৫. ইউক্রেন: ঠাণ্ডাযুদ্ধ এবং ভূ-রাজনীতি
ইউক্রেন যুদ্ধ বুঝতে হলে বিশ্ব ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব বোঝার জন্য পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন এবং মরণাস্ত্র উৎপাদন ব্যবসার কালে ভূ-রাজনীতি কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেটা সবার আগে বুঝতে হবে। বিশ্ব ব্যবস্থার গোড়াতে টান পড়ছে এবং পারমাণবিক যুদ্ধের কথাও শোনা যাচ্ছে। বর্তমান বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের চরিত্র সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত থাকা খুবই জরুরি।
ইউক্রেন যুদ্ধকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার দ্বন্দ্ব হিশাবে দেখায় ভুল নাই, যেখানে ইউক্রেনের জনগণকে বলি দেওয়া হচ্ছে। পতনশীল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিশাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল এবং রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া সঠিক ভাবে বোঝা ও পর্যালোচনা জরুরী। রাশিয়া সরাসরি যুদ্ধে জড়ালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা ‘প্রক্সি ওয়ার’। বোঝার জন্য প্রথমে দরকার মার্কিন ও পাশ্চাত্য গণমাধ্যমের একতরফা রুশ বিরোধী বয়ান প্রত্যাখান করা এবং পরাশক্তির বাইরে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার সাধারণ মানুষের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়িয়ে এই যুদ্ধের পর্যালোচনা করা। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের রুশ আগ্রাসনের নিন্দা করতেই হবে। এই নিন্দা স্রেফ নীতিবাগীশগিরি নয়। কারণ পুরা দুনিয়ার মানুষ এই যুদ্ধে নানান ভাবে আক্রান্ত হবে এবং তা সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধের রূপ নিতে পারে।
এই যুদ্ধের বিরোধিতা করবার আরও সঙ্গত কারণ বাংলাদেশের রয়েছে। এই যুদ্ধ নিয়মানুগ বিশ্ব ব্যবস্থার যদি আদৌ অবশিষ্ট কিছু থাকে সেটাও ভেঙে পড়ছে। আজ রাশিয়া যদি তার নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আগ্রাসন চালাতে পারে, তাহলে দিল্লী কিম্বা মায়ানমারও নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে যে কোন সময় বাংলাদেশে হানা দিতে পারে। হানাদারি মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশের কোন প্রস্তুতি নাই। গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দূরে থাকুক, বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলেও আদৌ কিছুর অস্তিত্ব নাই। কোন আলোচনাও নাই। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার কথা না ভেবে একজন ব্যক্তি স্রেফ একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার বলে চট্টগ্রাম বন্দর ভারতীয়দের ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে দিতে পেরেছে। তথাকথিত কানেকটিভিটি, বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক বিবেচনা তো আছেই। সমুদ্র বন্দর সর্বোপরি জাতীয় প্রতিরক্ষার বিষয়। এই কাণ্ডজ্ঞান ফ্যাসিস্ট শাসকদের না থাকুক, বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও প্রকট ভাবে অনুপস্থিত। তাই রাশিয়ার আগ্রাসন যেন রুশ-ভারত অক্ষশক্তি কিম্বা মায়ানমারের আদর্শে পরিণত না হয় তার জন্য অবশ্যই আমাদের তীব্র ভাবে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা করতে হবে। কিন্তু যদি যুদ্ধের কার্যকারণ বিচার করি তাহলে এই যুদ্ধের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ষোল আনা দায়ী। এক তরফা রাশিয়াকে নিন্দা করারও কোন সুযোগ নাই।
অনেকে ইউক্রেনের যুদ্ধ বোঝাতে গিয়ে ইউক্রেনের ইতিহাস, ইউক্রেনের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েন, রুশ সাম্রাজ্যের উত্থান পতন, প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়া, ইত্যাদি নানান বিষয়ে কথা বলছেন। কিন্তু সেইসব আলোচনা একদমই অসম্পূর্ণ থাকবে যদি দুটো বিষয়কে আমরা আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে না পারি। একটি হচ্ছে ভূ-রাজনীতি এবং পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে তার বর্ত্যমান দ্বন্দ্বের চরিত্র। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে ডিজিটাল টেকনলজি ও গণমাধ্যমের বিপুল উন্নয়নের ফলে বিভিন্ন মত উৎপাদন ও প্রপাগাণ্ডা দ্বারা মানুষের চিন্তা ও বোঝাবুঝির জগতকে প্রভাবিত করবার ক্ষমতা। মানুষের মগজ বা মন একালে নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হিশাবে হাজির হয়েছে। যে কারণে মতাদর্শিক তর্ক বিতর্ক এই যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হয়ে উঠছে। এই কারনে যে সকল রুশ দার্শনিক দর্শন কিম্বা মতাদর্শ পর্যালোচনায় কখনই পাশ্চাত্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। আজ তারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। কারন তারা পাশ্চাত্য দর্শনকে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে পর্যালোচনা করতে পারছেন। তারা বলছেন 'সত্য সার্বজনীন' এই দাবিতে পাশ্চাত্য তাদের নিজেদের ভু-রাজনৈতিক স্বার্থকে বিশ্বের সকলের স্বার্থ হিশাবে হাজির করে, যার ফলে বহুকাল দর্শনের নামে, সার্বজনীনতার নামে আদতে পাশ্চাত্যের ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যই কায়েম রয়েছে। একে ভেঙে বহু কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়া না গেলে কোন জনগোষ্ঠির পক্ষেই নিজেদের বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। মার্কন যুক্তরাষ্ট্রের গোলাম থাকা ইউরোপ কিম্বা এশিয়ার একমাত্র পরিণতি হতে পারে না। এই অবস্থা ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে। এই প্রসঙ্গে আলেক্সান্দার ডুগিনের নাম স্বাভাবতই সামনে চলে আসে। তবে তাঁর চিন্তা নিয়ে আমরা পরের কোন এক কিস্তিতে পর্যালোচনা করব। এই কিস্তিতে আমরা ঠাণ্ডা যুদ্ধ এবং ভূ-রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধারণা দেবার চেষ্টা করব। এই দিকটা বোঝা না গেলে দুগিনকেও বোঝা যাবে না।
ঠাণ্ডা যুদ্ধ
ইংরেজি Cold War শব্দটার বাংলা অনুবাদ আমরা দুই প্রকারে করি। একটা হচ্ছে ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’, আর আরেকটা ‘স্নায়ু যুদ্ধ’। মূল ভাবটা হচ্ছে যুদ্ধ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেটা বোমা বারুদ কামান দেগে হচ্ছে না। বাইরে বাইরে শান্তির ভাব রয়েছে, কিন্তু সেটা আসলে শান্তি নয় মোটেও। ফলে যুদ্ধের চাপ ঠিকই পড়ছে স্নায়ুতে। ইংরেজ উপন্যাসিক জর্জ অরওয়েল এর নাম দিয়েছিলেন ‘Peace that is no peace’।
অরওয়েলই প্রথম ‘কোল্ড ওয়ার’ কথাটা চালু করেছিলেন। সেটা করছিলেন মানুষের পরস্পরকে হত্যা করবার টেকনলজি আবিষ্কারের ধূম দেখে। ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকায় ১৯ অক্টোবর ১৯৪৫ সালে তিনি একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। নাম You and the Atom Bomb। এটম বোমা আবিষ্কারের পেছনে মানুষের বাসনাটুকুও উদাম হয়ে পড়ে। নিজের বানানো অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মানুষ পরস্পরকে ধূলায় মিশিয়ে দিতে চায়। এটা যে সম্ভব সেটা যে কেউই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরগুলো দেখলেই বুঝবে। মানুষ পরস্পরকে ধ্বংস করার প্রজাতি হিশাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপর হয়ত প্রবল সামাজিক বোধ সম্পন্ন প্রাণী, যেমন পিঁপড়া বা পিঁপড়াদের মতো কোন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সামাজিক কীটপতঙ্গই শুধু টিকবে।
কথাগুলো অরওয়েল বলছিলেন সেই সময়ের আবিষ্কার এটম বোমা প্রসঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করছিলেন দিকবিদিকের জ্ঞানহারা মানুষ অরাজকতার মধ্যে খাবি খাবার কথা ছিল, কিন্তু এটম বোমা দেখে মনে হচ্ছে সেটা ঘটে নি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সকলে মিলে নিজেদের মুক্ত করবার কথা না ভেবে নিজেরাই নিজেদের পায়ে শৃংখল পরিয়ে দিচ্ছে। নিজেরা নিজেদের দাস হয়ে পড়ছে। কিভাবে এটা ঘটছে? সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে টেকনলজি কিভাবে মানুষকে দাসে পরিণত করে সেটা খানিক ব্যাখ্যা করেছেন।
