ব্রেক্সিট ২: কার বিরুদ্ধে অসন্তোষ কার পাতে!
ব্রেক্সিট গণভোটের ফলাফল শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করে যাওয়ার পক্ষে হয়েছে। ব্রেক্সিট ইস্যুতে ভোটের ফলাফলে ত্যাগের পক্ষ জয়ী হয়েছে শতকরা ৫২-৪৮ অনুপাতে। এতে গণভোট-উত্তর পরিস্থিতি যা হতে পারে বলে অনুমান করা হয়েছিল তা একের পর এক ঘটা শুরু হয়েছে। সারা বিশ্বে ফলাফলের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সর্বব্যাপী। এটা বোঝা কঠিন ন যে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপরও এর প্রভাব পড়বে। গতকাল বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সংসদকে জানিয়েছেন যে বাংলাদেশের “পোশাক খাত চ্যালেঞ্জের মুখে” পড়েছে। ওদিকে ইতোমধ্যে প্রতি বৃটিশ পাউন্ড গণভোটের আগের তুলনায় দশ টাকা করে মূল্য হারিয়েছে। পরিস্থিতি আরো কতটা খারাপের দিকে যাবে তা নিয়ে অনুমান চলছে।
এ নিয়ে গভীরে প্রবেশের আগে কিছু ধারণা পরিষ্কার করা দরকার। যেমন- ব্রিটেনের ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়া মানে কী? ব্যাপারটা কী আসলে? বিভিন্ন রাষ্ট্র নানান কিসিমের রাষ্ট্রজোটে অন্তর্ভুক্ত হয় যার কোনটা অর্থনৈতিক অথবা রাজনৈতিক বা সামরিক ইত্যাদি সে রকম কোনো রাষ্ট্র-জোট ত্যাগ করা কি? অথবা ধরা যাক, জাতিসংঘ ধরনের বহুরাষ্ট্রীয় জোট বা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো সদস্যরাষ্ট্রের ছেড়ে যাওয়ার মতো? অথবা বহুরাষ্ট্রীয় (মাল্টিল্যাটারাল) ক্যাটাগরির আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক কে ওর কোনো সদস্যরাষ্ট্রের ছেড়ে যাওয়া? বাংলাদেশের সার্ক জোট ছেড়ে গেলে কী হবে তেমন একটা কিছু? উদাহরণ আর না বাড়িয়ে এবার উত্তরের দিকে যাওয়া যাক।
প্রথমত কোনো সদস্য রাষ্ট্রের জোট ত্যাগ করার উদাহরণ খুব একটা নাই, তুলনায় জোটের অকার্যকর হয়ে পড়ার উদাহরণ পাওয়া যাবে। তবে আলোচনা সেদিকে নিব না। আমরা এখানে কথা বলছি – ইইউ ধরণের বিশেষ রাষ্ট্রজোটের।
ব্রিটেনসহ ধরলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছিল মোট ২৮ সদস্য-রাষ্ট্রের। এখন এই ইইউ ধরনের রাষ্ট্রজোটের সাথে অন্য আর সব ধরনের রাষ্ট্রজোটের একটা প্রধান ফারাক আমরা এখন টানব। তা হল, ইইউ ছাড়া অন্য সব রাষ্ট্রজোটের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা সদস্যরাষ্ট্র একেকটা সার্বভৌম ইউনিট, এটা বজায় রেখে বা মেনে নেয়ার পরই এসব রাষ্ট্রজোট গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ একাধিক রাষ্ট্র নিয়ে জোট অথবা জাতিসংঘের মতো প্রায় সব (বর্তমানে ১৯৩ সদস্যের) রাষ্ট্রের রাষ্ট্রজোট হবার পরও জাতিসংঘ নিজে সদস্যরাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্বধারী কোনো সুপার স্টেট নয়।
