২. ইউক্রেনের যুদ্ধ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর কপট নীতি
যুদ্ধ মাত্রই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। কোন যুদ্ধই ব্যাতিক্রম নয়। যে কারণে রাশিয়ার যুদ্ধকে নৈতিক বা নীতিবাগীশ জায়গা থেকে অনেকেই 'আগ্রাসন বলে নিন্দা করছেন। আমরাও সরবে যুদ্ধ বন্ধ করা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সকল পক্ষের মধ্যে আলোচনা শুরুর ওপর জোর দিচ্ছি। কিন্তু নীতিবাগীশগিরি আর রাজনীতি দুটো ভিন্ন বিষয়। তাই ইউক্রেন কেন্দ্র করে একদিকে রাশিয়া আর অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোটভূক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে সেটা আমাদের বোঝা দরকার। নির্মোহ ভাবে এই যুদ্ধের বাস্তব কারণ সম্যক অবহিত হওয়া জরুরি। তাই রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে নিজেদের নীতিগত ভাবে ছহি আছি প্রমাণের চেষ্টা এখানে আমরা করব না। বরং মার্কন পররাষ্ট্র নীতির কপটতা নিয়ে আলোচনা করব।
শুরুতেই মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে রাশিয়া তার সামরিক তৎপরতাকে 'যুদ্ধ' বলতে নারাজ। রাশিয়া একে বলছে 'বিশেষ সামরিক ব্যবস্থা' (Special Military Operation)। পুতিন এই অপারেশান শুরু করার সময় ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে দাবি করেছেন ইউক্রেন একটি 'নব্য নাৎসি রাষ্ট্র' (neo Nazi state)। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেনেস্কি একজন ইহুদি। অনেকে বিস্ময় বোধ করেন তাহলে ইউক্রেনকে নব্য নাৎসী বলার কি যুক্তি থাকতে পারে? ইউরোপ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে যে ভাবে ইহুদি গণহত্যা হিশাবে উপলব্ধি করে, রাশিয়ার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। হিটলার রাশিয়ার সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হেনেছিল। অর্থাৎ তারাই নব্য নাৎসি যারা রাশিয়াকে ধ্বংস করতে চায়। ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকে হোলকস্টের সঙ্গে যুক্ত করে দেখে, কিন্তু হিটলারের বাহিনীকে রুখে দিতে গিয়ে রাশিয়াকে বহু প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য রাশিয়ার জনগণের লড়াই তাদের স্মৃতিতে 'নাৎসী' শব্দটি একটি চরম ইভিল বা চরম অকল্যাণ হিশাবে অর্থ ধারণ করেছে।
কপটতা শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের নয়, পাশ্চাত্য গণমাধ্যমগুলোর প্রপাগান্ডার ধরণ বোঝাও একটি কঠিন কাজ। ইউক্রেন যুদ্ধ যখন চলছে তখন আল আকসায় দখলদার ইসরায়েলি সৈন্য মুসল্লিদের ওপর যেভাবে চড়াও হয়েছে ও আক্রমণ করেছে সেই খবর বিশেষ নাই। রাশিয়ার আগ্রাসন নিন্দনীয়, কিন্তু ইসরাইল একটি হানাদার ও দখলদার রাষ্ট্র। এই ধরণের রাষ্ট্রকে Settler Colonial State বলা হয়। কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকা এই হানাদার ও দখলদার রাষ্ট্র টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু তারাই আবার রাশিয়ার ইউক্রেন হামলাকে 'আগ্রাসন' বলছে। আল আকসায় ইসরায়েলী সৈন্যদের হামলার খবর ছাপা হলে বলা হয়, দুই পক্ষে 'সংঘর্ষ' চলছে। যেন লড়াই চলছে সমানে সমানে। দেদারসে এই কপট কারবার চলছে।
