গণতন্ত্রের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের মৌলিক সংঘাতটা কোথায়?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির যে নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছে তাতে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। এই বর্বরতা শুধু ভয় জাগিয়েই ক্ষান্ত হয় নি, সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকের মনে প্রশ্নও জাগিয়ে তুলেছে হাজারো রকম। কী চায় জামায়াত-শিবির? তারা কি চায় নির্বাচন না হোক এবং আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির অজুহাতে সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা দখল করুক? অপরদিকে প্রশ্ন জাগে, এরশাদ ও তার অনুচররা তো এখন আর ক্ষমতায় নেই, অতএব প্রশাসনের নির্ভয়ে এখন কাজ করতে পারা উচিত। স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অবর্তমানে এ ধরনের ঘটনা ঘটা তো অনেক পরের কথা, ঘটবার আগেই প্রশাসনের উচিত ছিল তা নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ দূরে থাকুক ঘটনা ঘটবার সময় পুলিশকে বরং দেখা গেলো ঘটনা ঘটতে দেবার ভূমিকায়। তারা ঘটনা ঘটবার সময় সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুই করলো না, বর্বর ঘটনাকে চোখের সামনে ঘটতে দিল। এটা পরিষ্কার যে, প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র এই ঘটনা ঘটতে দিয়েছে।
এতে অবশ্য অবাক হবার কিছু নেই। বাংলাদেশে যদি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়, তাহলে সেটা আমলাতন্ত্রের জন্য হবে একটা বড়ো ধরনের বিপদ সংকেত। সে প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবার জন্যে আমলাতন্ত্র আদাজল খেয়ে চেষ্টা চালাবে সেটাই স্বাভাবিক। এখন নানাভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা চলবে যে, রাজনৈতিক দলগুলোকে সুযোগ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু করে দিয়েছে, ফলে দেশ একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দিকে এগুচ্ছে। দেশের শাসনভার আমলাতন্ত্রের হাত থেকে যদি রাজনৈতিক দলের হাতে যায়, তাহলে সেটা হবে একটা ভয়াবহ ব্যাপার। জনগণের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিকশিত না করতে দেবার এটাই হোল খুব পুরনো কায়দা। এবং এই কায়দাটার প্রয়োগ যথারীতি অতি দ্রুতবেগে শুরু হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে জামাত-শিবির আমলাতন্ত্রের হাতিয়ার হয়ে দেশে একটা গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে।
অনেককে এখন বলতে শুনছি, এরশাদ তো গেল কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামা করে দেশকে রসাতলে নেবে। যাঁরা কথাটা বলেন তাঁরা দেশের জন্য একটা স্বাভাবিক উৎকণ্ঠায় কথাটা বলেন। কিন্তু তাঁরা একটু তলিয়ে ভাবলে বুঝতে পারতেন– কথাটা আমলাতন্ত্রের পক্ষের কথা। উভয় আমলাতন্ত্রের– সামরিক ও বেসামরিক। কারণ কথাটার মানে হোল রাজনৈতিক দলগুলো দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ওরা কেবল দাঙ্গাহাঙ্গামা করে। ক্ষমতাটা সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের হাতে থাকুক। এরশাদ গেছে তাতে কী, আরেকজন এরশাদ আসুক। এরশাদ ছিল লম্পট আর লুটেরা। একজন ভাল জেনারেল আর আমলাদের দিয়ে দেশ চালালেই তো সবচেয়ে ভাল। জনগণের মনে এই ধরনের চিন্তা ঢুকিয়ে দেবার প্রথম কর্তব্য হাসিল করলো জামায়াত-শিবির চট্টগ্রামে।
আজ একটা কথা ভাববার সময় এসেছে তা হোল আমাদের যে প্রথাগত রাজনীতি– বড়ো দলগুলো যে রাজনীতির ভাষায় কথা বলে, যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, যে রাজনীতিকে তারা ‘গণতন্ত্র’ আখ্যা দেয়, সে রাজনীতি কেন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিকে মোকাবেলা করতে অক্ষম? মোকাবিলা দূরের কথা, অনেকের কাছে জামায়াত-শিবির ‘গণতন্ত্র’র মিত্র। কারণ তারা এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। বিরোধী দলের, বিশেষত আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে প্রায় হুবহু অনুসরণ করছে জামায়াতে ইসলামী। এমনকি তিন দল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করেছে সেটাও জামায়াতে ইসলামীরই প্রথম প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার সরকারের রূপরেখা। আমাদের ইতিহাস ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের ডাক সর্বপ্রথম জামায়াতে ইসলামী দেয় ১৯৮৩ সালের ২০শে নভেম্বর তারিখে। জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খানই প্রথম অই তারিখে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে অনুষ্ঠিত একটি সভায় এই রকম একটি সরকার গঠনের দাবি জানান। সত্য স্বীকার করতে আমাদের খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু এতো দীর্ঘ বছরের আন্দোলন ও সংগ্রামের পর জামায়াতে ইসলামীর কর্মসূচিই আমরা বাস্তবায়ন করেছি। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জামায়াতে ইসলামীর আগে আর কেউ তুলেছে বলে আমার জানা নেই। সম্ভবত সে কারণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, যিনি জামায়াতের পক্ষ থেকে সবার আগে তোলা প্রস্তাব বাস্তবায়নের ফলে রাষ্ট্রপতি হতে পেরেছেন, তিনি জামায়াতকে একটি বড়ো ধরনের রাজনৈতিক কনসেশন দিয়েছেন। ‘জয় বাংলা’ আর ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শ্লোগান নিয়ে বিতর্ক উঠবার কারণে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট দুটোর কোনটিই নিজে না বলে একধরনের নিরপেক্ষতা প্রদর্শনের যে কনশেসন দুই বড়ো দলকে দিয়েছেন তার চেয়েও জামায়াতকে দেয়া কনশেসন অনেক অনেক বড়ো। ডিসেম্বরের ২০ (১৯৯০) তারিখে সকালে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে বাংলাদেশ সামরিক একাডেমির ২৩তম বি এম এ লং কোর্স এবং ষষ্ঠ বি এম এ শর্ট কোর্সের জেন্টেলম্যান ক্যাডেটদের কমিশনপ্রাপ্তি উপলক্ষ্যে সালাম গ্রহণ করবার সময় প্রেসিডেন্ট সৌদি আরবে বাংলাদেশের সৈন্য পাঠানোর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। মনে রাখা দরকার– এটি একটি নীতিগত প্রশ্ন এবং এ বিষয়ে জনগণের পরিষ্কার ম্যান্ডেট হচ্ছে যে অবিলম্বে যেন বাংলাদেশের সৈন্য বাংলাদেশে ফিরে আসে। জামায়াতে ইসলামী ছাড়া বিরোধী দলের ডাকে এই প্রশ্নে আহূত হরতালে জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়া দিয়েছিল। জামায়াতে ইসলামীর কারণে সৌদি রাজতন্ত্র ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষাবলম্বনের বিরুদ্ধে জনগণের রায়কে উপেক্ষা করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি যে, রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করলেন তাতে তাঁর নির্দলীয়তা ও নিরপেক্ষতা একটা বড়ো ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে রয়েছে। আশ্চর্য যে, রাজনৈতিক দলগুলোর একটিও কিন্তু এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করে নি। তথ্য হিশাবে এটা জানিয়ে রাখা দরকার যে, প্রেসিডেন্ট ভাটিয়ারিতে তাঁর বক্তৃতা শেষে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলেন নি। কারণ ওটা বিএনপির শ্লোগান। টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের মাজার জিয়ারতের সময় সমবেত জনতার সামনে তিনি কিন্তু 'জয় বাংলা' বলেছিলেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। আমি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির এই প্রকার নিরপেক্ষতার মর্ম এখনো উদ্ধার করতে পারি নি। তবে দেশের নাগরিক হিশাবে আমার একটি প্রশ্ন আছে, তরুণ সৈনিকদের সামনে তিনি বাংলাদেশের দীর্ঘজীবন কামনা করে কি অন্তত এটা বলতে পারতেন না যে, ‘বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক’?
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এটা স্পষ্ট যে, প্রথাগত রাজনীতির যে-ধারা, বিশেষত বড়ো দলগুলো আমাদের যেভাবে গণতন্ত্র শেখায় তার বৃত্তের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীকে ধরা অসম্ভব। কারণ জামায়াতে ইসলামী এই বৃত্তের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রথাগত রাজনীতিটা কী?
