কৃষির কর্পোরেট চরিত্র ও জিএমও


সবুজ বিপ্লবের রাজনীতি, বিষ ও প্যাকেজ

গত শতাব্দির মাঝামাঝি সময় থেকে কৃষির কৃৎকৌশলে পরিবর্তন আনবার পরিপ্রেক্ষিতে বীজের ধারণায় এবং বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আনা হয়। সরকারি উদ্যোগে হলেও সেটা ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। ফসলের একাংশকে বীজ হিশাবে সংগ্রহে রাখা, বীজ বাছাই, পরের মৌসুমে বীছন তৈরি এবং জমির বৈচিত্র ও বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে বিভিন্ন জাতের ধান ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনের সিদ্ধান্ত কৃষক পরিবারই নিতেন। সেখানে কৃষক নারীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বিশেষ ভাবে চিনে, কৃষকদের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি কৃষকদের সংগঠিত করে এবং গণযুদ্ধ ও রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করে। চিনে বৈপ্লবিক ভূমি সংস্কার বাস্তবায়িত হোল। এই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার কারনে এশিয়ায় কৃষক ও কৃষি আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিবেচনার বিষয়ে পরিণত হোল।

এর মোকাবেলায় চিনের মতো বৈপ্লবিক ভূমি সংস্কার না করে কৃষিতে প্রযুক্তি প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে কৃষি ব্যবস্থার সংস্কার পাশ্চাত্যের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকৌশলে পরিণত হোল। ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার জনসংখ্যাও পাশ্চাত্য দেশের উৎকন্ঠার কারণ হয়ে উঠল। ফলে খাদ্য সংকটের জন্য যুদ্ধবিগ্রহ,খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা,অধিক মুনাফার জন্য খাদ্যের আড়তদারি ইত্যাদি সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে খাদ্যের অভাবের জন্য প্রধানতঃ জনসংখ্যাকে দায়ী করা শুরু হোল। বৈপ্লবিক ভূমিসংস্কার কিম্বা কৃষকের হাজার বছরের জ্ঞানচর্চার বিকাশ ও প্রয়োগ নয়, বরং সমাধান হোল আধুনিক বৈজ্ঞানিক কৃৎকৌশলের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো।

এই সময় খাদ্যের সংজ্ঞাতেও বদল ঘটলো। খাদ্যের সংজ্ঞা নির্ণয়ে দানাদার খাদ্যকে প্রধান খাদ্যের (Staple Food) মর্যাদা দেওয়া হোল; খাদ্যের পুষ্টিগুণের চেয়ে পরিমানের ওপর জোর দেওয়া হোল। মেক্সিকো সরকার ও রকফেলার ফাউন্ডেশান ১৯৪৩ সালের দিকে ‘সবুজ বিপ্লব’-কে একটি কৃৎকৌশলগত প্যাকেজ হিশাবে হাজির করবার জন্য ‘বিশেষ গবেষণা’র উদ্যোগ নিল। সেই উদ্যোগ ১৯৬০ দশকে পরিগঠিত হোল আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (International Rice Research Institute) হিশাবে। স্থানীয় পরিবেশ, প্রকৃতি, প্রাণবৈচিত্র এবং চাষের জমির বিচিত্র ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ধানের জাতকে দুটো ভাগে ভাগ করা শুরু হোল। একটি উচ্চ ফলনশীল প্রযুক্তি (উফশী) আর অপরটি উফশীর চেয়ে হীন ও নিম্ন মূল্যের বিপুল সংখ্যার স্থানীয় ফসলের জাত ও প্রজাতি। তারা হয়ে গেল অনুৎপাদনশীল মূর্খ কৃষকের নিম্ন মানের বীজ।

কিন্তু তথাকথিত অনুন্নত দেশগুলোকে রকফেলার ফাউন্ডেশানের নীতি ও কৃৎকৌশল চাপিয়ে দেওয়া সহজ ছিল না। সেটা আরোপ করতে হয়েছে বিশ্বব্যংকের ঋণ পাবার শর্ত হিশাবে। ষাটের দশকে বিশ্ব ব্যাংকের শর্ত মেনে তৎকালীন পাকিস্তানের আয়ুব খান সরকার উফশি বীজ প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি পদ্ধতি চালু করেছিলেন, যার মুলে শুধু উফশী বীজ নয়,একই সঙ্গে ছিল রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার। এবং তা এসেছিল সুদুর আমেরিকার ফোর্ড এবং রকফেলার ফাউন্ডেশানের আর্থিক কল্যাণে। এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোই সহযোগিতা করেছিল প্রাণ ও প্রাকৃতিক বৈচিত্রে সমৃদ্ধ দেশগুলোতে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে কৃষিকে ‘উন্নত’ করতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই সকল রাসায়নিক পদার্থের বা বিষাক্ত দ্রব্যের জন্য বাজার তৈরির দরকার ছিল। ‘সবুজ বিপ্লব’ বা Green Revolution তাহলে নিছকই বৈজ্ঞানিক ব্যাপার ছিল না। এটি ছিল একটি কৃৎকৌশলগত প্যাকেজ। আন্তর্জাতিক রাজনীতি আর আধুনিক বিজ্ঞানের কৌশল্গত ব্যবহার। অন্যদিকে যুদ্ধে ব্যবহৃত বিষাক্ত রাসায়নিক উদ্বৃত্তের বাজার তৈরির জন্য এমন ধানের জাত উদ্ভাবিত হোল যেসব জাত চাষের জন্য আসলে রাসায়নক ও বিষ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। সর্বোপরি এটা বাস্তবায়িত করতে কৃষক নয়, কৃষি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরির গবেষকদের হাতে তুলে দেওয়া। ইত্যাদি সব কিছুরই মিশ্রিত প্যাকেজ ছিল গ্রিন রেভ্লিউশান। অধিক উৎপাদন করে মানুষকে ক্ষুধা থেকে বাঁচাবার কথা বলা হয় বটে, আসলে সবুজ বিপ্লবের মুল কাজ ছিল ল্যাবরেটরীতে উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশিল বীজের সাথে কৃত্রিম সার ও কীটনাশক এবং তার সাথে সেচ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। কর্পোরেট কৃষির বীজ বপন এখান থেকেই শুরু।

