'ঈমান': একটি খসড়া নোট
এই খসড়া নোটটি চিন্তা পাঠচক্রের একটি চলমান কাজের খসড়া যা ইসলাম নিয়ে আমাদের অপরাপর কাজের সঙ্গে যুক্ত। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ধর্মচিন্তা ও দর্শনের ইতিহাসের আলোকে ইসলামের মৌলিক প্রস্তাবনা নতুন ভাবে উপলব্ধি এবং বিদ্যমান জ্ঞানচর্চার সীমানা অতিক্রম করবার সম্ভাবনা অন্বেষণ। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক বর্গ নিয়ে ফলপ্রসূ পর্যালোচনার ধারা গড়ে তোলা খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তা এবং সম্প্রতিকালে পাশ্চাত্যে আধুনিক ও উত্তরাধুনিক পরিমণ্ডলে যে তর্কবিতর্ক চলছে সেখানে ইসলাম তার নিজের উন্মোচন, স্বাতন্ত্র্য ও সম্ভাবনা নিয়ে কিভাবে হাজির হতে পারে সেই সম্ভাবনা বিচার একালে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তার ঐতিহাসিক অবদান অস্বীকার যেমন এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য না, তেমনি তাকে নির্বিচারে চিন্তার সার্বজনীন ইতিহাস হিশাবেও আমরা মানি না। পাশ্চাত্যের ইতিহাস একান্তই ইউরোপীয় ইতিহাস। কিন্তু সেটা মুখের কথা হিশাবে বলা নিরর্থক। ইউরোপের ইতিহাসকে ‘বিশেষ’ ইতিহাস হিশাবে গণ্য করবার শর্ত হচ্ছে ইউরোপের বাইরে চিন্তার অনুমান, ধারা ও তর্কবিতর্কের ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্য সুনির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করতে পারা। পাশ্চাত্যের আধুনিক ও উত্তরাধুনিক চিন্তার চ্যালেঞ্জকেও আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের ইতিহাসের দিক থেকে ভেদচিহ্নগুলো আমরা কিভাবে শনাক্ত করব যারা দ্বারা আমরা ইসলামকে তার বিশেষ রূপে চিনতে পারি এবং বুঝতে পারি? এই জিজ্ঞাসাই এই খসড়া নোটটি লেখার কারন। পাশ্চাত্য চিন্তার আধিপত্য এবং বৃত্ত অতিক্রম করে আগামি ও অনাগত দুনিয়ায় প্রবেশের সূত্র সন্ধানের জন্য কোরানূল করিম পাঠের প্রতি চিন্তা পাঠ চক্রের উৎসাহে এই খসড়াটি পাঠচক্রের সদস্য এবং বন্ধু মহলে পেশ করা হোল।
ইসলামে ‘ঈমান’ কথাটির ভাবগত তাৎপর্যকে স্রেফ ‘বিশ্বাস’ নামক যুক্তি, জ্ঞান বা প্রজ্ঞার বিপরীত ধারণায় পর্যবসিত করা যায় না। যদিও প্রাক-ইসলামি ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বের অনুকরণে আজ অবধি সেটাই চলছে। ইব্রাহিমী ধর্মের ইতিহাসের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় ইসলাম উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক প্রাক-ইসলামি ধ্যান-ধারণা বহন করে। কিন্তু কোরানুল করিম স্পষ্টই ঘোষণা দেয় যে আল্লাহ ‘গায়েব’ বা নিরন্তর অনুপস্থিত ঈমান আনতে হবে সেই গায়েবের ওপর। ‘গায়েব’ মানে অদৃশ্য না। কারণ যা অদৃশ্য তাকে দৃশ্যমান করা যায়। যা চোখের সামনে হাজির নাই, তাকে নজরের অধীন আনা অসম্ভব নয়। কিন্তু ‘আল্লাহ’ নামক চিহ্ন ‘আছে’ বা ‘নাই’য়ের অতীত যে বিশেষ প্রকার অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয় সেই আল্লার ক্ষেত্রে ‘আছে’ জাতীয় বিধেয় যেমন অর্থহীন, তেমনি ‘নাই’ বলাও নিরর্থক। কোরানুল করিম আমাদের এই নিরন্তর অনুপস্থিতির প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের কথাই বলে।
যদি তাই হয় ইসলামের প্রস্তাবনা একই সঙ্গে সকল প্রকার পরাতত্ত্বের (Metaphysics) অবসান এবং মানুষের নিজের প্রতি বা নিজের ‘আমি’-র প্রতি নিষ্ঠ হওয়ার আহ্বান। যে চেতনা সবচেয়ে সচেতন ও সজ্ঞান এবং যার মধ্যে আমিত্বের সর্বোচ্চ রুহানি বিকাশ ঘটেছে একমাত্র তার পক্ষেই নিঃশর্তে আত্ম-সমর্পন সম্ভব ও সহজ। কারণ সে ‘মানুষ’ নামক জীবের দেশকালপাত্রাধীন ইহলৌকিক নশ্বরতা বা সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সচেতন ও সজ্ঞান।
কিন্তু ‘ঈমান’-কে বিশ্বাস অনুবাদ করলে সেটা পাশ্চাত্য গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তাচেতনার অধীনস্থ হয়ে পড়ে। ঈমান তখন যুক্তিবর্জিত ‘বিশ্বাস’ হিশাবে হাজির হয় যার বিপরীতে হাজির হয় যুক্তি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি। অর্থাৎ গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তার ঐতিহ্য অনুযায়ী বিশ্বাস (Faith) ও জ্ঞান (Knowledge) পরস্পর বিরোধী ধারণা বা বাইনারি হিশাবে হাজির করা হয়। ইসলামের ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনের আভ্যন্তরীণ তর্কবিতর্কের ঐতিহ্যও এই বিভাজন দ্বারা প্রভাবিত। এই খসড়া নোটে এই বিভাজনকে প্রশ্ন করা হয়েছে। ‘ঈমান’কে আদৌ বিশ্বাস হিশাবে অনুমান ও অনুবাদ করা ঠিক কিনা সেটা কোরানুল করিমের আলোকে অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়েছে। খসড়া নোটটি মে ২১-২২ তারিখে রিদয়পুর বিদ্যাঘরে অনুষ্ঠিত ‘ধর্ম, দর্শন ও ভূ-রাজনীতি’ শীর্ষক আড্ডা-আলাপ বৈঠকেই আনুষ্ঠানিক ভাবে পেশ করা হয়। - ফরহাদ মজহার]
।। ‘ঈমান’ : একটি খসড়া নোট ।।
।। ১।।
আমরা এখানে অত্যন্ত গুরুতর একটি আলাপে বসেছি। হাল আমলের যেনতেন আলাপ নয়। কোন বিষয়কে গোড়ার দিক থেকে সাফ সাফ করে বোঝার প্রক্রিয়া। শুরু থেকেই যারা আমাদেরকে অনুসরণ করছেন তারা জানেন আমরা বিশেষত ইসলামের তাফসিরের ক্ষেত্রে কোনোরকম অনুমান বা অস্পষ্ট আলাপের পথ পরিহার করি। ফলে আমরা ব্যাপক ভাবে কোন যুক্তি মেনে নেবার বদলে তার বিজ্ঞান ও ভিত্তি খালি আকলে খোলাসা করার জানতর চেষ্টা চালাই। আমাদের আজকের আলাপ স্রেপ ঈমান সম্বন্ধে হোলে হোত। কিন্তু আমরা ভাষা, সমাজ, রাজনীতি ও দর্শনের গভীরতম তলদেশ হতে সক্রিয় ও সজীব চিন্তার মোকাবিলায় ‘ঈমান’ কথাটির বাস্তব তাৎপর্য ‘এস্তেম্বাত’ করার অত্যন্ত জরুরি ও দরকারি জিজ্ঞাসা আকারে বেছে নিয়েছি। যাতে আল্লার তাওফিকে আমরা আমাদের ভুল শুধরে সামনে এগিয়ে যেতে পারি। মানবেতিহাসের চিন্তার সফরে একেবারে সামনের কারাভাঁ স্পর্শ করার সৌভাগ্য যেন আমাদের হয়।