যেমন, এটম বোমা স্রেফ টেকনলজি তো না। এক ধরণের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গী। সেটা হোল অন্য মানুষের হাত থেকে বাঁচতে হলে এমন সব মারণাস্ত্র চাই যা শত্রুকে মেরে পুড়িয়ে ধূলায় মিশিয়ে দেবে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে এই প্রতিযোগিতা চললে যে ধরণের সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো মানুষ গড়ে তুলবে সেটা এমনই হতে হবে যেন কেউ কাউকে কখনই পরাজিত করতে না পারে; একই কথা ভিন্ন ভাবে বলা যায়, যেন কেউ কখনও জয়ী হতে না পারে। এটম বা পারমাণবিক বোমা সেই ভূমিকা পালন করে। পারমাণবিক বোমার ভয় দেখিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আর সাহস করবে না। কারন তারা জানে এই যুদ্ধে জেতা যাবে না, উলটা ধ্বংস হয়ে যাবার ভয় আছে। তাই যুদ্ধ নাই, কিন্তু যুদ্ধ জারি রাখা যায় কিভাবে? সেই জন্য পরস্পরের সঙ্গে এক প্রকার চিরস্থায়ী ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ জারি রাখার কাল্পর্বে বিশ্ব ইতিহাস প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ এটম বোমার পরস্পরের ধ্বংস নিশ্চিত করবার টেকনলজি গড়ে ওঠার পর যুদ্ধ এখন শুধু ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ হিশাবেই জারি থাকতে পারে।
এটম বোমা যদি সহজে বাই সাইকেল কিম্বা এলার্ম ক্লকের মতো প্রস্তুত করা যেত তাহলে এতদিনে মানুষ বর্বর হত্যাযজ্ঞের উৎসবে মেতে উঠত। তার মানে জাতীয় সার্বভৌমত্ব বলে কিছু আর থাকত না, আর রাষ্ট্রগুলোও ক্ষমতাধর পুলিশী রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহণ করত। কিন্তু এটম বোমা বানানো সহজ না, খরচও বিপুল। সে কারনে জর্জ অরওয়েল ভেবেছিলেন সম্ভবত এই ধরণের বোমা ব্যাপক যুদ্ধ বিগ্রহের সম্ভাবনা কমাবে। ধ্বংস হয়ে যাবার ভয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না। কিন্তু যুদ্ধে না জড়িয়েও যুদ্ধ করে যাওয়া ঘটবে ভিন্ন রূপে। এক নতুন পরিস্থিতি তৈরি হবে: এক ধরণের শান্তি জারি থাকবে যা আসলে শান্তি না। ‘দ্য অবজারভার’ পত্রিকায় অরওয়েল ১০ মার্চ ১৯৪৬ সালে লিখেছিলেন, “গত ডিসেম্বরে মস্কো সম্মেলনের পর, ব্রিটেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রাশিয়া একটি 'ঠাণ্ডা যুদ্ধ' শুরু করে”। প্রথম বারের মতো অরওয়েলেওর ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বর্ণনার জন্য ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ কথাটার ব্যবহার শুরু হয়।
ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা স্নায়ুযুদ্ধ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তাদের নিজ নিজ মিত্র -- পশ্চিম ব্লক এবং পূর্ব ব্লকের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কাল পর্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই এই পর্ব শুরু হয়। ঠিক কবে ঠাণ্ডা যুদ্ধের শুরু তার সুনির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে মতভেদ থাকলেও সাধারণত ১৯৪৭ সালের ট্রুম্যান ডকট্রিন (১২ মার্চ ১৯৪৭) ঘোষণা এবং কার্যকর করার পর থেকে ১৯৯১ সালের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি (২৬ ডিসেম্বর ১৯৯১)) পর্যন্ত বিস্তৃত বলে মনে করা হয়। ঠাণ্ডা যুদ্ধ মানে যুদ্ধ হচ্ছে না বা যুদ্ধ হয় নি ব্যাপারটা এমন না। এর অর্থ পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী দুই পরাশক্তির মধ্যে সরাসরি কোন যুদ্ধ হবে না, কিন্তু অন্যান্য ভূখণ্ডে বা অন্যান্য দেশের ওপর আধিপত্য বা প্রভাব বলয় জারি রাখতে তাদের ‘প্রক্সি ওয়ার’ জারি রয়েছে। দুটি পরাশক্তির ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের দ্বন্দ্ব ঠাণ্ডাযুদ্ধের কালপর্বে কমবেশী বিশ্ব ব্যবস্থার চরিত্র এবং ইতিহাসের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে ১৯৪৫ সালে দুই পরাশক্তির মধ্যে অস্থায়ী জোট গড়ে ওঠে এবং যুদ্ধে বিজয়ের পর এই দুই পরাশক্তি বৈশ্বিক প্রভাবের জন্য আদর্শিক এবং ভূ-রাজনৈতিক ঠাণ্ডা লড়াই শুরু করে। পারমাণবিক অস্ত্রাগারের উন্নয়ন এবং প্রচলিত সামরিক শক্তি মোতায়েন ছাড়াও, আধিপত্যের সংগ্রাম পরোক্ষ ভাবেও জারি ছিল। যেমন মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, প্রচার প্রচারণা, গুপ্তচরবৃত্তি, সুদূরপ্রসারী নিষেধাজ্ঞা, ক্রীড়া ইভেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং স্পেস রেসের মতো প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা। আমাদের মতো দেশে ঠাণ্ডা যুদ্ধের কালপর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বিশেষ প্রচারণার দ্বারা কমিউনিস্টদের আদর্শ ও চিন্তাকে সহজে প্রতিহত করতে পেরেছ, সেটা হোল কমিউনিস্টদের নাস্তিক হিশাবে এবং কমিউনিজমকে নাস্তিকদের দর্শন হিশাবে প্রচার করবার সাফল্য।
