রবীন্দ্রনাথ: বাংলা ভাষা ও হিন্দি


 

৭ জুন ২০২২

রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাকে সর্ব ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দি ভাষার সমান মর্যাদার অধিকারী গণ্য করেন নি। ভারত ইউনিয়নের সরকারি ভাষা (Official Language) হিন্দি। তার স্ক্রিপ্ট বা মূদ্রাক্ষর দেবনাগরী। (ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল ৩৪৩ দেখুন)। তবে রাজ্যের অধিকার অস্বীকার করা হয় নি, পশ্চিম বাংলায় বাংলা সরকারি ভাষা। কিন্তু সেটা ইংরেজি ও হিন্দির পরে শুধু নয় আরও পাঁচটি ভাষার আগেপরে। সেগুলো হোল, উর্দু, গুরুমুখি, নেপালি, অলচিকি বা সাঁওতালি এবং উড়িয়া। ইংরেজি ও বাংলার পরে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির ভাষাগুলোকে মমতা ব্যানার্জি মর্যাদা দিয়েছেন। আমি তা সমর্থন করি।

কিন্তু এর একটা নেতিবাচক ফল হচ্ছে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ভয়ানক গৌণ হয়ে পড়েছে। অন্য সকল জনগোষ্ঠির ভাষাকে মর্যাদা দেবার সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও ভাষা কিম্বা সাংস্কৃতিক দিক থেকে তাতে বাংলাভাষার কোন উপকার হয় নি। 'প্রমিত ভাষা' নামক রক্ষণশীলতা বাংলার বিকাশের প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে। তাছাড়া বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন হয়েছে, আরবি, ফারসি, উর্দু ইত্যাদি বাংলা ভাষা থেকে বিতাড়নের ধারা যেমন আছে, তেমনি প্রতিবেশী ভাষা বা সংস্কৃত থেকে নেওয়া দূরের কথা, কোন আন্তরিক সম্পর্ক বাংলা সাহিত্য করতে পারে নি। তবুও বাংলা অন্য ভাষার ওপর হিন্দির মতো সর্দারি বা অধিপতির ভূমিকা দাবি করে নি। সেটা ভাল। কিন্তু উড়িয়া বা আসামের সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির সম্পর্ক এখনও শত্রুমূলক।
পশ্চিম বাংলা স্বীকৃতি দিলেও বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ক্ষতি উর্দু, গুরুমুখি, নেপালি, অলচিকি বা সাঁওতালি কিম্বা উড়িয়ার জন্য হয় নি। হয়েছে হিন্দির জন্য। সাংবিধানিক ভাবে হিন্দি ভারতের অধিপতি ভাষা। এর সার্বিক ফল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য ভয়ানক নেতিবাচক হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আমরা যখন পশ্চিম বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবিতার দৌড় বিচার করি তখন তা সহজেই আমাদের নজরে ধরা পড়ে।
পশ্চিম বাংলা নিজের মাতৃভাষায় মৌলিক কিছু ভাববার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। রণজিত গুহের মতো স্বনামখ্যাত সাব-অল্টার্নবাদী বুদ্ধিজীবী কিম্বা সাবল্টার্ন ঘরানার ওজনদার যেকোন বুদ্ধিজীবীর কথাই ধরা যাক। তাঁদের অধিকাংশ কাজ ইংরেজিতে। পশ্চিম বাংলায় বাংলাভাষায় কাজ হয়েছে অল্প। বাংলা ভাষায় মৌলিক কোন কাজ হয়েছে দাবি করা মুশকিল। পশ্চিম বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বয়স কম না। বাঙালি মুসলমান যখন ইংরেজি শেখে নি, যখন তারা পাট, মরিচ, ধান বুনে জীবিকা নির্বাহ করছে, তখন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামেন্দসুন্দর ও রবীন্দ্রনাথদের জন্ম হয়েছে। হিন্দু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশের ইতিহাস ২০০ বছরেরও বেশী। তুলনায় নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতির দাবির ওপর অধিকার কায়েমের দাবি নিয়ে গঠিত বাংলাদেশের বয়স মাত্র ৫০ বছর।
এখানে তুলনার কিছু নাই। এটা বাস্তবতা। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে সীমান্তের দুই দিকেই বাঙালির প্রবল হীনমন্যতা ও ইংরেজ প্রীতি গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য মুক্তিযুদ্ধের পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা কায়েম করতে পারে নি। এমনকি সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের আইন সত্ত্বেও (The Bengali Language Implementation Act, 1987 )। অন্যদিকে ভারত রাষ্ট্র হিশাবে একটি 'ইউনিয়ন', কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্য সকল শক্তিশালী ভারতীয় ভাষার ওপর হিন্দির আধিপত্য কায়েম করবার ব্যবস্থাটা ফেডারেল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হিশাবে পাকাপোক্ত আছে। এই আধিপত্য সাংবিধানিক ভাবেই আরোপিত এবং চর্চিত। সেটা হিন্দি ভাষা বা সাহিত্যের নিজের গুণে না। হিন্দি ভারত ইউনিয়নের বিশেষ ক্ষমতা প্রাপ্ত ভাষা।
এর অর্থ কী? ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ভারতীয় রাজ্যের যে আত্মা, মর্ম বা সত্তা তাকে ধীরে ধীরে নাশ ও ধ্বংস করবার শর্ত ভারত ইউনিয়নের সংবিধানের মধ্যেই ন্যস্ত রয়েছে। হিন্দির সাংবিধানিক আধিপত্যকে তাই উপেক্ষা করবার সুযোগ নাই। এর বিরুদ্ধে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো থেকে আমরা যে প্রতিবাদ দেখি, পশ্চিমবাংলা তার ধারে কাছেও নাই।
নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশের একমাত্র ও প্রধান শর্ত হচ্ছে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা, নিষ্ঠার সঙ্গে সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা। আর কোন বিকল্প নাই। একই ভাবে দরকার অধিপতির ভূমিকা কঠোর ভাবে পরিহার করে অন্যান্য স্থানীয় ভাষার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ স্থাপন এবং উদার ভাবে গ্রহন ও বর্জন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে অবশ্যই তার প্রতিবেশী ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ও গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। উড়িয়া বা অহমিয়ার সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দূরত্ব এবং দুষমনির ফল ভাল হয় নি।
প্রতিবেশী ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক কেন দরকার? যেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিসর বাড়তে পারে এবং বাড়ে। যেন ভূ-রাজনৈতিক এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বিকাশের শর্ত তৈরি হয়। বাংলাভাষীরা যেন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভাবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ বলে আমরা এর তাগিদটা সহজে বুঝি। কিন্তু সাধারণ ভাবে বাংলাভাষী বাঙালি সেই ক্ষেত্রে মারাত্মক ভাবে রক্ষণশীল। বাঙালি তাই পিছিয়ে গিয়েছে। সাব-অলটার্ন নিয়ে তত্ত্ব করেছে ঠিকই, কিন্তু নিজেকে কখনই সাব-অল্টার্ন বা নিম্নবর্গ ভাবে নি। রণজিত গুহের সাম্প্রতিক বাংলা বই পড়তে গিয়ে এই কথাটা আমার ভীষণ ভাবে মনে হয়। একটা ইতিবাচক পথ -- অর্থাৎ বাংলায় কিভাবে যুগপৎ অঞ্চল ও বিশ্বকে ধারণ করা যায় -- বাংলাভাষীদের তারা দেখাতে পারতেন। কিন্তু সেটা হয় নি।
অনেকে যুক্তি দেবেন নিম্নবর্গ নিয়ে বাঙালি যারা কাজ করেছেন তারা অধিকাংশই ব্রাহ্মণ। তারা নিম্ন বর্গের সঙ্গে একসাথে মাটিতে বসেছেন বটে, কিন্তু মাটিতে নামেন নি। এই অভিযোগ ভেবে দেখার মতো। আজকাল বাংলাদেশে পার্থ চ্যাটার্জি, দীপেশ চক্রবর্তী প্রমুখদের নিয়ে বাংলাদেশের তরুণদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। গায়ত্রী চক্রবর্তী দীর্ঘকাল ধরেই বাংলাদেশে স্বনামধন্য। বাংলাদেশ নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি। বাঙালি হয়েও বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের প্রতি সুবিচার হয়তো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কৃতবিদ্যদের কাছ থেকে বাংলাদেশ আশা করে না। কিন্তু বাংলাদেশ নিম্নবর্গের মানুষদের দেশ। নিম্নবর্গের প্রতি দায় অবশ্যই প্রত্যাশা করে। সাব-অল্টার্নদের কাছ থেকে তো অবশ্যই। কিন্তু সেটা হয় নি।
প্রণব মুখার্জি যখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন তিনি সক্রিয় ভাবে হিন্দিকে জনপ্রিয় করার আবেদন জানিয়েছিলেন (দেখুন, President Pranab Mukherjee appeals for popularization of Hindi)। হয়তো হিন্দিভাষীদের কাছে নিজেকে আরও গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করে তোলার দরকারে। কিন্তু এর দরকার ছিল না । ভারত ইউনিয়নের সাংবিধানিক ক্ষমতার বলে হিন্দি ভারতের অধিপতি ভাষা। দরকার অন্যান্য স্থানীয় ভাষাকে জনপ্রিয় করবার কথা বলা। ভাষা এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারতের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিকাশের জন্য হিন্দি নয়, অন্যান্য রাজ্য ভাষা বা গৌণ ভাষাগুলোর বিকাশ অধিক জরুরি। কিন্তু ব্যানার্জি বাবু উল্টাটা করলেন। তিনি ‘হিন্দি দিবস’ পালন করতে গিয়ে উলটা দাবি করলেন যে “ভারতের সমস্ত ভাষার মধ্যে হিন্দির একটি বিশেষ স্থান রয়েছে”। তাতো আছেই। সংবিধানেই সেটাই বলা আছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ভারতের বিকাশের জন্য হিন্দি না, অধিপতি ভাষার চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া অন্যান্য ভাষার প্রতি নজর দেওয়াটাই ভারত ইউনিয়নের কাজ। হিন্দির পক্ষে বলতে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথকেও টেনে আনলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্ধৃতি দিয়ে রাষ্ট্রপতি হিশাবে প্রণব বাবু বললেন, নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ সমস্ত ভারতীয় ভাষাকে নদী এবং হিন্দিকে সমুদ্র বলে বর্ণনা করেছেন। হিন্দি সমুদ্র আর বাংলা ভাষা মেলা নদীর মধ্যে একটা নদী!! ভাবুন, এটা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ঠিক। প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি হয়ে সেই তত্ত্ব প্রচার করেছেন হিন্দির মহিমা কায়েমের জন্য।

