- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
এক
বাংলা নববর্ষ পালন করার পক্ষে যে যুক্তি সাধারণত দেওয়া হয় সেটা হয় সাহেবদের অথবা মুঘল আমলের জমিদার-মহাজনদের যুক্তি। সাহেবরা ‘নিউ ইয়ার’ পালন করেন। ইংরেজি নববর্ষে তারা সকালে পরস্পরকে বলেন, ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’। এর একটা স্মার্ট ধ্বনিগত চমক আছে। চৌকস। অতএব আমাদের চামড়া বাদামি হওয়া সত্ত্বেও আমাদেরও ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলবার একটা ব্যবস্থা থাকা চাই। সাহেব হবার বাসনায় আমরাও ‘নববর্ষের শুভেচ্ছা’ চালু করলাম। বাংলা নববর্ষের চল হোল।
‘বাংলা নববর্ষ’ নামক আদৌ কি কিছু ছিল? সেটা কেমন ছিল? কারা করত? কোথায় ছিল? আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে কিছু খোঁজখবর নিয়েছি। সেটা ছিল না যে এমন নয়। ছিল, কিন্তু সেটা বাঙালির বা এই দেশের জনগোষ্ঠির নববর্ষ নয়। সেটা ছিল সুদখোর মহাজন ও ব্যবসায়ীদের খেরো খাতা মেলাবার দিন। কার কাছে কি দেনা পাওনা তার হিসাব মিলিয়ে নতুন লাল খেরো খাতা খুলবার দিন। তাদের সংস্কৃতিও সংস্কৃতি। কিন্তু একটি বিশেষ সম্প্রদায় বা শ্রেণির সংস্কৃতি। তাকে সকলের সংস্কৃতি বলে চাপিয়ে দেওয়া একটা বিশেষ শ্রেণির আধিপত্য প্রমাণ করে। তাকে সার্বজনীন দাবি করাটা রাজনীতি, সংস্কৃতি নয়।
গত ২০ -২৫ বছর ধরে আমি গ্রামে গ্রামে কৃষকদের নিয়ে কাজ করছি। দেখেছি বাংলা নববর্ষকে তারা জমিদার-মহাজনদের খাজনা আদায়ের দিন কিংবা সারা বছরের সুদের হিসাব মেলাবার জন্য যতোটা বোঝে তথাকথিত ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ হিসাবে বোঝে না বললেই চলে। সংক্রান্তির পরের দিন ঘর ধোয়ামোছা, গরুকে গোসল করানো ইত্যাদি অনেক কিছু তারা করে বটে, কিন্তু তাকে নববর্ষ নামক কোনো ধর্মীয়, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক উৎসব বলা যায় না।
বাংলা নববর্ষ বানানো জিনিস। আমাদের বানাতে হয়েছে। বিশেষত আমরা যারা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখি না, কিন্তু আমরাই আবার বাঙালির সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বয়ান রচনার জন্য নিজেদের যোগ্য মনে করি। আমাদের নিজ শ্রেণীর আধিপত্য বজায় রাখবার জন্যই সেটা দরকার। বাঙালির নববর্ষ নামক একটা বয়ান আমাদের নিজ শ্রেণীর স্বার্থেই বানাতে হয়েছে। তারপর সাহেবদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের দাবি করতে হয়েছে, ‘এই দেখ আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি'।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার কৃষকদের শোষণ লুন্ঠন করে যে-অভিজাত জমিদার শ্রেণী গড়ে উঠেছিল তাদের সংস্কৃতিও সংস্কৃতি, কিন্তুই এটাই বাংলাদেশের সকল বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ বা সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি সেটা দাবি করা যাবে না। ঔপনিবেশিক কলকাতা শহর গড়ে ওঠা এবং তাকে কেন্দ্র করে অভিজাতদের যে বাঙালি সংস্কৃতি তার বর্ণ, শ্রেণি ও পুরুষতান্ত্রিক ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস ভুলে গিয়ে অভিজাতদের সংস্কৃতিকেই আমরা ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে দাবি করতে শুরু করেছি। পাশ্চাত্য 'রেঁনেসা'র নকল করে অভিজাতদের সংস্কৃতিকে 'বাঙালির পুনর্জাগরণ' বলা হয়েছে। আজ অবধি এটাই চলছে। আমাদের নববর্ষের আবহন শুরু হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়ে। আবহমান বাংলার কেচ্ছা গাওয়া আমরা এভাবেই শিখেছি।