ঠাণ্ডা যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট বিরোধী এবং ডানপন্থী সরকার এবং অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেছিল। এর বিপরীতে সোভিয়েত সরকার সমর্থন করেছিল বিশ্বজুড়ে বামপন্থী দল এবং বিপ্লবকে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের কাল পর্বে তৃতীয় বিশ্বের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এই সময়কালে (১৯৪৫-১৯৬০) উপনিবেশগুলোও রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে।
ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি এবং এক কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার (১৮৮৮-১৯৯১) মধ্য দিয়ে ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়; পুরানা মতাদর্শিক শিবিরে বিভক্ত দুনিয়ার কালপর্বও শেষ হয়ে যায়। সেই জায়গায় নতুন এক কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার ( New World Order) উদয় ঘটে। এই এক কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী করবার কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবতে হয়েছে। নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নব্বইয়ের শুরুতে জর্জ বুশ প্রশাসনের আন্ডার সেক্রেটারি অফ ডিফেন্স ছিলেন পল উলফোভিৎজ (Paul Wolfowitz )। পল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা নির্দেশিকা জারি করে বলেছিলেন: “আমাদের নীতি [সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর] এখন অবশ্যই হতে হবে ভবিষ্যতের যেকোন সম্ভাব্য বৈশ্বিক প্রতিযোগীর উত্থান রুখে দেবার ওপর পুনরায় মনোযোগ দেওয়া।" উলফোভিৎজ জোর দিয়ে বলেছিলেন যে "রাশিয়া ইউরেশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তি থাকবে। "তাই নিজের অবস্থা পুনরুদ্ধার করে যে সমস্ত রাজ্যগুলো নিয়ে আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত ছিল তাদের রাশিয়া আবার রুশ শক্তির অক্ষবলয়ের মধ্যে নিয়ে আসার অবস্থানে ফিরে আসার আগে, রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান স্থায়ীভাবে এবং কেউই যেন আর বদলাতে না পারে তেমন অবস্থায় দুর্বল করে রাখার জন্য যারপরনাই প্রচেষ্টার দরকার”। (“Excerpts from Pentagon’s Plan: ‘Preventing the Re-Emergence of a New Rival’,” New York Times, March 8, 1992)।
“Our policy [after the fall of the Soviet Union] must now refocus on precluding the emergence of any potential future global competitor.” Wolfowitz emphasized that “Russia will remain the strongest military power in Eurasia.” Extraordinary efforts were therefore necessary to weaken Russia’s geopolitical position permanently and irrevocably, before it would be in a position to recover, bringing into the Western strategic orbit all of those states now surrounding it that had formerly either been parts of the Soviet Union or had fallen within its sphere of influence (“Excerpts from Pentagon’s Plan: ‘Preventing the Re-Emergence of a New Rival’,” New York Times, March 8, 1992).
সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাবার পর রাশিয়ার প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হিশাবে গৃহীত। আজ অবধি তার কোন বদল হয় নি। রাশিয়াকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেওয়া হবে না। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর রাশিয়াকে বেষ্টন করে থাকা যে সব রাজ্যগুলো আলাদা হয়ে গিয়েছে তাদের ওপর রাশিয়ার আধিপত্য কোন ভাবেই আবার কায়েম করতে দেওয়া যাবে না। ইউরেশিয়ায় রুশ প্রভাব বলয়কে যারপরনাই রুখে দেওয়াই গত শতাব্দির নব্বই দশক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি।