যেমন বাংলাদেশ সম্পর্কে যেকোনো ইস্যুতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার একমাত্র বাংলাদেশ রাষ্ট্রের, জাতিসংঘ অথবা এর অধীনস্থ কোনো প্রতিষ্ঠান বা কমিটির নয়। জাতিসংঘ সার্বভৌম – ধারণার উপরে জন্ম নেওয়া কোন প্রতিষ্ঠান নয়। সদস্যরাষ্ট্রের ওপরে জাতিসংঘ কি সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের এখতিয়ার রাখে? এককথায় জবাব মোটেও না। প্রশ্নই আসে না। প্রত্যেক সদস্য-রাষ্ট্রই কেবল সার্বভৌম যার উপর কেউ নাই, আর কোন মাতব্বর নাই – এই অনুমানের ওপরই জাতিসংঘ গঠিত। ফলে জাতিসংঘের কোনো সিদ্ধান্ত মানার ব্যাপারটি কিভাবে ঘটে? ওই সিদ্ধান্ত বা আন্তর্জাতিক আইন বা কনভেনশন কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে জাতিসংঘের সব সদস্যের সম্মতিতে অনুমোদিত হয়েছে শুধু সেজন্য কি? না সেজন্য নয়। বরং ওই আইনের অনুরূপ লেখা একটা আইন (যেটা রেটিফিকেশন বলে পরিচিত) আমরা আমাদের সংসদে পাস করিয়ে নিয়েছি সেজন্য। সারকথায় জাতিসংঘের কোনো আইন বা কনভেনশন ইত্যাদি আমরা মানি এ জন্য যে, তার অনুরূপ এক আইন আমাদের নিজের সংসদ পাস করে নেওয়া হয়েছে, তাই। নিজের আইন তো নিজে মানবই। জাতিসংঘ কখনোই এমন কোনো তৎপরতা দেখায় না বা এমন কোনো রেওয়াজ নাই, যা থেকে আমরা অর্থ করতে পারি যে সে আমাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে অথবা আমাদের রাষ্ট্রের ওপরে অবস্থিত এক চূড়ান্ত কর্তৃত্বের কর্তৃপক্ষ হল জাতিসঙ্ঘ। বরং রাষ্ট্রই সার্বভৌমত্বের শেষ কথা। এর ওপর কাউকে রাখা হয়নি। এভাবে দুনিয়ার যেকোনো রাষ্ট্রজোট তার আলাদা আলাদা সদস্যরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অটুট রেখেই নানান রাষ্ট্রজোটের অংশ হয়।
কিন্তু এই ধারণার একমাত্র ব্যতিক্রম বা ব্যতিক্রম হওয়ার উদ্যোগ হল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। কী অর্থে? যেহেতু ইইউ গড়ার লক্ষ্য হল সদস্যরাষ্ট্রগুলো একটা লম্বা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একদিন প্রত্যেকের আলাদা রাষ্ট্ররূপ বিলুপ্ত করে সবাই মিলে একক এক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তবে এখনই সেই প্রক্রিয়ার পুরোটা সম্পন্ন হয়ে যায়নি। তাই ইইউ এখনই কোনো সার্বভৌম অস্তিত্ব নয়। তবে ইইউর কিছু কিছু ফোরামে নেয়া সিদ্ধান্ত সব সদস্যরাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক হয়েছে। এই অর্থে ওসব জায়গায় ইইউ নিজের সদস্যরাষ্ট্রের উপর সুপ্রীম কর্তৃপক্ষ। যেমন ইইউর ফোরামে গৃহীত প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রে কাজের দৈনিক শ্রমঘণ্টা কত হবে- এ বিষয়ক ইইউ ফোরামে নেয়া সিদ্ধান্ত সব সদস্যরাষ্ট্রের জন্য এখনই বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট । এখানে ইইউর ভূমিকা সদস্যরাষ্ট্রের ওপর সুপার স্টেট ধরনের। আর এটাই প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্র তার নিজ নিজ সংসদে আগে অনুমোদন দিয়েছে যে ঐসব ক্ষেত্রে ইইউ এর সিদ্ধান্ত সদস্য-রাষ্ট্রের উপর সুপ্রীম, তাই এটা বৈধ। সারকথায় রাষ্ট্রজোটের নানা ধরনের মধ্যে একমাত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন হল আলাদা ধরণের কারণ এটা হবু সুপার স্টেট। এক সুপার ষ্টেট হবার লক্ষ্যে সে আগাচ্ছে তাই।