ইউক্রেনের শহরগুলির ওপর গোলাগুলি চলছে। পাশ্চাত্য গণমাধ্যমে আমরা দেখছি রাস্তাঘাটে লাশ পড়ে আছে। তাদের দাফন, কবর বা কোন অন্ত্যষ্টি ক্রিয়া হয় নি। পহেলা এপ্রিল থেকে বুচা শহরে রুশ যোদ্ধাদের নৃশংসতা নিয়ে পাশ্চাত্য গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চলছে। পাশ্চাত্য গণমাধ্যমে এই ছবিগুলোর প্রচার যুদ্ধ কৌশলের অংশ হলেও যুদ্ধের নৃশংসতা সম্পর্কে আমাদের হুঁশ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ যাবতকাল যে সকল যুদ্ধ করেছে ও নৃশংসতা দেখিয়েছে সেই ইতিহাস থেকেই নৃশংসতার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাতটা যুদ্ধ ঘটিয়েছে। সেই যুদ্ধের নৃশংসতা ভুলে যাবার কোন কারণ নাই।
৯/১১-পরবর্তী যুদ্ধগুলির কথাই ধরা যাক। মার্কিন এবং ন্যাটো জোটভূক্ত রাষ্ট্রগুলো ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, সিরিয়া এবং পাকিস্তানে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটিয়েছে। একটি হিশাবে দেখা যাচ্ছে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, মার্কিন আগ্রাসন ও যুদ্ধের ফলে এই দেশগুলিতে আনুমানিক ৩৮৭,০৭২ বা তিন লক্ষ সাতাশিহাজার বাহাত্তর জন বেসামরিক সাধারণ মানুষের সহিংস মৃত্যু হয়েছে। সোমালিয়া এবং অন্যান্য দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১-পরবর্তী সামরিক অভিযানের ফলে বেসামরিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে প্রচুর। যুদ্ধক্ষেত্রে বসবাসকারী লোকজনকে তাদের বাড়িতে, বাজারে, রাস্তাঘাটে হত্যা করা হয়েছে। বোমা, গুলি, আগুন, ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) এবং ড্রোন দ্বারা তাদের হত্যার উৎসব হয়েছে (এখানে দেখুন)।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে এপ্রিলের ১৪ তারিখ অবধি বেসামরিক নাগরিক মারা গিয়েছে ১,৯৮২ জন; এদে্র মধ্যে ১৬১ জন রয়েছে শিশু। আহত হয়েছে ২,৬৫১ জন। তথ্যের উৎস জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন। তবে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন জানিয়েছে সংখ্যা আরও অনেক বেশীও হতে পারে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশন বলেছে ২০ এপ্রিল অবধি প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ শরণার্থী হিশাবে নিজের দেশ ছেড়েছে এবং দেশের ভেতরে প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ ইতোমধ্যেই গৃহহারা হয়ে পড়েছে। (এখানে দেখুন)।
পাশ্চাত্য গণমাধ্যম রাশিয়ান আগ্রাসনের ভয়াবহতা কয়েক সপ্তাহ ধরে সংবাদে বিপুল ভাবে প্রচার করছে। যার উদ্দেশ্য যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সংহতি গড়ে তোলা নয়, বরং রাশিয়ার বিরুদ্ধে নৈতিক সমর্থন আদায় করা। রাশিয়াকে নিন্দা করা এবং আগ্রাসী শক্তি হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করা। ফলে এই প্রচার সাংবাদিকতা না হয়ে মার্কিন যুদ্ধ কৌশল অর্থাৎ পরিকল্পিত প্রপাগান্ডার অংশ হয়ে পড়েছে। ফলে দাবি উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী যেন রাশিয়ার এয়ারফিল্ডগুলো বোমা মেরে নষ্ট করে দেয়। এই যুদ্ধকে নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বিচার করবার ক্ষেত্রে ধোঁইয়াশা তৈরি করাই এই সকল প্রপাগান্ডার উদ্দেশ্য। দ্রুত ইউক্রেনকে জ্যাভেলিন্স, ড্রোন এবং স্ট্রিঙ্গার মিসাইল সবরাহ করবার দাবি উঠেছে। শরণার্থির জন্য দাতব্য কর্মকাণ্ড জোরদার চলছে, বিপুল অর্থ দান করছে পাশ্চাত্যের জনগণ। এর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে সীমান্তের দিকে ট্রাক বোঝাই হয়ে তাজা তাজা মারণাস্ত্র যাচ্ছে ইউক্রেনে। এতে পরিষ্কার ইউরো-মার্কিন শক্তির প্রতিজ্ঞা হচ্ছে শান্তি বা আপোষ মীমাংসার জন্য উভয় পক্ষকে চাপ দেওয়া নয়। বরং যুদ্ধ প্রলম্বিত করা এবং যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাস্ত করা। পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে ইউক্রেনের যুদ্ধ মূলত রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন এবং ন্যাটো জোটভূক্ত দেশগুলোর প্রক্সি ওয়ার। হতভহাগ্য ইউক্রেন এখানে দাবার গুটি মাত্র।