পল উলফোবিৎজের যে ‘ডিফেন্স প্ল্যানিং গাইডেন্স’ (Defense Planning Guidance, FY 1994-1999) তৈরি করেছিলেন। ওয়াশিংটনসহ মার্কিন ক্ষমতাবান শ্রেণির নেতৃস্থানীয় কৌশলগত পরিকল্পনাবিদদের দ্বারা সেটা গৃহীত হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর নতুন পরিস্থতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক এক-কেন্দ্রিক বিশ্বের সর্বাধিপতি হয়ে থাকা বা বিশ্বের মোড়ল হয়ে থাকার নীতি গ্রহণে অবাক হবার কিছু নাই।
ইউরেশিয়া কেন্দ্র করে ভূ-রাজনৈতিক চিন্তার গোড়া অবশ্য আরও অতীতে। ধ্রুপদি ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্ব হিশাবে ইতিহাসের বইয়ে সেই চিন্তা পরিচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯০৪ সালে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনে এটি শুরুতে পেশ করেন হ্যালফোর্ড ম্যাকিন্ডার (Halford Mackinder)। এই ভু-রাজনৈতিক তত্ত্বটা আরো নিখুঁত করেন ১৯৩০ এবং ১৯৪০ দশকে নাৎসি জার্মানির কার্ল হাউশোফার (Karl Haushofer) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিকোলাস জন স্পাইকম্যান (Nicholas John Spykman)। তত্ত্বের সারকথা হচ্ছে বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ‘ইউরেশিয়া’ – অর্থাৎ ইউরোপীয় ও এশিয়া মহাদেশের প্রধান ভূমিখণ্ডের আধিপত্যের উপর নির্ভর করে। ম্যাকিন্ডার ইউরেশিয়ার প্রধান ভূমিখণ্ডকে ভু-রাজনৈতিক ‘হার্টল্যান্ড’ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। এই ‘হার্টল্যান্ড’কে সঙ্গে নিয়ে এশিয়া এবং আফ্রিকা একসাথে বিশ্বদ্বীপ তৈরি করেছে। এই তত্ত্ব থেকেই নানান সময়ে যে রণধ্বণি বিভিন্ন সময়ে তৈরি হয়েছে তা এইরকম:
Who rules East Europe commands the Heartland:
Who rules the Heartland commands the World Island:
Who rules the World Island commands the World.
পূর্ব ইউরোপ যারা শাসন করে তাদের হাতেই হার্টল্যান্ডের বল্গা
হার্টল্যান্ড যারা শাসন করে তারাই বিশ্বদ্বীপের হুকুমদার
বিশ্বদ্বীপ যারা হুকুম করে তারাই দুনিয়ার প্রভু
ভূ-রাজনীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক মতবাদ
ভৌগলিক বাস্তবতার সঙ্গে বিশ্ব ইতিহাসের সম্পর্ক এবং সে সম্পর্কে টানাপোড়েন থেকে বিভিন্ন মতাদর্শের যোগ বোঝা ও বিশ্লেষণ গুরুতর বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব ইতিহাসের আধুনিক পর্বের গতি প্রকৃতি বোঝার জন্য ভূ-রাজনৈতিক মতবাদ ও ভু-রাজনৈতিক আধিপত্য অর্জনের রণধ্বণি বা তত্ত্ব বোঝা খুবই জরুরি একটি বিষয়। ফালতু কথাবার্তা, নীতিবাগীশ ওয়াজ-নসিহত বা মূর্খদের কোলাহলে আমরা যেন বিভ্রান্ত না হই। নিজ নিজ ভূ-রাজনৈতিক মতলব কেন্দ্রে রেখে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিরোধের পরিণতি হিশাবে ইউক্রেন যুদ্ধ ঘটেছে। ভু-রাজনৈতিক ভাবে ইউরেশিয়ার ওপর আধিপত্য কায়েম ও বিস্তারের প্রতিযোগিতাই ইউক্রেন যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ যতো ক্ষুদ্র ও অসহায় রাষ্ট্র হোক গোড়ার বাস্তব সত্যগুলো মাথায় রাখলে এবং আমরাও আমাদের ভু-রাজনৈতিক চিন্তাকে শাণিত এবং আমাদের ক্ষুদ্র পরিসরে আমাদের কর্তব্য নির্ণয় করতে পারি।
মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করবার জন্য প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়াকে আফগানিস্তানে রক্তাক্ত যুদ্ধে ঠেলে দেবার কৌশল জিগনিও ব্রেজনেজিনস্কির সেটা সবাই কমবেশী স্বীকার করেন। আফগানিস্তান ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনাম। আফগানিস্তানে মুজাহিদিনদের সশস্ত্র করা, ইরানকে একটি পাশ্চাত্য বিরোধী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা, ইরানি বিপ্লবকে তার ন্যায্য লড়াইয়ের জন্য ঐতিহাসিক স্বীকৃতি না দিয়ে পাশ্চাত্যের চোখে তাকে ‘সভ্যতার দুষমণ’ বানানো, তথাকথিত ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তির দালালি, ইত্যাদি নানান ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের প্রণয়ণকারী হিশাবে ব্রেজনেজিনস্কি বিখ্যাত। তিনি সজ্ঞানে করেছেন নাকি তার ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের ফল হিশাবে আল কায়েদা গড়ে উঠেছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে আল কায়েদার গঠন ও উত্থানের ক্ষেত্রে ব্রেজনেজেনস্কির ভূ-রাজনৈতিক কৌশল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তাতে কোন সন্দেহ নাই। তিনি রাষ্ট্রপতি কার্টারকে বোঝান যে ইউএসএসআর-সমর্থিত আফগান সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্রক্সি-যুদ্ধ’ শুরু করার জন্য একটি গোপন সিআইএ প্রোগ্রাম চালানো "সোভিয়েত সামরিক হস্তক্ষেপ"কে প্ররোচিত করবে। তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "আমরা রাশিয়ানদের হস্তক্ষেপ করার জন্য চাপ দিইনি, কিন্তু আমরা জেনেশুনেই (আফগানিস্তানে) তাদের হস্তক্ষেপ করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছি," তিনি ল্য ন্যুভেল অবজারভেতরের সাথে ১৯৯৮ সালের একটি সাক্ষাত্কারে এই কথা বলেছিলেন। "যেদিন সোভিয়েতরা আনুষ্ঠানিকভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেছিল, আমি রাষ্ট্রপতি কার্টারকে যা লিখেছিলাম তার সারকথা ছিল: 'আমাদের কাছে এখন সুযোগ আছে ইউএসএসআরকে তার ভিয়েতনাম যুদ্ধ করতে দেবার সুযোগ করে দেয়া।'"
পরবর্তীতে তালিবানদের উত্থানের পর তাঁকে দোষ দেওয়া হচ্ছিল। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “সেই গোপন অপারেশনটি ছিল একটি চমৎকার ধারণা। এটি রাশিয়ানদের আফগান ফাঁদে টেনে আনতে প্রভাব ফেলেছিল এবং আপনি চান যে আমি এর জন্য অনুশোচনা করি?”। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে তিনি বলেছিলেন। “বিশ্ব ইতিহাসে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী হতে পারে ? তালেবান নাকি সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতন? কিছু বিক্ষুব্ধ মুসলিম নাকি মধ্য ইউরোপের মুক্তি এবং ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসান? (দেখুন, Zbigniew Brzezinski, The Man Who Trained Osama Bin Laden in Warfare)
দীর্ঘকাল ধরেই ইউরেশিয় ডকট্রিন বিশ্বে ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েমের প্রধান পথনির্দেশিকা হিশাবে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতির মর্মে হাজির রয়েছে। নেতৃস্থানীয় পুঁজিবাদী দেশগুলির সাম্রাজ্য বিস্তারের মানচিত্রে ইউরেশিয়া গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। হেনরি কিসিঞ্জার (Henry Kissinger) এবং (Zbigniew Brzezinski ) জেবিগনিউ ব্রজেজিনস্কির মতো মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের চিন্তাভাব্নাও ইউরেশিয়া সংক্রান্ত ভূ-রাজনৈতিক চিন্তা নির্ণয় বা নির্ধারণ করে। বলা বাহুল্য একই ভাবে একই ইউরেশীয় ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্ব নাৎসী জর্মনীর সাম্রাজ্য পরিকল্পনার কেন্দ্রে যথারীতি হাজির ছিল। ধারণাটির নাৎসী সংযুক্তির কারনে এ নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর আমরা বিশেষ উচ্চবাচ্চ শুনি নি। কিন্তু তা সরবে এখন ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থাৎ ইউরোপ কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, ভাঙ্গন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পর ইউরেশিয়া বা ‘হার্টল্যান্ড মতবাদ’ আবার সাম্রাজ্যবাদী প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রে চলে এসেছে। বিশেষত মার্কিন নিরাপত্তা নীতি, সমরনীতি এবং সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য অটুট রাখার কেন্দ্রীয় তত্ত্বে পরিণত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই নতুন ভূ-রাজনীতি কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থপতি ব্রজেজিনস্কি।
ব্রজেজিনস্কির বিখ্যাত বইয়ের ভূমিকা শুরু হয়েছে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে ইউরেশিয়ার গুরুত্ব বোঝানোর মধ্য দিয়ে। তিনি লিখছেন, “মহাদেশগুলো যখন রাজনৈতিক ভাবে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করছিল ইউরেশিয়া ছিল বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্র”। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠি ইউরেশিয়ায় বসতি স্থাপন করেছিল। যদিও তাদের অধিকাংশই ছিল পশ্চিম ইউরোপের প্রান্ত থেকে আসা, কিন্তু তারাই দুনিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে প্রবেশ ও আধিপত্য কায়েম করতে পেরেছে। যার মধ্য দিয়ে একেকটি ইউরেশীয় রাষ্ট্র বিশেষ প্রাধান্য লাভ করেছে এবং দুনিয়ার প্রধান ক্ষমতাধর শক্তি হবার গৌরব উপভোগ করেছে। বিংশ শতাব্দির শেষ দিকে আমরা দেখলাম বিশ্ব ব্যবস্থার পাটাতন সরে গিয়েছে। প্রথম বারের মতো ইউরেশিয়া বহির্ভূত একটি শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে যে শক্তি শুধু ইউরেশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাই শুধু করছে না, একই সঙ্গে দুনিয়ার মহাশক্তি হিশাবে হাজির হয়েছে। সোভিয়েট ইউনিয়নের পরাজয় এবং ভেঙ্গে পড়ার শেষ পরিণতি হচ্ছে পশ্চিম গোলার্ধের শীর্ষারোহন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছে দুনিয়ার একমাত্র এবং বাস্তবিকই প্রথম খাঁটি বিশ্ব শক্তি হিশাবে। ইউরেশিয়া, তা সত্ত্বেও তার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব হারায় নি। এর পশ্চিম প্রান্ত ইউরোপ দুনিয়ার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র, কিন্তু তার পূর্বাঞ্চল – এশিয়া – সম্প্রতিকালে অর্থনৈতিক প্রাণশক্তির কেন্দ্র এবং রাজনৈতিক আধিপত্য বৃদ্ধির অঞ্চল হয়ে উঠেছে। তাহলে দুনিয়া জুড়ে তৎপর আমেরিকার চিন্তা হোল ইউরেশিয়ার জটিল ক্ষমতা সম্পর্কের বিন্যাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে এবং বিশেষ ভাবে কিভাবে আমেরিকা প্রভাবশালী এবং বৈরি ইউরেশীয় ক্ষমতা সে প্রতিরোধ করবে। এটাই বিশ্ব ব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি চর্চায় কেন্দ্রীয় বিষয়। ক্ষমতা চর্চার নানান নতুন কৌশলের চর্চা ছাড়াও (যেমন, টেকনলজি, কমিউনিকেশান, তথ্য, এবং বাণিজ্য ও পুঁজি লগ্নির কায়কারবার ছাড়া) আমরা যা পাচ্ছি তা হোল মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিকে অবশ্যই ইউরেশিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনোযোগী থাকতে হবে এবং আন্তঃমহাদেশীয় ভারসাম্য রক্ষার নিয়ন্তা হিশাবে ইউরেশিয়ায় অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব খাটাতে হবে”।
আমি দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছি কারন ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে যে সকল আলোচনা বাংলাদেশে আমার চোখে পড়েছে সেখানে ইউরেশিয়ার ভু-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য এবং সংশ্লিষ্ট মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির আলোচনা প্রায় নাই বললেই চলে। অথচ ইউক্রেন যুদ্ধের গোড়ায় রয়েছে ইউরেশিয়ার ভু-রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং ইউরেশিয়ার ওপর আধিপত্য বজায় রাখা কেন্দ্র করে পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা।
ব্রজেজিনস্কি জিমি কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। আফগানিস্তানে সোভিয়েতদের জন্য ফাঁদ তৈরির মুন্সিয়ানা ব্রজেজিনস্কি্র। এটা এখন কম বেশী জানা যে ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে কার্টারের স্বাক্ষরিত একটি গোপন নির্দেশের অনুসরণে ব্রজেজিনস্কির নির্দেশনায়, সিআইএ, মুহাম্মাদ জিয়া-উল হকের পাকিস্তান থেকে সৌদি রাজপরিবার পর্যন্ত রাজনৈতিক ইসলামের বৃত্তের সাথে একত্রে কাজ করে। আজ যারা ইসলামি রাজনীতি করেন তাঁদের ভুলে গেলে চলবে না মুজাহিদিনদের নিয়োগ, সশস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংগঠন সিআইএ। আফগানিস্তানে সিআইএ-এর মুজাহিদিন এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর গঠন সোভিয়েত হস্তক্ষেপকে একটি অন্তহীন যুদ্ধে প্ররোচিত করেছিল। সোভিয়েত রাশিয়া সেই ফাঁদে পা দেয়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদী দখলদারি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংসের বীজ বুনে দেয়। যার পরিণতি কি হয়েছে আমরা এখন তা জানি। হয়তো বুঝতেও পারি। কিন্তু ধর্মের ছুতায় বা ধর্ম রক্ষার নামে ইসলামপন্থিদের বড় একটি জিহাদি অংশ আদতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ ও ভু-রাজনৈতিক পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত করেছে। আমরা এখন যখন ইসলাম নিয়ে কথা বলছি তখন ইসলামের মোজাহিদ হওয়ার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়নক হবার ইতিহাস মনে রাখতে হবে। সেটা যেন ভুলে না যাই। মুসলমানদের অপরিণামদর্শী আবেগ, অজ্ঞতা, মূর্খতা ও অশিক্ষার জের হিমালয়ের মতো প্রতিবন্ধকতা হয়ে চেপে বসে আছে। বামপন্থিদের বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা অধিকাংশই পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মদদ দাতার ভূমিকা পালন করেছে। অর্থাৎ মার্কিন ভু-রাজনৈতিক কৌশলই বাস্তবায়ন করেছে। সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই অবশ্যই সঠিক ছিল, কিন্তু সেই লড়াইয়ে লক্ষ্য, কৌশল ও শত্রু-মিত্র নির্ধারণ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কার্যত বিজয়ীও হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মোজাহেদিনরা সামনে থাকলেও কলকাঠি নেড়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র প্রশিক্ষণ নিয়ে ইসলামি জিহাদের পরিণতি ভাল হয়েছে কিনা সেটা নির্মোহ ভাবে ভেবে দেখার দরকার আছে।