এই প্রথাগত রাজনীতি বলে যে ‘গণতন্ত্র’ হচ্ছে দেশে বহু দল থাকবে। এবং তাদের নিজ নিজ দলের সমর্থক সংখ্যা বাড়াবার অধিকার থাকবে। সে কারণে তাদের মত প্রকাশের ও মত প্রচারেরও অধিকার থাকবে। নির্দিষ্ট সময় পর পর দেশে একটি সংসদ নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিয়ে যে দলকে তারা সমর্থন করে সেই দলকে ক্ষমতায় পাঠাবে এটাই হোল প্রথাগত রাজনীতির ‘গণতন্ত্র’ সম্বন্ধে ধারণা এবং এই গণতন্ত্রই প্রথাগত রাজনীতির ধারায় বিভিন্ন দলের নামে আমাদের জনগণের জন্যে চাওয়া হচ্ছে। বলা বাহুল্য সেই দলগুলোর মধ্যে ‘কমিউনিস্ট’ নামে পরিচিত দলগুলোও রয়েছে।
‘গণতন্ত্র’ বলতে এই যে ধারণা, এই ধারণার ভিত্তিতে কোন্ মুখে আমরা জামায়াত ইসলামীর মত প্রকাশের অধিকার ও রাজনীতি করার অধিকারের বিরোধিতা করি? এটাই যদি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হয়, তাহলে জামায়াতের অবশ্যই অধিকার আছে তার পক্ষে জনমত সংগ্রহে জনগণের সমর্থন আদায়ের। গণতন্ত্রের এই সংজ্ঞার ভিত্তিতে জামায়াত যদি আল্লার শাসন কায়েম করতে চায় আর কাফেরদের জবাই করতে চায়, তাহলে কোন যুক্তিতে জামায়াতের এ পরিকল্পনার আমরা বিরোধিতা করি?
আমাদের গণতন্ত্রের প্রথাগত সংজ্ঞা ও প্রচলিত ধারণার গলদটা তাহলে কোথায়? আসলে প্রথাগত সংজ্ঞা ও প্রচলিত ধারণা গণতন্ত্রের নেহায়েতই ব্যবহারিক দিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গণতন্ত্রের মর্ম সম্পর্কে ‘গণতন্ত্র’ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা কিছুই বলে না। ভোট দেয়া বা নির্বাচন করা গণতন্ত্র নয়। এটা হোল গণতন্ত্র কীভাবে চর্চা করা যায় তার একটা নিয়ম। গণতন্ত্র চর্চার আরো হাজারো নিয়ম থাকতে পারে। গণঅভ্যুত্থানের আগে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছার প্রতিভূ হয়ে উঠেছিল। সেটা সর্ব দলীয় ছাত্রঐক্য জনগণের ভোট নিয়ে কিম্বা নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়ার কারণে হয় নি। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণের সার্বজনীন ইচ্ছাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার মধ্য দিয়ে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য হয়ে উঠেছিল সমাজের সকল গণতান্ত্রিক নাগরিকের প্রতিনিধি। এই নাগরিকরা সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হাত থেকে এবং এরশাদের স্বৈরশাসন থেকে মনে প্রাণে মুক্তি কামনা করছিল। আন্দোলন, মিছিল, বিক্ষোভ প্রকাশ গণতন্ত্র চর্চার আরেকটি সম্যক পদ্ধতি যা চর্চা করে আমরা এরশাদকে হটিয়েছি। সমাজের ইচ্ছার প্রতিনিধি হয়ে উঠবার কারণে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের হাতেই রাষ্ট্রের কার্যকর ক্ষমতা কিছুদিনের জন্য হলেও চলে এসেছিল। খুবই দ্রুত সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য সে ক্ষমতা রাজনৈতিক জোটের হাতে এবং জোটের প্রস্তাবিত ফর্মুলা অনুযায়ী বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের হাতে সঁপে দিয়েছে। সেটা ভাল হোল কি মন্দ হোল ভবিষ্যতে বোঝা যাবে এখন কেবল এ উদাহরণে এটাই বোঝাতে চাইছি যে গণতন্ত্র চর্চা করার নানান রূপ আছে। কিন্তু সেটা চর্চার রূপ বা পদ্ধতি মাত্র, সেটাই গণতন্ত্র নয়।