যুদ্ধের নৃশংসতা নিয়ে পাশ্চাত্যের কপট ও স্ববিরোধী চরিত্র এর ফলে ল্যাংটা হয়ে যাচ্ছে। উনিশ বছর আগের ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধের ব্যাপকতা এবং নৃশংসতা আমরা স্মরণ করতে পারি। ইরাকে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র আছে এই মিথ্যা অভিযোগ এনে একতরফা যুদ্ধ চালানো হয়েছিল। এক রাষ্ট্র দ্বারা অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে যে যুদ্ধ চালানো হয়েছি তা এখন সকলেই আন্তর্জাতিক নীতি ও আইনের আলোকে ‘বাইনী’ ও ‘অন্যায়’ যুদ্ধ মনে করেন। সেই সময় যে ইরাকিরা বিদেশি হামলার বিরুদ্ধে তাদের দেশ রক্ষার জন্য লড়েছিল পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলো তাদের ‘সন্ত্রাসী’ হিশাবে চিহ্নিত করেছিল। পশ্চিমে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় চাওয়ার আবেদন ফিরিয়ে দেওয়া হয়ছিল। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে তাদের প্রবেশকে সম্ভাব্য নিরাপত্তা হুমকি হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে আমরা টিগ্রে (Tigray National Regional State)-এর নাম শুনেছি কিনা সন্দেহ। এটি ইথিওপিয়ার উত্তরে একটি প্রাদেশিক রাজ্য। এই রাজ্যে টিগ্রে, আইরব এবং কুনামা জাতি বাস করে। ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে টিগ্রের তুলনা করা যায়। কারন ইথিওপিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে টিগ্রের অবস্থা আরও করুণ, যা পাশ্চাত্য গণমাধ্যমে আসে না। ইথিওপিয়ান সৈন্যরা সামরিক অবরোধের মধ্যে রেখে টিগ্রের জনগণের ওপর বছর ব্যাপী বোমাবর্ষণ করেছে। বিদ্যুৎ, খাদ্য এবং চিকিৎসা সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে, আনুমানিক ৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ মানুষ সরাসরি নিহত হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে যুদ্ধের বীভৎস বিভীষিকা, ধর্ষণ। কিন্তু পাশ্চাত্যের মন গলে নি। ইয়েমেন আরেকটি উদাহরণ। পাশ্চাত্যের সমর্থনে সৌদী আরব ইয়েমেনে চিরস্থায়ী বিমান হামলার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছে। শহরগুলোতে কলেরায় শিশুরা মারা যাচ্ছে। প্রত্যক্ষ হামলায় কিম্বা যুদ্ধের পরিণতিতে হতাহতের সংখ্যা প্রায় ২৬০,০০০ বলে অনুমান করা হয়। কিন্তু পাশ্চাত্যের হৃদয় গলে না।
ফিলিস্তিনিরা ভবিষ্যত ইসরায়েলি ও দখলদারির বিরুদ্ধে লড়ছে ষাট বছর ধরে। লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনী ইসরায়েলি সামরিক শাসনের অধীনে বাস করছে। যার কোনো শেষ দেখা যাচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং জার্মানি ফিলিস্তিনিদের নেতৃত্বে বয়কট আন্দোলনকে দমন করার জন্য আইন পাস করেছে, পালটা এখন ম্যাকডোনাল্ডস, এক্সন, মবিল এবং অ্যাপলের মতো বড় সংস্থাগুলি রাশিয়ায় ব্যবসা স্থগিত করে পাশ্চাত্যের হাততালি পাচ্ছে। এই অপরিসিম হিপোক্রাসি ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যারপরনাই নোংরা চেহারা নিয়ে এখন হাজির।
