এক: তাজিকিস্তানে তাজিকদের সঙ্গে
২০ জুন, ২০১৯ তারিখে খুব ভোরে প্রায় সাড়ে তিনটায় টার্কিস এয়ারলাইনের বিমানে করে দুসাম্বে এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম তখন সূর্য ওঠে নি। একটু আলো-আঁধারিতে নামলাম। ইস্তাম্বুলে দীর্ঘ যাত্রা বিরতি খুব আরামদায়ক ছিল না। আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টগুলো দিনে দিনে সাধারণ যাত্রীদের জন্য কষ্টদায়ক হয়ে উঠছে। ব্রান্ডের ডিউটি ফ্রী শপ নানান বিলাস সামগ্রীতে ভরা অথচ সাধারণ যাত্রীদের খাবার জন্য ভাল কোন ব্যবস্থা নাই। এই রুটটি প্রবাসী শ্রমিকদের রাস্তা, ভাবছিলাম যাতায়াতে তাদের কত না কষ্ট হয়। ইস্তাম্বুলে আমার নিজেরও খুব কষ্ট হয়েছে দীর্ঘ আট ঘন্টা বসে থাকতে।
দুসাম্বে এয়ারপোর্ট ছোট, চার পাশে পাহাড়ের সারি, ভোরের আলোতে সুন্দর দেখাচ্ছিল। কিন্তু পাহাড়গুলোকে কেমন যেন ন্যাড়া মনে হচ্ছিল, গাছ মোটেও নেই। মাথায় পরিবেশ চিন্তা নিয়ে বেশ অনেকটা উদ্বিগ্নও হয়ে গেলাম, বনায়ন ধ্বংসের কথা ভেবে। কিন্তু আসলে তা মোটেও নয়, জানতে পারলাম আরো অনেক পরে।
এয়ারপোর্ট ছোট হলেও বেশ অনেকটা পথ হাঁটতে হোল এরাইভাল লাউঞ্জে আসতে। আমরা যারা অন-এরাইভাল ভিসা নেবো, তাঁরা ভিন্ন লাইনে ছিলাম। দেখতে দেখতে ভিড় বাড়তে লাগলো, কিন্তু যিনি ভিসা দেবেন সেই ভিসা কাউন্সিলর সেখানে ছিলেন না। লাউঞ্জের বড় বড় কাঁচের জানালা দরজা, তাই বাইরে দেখা যাচ্ছিল। সুর্য ধীরে ধীরে উঠছে, বাইরে বেশ আলো হয়ে গেছে। আমাদের ভিসা অফিসারের দেখা নেই। তিনটি ভিসার কাউন্টার থাকলেও শেষ পর্যন্ত আসলেন একজন। বেশ তৎপর একজন তরুণ অফিসার। স্মার্ট। তিনি এসেই একজন দুইজন ভি আইপির কাজ সেরে নিলেন। আমরা দাঁড়িয়েই থাকলাম। পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে পায়েও ব্যাথা অনুভব করতে লাগলাম।
ভোর প্রায় ৫টার দিকে আমি লাইনের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ভিসা অফিসার পাসপোর্ট নিলেন। আমার কাছে ভিসা আবেদনের যেসব কাগজ ছিল সব দিলাম। কিন্তু এইসময় তিনি হঠাৎ মাথায় বাজ পড়ার মতো কথাটি শোনালেন, “আপনার ভিসা এখনো অনুমোদন হয় নি। এটা অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত ভিসা দেয়া যাবে না। তারপর তিনি মোকাব্বেত মামাডালিয়েভা এর সাথে কথা বললেন। সব মিলে যা দাঁড়ালো তা সার সংক্ষেপ হচ্ছে আমাকে তাদের বৈদেশিক মন্ত্রণালয় সকাল ৮ টায় খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মোকাব্বেত ‘জান ওয়া জমিন’এর নির্বাহী পরিচালক, যাদের আমন্ত্রণে আমি তাজিকিস্তানে। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে এই ভোর বেলা এয়ারপোর্টে চলে আসলেন, এবং আমার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা হোল। শেষ পর্যন্ত বেলা ১১টায় সব নাটকের অবসান করে আমাকে ভিসা দেয়া হোল।
