১. বিএনপির 'রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা'
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে বিএনপির ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ (An Outline of the Structural Reforms of the State) তুলে ধরেছেন। এই ঘোষণা উপলক্ষ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের দশই ডিসেম্বর ঢাকা সমাবেশ ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। গোলাপবাগ সমাবেশে বিএনপি তার দশ দফা পেশ করেছিল। আমরা তখন বিএনপির সমাবেশের সাফল্যকে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ বলেছি। কিন্তু গোলাপবাগ সমাবেশে ঘোষিত দশ দফাকে বলেছি, 'যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন'। সমাবেশে জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক চেতনার অভিপ্রকাশ ঘটেছে তার সঙ্গে দশ দফা ছিল অপ্রত্যাশিত ছন্দপতন। কিন্তু দশ দফা সম্পর্কে সেই সমালোচনা আমরা জনগণের দিক থেকে দূরবর্তী রাজনৈতিক লক্ষ্যের কথা ভেবে বলেছি।
তারপরও আমরা গোলাপবাগকে অভিনন্দন জানিয়েছি। বিএনপি এ যাবতকাল ক্ষমতাসীনদের কাছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছিল। দশ দফাতে সেই অতি পুরানা রেকর্ডই বাজানো হয়েছে, তাই সেটা আমাদের কিছুটা হতাশ করেছিল। কিন্তু তারপরও আমরা বিএনপিকে অভিনন্দন জানিয়েছি। কারণ ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তির সকল বাধা মোকাবিলা করে শান্তিপূর্ণ ভাবে গোলাপবাগ সমাবেশ করতে পারাকে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির দিক থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি মনে করি। সেই ক্ষেত্রে আমরা কার্ল মার্কসের বরাতে বলেছি বিরাট বিরাট তত্ত্ব কথার চেয়েও সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ হচ্ছে সবচেয়ে জরুরি কাজ। কিন্তু যোগ করেছি, তত্ত্ব অবশ্যই লাগবে। তত্ত্বের অর্থ হচ্ছে বাস্তবোচিত ভাবে বিচার, বর্তমানের মধ্যে ভবিষ্যৎ শনাক্ত করতে পারার সামর্থ অর্জন এবং বিদ্যমান দ্বন্দ্বের বাস্তবোচিত সমাধানের প্রস্তাব করা যাতে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে বাংলাদেশে আমরা কয়েক কদম এগিয়ে যেতে পারি।
এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে বিএনপি তাদের বিরুদ্ধে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নেতিবাচক সমালোচনার জবাব দিতে পেরেছে। যারা হামলা, মামলা ও নির্যাতনে বিএনপি সাংঠনিক ভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছে ভেবেছিলেন তাদের উত্তর দেওয়া হয়েছে। এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে বিএনপি জাতীয় রাজনীতির বৃত্তে বেশ পরাক্রম নিয়েই প্রত্যাবর্তন করলো। দ্বিতীয়ত বিএনপি আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও সহিংসতা করে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্টদে এই অভিযোগেরও জবাব দেওয়া হোল। ঢাকা সহ প্রতিটি জেলা সমাবেশে বিএনপি আগোগোড়াই 'শান্তিপূর্ণ' সমাবেশের কথা বলেছে এবন প্রতিটি সমাবেশই শান্তিপূর্ণ ভাবে হয়েছে। যারা দাবি করতেন শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়, তারাও জবাব পেয়েছেন। এর ফলেয়াবতর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর কাছে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ল।
আন্দোলন-সংগ্রামকে শুধু আগাম লক্ষ্য নির্ধারণ ও তা কতোটা অর্জিত হোল তার দ্বারা বিচার করা যায় না। আন্দোলন সংগ্রাম জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষার পাঠশালা। ফলে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী সংগ্রাম অবশ্যই জনগণের নৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনার স্তরে ইতিবাচক রূপান্তর ঘটাতে বাধ্য। বলাবাহুল্য, একই কারণে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দল হিশাবে বিএনপিরও রূপান্তর ঘটবে। এটাই ঘটে। একই ভাবে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের রাজনৈতিক উপলব্ধি ও চেতনার