ব্রেক্সিট গণভোটের মাধ্যমে ব্রিটিশ জনগণ সিদ্ধান্ত জানাল যে ব্রিটেন ইইউর মধ্যে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র হিসাবে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করার যে সিদ্ধান্ত আগে নিয়েছিল সে সিদ্ধান্ত বদল করে তারা এবার নিজেদের সার্বভৌম ব্রিটেন রাষ্ট্রই অটুট রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল।
ব্রেক্সিট গণভোটে ব্রিটেনের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল রক্ষণশীল টোরি আর লিবারেল লেবার- এরা কেউই ইইউ ত্যাগের পক্ষে নয়, বরং ইইউর সাথে থেকে যাওয়ার পক্ষে বলে দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, প্রচারও করেছিল। ফলে আর অন্য ছোট দল হিসেবে যারা ইইউ ত্যাগের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল ও প্রচার চালিয়েছিল, তেমন এক দল হলো ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি (আইপি)। গণভোটের ফলাফল ত্যাগের পক্ষে যাওয়ার পর মিডিয়া এই পার্টির সেক্রেটারিকে প্রশ্ন রেখেছিল- কেন তারা জিতলেন বলে মনে করেন? তিনি বললেন, আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা জনগণ নিজেরাই নিতে চাই, তাই। এটা অবশ্যই সঠিক জবাব নয়। একই ভাবে আর এক নেতা তিনি “না-ভোট প্রচারক” কমিটির যুগ্ম-আহবায়ক। নাম (Michael Gove) বা মাইকেল গভ। কিন্তু তিনি আসলে আবার ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল টোরি পার্টির এমপি। তিনি তার ওয়েব সাইটে তাঁর না ভোটের পক্ষে থাকার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। যেখানে তিনিও UKIP দলের মত বললেন। যেসব নেতারা ইইউ-ত্যাগের পক্ষে কাজ করেছেন, তারা মূলত সাধারণ মানুষের নানান ক্ষোভ অসন্তোষকে সস্তা ও উগ্র জাতীয়তাবাদী সুড়সুড়ি দিয়ে আরও বড় করে কাজে লাগিয়েছেন। যেমন মাইকেল লিখছেন, তার আপত্তি্র পয়েন্ট হল তাঁর “বৃটেনের ভাগ্য অন্য রাষ্ট্রের রাজনীতিবিদের ঠিক করছেন’ ( “decided by politicians from other nations”)। এটা খুবই বাজে ও ফালতু যুক্তি। এক রংপুরের রাজনীতিবিদ যদি বলে, বাংলাদেশের বাজেট দিচ্ছেন এক (ভিন্ন জেলা অর্থে ভিনজাতের) সিলটি নেতা … এটা বললে বুঝতে হবে এগুলো মাথায় শয়তান ভর করা লোকের সস্তা সুড়সুড়ি মার্কা কথা। আমরা নানা জেলার মানুষ মিলিয়েই বাংলাদেশ গঠন করেছি। ফলে কেউ যদি সংসদে সিলেটি হয়ে রংপুরের ভাগ্য নির্ধারণ করে তবে কোথাও আবার রংপুরিয়াও সিলটির ভাগ্য নির্ধারণ করবে। ইইউ তে বৃটিশ না হয়েও ধরা যাক সে জর্মন জাতির সিদ্ধান্ত বৃটেনের উপর প্রযোজ্য হচ্ছে, বৃটিশের সিদ্ধান্তও অন্যত্র জর্মনের উপর প্রযোজ্য হচ্ছে। সুতরাং এটা কোন পয়েন্টই না। পরিষ্কার দগদগে উগ্র জাতিবাদি বিদ্বেষ বা রেসিজম বলে অনেকে তা নিন্দা করছেন। যদি ইইউতে ভাইস ভারসা ভাবে জর্মনী বা অন্য জাতি রাষ্ট্রের