কাশ্মিরের নারী: নারীমুক্তি ও স্বাধীনতা


কাশ্মির পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশে আমরা বেশ উদ্বিগ্ন। এমন নয় যে কাশ্মিরে এখন যা ঘটছে তা হঠাৎ করে হয়েছে বলেই এই উদ্বিগ্নতা। বিগত ৭০ বছর ধরে, ১৯৪৭ সালের পর থেকেই কাশ্মির নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে বিরোধ ও কাড়াকাড়ি তার বিরুদ্ধে কাশ্মিরের মানুষ সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। বিশেষ করে ভারত অধ্যুষিত জম্মু ও কাশ্মিরে ভারতীয় সৈন্যদের দমন-পীড়ন আমাদের সকলের জানা। এরই মধ্যে কাশ্মীরের জনগণ জীবন-যাপন করছেন; লেখা-পড়া, চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সব কিছুই হচ্ছে।

কিন্তু সম্প্রতি গত ৫ আগস্ট ২০১৯ ভারতের বিজেপি সরকার ভারতের সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ রহিত করে জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এরপর তাদের ওপর দমন পীড়ন যেভাবে শুরু করেছে, তাতে বিশ্বের সব দেশের মানুষের বিবেক নাড়া দিয়েছে। ভারত তার দেশের জনগণকে ধারণা দিচ্ছে যে তারা কাশ্মির জয় করে ফেলেছে, আর বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশিদের বলছে এটা নিছক একটা আভ্যন্তরীণ ( যেন বা পারিবারিক) বিষয়। কাজেই বাইরের কারো নাক গলানোর দরকার নেই। কিন্তু কাশ্মির তো কখনো ভারতের অভ্যন্তরেই ছিল না, এখন আভ্যন্তরীণ বিষয় হয় কেমন করে। এসব প্রশ্ন আছে বলেই উদ্বিগ্নতা। সারা বিশ্বে প্রতিবাদ? এই প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কি বন্ধ রাখা যাবে?

কাশ্মিরের মানুষ ৫ আগস্ট থেকে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন, বাইরের জগতের সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। ইন্টারনেট, টেলিফোনসহ সব ধরণের যোগাযোগের মাধ্যম বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অথচ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছেন বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা হয়েছে উন্নয়নে সুযোগ দেয়ার জন্যে। ভারতের মিডিয়াও বোঝাতে চাইছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আছে , অর্থাৎ কাশ্মিরের মানুষ খুশি হয়েছে এখন তারা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চলে এসেছে। এটা যে প্রপাগান্ডা তা ইতিমধ্যে ভারতের মূলধারার মিডিয়ার বাইরে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে। একাত্তরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান সম্পর্কে পাকিস্তানী প্রপাগান্ডা মনে করুন।

কাশ্মিরের নারীদের প্রতি ভারতীয় দখলদারি সৈন্যদের নির্যাতন বেড়েছে এবং ভারতের পুরুষদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি করা হয়েছে যে কাশ্মিরের জমি শুধু নয়, কাশ্মিরের নারীও তাদের দখলে! এরকম ভ্রান্ত ও আজগুবি ধারণা নিয়ে বিজেপির নেতারা রাজনৈতিক সুবিধা নিচ্ছেন এবং তাদের সমর্থকদের কাছে পুরুষতান্ত্রিক জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন। পদানত জনগোষ্ঠির নারীদের প্রতি এই কুৎসিত লোভ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। কারণ কাশ্মিরের নারীদের সংগ্রাম ও ইতিহাস সম্পর্কে জানলে যে কেউ তাঁদের দাঁড়িয়ে স্যালুট করবেন। আমি নিজে করছি।

তবে এটা ঠিক কাশ্মির সম্পর্কে বলতে গেলে মনে হয় পুরুষরা যুদ্ধ করছে আর নারী মাতম করছে, নির্যাতিত হচ্ছে। তাই এই লেখায় আমি কাশ্মিরের ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতি এবং কাশ্মিরের নারী সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরছি। এক: পাঁচ আগস্টের পর কাশ্মিরের মানুষ এবং বিশেষ করে নারীরা কেমন আছেন; দুই: কাশ্মিরের নারীর সংগ্রাম।

