- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
ইনসাফ আদায়ের লড়াই যখন ইনডিয়ার ‘নিরাপত্তার প্রতি হুমকি’
ভারতে মাওবাদের উত্থান : অরুন্ধতী রায়-এর পর্যবেক্ষণ। সম্পাদনা: আলফাজ আনাম, মেহেদী হাসান। সংবেদ প্রকাশনী। জুন ২০১০। ৮০ পৃষ্ঠা। ১০০ টাকা
ইনডিয়ার সরকার এবং গণমাধ্যমের ভাষায় মাওবাদীরা ‘সন্ত্রাসী’। অবশ্য ইনডিয়ার সরকারি স্বশস্ত্রবাহীনির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মাওবাদীদেরই শুধু না, প্রান্তিক ও গরিব মানুষের ওপর রাষ্ট্রের অন্যায়, জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের প্রতিবাদীকেই ‘সন্ত্রাসী’ বলছে ইনডিয়ার সরকার ও গণমাধ্যম। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চরিত্র আর গণমাধ্যমের চরিত্র একইরকম। ফলে, ইনডিয়া তার সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজে ‘সন্ত্রাস’ নির্মুলের ন্যায্যতা পাচ্ছে। এসব আদিবাসী এলাকায় বিমান হামলা চালানোর কথাও ইনডিয়ার সরকার ভাবছে বলে জানা গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে মানবাধীকার কর্মী ও লেখিকা অরুন্ধতী রায় মাস কয়েক চেষ্টা করে মাওবাদীদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং ওই অঞ্চলের সাধারণ জনগণের জীবন ও লড়াই দেখতে সেখানে যান। বনেবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে খুব কাছ থেকে তাদের বাঁচা-মরার লড়াই দেখেন। তারপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ শেষে তিনি লিখলেন ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস বা কমরেডদের সাথে পাহাড়ে জঙ্গলে। ইনডিয়ার আউটলুক ম্যাগাজিনে বিশ মার্চ অরুন্ধতী রায়ের এই লেখাটি ছাপা হয় ।
অরুন্ধতির একটা সাক্ষাৎকার সহ তার নিজের পর্যবেক্ষণমূলক লেখাটার সাথে কোটেশ্বরী রাওয়ের সাক্ষাৎকার, এবং নিউজ উইকে লেখা সলিল ত্রিপাঠির একটা লেখা নিয়া ‘ভারতে মাওবাদের উত্থান : অরুন্ধতী রায়ের পর্যবেক্ষণ’ বইটা তৈরি করা হয়েছে। কোটেশ্বরী রায় কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইনডিয়া (সিপিআই-মাওবাদী)’র পলিটব্যুরোর সদস্য। সলিল ত্রিপাঠি হলেন একজন ইনডিয়ান সাংবাদিক ও কলাম লেখক। বইটি সম্পাদনা করেছেন সাংবাদিক আলফাজ আনাম ও মেহেদী হাসান। আলফাজ আনাম ও আহমদ হাসান ইমরান ইনডিয়ার মাওবাদী আন্দোলনের সাথে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট মিলিয়ে লিখেছেন ‘ভারতের ভেতরে যুদ্ধ’ এবং ‘কেন মাওবাদী আন্দোলন’।
রেড করিডোর
পশ্চিমবঙ্গের লালগড় থেকে শুরু করে ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের পুরা অঞ্চলটা খনিজ সম্পদে ভরপুর। মার্বেল, তামা, সিলিকা, য়ুরেনিয়াম, লাইমস্টোন, খনিজ বক্সাইট, গ্রানাইট, টিন, ডলোমাইট, লৌহ আকরিক, কারান্ডামের মত ব্যাপক খনিজপদার্থ আছে এ অঞ্চলে। এসব খনিজ সম্পদ তুলতে ইনডিয়া সরকার এই অঞ্চলটা ইজারা দেয় বহুজাতিক কোম্পানির কাছে। অঞ্চলটিতে বহুজাতিক কোম্পানির অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য ইনডিয়ান ইউনিয়ন তার স্বশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ করে।
খনিজ উঠানোর জন্য তারা সে অঞ্চলের গরিব অধিবাসীদের তাদের জমিজমা ভিটেমাটি ছেড়ে সরে যাবার জন্য নানাভাবে তাদের ওপর চাপ তৈরি করছে। জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে তাদের। বসতিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া-হামলা-হত্যা-ধর্ষণ নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইনডিয়ার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পাহাড় ও জঙ্গলের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলাকে দিনের