দুই
নতুন বছর। অতএব, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো… ইত্যাদি। যা কিছু ‘পুরাতন’, ‘জীর্ণ’, ‘আবর্জনা’ সব ‘যাক যাক’ – সব ‘নতুন’ করে শুরু হোক। ‘নতুন’-কে বরণ করা আর যা কিছু ‘পুরাতন’ তাকে আবর্জনা ও পরিত্যজ্য জ্ঞান করে ফেলেই যদি দিতে হয় তো বেচারা রবীন্দ্রনাথকেও ফেলে দেওয়া ছাড়া আমাদের আর গত্যন্তর থাকে না। ফলে এখন ঠাকুরকে মহা আয়োজন করেই টিকিয়ে রাখবার দশা হয়েছে। এখন নববর্ষে ব্যান্ড সঙ্গীতও ঢুকেছে। রবীন্দ্রনাথ যখন গান লিখছিলেন তখন ব্যান্ড সঙ্গীতের হুল্লোড় ছিল না। আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত বা ব্যান্ড সঙ্গীত দুটোর একটিরও বিপক্ষে নই। আমি গান পাগল মানুষ অতএব দুটোর প্রতি আমার সমান ভালোবাসা। এখানে আমি গানের বিচার করতে বসিনি। যে কথা শুরু করেছি তার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাবার জন্য খানিক কোশেশ করছি মাত্র। যেমন ব্যান্ড সঙ্গীত ‘নতুন’ বলেই যদি ‘এসো এসো’ বলে বরণ করতে হয় আর ঠাকুর ‘পুরাতন’ বলে তাকে ‘যাক যাক’ বলে ফেলে দেবার নির্দেশ আসে তাহলে তো আমার খুবই অসুবিধা। পুরাতনকে ‘জীর্ণ’ বলে পরিত্যাগ করা আর নতুনকে ‘এসো এসো’ বলা খুবই মন্দ একটি আদর্শ। এই আদর্শই আমরা নববর্ষে প্রচার করি।
তবু ঠাকুর আমার প্রিয়। কারণ আমি নিজেও তো এই শ্রেণি থেকেই আসা। হোক আমার বাড়ি নোয়াখালি। আমার বয়স যখন খুবই কম তখন মাঝে মধ্যে সকালে জামে মসজিদে ফজর নামাজের পরে যে গানটি গাইতে গাইতে নোয়াখালীর মতো একটি নিমশহরে অস্ফুট প্রভাতে ঘরে ফিরতাম সেটা ছিল, ‘দাঁড়াও আমার আঁখির আগে, তোমার দৃষ্টি হৃদয়ে লাগে’। সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে যা আমার প্রাণে সাড়া তুলেছে তাকে 'আমার' বলতে আমার অসুবিধা হয় নি। কিন্তু 'আমার' সংস্কৃতি সকলের সংস্কৃতি নয়, সার্বজনীনও নয়, এই হুঁশটুকু হারিয়ে ফেলা ঠিক না।
আহ্ সেই সুবেহসাদেক। আকাশ খানিক অন্ধকার, অতঃপর লালাভ হয়ে উঠছে চতুর্দিক। ভাবতাম আমার ‘আঁখির আগে’ দাঁড়াবার জন্য আমি কাকে আবাহন করছি? কে দাঁড়াচ্ছে? সুবেহসাদেক থেকে শুরু করে যা ক্রমশ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে -- অনির্বচনীয় মুহূর্তের সেই এক এবাদত --যার স্মৃতির সঙ্গে গোটা মাইজদী কোর্ট আমার বুকের মধ্যে আজও খচিত হয়ে আছে। অতএব ঠাকুরকে আর যাই হোক ‘যাক্ যাক্’ বলে ফেলে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। নতুন আর পুরাতনের ভেদরেখা টেনে একটিকে অন্যটির চেয়ে অধিক মূল্যায়নের যে ব্যাকরণ, রীতি, অভ্যাস বা দর্শন আমাদের চিন্তা অধিকার করে রাখে তাকে প্রত্যাখ্যান করবার শিক্ষা আমি সুবেহসাদেক থেকেই নিয়েছি। সেই ভাবের মধ্যে সন্ধিক্ষণ বা সংক্রান্তির আলোছায়া; সেই না আলো না ছায়া এমন এক আনন্দ নিয়ে হাজির হয় যে নিজের অজান্তেই আমাদের ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে। ডাকি, ডাকতে থাকি: ‘দাঁড়াও আমার আঁখির আগে, তোমার দৃষ্টি হৃদয়ে লাগে’।
বহুদিন আগে কমল মজুমদারের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ পড়বার সময় প্রথম বাক্যেই পড়েছিলাম যে, ‘আলো ক্রমে আসিতেছে। এ নভোমণ্ডল মুক্তাফলের ছায়াবৎ হিম নীলাভ। আর অল্পকাল গত হইলে রক্তিমতা প্রভাব বিস্তার করিবে, পুনর্বার আমরা প্রাকৃতজনেরা, পুষ্পের উষ্ণতা চিহ্নিত হইব। আলো ক্রমে আসিতেছে।…’। একটা শিহরণ হয়েছিল আমার। ভুলবার নয়।