পাঁচ আগস্টের পর তথ্য আদান-প্রদান বন্ধ থাকায় মূল ধারার মিডিয়াতে খুব বেশি কিছু জানা যায় নি। এখানে দুটি সুত্র থেকে কিছু তথ্য দিচ্ছি। প্রথমটি হচ্ছে, আল জাজিরায় প্রকাশিত শাশা ভাট এর বর্ণনা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে কবিতা কৃষ্ণানসহ কয়েকজন এক্টিভিস্টের প্রতিবেদন “কাশ্মির কেজড (Kashmir Caged)”।

শাশা ভাট, একজন কাশ্মিরি যিনি বিদেশে থাকেন, কিন্তু সেই সময় তার আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন এবং স্বচক্ষে সব ঘটনা দেখছেন আগস্টের ১৬ তারিখ পর্যন্ত। তিনি শ্রীনগরে ৫ আগস্টের আগের ও পরের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তার বর্ণনার প্রয়োজনীয় অংশের একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করছি।

তিনি আগস্টের ১ তারিখ থেকেই দেখেছেন সৈন্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, পর্যটকদের চলে যেতে বলা হচ্ছে, অমর নাথ যাত্রায় আসা তীর্থ যাত্রীদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছিল। হোটেল খালি করতে বলা হচ্ছিল। তবুও আগস্টের ৫ তারিখের আগে দোকান পাট জমজমাট ছিল, কারণ সামনে ঈদুল আজহা এবং এটা বিয়ের মৌসুম। ক্রমেই মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হচ্ছিল, এবং কারফিউ হবে বলে খাদ্য কেনার লাইন পড়ে গিয়েছিল। আগস্টের ৪ তারিখ মাঝ রাতে কারফিউ জারি করা হোল, ইন্টার নেট, ল্যান্ড লাইন ফোন বন্ধ হোল। টিভিও দেখা যাচ্ছিল না। কোন মতে রেডিওতে জানা গেল সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল হয়েছে, রাজনৈতিক নেতারা গ্রেফতার হয়েছেন। রাস্তাঘাট নির্জন হয়ে গিয়েছে, তারই মধ্যে কিছু মানুষ বুক চাপড়ে মিলিটারির দিকে লক্ষ্য করে প্রতিবাদ করছেন।

সাধারণ জীবন যাত্রার জন্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হলে দোকানের শাটার অর্ধেক খুলে কিংবা দোকানীর বাড়ীতে গিয়ে কিনতে হয়েছে। তবে ঈদে বিক্রি করবে বলে যারা গরু, ভেড়া পালন করেছিল তাঁরা বিক্রি করতে পারেন নি। বলতে গেলে সেখানে ঈদ করতে দেয়া হয় নি। শিশুরা ঈদের দিন আনন্দ করার জন্যে বেরুতে পারে নি। কিছু মানুষ যারা কোন মতে কোরবানী দিয়েছেন তারা মাংস বিতরণ করেছেন। এরই মধ্যে মিলিটারির টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ, পেপার স্প্রে ঘরের জানালা দিয়ে চলে আসছে। সেনারা বাড়ী বাড়ী গিয়ে তল্লাসী চালাচ্ছে। অথচ এসব কিছু ভারতের কোন খবরে উচ্চারিত হচ্ছে না। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদী বলছেন ভারতের মানুষ নাকি কাশ্মির সংক্রান্ত এই সিদ্ধান্তে দারুন খুশি হয়েছেন। (দেখুন, India Talked of Peace and Calm in Kashmir, I Saw the Opposite)