এই ব্যাপারটা অনুধাবন করা দারুণ গুরুপূর্ণ, নইলে প্রথাগত রাজনীতি কোথায় গলদ করে সেটা আমরা ধরতে পারব না। এই রাজনীতি গণতন্ত্র আর গণতন্ত্র চর্চা করার রূপ বা পদ্ধতির মধ্যে ফারাক করতে অক্ষম। গণতন্ত্রই যদি না থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের আচার পদ্ধতি দিয়ে আমরা কী করব? প্রথাগত রাজনীতি বুঝতে পারে না যে, গণতন্ত্র চর্চা করার রূপ বা পদ্ধতির আগে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা চাই। সেটা নিয়ম করে হয় না। যা নাই তাকে একটা পদ্ধতি চালু করে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। যদি সম্পূর্ণ সন্ত্রাসহীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয় তবুও সেটা একটা প্রাণহীন পদ্ধতির অতিরিক্ত হবে না যদি না, গণতন্ত্র সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাণে আগেই প্রতিষ্ঠিত না থাকে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে হয় আগে। গণতন্ত্রকে হয়ে উঠতে হবে নাগরিকদের প্রাণধর্ম। সেটা একবার প্রতিষ্ঠিত করা গেলে তারপর তার চর্চার দিকটাও পরিষ্কার হয়ে আসে।
তাহলে গণতন্ত্রের প্রাণধর্ম কী? গণতন্ত্রের প্রাণধর্ম হচ্ছে এই যে ব্যক্তি সার্বভৌম, মানুষ স্বাধীন। মানুষের ব্যক্তিসত্তার সার্বভৌমত্ব হচ্ছে গণতন্ত্রের মূলকথা। এ কথাটাই আমরা সাধারণত আরো সহজ করে বলি এভাবে যে, জনগণই সার্বভৌম। রাষ্ট্র নয় সরকার নয়, রাজনৈতিক দল নয়, কেউই নয়। একমাত্র জনগণই হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েরই একটি শ্লোগান দেখেছি দেয়ালে: ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। এই শ্লোগানটিকে গণতন্ত্রের সমার্থক বলে ভ্রম হতে পারে এবং এখানে যেহেতু জনগণের কথা আছে ফলে শুনতেও খুব ভাল লাগে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখব জনগণ এখানে ক্ষমতার ‘উৎস’। জনগণ এই শ্লোগান অনুসারে সার্বভৌম নয়। ফলে শ্লোগানটি গণতন্ত্রের সমার্থক হোল না। জনগণ যদি নেহায়েতই উৎস হয়, তাহলে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকতে পারে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে, কিম্বা সরকারের কাছে, কিম্বা রাষ্ট্রের কাছে, ইত্যাদি। এখন এই ‘উৎস’কে যেনতেন প্রকারে ভোটের বাক্সের কাছে নিয়ে কেউ যদি নামে লীগ-ছাপড় মেরে ক্ষমতায় যেতে পারে তবে সেই হয়ে যাবে সার্বভৌম। তারপর জনগণের মৌলিক অধিকার সে খর্ব করুক কি একটা ফ্যাসিস্ট শাসন চাপিয়ে দিক, কিছুই করার থাকবে না জনগণের। কারণ ভোটে জিতেই তো সে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করেছে, সার্বভৌম হয়েছে। যে সমাজ ও রাষ্ট্রে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা একটি স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়, যে সমাজ বা রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক নয়।
গণতন্ত্রের এই প্রাণধর্মের দিক থেকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজনীতিকে একবার বিচার করলেই আমরা দেখব যে, মৌলিক সংঘাতটা এখানে গণতন্ত্রের প্রাণধর্মের সঙ্গেই। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির মনে করে না জনগণ সার্বভৌম। তারা বলে আল্লাহ হচ্ছেন সার্বভৌম। জনগণের ভালমন্দ বিচারের ক্ষমতা নাই এবং কোনটা সঠিক এবং কোনটা বেঠিক এটা বিচার করার মতো বিবেক জনগণের থাকে না। অতএব, নিজের বিধান, নিজের সংবিধান, নিজের আইন নিজে প্রণয়ন করার ক্ষমতা জনগণের নাই। সুতরাং, জনগণকে চলতে হবে আল্লার বিধান অনুযায়ী। বিশেষত সে বিধান জামায়াতে ইসলামী যেভাবে ব্যাখা করে ঠিক সেভাবে। অন্য কারো ব্যাখ্যা হলে চলবে না ।