উপর বৃটিশ (ইইউ এমপি বা MEP )র সিদ্ধান্ত কার্যকর না হত তাহলে এসব কথা বলার সুযোগ থাকত। এছাড়া সবার উপরে বৃটেন কী স্ব-ইচ্ছায় ১৯৭৩ সালে ইইউ তে যোগ দেয় নাই? স্ব-ইচ্ছায় যোগ দেয়ার মানে কী? অ-বৃটিশেরও মতামত কিম্বা অবস্থা ভেদে মাতব্বরি শুনতে ব্রিটেনের জনগন রাজি। অতএব এসব ফালতু জাত-বিদ্বেষী বক্তব্যকে যদি জবাব হিসেবে গ্রহণ করতে হয়, তবে মানতে হবে এত দিন বেআইনি বা অবৈধভাবে ব্রিটেনবাসীকে বঞ্চিত করে, তাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে ইইউ সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল, যেন সেটার অবসান ঘটালেন তারা গণভোটে ভোট দিয়ে। কিন্তু না তা তো নয়। আইনে যা লেখা আছে তা মেনেই সেই ১৯৫১ সাল থেকে শুরু হওয়া এক ক্রমপ্রক্রিয়ায় ব্রিটেন ইইউর ভেতরে বিলুপ্ত হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছিল। ইইউ কোন জবরদস্তি প্রক্রিয়া তো ছিল না।
আবার সেই ইইউ প্রক্রিয়া যেহেতু এখনো শেষ বা সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়নি, ফলে ২০০৭ সালের লিসবন চুক্তি, যার আরেক নাম ইউরোপীয় ইউনিয়ন চুক্তি, যেটা তার আগের করা ইইউ বিষয়ক সব চুক্তির আপডেটেড বা সর্বশেষ রূপ, এর আর্টিকেল ৫০ অনুসারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রক্রিয়া থেকে এখনও যেকোনো সদস্যের বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ বৈধভাবেই ছিল। যেটার সুযোগ নিতেই ব্রিটেনের জনগণ তাদের আগের সিদ্ধান্ত বদলানোর সুযোগ নিয়েছে এই গণভোট করে। এটাও বৈধ। ফলে ১৯৭৩ সালে ইইউতে ব্রিটেনের যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত এবং এই গণভোটে ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দুটোই আইনি দিক থেকে বৈধ সিদ্ধান্ত। তাহলে আসলে এখন কী ঘটেছে? আর কেন সেটা ঘটল?
সাধারণ নির্বাচন বা গণভোট মানে ঐ একবারই যখন সিদ্ধান্ত সাধারণ জনগণের পর্যায়ে নেমে আসে। কার তুলনায়? সরকার গঠন হয়ে গেলে যে সংকীর্ণ গোষ্ঠি এবার সরকারের নীতি-সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের ক্ষমতার তুলনায়। গ্লোবাল অর্থনীতিতে বা গ্লোবাল কাপিটালিজমে অনেক প্রভাবশালী অর্থনীতি আছে। এরাসহ সব আধুনিক রাষ্ট্রেই পুঁজি ব্যবসায়ী, শিল্পকারখানা বা ট্রেডার ব্যাংকার সমাজের এ অংশটিই তাদের পক্ষে রাষ্ট্রের মৌলিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে থাকে। নির্বাচন একবার হয়ে গেলে পরের নির্বাচনের আগে পর্যন্ত এসময়গুলোতে রাষ্ট্র কার্যত থাকে এই গোষ্ঠির প্রভাবে। মূলত এসব সময়গুলোতে নেয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ জনগণ ক্রমেই অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছিল।
