প্রস্থানপথ নাই, অতএব পদলেহন...
ফরহাদ মজহারের এই নিবন্ধগুলো এক-এগারোর সময়কালে বিভিন্ন সময়ে লেখা। এক-এগারোর সময়কাল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে পরের বছর ২০০৮ সাল জুড়ে। নিবন্ধগুলো ২০০৮ সালের রাজনৈতিক ঘটনা-ঘটনের পটভূমিতে বসে সমসাময়িক সময় ও প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা। ফলে ইতিহাসের বাস্তব ও সুনির্দিষ্ট উপাদানে ভরপুর। তবে এটা কেচ্ছাকাহিনীর মতো বলে যাওয়া কোনো বিবরণ নয়। বরং তার মধ্য দিয়ে মূলত বাস্তবতা ও বাস্তব ঘটনাঘটনের প্রতি তাৎক্ষণিক পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই লেখালিখিগুলো বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানে নতুন বয়ান ও মতামত হাজির করেছে, রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে। ফলে আমরা লেখাগুলিকে খোদ এই ইতিহাসের প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবেই পড়তে পারি। এই লেখাগুলি আমরা চিন্তার পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি যাতে পাঠক আজকের পরিস্থিতে বসে সেসময় কে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিভাবে নিচ্ছিলো তার প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করে নিতে পারেন।
১
বাংলাদেশের বর্তমান সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে প্রস্থানের পথ কী? এই বিষয়ে এর আগে দুই একবার আমি আলোচনা করেছি। সাংবিধানিক সমাধানের— অর্থাৎ বাংলাদেশের ‘সংবিধান’ নামে লিখিত নিয়মাবলী বা শাসনবিধি শাসক শ্রেণী নিজেরা মানে না, অথচ জনগণকে প্রতারণা করবার জন্য দেখায় ও ব্যবহার করে— এই কায়দায় সংবিধানের ছুতা দেখিয়ে এবারে সমাধান আমি দুঃসাধ্যই মনে করি।
একটি অসাংবিধানিক সরকারকে বৈধতা দেবার কারসাজি আমরা দেখতে দেখতে এখন মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কায়দাটা খুবই সহজ। যদি কারো হাতে ক্ষমতা ও শক্তি থাকে— এই শক্তির বরাতে তিনি অনায়াসেই ক্ষমতা নিয়ে নিতে পারেন। সংবিধান-টংবিধান ফালতু জিনিস। ছেঁড়া ত্যানা বা কাগজের টুকরা। আপনি ইচ্ছে করলে রাখতে পারেন, ফেলেও দিতে পারেন। সংবিধান নিয়ে সমাজে হৈচৈ হলে বাংলাদেশে ‘প্রাজ্ঞ সংবিধান বিশারদ’কুল তো আছেনই, তাঁরা বলে দেবেন কিভাবে অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডকে সাংবিধানিক কাজ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। আফটার অল, সবই তো আসলে সংবিধান ‘ব্যাখ্যা’ করার মামলা। আপনি আপনার পছন্দমতো আদালত পাড়ায় লোকও পেয়ে যাবেন যাঁরা সংবিধান রক্ষা করবার শপথ নিয়েও নিজের পদ রক্ষাই প্রাথমিক কর্তব্য মনে করে শক্তিধরদের খেদমতে হাজির হয়ে যাবেন। অস্ত্রের শক্তি এমনই যে সংবিধানের যে ব্যাখ্যাই আপনি চাইবেন সেই ব্যাখ্যাই ইনশাআল্লাহ হাজির হয়ে যাবে। এই জন্যই আমি আমার আগের একটি লেখায় পাঠকদের মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস- মাও জে দংয়ের এই প্রাজ্ঞ উচ্চারণের তাৎপর্য আমরা যেন না ভুলি। অনেকে ভুল করে ভাবেন এটা বুঝি বামপন্থীদের তত্ত্ব। মোটেও না। এটা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষদের যারা শোষণ, শাসন করে; যারা পুলিশ, সেনাবাহিনী, আইন আদালতকে সবসময়ই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে; যারা সৈনিকদের মর্যাদার তোয়াক্কা না করে ধনি ও ব্যবসায়ীদের সম্পত্তির পাহারাদার গণ্য করে— এ তত্ত্ব আসলে তাদেরই কায়কারবার দেখে বলা হয়েছে। বন্দুকের নলের তত্ত্ব এদেরই ক্ষমতা চর্চার বাস্তবতা থেকেই তৈরি হয়েছে।
