জলবায়ু সম্মেলন কপ ২১: আর কতো!


ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে শুরু হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু কপ-২১ (বা কনফারেন্স অব দ্য পার্টি) সম্মেলন। টানা ১২ দিন চলবে দেনদরবারের নাটক; গাওয়া হবে নানান গীত ও কেচ্ছা। বিশ্বধরিত্রী সম্মেলন হয়েছে ২০১৩ সালে। এর পর ১৯৯৭ সালে এলো কিয়োটো প্রটোকল বা সমঝোতা। প্রটকলকে বাংলায় অনেক সময় চুক্তি বললেও সেখানে ফাঁক আছে। জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত কনভেনশান হয়েছিল ১৯৯২ সালে। সেই কনভেনশানে  জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাবার জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাবার কথা উঠেছিল কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন কমানোর জন্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজ নিজ দেশের পক্ষ থেকে Common but Differentiated Responsibilities অর্থাৎ একই লক্ষ্যে ভিন্ন দায়িত্ব চুক্তি করার চেষ্টা করেছিল। কিয়োটো প্রটোকল তারই সম্প্রসারণ মাত্র। অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও ধনী দেশগুলো তাদের জন্য দেয়া নিঃসরণ মাত্রা কমাতে  চায় না। ফলে এই স্কল সম্মেলন বা তথাকথিত ‘চুক্তি’ কথার কথা হয়েই থেকেছে। অথচ বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন বিশ্বের পরিবেশ দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বাড়ছে। এবারও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ঠেকাতে ১৫০টিরও বেশি দেশ প্যারিসে একটি চুক্তিতে পৌঁছার চেষ্টা করবে। কিন্তু সেই চুক্তিঙ্কী দাঁড়াবে, শেষ্মেষ কার স্বার্থ রক্ষা করবে, তা নিয়ে শঙ্কা আছে।  জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব যাদের কারণে ঘটছে সেই ধনী দেশগুলো ‘পরিবেশ’ রক্ষায় করণীয় নিজ দায়িত্ব পালনে বিশ্বাসী নয়। তাই তারা কোনো ছাড় দেবে বলে মনে হয় না।

গত চার বছরে (২০১১ থেকে ২০১৫) পানি অনেক গড়িয়েছে।  ডারবানে অনুষ্ঠিত ১৭তম কপ সম্মেলনের পর থেকে দোহা (২০১২), ওয়ারসো (২০১৩), লিমা (২০১৪) হয়ে এখন বিশ্বের নেতারা মিলিত হচ্ছেন প্যারিসে। প্যারিসের সম্মেলনে আদৌ কিছু হবে, নাকি আগের সম্মেলনগুলোর মতো বিনা সমঝোতায় শেষ হবে, এটাই হচ্ছে প্রশ্ন। এতদিন কপ সম্মেলনগুলোতে কোনো চুক্তিতে পৌঁছানো যায়নি। তাহলে এবার কি চুক্তি হবে? যদিও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘There will be no surprises’- কোনো চমক নয়, এবার নাকি চুক্তি হবে! 

আসলেই কিছু হবে কিনা তা বোঝার জন্য একটু পেছনের অভিজ্ঞতাগুলোর দিকে ফিরে তাকানো যাক।  ডারবান সম্মেলন ২০১১ সালের ৯ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ হয়েছে ১১ ডিসেম্বর। খুব অদ্ভুতভাবে সম্মেলন শেষ হোল যখন অনেক দেশের অংশগ্রহণকারীরা চলে গেছেন। তখন রাতজাগা মিটিং করে কয়েকটি সিদ্ধান্ত এমনভাবে দেয়া হলো যে  বলা যায় যে সেটা যেন   ‘নিলে নাও, না নিলে থাক’ টাইপের সিদ্ধান্ত। অথচ উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হলো, জলবায়ু পরিবর্তন রুখে দেয়ার ধনীদের দায়িত্ব আর উন্নয়নশীল দেশের দায়িত্ব নিয়ে লেখা টেক্সটে ভারসাম্যহীনতা দেখা যাচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, ধনী দেশগুলো তাদের সৃষ্ট দূষণ রোধের জন্য বাড়তি দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। তারা যে দায়ী এ বিষয়ে তাদের দায়িত্ব নেয়ার অনীহা কপ সম্মেলনকে সফলভাবে শেষ হতে দেয়নি। এর পরের বছর (২০১২) দোহায় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। এখানেও দেখা গেল বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু সংক্রান্ত অ্যাকশন পরিকল্পনায় কর্মশালা ও গোলটেবিল বৈঠক করে চুক্তির মূলনীতি থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করা হলো। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশ যারা মূলত ভুক্তভোগী তারা দেনদরবারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো।  এদের মধ্যে অন্তত ৪৮টি দেশ গরিব দেশ হিসেবে চিহ্নিত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