যেমন ২০০৮ সাল থেকে চলে আসা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব এখনো বিশ্ব অর্থনীতিতে কাটেনি। আর ওই মন্দা আসলে ডেকে এনে ছিল যেন এক প্রতিযোগিতা! কীসের? ঐ মহামন্দায় দেউলিয়া হয়ে পড়া কোম্পানী পুঁজির কারবারিদের দায়দেনা ও ক্ষতি জনগণ বা রাষ্ট্রের কাঁধে কেমন লটকিয়ে দেয়া যায় তারই প্রতিযোগিতা। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ ঢেলে সব ব্যক্তি ব্যবসা ও কর্পোরেট কোম্পানীর দায়দেনা ও ক্ষতি মিটানো হয়েছিল। এরপর আবার শুরু হল (austerity) অস্টারিটি মানে অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রসাধন। অর্থাৎ রাষ্ট্র সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে বিনিয়োগ কমিয়ে দিবে আর স্বাস্থ্য শিক্ষা ধরনের সামাজিক বেনিফিটে কাটছাঁট করবে। যার সবচেয়ে আর সব দিক থেকে চাপটা এসে পড়বে কেবল শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সমাজের নিচের কম আয়ের জনগণের ওপর। এর ওপর আবার বিগত ২০০১ সাল থেকেই – ‘ইসলামি জঙ্গি’ মারতে গিয়েশেষ নাই এমন যুদ্ধে আটকে গিয়েছে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো। এর অর্থনৈতিক দায় বইতে পশ্চিমা রাশ্ট্রগুলোর অসমর্থ হওয়া ছিল সব কিছুর প্রধান ফ্যাক্টর। ঐ যুদ্ধের ঘটনার লেজে লেজে যেখান থেকে আবার দুনিয়াতে রিফিউজি বা উদ্বাস্তু সমস্যা খাড়া হয়ে গেছে। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে ইউরোপেরই নিচের মানুষদের চেয়েও কম বেতনে রিফিউজিরা খুবই খারাপ ও দুস্থদশায় আছে বলে কাজ করতে রাজি – ফলে এরাই শ্রমজীবীদের বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে হাজির হতে চাইছে। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুদ্ধের রিফুইজি বলে ঠেলে ফেলতে পারে না, জাতিসংঘ উদ্বাস্তু কমিশনে কমিটমেন্ট ইত্যাদির কারণে রফুইজি নিচ্ছে বা প্রতিদানে অর্থের সংস্থান করে দিচ্ছে। এগুলো প্রতিটার ক্ষেত্রে ইউরোপেরই নিচের মানুষদের স্বার্থ আর তাদের শাসকদের স্বার্থ পরস্পর মুখোমুখি। ফলে শ্রমজীবিদের চোখে ইইউ ভিলেন। ফলে সব কিছুকে উল্টে ফেলে দেয়ার অছিলা খুঁজছিল ইউরোপেরই কম আয়ের জনগণ। কারণ স্ব স্ব রাষ্ট্রে এসব সিদ্ধান্ত ও কাজ করা হচ্ছিল ইইউর আইনি বাধ্যবাধকতার অজুহাতে, ইইউর অমুক আইনের বাধা আছে, অথবা ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের রুল আছে তাই অস্টারিটি করতে হচ্ছে অথবা ইইউর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তাই উদ্বাস্তু নিতে হবে- এভাবে ইইউকে দেখিয়ে রাষ্ট্রগুলো এইসব করছিল। ফলে স্বভাবতই জনগণ সেই ইইউ নামে ভুতুড়ে ক্ষমতাকেই উপড়ে ফেলার পক্ষে চলে যায়। অর্থাৎ সমাজে এসব অসন্তোষ বাড়ছিল। এই অসন্তোষ নিরসন বা আমলে নেয়ার নামে ক্যামেরন ভেবেছিলেন ইইউতে থাকা না থাকাকে গণভোটে দিলে আবার ইইউতে থাকাই জিতবে। ফলে গণক্ষোভ প্রশমিত করার রাস্তা তার নাগালেই আছে। তাই আগবাড়িয়ে ২০১৩ সালে তিনি গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ দিকে সমাজের ওপরের অংশ এবং দুই প্রধান দল ধরেও নিয়েছিল, গণভোটে ইইউ ত্যাগের পক্ষ জিততেই পারে না। এটা তাদের কাছে অসম্ভব কল্পনা মনে হয়েছিল। কিন্তু যত