সত্যি যে যতোদিন জনগণ ভয়ে রাস্তায় না নামে, প্রতিবাদ বিক্ষোভ না করে, ততোদিন এই ধরনের শাসন চলতেই পারে। ঠেকাবে কে? শাসক শ্রেণীর মধ্যে লুটের পসরা, ভাগের বখরা নিয়ে মনোমালিন্যের কারণেও বাস্তব পরিস্থিতিতে বদল ঘটতে পারে। তখন অন্য কেউ— শাসক শ্রেণীরই আরেক অংশ নির্বাচন, গণতন্ত্র, জনগণের শাসন ইত্যাদি নামে ফিরতিবার ক্ষমতায় আসে, যথারীতি পুরানা খেলাটাই চলতে থকে আবার।
কিন্তু এই কাজ করতে গেলে কিছু সাংবিধানিক অসুবিধাও আছে। যেমন, অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করলে— যেমন, সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া, কিম্বা এখন যেমন জরুরি অবস্থার অধীনে কার্যত সেনাশাসন চালালে এই ধরনের সরকার ও সরকারের কর্মকাণ্ডের একটা সাংবিধানিক বৈধতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। লোক দেখানো হলেও। সেটা করা হয় যিনি ক্ষমতায় তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই তারই অধীনে একটা নির্বাচন দেওয়ার মধ্য দিয়ে। বলাবাহুল্য সেই নির্বাচনে তারাই নির্বাচিত হয়ে আসে যারা ক্ষমতাসীনদের বশংবদ বা অতিশয় অনুগত। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সংসদে একটা বিল পাশ হয়। সেই বিলে বলা হয় অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীনরা যা কিছু কাণ্ড ও অকাণ্ড করছে সবই সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বৈধ বলে গৃহীত হলো। অর্থাৎ অসাংবিধানিক সরকারের অধীনে ‘নির্বাচিত’ (?) সংসদ সদস্যগণ এই বলে একটা সাংবিধানিক সার্টিফিকেট দেবে যে এই সরকার অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় এলেও এই অসাংবিধানিক অপকর্ম আমরা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বৈধ করে নিচ্ছি। অর্থাৎ অসাংবিধানিক বা অবৈধ সরকারকে বৈধতা দান করে তারা সংসদে একটি বিল পাশ করবে। ব্যস। অর্থাৎ যাদের জোরে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হয়ে আসতে পেরেছে তারা এই কর্মটি অতি আরামের সঙ্গে করবার ক্ষেত্রটি আমাদের প্রাজ্ঞ সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞরা— যারা বাংলাদেশের সংবিধান মুসাবিদা করেছিলেন, তাঁরা করেই রেখেছেন। সংবিধানে এই অনুচ্ছেদ ১৪২ অনুচ্ছেদ নামে (কু) খ্যাত। কী প্রতিভা এইসব উকিল ব্যারিস্টারদের। অবাক হতে হয়!
প্রশ্ন হচ্ছে পরাশক্তির স্বার্থ হাসিল করবার জন্য যারা ক্ষমতাসীন হয়েছে তারা এই ধরনের একটি সংসদ নির্বাচন ও তাদের কর্মকাণ্ডকে ‘বৈধতা’ দেবার এই অতি চেনা কারবারটা সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারবে কিনা। এই ধরনের রাবার স্ট্যাম্প সংসদ নির্বাচিত করে আনা সম্ভব হবে কি?