গত ৯ থেকে ১৩ আগস্ট, ২০১৯ ( ৫ দিন) শ্রীনগর শহর এবং কাশ্মিরের কয়েকটি ছোট শহর ও গ্রাম ঘুরে এসেছেন Jean Drèze, economist, Kavita Krishnan, Communist Party of India (Marxist-Leninist) and AIPWA , Maimoona Mollah, All India Democratic Women's Association (AIDWA) এবং Vimal Bhai, National Alliance of People's Movements (NAPM)। তাঁরা যা দেখেছেন তার সাথে ভারতীয় গণমাধ্যমের দেয়া তথ্যের কোন মিল নেই। তাঁরা দেখেছেন কাশ্মিরের মানুষ ক্ষুব্ধ, যদিও একটা ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছে। ১৫ আগস্টের পর তারা প্রতিবাদ কর্মসুচি পালন করবে, কিন্তু তারা এও জানেন যে প্রতিবাদ শান্তিপুর্ণ হলেও তাদের ওপর নেমে আসবে দমন ও নিপীড়ন।

এই প্রতিবেদনের নাম “কাশ্মির কেজড”( এখানে দেখুন, Kashmir Caged) । প্রতিবেদনটি দিল্লীতে একটি সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করতে চাইলে তাদের করতে দেয়া হয় নি। এই এক্টিভিস্ট দলটি যখন সেখানে গেছেন তাঁরা মানুষের মধ্যে ক্ষোভ, দুঃখ, যন্ত্রণা এবং প্রতারিত হবার অনুভুতি দেখেছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও কাশ্মিরের মানুষের মধ্যে যে আতিথেয়তা ও আন্তরিকতা দেখেছেন তা তাদের অভিভূত করেছে। সত্যি বলতে কি বিজেপি’র মুখপাত্র ছাড়া কেউই ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বিলোপের পক্ষে বলেন নি। বিশেষ করে যে পদ্ধতিতে বিলোপ করা হয়েছে তা তাদের বিক্ষুব্ধ করেছে।

সরকার জনগণের ক্ষোভ মোকাবেলার জন্যে কারফিউ জারি করে রেখেছে, যার ফলে এখানকার জনগণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। ভারতে প্রচার মাধ্যম যেভাবে কাশ্মিরের অবস্থা স্বাভাবিক বলে বর্ণনা করছে তা একেবারেই বিভ্রান্তিকর। অন্যদিকে মানুষ তার ক্ষোভ প্রকাশের জন্যে কোন প্রতিবাদ করতে পারছে না, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিবাদ এখানে হবেই।

‘স্বাভাবিক’ অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তারা বলেছেন, “এটা কবরের শান্তি”। আর একজন বলেছেন “বন্দুক কি খামোশী” (বন্দুকের নৈঃশব্দ)। Greater Kashmir পত্রিকার ভেতরের পাতা ভরে ছিল সকল বিয়ে-শাদী ও অনুষ্ঠান বাতিলের ঘোষণায়। অসুস্থ মানুষকেও হাসপাতালে যেতে দেয়া হচ্ছিল না। ঈদের দিনে আজান দিতে দেয় নি, মানুষ নিজ নিজ বাড়ীতে ঈদের নামাজ পড়েছেন। একজন নারী বলেছেন “আমাদের মনে হচ্ছে “আমরা যেন জেলখানায় আছি”। কেউ বলেছেন, “আমাদের ভাইয়েরা পুলিশের কাছে বন্দি, আমরা কি করে ঈদের আনন্দ করবো?”

কাশ্মিরের সাধারণ মানুষ ৩৭০ ধারা বিলোপ করাকে ভারতের ধোঁকাবাজি হিশেবে দেখছে। তারা বলছে ৩৭০ ধারা ছিল কাশ্মির এবং ভারতের নেতাদের মধ্যে একটি চুক্তি। এই চুক্তি না হলে ভারতের সাথে কখনই কাশ্মির থাকতো না। এখন তারা চুক্তি বাতিল করেছে, কাজেই কাশ্মিরের ওপর তাদের আর কোন দাবিও থাকতে পারে না। আর একজন ৩৭০ ধারা কে ভারত এবং কাশ্মিরের মঙ্গলসুত্র (যা হিন্দু নারী বিয়ের বন্ধন হিশেবে গলায় পরে) হিশেবে বর্ণনা করেছেন। চুক্তি বাতিলের কারণে সেই বিয়ে আর নেই!