সবুজ বিপ্লবের সমস্যা
কিন্তু শতাব্দি শেষ না হতেই আধুনিক কৃষি বা সবুজ বিপ্লবের সমস্যা দেখা দিল। মাটি নষ্ট, পানি নষ্ট, ফলন কমে যাওয়া, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, ফসলের মূল্য না পাওয়া, ইত্যাদি। এই সকল কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের বেঁচে থাকাই কষ্টের ব্যাপার হয়ে গেল। এরপর নব্বইয়ে দেখা গেল হাইব্রিড বা সংকর বীজের ছড়াছড়ি। ভাল বীজ উৎপাদন ও বিতরণের সরকারি উদ্যোগ থেকে সরে এসে ঢুকলো প্রাইভেট কোম্পানি,বিশেষ করে যারা এতোদিন রাসায়নিক কীটনাশক বিক্রি করেছে তারাই হাইব্রীড বীজের ব্যবসায় ঢুকে পড়লো। বাংলাদেশে এখন উফশী এবং হাইব্রীড বীজের কারণে কৃষক দেশীয় বীজ হারাতে বসেছে। অথচ হাইব্রীড বীজে আপাত দৃষ্টিতে অধিক ফলন হলেও খাদ্যের মান একেবারে কমে গেছে। ‘টাটকা’ ও ‘চকচকে’ সব্জি ও ফল উৎপাদন করতে গিয়ে কীটনাশক ও নানান ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার মারাত্মক ভাবে বেড়ে গিয়েছে। কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। রোগ বালাই বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্য সুচকে অ-সংক্রামক ব্যাধির হার, বিশেষ করে ক্যান্সার,আশংকাজনকভাবে বেড়ে গেছে। মোট মৃত্যুর ৬১% এখন শুধু অ-সংক্রামক রোগের কারণেই হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক হারে কীটনাশকের ব্যবহার এর অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় দেখা যায় বাজারে বিক্রিত সব্জির ৬৭% (যা অধিকাংশই হাইব্রিড) গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া উচ্চ ফলনশীল বা হাইব্রীড কোনটাই কৃষকের কাছে জনপ্রিয়তা পায় নি। নির্দিষ্ট কিছু ফসলের জন্য সরকারের যে কৃষি উপকরণ সহায়তা দেয়া হয় সেটা উচ্চ ফলনশীল বীজ কিংবা হাইব্রীড ফসলের জন্যই। আধুনিক কৃষি শুরু হবার পর থেকে সার-কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে। বাৎসরিক কৃষি পরিসংখ্যান গ্রন্থে (Yearbook of Agricultural Statistics in Bangladesh, 2009) দেখছি ১৯৯৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কীটনাশক ব্যবহারের পরিমান ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ১৯৯৩ সালে ছিল ৭৬৬০.৩৯ মেট্রিক টন, ২০০৭ সালে তা হয়েছে ৩৭৭১২.২০ মেট্রিক টন, অর্থাৎ ৩৯২% বেড়েছে। উল্লেখ্য ধান ও অন্য ফসলে হাইব্রীড বীজের ব্যবহার ১৯৯৮ সাল থেকে অনেক গুণ বেড়ে গেছে।

কৃষিতে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের পর থেকে খাদ্য নিরাপত্তার ধারণা পাল্টাতে শুরু করেছে,এখন নতুন ধারণা হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) নয়, জাতিসংঘের আরেকটি প্রতিষ্ঠান খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) কীটনাশক ব্যবহার কমানোর জন্যে সমন্বিত কীটনাশক ব্যবস্থাপনা (IPM) প্রবর্তন করেছে। সম্প্রতি প্রবর্তন করেছে নিরাপদ খাদ্য প্রকল্প, যার অন্যতম প্রধান দিক হচ্ছে খাদ্যে রাসায়নিক দুষণ সনাক্ত করে খাদ্য উৎপাদন, বিক্রয় ও ভোগ করার পুরো চেইন নিরাপদ করা। জাতি সংঘের পরিবেশ কর্মসুচীর উদ্যোগে ২০০১ সালে সুইডেনের স্টকহোমে persistent organic pollutants (POPs) ব্যবহার নিষিদ্ধ্ করার জন্যে একটি চুক্তি হয় যা Stockholm convention on persistent organic pollutants (POPs) নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিকভাবে আন্দোলনের ফলে এই চুক্তিতে ৫০টি রাষ্ট্রের স্বাক্ষর পাওয়া যায় এবং মাত্র তিন বছরের মধ্যে ২০০৪ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ আইনে পরিণত হয়। এই আইন আন্তর্জাতিকভাবে সব রাষ্ট্রের জন্যে মেনে চলা বাধ্যতামূলক। পেস্টিসাইড একশান নেটওয়ার্ক এই বিষয়ে বিশেষ অবদান রেখেছে। এই আইনের আওতায় ১২টি কীটনাশকের ব্যবহার আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এই তালিকা ২০০৯ সালের মধ্যে ২১টি কীটনাশকে এসে দাঁড়ায়িছে। আধুনিক উচ্চফলনশীল কৃষি প্রকৃতি ও পরিবেশকে বিষাক্ত করেছে এখন তার ফলে মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষা ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