তিন
বাঙালি সংস্কৃতির বয়ান তৈয়ার করবার তাগিদে বাংলা নববর্ষ পালন করবার পক্ষে মোঘলাই যুক্তির মূল কথা হচ্ছে সম্রাট আকবর বাংলা বছর চালু করেন সৌর বছর আশ্রয় করে। ঠিক। কিন্তু তিনি কাজটা করেছিলেন খাজনা আদায় করবার জন্য। জমির মালিকানা ও দখলদারির ওপর মোঘলাই শাসন কায়েম করবার দরকারে। ওখানে মোঘলাই খাজনাদারি কিভাবে বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি হয়ে উঠল সেটার ব্যাখ্যা খুব একটা পাওয়া যায় না। আমি সাহেবও নই, মোঘলও নই। কিন্তু সাহেবি বা মোঘলাই যুক্তি দেখিয়ে বাংলা নববর্ষ নামক একটি ব্যাপার চালু হয়ে যাবে আর তাকে আমাদের ‘আবহমান বাঙালির সংস্কৃতি’ বলে মেনে নিতে হবে অতোটা উদার আমি হতে পারি না।
সবাই যখন বাংলা নববর্ষ বা বাঙালির (সাহেবি বা মুঘলিয়ানা) সংস্কৃতি নিয়ে মশগুল তখন চৈত্রসংক্রান্তি পালন করবার পক্ষে ওকালতি করে আমি ২০০৬ সালে একটা লেখা লিখেছিলাম ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এইজ’ পত্রিকায়। সেই লেখা বাংলায় বিশদ করে এখানে হাজির করবার ধৈর্য আমার হবে না। উৎসাহী পাঠক একটু ঘাঁটলে খুশি হব :
http://www.newagebd.com/2006/apr/14/pb06/celebration.html/ (সম্ভবত এ লেখাটি তাদের আরকাইভে এখন আর নাই। আমি খুঁজে পেলে তুলে দেবো।)
সেই লেখায় বাংলার ভাবান্দোলনের জায়গায় দাঁড়িয়ে সকলকে সংক্রান্তি পালনের আহবান জানিয়েছিলাম। যে দিকটার তাৎপর্য তুলে ধরে ওকালতি করেছি তার সঙ্গে যুক্ত বাংলার ভাবে ‘সময়’ সংক্রান্ত ধারণা। এর কিছুটা ইশারা ‘সন্ধিক্ষণ’, ‘সংক্রান্তি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের মধ্যে পাঠক হয়তো ইতোমধ্যে খানিকটা টের পেয়েছেন। একই ভাব ধরবার জন্য আমি যখন আরবিতে ‘সুবেহসাদেক’ বলি তখন অনেকের উসখুশ লাগতে পারে। এটাও 'সন্ধিক্ষণ, 'সংক্রান্তি' ইত্যাকার সময়মূলক ধারণার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এটা মুসলমানদের শব্দ, অতএব পরিত্যজ্য। এই সাম্প্রদায়িকতার চর্চাই তো আমরা করি।
শিব পার্বতী সেজে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো আর নৃত্য এখনও চৈত্র সংক্রান্তির সময় দেখা যায়। কতদিন টিকবে জানি না। শিবের সঙ্গে প্রকৃতি ও কৃষিব্যবস্থার যে সম্পর্ক -- নদীবিধৌত বাংলার একান্তই নিজের জিনিষ -- উত্তর কিম্বা দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে যার সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ -- এর মর্ম আমরা বুঝি নি, এখনও বুঝি কিনা সন্দেহ। শিবের জটা আঁচড়ে দিচ্ছেন পার্বতী, মেঘের আওয়াজ হয়ে গুরুগম্ভীর কাঁপছে নভোমণ্ডল, আর বৃষ্টির ধারা হিমালয় থেকে বাংলায় ধেয়ে আসছে পলিমাটি বুকে নিয়ে -- এছাড়া কিভাবে বাংলার কৃষির বিকাশ সম্ভব! এরপর রয়েছে বঙ্গোপসাগরের তীরে মহেশখালির আদিনাথ পাহাড়ে গোরক্ষনাথ ও নাথপন্থীদের গল্প। সে এক বিশাল আখ্যান। শৈশব থেকেই যে স্মৃতি আমি বয়ে বেড়াই। যে স্মৃতির দাগ অনুসরণ করে আমি নদিয়ায় যাই, ফকির লালন শাহকে দেখি। চিনি। কতোদিনের চেনা। সেই অন্বেষণের আরম্ভে রয়েছে সেই এক দেবের দেব ভোলানাথের সন্ধান করে যাওয়া যিনি বিষ পান করে নীলকন্ঠ হয়েছেন। এই বিষ গিললে মৃত্যু, আর উগরে দিলে সৃষ্টির ধ্বংস: প্রাণের বিনাশ। কন্ঠে বিষ ধারণ করে শিব সমগ্র সৃষ্টি ও সকল প্রাণের হেফাজত করছেন। বিষে তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে গিয়েছে, সেই কণ্ঠ জড়িয়ে রয়েছে ঠাণ্ডা সরিসৃপ। শিব প্রকৃতি ও প্রাণের মহেশ্বর। বাংলার এই শিব কোন সম্প্রদায়ের নন, কারণ সকল প্রাণের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন বলেই তিনি দেবের দেব মহাদেব।