আমরা আমাদের আলোচনায় আগে এই আলাপের ধরন ও ধাঁচ বোঝার চেষ্টা করবো। কানখাড়া ও দিলখোলা রেখে আমরা যদি এই আলাপকে বুঝতে পারি আশা করি আপনাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না।
ইসলামে উলুমুশ শরিয়া (علوم الشريعة) নামক শরিয়তী জ্ঞান চর্চার অত্যন্ত সমৃদ্ধ সিলসিলা রয়েছে। আমরা একে বাঙ্গলায় বলতে পারি ধর্ম শাস্ত্র। আরেকটু প্রথাগত মানে করলে দাঁড়ায় ‘ইসলামি জ্ঞান’। এর কোনটাই আমার কাছে সঠিক ও সহীশুদ্ধ তর্জমা বলে মনে হয় না। বাংলার ধর্ম চর্চায় ধর্মশাস্ত্র খুবই গৌণ ব্যাপার। তবে যতটুকুর মধ্যে তার প্রাধান্য ছিল তাকে সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার বিজ্ঞান হিসাবেই বেশি ব্যবহারের চল ছিল। গোড়ার দিকে ধর্ম, ধর্মোপদেশ, পঞ্জিকা কিম্বা গণিত চর্চা ধর্মশাস্ত্রের অধীনেই চালু ছিল। এক পণ্ডিতের মধ্য দিয়ে সকল পাণ্ডিত্য নেয়াই ছিল নীতি। ফলে এই জনগষ্ঠীর জীবন কখনো দ্বীবিভাগ করবার দরকার পড়ে নি। খণ্ডের ভিতর অখণ্ড ভজনাই ছিল তাদের লক্ষ্য। ইসলামেও গোড়ার দিকে মানুষের জ্ঞানচর্চাকে ভাগভাগ (إنقسام المعرفة) করার নিয়ম ছিল না। ফলে কোরান-সুন্নাহ চর্চার ভিতর দিয়ে একজনে সব রকমের এলেম হাসিল করবার একীভবন প্রক্রিয়া (الإتحاد) জারি ছিল। কেননা ইসলামী তুরাসে (التراث الإسلامي) বা ঐতিহ্যে আজকালকার স্রেফ ‘ধর্মতত্ত্ব’ theology চর্চাকেই ইসলাম বলার রেওয়াজ ছিলো না। ইসলামে জ্ঞান ও উপলব্ধি চর্চায় কোন বিভাজন নাই। ‘দ্বীন’ (الدين) বলতে এক পরিব্যপ্ত জীবনব্যবস্থার অন্তর্গত মানুষ এবং তার ইহলোক। মানুষের মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠার যে অপার সম্ভাবনা আল্লাহ তার মধ্যে পুরে দিয়েছেন ‘দ্বীন’ হছে সেই ধরনের চর্চা। ফলে ইসলাম যে সমাজ কিম্বা ‘পরিসর’ এর প্রস্তাব হাজির করে তা আমল ও এলেমের যুগপৎ চর্চার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে। বাস্তব জগতের বাইরে বিমূর্ত কোন দর্শন বা তত্ত্ব খাড়া করা নিজেকে খোদা বানাবার শামিল। এ খাসিলত থেকে আল্লাহ পানাহ।
কিন্তু পাশ্চাত্য চিন্তার প্রবল আধিপত্যের ফলে মানুষের জ্ঞানচর্চার মধ্যে কারিগরি (الصناعة) খাটানো হোল। বাহ্যিক লক্ষণ (الظواهر) ও চিহ্নের (الصور) মধ্যে গিঁট লাগিয়ে আলাদা আলাদা জ্ঞানের শাখা বের করা হোল। এর মধ্য দিয়ে মানবেতিহাসে কত বড় ক্ষতি হয়ে গেলো আজ আমরা চোখের সামনে তা দেখছি। আমার এখানে এটা বলা উদ্দেশ্য যে একালে ‘ইসলামি জ্ঞান’ বা ‘ইসলামি দর্শন’ আকারে যে ধারণা জন্ম হয়েছে, সে সম্পর্কে সজাগ থাকা। কেননা তার শুরুই হয় কিছু অস্পষ্ট অনুমান ও ধারণার মধ্য দিয়ে। প্রথমে ‘এলেম’ বলতে স্রেম ধর্মীয় জ্ঞান বা উলুমুশ শরীয়া এবং তারপরে দুনিয়াবি আর আখেরাতি (العلوم الدنيوية والأخراوية) নামে আরো দুইটা ভাগ করা। ফলে দুনিয়াবি জ্ঞান চর্চা হয়ে দাঁড়ালো ‘ইহলৌকিক কর্মকাণ্ড’, যা বান্দাকে আল্লামুখী করবার বদলে, বান্দাকে তার নফসের খাহেশাতমুখী করে। কিন্তু ইসলামে মানুষের নাফসানিয়াতের দরজা থেকে রুহানিয়াতের মাকামে উঠবার যে শক্তিশালী দার্শনিক প্রস্তাবনা আছে সে কথা তারা আপাদমস্তক ভুলে গেলেন। আমরা এই আলাপে ভুলেও এই পথে ঢুকবো না। কেননা জগতের সঙ্গে ‘আমি’ এর যে সম্বন্ধ মানে কর্তারূপী মানুষ এবং কর্মের বিষয়রূপী প্রকৃতি আধুনিক কালে আমাদের বিরাট সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, সেই সংকট কাটানোর জন্য ‘গায়েবী ঈমান’ (الإيمان بالغيب) কথাটা গভীরভাবে উপলব্ধি ও আত্মস্থ করা ছাড়া আমাদের কোন উপায় নাই। ফলে ‘গায়েবী ঈমান’ কথাটা স্রেফ দার্শনিক জিজ্ঞাসাই নয়, বরং নতুন সমাজ, রাজনীতি ও চিন্তার দিশা অর্জন ও বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেহেতু ‘ঈমান’ বিষয়ে আলাপ করতে চাই কাজেই এই সব গোড়ার বিষয়ে গোড়াতেই ভালো করে জেনেবুঝে নেবার দরকার আছে।
।। ২।।
এবার আমরা আরো সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের আলাপে ঢুকবো। যে কোনো আলাপ যতো নির্দিষ্ট ও পরিচ্ছিন্ন আকার নিবে তার মধ্যে আমরা ততোবেশি নিবিষ্ট ও নিবদ্ধ হতে পারবো। আর একথা তো সবাই জানেন যে, অতি কথার চাইতে সারকথাই ভালো। আমরা বরং সব কথার সার কথা ছেঁকে তুলে আনবো।
ভাষার প্রশ্নে একটা গণ্ডোগোল আছে। কেননা আমরা ভাষার বাস্তব অবস্থা (حقائق اللغة) বুঝতে গেলে বিভিন্ন মোড় ঘুরতে হয়। সরাসরি ভাষার প্রশ্নে যাবার আগে আমি কয়েকটি সোয়ালের জবাব খোঁজা আপাতত গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। আজকালকার মাগরিবি-আরাবি ধারায় খুবই গুরুত্বের সঙ্গে ‘তুরাস’ (التراث) ব্যাপারটি যুগপৎ দার্শনিক, রাজনৈতিক, নৈতিক ও ভাষার জিজ্ঞাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা ঈমানের আলাপের সঙ্গে সেই তুরাসের নাড়ির সম্বন্ধ খুঁজতে যারপরনাই আগ্রহী। ইসলামে সিলসিলা, ধারাবাহিকতা কিম্বা ‘খিলাফাত’ ধারনাটি গুরুত্বপূর্ণ। এখন এগুলো সব ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলবো না। শুধু খিলাফাতের বিশেষ অর্থ থেকে তার আরেকটি অর্থের তল্লাশি করবো।