খুব দারুন তামাশা করছেন জো বাইডেন। তিনি দাবি করছেন ভ্লাদিমির পুতিন ওয়ার ক্রিমিনাল, রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপরাধীদের বিচার করতে অন্যদের সাথে কাজ করবে। কিন্তু তামাশা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্যই নয়। শুধু তাই না, তাদের বা তাদের মিত্র ইসরায়েলের দ্বারা সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের আন্তর্জাতিক তদন্তের কথা উঠলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা কঠোরভাবে বিরোধিতা করে। আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বাহিনী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটিয়েচ্ছে, এই অভিযোগ উঠেছে বারবার। কিন্তু তার বিচার দূরের কথা নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তের প্রস্তাবও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা বাধা দিয়েছে। বিচার দূরের কথা।
ইউক্রেনের জনগণের দিক থেকে ইউরোপের যুদ্ধ রাশিয়ার আগ্রাসন। আলবৎ। আমরা অবশ্যই বিদেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আক্রান্ত জনগোষ্ঠির আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকার করতে বাধ্য। কিন্তু ইউক্রেনে একই সঙ্গে রুশ ও ইউক্রেনীয়দের মধ্যে দীর্ঘকাল গৃহযুদ্ধ চলছে। দ্বীতিয়ত রাশিয়া তার নিজের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন সময় পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আপত্তি ও উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছে। কিন্তু মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্র এবং ইউরোপ তাকে পাত্তা দেয় নি। এখনও দিচ্ছে না। বরং তারা তাদের যুদ্ধই ইউক্রেনের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর সামরিক বেষ্টনী ক্রমাগত সম্প্রসারিত করেছে। অনেকে দাবি করেন, ভু-রাজনৈতিক দিক থেকে এটাই যুদ্ধের প্রধান কারন। ভূ-রাজনীতির বৈশ্বিক বাস্তবতার দিক থেকে এই যুদ্ধ মুলত পুতিনের রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বা মার্কিন ও ইউরোপীয় জোটের ‘প্রক্সি ওয়ার’। এই সহজ সত্যটা বাংলাদেশে আমাদের কাছে পরিষ্কার থাকা দরকার। এই বাস্তবতা আগ্রাসন বিরোধী নীতিবাগীশতার বুলি দিয়ে আড়াল করে দেওয়া কঠিন। রাশিয়া আগ্রাসী, রাশিয়াই স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ ইউক্রেন হামলা করেছে, অতএব ইউক্রেনের যুদ্ধকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের বিরুদ্ধে রুশদের আগ্রাসন হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা প্রবল। এটা তো সহজেই দেখা যায়, তাই আমাদের নীতিবাগীশ চেতনা তার প্রতি সাড়া দেয়। সেটা অন্যায় নয়। কিন্তু স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, সরকার বদল বা রেজিম চেইঞ্জ কিম্বা সরাসরি যুদ্ধ চালানোর ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের অপরাধের বোঝা বিশাল এবং ভারি। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই কুকর্ম করে বলে রাশিয়াকে করতে হবে তার কোন যুক্তি নাই। তাই না? এই জন্য প্রথম কাজ হচ্ছে সস্তা নীতিবাগীশতা বাদ দিয়ে ইউরোপের যুদ্ধকে আরও বড় প্রেক্ষাপটে বিচার ও বোঝার চেষ্টা করা।
ইউক্রেন জুড়ে যখন লড়াই চলছে, তখন কোন পক্ষের কথায় মজে না গিয়ে আমাদের উচিত বাস্তবতা পরিস্থিতি যথাসাধ্য নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক ভাবে দেখা ও বোঝার চেষ্টা করা। দুই পক্ষ থেকে দুই রকম ব্যাখ্যা আমরা পাচ্ছি। পশ্চিমে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য গণমাধ্যমগুলোর ভাষ্য হোল, রাশিয়া সদাসর্বদাই একটি সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন রুশদের পুরানা সাম্রাজ্যবাদী খায়েশ পূরণ করবার আকাংখাকেই ধারণ করেন। (এখানে দেখুন, ‘The (Russian) Empire Strikes Back’)। এ লেখাটি লিখেছেন, মার্কিন দূত কুর্ট ভোল্কার (Kurt Volker)। তিনি ইউরোপের একটি নীতি নির্ধারণী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি এনালিসিস’ (Center for European Policy Analysis) -এর সঙ্গে যুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতি এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। কুর্ট ভোল্কারকে উদ্ধৃত করবার কারন হচ্ছে ২০১৭-২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধি হিশাবে ইউক্রেন সংক্রান্ত আপোষ-মীমাংসার আলোচনায় ইনি যুক্ত ছিলেন। এর আলোচনা থেকে আমরা মার্কন অবস্থা বুঝতে পারব। কুর্ট ভোল্কার ন্যাটোতে মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের রাষ্টদূত হিশাবে ২০১৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত কাজ করেছেন।
কুর্ট ভোল্কার বোঝাতে চাইছেন ইউক্রেনের পুরা সমস্যা পুতিনের মধ্যে। পুতিন যদি২০০০ সালে রাশিয়ার ক্ষমতায় না আসতেন তাহলে এতো ঝামেলা হোত না। কারন ভ্লাদিমির পুতিন পুরানা মহান রাশিয়া আবার পুনরুদ্ধার চাইছেন । তাঁর অভিপ্রায়ের কথা পুতিন ক্ষমতায় আসার পরপরই জানিয়ে দিয়েছেন। তখন প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়ার ভেঙ্গে নানান টানাপড়েনের মধ্যে রাশিয়াকে যেতে হচ্ছে। ভাঙনের পর সবাই ভেবেছিল রাশিয়ার পুরনা গৌরবে কথা পুতিনকে তো তাঁকে বলতেই হবে। নইলে তিনি রুশদের সমর্থন পাবেন না। কিন্তু দুই দশক পরে এটি নাকি এখন স্পষ্ট যে পুতিন ইউরোপ এবং ইউরেশিয়ায় রাশিয়ার আধিপত্য পুনরায় প্রতিষ্ঠার প্রকল্প শুরু থেকেই শুরু করেছেন।
কি করে সেটা আমরা বুঝব? কুর্ট ভোল্কার বলছেন, পুতিন রাশিয়ান সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন করেছেন; রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রাগার আধুনিক এবং সম্প্রসারণ করেছেন, রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা এবং তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছেন, গোয়েন্দা কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত এবং সম্প্রসারণ করেছেন। যেন নিশ্চিন্তে তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারেন তার জন্য রাশিয়ান গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির রাজনৈতিক বিরোধিতাকে শক্ত হাতে দমন করেছেন। রাশিয়ার নির্বাচনে এখন ব্যাপক কারচুপি হয়েছে।
এরপর কুর্ট ২০০৭ সালে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট পুতিনের বক্তৃতার সূত্রে উল্লেখ করেছেন, রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটভূক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিয়ে যে ইউরোপীয় নিরাপত্তা স্থাপত্য, বলয় বা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। অর্থাৎ সোজা কথায় পুতিন ন্যাটো বিরোধী। রাশিয়া ন্যাটো বিরোধী বটে, কিন্তু ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার বিরোধী নয়। কিন্তু ইউরোপের কাঁধে বন্দুক রেখে মার্কিন স্বার্থে তৈরি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য চায় না। এর উপকারভোগী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । কুর্ট যাকে ‘ইউরোপিয়ান সিকিউরিটি স্ট্রাকচার’ বলছেন, তা আসলে মোটেও ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার কাঠামো না। বরং মার্কিন নিরাপত্তা বর্ম, যার দ্বারা মার্কিন স্বার্থ রক্ষা হয়, ইউরোপের স্বার্থ নয়। পুতিন তার বিরোধিতা করে ঠিকই করেছেন।