আমি ইংরেজ বা আরব নই, সংস্কৃত ভাষা আর বাংলা ভাষাও সমার্থক নয়। ধর্মসূত্রে ও মুঘল শাসনের কারণে আরব ও পারস্য সভ্যতার সঙ্গে আমাদের যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক ঘটেছে তাকে আমরা রাবার দিয়ে মুছে ফেলতে পারি না। যেমন, ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসনকেও নয়। কিন্তু বাংলাকে অবশ্যই সংস্কৃত, আরবি, ফারসি বা ইংরেজি হলে চলবে না। ঠিক। কিন্তু সংস্কৃত ভাষা থেকে শব্দ আহরণকে আমরা স্বাভাবিক গণ্য করি, এমনকি হরদম ইংরেজি ব্যবহারেও আমরা আপত্তি করি না। কিন্তু আরবি বা ফারসি থেকে শব্দ আহরণকে আমরা যখন কানা চোখে দেখি তখন তাকে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? অন্য ভাষা ও ভাব আমার ভাষা ও ভাবের মধ্যে আত্মস্থ করবার শক্তি অর্জনের মধ্যেই বাংলা ভাষা ও ভাবের বিকাশের সমূহ সম্ভাবনা, বিশেষত যে সকল ভাষা ও ভাবের সঙ্গে ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় আমাদের যোগ ঘটেছে। এর কোন বিকল্প নাই। জনগোষ্ঠি হিসাবে বিশ্বসভায় আমাদের দাঁড়াবার সম্ভাবনাও নির্ভর করবে আত্মস্থকরণ বা আত্মীকরণের এই হিম্মতটুকু দেখাবার মধ্য দিয়ে। বাংলা ভাষা ও ভাবের হজমি শক্তি প্রবল। পণ্ডিত আর সাহেবে মিলে যে বাংলা গদ্য দাঁড় করিয়েছে তাকে ‘প্রমিত’ বা একমাত্র ‘বাংলা’জ্ঞান করবারও কোনো যুক্তি নাই। রবীন্দ্রনাথও সেটা মানেননি। আমিও মানি না।
‘সময়’ সংক্রান্ত ধারণার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক আমি বাংলার ভাবের জায়গায় দাঁড়াবার জন্য হারাতে চাই না। সেটা হচ্ছে সময় যে একটা সরলরৈখিক ব্যাপার এই ধারণার আধিপত্য সম্পর্কে সাবধান হওয়া। বাংলার ভাবে বছর আর ঋতুর পার্থক্য প্রবল। এই ভাব মোতাবেক বছর ‘নতুন’ হয় না, বরং ফিরে ফিরে আসে। প্রত্যাবর্তন করে। একই ঋতুরই বারবার আবির্ভাব ঘটে। অতএব বছর শেষ আর শুরুর মুহূর্তকে একই কালের আবর্ত বলে বিচার করবার যে শিক্ষা আমরা পাই আমি তাকে ভুলে যেতে নারাজ। ‘নববর্ষ’ বা বছর নতুন ভাবে আসে এই ধারণার আধিপত্যের মধ্যে পড়েছি আমরা। এর মুশকিল হচ্ছে যা চলে গিয়েছে বা যা ‘পুরাতন’ হয়ে গিয়েছে তাকে আবর্জনা বা বর্জনীয় গণ্য করা প্রবল হয়েছে। এর মধ্যে যে-রাজনীতি নিহিত রয়েছে আমি সে সম্পর্কে সাবধান ও সতর্ক থাকতে চাই। নববর্ষ বা নতুন বছর পালন আমাদের সেই জন্য বিপদের মধ্যে ফেলে দেয়। অন্যে করলে 'নববর্ষ' করুক, সেখানে বাধা দেবার কোন প্রশ্ন আসে না। বাধা দেওয়ার ফল কুফলই বয়ে আনবে; যা ‘নতুন’ তার বিপরীতে ‘পুরাতন’-কে প্রতিষ্ঠা করাও আমার রাজনীতি নয়। আমি বছর বা ঋতুর এই ফিরে ফিরে আসার ভাবটা রক্ষা করতে বিশেষ ভাবে আগ্রহী। আবর্তের বা প্রত্যাবর্তনের এই ধারণা আমাদের ভাবে, জ্ঞানে ও সংস্কৃতিতে এমন একটা স্থান দখল করে আছে যাকে আমি হারাতে নারাজ। আর, এরই একটা ভালো সুন্দর নাম : সংক্রান্তি। ফলে যারা সাহেব হতে গিয়ে নববর্ষ পালন করতে চায় করুক, আমি চৈত্রের সংক্রান্তি পালন করতে চাই। সংক্রান্তির সংস্কৃতি ও ভাব হারিয়ে ফেললে আমি দরিদ্র হয়ে পড়ি। স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠি হিসাবে নিজের বৈশিষ্ট আমি হারিয়ে ফেলি। জগতে বৈচিত্র্যের নিরাকরণ ঘটে।