বাঙালির হীনমন্যতা অতিশয় গভীর। সেটা ঠাকুর থেকে প্রণব মুখার্জি অবধি ব্যাপ্ত। প্রণব বাবুর হিন্দি প্রীতি এতোই গভীর ছিল যে তিনি উল্লেখ করেছেন যে ভারত ইউনিয়নের সংবিধানে বিধান করা হয়েছে যে হিন্দিকে এমনভাবে বিকশিত করতে দেওয়া উচিত যাতে এটি ভারতের সংমিশ্রিত সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করে। এর একটাই মানে দাঁড়ায়। হিন্দি সংস্কৃতিকে ভারতীয় সংস্কৃতি হিশাবে গড়ে তোলা। অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির বারোটা বাজানো।

বাংলাদেশ নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে লড়াই করেছে অবশ্যই। বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির দাবিতে বাংলাদেশ নিজের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছে বটে, কিন্তু অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির যথাযোগ্য মর্যাদা বাংলাদেশ কায়েম করতে পারে নি। বাংলাদেশের ব্যর্থতাও অপরিমেয়।

এই আলোচনাগুলো কেন দরকার? কারণ ভূ-রাজনৈতিক ভাবে উপমহাদেশকে আমলে না নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে আগামি ও আসন্ন বহুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় নিজের স্থান নির্দিষ্ট করে চিনে নেওয়া অসম্ভব। এটা পরিষ্কার যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশের দায় বাংলাদেশের ঘাড়ে ঐতিহাসিক ভাবেই ন্যস্ত রয়েছে। সেটা সঠিক ও ন্যায্য ভাবে সম্ভব যদি অন্য সকল জনগোষ্ঠির ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দৃঢ় ভাবে সংকল্প নিতে পারে। অতএব ভারত ইউনিয়নের মতো বাংলাকে অধিপতি ভাষা হিশাবে অন্যান্য জনগোষ্ঠির ওপর চাপিয়ে দেওয়া পরিহার করতে হবে। বাংলাদেশ যদি নিজেকে বৃহৎ পরিসরে ভাবতে না পারে এবং সংকীর্ণ বাঙালি জাতিবাদের গণ্ডিতে আটকে যায় সেটা বিনায়ক দামোদর সাভারকারের সংকীর্ণ নাস্তিক্যবাদী জাতিবাদের অধিক কিছু হবে না। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য সেটা মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠবে।