রাশিয়া জানিয়ে দিয়েছে যে তারা আর Conventional Armed Forces in Europe (CFE) Treaty মানবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি যে জর্জিয়া ও মলডোভাতে অতিরিক্ত রুশ সৈন্য রয়েছে। তার জন্য স্বাগতিক দেশের সম্মতি নেবার যে নীতি আছে রাশিয়া তা মানে না। সৈন্যের ঘনত্ব, অনুশীলন এবং স্বচ্ছতার উপর ভিয়েনা কনভেনশনের সীমা রাশিয়া উপেক্ষা করতে শুরু করেছে। তাছাড়া মধ্যবর্তী এবং ছোট-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র the Intermediate-Range and Shorter-Range Missiles (INF) Treaty রাশিয়া মানে না। ‘ওপেন স্কাই’ চুক্তির অধীনে অনুরোধ করা ওভারফ্লাইটগুলিকে অনুমতি দিতেও অস্বীকার করে।
এই ধরণের সকল চুক্তি মূলত ন্যাটো জোট ভূক্ত দেশগুলোকে নিয়ে মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্য কায়েম রাখা এবং এক কেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা বহাল রাখার নীতি। যা সরাসরি মার্কিন ভূ-রাজনোইতিক এবং সামরিক স্বার্থ রক্ষা করে এবং রাশিয়ার নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে ফেলে। কিন্তু যে কথাটা পাশ্চাত্য মিডিয়া বলে না কিম্বা বেমালুম গায়েব করে দেয় সেটা হোল নিরপাত্তার প্রশ্নে ন্যাটোর সঙ্গে বারবার আপোষ-সমঝোতায় আসার প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। ভ্লাদিমির পুতিন ন্যাটোর সঙ্গে নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত বিবাদমান বিষয়গুলো্র মীমাংসার কথা বারবারই বলেছেন। পুতিন ন্যাটোকে জানিয়েছে রাশিয়া চায় “নির্ভরযোগ্য এবং দীর্ঘস্থারী নিরাপত্তা গ্যারান্টি”। সেটা লিখিত হতে হবে। মুখে বললে হবে না। কিন্তু ন্যাটো সেটা উপেক্ষা করেছে। কেন রাশিয়া ‘নিশ্চয়তা’র ওপর জোর দেয়। কারন এর আগের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে মুখে অনেক প্রতিশ্রুতির কথা থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নি। এই ভঙ্গুর ও অনিশ্চয় পরিস্থিতি রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি।
শুধু তাই নয় । ডিসেম্বরে রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর কাছে একটি সম্ভাব্য লিখিত চুক্তির খসড়া পেশ করেছে। কিন্তু সেই খসড়া নিয়ে আলোচনার আগেই পাশ্চাত্য তা নাকচ করে দিতে শুরু করে। পাশ্চাত্য গণমাধ্যমে এই খসড়াকে বলা হয়েছে কোন আপোষের জন্য নাকি এই খসড়া লেখা হয় নি। বরং কোন সিদ্ধান্তে না যাওয়ার জন্যই এই খসড়া। এই বক্তব্য চরম হাস্যকর এবং কপটতায় পূর্ণ। কোন প্রকার কথোপকথন বা ডায়লগের আগেই রাশিয়ার প্রস্তাব নাকচ করে দেবার মধ্যে ন্যাটোর কপট মতলব ধরা পড়ে। ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে জো বাইডেন বলছেন, ‘এই যুদ্ধ পুতিনই চাইছে”। “This was … always about naked aggression, about Putin’s desire for empire by any means necessary,” ( এটা সব সময়ই একটা নগ্ন আগ্রাসনের ব্যাপার, যে কোন উপায়ে এটা হোল পুতিনের সাম্রাজ্য বিস্তার) । দেখুন, ‘Putin Chose This War’: Biden Denounces Russia’s Actions in Ukraine’। এটা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্টের কপট ও মিথ্যচারে পূর্ণ পররাষ্ট্র নীতির পক্ষে দেশটর প্রধান নির্বাহী প্রধানের চরম মিথ্যাচার।
দেখা যাচ্ছে রুশরা নতুন ভাবে তাদের পুরাতন রুশ সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চায় এই কপট অভিযোগের মধ্য দিয়ে ন্যাটো রাশিয়ার সঙ্গে কোন দীর্ঘস্থায়ী এবং মজবুত শান্তিচুক্তি করবার পথ কার্যত পরিহার করে চলেছে। রাশিয়াকে চতুর্দিক থেকে সামরিক বেষ্টনি গড়ে তুলে উস্কানি দিয়ে চলেছে। যার পরিণতি ইউক্রেনকে দাবার গুটি হিশাবে ব্যভার করে ইউরোপকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করা।