আল্লাহ হচ্ছেন সার্বভৌম, তিনিই সকল ক্ষমতার মালিক, এটা কেবল ইসলামের শিক্ষা না। পৃথিবীর একেশ্বরবাদী সকল ধর্মের শিক্ষা এটাই। এটা আমি বলছি এ কারণে যে, জামায়াতে ইসলামীর কথা ধরলে মনে হবে ইসলাম খুবই অগণতান্ত্রিক একটি ধর্ম। অন্য ধর্ম বুঝি ভিন্ন রকম বলে। একথা সত্যি নয়। অপরদিকে ইসলাম একটি অসাধারণ ধর্ম এবং তার এমনসব বিচিত্র সৃষ্টিশীল দিক আছে যা বিভিন্নকালে দার্শনিক ও ভাবুকদের বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে এবং সাম্রাজ্যবাদের ক্রমাগত আক্রমণে ইসলামের সৃষ্টিশীল দিক আমরা প্রায় কিছুই এখন আর জানি না। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসলাম সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামীর ক্ষতিকর ব্যাখ্যা।
গণতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কটা বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে ধর্মের ‘সার্বভৌম’ শব্দটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়। এই সৃষ্টিজগতের শর্ত হচ্ছেন আল্লাহ, বা আমাদের অস্তিত্বের শর্ত হচ্ছেন তিনি, এই অর্থে আল্লাহ অবশ্যই সার্বভৌম। কারণ দুনিয়া মানুষ সৃষ্টি করে নি, এর সৃষ্টিকর্তাও তিনি। এবং আমাদেরকেও সৃষ্টি করেছেন তিনিই। কিন্তু আমাদের তিনি সৃষ্টি করেছেন ইচ্ছা ও বিবেক সম্পন্ন করে। এই ইচ্ছা বা বিবেককে ব্যবহার করার সার্বভৌম ক্ষমতাটাও তিনি আমাদেরকে দান করেছেন। এই সার্বভৌম ক্ষমতা তিনি আমাদের দান করেছেন বলে বা তাঁর কাছ থেকে সৃষ্টির সুবাদে আমরা পেয়েছি বলে আমরা যদি পাপ করি তাহলে আমরা দোজখে শাস্তি পাওয়ার এবং পার্থিব জীবনে ভাল পথে চললে পুরস্কৃত হবার যোগ্য। ইচ্ছা ও বিবেকের এই সার্বভৌম ক্ষমতা তিনি যদি তাঁর আশরাফুল মখলুকাতকে না দিতেন, তাহলে আমরা ভালমন্দ যা করতাম সব কিছুরই কর্তা থাকতেন তিনি। ফলে আমাদের শাস্তি বা পুরস্কৃত করারও কোনো ন্যায্যতা তাঁর থাকত না।
সকল একেশ্বরবাদী ধর্মের সঙ্গে এখানে ইসলামের মিল আছে। কিন্তু মানুষের ইচ্ছা ও বিবেকের সার্বভৌমত্বের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যায় ইসলাম এই ক্ষেত্রে বরং আগুয়ান। ইসলাম যখন বলে ‘আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথা নোয়াবে না’, তখন একথাটার পার্থিব তাৎপর্য দাঁড়ায় এই যে, ব্যক্তির ওপর অন্য কারো খবরদারি বা একনায়কী শাসন ইসলাম বরদাশত করে না। জামায়াত-শিবিরেরও নয়। অপরদিকে খেয়াল রাখা দরকার বিজয়োল্লাসের আবেগে আমরা এখনো টের পাই নি যে, এতো দীর্ঘ আন্দোলন ও রক্তপাতের পর আমরা আসলে কিছুই পাই নি। এটা কেবল আমার একার কথা নয়, বাংলাদেশে যাঁরাই একটুখানি দেশ ও দশের কথা ভাবছেন তাঁরা নানান সভা-সেমিনারে বক্তৃতায় লেখায় সবাইকে বার বার এই বলে সাবধান করে দিচ্ছেন যে, যতোটা খুশি আমরা জাহির করছি ততোটা খুশি হবার মতো বিজয় আমরা এখনো আসলে অর্জন করি নাই। আলবৎ এরশাদকে হটিয়েছি, ওটা নিঃসন্দেহে বিজয়ের দিকে এক কদম আগ বাড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু সেটা লক্ষ্যের দিকে কদম বাড়ানো মাত্র, লক্ষ্য অর্জন নয়। এবং লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারব কিনা, নাকি তার আগেই আগের চেয়েও খতরনাক একটা বিপর্যয়ের মধ্যে দেশ ও জাতি পতিত হয় সেই ভয়ে আমি একা নই, অনেকেই আতঙ্কিত। চট্টগ্রামের ঘটনা অনেকের সেই আতঙ্ককে বিভীষিকায় পরিণত করেছে।