তাহলে একটিকে অন্যটির বিপরীতে বসিয়ে অন্যটির তুলনায় অধিক মূল্যায়নের যে নীতি, মানদণ্ড, দর্শন বা ভাব তাকে পরিহার করবার কথা বলছি। ঠিক। কিন্তু ভাব আর রাজনীতি তো এক কথা নয়। চৈত্রসংক্রান্তি পালন করার মধ্য দিয়ে মুঘল, ইংরেজ ও এই কালের সাম্রাজ্যবাদ আমাদের ভাবগত অবস্থান থেকে টলিয়ে দেবার যে প্রবল ধারা বজায় রেখেছে তার বিরুদ্ধেও তো দাঁড়ানো দরকার। কেন দরকার? চৈত্রসংক্রান্তি পালন করা না করা নিছকই ভাবের ব্যাপার মাত্র নয়, নিছকই সংস্কৃতি নয়। এটা রাজনীতি। আর যখনই আমরা রাজনীতির জায়গায় দাঁড়াই তখনই ভেদবিচার ছাড়া চলে না। যদি মোঘলাই, সাহেবি বা নব্য মধ্যবিত্তের সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাবগত বিকাশ ও রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসাবে বিকাশের প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে তাহলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছাড়া পথ কই?
তাহলে রাজনৈতিক কারণেও আমাদের চৈত্র সংক্রান্তি পালন করা দরকার।
তবে, আরেকটি দিকও আছে।
চার
বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন সংক্রান্তি; সূর্য এক রাশি থেকে আরেক রাশিতে যখন গমন করছে তখন প্রতি মাসেই তার একটা সংক্রান্তি ঘটে। সংক্রান্তি পালনের অর্থ তাহলে গ্রহ-নক্ষত্র ও বিশ্বনিখিলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের একটা ব্যাপারও বটে। যে গ্রহ বা নক্ষত্রের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগ নাই, যাদের অধিকাংশকেই আমি কখনোই দেখিনি বা দেখব না, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক পাতাবার যে ভাব তার গুরুত্ব অপরিসীম। সেই দিক থেকে চৈত্র মাসের সংক্রান্তির ভাবই আবার আলাদা। বসন্তের শেষে সূর্যের শেষ দাবদাহ জ্বালিয়ে দিচ্ছে সব। কিন্তু বিদায় নিচ্ছে চৈত্র। আসছে বৈশাখ আর ওর হাত ধরে মেঘ আর জল। জমিতে জো আসবে এখন, কৃষক নতুন আমন ধান লাগাবার জন্য তৈরি হবে। আর মেয়েদের কাজ? বিস্তর…।
সব কাজের সেরা কাজ হচ্ছে চৈত্রসংক্রান্তিতে প্রকৃতির খোঁজখবর নেওয়া। কৃষকদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে যে দিকটা আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করেছে সেটা হচ্ছে প্রকৃতির খোঁজখবর নেবার ধরন; এই কাজটা বিশেষ ভাবে কৃষক মেয়েরা করে। কি করে খোঁজখবরের কাজটি করে তারা?
বাংলার মেয়ে চৈত্রসংক্রান্তিতে শাক কুড়াতে বেরুবে। তাকে চৌদ্দ রকম শাক কুড়াতে হবে। ‘চৌদ্দ’ কথাটা আক্ষরিক অর্থে নিলে চলবে না। এর অর্থ যতো সংখ্যক পাওয়া সম্ভব। নানান ধরনের বিচিত্র সব শাক। আবাদি শাক নয় কিন্তু, অনাবাদী অর্থাৎ বনেজঙ্গলে আপনজালা শাক। ঘরের পাশে আলান পালান মাঠের আনাচে কানাচে কোনাকানচি থেকে তোলা শাক। বাংলার মেয়েকে সংক্রান্তি মুহূর্তে খবর নিতে হবে প্রকৃতির যে অংশ অনাবাদী – যে অংশ কৃষি সংস্কৃতির সংরক্ষণ করে রাখার কথা, নইলে প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ অসম্ভব – সেই অনাবাদী প্রকৃতি ঠিক আছে কিনা। যে সব গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণী আবাদ করতে গিয়ে আবাদী জায়গায় কৃষক তাদের উঠতে দেয়নি, থাকতে দেয়নি, তারা সব কি ঠিকঠাক আছে?