সবুজ বিপ্লব মাত্র ৩৬ বছরের মধ্যেই (১৯৯৬ সালে) জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সমালোচনা মুখে পড়ে যায়। তাদের ভাষায় “The Green Revolution of the 1960s and 1970s brought high yielding plant varieties to the fields of the developing world. It also brought greatly increased use of insecticides.” অর্থাৎ সবুজ বিপ্লব ১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর দশকে উন্নয়নশীল দেশে উচ্চ ফলনশীল ফসল মাঠে এনেছে, কিন্তু একই সাথে কীটনাশকের ব্যবহারও বাড়িয়েছে (ফাও) । এর ফলে পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়েছে। একই সাথে উপকারী পোকাও ধ্বংস হয়েছে। ফলে বিজ্ঞানীরা সমন্বিত কীটনাশক ব্যবস্থাপনা (IPM) উদ্ভাবন করেছেন। এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে উৎপাদনে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা এবং কৌশলে স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে ফসল ফলানো এবং কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনা। ২০০০ সাল থেকেই বিভিন্ন দেশে আইপিএম ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ কীটনাশক ব্যবহার কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। আইপিএম-এর সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এই পদ্ধতি কীটনাশক ব্যবহার কমাবার পরামর্শ দেয় কিন্তু বন্ধ করতে বলে না। ফলে কীটনাশকের ব্যবহার সম্পুর্ণ বন্ধ করা সম্ভব হয় নি, কোথাও ব্যবহারও খুব একটা কমেও নি।  তবে এটা ঠিক কৃষক কীটনাশক ব্যবহার কমাতে, এমনকি বন্ধ করতে, এখন খুব আগ্রহী। কৃষকের সচেতনতা বৃদ্ধিতে আইপিএম-এর কিছুটা ভূমিকা আছে।

কিন্তু কীটনাশক ব্যবহার কমাতে হলে কিংবা বন্ধ করতে হলে শুধু উৎপাদন পদ্ধতি বদলালেই হবে না,এর সাথে জড়িত রয়েছে বীজের ব্যবহার। উফশী কিংবা হাইব্রীড বীজের সাথে কীটনাশক ব্যবহার ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। প্রযুক্তি বদলের ক্ষেত্রে বীজের ধরণের পরিবর্তন খুব দ্রুত নজরে পড়ে।

কৃষিখাতের কর্পোরেট চরিত্র ও বহুজাতিক দখলদারি

উফশী ও হাইব্রীড বীজ প্রযুক্তির পরিবর্তনের এই প্রেক্ষাপট দেয়া হোল কৃষি খাতের কর্পোরেট চরিত্র ও বহুজাতিক কৃষি কোম্পানি খাদ্য চক্রে একচেটিয়া কায়েমের শর্ত তৈরির ক্ষেত্রে গ্রিন রেভলিউশানের ভূমিকা বোঝানোর জন্য। আধুনিক কৃষির কারনে বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি গড়ে উঠেছে। কৃষকের বীজের জায়গায় যখন উফশী ও হাইব্রিড বীজ প্রবর্তনের সরকারি নীতি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহন করা হোল  তখন বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি, এতোদিন যারা কীটনাশক, ওষুধ কিংবা অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবসা করতো তারা এখন কৃষি ফসলের বীজের ব্যবসায় নেমে পড়ল। তারা শুধু বীজের ব্যবসা করেই সন্তুষ্ট নয়, বীজের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্যে বীজ অবৈধ ভাবে পাচার শুরু করে দিল (biopiracy)  কিম্বা পেটেন্ট করে ফেলছে। বীজ চুরি করে কিম্বা প্যাটেন্টের মাধ্যমে কর্পোরেশান বীজের প্রকৃত মালিক হয়ে যায়। হাজার বছরের কৃষিতে হাজার জাতের বীজ উদ্ভাবন করেও কৃষক কখনো বীজের ওপর মালিকানা নেয় নি কারণ বীজ প্রকৃতির অংশ। বীজের অপর সকলেরই অধিকার। বীজ প্রকৃতির উৎপাদন চক্রের মূহূর্ত মাত্র। কেউ বীজ সৃষ্টি করতে পারে না, একটু আধটু বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করতে পারে মাত্র।

বীজ মাঠ থেকে হারিয়ে কোম্পানির দখলে যাওয়ার অর্থ বীজের উৎপাদন চক্রে ফিরে যাওয়ার স্বাভাবিক চক্র ব্যাহত করা এবং কার্যত বীজ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি দেশে কৃষি ব্যবস্থার ওপর কর্পোরেট ও বিদেশি আধিপত্য কায়েম করা। কিন্তু যেই সময় থেকে বহুজাতিক কোম্পানি বীজের ব্যবসায় হাত দিয়েছে তখন থেকেই বীজের ওপর পেটেন্ট (Intellectual Property Rights) নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO) দেনদরবার শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ETC প্রকাশিত Who Owns Nature শীর্ষক প্রতিবেদন (২০০৯) প্রকাশের সময় থেকেই বোঝা যাচ্ছি  মালিকানাধীন বীজের বাজার (অর্থাৎ যে বীজে ব্রান্ড নাম আছে এবং কোম্পানির একচ্ছত্র মালিকানা রয়েছে) তাদের সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছে এবং গুটি কয়েক কোম্পানির মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ রয়েছে। যেমন ২০০৭ সালের হিশাব অনুযায়ী মনসান্তো ৪,৯৬৪ মিলিয়ন ডলারের বীজ ব্যবসা করে এবং মালিকানাধীন বীজের বাজারের ২৩% নিয়ন্ত্রণ করে,এর পরে রয়েছে ডু-পন্ট (১৫%),সিনজেনটা (৯%)। মাত্র ১০টি কোম্পানি পৃথিবীর মালিকানাধীন বীজের বাজারের ৬৭% দখল করে আছে। তার মধ্যে উল্লেখিত তিনটি কোম্পানি ৪৭% বাজার দখল করে আছে। এর অর্থ হচ্ছে বিশ্ব কৃষি ব্যবস্থায় গুটিকয়েক বহজাতিক কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রবণতা।