মাত্রারও ইতিবাচক রূপান্তর ঘটে। ষাট দশকে আওয়ামী লীগ ছিল সিয়াটো-সেন্টো সমর্থক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষভূক্ত দল। শেখ মুজিবর মাও জে দং বা হো চি মিন ছিলেন না। তিনি মুসলিম লীগ করে আসা আজকের ছাত্রলীগের যে কোন পান্ডার মতোই ছিলেন। মাত্রা ভেদ থাকতে পারে কিন্তু তার অধিক কোন ভাবমূর্তি ষাট দশকে শেখ মুজিবর ধারণ করতেন না। কিন্তু তাঁর ছয় দফার আন্দোলন শেষাবধি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নিয়েছিল। আর সেই আন্দোলনে পক্ষ নিয়েছিল মার্কিন বিরোধী রুশ-ভারত অক্ষ শক্তি। শিখতে জানলে ইতিহাস আমাদের শেখায়। ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাস কোন হিমালয় নয় যে তা টলে না। ইতিহাসে ভূরি ভূরি এই সত্যের সাক্ষী রয়েছে। শুধু সমাজ বা রাজনীতি নয়, ব্যক্তিও বদলায়। এই রূপান্তর প্রক্রিয়াকেই সামগ্রিক ভাবে আমরা ইতিহাস বলি।”
ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে বিএনপি কোন সর্বব্যাপী আন্দোলন চায় না, এ যাবত চায় নি। কিন্তু এখন চাইছে। আগামিতে কতটা চাইবে এবং এবং আন্দোলন সংগ্রামকে কোন বাস্তবোচিত ইতিবাচক পরিণতিতে পৌঁছাতে পারবে কিনা আমরা জানি না। কিন্তু সংকীর্ণ নির্বাচনের দাবির বাইরে এসে বিএনপি যদি আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ফয়সালা চায় তাহলে সেটাই হবে বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত রূপান্তর।
বিরোধী দল হিশাবে বিএনপির রাজনীতির আরেকটি গুণগত পরিবর্তন বিশেষ লক্ষ্য করবার বিষয় ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ ক্ষমতাসীনদের কাছে পেশ করা হয় নি, জনগণের কর্মসূচি হিশাবে জনগণের কাছেই পেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ তারাক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তিরর কাছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি তুলছে না। জগণের হয়ে তারা জনগণের অধিকার আদায় করতে চাইছে। যারা শুরুতেই এই পার্থক্য বুঝেছেন তারা রূপরেখায় কি আছে তার অর্থ বোঝার আগে আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়ে রূপরেখা হাজির করবার রাজনৈতিক তাৎপর্য সহজে ধরতে পেরেছেন। এটা ক্ষমতাসীনদের কাছে দাবিনামা পেশ ও আদায়ের কর্মসূচি না। ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে ‘অপসারণ’ এবং তার পরে জনগণের সম্ভাব্য করণীয় বিষয়ের নির্দেশ। এটা গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করার বিষয়।
কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে সর্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটা দোনামনা ভাব এখনও রয়েছে। কিন্তু কর্মীদের মধ্যে আমরা সম্পূর্ণ নতুন উদ্দীপনা দেখছি, বিশেষত বিভিন্ন বিভাগীয় সমাবেশে সরকারের সকল বাধা উপেক্ষা করে তারা যেভাবে এসেছেন এবং হিমঠাণ্ডা রাত ও কুয়াশা উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নীচে বসে থেকে সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছেন তাতে দল হিশাবে বিএনপির রূপান্তরই আমরা লক্ষ্য করছি। এরশাদকে ক্ষমতা থেকে হঠাবার জন্য তত্ত্ববধায়ক সরকারের ধারণা এবং এক এগারোয় তিক্ত অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে। সে কারনে বিএনপির নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবির মানে জনগণের কাছে হয়ে উঠেছিল বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রেখে দল হিশাবে বিএনপির ক্ষমতায় যাবার সংকীর্ণ একটি পথ। এদিক থেকে গণমানুষের পাবার কিছু নাই। কিন্তু রূপরেখা সেদিক থেকে ভিন্ন। এই ভিন্নতা রূপরেখায় কি আছে কি নাই তার দ্বারা আমরা বুঝব না। এই রূপপরেখাকে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে অপসারণের ডাক হিশাবে বুঝলেই আমরা রূপরেখার রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝব। আসলে এখানেই রূপরেখার প্রাথমিক রাজনৈতিক গুরুত্ব।