ইতিমধ্যে প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেছে। আগস্টের ৯ তারিখে ১০,০০০ মানুষ শ্রীনগরে প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু তাদের ওপর পেলেট ছোঁড়া শট গান দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। অনেকেই আহত হয়েছেন। দুজন পেলেট বুলেটে আহতকে দেখা গেছে; তাদের চোখ লাল হয়ে আছে, প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে। অথচ তাদের প্রতিবাদ ছিল শান্তি পুর্ণ, একটা ঢিলও তারা ছোড়ে নি।

অল্প বয়সী ছেলেদের বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মেয়েরা অভিযোগ করেছে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। পরিবার আশংকা করছে যাদের তুলে নিয়েছে তারা গুম হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এতো জুলুমের পরও একজন যুবক বললেন, “জিতনা জুলম করেঙ্গে, উতনা হাম উভ্রেঙ্গে”( যত জুলুম করবে, ততই আমরা জেগে উঠবো)। শুধু তাই নয়, একটি কথা প্রায় সব জায়গায় শোনা গেছে। তা হচ্ছে, “ নেতাদের গ্রেফতার করেছে তো কি হয়েছে। আমাদের নেতার দরকার নেই। একটি কাশ্মিরি শিশুও যদি বেঁচে থাকে, আমাদের সংগ্রামও টিকে থাকবে” ।

এই দুটি বর্ণনা ৫ আগস্টের পরের অবস্থা জানার জন্যে খুব সহায়ক। কাশ্মিরের মানুষের মনের জোর আছে, তারা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। তাঁদের সংগ্রাম তাই চলবেই।


 

Killus


কাশ্মিরের নারী যারা জম্মু এবং কাশ্মিরের ভেতর এই মুহূর্তে আছেন এবং যারা বাইরে আছেন কেউই থেমে নেই। এর মধ্যে হামিদা নাঈমের একটি বক্তৃতা (১৪ আগস্ট, ২০১৯) খুব জনপ্রিয় হয়েছে। তিনি এই বক্তৃতায় ভারতের সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি জম্মু ও কাশ্মির প্রিন্সলী স্টেট এর শেষ শাসক মহারাজা হরি সিংয়ের নাতনী। তিনি বলেন “স্পেশাল স্ট্যাটাস তো ভারতীয়রা আমাদের দেয় নি, যেটা অন্যান্য প্রিন্সলি স্টেট চাইতে পারে। আমরাই তাদের সাময়িকভাবে দিয়েছিলাম। আসলে তারা আমাদের ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্ব কেড়ে নিয়েছে এবং আমাদের সংগ্রাম হচ্ছে এই সার্বভৌমত্ব পুনরায় উদ্ধ্বার করা। (এখানে দেখুন)

কাশ্মিরের নারীর সংগ্রামী দীর্ঘ ইতিহাস আছে। মনে করার কোন কারণ নেই যে ভারতে জম্মু ও কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর জমি কেনার যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে তার সাথেই তারা ভাবছে যুদ্ধ জয়ের পর কাশ্মিরের নারীদের ওপরও তাদের দখল কায়েম হবে। বিজেপির কিছু নেতা প্রলাপ বকছেন এই বলে যে ভারতে যেসব রাজ্যে এখন পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা কমে গেছে সেখানকার পুরুষদের জন্য তারা কাশ্মিরি বৌ এনে দেবে!