নতুন দিক হচ্ছে,এই কোম্পানিগুলো বিশ্ব বাজারে একচ্ছত্র ব্যবসা কায়েমের জন্য একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের মনসান্তো জার্মানীর ওষুধ কোম্পানি বায়ারের সাথে ব্যবসা এক্ত্রীকরণ বা merge করছে। বিশ্বব্যাপী মনসান্তো বিরোধী আন্দোলনের কারণে মনসান্তো-বায়ার ৬৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে এক্ত্রীকরণ করা হলেও মনসান্তো নাম থাকছে না, শুধু বায়ার নামই থাকবে। (দেখুন, After a $66 billion merger

মনসান্তোর জিএম ফসল প্রবর্তন ও তার কীটনাশক গ্লাফোসেট বিক্রির জন্য যেসব অনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেছে তার কুখ্যাতি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে হল্যান্ডের হেগ শহরে মনসান্তোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিকী আদালতে সারা বিশ্ব থেকে সাক্ষী দেয়া হয়েছে। এবং প্রতিকী আদালতে মনসান্তোকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

মনসান্তো নাম থাকুক বা না থাকুক,মনসান্তো-বায়ার এর সাথে এই মার্জ বিশ্বের কৃষিতে নতুন হুমকির সৃষ্টি করবে। প্রথমতঃ দুটো কোম্পানির মধ্যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বীজ (traited seeds) নিয়ে যে প্রতিযোগিতা ছিল তা থাকবে না, তারা তাদের মুনাফা বাড়ানোর জন্যে ইচ্ছে মতো বীজের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে বীজের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করবে। এই দুটো কোম্পানি সব্জি বীজে বেশি সক্রিয়। মনসান্তোর আগাছানাশক ‘glyphosate’ এবং বায়ারের glufosinate ammonium সর্বাধিক বিক্রিত পণ্য। এইভাবে মার্জ করে তারা বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালি কোম্পানিতে পরিণত হতে চায় যা খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকের অধিকারের জন্যে হুমকি হয়ে উঠবে। http://europa.eu/rapid/press-release_IP-17-2762_en.htm

মার্জ করার প্রক্রিয়া আরও কয়েকটি কোম্পানির মধ্যে চলছে,যেমন ডো এবং ডু-পন্ট (Dow and Dupont) সিনজেন্টা এবং কেমচিন (Syngenta and ChemChina)। বাংলাদেশে এই সব কোম্পানির অস্তিত্ব খুব সক্রিয়ভাবে আছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে সিনজেন্টা এবং মনসান্তো।

গোল্ডেন রাইস ও বিটি বেগুনঃ বাংলাদেশে জিএম ফসলের বেপরোয়া ছাড়

স্বাভাবিক প্রাণকোষের বিকৃতি ঘটিয়ে তৈয়ার করা (genetically modified) যেসব প্রযুক্তির প্রবর্তনের ওপর বৈজ্ঞানিক নজরদারি ছাড়াও সামাজিক,আইনী ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকা অপরিহার্য,জিএম ফসল তেমনি একটি প্রযুক্তি। প্রাণ ও পরিবেশের নিরাপত্তা,প্রাণের বৈচিত্র্যের ক্ষয়,কৃৎকৌশলের ক্ষতিকর দিক,মানুষের স্বাস্থ্য এবং আরও নানান দিক বিবেচনা করে প্রাণ বিকৃত করে বানানো প্রযুক্তির ওপর নজরদারি না থাকলে একটি দেশের কৃষি,পরিবেশ,প্রাণের বৈচিত্র্য ও প্রাণের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে।

বাংলাদেশের মতো উর্বর ও প্রাণবৈচিত্র সমৃদ্ধ একটি দেশে নির্দয়ভাবে জিএম ফসল উৎপাদনের জন্যে বিদেশী কোম্পানিগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে কারণ একে একে বিভিন্ন দেশ তাদের মাটি এই জিএম ফসলের জন্যে ব্যবহার করতে দেবে না, কারণ জিএম ফসলের ক্ষতির দিক প্রকট হয়ে উঠছে। বিশ্ব এখন সে দিকেই যাচ্ছে। তাই জিএম ফসল প্রবর্তনকারী কোম্পানির এমন কিছু দেশ লাগবে যেখানে জিএম ফসলের ক্ষতির কথা গ্রাহ্য করা হবে না,তারা অনায়াসে সরকারের সাহায্যে শুরু করে প্রাইভেট সেক্টরের মাধ্যমে বিকৃত বীজ চালিয়ে নিতে পারবে।