এখানে ‘কৃষি’ বললে কথাটি পরিষ্কার করা যায় না। বলতে হয় ‘চাষাবাদ’। ‘চাষ করা’ এবং ‘আবাদ করা’। কৃষক ‘চাষ’ যখন করে তখন প্রকৃতির মধ্যে স্বাভাবিকভাবে বা প্রাকৃতিকভাবে যে সকল শাক গাছপালা লতাগুল্ম বেড়ে ওঠে তাকে তার পরিষ্কার করতে হয়। তাদের বাদ দিয়ে সেখানে যে-জাত বা প্রজাতি কৃষক চাষ করতে চায় তারই বীজ বোনা হয় বা , তারই চাষ হয়। মানুষ নিজের ভোগের জন্য যে জাতি ও প্রজাতিগুলো দরকার তার চাষ করল কিন্তু যেসব জাত বা প্রজাতি সে মাঠে বাড়তে দিল না, তাদের কী হবে? ‘আবাদ’ করার অর্থ হচ্ছে যেসব জাত বা প্রজাতি চাষ করা হোল না তাদের প্রাকৃতিক বা পরিবেশগত ভাবে রক্ষা করবার ব্যবস্থা রাখা, যাতে তারা নষ্ট না হয়, হারিয়ে না যায়। কৃষকের এখন যা দরকার তা চাষ করবার জন্য প্রকৃতির একটা অংশ ব্যবহার করতে হচ্ছে, অন্যদিকে প্রকৃতির অনাবাদী অংশে তাকে রক্ষা করতে হচ্ছে সেই সব জাত ও প্রজাতি যা আজ নয়, কিন্তু আগামী দিনে তার ও অন্যান্য প্রাণিকুলের প্রয়োজন। প্রকৃতির ব্যবহার এই মুহূর্তের প্রয়োজন মেটাবে। কার প্রয়োজন? মানুষের প্রয়োজন। কিন্তু প্রকৃতি তো শুধু মানুষের জন্য নয়। কিন্তু মানুষের প্রয়োজন মেটাবার জন্য চাষাবাদ করলেও আগামির জন্য আবাদ করতে হয়। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হয় যাতে প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্রের ক্ষয় না ঘটে। প্রকৃতির আবাদি ও অনাবাদি দুটো দিককেই সমানভাবে চর্চা ও উভয়েরই ফলন ও প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে কৃষি সভ্যতা দাঁড়ায়। টিকে থাকে।
তাহলে চৈত্রসংক্রান্তিতে মেয়েদের চৌদ্দ রকম শাক খাওয়া তো আসলে সব রকম গাছপালা প্রাণ ও প্রাণীর হালহকিকতের খোঁজ নেওয়া। বাংলার মেয়ের ব্রত – পুরুষতান্ত্রিক ধর্মের সঙ্গে যার বিরোধ চিরকালের – সেই ব্রতের উপলক্ষ সপ্রাণ প্রকৃতি। সৃষ্টি থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন ভাবে 'স্রষ্টা' নামক কোনো কর্তাসত্তা নয়। স্রষ্টা আছেন, কিন্তু কল্পনা বা বুদ্ধির নির্মাণ হিসাবে নন, আছেন সৃষ্টির নিরন্তর প্রক্রিয়ায় – সপ্রাণ প্রকৃতির সপ্রাণতার অন্তর্গত হয়ে। তিনি কর্তা হতে পারেন, কিন্তু প্রকৃতি তাঁর 'অঙ্গ' হয়ে সতত বিরাজমান।
'পুরুষ পরওয়ারদিগার
অঙ্গে ছিল প্রকৃতি তার
প্রকৃতি প্রকৃত সংসার সৃষ্টি সবজনা (লালন)
নিজের প্রয়োজন মেটাবার জন্য প্রকৃতিতে মানুষের কৃষিমূলক হস্তক্ষেপ ও অনাবাদি জগতকে সাময়িক অপসারণের পরও সৃষ্টির প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করার কর্তব্য থেকে যায় আমাদের। চৈত্রসংক্রান্তিতে অনাবাদি শাক কুড়ানো ও তার কদর প্রতিষ্ঠা সে কারণে জরুরী হয়ে পড়ে । তার মানে পুরুষ কৃষক কৃষি কাজ করতে গিয়ে প্রকৃতির এমন কোনো ক্ষতি করল কিনা, অনাবাদি জাত ও প্রজাতি লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে কিনা সেই খবর নেবার জন্য 'অনাবাদি' শাকের খোঁজ পড়ে চৈত্রসংক্রান্তিতে। চৈত্রসংক্রান্তি সেই দিক থেকে অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ।
