আতাউর রহমান রাইহান


Thursday 01 July 10

print

বাংলাদেশের জাতীয় সাহিত্যের নতুন জীবন

আহমদ ছফার লেখালেখি বিষয়ে সলিমুল্লাহ খান প্রথমবারের মতো নিজের মত-অমত লিখে জানান দেন আজ থেকে তেত্রিশ বছরেরও কিছুকাল আগে। বাংলা একাডেমীর উত্তরাধিকার পত্রিকার ১৯৭৭ সালের মার্চ-এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত সেই লেখায় ছফার ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’ কবিতাটির রিভিউ লিখেছিলেন তিনি, আজকের সলিম খানের ভাষায় যাকে বলতে হয়ে কবিতার ‘পুনর্দৃষ্টি’। সেইখানে ছফাকে তিনি দেখেছিলেন ‘স্বদেশ ও স্বজাতি’র বন্দনাকরনেওয়ালা এক কবি-লেখক হিশাবে। তারপর তেত্রিশ বছর কাটলো--ইতিমধ্যে সলিম খান পুনরায়, বারবার এবং ফিরে ফিরে ছফার লেখালেখিতে দৃষ্টি দিয়েছেন। সেসব একত্রে এবারের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে ‘আহমদ ছফা সঞ্জীবনী: জাতীয় সাহিত্য-১’ কিতাবে। ছফা প্রসঙ্গে খান সাহেবের প্রায়সবগুলা লেখার সুসম্পাদিত সংকলন।

এ জাতি সে জাতি না

তেত্রিশ বছর পরে এসে সলিমুল্লাহ পুনর্দৃষ্টি দিচ্ছেন ছফার জীবন ও সৃষ্টিতে--‘স্বদেশ ও স্বজাতি’ বিষয়ে তো বটেই, একই সাথে বাংলাদেশের ‘জাতীয় সাহিত্য’ প্রশ্নে ছফার স্বতন্ত্র ও অনন্য অবস্থানের কথা জানাচ্ছেন তিনি। ছফা’র মতো তিনিও ফ্রাঞ্জ ফানো’র ‘জাতি’ বিষয়ক নয়া-আলাপে একমত; ‘জাতীয় পরিচয় বা সংজ্ঞা আর জাতীয়তাবাদ এক কথা নহে’। ছফা যে ‘স্বজাতি’কে কেন্দ্র করে তার চিন্তা বিস্তারিত করেছিলেন তার মূল সুর হল, লেখকের ভাষায়; ‘জাতীয় মর্যাদা দরকার। তাহা আমাদের সারা দুনিয়ার নিপীড়িত জাতির সহিত এক কাতারে দাঁড় করাইবে। এই পথ মিলনের। আর তথাকথিত জাতীয়তাবাদ আমাদের আলাদা করিবে।’ (নামে আসে নামে যায় : সঞ্জীবনী)।

ছফা জাতীয়তাবাদী হন নাই। সলিমুল্লাহর দৃষ্টিতে ছফা’ই হচ্ছেন একমাত্র লেখক যিনি একাত্তরের যুদ্ধকে বিপ্লব জ্ঞান করতেন, যে বিপ্লবে বাংলাদেশের মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কায়েম করে। যে বিপ্লব বৃহত্তর ভারতের কেন্দ্রীয় শাসকদের অধীন বহু জাতিকে তো বটেই, সারা দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষকে পথ দেখায়। আত্মপরিচয় তালাশ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাক্সক্ষায় ছফা জাতি হিশাবে বাংলাদেশের মানুষের কর্তব্য-কর্মের ছক তৈরি করেছেন। ফলে সলিমুল্লাহর বিচারে আহমদ ছফা হচ্ছেন বাংলাদেশের জাতীয় সাহিত্যের পথ প্রদর্শক। সাতাত্তর সালের ওই রিভিউটির শিরোনাম হিশাবে কবিতার নামের পরে কবির নাম যোগ করে কাজ সেরেছিলেন লেখক, আর এই গত বছরে রিভিউটি নতুন নাম পেল লেখকের তরফে--‘জাতীয় সাহিত্য ১৯৭১’; ‘আহমদ ছফা সঞ্জীবনী’র সবশেষে জায়গা পেয়েছে প্রবন্ধ আকারে।