পর দিন এভাবে দমন নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন মাওবাদীরা এসব নির্যাতিত মানুষগুলার পাশে দাঁড়ানোতে দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে ধীরে। অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তাদেরকে সজাগ করে তুলছে। সচেতন করে তুলছে রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে। এভাবে এ নির্যাতিত ক্ষুদ্র জাতিগুলার সাথে মাওবাদীরা একাট্টা হলে, ইনডিয়ান ইউনিয়নের নিপীড়ক সরকার আর তার সহযোগী গণমাধ্যম এ অঞ্চলের নাম দেয় রেড করিডোর। কথাগুলা অরুন্ধতী রায়ের দোহাই দিয়ে আহমদ হাসন ইমরান ‘কেন মাওবাদী আন্দোলন’ লেখায় এভাবেই বলে গেছেন।
ঘরের লোক হয়েও দুশমন
আন্তর্জাতিক পুঁজির বিস্তারের সাথে তাল মিলিয়ে ইনডিয়া তার অর্থনৈতিক কৌশল এবং কায়কারবার গড়ে তুলছে। আবার একইসাথে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের নানামুখি পরিবর্তনগুলা সামনে রেখে ইনডিয়া তার রণকৌশলগত নীতি নির্ধারণ করছে। ফলে এই রাষ্ট্রটা একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরাইলের সাথে এক হয়ে আগাচ্ছে। অপরদিকে চীন সহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটা রাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত ভাবে বিরোধে জড়াচ্ছে। চীন হল তার প্রতিবেশী ও একই সাথে প্রতিযোগী। এর সাথে আছে পাকিস্তান। আশপাশে নেপাল, বাংলাদেশ, মায়ানমারের মত ছোট ছোট রাষ্ট্র আছে। একটা বড় রাষ্ট্র হিশাবে ইনডিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক তৎপরতার শক্তি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলাতে প্রভাব ফেলে।
তার ভেতরকার স্বাধীনতাকামী এবং অপরাপর সশস্ত্র সংগঠনগুলার শক্তি মোকাবেলার বিষয়টা সেজন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ইনডিয়া তার অখ- অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ হুমকিগুলা নিয়ন্ত্রণ করছে। আবার এবিষয়গুলা মাথা রেখে সে প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলার সাথে তার সম্পর্ক ও কৌশলও নির্ধারণ করে। কিন্তু ইনডিয়ার ভেতরের শক্তিগুলার উত্থান সে নিজেই ঘটাইছে তার নিজের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার দীর্ঘ চর্চার মারফতে। ক্রমাগত ভাবে সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গরিব ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলাকে দমন করে যাচ্ছে। তার এ ভেতরের হুমকি মোকাবেলার সবচে পরিস্কার নজির হল মাওবাদীদের বিরুদ্ধে চালিত দমন-পীড়ন। এ বিশাল রাষ্ট্রটির চব্বিশটা রাজ্যে মাওবাদী বিদ্রোহ চলছে। ইনডিয়ান সরকারের ভাষায় পাকিস্তান বা চীনের চেয়েও বড় শত্রু এই মাওবাদীরা।
আলফাজ আনাম ‘ঘরের ভিতরে যুদ্ধ’ লেখায় বলেন, ঘরের লোক হয়েও এখন ইনডিয়ার সবচেয়ে বড় দুশমন আদিবাসীরা। যারা সে আদিকাল থেকেই ইনডিয়ার পাহাড়ী ও বনাঞ্চলে বসবাস করে আসছে। তাদের বেঁেচ থাকার উপায়-উপকরণ এই পাহাড় ও বন থেকেই জোগাড় করে। কিন্তু ইনডিয়া সরকার এই আদিবাসীদের বসতভিটা থেকে তাড়িয়ে সেখান থেকে খনিজ সম্পদ তুলছে। বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ইজারা দিয়েছে। এভাবে রাষ্ট্র নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করছে। অস্ত্রের মুখে বসতভিটা থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। তারপর প্রতিবাদী হলে হত্যা, গুম করে ফেলা। ফলে বিদ্রোহ করছে জনগণ।
প্রাণ ও প্রকৃতি বাঁচানোর লড়াই