২০১৩ সালে ওয়ারসোতে অনুষ্ঠিত কপ-১৯ এ উন্নয়নশীল দেশগুলো অবাক হয়ে দেখল, তারা যা প্রস্তাব করেছিল তা নেগোসিয়েটিং টেক্সটের মধ্যে ঢোকেইনি। চীনও বেশ অবাক হয়েছিল তাদের প্রস্তাব নেয়া হয়নি বলে। ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও চীন মিলে BASIC নামে জোট বদ্ধ। তার ক্ষুব্ধ হয়েছে যে বাস্তবায়নের দিকে নজর কম দেয়া হয়েছে।

লীমাতে অনুষ্ঠিত কপ-২০ সম্মেলনেও উন্নয়নশীল দেশের দাবি আরও জোরদার করা হলো। তাদের দাবি, প্রধানত একটি স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় চুক্তি হোক। ধনী দেশের টালবাহানা চলতেই থাকে। যেমন- উন্নয়নশীল দেশগুলো দাবি করল স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আলোচনা শুরু করার জন্য, তখন সম্মেলনের সহ-সভাপতি বললেন, ‘আমি এখনও প্রতিনিধি দেশের (পার্টি) কাছে শুনিনি যে, আলোচনা শুরু হোক, তারা হ্যাঁ বললে আমরা শুরু করতে পারি।’ এর উত্তরে ইকোয়েডর বলল, ‘ঠিক আছে, আপনার মাধ্যমে আমরা শুনতে চাই কারা এখন স্বচ্ছ পদ্ধতিতে আলোচনা শুরু হোক এটা চান না, তারা বলুক।’ এর উত্তরে ধনী দেশ কোনো কথা বলেনি। কিন্তু আলোচনার স্বচ্ছতাও বজায় থাকেনি। সম্মেলনের সহ-সভাপতিরা এ বিষয়ে কম আগ্রহী মনে হয়েছেন। তারা ধনী দেশের কথামতোই কাজ করে। 

এখন প্যারিসে শুরু হয়েছে ২১তম সম্মেলন। সারা বিশ্বের নজর সেদিকে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের মানুষের। কারণ দোষ করবে ধনীরা, যাদের ‘উন্নত দেশ বলা হয়’ আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের সব ধরনের ক্ষতির শিকার হবে উন্নয়নশীল দেশ। তাই উন্নয়নশীল দেশের গরজ বেশি যেন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আলোচনার মাধ্যমে সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে এবং ভারসাম্য বজায় রেখে যেন চুক্তি করা হয়। 

প্যারিসের আগেই বেশ কয়েক দফা প্রস্তুতি বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠকগুলোতে ধনী দেশগুলো কতগুলো নতুন বিষয়ের অবতারণা করে, যা বেশ উদ্বেগজনক। যেমন তারা প্রশ্ন তোলে, ‘উন্নত দেশ’ এবং ‘উন্নয়নশীল দেশ’ সম্পর্কে ধারণাগত পার্থক্য কী, ক্ষতি আর দুর্যোগের কথা আদৌ তোলা হবে কিনা ইত্যাদি। আরও একটি সমস্যা দেখা গেছে সেটা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চায় যে আলোচনার সিদ্ধান্ত হবে সবাই কী চায় তার ভিত্তিতে, যাকে ইংরেজিতে ভারিক্কি নাম দেয়া হয়েছে ‘Consensus’। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের দাবি হচ্ছে, সব ধরনের বিষয় যেন অন্তর্ভুক্ত করা হয়, কোনো কিছু যেন বাদ দেয়া না হয়; অর্থাৎ তারা  Inclusive হতে চাইল। কারণ সবাই কী চায় বলতে সেটা আসলে শেষ পর্যন্ত হয়ে যায় ধনী দেশগুলো কী চায়। সেখানে ছোট ছোট দেশ যারা তাদের ওপর নির্ভরশীল তারাও বাধ্য হয় তাদের সঙ্গে সুর মেলাতে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের দাবি অনুযায়ী হলে গরিব দেশের বিষয়গুলো প্রাধান্য পাওয়া দরকার। এটাতেও ধনী দেশ নাখোশ হয়ে যায়।