গণমানুষের সংস্কৃতি প্রকৃতি ও লোকায়তিক ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বাংলার নারীবাদও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়েছে এই সকল দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যাওয়া ব্রত, মানত ও বিবিধ লুপ্তপ্রায় এবাদতের মধ্য দিয়ে। প্রকৃতি, প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষার সঙ্গে বাংলার জনগোষ্ঠির সংস্কৃতি এখানে অঙ্গাঙ্গি হয়ে বিরাজ করে। জীবন যাপন থেকে এই সংস্কৃতিকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। যদি আমরা প্রাণে বেঁচে থাকতে চাই তাহলে এই সংস্কৃতির উপাসনাই আমাদের কাজ। এটাই এই কালে – পরিবেশ বিধ্বংসী সভ্যতার এই কলিকালে – আমাদের প্রধান কর্তব্য হয়ে উঠেছে। ‘বাঙালি’ বা ‘বাংলাদেশী’ হবার জন্য নয়, প্রকৃতির মধ্যে টিকে থাকার যে লড়াই – জীবের সে-লড়াইয়ের রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসবার জন্য আমাদের দরকার চৈত্রসংক্রান্তি। "
এই বিষয়ে আমি ‘ভাবান্দোলন’ বইতে ‘কৃষি, ভাব ও কাব্য’ নিবন্ধে আলোচনা করেছি। এখানে আর কথা বাড়াব না। নতুন একটি প্রসঙ্গে যাবো।
চার
টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পী রাম বসাক আর আমি। বিষ্ণুপুর গ্রামে নয়াকৃষির রিদয়পুর বিদ্যাঘরে চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবে। রাম আর আমাদের সঙ্গে নাই। হায় সেই নাচও নাই, দুজনেই গ্রামের মানুষকে আনন্দ দিয়ে মজা পেতাম। যে বন্ধন অন্যেরা ছিঁড়ে ফেলতে চায়, চৈত্র সংক্রান্তি ছিল সেই বন্ধন নতুন করে গিঁট লাগাবার উৎসব।
দেবের দেব মহাদেব কৃষির দেবতা কেন বাংলায় – এই প্রশ্ন আমার বহুদিনের। চৈত্রের শুরু থেকেই হরগৌরি সেজে গ্রামে গ্রামে গান, অভিনয়, ঢোল বাদ্যি ইত্যাদি এখনও রয়েছে। কেন শিবের এই ডাঁট আর তার পাশে পার্বতীর এই প্রতাপ এটা ভেবে ভেবে আমাদের অনেক দিন গেছে। কিন্তু শিক্ষাটা শেষাবধি গ্রামের কৃষক মেয়েদের কাছেই পেয়েছি। মহাদেবের পিন্দনে এখন যে বাঘছাল, আর হাতে ত্রিশূল – শিব বা মহাদেব আদিতে তা ছিলেন কিনা সন্দেহ। একবার দেখি গলায় নীল রঙ মেখে নীলকণ্ঠ সেজে মহাদেব পার্বতিকে পাশে নিয়ে গ্রামে ঘুরছেন প্রচণ্ড চৈত্রে। আর হঠাৎ ধূপ ধূপ করে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মেয়েরা নীলকণ্ঠ মহাদেবকে প্রণাম আর সেলাম করছে। মেয়েদের শুধালাম শিব এতো প্রিয় কেন মেয়েদের? তাদের প্রথম উত্তর হচ্ছে শিব যেহেতু তার স্ত্রীর ‘দাসত্ব’ করে অতএব আমরা মেয়েরা পার্বতীর হয়ে শিবের ভক্তি করি। এই উত্তরে খুশি না হওয়ায় প্রায় সব কৃষক মেয়ে উত্তর দিল, এই যে গলায় বিষ ধারণ করে আছেন মহাদেব তাকে দেখেন, নাগিনী বিষের জ্বালা শীতল করবার জন্য তার গলা পেঁচিয়ে আছে। শিব মহাদেব বটে, কিন্তু দেবতাও নন, অসুরও নন। তিনি আসলে মানুষ, তাই তিনি মহাদেব। তিনি মানুষ বলেই তাকে আমাদের ভক্তি। প্রশ্ন করলাম, এতো মানুষ থাকতে শিব কেন? উত্তর এলো অসুর আর দেবতা উভয়েই অমৃত চায়। তাদের সাধনা যে তারা ‘অমর’ হবে। কিন্তু শিব তো ‘অমর’ হবার সাধনা করে না, ‘মানুষ’ হবার সাধনা করে। তাই সে পাগল, মাস্তান, উন্মাদ। সাগর মন্থন করে যখন বিষ উঠে এলো সেই বিষ দেবতা আর অসুররা