অরুন্ধতী রায় তাঁর এ লেখায় মাওবাদীদের স্বশস্ত্র গান্ধীবাদী হিশাবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের লড়াই যেমন-একদিকে জীবন-জীবিকা রক্ষার, অপরদিকে বন ও পরিবেশ রক্ষার। কিন্তু এ পরিবেশ রক্ষার লড়াই-ই ইনডিয়ার কাছে বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। মাওবাদী নিয়ন্ত্রণ আছে এমন এলাকায় ইনডিয়া প্রায় পঁচাত্তর হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। মাওবাদীদের ওপর হামলা করতে ইজরাইল থেকে লেজার রেঞ্জ ফাইন্ডার, থারমাল ইমেজিং ইকুইপমেন্ট, ড্রোন বিমান এনেছে ইনডিয়া। ইজরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইনডিয়ার ত্রিশজন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে কিভাবে মাওবাদী নেতাদের গুপ্ত হত্যা করতে হবে। যাতে নেতৃত্বশূণ্য হয়ে মাওবাদ আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। এতসব করেও এই প্রকৃতির সন্তানদের প্রাণ-প্রকৃতি বাঁচানোর লড়াই থামাতে পারে নাই ইনডিয়া। ইনডিয়ার পত্রিকাগুলা এখন খবর ছাপে, নকশাল এলাকায় বন জঙ্গলের পরিমাণ ও সীমানা বেড়ে গেছে।
উন্নয়নের নামে জমিদখল
ইনডিয়ার সুশীল সমাজ-মন্ত্রী-আমলারা বলে বেড়াচ্ছেন, গণতান্ত্রিক ভোটের মাধ্যমে নিজেদের দাবি-দাওয়া জানাতে পারে মাওবাদীরা। কিন্তু অর্থ, গণমাধ্যম ও রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক কাঠামো এবং পেশীশক্তির রাজনীতির জগতে তাদের ক্ষমতায়ন আসলে কি সম্ভব? সেটা ওই গরিব ক্ষুদ্র জাতিগুলা ভালোভাবেই জানে। যেখানে জোর করে বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে তাদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়ানো হল, সেখানে এই গণতান্ত্রিক পোশাকি কথাবার্তার কোন অর্থ নাই।
অরুন্ধতী রায়ের ভাষায়, ১৯৫০ সালে ইনডিয়ার সংবিধান পাশ হল। সংবিধানের ছুতায় আদিবাসীদের বাসস্থান, আবাসভূমি নিয়ে নিল রাষ্ট্র। পাহাড়-বন-জঙ্গলের ওপর থেকে তাদের অধিকার চলে গেল রাষ্ট্রের হাতে। আদিবাসীরা হয়ে গেল নিজভূমিতে পরবাসী। নিছক ভোটাধিকারের বিনিময়ে তাদের জীবন-জীবিকার উপায়, মর্যাদা কেড়ে নিল। বাঁধ নির্মাণ, সেচ প্রকল্প, খনিজ সম্পদ তোলার কথা বলে তাদের ঘরবাড়ি ছাড়া করল। ইনডিয়ার এই অঞ্চলটির তিন কোটিরও বেশি মানুষ এখন ভিটেমাটি ভূমি হারা। এরা সবাই ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। এসবের বিপরীতে বলা হল তাদেরকে ইনডিয়ার মূল ধারায় মানে, আধুনিক জীবন-যাপনের ভেতরে নিয়ে আসা হবে। ফলে ইনডিয়ান ইউনিয়ন যখনই উন্নয়নের কথা বলে, তখনই এই নিপীড়িত ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীর লোকেরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে, উন্নয়ন মানে হলো ভিটে মাটি ছাড়া হওয়া।
মাওবাদীদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা
মাওবাদীরা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে ‘জনতা সরকার’ নামে একটা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। তারা এ প্রশাসনিক ব্যবস্থার মূলনীতি নিয়েছে চীনা বিপ্লব ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে। যে সব অঞ্চলে পাঁচশ থেকে পাঁচ হাজার লোক বাস করে, এরকম এলাকাগুলোতে জনতা সরকারের একটা করে প্রশাসনিক ইউনিট আছে। এদের নেতা নির্বাচিত হয় এইসব এলাকার জনগণের ভোটে। প্রতিটা ইউনিটের আবার নয়টা বিভাগ আছে। তা হল--কৃষি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিচার, প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বনবিভাগ। কয়েকটা এলাকার জনতা সরকার নিয়ে একটা আঞ্চলিক পরিষদ আছে। তিনটা আঞ্চলিক পরিষদ নিয়া গঠিত একটা বিভাগ। চীনা বিপ্লবীদের মত তারা সফল হলে তাদের রাষ্ট্র কাঠামো কেমন হবে, তা বোঝা যায় অনেকটা এ প্রশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে।
শুদ্ধি অভিযান: উচ্ছেদেই মুক্তি!