কৃষিতে জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং বা জেনেটিক মডিফিকেশন প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিক কিছু আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্র্য চুক্তি সনদে (CBD) অণুস্বাক্ষর করেছে ২০ মার্চ ১৯৯৪ তারিখে। পরিবেশ,প্রাণবৈচিত্র্য এবং মানব স্বাস্থ্যের ওপর জিএমও-র বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কার্টেগেনা প্রোটকল (Cartagena Protocol on Biosafety-CPB, 24 May 2000) অণুস্বাক্ষর করেছে।

দেশে একটি বায়োসেফটি প্রটোকল করার জন্য ২০০৬ সালে ন্যশনাল বায়োসেফটি ফ্রেমওয়ার্ক (NBF) গৃহিত হয়। এই ফ্রেমওয়ার্কে বাংলাদেশে জিএমও নিয়ন্ত্রণের জন্য ভিত্তি তৈরি করা হয়। বিদ্যমান বিধিবিধানের বিবরণ এবং স্বচ্ছ কার্যকর আইনী ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা এবং ভবিষ্যৎ চাহিদার রূপরেখা প্রনয়ন করা হয়। ফ্রেমওয়ার্কের পাঁচটি অনুচ্ছেদের তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বায়োসেফটির বিদ্যমান প্রশাসনিক বিধিবিধান বাংলাদেশের জন্য কতটা কার্যকর তা মূল্যায়ন করা এবং যথাযোগ্য ক্ষেত্রে নতুন বিধিবিধান তৈরি করার সুযোগ রাখা হয়েছে। সেই মতে বাংলাদেশ বায়োসেফটি রুলস-২০১০ প্রস্তুত করা হয়েছে। বায়োটেকনোলজি এবং মারাত্মক ক্ষতিকর জীব-অণুজীব উৎপাদন,ব্যবহার,আমদানি-রফতানী,সংরক্ষণ অথবা জিএমও,এলএমও এর প্রভাব থেকে পরিবেশ-প্রকৃতি,প্রাণবৈচিত্র্য,মানব স্বাস্থ্য কিভাবে রক্ষা করা যাবে তার বিধিবিধান রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশে জিএম ফসল হিশাবে গোল্ডেন রাইস নামক জিএম ধান, যা ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ধান নামে প্রবর্তন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল ধান বিআর-২৯,ফিলিপাইনে অবস্থিত আন্তজার্তিক ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট এর আই আর-৬৪ (IR-64),এবং ফিলিপাইনের একটি জাত RC-28 এর সাথে ভুট্টার জিন ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ভূট্টার বিটা কেরোটিন ব্রি ধান-২৯ এর মধ্যে ঢুকিয়ে ভিটামিন-এ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে দাবি করা হচ্ছে। প্রথম অবস্থায় ডেফোডিল ফুলের বিটা কেরোটিন স্থাপন করে এই জিএম (বা বিকৃত) গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে প্রায় একযুগ ধরে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিকভাবেই সফল হয় নি। তাই দ্বিতীয় পর্যায়ে ডেফোডিলের পরিবর্তে ভুট্টা থেকে বিটা কেরোটিন নেয়া হয়েছে। সিনজেন্তা কোম্পানির তৈরি এই জিএম ধানের নাম দেয়া হয়েছে ‘গোল্ডেন রাইস’। বাংলাদেশকে তারা পরীক্ষাগার এবং বাজারজাতের স্থান হিশাবে ব্যবহার করছে। ধান এবং ভূট্টার মতো দুটি ভিন্ন জাতের ফসলের একত্র করলে তার ফলাফল কি হতে পারে বৈজ্ঞানিকভাবে তার কোন তথ্য ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এখনও উদ্ভাবকরা এখনো দেয় নি।

ধানের স্বাভাবিক চরিত্রে বিকৃতি ঘটিয়ে এর মধ্যে বিটা কেরোটিন ঢুকিয়ে অনুমান করা হচ্ছে শরীরে গিয়ে এই বিটা কেরোটিন ভিটামিন-এ রূপে রূপান্তরিত হবে। ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতি এবং রাতকানা রোগের যুক্তি দেখিয়ে গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের সাথে কোম্পানির স্বার্থ জড়িত। এর সাথে গরীবের রাতকানা রোগ নিরাময়ের কোনোই সম্পর্ক নাই কারণ ভিটামিন ‘এ’ পাওয়ার উৎস বাংলাদেশের অনেক খাদ্যের মধ্যে আছে। এই বিষয়ে বাংলাদেশ পুষ্টিবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানেও অনেক গবেষণা হয়েছে। অনেক ধরণের শাক যেমন কাঁটানটে,সাজনাপাতা,কলমি,পুঁইশাকসহ আবাদি ও অনাবাদী শাকের তালিকা রয়েছে। তাছাড়া গাজর,মিষ্টিকুমড়া,মিষ্টি আলু,সীম ঢেঁড়স, পুঁইশাক,ডাটাসহ অনেক ভিটামিন এ সমৃদ্ধ সবজি আছে। ফলের মধ্যে পাকা পেঁপে, বাংগী, কাঁঠাল,আম,কলা,আনারসসহ বিভিন্ন ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ আছে। যা আমাদের দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। ঢেঁকিছাঁটা চালের মধ্যে ভিটামিন ‘এ’ এর পর্যাপ্ত পরিমানে রয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান এবং বিশেষ করে ধান উৎপাদনকারী দেশ। এই মুহুর্তে স্বাভাবিক প্রাণকোষের বিকৃতি ঘটিয়ে তৈয়ার করা ধান বা জিএম ধানের অনুপ্রবেশ ঘটালে আমাদের দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ফসল ধানের ওপর নানা ধরনের হুমকি সৃষ্টি হবে।