বলাবাহুল্য, রূপরেখা সম্পর্কে আমাদের বিস্তর সমালোচনা আছে। শিরোনামেই পরিষ্কার এই রূপরেখা রাষ্ট্র কাঠামো 'মেরামত' বা সংস্কার চায়, কিন্তু 'রাষ্ট্র ক্ষমতা'র রূপান্তর চায় না। রাজনীতিতে রাষ্ট্র ক্ষমতাই মূল বিষয়। ফলে এই পার্থক্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 'রাষ্ট্র কাঠামো এবং 'রাষ্ট্র শক্তি' কিম্বা রাষ্ট্রের 'কাঠামো' এবং 'শক্তি' মোটেও এক জিনিষ নয়। দুটি পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত কিন্তু দুটো একই সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা। রাষ্ট্রকাঠামো রাষ্ট্রের বাহ্যিক দিক মাত্র। রাষ্ট্রের কাঠামো বা বাইরের চেহারা 'মেরামত' বা 'সংস্কার' করলেই 'রাষ্ট্র শক্তির চরিত্র বদলে যায় না বা বদলানো যায় না। ক্ষমতার চরিত্রে রূপান্তরের রাজনীতি আলাদা। বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে গণক্ষমতা বা গণশক্তির পরিগঠনই এখনকার প্রধান কাজ। এটাই গণমানুষের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা বা চাওয়া। তার তরিকা আলাদা। বলাবাহুল্য বুর্জোয়া ও ধনী শ্রেণীর দল হিশাবে বিএনপি ধনী ও লুটেরা শ্রেণীর হাতেই রাষ্ট্র ক্ষমতা কব্জা রাখতে চায়। এতে অবাক হবার কিছু নাই। এটাই বাস্তবতা। হয়তো নিজের অবস্থান শক্তিশালী করবার জন্য কাঠামোয় কিছু সংস্কার বিএনপি করবে বটে, কিন্তু সেটা হবে অনেকটা জনগণকে একটা বুঝ দেবার জন্য। রাষ্ট্রের এই মেরামত বা সংস্কারের রূপরেখার মধ্যে যে বার্তা জনগণ পাচ্ছে সেটা হোল বিএনপি যৌথ বা যুগপৎ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার পুরানা ও প্রাচীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্ববধায়ক সরকারই চায়। সেই সরকার বর্তমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার করবে বটে, কিন্ত তার মূল কাজ বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানো। বিএনপি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এটা সকলেই এখন বোঝে যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি জয়লাভ করবে এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা বিএনপির কব্জাতেই আসবে। তাই বিএনপি কাঠামোর সংস্কার ততোটুক চায় যতোটুকু ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব।
কিন্তু ‘রূপরেখা’ সম্পর্কে আমাদের যতোই সমালোচনা থাকুক বিএনপির রাজনীতির দিক থেকে 'রাষ্ট্র কাঠামো' মেরামতের রূপরেখা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। শুধু বিএনপির জন্য নয়, আমাদের জন্যও। কারণ আমরা মনে করি আন্দোলন-সংগ্রামই জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ায় এবং আন্দোলন-সংগ্রামই জনগণকে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করে তোলার সঠিক পথ। জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি একই সঙ্গে 'ফ্যাসিস্ট শক্তি'র বিপরীতে 'গণশক্তি'র পরিগঠন ও আবির্ভাব সম্ভব করে তোলে। তত্ত্ব তখন বাস্তবের রূপ পরিগ্রহণ করে। আন্দোলন-সংগ্রাম জারি থাকলেই যেসকল বিষয় আমরা এখানে আলোচনা করব সেই সকল বিষয়ের প্রতি জনগণের আগ্রহ থাকবে এবং তা বৃদ্ধি পাবে।
তাই বিএনপির 'রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা'কে আমরা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দলিল হিশাবে মেনে নিয়ে কয়েক কিস্তিতে রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক নিয়ে পর্যালোচনা করব। আমরা আশা করব অন্যরাও এ নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা-পর্যালোচনা করবেন। কোন বিমূর্ত, অপরিচ্ছন্ন বা ইউটোপিয়া নয়, মাঠের রাজনীতিকে কংক্রিট কেন্দ্রে রেখে আমরা যদি আমাদের বাস্তব সমস্যাকে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক থেকে সঠিক ভাবে পর্যালোচনা করতে পারি তাহলে রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণকেও আমরা আরও ফলপ্রসূ করতে সক্ষম হব এবং জাতীয় নেতৃত্ব বিকাশের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি তৈরির ক্ষেত্রে যথাযথ ভুমিকা রাখতে সক্ষম হব।
আশা করি আলোচনায় দায়িত্বশীল ভাবে সবাই অংশগ্রহণ করবেন।
(২১ ডিসেম্বর ২০২২)