‘খিলাফাত’, খিলফাতুন, খালিফা (خلافة، خلفة، خليفة)— একই ধাতুমূল থেকে নিষ্ক্রান্ত শব্দমালা। যার মানে একের পর এক, ধারাবাহিকভাবে মানুষের এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্মের হাজির হওয়া। সুতরাং সমগ্র মানবজাতি একে অপরের মধ্য দিয়ে, ধারাবাহিকতার নতিজা আকারে হাজির হয়। কাজে কাজেই মানুষের মধ্যে তার আগের স্তরের খারাপ গুণগুলি যেভাবে বদল হয় তেমনি একই সূত্রে ভালো গুণাবলীও সে লাভ করে। ইসলাম তাই পূর্বের সমস্ত ধর্মকে স্বীকার করে এবং মানবেতিহাসে নিজের আবির্ভাবের গুরুত্বও ঘোষণা করে। ‘তুরাস’ প্রত্যয়টি এই অর্থ থেকে আরো বিশেষায়িত অর্থে ব্যবহৃত হয়। একটা বিশেষ ধারাবাহিকতা বজায় রেখে একটা জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরে যে জ্ঞানচর্চার সিলসিলা গড়ে ওঠে, তাই তুরাস। মানে ওয়ারিশ স্বত্ব। এটা জমি-জমার স্বত্ব নয়। বরং জ্ঞান ও চিন্তার উত্তরাধিকার। ইসলামি জ্ঞানতাত্ত্বিক সিলসিলায় নানা কার্যকারণ ও প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন রকম জ্ঞানতত্ত্ব ও জ্ঞানকাঠামোর উৎপত্তি ঘটেছে। আমাদের আজকের আলাপের নজির রয়েছে ইলমুল কালাম, ইলমুল আকায়েদ- এই দুটোকে ‘উসুলুদ্দীন’ (أصول الدين) বলারও চল ছিলো। এছাড়া ফালসাফা, হেকমাত ও তাসাওউফের আলাপে দর্শন ও উপলব্ধির মধ্য দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ আলাপের মেলা নজির রয়েছে।
খালি চোখে পদ্ধতিগত দিক থেকে আপনারা আমাদেরকে এলমুল কালামের লোক বলতে পারেন। গ্রীক সভ্যতার দর্শন আরবদের ভাষার মধ্যে কথোপকথনের যে নতুন আঙ্গিকের (اسلوب) ইশারা দেয় দার্শনিক পদ্ধতির দিক থেকে তা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তর্কবিতর্কের এই প্রকরণের বাইরে চিন্তার বিশুদ্ধ স্তরে ইসলামের প্রস্তাবনা ও হেদায়েত সমূহ বিকশিত করাও যায়। ‘ধর্মীয় যুক্তিবিদ্যা’ চিন্তার নিজের কাছে কিম্বা স্বভাবের কাছে ফিরায় না। খোদায়ী অন্তর্দৃষ্টি ও বুদ্ধির দৃষ্টিকোণ (البراهين الكشفية) ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সেই কাজ যে করা সম্ভব সেটা এখনো সম্ভাবনা। ফলে আমাদের এই আলাপের মধ্য দিয়ে আপনারা আশা করি এই রকম চিন্তা বাদ দিবেন। আমরা আমাদের রুহানি অভিজ্ঞতা এবং সক্রিয় ও সজীব চিন্তার অধীনে কালাম শাস্ত্রের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতাকে বুঝি এবং তাকে পর্যালোচনা করি। কিন্তু তার সীমায় আবদ্ধ থেকে নয়। বরং আরো উন্নত ও উচ্চস্তরের অভীজ্ঞতা অর্জনের বাস্তব আকাংখার সম্মুখীন হওয়াই আমাদের একমাত্র বাসনা।
আমরা নানান ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে ইসলামের বৈপ্লবিক মর্ম বোঝার প্রতি আগ্রহী। বিশ্ব ইতিহাসে ইসলামের মহিমা ও মাহাত্ম্য উপলব্ধি করবার দায় আমরা বোধ করি, আমরা চাই বিশ্বব্যাপী চিন্তার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আমরা যেন সামনের সারিতে বসে লড়তে পারি। বলা বাহুল্য এটা কঠিন কাজ। কাজেই ইসলামের অতীত ইতিহাস বা ইসলামের আভ্যন্তরীন তর্কবিতর্কের ঐতিহ্য discursive tradition থেকে যেমন আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, তেমনি নতুন ভাবে চিন্তা করবার চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকিও গ্রহণ করতে হবে। কোন বদ্ধমূল, আযৌক্তিক কিম্বা প্রজ্ঞাশূন্য চিন্তার অভ্যসের প্রতি আমাদের নির্বিচার আসক্তি থাকলে চলবে না। ইসলামকে সব ধরনের পিছুটান ও পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে আমাদের মৌলিক ভাবে চিন্তা করতে হবে।
এটা দীর্ঘ সফর ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ। তবে ইসলামের ‘ঈমান’ ব্যাপারটা এই কাজে আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমরা সহজেই ভিতর ও বাহিরের বৈশিষ্ট্য থেকে একে আলাদা করতে পারি না। ফলে একই সঙ্গে এই আলাপে আলাদা আলাদা খতে প্রতিটি বিষয় চিহ্নিত করা জরুরি। সংক্ষেপে হোলেও।
।। ৩।।
আমরা আমাদের আলাপের সুবিধার্থে ভিতর দিকটা নিয়েই আগে কথা বলবো। আমরা যদি একবার ভিতর বুঝে নিতে পারি বাহির দিকটাও অনায়াসে বাগে এসে যাবে। ঈমানের আসল হাকিকত খুঁজে বার করা ভাষার ভিতরের গবেষণার ক্ষেত্র। তাই যথাসম্ভব ভিতরকে পুরাপুরি বাইরের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা জরুরি। এই কারণে 'ঈমান' এর অন্তর্নিহিত মানে বা অর্থ বুঝার জন্য শুরু থেকেই কয়েকটি পর্যায়ে ঈমানের মূলধাতু, ব্যবহার এবং কোরানুল কারিমে ঈমান থেকে নিষ্পন্ন শব্দাবলির সাথে স্থানকালপাত্রের সংযোগ ও সম্বন্ধ বিচার-বিশ্লেষণ করবো।
কোরান শরীফে 'ঈমান' কথাটি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখান থেকে একটি অর্থকে প্রধান ধরা মুশকিল। ঈমানের ভাষাতাত্ত্বিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক ভাষ্য রচনায় কুরানই আমাদের একমাত্র হেদায়েত। কোন আয়াতে 'ঈমান' যে প্রসঙ্গ, পরিপার্শ্ব কিম্বা ব্যবহারিক দিক থেকে যে অর্থ নিয়ে হাজির হয়, তার সঙ্গে অন্যান্য আয়াতের সম্পর্ক বিশ্লেষণ আমাদের প্রধান আগ্রহের বিষয়। আমরা দেখাব কুরানে অন্যান্য ব্যবহারের মধ্যে ‘গায়েবি ঈমানের’ তাৎপর্য কি এবং কোথায়? ঈমান মানে কি বিশ্বাস? যদি হয়, তাহলে ‘গায়েব’ বা যা সবসময় অনুপস্থিত বা নিরন্তর অনুপস্থিত, তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা স্ববিরোধী ধারণা কিনা। অতএব ঈমান-কে স্রেফ ‘বিশ্বাস’ অনুবাদ করলে গায়েবে ঈমান কথাটার যে গভীর দার্শনিক তাৎপর্য তা আমরা হারিয়ে ফেলি। তাহলে ঈমানের সম্ভাব্য অর্থ কি হতে পারে? নাকি আমরা ‘ঈমান’-কে অনুবাদের চেষ্টা না করে ঈমান রেখে তার দার্শনিক তাৎপর্যের গভীরতা অন্বেষণ করব।