গোল্ডেন রাইসের গবেষণা আগে হলেও জিএম বা বিটি বেগুন ২০১৩ সালে তড়িঘড়ি অনুমোদন নিয়ে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে মাঠ পর্যায়ে চাষের মাধ্যমে সরকারিভাবে প্রবর্তন করে বাংলাদেশে জিএম খাদ্য ফসল উৎপাদনকারি দেশ হিশেবে বিশ্বের আরও ২৮টি দেশের কাতারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি করা হয়। বিটি বেগুন জিন কৌশলে বিকৃত একটি জিএম সব্জি ফসল। ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস (বিটি) ব্যাকটেরিয়া থেকে ক্রিসটাল জিন বেগুনে সংযোজন করা হয়েছে,অর্থাৎ দুটি ভিন্ন প্রানের জিন,(উদ্ভিদ ও প্রাণী),সংযোজন করা হয়েছে;ফলে এই ফসল ট্রান্সজেনিক (Transgenic)। উদ্দেশ্য হিশেবে বলা হয়েছে বেগুনের ফল ও কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড বীজ কোম্পানি (মাহিকো) বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনসান্টোর সহায়তায় বেগুনের জিন বিকৃতির এ কাজটি সম্পন্ন করে ২০০৫ সালে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) এ কাজের সাথে যুক্ত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ABSP-II প্রকল্পের অর্থায়নে বারি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। সরকারি প্রতিষ্ঠান এই পরীক্ষা করলেও সার্বিক নিয়ন্ত্রণ আগাগোরা মনসান্তো এবং তার সহযোগীদের হাতেই থেকেছে।

বেগুন একটি গুরুত্বপুর্ণ এবং সকল শ্রেণীর মানুষের জন্যে অতি প্রিয় এবং প্রয়োজনীয় সব্জি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুন্দর সুন্দর নামের বেগুন আছে। তারই মধ্যে ৯টি স্থানীয় জাতের বেগুনে বিটি জিন ঢুকিয়ে জিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্তো তার ভারতীয় অংশীদার মাহিকো। আমাদের দেশের কৃষি গবেষনা প্রতিষ্ঠান তাদের হাতে কৃষকের ৯টি বেগুনের জাত তুলে দিয়েছে কৃষকের অজান্তে। এই বেগুনের ওপর মালিকানাও নিয়ে নেয়া হয়েছে চুক্তি করে।

বেগুনের ওপর জেনেটিক কারিগরি করার সুদুর প্রসারী প্রভাব রয়েছে। ডি ক্যানডোল (১৮৮৬) অরিজিন অব কালটিভেটেড প্লান্টস (আবাদী ফসলের আদি উৎপত্তিস্থল) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে প্রচীন কাল থেকে বেগুন (Solanum melongena) প্রজাতি অবিভক্ত ভারতে পরিচিত। সে অর্থে বেগুন জন্মগত ভাবে এশিয়া মহাদেশের একটি প্রজাতি। রুশ বিজ্ঞানী ভ্যাভিলভ (১৯২৮) এর মতে বেগুনের আদি উৎপত্তিস্থল ইন্দোবার্মা অঞ্চল। আজও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বিভিন্ন আকার আকৃতি ও বর্ণের বেগুন পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক পরিবেশে বেগুনের সর্বাধিক বৈচিত্র্য দেখা যায় বাংলাদেশ ও মায়ানমারে। অর্থাৎ সারা পৃথিবীতে যে বেগুন পাওয়া যায় তা কোন না কোনভাবে এই দেশ থেকে গিয়েছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিশেবে বাংলাদেশে ২৪৮ জাতের বেগুন আছে, কিন্তু উফশি ও হাইব্রিড জাত আসার কারণে স্থানীয় জাত বিলুপ্ত হচ্ছে,এবং চাষের ধরণ বদলে যাচ্ছে। স্থানীয় জাতের সবগুলো বেগুন চাষ না হলেও এখনো বাজারে গেলে কম পক্ষে ৪০-৫০ জাতের বেগুন পাওয়া যাবে। এলাকাভেদে বেগুনের বৈচিত্র্য দেখলে অবাক হতে হয়। বেগুনের বিভিন্ন নাম দেখলে বোঝা যায় তা কৃষকের কত প্রিয়। কোন রকম পেটেন্ট ছাড়াই নাম চলে আসছে শত শত বছর ধরে। এর মধ্যে রয়েছে নয়নতারা,ঝুমকি,লইট্টা,হিংলা,ভোলানাথ, তবলা,ঢেপা,দুধ বা ডিম বেগুন,লাফা,ঘৃত্যকাঞ্চন সহ শত শত জাত।

এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ বিটি বেগুন ১, ২, ৩, ৪ নামক একটি জেনেটিকালী মডিফাইড বা বিকৃত বেগুনের কৃষক পর্যায়ে ছাড়ার যে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তা একেবারেই অপ্রয়োজনীয় এবং অনাখাংকিত। মনে রাখা দরকার বিটি বেগুনের গবেষণা শুধু বাংলাদেশে এককভাবে হয়নি, মোট তিনটি দেশে হয়েছে। তার মধ্যে ভারতে চাষী ও ভোক্তার সংখ্যার দিক থেকেই সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপুর্ণ। ভারতে বিটি বেগুন ছাড় পায়নি স্বাস্থ্য, পরিবেশ ঝুঁকিসহ আদি উৎপত্তিস্থলে কোন প্রকার জিএমও প্রবর্তন না করার নীতির জন্যে। ভারতের টেকনিকাল ইভালুয়েশান কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “আদি উৎপত্তি স্থলে কোন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া জিএম ফসল ছাড় দেয়া যাবে না,কারণ এর ফলে ফসলের বৈচিত্র্যে ক্ষতি হতে পারে”। কম্পানি ভারতে সেই বিশেষ প্রয়োজন দেখাতে পারে নি। বাংলাদেশও তো সে একই অঞ্চলের অংশ। তাহলে বাংলাদেশ কিভাবে জিএম বেগুনের ছাড় দেয়া হোল? এইসব বিষয় নিয়ে বড় ধরণের কোন ক্ষতি হওয়ার আগেই আমাদের সতর্ক হবার বিষয় ছিল,যা পরিবেশবাদীদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও করা হয় নি।