আন্দোলন থেকে জনগণ কিছুই পায় নি এবং আন্দোলনকে রাজপথে জীবন্ত রাখতে না পারলে কিছুই পাওয়া দূরের কথা, যাঁরা আন্দোলন করেছিলেন তাঁদেরই জীবন বিপন্ন হয়ে উঠবে। কেন? কারণ সামরিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার নাট-বল্টুসহ অক্ষত রয়ে গেছে। নির্যাতন নিপীড়নের হাতিয়ার ও লোকবল সব যেখানে থাকার সেখানেই আছে। তারা জানে আন্দোলনের যে সকল সংস্থা গড়ে উঠেছে এগুলো হচ্ছে তাদের মৃত্যু ফরমান এবং যেসকল তারুণ্যদীপ্ত ছাত্র নেতৃত্ব লড়াই করে জনগণের মন জয় করে নিয়েছে সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মওতের পরোয়ানাও এই নয়া নেতৃত্বের হাতেই প্রণীত হবে। সেই পরোয়ানা লিখবার আগেই এদের যেকোনোভাবে ধ্বংস করতে না পারলে সামরিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্ণধারদের শান্তি আসবে না। অতএব, সুযোগ পেলেই তারা আঘাত করবে এবং আসলে আঘাত করেই যাচ্ছে।
ব্রিটিশরা এদেশ শাসন করবার জন্য যে আমলাতান্ত্রিক কাঠামো কায়েম করে দিয়ে গেছে তার বদলে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো এতো বড়ো আন্দোলনের পরেও কেন বহাল তবিয়তে থেকে গেল সেটাই এখন সকলেরই ভাবার বিষয়। ভুলে যাওয়া উচিত নয়। যে ফর্মুলায় এতদিন আন্দোলন চলেছে সেখানে সামরিক আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর কোথাও ছিটেফোঁটা বদল ঘটাবার জন্য এক অক্ষর কথা নাই। বরং এই কাঠামো যেন অক্ষত থাকে তার জন্যে ‘সাংবিধানিক পন্থায়’ ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটানো হয়েছে এবং বারবার সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা জনগণকে বলা হচ্ছে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা মানে কী? এর মানে হচ্ছে ঔপনিবেশিক আমল থেকে যে আমলাতান্ত্রিক ও গণবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থা আমাদের দেশে বহাল আছে সেটারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, টিকিয়ে রাখা ।
এটা আমরা জানি বিরোধী দলগুলো কেবল এরশাদকে শাসন ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে চেয়েছে। এর ফলে একদিকে জনগণের লক্ষ্য সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে নিক্ষিপ্ত না হয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল এরশাদ ও জাতীয় পার্টির ওপর অপরদিকে জনগণের মধ্যে এই ধারণা গড়ে উঠেছে যে, বাংলাদেশ শাসন করত কেবল এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টি এবং তখন যে দল নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাবে তারাই দেশ শাসন করবে, আমলা বা আমলাতন্ত্র নয়। আসলে এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টি করত লুটপাট, সরকারে থাকাটা ছিল তাদের জন্য স্রেফ ব্যবসার ব্যাপার। তারা শাসন করত না। শাসন করত আমলারা, ক্ষমতায় ছিল আমলা ও আমলাতন্ত্র। আমলারাই ছিল সরকার এবং আমলারাই ছিল রাষ্ট্র। এবং এখনো তারাই হচ্ছে সরকার এবং তারাই হচ্ছে রাষ্ট্র। এবং যদি এই সামরিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কোনো বদল না ঘটে তাহলে আগামী দিনেও তারাই থাকবে সরকার এবং তারাই হবে রাষ্ট্র। কোনো হের ফের হবে না।
৩ জানুয়ারি, ১৯৯১।