উল্লেখ্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নারী-পুরুষ অনুপাত এতো কমে গিয়েছে যে বর্তমানে যুবকরা বিয়ে করতে চাইলে বৌ পায় না। প্রতি ১০০০ পুরুষের বিপরীতে নারীর সংখ্যা ৯৩০। কিছু রাজ্যে যেমন হরিয়ানায় আরও কম, প্রতি হাজার পুরুষের বিপরীতে মাত্র ৮৭৯ নারী। হরিয়ানা রাজ্যে বিহার থেকে মেয়ে নিয়ে বিয়ে করানো হোত। সেখানকার মূখ্য মন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টার লজ্জাজনকভাবে ঘোষণা দিচ্ছেন, এখন আর সমস্যা নেই। আমরা কাশ্মির থেকেই মেয়ে নিয়ে আসতে পারবো। অথচ তারা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসুচির আওতায় দুটি সন্তান নীতির কারণে পুত্র সন্তান না হলে কন্যা ভ্রূণ হত্যা করে আসছে বিগত তিন দশক ধরে। অর্থাৎ তারা নিজেদের মেয়েদের মায়ের পেটেই মেরেছে, সবারই পুত্র সন্তান চাই। গর্ভধারণের পর ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে জানা গেলেই গর্ভপাত ঘটিয়ে মেয়েদের জন্মাতে দেয়া হয় নি। এখন তাদের সেই পুত্রধনদের জন্যে পুত্রবধু পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কু-দৃষ্টি পড়েছে কাশ্মিরের দিকে!

কিন্তু কাশ্মিরের নারী সেই রকম দুর্বল নয় যে তাদের হাতের পুতুল হয়ে থাকবে। গত ৭০ বছর ধরে তারা নিজস্ব পরিচয় বজায় রেখে চলেছে। ইকোনমিক এন্ড পলিটিকাল উইকলী এর একটি বিশেষ সংখ্যা উইমেন এন্ড কাশ্মির (EPW VOL LIII NO 47, December 1, 2018) বের করেছে। এই সংখ্যায় বিভিন্ন প্রবন্ধে নারীদের শক্তিশালী রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

হাফসা কাঞ্জোয়াল লিখেছেন ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর যে ন্যাশনাল কনফারেন্স সরকার (বা এনসি সরকার) হয়েছিল তাতে নয়াকাশ্মির ধারণা তৈরি করা হয়েছিল, যার ম্যানিফেস্টোতে নারীর ক্ষমতায়ন যুক্ত করা ছিল। ম্যানিফেস্টোর প্রচ্ছদে জুনি গুজ্জার নামের একজন মুসলিম নারীর ছবি দেয়া ছিল এবং এর মধ্যে একটি অধ্যায় ছিল নারীর অধিকার সম্বলিত। নারীর প্রশ্নে সম মুজুরি, গর্ভকালীন বেতনসহ ছুটি, ব্যবসা বাণিজ্য করা, সম্পত্তিতে অধিকার এবং বিয়েতে সম্মতি প্রদানের মতো গুরুত্বপুর্ণ বিষয় স্থান পেয়েছিল। মেয়েদের শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি করার কথাও বলা হয়েছে। এই সরকারই সাময়িকভাবে ভারতের সাথে যুক্ত হবার অনুমোদন দিয়েছিল। শেখ আব্দুল্লাহ সরকার প্রথম মহিলা কলেজ স্থাপন করেছিলেন ১৯৫০ সালে। এখানে নারী শিক্ষা কোন এলিট চিন্তা থেকে করা হয় নি, বরং নারীকে উন্নয়নের অংশীদার করাই উদ্দেশ্য ছিল। নারীর কাজের পরিসর বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, পেশাগতভাবে নানা কাজে যুক্ত হবার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছিল। অথচ এর আগে মুসলিম নারীদের শিক্ষার কোন সুযোগ ছিল না, বিশেষ করে খান্দানী পরিবার হলে তো কথাই নাই।