ইসলামি ধর্মশাস্ত্রে, ধারাবাহিকভাবে আকিদা, কালাম এবং ধর্মীয় আলাপে দেখা যায় যুগে যুগে ঈমানের এমন অর্থ প্রতিষ্ঠার দিকেই চেষ্টা চালানো হয়েছে, যার সঙ্গে ঈমান শব্দটির নাড়ির যোগ নাই। ফলে তার মধ্যে মারাত্মক অর্থ বিপর্যয় ঘটেছে। আমরা একে আদবের সঙ্গে ‘তাসামুহ’ বলি। মহান পূর্বসূরীদের অনুসন্ধানে যতটুকু ভালো আমরা সাদরে তা কবুল করি। এবং আজকের পর্যায়ে আমরা যে প্রজ্ঞা ও চিন্তা হাসিল করেছি তার আলোকে তাদের ‘তাসামুহাত’ ব্যাখ্যা করি। ইসলামি ইতিহাসে এই রকম নিরন্তর আলোচনা পর্যালোচনার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে।
তাদের কথাবার্তায় ‘ঈমান’ শব্দটি নিয়ে আগাগোড়া পরিষ্কার কিম্বা কোনো তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা নজরে পড়ে না। কেননা 'ঈমান' কথাটা যদি 'আমানা' থেকে উৎপত্তি হয়, তবে বর্ধিত 'আলিফ' যোগে তার অর্থ আরো বিশুদ্ধতম অর্থ তৈরি করবে। 'আমানা' অর্থ যদি আশ্রয় বা নিরাপত্তা হয়, তাহলে আল্লার তরফে নিংশর্ত আশ্রয় গ্রহণই হবে ঈমানের মূল অর্থ। যখন এই অর্থ থেকে অন্য অর্থে 'ঈমান' কথাটি ব্যবহার হবে, তখন সেই ব্যবহার ঈমানের 'প্রথম অর্থ' (الدلالة الأولى) থেকে দ্বিতীয় অর্থে (الدلالة الثانية) পরিবর্তন করানো হিসাবে গণ্য হবে। 'দ্বিতীয় অর্থ'–কে বলা হবে রূপক কিম্বা গৌণ অর্থ। কাজেই প্রথাগত অর্থে 'বিশ্বাস কিম্বা কোনো কিছুকে সত্য হিসাবে ধরে নেয়া' (تصديق) এর ওপর স্বয়ং ঈমানের দিক থেকেই বিতর্কিত মনে করা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে খোদ এই কথাগুলোই 'ঈমান' এর গায়ে এমনভাবে লেপ্টে গেছে যে আজকাল ঈমানের সিরাতসুরাত বোঝাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রবন্ধে উভয় অর্থের অন্তর্নিহিত সম্বন্ধ কি, একটু পরেই আমরা তা বিচার করবো।
ইসলামি ইতিহাসে গোঁড়ার দিকে এ নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক দেখা গেলেও তখনকার আলেমদের নিকটে ভাষা, ভাষার ইতিহাস, অর্থগঠন এবং এক অর্থ থেকে অন্য অর্থের পার্থক্য ও রূপান্তরের বিজ্ঞান ও কলাকৌশল অস্পষ্ট ছিলো। ফলে তাদের ভিতরের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম, ফকিহ কিম্বা মুতাকাল্লিমগণ 'আকিদা' এর বিষয়বস্তু হিসাবে 'ঈমান'– নিরেট বিশ্বাস বা 'তাসদিক' হিসাবে তাফসির করেছেন। এই তাফসিরের সঙ্গে নানা পক্ষের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলছিলো, তাকে পৃথক করে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। ফলে 'ঈমান' শব্দের ধাতুগত রূপান্তরের ইতিহাস, অর্থের সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক এবং 'ইসলাম' এর মধ্যে আসলেই 'ঈমান' শব্দটি কিভাবে আছে, সেই অনুসন্ধানের প্রতি তারা মনোযোগ দিতে পারেন নি।
।। ৪।।
আমরা এখানে সংক্ষেপে আধুনিক ও পুরাতন বিভিন্ন ভাষাবিদদের বয়ান তুলে ধরছি। তাদের মধ্য দিয়ে আমরা বোঝার চেষ্টা করবো, আসলে আদিতে 'ঈমান' বলতে কি বুঝাতো? এটার জন্য একইসঙ্গে তার উৎপত্তি, রূপান্তর এবং ধাতুগত পরিবর্তন বোঝাও গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য আমরা উপরের দাবির ভিত্তিতে নিচে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পেশ করছি।
আভিধানিক ও শাব্দিক বিশ্লেষণ:
ঈমান (الإيمان) 'আল ইফআল' এলাকার শব্দ। এই ধরনের শব্দের বৈশিষ্ট্য হোল শব্দের 'বিশুদ্ধতম ধাতু'র অর্থ আগাগোড়া রক্ষা করার দিকে লক্ষ্য রাখা। এই এলাকার কোনো রূপান্তরিত ক্রিয়াপদ যখন ব্যবহার হবে, তখন তার ধাতুগত অর্থকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে অর্থ আদায় করতে হয়। উদাহরণত 'আল ইকরাম' মানে সম্মান করা, আল ই'লাম মানে জানানো বা জ্ঞান দান করা। এই এলাকার সকল শব্দই নিজের উৎপত্তিগত অর্থ রক্ষা করে ব্যবহার হয়। এই বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় 'আল ঈমান' কথাটার আভিধানিক অর্থ হোল, নিরাপত্তা বা আশ্রয় দান। এখানে তার উৎপত্তির মূলে যে তিনঅক্ষরের ধাতু রয়েছে, সেই অর্থকেই সে প্রকাশ করছে। কুরানুল কারিমে সুরা কুরাইশে নিছক এই অর্থে বলা হয়েছে,
(وَءَامَنَهُمْ مِنْ خَوْفٍ)
তিনি তাদেরকে ভয় থেকে নিরাপত্তা দান করেন।
এখানে যদি 'ঈমান' এর এই অর্থ বাদ দিয়ে তর্জমা করা হয়, 'তিনি তাদেরকে ভয় থেকে সত্যায়ন করেছেন কিম্বা বিশ্বাস করেছেন'– তা কোনো ভাবেই সঠিক তর্জমা হিসাবে গণ্য হবে না। আদিতে 'ঈমান' শব্দটি নিরাপত্তা বলুন কিম্বা বলুন আশ্রয় এই অর্থেই আসল। কেউ কেউ এ কথা স্বীকার করলেও তাদের কথার মধ্যে বিচ্যুতি এবং অস্পষ্টতা থেকে গেছে। 'ঈমান' এর প্রকৃত মানে বের করার দিকে খুব একটা আগ্রহ ছিলো না। ফলে ইসলামে 'ঈমান' কথার মধ্যে যে অর্থগত সম্ভাবনা বা সংকেত রয়েছে, তাও তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গিয়েছিলো। দু এক জন 'তাসদিক' কথাটাকে ঈমানের রূপকার্থ মনে করলেও শেষমেশ এর পক্ষেই ওকালতি করে গেছেন।
প্রাচীন বইপুস্তকের ভিতর থেকে আমরা একটি বইয়ের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ইবনুল ফারিস (মৃত্যুঃ ১০০৪ খৃঃ) ঈমানের মূলধাতু (أمن) এর আলোচনায় এসে বলেন,
(ﺃﻣﻦ) اﻟﻬﻤﺰﺓ ﻭاﻟﻤﻴﻢ ﻭاﻟﻨﻮﻥ ﺃﺻﻼﻥ ﻣﺘﻘﺎﺭﺑﺎﻥ: ﺃﺣﺪﻫﻤﺎ اﻷﻣﺎﻧﺔ اﻟﺘﻲ ﻫﻲ ﺿﺪ اﻟﺨﻴﺎﻧﺔ، ﻭﻣﻌﻨﺎﻫﺎ ﺳﻜﻮﻥ اﻟﻘﻠﺐ، ﻭاﻵﺧﺮ اﻟﺘﺼﺪﻳﻖ. ﻭاﻟﻤﻌﻨﻴﺎﻥ ﻛﻤﺎ ﻗﻠﻨﺎ ﻣﺘﺪاﻧﻴﺎﻥ. ﻗﺎﻝ اﻟﺨﻠﻴﻞ: اﻷﻣﻨﺔ ﻣﻦ اﻷﻣﻦ. ﻭاﻷﻣﺎﻥ ﺇﻋﻄﺎء اﻷﻣﻨﺔ. ﻭاﻷﻣﺎﻧﺔ ﺿﺪ اﻟﺨﻴﺎﻧﺔ.