আমার ধারণা এবার এটা খুব সহজ হবে না, এই চেষ্টা ব্যর্থ হবার সম্ভাবনাই বেশি। এর নানা কারণ আছে, নানা দিক থেকে এর ব্যাখ্যা হতে পারে। বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে আজ অবধি ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য যা কিছু উদ্যোগ নিয়েছে তার প্রায় সবকটিই ব্যর্থ হয়েছে। তবে কাজটি এবার কঠিন হয়ে গিয়েছে সাধারণভাবে জনগণের মধ্যে সংবিধান, গণতন্ত্র, রাষ্ট্রের ভিত্তি, ক্ষমতার বৈধতার প্রশ্ন ইত্যাদি নানান বিষয়ে আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতনতার কারণে। একটি অসাংবিধানিক সরকার যদি অবৈধভাবে ক্ষমতারোহণ করে তাদের সকল কর্মকাণ্ডই অবৈধ— অতএব সেই অবৈধ সরকার ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় সংসদে তার বশংবদ লোকগুলোকে নির্বাচিত করে এনে তাদের দিয়ে নিজের বৈধতা আদায় করে নেওয়ার ব্যাপারটা যে নিছকই একটা রাজনৈতিক তামাশা এই দিকগুলো আমাদের সমাজে আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন হয়েছে।
তাই কি? আমি হলফ করে বলতে চাই না। শেখ হাসিনা বলেছেন তিনি যদি ক্ষমতায় আসেন তাহলে অসাংবিধানিক বা অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসা বর্তমান সরকারকে তিনি ‘বৈধতা’ দেবেন? তাঁর এই ঘোষণার ফলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি যেখানে গিয়ে ঠেকেছে তার ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় এতো তাড়াতাড়ি বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা সত্যি যে গণমানুষের চেতনার স্তর সম্পর্কে রাজনীতিবিদদের হুঁশ খুবই কম।
২
জাতীয় অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধকে ‘অতিরিক্ত ভারতীয়করণের’ নালিশ জানিয়েছেন নয়া দিগন্তে ছোট কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ ২৭ মার্চের একটি লেখায়। এই লেখায় ‘ভারতীয়করণের’ প্রসঙ্গ ছাড়াও রাজনীতি ও সামরিক নীতি ও কৌশলের সম্পর্ক প্রসঙ্গেও তাঁর বেশ কিছু অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মন্তব্য রয়েছে। পাঠকরা যেমন এতে উপকৃত হয়েছেন, তেমনি গবেষকদের জন্যও এখানে চিন্তার খোরাক আছে। আমি এখানে দুই একটি বাড়তি বিষয় যোগ করব।
এই ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নাই যে ভারতীয় জনগণ একাত্তরে আশ্রয় দিয়ে ও আরো নানাভাবে সহায়তা করে আমাদের লড়াই-সংগ্রামে তাদের গণতান্ত্রিক মৈত্রীর নজির রেখেছে। তার জন্য আমরা অবশ্যই তাঁদের কাছে ঋণী। এই ঋণ স্বীকারের পথ ভারতীয় শাসক ও শোষক শ্রেণীর পদলেহন নয়, বরং ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণের এখনকার লড়াই-সংগ্রামে নৈতিক সমর্থন দেওয়া এবং উপমহাদেশের নিপীড়িত ও শোষিত জনগণের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন আরো দৃঢ় করা। সাধ্যানুযায়ী সফলভাবে পরস্পরকে সহায়তা করা। ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণের সঙ্গে মৈত্রী আমাদের অবশ্যই দরকার। সেই দিক থেকে ভারতের যে সকল জনগোষ্ঠী আমাদের মতো তাদের নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করছে তাদের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানানো, জাতপাত বর্ণ প্রথায় নিপীড়িত ভারতের নিম্ন বর্গের মানুষের লড়াই-সংগ্রামে সমর্থন, সহায়তা দান এবং ভারতীয় জনগণের বিরুদ্ধে ভারতের শাসক এবং শোষক শ্রেণীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় প্রতিবেশী দেশের নাগরিক হিশাবে আমাদের প্রতিবাদ জানানোর মধ্য দিয়েই আমরা ভারতের জনগণের ঋণ শোধ করতে পারি। ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণীর পদলেহন করে ভারতীয় জনগণের ঋণ শোধ হয় না। বরং ঋণ আরো বাড়ে। কিন্তু বাংলাদেশের ভারতীয় শাসক ও শোষক শ্রেণীর পক্ষে একটি শক্তিশালী তাঁবেদার শ্রেণী গড়ে উঠেছে যারা ভারত ও বাংলাদেশ- অর্থাৎ উভয় দেশেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতান্ত্রিক জনগণের দুশমন। জনগণের পর্যায়ে ভারতের প্রতি একাত্তরের ঋণ পরিশোধের একমাত্র পথ হচ্ছে উপমহাদেশে গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামে একাত্ম হবার এবং ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবার পথ ও কৌশল অন্বেষণ। ভারতের জনগণ গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আমাদের সহায়তা করেছিলেন, আমরাও তাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা যোগাব— এটাই হচ্ছে সঠিক নীতি। ভারতের সার্বভৌমত্বে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ বা উসকানি না দিয়ে কিভাবে আমরা এই নীতি বাস্তবায়ন করব সেটা নিতান্তই কৌশলের প্রশ্ন। কিন্তু নীতিগত ক্ষেত্রে এই বিষয়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা থাকা উচিত নয়। কিন্তু মৈত্রীর এই পথ ও নীতিকে সমূলে বিনষ্ট করবার জন্য ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণী ক্রমাগত বাংলাদেশে কাজ করে যাচ্ছে। ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণীর পক্ষে একটি তাঁবেদার গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে যারা চায় আমরা ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণ নয়, আমরা শুধু যেন ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণীর পা চেটে চলি। আজ বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্যই এই গোষ্ঠী ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এর আগে আমি পাঠকদের হুঁশিয়ার করেছি যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে ভারতীয় রক্ষীবাহিনীতে পরিণত করা হচ্ছে। ভারতীয় সেনাকর্মকর্তাদের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশে সফরের মধ্য দিয়ে আমরা সেই সত্যেরই বাস্তবায়ন দেখছি মাত্র।
ভারতীয় সেনাকর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ সফর করবেন সেটা আনন্দের, আমরা তাকে স্বাগত জানাব। আমি মনে করি একাত্তরে যুদ্ধের সময় যদি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমাদের সহযোগিতার দিকগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা স্বীকার করি ও তাঁদের ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানাই তাহলে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়ে। পাঠককে আগেই সাবধান করে দিচ্ছি সস্তা ভারতীয় বিরোধিতার পক্ষে আমি নই। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজেদের মর্যাদা, সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরক্ষার প্রশ্নে আপোষহীন থাকা। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী বা স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিশাবে বাংলাদেশের মর্যাদা রক্ষার প্রতীকী দিকগুলোর দিকেও নজর রাখা জরুরি। লক্ষ করতে হবে, যে দিনে তাঁদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সেই দিনটি বিজয় দিবস নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। এটা মেনে নেওয়া যায় না।
এর অর্থ কী? ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েছে? বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে ভারতীয় সেনাকর্মকর্তারা? বাংলাদেশের মানুষ নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন করে দিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। এই কি? ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং যুদ্ধ করেছে। আমরা যুদ্ধ করেছি আমাদের মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য। ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধ করেছে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য। ফলে বিজয় দিবসে তাদের আমন্ত্রণ জানাবার একটা জায়গা আছে যদি একইভাবে তারাও আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানায়।