এখন আমরা প্রায়ই দেখি কাশ্মিরি নারী বিশাল শোক মিছিলে মাতম করছে। মিছিলে দেখা যাচ্ছে একটি শহীদের লাশ কাঁধে নিয়ে যাচ্ছে আর কান্না ও শ্লোগান একই সাথে হচ্ছে। মনে হতে পারে এখানে যেই নারীরা আছেন তাঁরা সেই লাশের মা, বোন বা নিকট আত্মীয়। কিন্তু আসলে দীর্ঘ দিনের নিপীড়নের মধ্যে থেকে কাশ্মিরেও পাল্টা যুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং সেই যুদ্ধে যারা যাচ্ছে তারা শহীদ হচ্ছে। কাজেই এই লাশ সকলেরই আপনজন। ইনশাহ মালিক তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন কাশ্মিরি নারী, মা হিশেবে, মাতম করলেও সেটা তাঁর একান্তই ব্যাক্তিগত এবং নিজের ভেতরের কষ্ট। কিন্তু কাশ্মিরের নারীরা এই কান্না এবং মাতমকে সংঘবদ্ধ্ প্রতিবাদের ভাষা হিশেবে নিয়েছেন এবং তাঁরা অনেক বেশি সংখ্যায় লাশ নিয়ে শোক মিছিলে যাচ্ছেন এবং মাতম করছেন। তিনি নারীর এই অংশগ্রহণকে “নীরব নারীবাদী বিপ্লব” বলে আখ্যায়িত করছেন কারণ এর মাধ্যমে তাঁরা একদিকে নিজ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বাধা অতিক্রম করছেন অন্যদিকে কাশ্মিরে সামরিক দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ‘শহীদের মা’ হিশেবে নারীকে যেভাবে চিহ্নিত করা হয় তা পুরুষতান্ত্রিক। কাশ্মিরের নারী সেই ধারণাকে ভেঙ্গে দিচ্ছেন।

একটি ঘটনার উল্লেখ করা যাক। সাবজার নামের একজন যোদ্ধার মৃত দেহ যখন তার বাড়ীতে আনা হয় তখন হাজার মানুষ তার মায়ের সামনে। কিন্তু সাবজারের মা কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। সাবজারের লাশ ঘরের ভেতর নিয়ে গিয়ে তিনি পাশে বসে কাঁদলেন; তারপর বাইরে এসে স্বামীকে জানালেন ছেলেকে দাফন করার সময় হয়েছে। তিনি সাবজারের জন্য সবার সামনে শোক করেন নি; সবার সাথে শোক মিছিলে গিয়ে আজাদীর পক্ষে দাবি তুলেছেন। সাবজারের মায়ের এই আচরণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সকল শহীদের মায়েরাই দেশের আজাদীর জন্যে এভাবে তাঁদের দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরেছেন।