يقال: ﺃﻣﻨﺖ اﻟﺮﺟﻞ ﺃﻣﻨﺎ ﻭﺃﻣﻨﺔ ﻭﺃﻣﺎﻧﺎ، ﻭﺁﻣﻨﻨﻲ ﻳﺆﻣﻨﻨﻲ ﺇﻳﻤﺎﻥا. ﻭاﻟﻌﺮﺏ ﺗﻘﻮﻝ: ﺭﺟﻞ ﺃﻣﺎﻥ: ﺇﺫا ﻛﺎﻥ ﺃﻣﻴﻨﺎ
মূল অক্ষর হামযা, মীম এবং নূন। এর পরস্পর নিকটবর্তী মূল দুটি অর্থ আছে,
প্রথম অর্থ: 'আমানত' যেটি খেয়ানতের বিপরীতে আসে। আর এর অর্থ হল, অন্তরের স্থিরতা বা স্বস্তি। অপরটি হোল তাছদীক বা সত্যায়ন। উভয়টির অর্থ আমাদের কথামতে সমপর্যায়ের।
ইমাম খলিল বিন আহমদ (মৃত্যুঃ ৭৮৬ খৃঃ) বলেন: أمنة (আমানাহ) এটি أمن থেকে উদ্ভূত। أمان (আমান) অর্থ হলো নিরাপত্তা প্রদান করা। এবং أمانة (আমানাত) হোল খেয়ানতের বিপরীত।
আরবদের কথায়,
"ﺃﻣﻨﺖ اﻟﺮﺟﻞ ﺃﻣﻨﺎ ﻭأمنة ﻭﺃﻣﺎﻧﺎ، ﻭﺁﻣﻨﻨﻲ ﻳﺆﻣﻨﻨﻲ ﺇﻳﻤﺎنا"
উদাহরণ (১) আমি একজন ব্যক্তিকে নিরাপত্তা (ﺃﻣﻨﺎ ﻭأمنة ﻭﺃﻣﺎﻧﺎ) দিলাম। (২) তিনি আমাকে নিশ্চিত নিরাপত্তা দিলেন বা দিবেন। মাকায়ীসুল লুগাহ্ (১/১৩৪)
ভাষাবিদ ইবনুল ফারিসের বর্ণনায় ইমাম খলিলের বরাত থেকে স্পষ্ট যে, ভাষার মধ্যে 'ঈমান' কথাটা ধাতুগত অর্থেই আসল। তার সূত্র ধরেই আমরা অন্যান্য ভাষাবিদদের সুরে বলতে পারি 'আল ইফআল' এলাকার শব্দের প্রয়োগ তার বিশুদ্ধতম তিনবর্ণের অর্থেই আসল এবং অন্য অর্থে যখন একে ব্যবহার করা হয়, তখন তাকে রূপক কিম্বা অর্থের মধ্যে আরেক ধাপ রূপান্তর হিসাবে ধরা হবে। ভাষা নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের মতে কোনো অর্থের রূপান্তর তখনই ঘটানো চলে যখন তার প্রথম অর্থের বিলয় ঘটে। কিন্তু আমরা একটু পরেই দেখবো ইসলামে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ সর্বদাই গুরুত্বের সঙ্গে ছিলো। বিশেষ ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস আকারে ঈমান কথাটি তখনকার সমাজ, তর্কবিতর্ক ও ঐতিহাসিক কারণে সৃষ্টি হয়েছে। যদ্দরুন 'ঈমান' এর আদি কিম্বা প্রথম অর্থের মধ্যে বিপর্যয় ঘটে। সমাজ ও জ্ঞানের পরিমণ্ডলে ফলে ইসলাম বিশ্বাস আকারে হাজির হওয়া শুরু করে। এখনো সেই সমস্যার মধ্যেই আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। কাজেই এই তর্ক এড়াবার সুযোগ নাই।
ভাষার ব্যবহারে, অন্তত কুরানের ভাষা বুঝার এই সাধারণ ব্যকরণের দিকে আমাদের দৃষ্টি ফেরানো জরুরি। এই ধরনের বিচ্যুতি কিম্বা অসতর্কতার ফলে চিন্তা ও দর্শনের মধ্যে যে মারাত্মক সমস্যা তৈরি হয়, তার পরিণতিও মারাত্মক। ঈমানের ক্ষেত্রে তখন সেই সমস্যা বিশ্বাস ও বুদ্ধির দ্বন্দ্ব আকারে হাজির হয়। অথচ কুরানুল কারিম কিম্বা রাসূলের সিরাত থেকে এর পক্ষে কোনো যুক্তিযুক্ত জবাব পাওয়া যায় না। তখনই আমরা এই প্রশ্নে বিচলিত হয়ে উঠি, আসলেই 'ঈমান' মানে কি? গায়েবের সঙ্গে ঈমান কথাটা কেনো ব্যবহার হোল? যিনি 'গায়েব', যিনি 'নাই' তার প্রতি ঈমান, পক্ষান্তরে ধরে নেয়া জিনিস বা নিছক বিশ্বাসের পার্থক্য কি?