দুই ধরনের খেলার বাইরে

সাতাত্তর সালে ছফা’র না-শিক্ষক না-বন্ধু না-চেলা সলিম খানের সমালোচক দৃষ্টিতে আবিস্কৃত হতে শুরু করেছেন ছফা--সেই আবিস্কারের নগদ দলিল হচ্ছে ‘আহমদ ছফা সঞ্জীবনী’। লেখক মনে করেন ‘ভাষার জগতে যাঁরা মহান মানুষ’ তাদের প্রতি সাধারণত যেই দুই ধরনের আচরণ করে মানুষ--হয় তাদের দেবতা বানিয়ে সমালোচনা-পর্যালোচনার ঊর্ধ্বে তুলে রাখা হয়, নয় ত তাকে যেনতেনভাবে নাকচ করা-- এ দুয়ের কোনোটিই আহমদ ছফাকে নিয়ে হয় নাই। সলিম লিখছেন, ‘আমরা তাঁকে ভগবানও বানাই নাই, হত্যাও করি নাই। আমরা তাঁর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেছি। শিক্ষকের বেশে, বন্ধুর পরিচয়ে আমরা তাঁর স্মৃতিকথা প্রকাশের অপেক্ষায় আছি।’ (আমাদের কালের নায়ক: সঞ্জীবনী)। লেখকের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ‘বিশেষ ধরনের লেখক’ আখ্যা দিয়ে আহমদ ছফাকে দূরে ঠেলে রাখা হয়েছে। ছফাকে নিয়ে দুই ধরনের খেলার বাইরে নিরেট বিচার করতে বসেছেন সলিমুল্লাহ খান। যে বিচারে লেখকের মতে ‘ছফার লেখার বিজ্ঞাপন লেখা আমার উদ্দেশ্য হতে পারে কিন্তু বিধেয় ছিল না।’

একুশটি মাটির ঢেলা

লেখকের প্রশ্ন; ছফাকে যারা বিশেষ এক প্রকারের লেখকের আখ্যা দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন, দূরে ঠেলে দিয়েছেন, ভবিষ্যৎ তাদের কি একেবারে মাফ করবে? হয়ত মাফ করবে, তাতে কারও হাত নাই। কারণ, শয়তানের বিচারভার মানুষ নেবে কেন, খোদার এখতিয়ার। লেখক বললেন, শয়তানের সাম্রাজ্য লক্ষ্য করে একুশটি মাটির ঢিল ছুঁড়লাম মাত্র। সংকলনটিতে প্রকাশিত মোট একুশটি লেখাকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করে বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রথমেই মাধ্যমিকা অংশে সম্পাদক বইটি নিয়ে কথা বলেছেন। তারপর আছে লেখকের প্রার্থনা এবং এরপর আছে ভাজক, ভাজ্য, ভাগফল ও ভাগশেষ, সর্বশেষ সংবর্ধনা। বইটির ‘সংবর্ধনা’ অংশে ছফার দুইটি দুষ্প্রাপ্য লেখা দেয়া হয়েছে। আহমদ ছফা রচনাবলীতে এখনো যার জায়গা হয় নাই। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান।

‘প্রার্থনা’য় লেখক পুরা বইটির সংক্ষিপ্তসার করেছেন। আহমদ ছফার সাথে যে লেখকের বেশ অনেক বিষয়েই মতপার্থক্যও ছিল, সে কথাও গোপন রাখেন নাই। যেমন আহমদ ছফা’র অনেক মতের বিষয়ে লেখক বলছেন, রবীন্দ্রনাথকে ছফা কোনো কোনো জায়গায় বঙ্কিম থেকে আলাদা করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, বঙ্কিমের বিকল্প হিশাবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। লেখক সেখানে দুজনকে একই নৌকার সহযাত্রী ছাড়া অন্য কিছু মনে করেন নাই। লেখাগুলাতে সাহিত্যিক ভারভারিক্যি বা অধ্যাপক সুলভ জারিজুরি নাই। আহমদ ছফার সময় থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ের সূত্র ধরে লেখক লেখাগুলা শুরু করেছেন। ফলে পাঠকের সামনে আর অপরিচয়ের বাধা রইল না। যেমন আহমদ ছফার ‘ছফা’ বানানের সূত্র ধরে লেখক শুরু করেছেন “নামে আসে নামে যায়” লেখাটি। সাহিত্য সুলভ ‘নামে আসে নামে যায়’ মূলত নুরুল আনোয়ারের লেখা ছফা জীবনীগ্রন্থের ভূমিকা ছিল। সলিমুল্লাহ খানের বয়স যখন আঠারো তখন আহমদ ছফার সাথে তার পরিচয়। সলিম স্বীকার করেছেন ছফার নাম তাকে অনেক আকৃষ্ট করেছে। সেই নাম, যে নামের বানান ‘ছফা’ রবীন্দ্রনাথ-সুনীতিকুমার-রামমোহনের ব্যাকরণের বিচারে অশুদ্ধ। ছফার জীবন ও চিন্তা থেকে সলিমুল্লাহ দেখিয়েছেন ‘আহমদ ছফার নামের ইতিহাস বাঙালী মুসলমানের আত্মসংজ্ঞার ইতিহাস বৈ নহে।’ আত্মসংজ্ঞার যে লড়াই শেষ হয় নাই, না সাতচল্লিশে না একাত্তরে।