বেগুনে পোকা লাগে বলে ফলনের ক্ষতির যে যুক্তিতে বিটি বেগুন প্রবর্তন করা হচ্ছে,তার কোন ভিত্তি নেই। বিটি বেগুনের পক্ষে যুক্তি হিশেবে দেখানো হচ্ছে যে ডগা ও ফল ছিদ্রকারি পোকার কারণে ৫০ থেকে ৭০% বেগুনের ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এবং তাই কৃষকরা এক মৌসুমে ৮০ বার কীটনাশক প্রয়োগ করে যার কারণে বেগুন বিষাক্ত হয়ে যায় বলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বরাতে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে (১৭ সেপ্টেম্বর,২০১৩) তারিখে প্রকাশিত ‘Modified Brinjal Found Okay’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই তথ্যের পক্ষেও কোন প্রমান দেয়া হয় নি। বিটি বেগুন চাষেও কীটনাশকের ব্যবহার হয়, তার প্রমান আছে। কাজেই বিটি বেগুন মোটেও কীটনাশক মুক্ত নয়।

স্থানীয় জাতের বেগুনে পোকার আক্রমণ তেমন তীব্র হয় না,এবং কীটনাশকও দিতে হয় না কারণ বেগুনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। এসব বেগুনের মনোকালচার বা একাট্টা চাষ হয় না। যেসব স্থানীয় জাতের বেগুন নিয়ে বিটি করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে এই পোকার আক্রমণ তেমন তীব্র নয়। বারির নিজস্ব গবেষণায় দেখা গেছে স্থানীয় জাতের বেগুনে পোকার আক্রমণ খুব কম হয়। যেমন ঝুমকি বেগুনে পোকা খুবই কম লাগে, মাত্র ১ – ১০% (Highly Resistant) খটখটিয়াও মোটামুটি কম লাগে,২০% (Fairly Resistant)। কিছু বেগুন যেমন ইসলামপুরি ২১ – ৩০% পোকার সম্ভাবনা আছে (Tolerant) এবং ইরি বেগুন একটু বেশী লাগে ৪১% এর বেশী। কীটের আক্রমণ রোধই যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে হাইব্রিড বেগুনে কেন বিটি করা হোল না?

বেগুনে শুধু একধরনের পোকার আক্রমণ হয় না,আরো অনেক ধরণের পোকা বা রোগ বালাই হয়। যদিও ডগা ও ফল ছিদ্রকারি পোকার আক্রমনকেই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিটি করার কারণে শুধু ডগা ও ফল ছিদ্রকারি পোকার আক্রমণ বন্ধ করা যাবে, অন্য রোগ বালাইয়ের আক্রমণ ঠিকই থাকবে। অথচ এই সব পোকার ব্যবস্থাপনা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত সম্বন্বিত কীট ব্যবস্থাপনা (Integrated Pest Management) বা আইপিএম পদ্ধতিতে রোধ করা সম্ভব এবং এতে কোন প্রকার স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ঝুঁকি নেই।

একের পর এক ধান, বেগুন, আলুসহ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ফসলে জিএম প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কোর্পোরেট কৃষির দরজা খুলে দেয়া হচ্ছে এবং দেশের প্রাণবৈচিত্র্যর ওপর হুমকি সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই হুমকি মোকাবিলার বৈজ্ঞানিক দক্ষতা ও আইনগত সুরক্ষা আমাদের দেশে নাই। তাছাড়া কৃষকের বীজ রক্ষার অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিকৃত (বা জিএম) বীজের নেতিবাচক প্রভাবের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে,কারণ এই ধরণের প্রযুক্তি একদিকে স্থানীয় ফসলকে দুষিত করছে অন্য দিকে বীজসহ সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থার ওপর বহুজাতিক কোম্পানীর আধিপত্য ও দখলদারি বাড়িয়ে তুলছে। কৃষি ব্যবস্থা যদি কোম্পানির দখলে চলে যায় তাহলে দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

প্রাণবৈচিত্র্য ও কৃষকের বীজ রক্ষার সংগ্রাম চলছেই

বীজের প্রযুক্তি যতোই বড় বড় কর্পোরেশানের হাতে গিয়ে বিকৃত হচ্ছে,ততোই পৃথিবীর বহু দেশে কৃষকের বীজ রক্ষার কাজ নতুন করে দানা বাঁধছে। কৃষক,বিশেষ করে কৃষক পরিবারের নারী,তাঁর নিজের ঘরে সব সময় বীজ রক্ষা,পুনরুৎপাদন ও বীছনের কাজ করেন;কৃষক পরিবারের মেয়েরাই প্রধানত কৃষকের বীজ ব্যবস্থা হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছেন। কৃষকের বীজ ব্যবস্থাই হোল কৃষির প্রাণ,কৃষি ব্যবস্থার ভিত্তি। ১৯৯৬ সাল থেকে যখন খাদ্য নিরাপত্তা (Food Security) কথাটি মূলধারা আলোচনায় এসেছে তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যারা সরাসরি কৃষকের সাথে কাজ করেন তাঁরা আওয়াজ তুলেছেন খাদ্য সার্বভৌমত্বের (Food Sovereignty); খাদ্য নিরাপত্তা রাষ্ট্রের জন্যে, খাদ্য সার্বভৌমত্ব কৃষকের অধিকার এবং বীজের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি রয়েছে।