।। ৫।।
এবার আমরা আসল আলাপে ঢুকবো। ঢুকার আগে জেনে নেবো ‘তাসদিক’ (تصديق) বলতে কি বুঝায়। আমরা ইসলামি জ্ঞানতত্ত্বে 'তাসদিক' কথাটার নানা রকম অর্থ দেখি। বাংলায় আরবি 'তাসদিক' কথাটা থেকেই 'বিশ্বাস' কিম্বা আল্লাকে ‘সত্য' বলার অর্থ করা হয়। আমরা ভাষার প্যাঁচে পড়তে চাই না। কিন্তু আল্লাকে সত্য বলা না বলা নিয়ে গুরুতর তর্কে এখানে অলরেডি ঢুকেই পড়েছি। কিছুদূর গেলে আপনারা বুঝবেন আমি কেনো এ কথা বলেছি।
তাসদিক কথাটা 'তাফয়ীল' এলাকার শব্দ। এর মানে হচ্ছে, কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে সত্য হিসাবে গণ্য করা বা কোনো একটি কথাকে সত্য হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া। এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যার আলোচনায় শুরুতেই দুইভাগে 'জানা'–কে ভাগ করা হয়ঃ
এক. তাসাওউর বা কল্পনা বা অনুমানের সাহায্যে অর্জিত জানা।
দুই. 'তাসদিক' মানে 'বিষয়' (موضوع), 'বিধেয়' (محمول) এবং 'সম্বন্ধ' (نسبة) মিলে গঠিত বাক্য। মানে ভাষার মধ্যে তিনটি অংশের মাধ্যমে গঠিত 'বাক্য' হোল 'তাসদিক'। আল্লাকে ভাষার মধ্যে 'তাসদিক' করা মানে তাকে বস্তু হিসাবে গণ্য করা।
এরিস্টটলের কিতাবুল বোরহান– এর মধ্যে পরিষ্কার লিখা আছে,
" চিন্তা বা অনুমান খাটিয়ে বোঝা যায় এমন বস্তুর আগে যে এলেম (العلم) হাজির থাকে, তা দুই রকম, এক. 'তাসদীক' (تصديق) বা সত্যায়ন মানে কোনো বস্তুর 'থাকা' বা 'না থাকার' জ্ঞান। আরেকটি হচ্ছে 'তাসাওউর' (تصور) বা কল্পনা মানে কোন বস্তুর নামচিহ্ন কি বুঝায়, সেই জ্ঞান ।"
আল্লাহ পাকের ওপর একটা বস্তুর মতো নাই বা আছে বিশেষত্ব খাটে না। এরিস্টটলের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, আসলে বুদ্ধির জগতে 'নাই বা আছে' বুদ্ধির মধ্য দিয়ে সংজ্ঞায়িত কিম্বা সীমায়িত হয়। বুদ্ধি যা কিছু আছে বা নাই আকারে কল্পনা করে, তার ব্যাপারে আছে বা নাই খাটে। যাকে সম্ভাব্য কিম্বা আবশ্যক অস্তিত্ব হিসাবে ধরে তার নিকটতম বা দূরতম বর্গ এবং বৈশিষ্ট্য, পদ ও শ্রেণী নির্ণয়ের মধ্য দিয়ে একটা বৌদ্ধিক অর্থ বা সংজ্ঞা তৈরি করা যায়। আমরা বুদ্ধির এই অর্থকে বলি ‘মাহিয়াত’, মানে কোন কিছুর সারসত্ত্বা। ‘এটা কি’ প্রশ্ন বৈষয়িক প্রয়োজনে মানুষ ব্যবহার করতে পারে। দর্শনের মধ্যে তার গুরুত্বও অনস্বীকার্য। কিন্তু আল্লার উজুদ বা 'বর্তমানতা' বুদ্ধির অস্তিত্বে (وجود ذهني) পর্যবসিত করার ক্ষতি মারাত্মক। আল্লার উজুদ নাই বা আছের বাইরে নিরন্তর গায়েব হয়ে থাকেন। যাকে রক্তমাংসের শরীর উৎপাদিত ভাষা কিম্বা সংজ্ঞা ও পরিচয়ের মধ্যে আটকানো যায় না। ইসলামে আল্লাহ 'গায়েব', এই গায়েবের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করাই মুত্তাকির কাজ। কেননা ‘আছে’ বা ‘নাই’ বলার তর্ক বহুকাল জারি ছিলো। কিন্তু চিরপরিচিত এ পথ ধরে ইসলাম হাঁটে নাই। বরং মানুষের রুহানী সম্ভাবনার নিরন্তর বিকাশের তাগিদে গায়েব, যা অনুপস্থিত কিন্তু সর্বত্র উপস্থিত তার সামনে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করার দাওয়াত নিয়ে হাজির হয়েছে। কাজেই ইসলাম যে কথা বলতে বিশ্ব ইতিহাসে হাজির হয়েছে, তা ছিলো পুরাপুরি নতুন ও বৈপ্লবিক। কিন্তু এই দিকে আমরা সম্পূর্ণ বেখেয়াল।
এবার আমরা ‘গায়েবি ঈমান’ ও বিশ্বাস কিম্বা তাসদিক কথাগুলির মানে ধরতে পারবো। এই কথাগুলি ধারণাগত দিক থেকে এবং একইসাথে ঐতিহাসিক দিক থেকে একে অপরের বিপরীত।
।। ৬।।
কুরানুল কারিমে ’ঈমান’ কথাটার ব্যবহার যথেষ্ঠ তাৎপর্যপূর্ণ। এই সকল আয়াত পর্যবেক্ষণ করে আমরা একটা নীট ফলাফল পাই। কুরানে কোত্থাও আল্লার শানে ‘তাসদিক’ কথাটা এস্তেমাল হয় নাই। বরং বেশ কিছু পূর্ববর্তী কেতাব ও রাসুলদের ব্যাপারে এই শব্দের বিস্তর ব্যবহার হয়েছে। ইসলাম তার আগের আসমানি কেতাব ও ধর্মকে সত্য বলে ঘোষণা করে। তাকে বিশ্বাসও করা যায়। কিন্তু আল্লার শানে ‘ঈমান’ ছাড়া অন্য কোন শব্দ কোথাও ব্যবহার হয় নি। আমরা তাই বিশ্বাস মানেই তাসদিক আর তাসদিক মানেই বিশ্বাস আর তাসদিকই হোল ‘ঈমান’ এভাবে সরলীকরণ করতে পারি না। উদাহরণ স্বরূপ একটি আয়াত উদ্ধৃত করছি,
وَ مَا کَانَ هٰذَا الۡقُرۡاٰنُ اَنۡ یُّفۡتَرٰی مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ وَ لٰکِنۡ تَصۡدِیۡقَ الَّذِیۡ بَیۡنَ یَدَیۡهِ وَ تَفۡصِیۡلَ الۡکِتٰبِ لَا رَیۡبَ فِیۡهِ مِنۡ رَّبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ
আর এ কুরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো রচনা হওয়া সম্ভব নয়। বরং এর আগে যা নাযিল হয়েছে এটা তার সত্যায়ন এবং আল কিতাবের বিশদ ব্যাখ্যা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটা সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে। (সুরা ইউনুসঃ ৩৭)
যদি ঈমান আদিতে সত্যায়ন অর্থেই ব্যবহার হোত তাহলে সত্যায়নের বদলে ঈমান কথাটাই ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সামগ্রিক অর্থে এই ব্যবহার জায়েয নাই। খণ্ডিত ভাবে যদিও করা যায়, সব ক্ষেত্রে অন্তত ঈমানের মত তাৎপর্যপূর্ণ একটি পরিভাষা নিরেট বিশ্বাস আকারে তর্জমা করা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
আমরা হাজারটা উদাহরণ না এনে এখানে আরো দুই জন প্রসিদ্ধ মুফাসসির ও মুহাদ্দিসের বয়ান উল্লেখ করবো। প্রথম জন আল্লামা আলুসি। আলুসি লিখিত তাফসির ‘রুহুল মাআনি’ বিশ্ব বিখ্যাত। তিনি ঈমানের ব্যাখ্যায় বলেছেন,
অভিধানে ঈমান হোল, 'তাসদিক' অর্থাৎ সংবাদদাতার আদেশ স্বীকার ও কবুল করা, এবং তাকে সত্যবাদী হিসাবে গণ্য করা।
এরপর বলেন,
এই শব্দটি 'আল আম্ন' (الأمن) থেকে 'ইফআল' এলাকা থেকে ব্যবহার হয়েছে। 'বা' হরফ যুক্ত করে (آمن به) যখন ব্যবহার হয়, তখন তার মূল অর্থ যেন এরকম, বিরোধিতা ও মিথ্যা আরোপ করা থেকে তাকে নিরাপদ করা।
'লাম' হরফ দিয়ে যখন ব্যবহার হয়, যেমন,
(قَالُوا أَنُؤْمِنُ لَكَ وَاتَّبَعَكَ الأَرْذَلُونَ)
আমরা কি তোমার কথার ঘোষণা দেবো, অথচ তোমার অনুসরণ করে নিচু শ্রেণীর লোকেরা। সুরা শুআরা (১১১)
হাদীসে রাসুল সা. যখন 'বা' যুক্ত করে বলেন,
(الإيمان أن تؤمن بالله)
ঈমান হোল আল্লাকে স্বীকার করা।
এই দুইটা নজির দিয়ে আলুসি দেখান, প্রথম বাক্য 'ঘোষণা দেয়া' অর্থ গ্রহণ করেছে। দ্বিতীয় বাক্য 'স্বীকার করা' অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও আরো একটি অর্থে 'ঈমান' এর ব্যবহার রয়েছে। আলুসি একে ঈমান' শব্দের প্রচলিত মূল অর্থ হিসাবে গণ্য করেছেন। আরবিতে (ذا أمن) বলা হয়, যখন কোনো লোকের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হয়। (আলুসী, রুহুল মাআনী ১:১১৩)
লাগাতার আরেকটি উদ্ধৃতি এখানে তুলে দিচ্ছি। এটা ইবনে হাজার আস্কালানীর বক্তব্য। তার লেখা কিতাব ফাতহুল বারি সর্বজন সমাদৃত। তিনি কিছুটা স্পষ্ট করেই বলেছেন,
আভিধানিক অর্থে 'ঈমান' হোল, 'তাসদিক'। শরিয়তের পরিভাষায় রাসুল তার রবের পক্ষ থেকে যা কিছু এনেছেন, তাকে সত্য হিসাবে গণ্য করা।
এরপর কিছুদূর গিয়ে বলেছেন,
'ঈমান' আল আম্ন (الأمن) থেকে উদ্ভূত বলার মধ্যে ‘আমান’ এবং ‘তাসদীক’– এই দুই অর্থের পার্থক্যের কারণে আপত্তি ওঠে। তবে বলা যায়, এই শব্দের মধ্যে 'রূপক অর্থ' প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। (ফাতহুল বারী ১: ৪৬)
ভাষার মধ্যে অর্থের অনুপ্রবেশ ঘটে। আমাদের হুঁশে হোক বা বেহুঁশে ভাষা নানান বাস্তবতার কারণে অর্থের রূপান্তরে ঘটায়। ঈমানের মধ্যে এই রূপান্তর ঘটেছে প্রবল সচেতনতার ভিতর দিয়ে। দুঃখের বিষয় হোল তারা তখন ঈমান জিনিসটির যে গভীরতম তাৎপর্য তাকে ধরতে পারেন নি। আমরা রূপকতা বা রূপান্তর মানে সম্পর্কর পুরানা কেতাবাদিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধ আলাপ দেখি। উপমহাদেশে দীর্ঘদিন যাবত পঠিত ও নানা ভাবে চর্চিত মান্তেকের কেতাব সুল্লামুল উলুমে বলা হয়েছে,
أن المنقول يمتاز عن المجاز بأن النقل فيه ترك للمعنى الأصلي ويكون اللفظ مشهورا في المعنى الثاني وفي المجاز لا يكون المعنى الأول وهو الحقيقي متروكا.