গণভোটের নির্ধারিত দিন এগিয়ে আসতে থাকে ততই বিশ্ব অর্থনীতি বা ক্যাপিটালিজম পরিচালনের রাষ্ট্রনেতা, বিভিন্ন বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের নেতারা ততই ইইউ ত্যাগ করে গেলে কী বিপর্যয় ঘটবে, একের পর এক এর ভয়াবহতা উল্লেখ করতে থাকে। এর প্রতিক্রিয়া হয় আরো নেতিবাচক। বিবিসি যে আটটা কারণ তুলে ধরেছে, তার এক নম্বর কারণ হিসেবে “ব্রেক্সিটের নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাবের উল্টো ফলকে” । ব্রিটিশ সাধারণ ভোটাররা ব্যাপারটিকে তাদেরকে ভয় দেখানো বা হুমকি দেয়া হিসেবে দেখেছিল। ফলে চাপের ভেতরে তাদের দিশেহারা অবস্থা। এর ওপর আবার সর্বক্ষণ হবু সুপার স্টেট ইইউর দোহাই দেয়াতে এই ভুতুড়ে আড়ালি ক্ষমতাকেই জনগণ সবার আগে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটা মনে করা যেতে পারে।
ব্রিটেনের ভাষায় ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি (আইপি) হলো এক ‘ডানপন্থী’ পার্টি। এরা এই গণভোটকে উগ্র জাতীয়তাবাদ ছিটানোর মহাসুযোগ হিসেবে নিয়েছিল। তারা মিথ্যা আওয়াজ তুলেছে যেন উগ্র জাতীয়তাবাদের স্লোগান তুললে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের সব সঙ্কট দূর হয়ে যাবে। ইসলামি জঙ্গি মারার নামে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের যে সঙ্কটকে আরো বাড়িয়ে তোলা হয়েছে, তা আপনাআপনিই মিটে যাবে, এই মিথ্যা স্লোগান দেয়া হয়েছে। ব্রিটিশ সংস্কৃতি মূল্যবোধ সবার চেয়ে ভালো এই উগ্র প্রচার করেছে। ফলে বৃটিশরা নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্ত নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে মূল সমস্যা থেকে সাধারণ জনগণের দৃষ্টি সরাতে সক্ষম হয়েছিল। এসব কিছুর নিট ফলাফল হলো গণভোটের ইইউর ত্যাগের সিদ্ধান্তের জয় লাভ।
ইইউ ত্যাগের পক্ষের প্রাক্তন মেয়র বরিস জনসন ও অন্য প্রবক্তারা জানেন, যে তারা মিথ্যা প্রলোভনে ত্যাগের পক্ষকে জিতিয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে প্রাক্তন মেয়র বরিস জনসনকে মিথ্যা বলার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বরিস জনসনের ছবিসহ ঐ সম্পাদকীয়ের শিরোনাম হল ব্রেক্সিটের প্রবক্তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। অথচ সবাই জানত ইইউ-ত্যাগের পক্ষে জিতলেও গরিব শ্রমজীবীর মূল ক্ষোভ অসন্তোষ এতে কাটবে না। তাই নিউইয়র্ক টাইমস গত ২৬ জুন আর এক রিপোর্টে বলছে ইইউ-ত্যাগ ভোটের জিতার পরে অনেক নেতা উলটা প্যাডেল মেরে ভাগা শুরু করেছে। কারণ জিতলে তারা কী করবে এনিয়ে তাদের কোন অর্থনৈতিক পরকল্পনা ছিল না। প্রতিদিন ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড নাকি ইইউকে দিতে হত খামোখা বলে বরিস জনসনরা প্রচার চালিয়েছিল। এখন স্বীকার করছে ওটা ভুল ছিল। তাই তারা এখন ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া যত দেরিতে শুরু করা যায়, তার