইতিবাচক অভিপ্রায় হিসাবে সেই ব্যাখ্যা আদালত গণ্য করলে আদালতের মর্যাদা অনেক বাড়তো । এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই।
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভক্তি
আদালতের কর্তৃত্বের কথাটি আবার তুলছি এ কারণে যে ওপরের বৈচারিক যুক্তি ছাড়াও আদালতে – বিশেষত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে শাস্তি দেওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের আবেগ ও সংবেদনা জড়িত, সেই দিকটিকেও বিবেচনার দাবি রাখে। জনগোষ্ঠী হিসাবে আমরা আবেগী এবং অনেক সময় যুক্তিতর্ক, বিচার বিবেচনা, নীতি আদর্শ ইত্যাদির আমরা বিশেষ ধার ধারি না। কিন্তু আদালতকে সেন্টিমেন্টাল হলে চলে না। এই বাস্তবতায় উচিত কাজ হচ্ছ আরও বেশী সতর্ক থাকা। আদালত অবমাননার মামলা আদালতে যেভাবে পরিচালিত হয়েছে এবং যে রায় ও শাস্তি আদালত দিয়েছেন তাতে মনে হচ্ছে সমাজে এর ফলে বেশ বড়সড় একটা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই বোঝা ঘাড়ে তুলে নেওয়া আদালতের জন্য এখন একটি বাড়তি কাজ হয়ে উঠল। এর প্রমাণ হচ্ছে ৯২ জন মুক্তিযোদ্ধার ক্ষোভ। ট্রাইবুনালের রায়ে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রথমে ৫১ জন বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে পরে আরও মুক্তিযোদ্ধারা যুক্ত হন। তাঁরা একটি বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিদাতারা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। অর্থাৎ তাঁরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেছেন। এঁদের অনেকেই বীর বিক্রম, বীর প্রতীক ও যুদ্ধাহত। মুক্তিযোদ্ধারা যথেষ্ট আবেগের জায়গা থেকে বিষয়টিকে দেখেছেন। তাঁরা জীবন বাজি রেখে এই দেশের জন্য লড়েছেন। তাঁদের আবেগের মূল্য অপরিসীম। আশা করি, ন্যায় বিচার ও আদালতের মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে এই বিতর্ক আমরা ইতিবাচক ভাবে সমাপ্ত করে সামনে এগিয়ে যেতে পারব।
মুক্তিযোদ্ধারা বলেছেন, “একজন মুক্তিযোদ্ধা খুন করলে তার ফাঁসি হতে পারে, চুরি করলে তার জেল-জরিমানা হতে পারে কিন্তু বাকস্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার পক্ষে বিবৃতি দেওয়ায় ডাঃ জাফরুল্লাহর মতো একজন নিলোর্ভ, মানবসেবায় নিয়োজিত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকারের খাঁচায় আবদ্ধ করে অপমান করার অধিকার কোন বিচারকের থাকতে পারে না। যেকোন আদালতের গঠনমূলক সমালোচনা সেই আদালতকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তোলে বলেই আমরা মনে করি। যে বিচারক মহোদয়গণ ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আদালতের রায়ের নামে রাজাকারের খাঁচায় আবদ্ধ করে অপমানিত, লাঞ্ছিত করেছেন তারা, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকেই অসম্মান করেছেন। আমরা রাজাকারের বিচারের আদালতে আর কোন মুক্তিযোদ্ধার সম্মানহানি দেখতে চাই না। আমরা বিচারের পক্ষে, কিন্তু বিচারের নামে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানের তীব্র বিরোধী। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি”।
কিছু ‘নামধারী মুক্তিযোদ্ধা’ স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ জাফরুল্লাহ বিরুদ্ধে আরেকটি আদালত অবমাননা মামলার আবেদন করেছেন। আদালতের ভূমিকার নিন্দা করা ছাড়াও এই নামধারী মুক্তিযোদ্ধাদের ‘অসৎ উদ্দেশ্য’ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করাও রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের বিবৃতি দেবার কারন। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা একে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্ত করবার ষড়যন্ত্র হিসাবে দেখছেন। তাঁরা ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্ত করার সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহবান’ জানিয়েছেন।