সরকারি ভাষা এবং রাষ্ট্র ভাষার তর্ক স্রেফ আইনী বা সাংবিধানিক বিষয় না। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর বাংলাদেশ গঠিত। বাংলাদেশের আত্মা, মর্ম বা সত্তা্র শেকড় তার ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মধ্যে। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যেই তার রূপ খুঁজে পেতে হবে। কিন্তু আজও বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং বাঙালির ঐতিহ্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কোন স্থান নাই। উচ্চ বর্ণের হিন্দু বাঙালি যেভাবে মুসলমানদের বাদ দিয়ে বিভাজন তৈরি করেছে বাংলাদেশের ভাষা ও সাহিত্যও ঠিক সেই ভাবে ক্ষুদ্র জাতি সত্তার উপস্থিতি শূন্য করে রেখেছে। এভাবে চলতে পারে না। মুসলমান বাঙালি বাদ দিয়ে যেমন 'বাঙালি' নাই, তেমনি বড় বাংলার সমতল ও পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা 'আদিবাসী'দের বাদ দিয়ে কোন 'বাংলা' বা 'বড় বাংলা' নাই। এটা কবুল করতে হবে।

আমি 'বড় বাংলা'র কথা বলি। এটা একালে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক বর্গ। আমাদের বাঁচামরার প্রশ্ন এই ধারণা বা বর্গের সঠিক মর্ম নির্ণয় এবং বিকাশের ওপর নির্ভরশীল। বড় বাংলা কোন জাতিবাদের নাম না, না বাঙালি বা না বাংলাদেশী। বড় বাংলা আমাদের ভূগোল আমাদের আবাস, আমাদের প্রাণ ও প্রকৃতির জগত। আমাদের নদি, পাহাড়, সমতল, পলি,‌ বনভূমি, আবাদি জমি, অনাবাদি জমি, বঙ্গোপসাগর -- সব কিছু মিলিয়ে প্রাণ ও প্রকৃতির যে জগত সেই জগতের নাম 'বড় বাংলা'। এই জগৎকে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারলেই বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত বা যুদ্ধ বিগ্রহের ডামাডোলে আমরা বর্জ্য হিশাবে পরিত্যক্ত হব না। সকলকে রক্ষা করতে পারব।

ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বিশ্ব-বাস্তবতার রূপ আমরা দেখছি তার বিপরীতে টিকে থাকার জন্য আমাদের অবশ্যই নিজেদের সম্পর্কে নতুন ভাবে ভাবতে হবে। অতএব আধুনিক জাতিবাদ না একদমই – বরং আমাদের ভূগোল, আবাস, ভাষাসমুহ, বিচিত্র ও বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং আমাদের পরস্পরের জীবনের সঙ্গে নিবিড় ভাবে বিস্তৃত নানান সম্পর্ক ও সন্ধির মধ্যে আমাদের নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে। যেন আমরা একই সঙ্গে স্থানীয় এবং বৈশ্বিক হতে পারি।
পরিশেষে একটি গুরুতর বিষয়ের দিকে নজর দিতে বলব। ঔপনবেশিক আমলে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর ভাষা ও সাহিত্যে ইসলাম ও মুসলমানের কোন স্থান ছিল না। ইসলামকে এখনও বাংলা ও বাঙালির বাইরের ব্যাপার গণ্য করা হয়। নিজেকে হিন্দু দাবি করেও বাঙালি থাকা যায়, কিন্তু মুসলমান দাবি করে 'বাঙালি' হওয়া যায় না। তাই হিন্দুত্ববাদ 'বাঙালি মুসলমান' নামক নব্য সাম্প্রদায়িক পরিভাষা আবিষ্কার করেছে। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে 'বাঙালি মুসলমান' কথাটির বর্ণনামূলক উপযোগিতা রয়েছে। অথচ এই হিন্দুত্ববাদী পরিভাষাই জাতিবাদী মুসলমানদের বড় একটি অংশ আজকাল নিজেদের পরিচয় হিশাবে ব্যবহার করে। তারা বুঝতে পারে না এটা আসলে ঔপনিবেশিক শাসন ও হিন্দুত্ববাদের কারখানায় তৈয়ারি পরিভাষা। বাঙালি মুসলমানকে 'বহিরাগত' হিশাবে প্রতিষ্ঠা করবার হিন্দুত্ববাদী বর্গ।
জাতিবাদ -- সেটা ভাষা ও সংস্কৃতি জাত হোক, কিম্বা হোক ধর্মীয় -- ইতিহাসের জতিবাদী পর্যায়টা আমাদের দ্রুত পেরিয়ে যেতে হবে। আমরা 'বড় বাংলা' কথাটা ভবিষ্যতের দিকে নজর রেখে বলি।

বড় বাংলার আর কোন মতলব নাই।

(৭ জুন ২০২২)

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।