তরুণ প্রজন্মের নারীরাও ভারত বিরোধি বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করছে এবং নেতৃত্ব দিচ্ছে, কিন্তু তাদের এই অংশগ্রহণকে হাসিঠাট্টা করে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে কিংবা তাৎপর্যহীন বলে অবহেলা করা হচ্ছে। মীর ফাতিমা কানথ ২০১৭ সালে কলেজ ছাত্রীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিয়ে লিখেছেন। ১৫ এপ্রিল ২০১৭ সালে দক্ষিণ কাশ্মিরের ফুলওয়ামা ডিগ্রী কলেজের সামনে চেক পয়েন্ট বসানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছিল। ছাত্রীরা সেই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে, কখনো নেতৃত্বও দিয়েছে। তাদের বাধা দেয়া হলে ঢিলও ছুড়ে মেরেছে সেনাদের প্রতি। কেন মেয়েরা এই প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করছে জানতে চাইলে তারা বলে মানবাধিকার লংঘনের সীমা এতো বেড়ে গেছে যে তারা বাধ্য হয়েছে এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামতে। আর একজন ছাত্রী বলে, পুলিশের অত্যাচারই তাদের প্ররোচিত করছে। তাদের “এই ক্ষোভ অনেক গভীর” । তরুণ বয়সের নারীদের এভাবে সামনে আসা এমন কি পাথর ছুড়ে মারা নিয়ে ভারতের মিডিয়াতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক – উভয়ভাবেই হৈ চৈ করা হয়। মাথায় স্কার্ফ পরা এবং মুখ ঢাকা নারীদের শ্লোগান দেয়ার ছবি সোশাল মিডিয়াতেও ভাইরাল হয়ে যায়। কেউ বলে নারীদের জঙ্গী বানানো হচ্ছে, কেউ বলে এক নতুন অধ্যায়ের সুচনা হচ্ছে। মিডিয়াতে একটি ছবি খুব প্রচার করা হয়েছে। সেটা হচ্ছে একটি মেয়ে তার এক হাতে বাসকেট বল, অন্য হাত পুলিশের দিকে পাথর ছুঁড়ে মারছে। মেয়েটিকে জিগ্যাস করা হলে কেন সে পাথর মারছে, সে জানায়, “আমরা তো বাস্কেট বল প্রাক্টিস করতেই এসেছিলাম। কিন্তু পুলিশ আমাদের প্রতি অশালীন আচরণ করেছে তাইতো আমরা ঢিল মেরেছি। আমরা তো ঢিল ছোঁড়ার মানুষ নই” । মেয়েরা শ্রীনগর শহরে কলেজে যাবার পথে ও বাস্কেটবল খেলতে এসে ভারতীয় সৈন্যদের ওয়াচ টাওয়ার থেকে “বিশেষ চাহনী” এড়িয়ে চলতে হয়। তারা বাস্কেট বল খেলতে গিয়েও মাথার স্কার্ফ খুলতে পারে না, এবং খুব অস্বস্তিতে থাকতে হয়। এর বাইরেও অনেক ঘটনায় এই মেয়েরা অতীষ্ঠ হয়েই প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। নারীদের এই প্রতিবাদ এখন মিডিয়াতে একটু ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে, কিন্তু কাশ্মির সম্পর্কে যারা জানেন তারা বলছেন নারীরা ১৯৫০, ৬০ দশকেও প্রতিবাদ করেছে, ২০০৮, ২০১০ সালেও করেছে। সে সময় তাদের হাতে লাঠি ছিল, আর এখন তাদের হাতে বাস্কেট বল এবং পাথর দেখা যাচ্ছে। এই যা পার্থক্য।

কাশ্মির দীর্ঘ দিন ধরে সামরিক দখলে থাকার কারণে নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে তাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা প্রতিকূলতার শিকার হচ্ছেন। নারীর ক্ষেত্রে এই সমস্যা একদিকে সামরিকায়ণের নির্যাতন অন্যদিকে সামাজিক ও কাঠামোগত পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র অনেক জটিল আকার ধারণ করে। দীর্ঘ ৭০ বছরে এই আগ্রাসী পরিস্থিতির মধ্যে থেকে কাশ্মিরি নারী নিজ কায়দায় মোকাবেলা করে আসছেন এবং এখনো করছেন। তাদের জীবনের ম্যাপ বছর ধরে গণনা করা যায় না। তারা গোনে কয়টা গ্রীষ্মকাল হত্যাকাণ্ডে কেটেছে, কত মাস কেটেছে গণ চোখ বন্ধ করার (mass blindings) ঘটনায়, অগণিত কারফিউ, মানুষের প্রতিরোধ, রাজনৈতিক বিপর্যয়, দেশ ছেড়ে যাওয়া, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে লড়াই, এবং গণধর্ষণ কত হয়েছে, তার হিশেব করে। শ্রীনগরের কবরে ফুলের বাগান গড়ে ওঠে, বিধ্বস্থ বাড়ী এবং টর্চার সেন্টারে অফিস আদালত করা হয়। ইকোনমিক এন্ড পলিটিকাল উইকলীর এই বিশেষ সংখ্যার সম্পাদকদ্বয় নিতাশা কাউল এবং আতহার জিয়া প্রশ্ন তুলছেন, কাশ্মিরের নারী সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত নয় “তারা কি কথা বলতে পারে?” বরং জিজ্ঞেস করা উচিত, “আপনারা কি তাদের কথা শুনতে পান”?


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।