কোথায় রাখবে ঠিক করতে পারছিল না। তখন তারা সেই বিষ খাইয়ে দিল শিবকে। এখন শিব দেখলেন তিনি যদি বিষ খেয়ে ফেলেন তো তিনি মরেন, আর যদি উগরে ফেলে দেন তাহলে সমস্ত জগৎ সংসার ধ্বংস হয়। সমস্ত প্রাণ ও পরিবেশের সর্বনাশ ঘটে। শিব তখন করলেন কি, তিনি বিষ রাখলেন তাঁর কণ্ঠে। বিষে তার গলা নীল হয়ে গেল। বিষের জ্বালা নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন যেন প্রকৃতি বাঁচে, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, জীব অনুজীব প্রাণে রক্ষা পায়। এই যে নীলকণ্ঠ, দেবের দেব মহাদেব, তিনি ছাড়া ভক্তির পাত্র তো দেবতা হতে পারেন না। অসুর নয়, দেবতা নয় শিবরূপের ভজনাই আমাদের কাজ। শিবকে স্ত্রৈণ বলা যায়, কারণ তিনি পার্বতীর দাসত্ব করেন, এই দাস তো আসলে প্রকৃতির দাস, প্রাণের হেফাজতকারী। যে প্রাণ ব্রহ্মাণ্ডকে সচল ও সজীব রাখে তাকেই রক্ষা করেন শিব। সে কারনেই তিনি দেবের দেব মহাদেব।
যিনি জগৎ রক্ষা করেন ও জগৎ প্রতিপালন করেন। যিনি নিজে বিষ ধারণ করে জীবের প্রাণ রক্ষা করেন তিনি দর্শন দেন প্রতি বছর চৈত্রে। চৈত্রের সংক্রান্তিতে কৃষকের যে-উৎসব, সেখানে তিনি পার্বতীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি বাড়ি যান। প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষার পাঠ মনে করিয়ে দেন, মানুষের কর্তব্য সম্পর্কে হুশিয়ারি জারি করে যান।
কে জানে হয়তো এই জন্যই ফকির লালন শাহ তার আগের প্রচলিত সমস্ত ‘গুরু’ সংক্রান্ত ধারণাকে নাকচ দিয়ে বললেন, ‘গুরু’ যিনি তাকে ধ্যানী শিবের মতোই জীবের প্রতিপালক হতে হবে :
‘কিঞ্চিত ধ্যানে মহাদেব
সে তুলনা কী আর দেব
লালন বলে গুরু ভেব
যাবে রে মনের ধোঁকা
পাবে সামান্যে কি তার দেখা ।
যদি চৈত্রসংক্রান্তি ভুলে যাই তো শিবকেও ভুলি। যদি শিবকে ভুলি, তাহলে ধ্যান ও প্রজ্ঞার অর্থও ভুলি। ভক্তি কথাটিরও কোনো অর্থ আর থাকে না। জগতে যদি ভক্তি না থাকে তাহলে বিষ রাখব কোথায়? জীবের বাঁচার উপায় কি হবে? জগৎ কি ছারে খারে যাবে?
এই কালের রাজনীতি সেই পরওয়ারদিগারের রাজনীতি যিনি জগতের ‘প্রভু’ হবার বাসনা করেন না, কিন্তু হতে চান প্রতিপালক। রাববুল আলামীন। তাকেই আমরা দয়ার দয়া নামে ডাকি। ভাবগত দিক থেকে ইসলামের গৌরবের দিক হচ্ছে আল্লাহকে 'প্রভু' হিসাবে গণ্য করবার ঐতিহাসিক ধারাকে এই ধর্ম অস্বীকার করে নি, কিন্তু তাঁর যে 'ইসম' বা নাম নেবার বিধান মোমিনদের জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে সেটা হচ্ছে, 'বিসমিল্লাহের রাহমানের রাহিম'। তাঁর যে গুণের এবাদত বা ভজনার নির্দেশনা সেটা তাঁর দয়ার দিক, প্রভুত্বের বা আধিপত্যের রূপ নয়। বাংলায় রাহমানুর রাহিম কথাটির ভারি সুন্দর অনুবাদ হচ্ছে : ‘দয়াল’।
সব কাজই সেই কারণে দয়ালের নামে শুরু করাই বাংলার সংস্কৃতি। হয়তো বাংলার বিধানও তাই।
‘দয়াল চাঁদ আসিয়ে আমায় পার করিবে
এমন সুভাগ্য আমার কবে হবে’…
... ... ... ...
[লেখাটি সাপ্তাহিক বুধবারে ছাপা হয়েছিল ২০১০ সালে এপ্রিল মাসের ১৫ তারিখে।সম্প্রতি অন লাইন পত্রিকা 'আমাদের বুধবার' লেখাটি আমার ছেপেছে]
লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)