মার্কি যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানের বিরুদ্ধে পালটা যুক্তিটাও খুবই শক্তিশালী। সেটা হোল, রাশিয়ার নিরাপত্তা বোধ, তাদের উৎকন্ঠা এবং উদ্বেগ খাঁটি। একে গৌণ ভাববার কোন কারন নাই। তাদের দেশের পূর্ব দিকে ন্যাটো সম্প্রসারিত হচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই ফুটবল বা হকি খেলবার জন্য না, এটা রীতমতো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর সামরিক প্রস্তুতি। এটা পুতিনের যুদ্ধ , কিন্তু মার্কিন বা ন্যাটো নির্দোষ ফেরেশতা না। হাফ-প্যান্ট পরা বালক ফুটবল মাঠে খেলা দেখতে দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা এমন না একদমই। এইসব কথা নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকাতেই ছাপা হচ্ছে । দেখুন, This Is Putin’s War. But America and NATO Aren’t Innocent Bystanders। রাশিয়ানরা তাদের দেশের পূব দিকে ন্যাটোর সম্প্রসারণকে তাদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিশাবেই দেখে। পুতিন বহু বছর ধরেই পরিষ্কার ভাবে এবং বারবারই বলে আসছেন যে, যদি এই সম্প্রসারণ অব্যাহত থাকে, তাহলে রাশিয়ানরা এর জবাব দেবে। মার্কিন ও ন্যাটো আগ্রাসন অবশ্যই প্রতিরোধ করবে। দরকার হলে সামরিক পদক্ষেপের নিতে রাশিয়া দ্বিধা করবে না। এটা শুধু রুশদের দৃষ্টিভঙ্গি নয়। এমনকি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞরাও সেটা মনে করেন। বিডেন প্রশাসনের অধীনে বর্তমান সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির পরিচালক, উইলিয়াম জে বার্নস, ১৯৯৫ সাল থেকে রাশিয়ার উপর ন্যাটো সম্প্রসারণের উস্কানিমূলক প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করে আসছেন। যখন বার্নস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন রাজনৈতিক কর্মকর্তা তখন মস্কোর দূতাবাসের দায়িত্বরত অবস্থায় ওয়াশিংটনকে জানিয়েছেন, ‘Hostility to early NATO expansion is almost universally felt across the domestic political spectrum here’. "এত জলদি ন্যাটো সম্প্রসারণকে প্রায় সর্বজনীনভাবে এখানে (অর্থাৎ রাশিয়ায়) দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক ধারা শত্রুমূলক তৎপরতা মনে করে” ( দেখুন Congressional Record)।
এর প্রায় ১০ বছর পর ২০০৮ সালে সালে, মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেইটস কন্ডোলিসা রাইসের কাছে একটি মেমো পাঠান। সেখানে তিনি লেখেন ইউক্রেনকে যদি ন্যাটোতে ঢুকিয়ে নেবার চেষ্টা হয় তাহলে সেটা শুধু পুতিন নয় রাশিয়ার নীতিনির্ধারকদের কাছে লাল বিপদচিহ্ন হিশাবে বিবেচিত হবে। রাশিয়ার প্রধান প্রধান রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে প্রায় আড়াই বছর ধরে বার্নস কথা বলে এমন একজনকেও বার্নস পাননি যারা ইউক্রেনকে ন্যাটোয় অন্তর্ভূক্ত করবার চেষ্টাকে সপ্রাসরি তাদের চ্যালেঞ্জ করা হিশাবে দেখেন না।
“Ukrainian entry into NATO is the brightest of all redlines for the Russian elite (not just Putin). In more than two and a half years of conversations with key Russian players . . . I have yet to find anyone who views Ukraine in NATO as anything other than a direct challenge to Russian interests” (দেখুন, Burns, 2020).