নকল করা অর্থ আর রূপান্তরিত অর্থের ফারা ঘটে এভাবে যে, নকল করা মানে আসল অর্থ বর্জন করা এবং উক্ত শব্দটি দ্বিতীয় অর্থেই প্রসিদ্ধ হয়ে উঠা। রূপক হোল যেখানে প্রথম অর্থ, মানে আসল ও হাকীকী অর্থ পরিত্যাক্ত হয় না। (সুল্লামুল উলুম, মুহিব্বুল্লাহ বিহারী, পাকিস্তানি ছাপা, পৃ, ৪০)
আরবি ‘মাজায’ মানে এখানে আমরা ‘রূপক’ বলছি। আরবি মাজায শব্দের মধ্যে এই ইশারা নিহিত, কোন শব্দ যখন আসল অর্থ থেকে কোন কারণে পরবর্তী অর্থের অবস্থায় চলে আসে তখন প্রথম অর্থ নেবার সুযোগ থেকে যায় (جواز المعنى الأول)। এখান থেকে পরিষ্কার যে রূপক অর্থ এবং এক অর্থ থেকে আরেক অর্থে নকল করার মধ্যে স্পষ্ট ফারাক রয়েছে। কাজেই 'ঈমান' কথাটার অন্তরাল থেকে তার আদ্যার্থ মোটেও ছুটে যায় নি। বরং ভাষার মধ্যে অস্বাভাবিক ভাবে বসানো হয়েছে।
।। ৭।।
আরেকটু গভীর ভাবে যদি দেখি তাহলে আল্লামা যামাখশারির একটি বিশ্লেষণ সামনে রাখতে পারি। তার বক্তব্যের সারার্থ হচ্ছে,
আমি যখন ঈমান করি, আমি তখন নিরাপদ ও বিপদমুক্ত হই। এরপর এই মানে থেকে আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরযোগ্যতা অর্থে রূপান্তর। তারপর সত্যায়ন করা, অর্থাৎ তাসদিকে এর রূপান্তর ঘটে।’ (তাফসিরুল কাশশাফ, পৃঃ ৩৮, দারুল মাআরিফ, বৈরুত, লেবানন।)
এর বাইরে যামাখশারি বেশি কিছু বলেন নি। ফলে কিভাবে এই পরিবর্তনগুলো ঘটল সেই গবেষণার কাজ স্বাভাবিক ভাবেই পরবর্তী লোকদের ঘাড়ে পড়বে। ফলে বোঝা যাচ্ছে এই রূপান্তরগুলিঃ আশ্রয়>নিঃশর্তে আশ্রয়>সত্যায়ন= পরে বঙ্গদেশ ও আধুনিক মুসলিম চিন্তাবিদদের ফেইথ faith বা বিশ্বাস আকারে তর্জমা ভাষা ও ইতিহাস সম্পর্কে মারাত্মক গাফিলতির ফল।
‘ঈমান’ শব্দের মধ্যে ক্রমাগত এই বিপর্যয়ের দরুন ঈমান কথাটির ব্যুৎপত্তি ইতিহাসও কিছুটা অস্পষ্ট ও অ্পরিচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। আরবিতে অর্থের মধ্যে রূপান্তর ঘটাবার ক্ষেত্রে ‘সিলাহ’ কিম্বা বাংলায় যাকে বলে উপসর্গ তার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। আরবিতে এটাই নিয়ম। ঈমানের সঙ্গে আরবি হরফ ‘বা’ কিম্বা ‘লাম’ যোগে অর্থের রূপেও পার্থক্য ঘটে। ‘বা’ যোগে ‘ঈমান’ সত্যায়ন বা সত্য হিসাবে ঘোষণা করা অর্থে ব্যবহৃত হবার নিশ্চিত কোন সম্ভাবনা নাই। কারণ ঈমান কথাটা মূল অর্থেই সুরা কুরাইশে ‘মিন’ উপসর্গ যোগে এস্তেমাল হয়েছে। আর এগুলো কোনটাই পুরাপুরি আসল অর্থকে নাকচ করে দেয় না। বরং প্রেক্ষাপট ও উপযোগিতার ভিত্তিতে তর্জমা করা হয়।
আমরা দেখি এই তর্জমা করতে গিয়ে ঈমানকে বিশ্বাস আকারে অনুবাদ করা হয়েছে। আভিধানিক ব্যাখ্যায় আমান বা নিরাপত্তা উৎসমূল থেকে সরিয়ে আমানত বা বিশ্বস্ততা উৎসমূল আকারে পেশ করা হয়েছে। ফলত শুধু ঈমান কথাটার অর্থে signified বিপর্যয় ঘটেনি, বরং তার চিহ্নের signifier মধ্যেও বিপর্যয় ঘটেছে। আর একের পর এক পর্দা পড়ে তার মধ্যে নিহিত ইশারা sign জুলমাতে হারিয়ে গেছে। ঈমান কথাটি তার আদ্যার্থ থেকে বেরিয়ে এসে আরো দুটি অর্থে ঢুকে পড়া আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করবো? আমরা কি একে কারিগরি কিম্বা ভাষার মধ্যে নানা রকম ব্যাখ্যার পরিণতি হিসাবে গণ্য করবো? এ প্রশ্ন তোলা থাকলো। আমরা তার ফলশ্রুতিতে ঈমান অর্থ বুঝি বিশ্বাস। কাজেই ইসলাম একটা পশ্চাৎপদ ধর্ম। বুদ্ধি ও চিন্তাকে শেষ করে দেয়াই তার লক্ষ্য।
এতে পাশ্চাত্যের আরেকটি প্রবল প্রপাগাণ্ডা শক্তিশালী হয় যে ইসলাম ঐতিহাসিক ভাবে একটি ‘বিশেষ’ ধর্মোপলব্ধি কেবল। পুরানা ও প্রাচীন: দেড় হাজার বছর আগের ‘বিশেষ’ উপলব্ধি। চিন্তার ইতিহাসের দিক থেকে ধর্মতত্ত্বের অধিক যার কোন ধর্ম-বিমুক্ত স্বাধীন অবদান নাই। তাই তাদের দাবি একালে ইসলামেরও কোন কোন উপযোগিতা নাই। ‘ইসলাম’ নামক এই প্রাচীন ধর্মীয় উপলব্ধি সার্বজনীন বা অনিবার্য সত্যের নতুন কোন ইশারা বা ইঙ্গিত দিতে অতএব অক্ষম। ইসলাম তাই মানবেতিহাসকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। সামনে অগ্রসর হতে দেয় না। চিন্তার বিকাশে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। ফলে চিন্তার বিকাশে ইসলামের কোন ভূমিকা নাই। পাশ্চাত্য সেকুলারিজমের মত ইসলামেরো একটা রেনেসা দরকার। ধর্ম থেকে বুদ্ধিকে স্বাধীন ও মুক্ত করলেই বর্বর মুসলমানদের সভ্য করা সম্ভব। আবার এর বিপরীতে আলেম-ওলামাগণ বুদ্ধি ও যুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