দুই হাজার পাঁচ সালে সালওয়া জুদুম বা শুদ্ধি অভিযান বাহিনী গঠন করে মাহেন্দ্র কর্মা গ্রামের প্রভাবশালীরা। বহুজাতিক কোম্পানি কোন এলাকায় খনিজ সম্পদ উঠাতে ইজারা বা কারখানা স্থাপন করলে এ বাহিনী ওই আদিবাসীদের সরিয়ে রাস্তার ধারে ক্যাম্পে নিয়ে আসত। এটা একটা কৌশল ছিল ইনডিয়ান প্রভাবশালীদের। ক্যাম্পে থাকলে আদিবাসীরা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বনের ভেতরের জমিও ফাঁকা থাকবে। মাওবাদীদের সাথে যোগ দিয়ে তারা আন্দোলনও করতে পারবে না। কোন গ্রামের লোকজন ক্যাম্পে আসতে না চাইলে শুদ্ধি অভিযান বাহিনী সে গ্রাম পুড়িয়ে ফেলত। কোন কোন গ্রাম তারা আট-নয় বারও পুড়িয়ে দিয়েছে। মজার ব্যপার হল, ইনডিয়ার গণমাধ্যম এসব ঘটনা কখনো প্রকাশ করে নাই। কিন্তু মাওবাদীরা যখন ইরাবোরে সালওয়া জুদুম ক্যাম্পে হামলা করে বিশ জনকে মেরে ফেলে পত্রিকাগুলা তখন একটা বানোয়াট খবর ছাপল--নকশাল হামলা থেকে বাঁচতে গ্রামবাসী সরকারি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু মাওবাদীরা সে ক্যাম্পে হামলা করে বিশ জন মেরে ফেলেছে ও দেড়শ জনকে আহত করেছে।
মাওবাদী আন্দোলনে বাংলাদেশকে জড়ানো
মাওবাদী আন্দোলন এখন ইনডিয়ার পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্রজাতিসত্তাগুলার আন্দোলন। ইনডিয়ার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রায়ই মাওবাদীদের হামলায় হেস্তনেস্ত হচ্ছে। প্রশ্ন হল, তারা অস্ত্র আনে কোথা থেকে? ইনডিয়া সরকার ধারণা করছে, মাওবাদী বিদ্রোহীরা অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ থেকে। এই বইয়ের সম্পাদকদ্বয় মনে করেন, আগামীতে ইনডিয়ার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা বিবেচনার বিষয় হিশাবে আসবে। গেল বছরের নভেম্বর থেকে মাওবাদ দমনে ইনডিয়া সবুজ শিকার অভিযান (গ্রিন হান্ট অপারেশন) শুরু করেছে। তবে ইনডিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ গণমাধ্যমের বানানো জিনিস। অথচ এ বিশেষ অভিযানে ইনডিয়ার আধাসামরিক বাহিনীর প্রায় পাঁচ হাজারের মত সদস্য নিয়োজিত। রাষ্ট্রের বৈষম্যের শিকার ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আন্দোলন আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী দিয়ে দমন--আঞ্চলিক রাজনীতিতে কতটা খারাপ প্রভাব পড়বে, তাও বিবেচনার বিষয়।
‘ভারতে মাওবাদের উত্থান : অরুন্ধতী রায়-এর পর্যবেক্ষণ’ বইটা ইনডিয়ার আদিবাসীদের একটা প্রামাণ্য প্রতিবেদন দিয়েছে পাঠককে। কিন্তু বাংলাদেশ যে ইনডিয়ার থেকে আলাদা কিছু করে নাই, তার বড় প্রমাণ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ীদের রাষ্ট্রের স্বাভাবিক নাগরিকত্ব এবং বিশেষত তাদের ভূমি ব্যবস্থার সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দেয়া। বছরের পর বছর বাংলাদেশ রাষ্ট্র পাহাড়ীদের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে একটা সংঘাত তৈরি করে রাখছে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিকীকরণের প্রক্রিয়া এখনো সেখানে জারি রয়েছে। আমরা যদি এসব থেকে কিছু শিখি। বইটা এসব নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)