রাশিয়ান নেতারা দীর্ঘদিন ধরেই ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ সম্পর্কে উৎকন্ঠা জানিয়েছে। বিশেষ করে ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে (চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ড) এবং ২০০০-এর দশকের শুরুতে (বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া এবং স্লোভেনিয়া) ন্যটো জোটের অন্তর্ভূক্ত হয়। রাশিয়ার উৎকন্ঠা ২০০০ -এর দশকের দিকে শেষের দিকে বাড়তে থাকে কারণ ন্যাটো ভবিষ্যতে কোন এক সময় জর্জিয়া এবং ইউক্রেনকে জোতের অন্তর্ভূক্ত করে নেবার ইচ্ছা জানিয়ে রেখেছে।
রাশিয়া বলেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো ক্রমাগত ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে করা প্রতিশ্রুতি লংঘন প্রতিশ্রুতি ছিল যে ন্যাটো জোট সোভিয়েত ব্লকে প্রসারিত হবে না। অন্যদিকে ন্যাটো জোটের নেতারা বলছেন যে তারা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যান্য বিষয়ে রাশিয়ার সাথে নতুন কূটনীতির জন্য উন্মুক্ত, কিন্তু তবে তারা ন্যাটোর নতুন সদস্য কোন রাষ্ট্র হতে চাইলে ন্যাটোর দরজা চিরতরে বন্ধ করার বিষয়ে আলোচনা করতে রাজি নন, সংঘাতটা এখানে।
ন্যাটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন) বানানো হয় ১৯৪৯ সালে। এটা দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ও বড় সামরিক জোট। ন্যাটো অতএব অবশ্যই রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই জোটের সদস্য হলো ৩০টি দেশ। কিন্তু ১৯৪৯ সালে মাত্র ১২টি দেশ নিয়ে ন্যাটো প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে ও পর্তুগাল। ন্যাটো গঠিত হয় প্রধানত বর্তমান রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। ন্যাটোর সম্প্রসারণে অতএব রাশিয়ার উৎকন্ঠিত না হবার কোন কারন নাই। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাই যেটা চাইছেন সেটা হোল ন্যাটো যেন আর কোন দেশকে সদস্য না করে। ৩০টি দেশেই জোট হয়েই সেটা থাকুক। থামতে হবে। পুতিন এ বিষয়ে নিশ্চয়তা চান। কিন্তু ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এটাই রাশিয়ার ক্ষোভের কারণ।
যদিও বুখারেস্ট সামিটে (২০০৮) ন্যাটো ইউক্রেন এবং জর্জিয়ার জন্য কোন আনুষ্ঠানিক সদস্যপদ পরিকল্পনা ঘোষণা করেনি, কিন্তু জোটটি তখন নিশ্চিত করেছে যে "এই দেশগুলি ন্যাটোর সদস্য হবে" । জোট এই সময় আলবেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়াকে যোগদানের আলোচনার জন্য আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পত্র দেয়। যারা সদস্য হয়েছিল। ন্যাটো ২০১৭ আরও সম্প্রসারিত হয়, মন্টিনিগ্রোকে স্বীকার করে এবং ২০২০ সালে উত্তর মেসিডোনিয়াকে স্বাগত জানায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর ঠাণ্ডা যুদ্ধের সাময়িক অবসান হয়েছে মনে হলেও এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় সাতটি যুদ্ধে উদ্যোগ নিয়েছে এবং নিজেকে জড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইতি টেনেছে এবং আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়েছে বটে, কিন্তু সেটা আরও বড় যুদ্ধে প্রস্তুতির জন্য। আফগানিস্তান থেকে সেনাবাহিনীর অপসারণ সেই প্রস্তুতির জন্য হতে পারে। অন্তত ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সম্প্রাসারণবাদী ভূমিকা সেই বার্তাই দেয়। ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের অনিবার্য পরিণতি ইউক্রেনের যুদ্ধ । যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এবং ট্রাজেডি সম্পর্কে আমরা জানি। ইউক্রেনের যুদ্ধের মধ্যে বড় সড় ট্রাজেডির বিপদ নিহিত রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক হত্যাযজ্ঞের সম্ভাবনা আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না।
১৮ এপ্রিল ২০২২