কিছু গণমাধ্যমে খবর হিসাবে এলেও গণমাধ্যমে এই বিবৃতি পুরাপুরি ছাপা হয় নি। আমরা উদ্ধৃতি দিচ্ছি যেন আবেগ ও আদালত নিয়ে অনাকাংখিত বিতর্ক এড়িয়ে আমরা বৈচারিক নীতি, মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধ্যান ধারণার আলোকে আদালত অবমাননার বিষয়টিকে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করতে পারি। অনাকাংখিত বিতর্ক বিষয়টিকে অস্পষ্ট করে তুলবে। বিচারকদের মর্যাদাকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার উর্ধে স্থাপন করার বিপদ যেন আমরা সবাই – আদালত ও নাগরিক উভয়েই -- ধরতে বা বুঝতে পারি। বুঝতে পারি আদালতের রায় ও বিচারকদের ভূমিকা কখন আবেগ ও নিস্ফল সামাজিক ও রাজনৈতিক কূটতর্কে পরিণত হয়। যা পরিহার আমাদের সকলেরই কর্তব্য। লর্ড ডেনিং বিচারকদের আচরণ ও মানবাধিকারের প্রশ্নে নৈতিক অবস্থান স্মরণে রেখে তাঁর যে মন্তব্য করেছিলেন তার উদ্দেশ্যটিও ছিল এটাই। এই দিকটি উপলব্ধি করা আমাদের সকলের জন্যই জরুরী। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ‘বাকস্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তা’র পক্ষে বিবৃতি দেওয়ায় ডাঃ জাফরুল্লাহর মতো একজন নিলোর্ভ, মানবসেবায় নিয়োজিত বীর মুক্তিযোদ্ধা’র বিচার প্রক্রিয়া ও শাস্তিকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নিজেদের ও মুক্তিযুদ্ধের ‘অপমান হিসাবে গণ্য করেছেন। এই অপমান বোধের নৈতিক ভিত্তি স্পষ্ট। সেটা হোল মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা এবং মুক্তিযোদ্ধার গৌরব। এর কি কোন বৈচারিক ভিত্তি আছে?
আপাতদৃষ্টিতে এটা স্পষ্ট ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল’ মুক্তিযুদ্ধের আবেগ বলি, ইতিহাস বলি কিম্বা চেতনা বলি তার বাইরের কোন প্রতিষ্ঠান নয়। যে আইনে এই আদালত গঠিত হয়েছে তাকে ‘বিশেষ আইন’ বলা হয়। এই বিশেষত্বের দাবি কীসের ভিত্তিতে? বলা বাহুল্য, সেটা নৈতিক ও ঐতিহাসিক – নিছক নৈর্ব্যক্তিক শুষ্ক আইন নয়। এই আদালতের ন্যায্যতা মুক্তিযুদ্ধে – অতএব মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার দায় আছে কিনা সেটা নিঃসন্দেহে বৈচারিক তর্কের বিষয়। এই তর্ক মীমাংসার পথ ও পদ্ধতি নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। এটাও স্পষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা আদালতের রায় ও তার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট নতুন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এই তর্ক তুলেছেন । ডা. জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে নতুন করে যারা আদালত অবমাননার অভিযোগ আনবার চেষ্টা করছে তারা ‘মুক্তিযোদ্ধা’ – বিবৃতিদাতা মুক্তযোদ্ধাদের ভাষায় ‘নামধারী মুক্তিযোদ্ধা’। দেখা যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আসলেই বিভক্তি দেখা দিয়েছে। বিবৃতিদাতা মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগী হবার যথেষ্ট কারণ বাস্তবে তৈরি হয়েছে।
অথচ এর কোন দরকারই ছিল না। বিচার প্রক্রিয়া বা রায় নিয়ে সমাজে তর্ক বিতর্ক হতেই পারে, কিন্তু সেটা আদালতকে কখনই প্রশ্নবিদ্ধ করে না। ডেভিড বার্গম্যানের রায় নিয়ে নাগরিকদের বিবৃতি অত্যন্ত সৎ বিবৃতি। তাঁরা সরল বিশ্বাসে সেই বিবৃতি দিয়েছেন। আদালতের চোখে সে বিবৃতির মধ্যে ভুল থাকতে পারে। তাঁরা দোষও ধরতে পারেন। যে কারনে আমি আগের নিবন্ধে বলেছি শমন জারি করে নাগরিকদের আদালতে হাজির করা ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের দিক থেকে খুবই সঠিক সিদ্ধান্ত। অভিযুক্তদের কয়েকবার আদালতে হাজির হওয়াই ছিল যথেষ্ট। যদি শাস্তি দেওয়াই আদালতের ইচ্ছা হয় তারপরও এটা ক্লিয়ার যে শমন জারি করে নাগরিকদের আদালতে হাজির করাই ছিল যথেষ্ট শাস্তি। কিন্তু আদালত নিজের ক্ষমতা ন্যায় বিচারের স্বার্থে এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিতর্ক এড়াবার স্বার্থে কি সীমিত রাখতে পারতোনা? সেটাই কি সমিচীন ছিল না? অবশ্যই। লর্ড ডেনিং বিচারকদের জন্য যে নীতি প্রস্তাব করেছেন তাতে পরিষ্কার আদালতের দিক থেকে এই তর্ক এড়িয়ে যাওয়াই ছিল সমীচিন কাজ। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা এখন সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন, আদালত শাস্তি দিতে পারে, কিন্তু নাগরিকদের অপমান করতে পারে না। আর ইতিহাসের প্রহসন যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে শুধু শাস্তি দিয়ে ক্ষান্ত হয় নি। যে কাঠগড়ায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের আদালত বিচারের জন্য দাঁড় করাত, সেখানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে মত প্রকাশের অপরাধে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে যা আদতে ‘রাজাকারের খাঁচা’। ভুল হলেও আদালত সজ্ঞানে সচেতন হয়ে এই কাজ করেছে কিনা সেই প্রশ্ন মুক্তিযোদ্ধাদের মনে জাগতেই পারে। সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে সমাজের সংবেদনশীল আবেগকে এখানে আহত করা হয়েছে। বিবৃতিটি তার প্রমাণ। আমি আদালতকে বিচক্ষণ হতে অনুরোধ করব। একই সঙ্গে নাগরিক হিসাবে নাগরিকদেরও উচিত বৈচারিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এমন আবেগ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সংযত হবার।
আদালত অবমাননা কোন ফৌজদারি অপরাধ নয়। অন্যদিকে কোথায় মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমা শেষ ও আদালতের এখতিয়ার শুরু, কিম্বা কোথায় আদালতকে সজ্ঞানে ও সচেতন ভাবে নাগরিকদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষা নিশ্চিত করবার জন্য সংযত হতে হবে -- তার কোন বিধিবদ্ধ ফর্মুলা নাই। বিচার বিভাগের কাছে যেমন তেমনি আইনশাস্ত্র বা রাষ্ট্র নীতির দিক থেকে এটা সবসময়ই তর্ক হয়ে রয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে লর্ড ডেনিং-এর নীতি অনুসরণ – অর্থাৎ নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্য আদালত অবমাননা আইন নাগরিকদের ওপর প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকা -- বিচারকদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ও মর্যাদাজনক অবস্থান। আদালতের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্যও জরুরী। অসতর্কতার বিপদ কি হতে পারে সেটা রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তব্যে পরিষ্কার। তাঁরা অভিযোগ তুলছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল ‘আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকেই অসম্মান করেছেন”। মুক্তিযোদ্ধারা বিচারের পক্ষে কিন্তু বিচারের নামে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানের তীব্র বিরোধী। তাই তাঁরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের অপমান এখন একটি আবেগ ও সংবেদনার ক্ষেত্রে প্রবেশ করলো বলাবাহুল্য যা নিয়ে আইন ও বৈচারিক পরিমণ্ডলে আলোচনা কঠিন করে তুলবে। বিষয়টি বিচার বিভাগের অন্দরমহলের বিষয় না থেকে এখন রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হোল। যার মোকাবিলা বা সামাল দেওয়া বিচার বিভাগের জন্য শাঁখের করাত হবে। পরিস্থিতি আদালত কিম্বা নাগরিক কারো কাছেই বাঞ্ছনীয় নয়।
কিন্তু নাগরিকদের অপমান বা মর্যাদা হানি মানবাধিকারের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আদালতের দিক থেকেও যা মান্য করা অতীব জরুরী। এই বিষয়টি নিয়ে পরে আমরা সময় ও সুযোগ মতো বিস্তৃত আলোচনা করব।