ব্রজেজিনস্কিকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ৯/১১ পরে বিশ্বব্যাপী তথাকথিত ইসলামি সন্ত্রাস বৃদ্ধির পেছনে তার কোন ভূমিকা রয়েছে কিনা। এর জন্য তিনি অনুশোচনা করেন কি? এই প্রশ্নের উত্তরে, ব্রজেজিনস্কির পরিষ্কার উত্তর ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংসই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। (দেখুন Natylie Baldwin, “Brzezinski’s Mad Imperial Strategy,” Natylie’s Place, August 13, 2014)। খুব একটা মিথ্যা তিনি বলেন নি। ব্রজেজিনস্কি পরবর্তী মার্কিন প্রশাসনের প্রকাশ্যে অথবা অদৃশ্যে থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতি ও ভু-রাজনৈতিক পরিকল্পনার প্রধান নায়কের ভূমিকা পালন করেছেন অন্য যেকোনো মার্কিন কৌশলগত চিন্তাবিদদের চেয়ে, ব্রজেজিনস্কিই ছিলেন রাশিয়ার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ণকারী। এই স্ট্রাটেজি মার্কিন প্রশাসন দ্বারা পরপর তিন দশক ধরে প্রণীত ও বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে।
“Ukraine: Zbig’s Grand Chessboard and How the West Was Checkmated,” বইতে Natylie Baldwin এবং Kermit Heartsong লিখেছেন, জিমি কার্টার হোয়াইট হাউস থেকে চলে যাওয়ার পর ব্রজেজিনস্কি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে গিয়েছেন। তিনি জন কেরির ২০০৪ সালের রাষ্ট্রপতি প্রচারাভিযানে এবং ওবামার ২০০৮ সালের রাষ্ট্রপতি প্রচারাভিযানের উভয় ক্ষেত্রেই পররাষ্ট্র নীতি উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছিলেন। তিনি ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়াকে দুর্বল করার জন্য প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া উৎসাহিত করার জন্য আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। ব্রজেজিনস্কি ইউক্রেন প্রকল্পে যোগদান করেন ১৯৮৯ সালে। এই প্রকল্পের কাজ ছিল ইউক্রেনের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করা। দুই হাজার চৌদ্দ সালের একটি লেখায় ব্রজেজিনস্কি ইউক্রেনকে রাশিয়ার প্রভাব থেকে বের করে মার্কিন প্রভাবের ক্ষেত্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি দেন। ন্যাটালি বল্ডউইন এবং কারমিট হার্টস্ট্রং দেখিয়েছেন ইউক্রেন বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দু (pivot) ব্রজেজিনস্কি সেটাই মনে করেন। ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিযোগিতা যে লাটিমের ওপর ঘুরছে সেটা ইউক্রেন। যদি এটি রাশিয়ার প্রভাবের ক্ষেত্রে থেকে যায়, তবে রাশিয়াকে ইউরেশিয়ার বাকি অংশে আধিপত্য প্রসারের শর্ত ও সুযোগ করে দেবে।
রাশিয়া যেন আমেরিকান আধিপত্যের চ্যালেঞ্জ করতে না পারে এবং যেন সেই চ্যালেঞ্জ প্রতিরোধ করা যায় তার জন্য, ব্রজেজিনস্কি যুক্তি দিয়েছিলেন যে কোন মূল্যে হোক রাশিয়াকে ইউরেশিয়ায় আধিপত্য কায়েম করা থেকে বিরত রাখা মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক নীতির প্রধান দিক। একথা আরেক ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ রিচার্ড সাকওয়াও জানিয়েছেন। তিনি কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের Russian and European Politics-এর একজন অধ্যাপক।
ইউক্রেনের যুদ্ধকে তাহলে ভূ-রাজনৈতিক হিশাব নিকাশের আলোকে বুঝতে হবে। এই দিকটি সাধারণত আলোচনার বাইরে থেকে যায়, তাই অন্য বিষয়ে যাবার আগে শুরুতেই বিষয়টির গুরুত্ব ধরিয়ে দেয়া গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। আশা করি আগামি কিস্তিগুলোতে পাঠক আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
০১ এপ্রিল ২০২২