পক্ষে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। যেমন ইইউ ত্যাগের আইনগত পদ্ধতি হলো কোনো সদস্যরাষ্ট্র নিজ রাষ্ট্রের আইন বা কনস্টিটিউশনাল বাধ্যবাধকতা পালনের মুখোমুখি হয়ে পড়লে (যেমন- বৃটেন এখন গণভোটের রায় বাস্তবায়নে বাধ্য) সে ইইউ ছেড়ে যাওয়ার জন্য সবার আগে ইইউকে নোটিশ দেবে। এটাই সর্বশেষ লিসবন ইইউ চুক্তির আর্টিকেল ৫০ অনুসারে ইইউ ত্যাগ করতে চাওয়া দেশের ত্যাগের প্রক্রিয়া শুরুর প্রথম পদক্ষেপ। অর্থাৎ বৃটেনে গণভোট হয়ে ফলাফল চলে এলেও আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউ এখনো বৃটেনের কাছ থেকে ত্যাগের ইচ্ছার কথা জানে না। আর এই ইচ্ছা জানানোর এখতিয়ার বা জানানোর পার্টি হল, যে ত্যাগ করতে চায়। সে হিসেবে কেবল ব্রিটেন। তাই সাবেক মেয়র বরিস জনসন আর্টিকেল ৫০ স্মরণ করিয়ে বলছেন, এটা তাদের এখতিয়ার এবং তারা আগামী অক্টোবরের আগে ইইউকে আনুষ্ঠানিক নোটিফাই করতে চিঠিই দেবেন না। ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে আর্টিকেল ৫০-কে সক্রিয় করে জানানোর প্রক্রিয়া শুরু করলে এর পরের কমপক্ষে দুই বছরের আগে এই বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া শেষ হবে না। ফলে যারা ইইউ-ত্যাগ পক্ষকে জিতিয়েছেন, সেই প্রবক্তারা তাই যদ্দুর সম্ভব আগামীতে নিজেদের সম্ভাব্য ব্যর্থতা লুকিয়ে রাখার সুযোগ নিতে চান। বিপরীতে জর্মান, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লেদারল্যান্ডস, ইতালি ও লুক্সেমবার্গের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মিলিত হয়ে এক যৌথ আহ্বান রেখেছেন ব্রিটেনের প্রতি। দাবি করেছেন ইতোমধ্যেই গণভোটের ফলাফল গ্লোবাল বাজারের আনাচে-কানাচে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। মার্কেটে উথাল পাথাল ঘটা শুরু হয়েছে। ফলে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করতে ব্রিটেন যেন দ্রুত শুরু করে, যাতে ব্রিটেন বাদে ইইউ (২৭ সদস্যরাষ্ট্র) নিজেদের আরো কোনো বিপর্যয়ের হাতে না পড়ে তার বিপক্ষে প্রস্তুতি নিতে পারে। এই ছয় রাষ্ট্রই ১৯৫১ সালে ইইউর প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করেছিল।
ব্রিটেন ও বাকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে বিচ্ছেদ কি সহজেই ঘটতে পারবে, নাকি আরো বিপর্যয়ের মুখোমুখি পড়তে যাচ্ছে গোটা দুনিয়া - এটাই এখন দেখার বিষয়!
[এই লেখার প্রথম পর্ব যার শিরোনাম ছিল, “ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগ : গড়ার ভাঙনের শুরু” ঐ লেখা বিগত ১৯ জুন দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় আগে ছাপা হয়েছিল। 'ব্রেক্সিট ১: ভাঙাগড়ার শুরু' নামে চিন্তায় তা ছাপা হয়েছে। চলতি পর্বের লেখাটা আগে ২৬ জুন ২০১৬ দৈনিক নয়াদিগন্তে ছাপা হয়েছিল। এখানে আরও পরিমার্জনাসহ 'ব্রেক্সিট ২: কার অসন্তোষ কার পাতে !' নামে ছাপা হোল। দুটো লেখায় আবার নানান সংযোজন ও সম্পাদনা করা হয়েছে।]
৩০ জুন ২০১৬, বৃহস্পতিবার