সকাল ৫ টা থেকে ১১টা অনেক সময়, এই সময় দুসাম্বে এয়ারপোর্টের এমন একজায়গায় বসে ছি্লাম যাকে এক অর্থে বর্ডার বলা যেতে পারে। মোকাব্বেত ইমিগ্রশনের এই পাড়ে আসতে পারছিল না, আর আমি মাত্র দুই হাতের ব্যবধানে থাকা সত্ত্বেও তার কাছে গিয়ে কথা বলতে পারছিলাম না। এই সময় বেশ কয়েকটি বিমান আসল, যাত্রীরা এক ঝাঁকে এসে আবার ইমিগ্রেশন পার হয়ে চলে গেলে এই স্থানটি একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। এই সময় সেখানে পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত নারী, মাল টানাটানি করছিলেন এমন কিছু শ্রমিক পুরুষ এবং মাঝে মাঝে দুএকজন অফিসার পদের নারী ও পুরুষ আসা যাওয়া করছিল। লক্ষ করলাম প্রায় কাজেই নারী এবং পুরুষ আছেন এবং তাঁরা খুব স্বতঃস্ফুর্তভাবে কাজ করছেন। ইমিগ্রেশান অফিসার পদে বেশ কয়েকজন নারীকে দেখলাম। শতভাগ মুসলমানের দেশ হিসেবে তেমন কোন সমস্যা আছে বলে মনে হোল না।
আমি যে বসে আছি এটা অনেকেরই চোখে লেগেছে। ইংরেজী জানা নাই বলে অনেকে কথা বলেন নি, তবে আমাকে শাড়ী পরা দেখে ভারতীয় বলে ধরে নিয়ে খুব আদবের সাথে নমস্তে বললেন অনেকে। আমিও তাৎক্ষণিক শোধরালাম, আমি ভারতীয় নই আমাকে আসসালামু আলায়কুম বলতে পারেন। খুশি হয়ে তারা অনেক সালাম দিলেন আবার কেউ কেউ ‘নমস্তে’ বলার জন্যে ক্ষমাও চাইলেন। এই টুকু ইংরেজী দেখলাম অনেকেই জানেন, বললেন ‘সরি’ । এরই মধ্যে এক তরুণি ইমিগ্রেশন অফিসার আমার কাছে এসে হিন্দীতে (ঠিক হিন্দি নয় সে আসলে উর্দু বলছিল) কথা শুরু করে দিল। ব্যাপার কি জানতে চাইলো। আসলে সে লাক্ষনৌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে পড়াশোনা করে এসেছে। কাজেই তার হিন্দী আর হিন্দী নাই, সেটা উর্দু হয়ে গেছে। মেয়েটির নাম মাতলুবা। সে আমাকে এক বোতল পানি এনে দিল। তার মনে হয়েছিল আমার কিছু খাওয়া দরকার। কিছু ক্ষণ পর পর এসে খোঁজ নিতে শুরু করতে থাকলো। এরই মধ্যে এয়ারপোর্ট কাস্টমস এর বেশ কিছু নারী ও পুরুষ তাদের সুপারভাইজাররা তাদের একধরণের প্রশিক্ষণ দিল। সেটাও দেখলাম। ভালই লাগছিল।
মোকাব্বেত অন্যদিকে আমার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। আমি কিছু খাইনি বলে সে খাবারের ব্যবস্থার অনুমতি চাইলো। সেই সময় কর্তব্যরত প্রায় সকল অফিসারই আমার জন্যে সহানুভুতিশীল। তবে তাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। এখন পররাষ্ট্রে মন্ত্রণালয়ের কাছেই সব। একসময় আমার জন্যে খাবারের ব্যবস্থা করলো। বার্গার এল। আমি বার্গার খেতে পছন্দ করি না, কিন্তু এই বার্গারটা আমার এতো মজা লাগলো কেন বুঝলাম না। ইতিমধ্যে কাউন্সিলারও আমার কাছে এসে জানতে চাইলো আমার কিছু লাগবে কিনা। আমি বললাম আমার লাগেজ কেমন করে পাবো সেই চিন্তায় আছি। আমার স্যুটকেসে আমার ওষূধ আছে শুনে সে নিজে গিয়ে লাগেজের জায়গায় আমার দুটো স্যুটকেস আমাকে দিল। বড় শান্তি পেলাম। বার্গার খেয়ে ওষুধ খেতে পারলাম।