ইসলামে এই ধরনের কোন বিশ্বাস বা ধর্ম কিম্বা দ্বীনের বাইরে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার কোন স্থান নাই। যারা ধর্ম থেকে বুদ্ধি বা বুদ্ধিকে ধর্মের বিপরীতে হাজির করেন তাদের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই। তাহলে ‘গায়েবে ঈমান’ কথাটার মানে কি? স্বভাবতই এখন এই প্রশ্ন উঠবে। আমরা তার আগে ‘ইসলাম’ কথাটাও বোঝার চেষ্টা করবো। ঈমান এবং ইসলাম একই অর্থে ও উদ্দেশ্যে কুরানে ব্যবহার হয়েছে। কাজেই ঈমান সম্বন্ধে আমাদের এই আলাপ আরো পরিচ্ছন্ন জায়গায় নিতে হোলে ইসলাম বলতে আসল কি বুঝায়, সে সম্পর্কে অল্পবিস্তর আলাপ করা প্রয়োজন।
।। ৮।।
কোরানুল কারিমে এবং ইসলামি ইতিহাসে খোঁজ নিলে দেখা যায় এই দুটি শব্দ পরস্পর পাশাপাশি ব্যবহার হয়েছে। ফলে এই দুইয়ের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। সাধারণত এই অর্থেই আলেম ওলামাগণ ইসলাম কথাটা ব্যবহার করেন। কোরানে এই ধরনের ব্যবহার হোল
اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاٰیٰتِنَا وَ کَانُوۡا مُسۡلِمِیۡنَ
যারা আমার আয়াতে ঈমান এনেছিল এবং যারা ছিল মুসলিম। সুরা যুখ্রুফ- আয়াত নং ৬৯
وَ مَاۤ اَنۡتَ بِهٰدِی الۡعُمۡیِ عَنۡ ضَلٰلَتِهِمۡ ؕ اِنۡ تُسۡمِعُ اِلَّا مَنۡ یُّؤۡمِنُ بِاٰیٰتِنَا فَهُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ
আর তুমি অন্ধদেরকে তাদের ভ্রষ্টতা থেকে হিদায়াতকারী নও; তুমি কেবল তাদেরকে শোনাতে পারবে যারা আমার আয়াতসমূহে ঈমান আনে, অতঃপর তারাই আত্মসমর্পণকারী।সুরা নামল- আয়াত নং ৮১
ইমাম ইবনে মান্দার কিতাবুল ঈমান- এ তাই বলা হয়েছে, এইখান থেকে বোঝা যায় যে ঈমান এনেছে, সে একইসঙ্গে মুসলিমও। যে এই দুটি নামের একটির উপযুক্ত, তার উপর অন্য নামটিও খাটবে, যদি সে তার সংগে যুক্ত দায়িত্ত-কর্তব্য পালন করে। আর যদি কেউ তার ভিতর থেকে কোনো কিছু অস্মিকার করে, সে পরাপুরি ঈমান ও ইসলাম থেকে বাহির হয়ে যাবে। (কিতাবুল ঈমান- পৃ ৩২২)
মোটাদাগে ঈমান এবং ইসলাম কথা দুইটির এই ধরনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সরাসরি এই আলাপে প্রবেশ করা যাক।
অভিধানে “ইসলাম” এর ব্যবহার
ঈমানের মত ইসলাম- ইফআল এলাকার শব্দ। এর ধতুমূল হোল س-ل-م এই তিনবর্ণে সামিয়া’- এর শব্দ হিসাবে যখন কর্তার ওপর প্রয়োগ হয়, তখন তার অর্থ হবে, সে নিজেকে নিরাপদ করল। আবার কখন আরবি হরফ ‘লাম’ কিম্বা ‘মিন’ দিয়ে সম্পাদিত পদের দিকে সংক্রমিত হয়।তখন তার অর্থ দাঁড়ায়,
১। লাম যোগে তার জন্য নিষ্কৃতি দেয়া হয়েছে।
২। মিন যোগে সে দোষত্রুটি থেকে মুক্ত হয়েছে।
৩। মিন যোগে আরেকটি অর্থ, সে বিপদ থেকে রেহাই পেল।
আরবিতে যখন এই শব্দটি “তাফয়ীল” (تفعيل) এলাকার মধ্যে ব্যবহার হয়, তখন এর মধ্যে মৌলিক অর্থের পরিবর্তন ঘটে। তখন এর মানে দাঁড়বে, অর্পণ করা। নিষ্কৃতি দেয়া, মুক্ত হওয়া, রেহাই দেয়া- এই অর্থের মধ্যে শান্তি, সমর্পণ ও আনুগত্য- এর অর্থও নিহিত। এই রূপান্তর সরাসরি ঘটে কথার মধ্যে। কেননা মানুশ যার মাধ্যমে নিষ্কৃতি অর্জন করে তার প্রতি অনুগত হয়, আবার মুক্ত হবার মধ্য দিয়ে শান্তি লাভ করে, যখন রেহাই পায় তখন সে সুস্থ ও নিরাপত্তাও হাসিল করে। ইসলাম শব্দে শুরু থেকে যে রূপান্তর সমূহ ঘটেছে তার ভিতর দিয়ে আমরা হয়ত বুঝতে পারছি এই রূপান্তর নিজ আদিরূপকেই আরও দৃঢ়ভাবে ধারন করে। ফলে এর অর্থ হয়, নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করা।
অভিধানে ইসলাম- এর মধ্যে “আত্ম বা নিজ” অর্থও বিদ্যমান। সেই কারনে ইসলাম মানে নিজেকে অর্পণ ও অনুগত করাও বটে। এই সমর্পণ জোরাল ভাবে কোরানে এসেছে সুরা বাকারায়,
হে ঈমানদারগণ তোমরা পূর্ণাঙ্গরূপে ইসলামে প্রবেশ করো। (আয়াত নং ২০৮)
ইসলাম কথাটার যে তাফসির এখানে আমরা দিয়েছি আমাদের আগের কথাই মূলত তাতে পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। সুতরাং ঈমান সম্পর্কে যে ভুল ধারনার প্রাসাদ গড়ে উঠেছে, তা টিকে থাকবার কোন উপযোগিতা নাই। এই পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে আমরা বুঝি যে ইসলামে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করাই আল্লার একমাত্র হেদায়েত।
বিশ্বাস বা ফেইথের তর্ক মূলত খ্রিস্টিয়াটিনির বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা তর্ক।