শেষ পর্যন্ত প্যারিস জলবায়ু চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথম দিনেই ফ্রান্সের দিক থেকে সে ধরনের আভাসও দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে চুক্তিতে যা থাকবে তা আমাদের মতো দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে বলে মনে হয় না। যেমন- বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধির মাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার কোনো লক্ষণ নেই, যেখানে ১.৫ ডিগ্রি থাকাটাও উদ্বেগের বিষয় ছিল। এখন তাপমাত্রা ০.৮ ডিগ্রি বেশি মাত্রায় বাড়ছে। বিশ্বের বাৎসরিক নির্গমন মাত্রা ৫০ বিলিয়ন টন করে বাড়ছে। আর যতটুকু সহ্য করার জায়গা আছে তা আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ু সম্মেলনের চুক্তির ভাষায় প্রতিটি দেশ তার ইচ্ছায় টার্গেট নির্গমন কমানোর ( Intended Nationally Determined Contributions বা INDC) ক্ষেত্রে অবদান রাখবার সংকল্প অনুযায়ী  কমাবে; কিন্তু তা ২ ডিগ্রি কম করার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।  
প্যারিসে সম্মেলন কেবল শুরু হয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সরকারের প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি সম্মেলনস্থলের বাইরে অনেক কর্মকাণ্ড করে এবং ভেতরেও তারা অনেক লবিং করার কাজ করে। এটাই রেওয়াজ হয়ে আসছে এতদিন। এ কাজ উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলোর জন্য খুবই কাজে আসে। কারণ তারা মূল ইস্যুতে অনেক ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবেশবাদীরা অনেক গবেষণা করে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে চলে আসে। কিন্তু এ ধরনের কাজ করা এবার কঠিন হয়ে গেছে। প্যারিসে মাত্র দুই সপ্তাহ আগে সন্ত্রাসী হামলার কারণে সেখানে জরুরি অবস্থা চলছে। কোনো ধরনের বিক্ষোভ করা যাচ্ছে না। তাই বলে পরিবেশবাদীরা বসে থাকবে? না, তারা বসে থাকেনি। তারা এক অভিনব কায়দায় প্রতিবাদ করেছে। ২০ হাজার মানুষের সমাবেশ করতে পারেনি বলে তারা ২০ হাজার জোড়া জুতা একখানে করে প্রতীকী সমাবেশ করেছে। অবশ্য ফ্রান্সের প্রশাসন তাও সহ্য করেনি, তারা দুই শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করেছে।

প্যারিসে যে কোনো ধরনের সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা চলছে; তাতে দুইজনের বেশি মানুষ একখানে জড়ো হতে পারবে না। কেউ ‘বেআইনিভাবে’ সমাবেশ করলে তাকে ৩ হাজার ৯৭২ ডলার জরিমানা করা হবে, অথবা দুই মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। জলবায়ু সম্মেলন আছে জেনেও ফ্রান্সের এ নিষেধাজ্ঞা শুধু জঙ্গি দমন, নাকি পরিবেশ আন্দোলন দমন চলছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কারণ এরই মধ্যে ফ্রান্স এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এতদিনের প্রস্তুতি অনুযায়ী লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ বন্ধ করতে হয়েছে। যারা গেছে, তারা ঝুঁকির মধ্যে আছে। এরই মধ্যে দুই শতাধিক আটক হওয়া উদ্বেগের কারণ বটে।

আমাদের ধরিত্রী বেশ বিপদের মধ্যে আছে। আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। তাই পরিবেশবাদীরা একেবারে দমে যাচ্ছেন না, দমে যাওয়া সম্ভব নয়। ২০ হাজার জুতার প্রতীকী সমাবেশ করার পর প্রায় ১০ হাজার মানুষ কয়েক কিলোমিটারজুড়ে মানববন্ধন করে। তারা স্লোগান দিয়েছে- ‘সিস্টেম বদলাও, ক্লাইমেট পরিবর্তন নয়’; কোনো মিথ্যা সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে না’; ‘জরুরি অবস্থা হচ্ছে জলবায়ু’ ইত্যাদি। অবশ্য ফরাসি পুলিশ টিয়ার গ্যাস দিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। পরিবেশ রক্ষা ও জঙ্গিবাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখে না ফরাসি সরকার! তাই পরিবেশবাদীরা প্রশ্ন তুলেছেন, ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতি Liberte, Eaglite, Fraternity (Liberty, Equality, Fraternity) কি মানুষের জন্য নাকি Le Bourget সম্মেলনস্থলে আসা বহুজাতিক কোম্পানি এবং ধনীদের জন্য? 

তবুও সারা বিশ্বের ১৭৫টি দেশে ৭ লাখ ৮৫ হাজার মানুষ ২ হাজার ৩০০ পদযাত্রার মাধ্যমে তাদের দাবি তুলেছে- ‘আমাদের ১০০ ভাগ পরিষ্কার জ্বালানির ভবিষ্যৎ চাই, যেন আমরা প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারি।’ বাংলাদেশেও পরিবেশ আন্দোলন পদযাত্রা করেছে এবং সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করেছে। ইয়েমেনের সানা শহরে যুদ্ধ বোমা পড়ছে এমন অবস্থায়ও পদযাত্রা করেছে।

আমাদের দেখার বিষয়, পরিবেশ রক্ষার কাজ আমাদের সরকারও কীভাবে করে। শুধু ধনী দেশের দিকে আঙুল তুললেই হবে না, আমরা নিজেরাও বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করছি নাকি জনগণের স্বার্থ দেখছি, তাও তো বুঝতে হবে।

প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলনের দিকে নজর রাখছি। শেষ হলে আবার লিখব।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।