মাতলুবার কাজ একটু কম ছিল, তাই এসে আমার সাথে উর্দুতে গল্প জুড়ে দিল। তার কাছে আমি অনেক কিছু জেনে নিলাম। পাহাড় ন্যাড়া কেন জানতে চাইলে সে একটু মনে হোল অবাক হোল। সে বললো এগুলো এয়ারপোর্টের কাছে বলে হয় এমন লাগছে। কিন্তু পাহাড় ন্যড়া কেন তার আরো ভাল ব্যাখ্যা পেয়েছি আরও পরে। মাতলুবা জানালো এখানে নারী পুরুষ সব একসাথে কাজ করে। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ খুব একটা নেই। এখানে এই পার্থক্য খুব বোঝা যায় না। তাজিকিস্তানে ১০০ ভাগই মুসলমান, কিন্তু তারা ইসলামের কোন কড়া কড়িতে নেই। মেয়েরা সব ধরণের পোষাক পরতে পারে, কোন বাধা নেই। কিন্তু তার পরেই সে বলল এখানে হিজাব পরা নিষিদ্ধ্ করা হয়েছে, মুখ ঢাকা বোরকাও পরতে পারবে না। কর্মজীবি মেয়ে কিংবা ছাত্রীরা কোন হিজাব বা বোরকা পরতে পারবে না। কিন্তু এসব নিয়ে অনেক প্রতিবাদ হয়েছে। তাই এখন দুএকজনকে হিজাব পরতে দেখা যায়। মসজিদ শুধু পুরুষদের জন্য, কোন নারী মসজিদে যায় না। এর বিরুদ্ধেও আন্দোলন হচ্ছে। বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার ইসলামিক বিধান অনুসারেই হয়।
ভিসা পেয়ে এক পর্যায়ে আমরা দুসাম্বে এয়ারপোর্ট থেকে বেরুলাম। বাইরে ‘জান ওয়া জমিন’ এর ড্রাইভার এবং কর্মীরা অপেক্ষা সেই সকাল থেকে। একজন কৃষিবিদ উপদেষ্টাও ছিলেন। তাঁরা অত্যন্ত সুন্দরভাবে স্বাগত জানালেন। গাড়ীতে করে রওয়ানা দিলাম প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের ভ্যেনুর দিকে। এটা এয়ারপোর্ট থেকে দূরে, দুসাম্বে শহর থেকেও আধা ঘন্টা পথ। মোকাব্বেত নেমে গেলেন তাঁর বাড়ীতে, আমার সাথে দুজন স্টাফকে দেয়া হোল। তবে তাঁরা ইংরেজী মোটেও জানেন না। কাজেই কথা বলার উপায় ছিল না।
গাড়ী চলতে শহরের বাইরে আসতেই চোখে পড়লো দুপাশে সুন্দর পাহাড়গুলো। এখন আমার প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেই পেলাম। পাহাড়গুলো ন্যাড়া নয়, ওটাই ওদের জমি। সব পাহাড়েই ফসলের চাষ হচ্ছে। যেন জমিগুলো একটু ফুলে ফেঁপে উঠেছে এমনই লাগছিল। অবশ্য এমন উঁচু নিচু, ঢালু জায়গায় কেমন করে চাষ করে, ফসল কাটে, তা জানার কৌতুহল থেকেই গেল।
শেষ পর্যন্ত আমাম্র গন্তব্য ‘সানাটোরিয়াম’ এ এসে পৌছুলাম। তারা যত্ন করে আমাকে রুমে পৌঁছে দিল। দুপুরে খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। বিকেলে উ্ঠে সুর্য না ডুবতেই রাতের খাবার বা ডিনার খেতে হোল। সবার এক সাথে খাওয়া তাই খেতেই হবে।
খাওয়ার পর দেখলাম সবাই বাইরে বসেছেন। আমিও গেলাম। ভাষার সীমাবদ্ধতা থাকলেও তাদের আন্তরিকতা বুঝতে কোন কষ্ট হচ্ছিল না। বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারীই নারী, নানা বয়সে। ষাটোর্ধ্ব বয়সের অনেকেই আছেন। তাতে কি! গান হচ্ছে। অংশগ্রহণকারীরা সবাই বাইরে খোলা জায়গায় বসে গান শুনছে। আবার কয়েকজন উঠে উঠে নাচছেন। দেখতে খুব সুন্দর। ওদের নাচের মধ্যে শরীরে দুলুনি নেই আছে পা ও হাতের কাজ। গানের ছন্দ ও তালের সাথে মিলিয়ে হাতের নানা ভঙ্গীতে ফুটিয়ে তুলছেন এক অপূর্ব ভঙ্গী।
প্রথম দেখাতেই, এতো ঝড়ঝক্কির পরও, ভাল লাগল তাজিকিস্তান।
(চলবে)
২১ জুন ২০১৯