ভারত একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। মুক্তিযুদ্ধ যখন চলছিল পাকিস্তান তখনও বর্তমান এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব জাতিসংঘে বা আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্বীকৃত। অতএব ভারত বাংলাদেশকে নৈতিক সমর্থন দিতে পারে, অর্থ সহায়তাও দিতে পারে, কিন্তু আইনগত একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরে সশস্ত্র সংগ্রামে প্রত্যক্ষ মদদ দিতে পারে না। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাজ হচ্ছে নিজের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। ভারতীয় সেনাবাহিনী একাত্তরে তাই করেছে। একাত্তর সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। তারা নিম্ন দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমাদের কাছে যা ছিল মুক্তিযুদ্ধ— ভারতের কাছে তা হচ্ছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয়, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধেরও বিজয়। কিন্তু এই বিজয় অর্জন ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য অসম্ভব ছিল যদি বাংলাদেশের জনগণের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা ইতোমধ্যেই পাকিস্তানী দখলদারদের পর্যুদস্ত করে না ফেলতেন। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেই বরং ভারতীয় সেনাবাহিনীর কৃতজ্ঞতা জানাবার কথা। উল্টাটা নয়।
তাহলে ভারতীয় সেনাকর্মকর্তাদের প্রতি কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাবার দায় যদি আমরা আদৌ বোধও করি সেটা করবার কথা বিজয় দিবসে- স্বাধীনতা দিবসে নয়। কিন্তু স্বাধীনতা দিবসে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ডেকে এনে এটাই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমরা করি নি, এটা করেছে জেনারেল জ্যাকব এবং ইস্টার্ন কমান্ডের ভারতীয় সেনাপতিরা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অপমান ও অমর্যাদা করবার ধৃষ্টতা ছাড়া একে আর কী বলা যায়!
ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণীর তাঁবেদাররা ঠিক এই সত্যটাই প্রতিষ্ঠা করবার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে। এই দেশের দুর্ভাগ্য যে অনেকের কাছেই আমাদের ‘স্বাধীনতা দিবস’ আর ‘বিজয় দিবসে’র পার্থক্য পরিষ্কার নয়। ভারতের কাছে ‘বিজয়’ বাংলাদেশের বিজয় নয়- বরং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বিজয় এবং পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করবার রাজনীতি ও সমরনীতির সাফল্য। কিন্তু বাংলাদেশের কাছে বিজয়ের অর্থ হচ্ছে বিশ্বসভায় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়। একদিকে একাত্তরে আমাদের মুক্তি সংগ্রামে, অন্যদিকে একাত্তরে নভেম্বর/ডিসেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধ। দুটো একই যুদ্ধ নয়। স্বাধীনতা দিবস একান্তই বাংলাদেশের জনগণের দিবস— এই দিন, এই মুহূর্ত, এই অসামান্য ঐতিহাসিক ক্ষণ একান্তই বাংলাদেশের জনগণের— একান্তই আমাদের এই দেশের গণমানুষের স্বাধীনতা অর্জনের দিবস। এখানে অন্য কাউকে স্থান দেবার এখতিয়ার কারো নাই। না, বাংলাদেশের সেনাপতিরও নাই।
পরিষ্কার যে এই লক্ষণগুলো মোটেও ইতিবাচক লক্ষণ নয়। এখানেই ভারতপন্থী বাংলাদেশী তাঁবেদারদের আসল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খোলামেলা প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং বাংলাদেশেরও সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য আমরা নাগরিকরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না।
৩
এই সকল লক্ষণ থেকে আমাদের শেখার দিকটা হলো এই যে এগারোই জানুয়ারিতে অনেক কিছুই আমাদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। সেটা ফিরে পেতে হলে আমাদের আবার একাত্তরে ফিরে যাবার দরকার রয়েছে। এইসব লক্ষণ থেকে এটাও বুঝি যে নির্বাচনের যে সকল ধোঁয়াশা কথাবার্তা চলছে সেগুলো একান্তই হাওয়াই কথাবার্তা। কারণ লড়াইটা যদি জনগণের করতেই হয় তবে সেটা নির্বাচনী লড়াই নয়। কিসের লড়াই?
নিজেদের আত্মমর্যাদা ও রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিশাবে সার্বভৌম ক্ষমতা গঠনের লড়াই। নতুনভাবে বাংলাদেশ নির্মাণের কথা ভাবতে হবে আমাদের।
১৪ চৈত্র ১৪১৪। ২৮ মার্চ ২০০৮। শ্যামলী।