১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে Convention on Biological Diversity (CBD) বা প্রাণবৈচিত্র সনদের অনুপ্রেরণায় বিভিন্ন দেশে প্রাণবৈচিত্র নির্ভর কৃষি, (Ecological/ organic Agriculture)শুরু হয়েছে। এর মূল কাজ হচ্ছে কোন প্রকার রাসায়নিক সার-কীটনাশক ব্যবহার না করা ও স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় বীজের ব্যবহার করা। শুধু উন্নয়নশীল দেশেই নয়, ইওরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। কমিউনিটি সীড ব্যাংক-এর আন্দোলন গত শতাব্দির ৮০’র দশকের শেষের দিকে আরম্ভ হয়েছে। বাংলাদেশেও সেই একই সময়ে নয়াকৃষি আন্দোলন শুরু হয়। সেই সময় ভয়াবহ বন্যার প্রেক্ষিতে আধুনিক বীজের প্রবর্তনের কারণে স্থানীয় জাতের বীজ হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কৃষকরা প্রবল ভাবে তুলে ধরেন। সে কারণে নয়াকৃষি শুধু রাসায়নিক সার-বিষ বন্ধ করার চাষ পদ্ধ্বতি নয় বরং প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষি হিসেবে নয়াকৃষি আন্দোলন গড়ে ওঠে। শুরুতে শুধু রাসায়নিক সার ও কীটনাশক বন্ধের দিকে জোর দিলেও দ্রুত পরিস্কার হয়ে ওঠে যে আসলে বীজ ঠিক না থাকলে এবং বীজের ওপর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ না থাকলে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। নারী কৃষকরাই প্রধানতঃ এই বিষয়টি তুলে ধরেন।

কৃষকের বীজ ব্যবস্থার গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথাবার্তা বেশি দিনের নয়,অতি সম্প্রতি কালের। আড়ালে পড়ে থাকা কৃষকের জ্ঞান চর্চাকে সামনে নিয়ে এসে ফসলের বীজ এক জায়গায় সংরক্ষণ করা,বিভিন্ন জাত ও প্রজাতির ভালমন্দ বিচার করা,পরিবেশ ও প্রকৃতির উপযুক্ত বীজ নির্বচন করা,পরস্পরের মধ্যে বীজ,তথ্য,জ্ঞান আদান প্রদান এবং জ্ঞানচর্চার কাজকে আরও প্রণালীবদ্ধভাবে করবার তাগিদ থেকে নিজ নিজ দেশের স্থানীয় ও সনাতনী ‘বীজ ব্যাংক’ আন্দোলন সম্প্রতিকালে পৃথিবীর নানান দেশে গড়ে উঠেছে। বিশ্বে কমিউনিটি সীড ব্যাংক বর্তমানে দেশীয় বীজ সংরক্ষণ এবং প্রসারের একটি কার্যকর এবং নির্ভরযোগ্য কৌশল হিশাবে স্বীকৃত হচ্ছে। নয়াকৃষি আন্দোলন লোকায়ত জ্ঞানচর্চার এই ধারাকেই সাংগঠনিক ও বিধিবদ্ধ ভাবে সম্পন্ন করবার জন্য বীজ সংঘ ও বীজ সম্পদ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। যা এখন সারা বিশ্বে পরিচিত। বাংলাদেশে এই ধরণের উদ্যোগ আরও গড়ে উঠেছে।

শেষ কথা

আমাদের এমন কৃষিনীতি দরকার যা কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করে। কৃষি প্রযুক্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও স্থানীয় পরিবেশ, কৃষকের জ্ঞান এবং আমাদের উদ্ভাবনী শক্তিকে প্রাধান্য দিতে হবে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বহুজাতিক কোম্পানি মিলে যে নীতি ও প্রযুক্তি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে তার নেতিবাচক ফল সম্পর্কে কৃষক আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠেছে। বীজের ওপর বহুজাতিক কোম্পানির দখলদারি ও ক্ষতিকর প্রযুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। জনগণ বীজের কারিগরি, বিশেষ করে কীটনাশক নির্ভর হাইব্রিড বীজ এবং জিএমও’র বিষয়েও সচেতন হয়ে উঠছে। জিএমও স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং ক্ষতিকর। জিএমও ফসলের আমাদের কৃষির জন্য আবশ্যিক কোন টেকনলজি নয়। এর প্রবর্তন বিপজ্জনক কারন স্বাস্থ্যের ওপর জিএম ফসলের খারাপ প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার চেয়েও তার বাজার বাড়াবার পদক্ষপই শুধু নেওয়া হচ্ছে। কর্পোরেট কৃষি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পায়, অথচ প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করে জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কোন পরিকল্পনা আমরা দেখি না। কোম্পানি নয়, কৃষক পরিবারকে শক্তিশালী করাই খাদ্য সার্বভৌমত্ব অর্জন করার পথ।

কারণ, শেষাবধি কৃষকই আমাদের খাদ্য জোগায়, কোম্পানি নয়।

ফরিদা আখতারঃ নির্বাহী পরিচালক, উবিনীগ
পরিবেশ, উন্নয়ন ও নারী অধিকার কর্মি

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।