জাতীয় সাহিত্যের প্রাণ

বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যকে, স্রেফ বাংলা সাহিত্য বা বাঙালী সাহিত্যের স্তর উত্তীর্ণ করে বাংলাদেশের ‘জাতীয় সাহিত্য’ বলে একটা জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন আহমদ ছফা-- এটা প্রমাণ করছেন লেখক। লেখকের দাবি; আহমদ ছফা জাতীয় সাহিত্য হতে আগমন করেছেন এবং ফিরেও গেছেন সে দিকে। তাই, এখন যদি তাকে জাতীয় সাহিত্য থেকে আলাদা করার শত চেষ্টা করা হয়, তা পারা যাবে না। লেখক বলছেন, ১৯৭১ সালের অভিজ্ঞতা এই জাতীয় সাহিত্যের সংজ্ঞাকে একটু বিশদ করেছে বৈ কি। তবে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কিংবা স্বয়ং রবি ঠাকুর জাতীয় সাহিত্য বলতে যা বুূঝতেন এবং বোঝাতে চেষ্টা করতেন, এখানে ঠিক সেরকম কোনো জাতীয় সাহিত্য বুঝানো হবে না। এখানে একটু অতিরিক্ত আছে, তা হল, ১৯৭১। ভাষা বলতে যেমন এখানে কেবল বাংলার কথা বলা হয় নাই, তেমনি সাহিত্য বলতে নেহাত বাংলা সাহিত্য বুঝানো হয় নাই। ভাষা বলতে যেমন তার গণমানুষের ভাষা তেমনি সাহিত্য বলতে বুঝানো হয়েছে স্বদেশ-বিদেশ নির্বিশেষে জনসাধারণের সাহিত্য। কাদা মাখা ভাষায় যেটাকে বলা হয় নিছক ছোটলোকের সাহিত্য।

শেষে এসে মনে হচ্ছে বইটি সর্ম্পকে লেখকের নিজের বিশদ বক্তব্যের একটা অংশ তুলে দিলে পাঠকের সুবিধা হবে। ‘প্রার্থনা’য় লেখক বলছেন ‘‘১৯৭১ সনের যুদ্ধকে কেহ বলেন ‘মুক্তিযুদ্ধ’ কেহ বা ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’। কেহ ইহাকে ‘বিপ্লব’ বলিয়া বিড়ম্বিত করেন না। আহমদ ছফা এই যুদ্ধকে মধ্যে মধ্যে বিপ্লব বলিয়া ভ্রম করিতেন। এইটুকুই হয়তো অতিরিক্ত। বাংলার জাতীয় সাহিত্য বলতে তাই আমরা উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম উর্ধ্ব অধঃ ছয় বাংলা মাত্র দেখি না। কিংবা বুঝি না শুদ্ধ বৌদ্ধ খ্রিস্টান কি হিন্দু মুসলমান পুরাণ। আমাদের জাতীয় সাহিত্য ইহাদের যোগফলের সামান্য অধিক। এই অধিকই আহমদ ছফার মধ্যে বিশেষ হইয়াছে। যে পুস্তক পাঠ করিলে ইহা বুঝিতে পারা যায় তাহার নাম আহমদ ছফা সঞ্জীবনী।’’

পাঠের পর আমাদেরও তা-ই মনে হয়। বাংলাদেশের জাতীয় সাহিত্য কিভাবে গড়ে উঠলো এবং ছফা কিভাবে তার ভিত্তি গড়ে অনেকদূর এগিয়ে নিলেন; এই ‘পুস্তক পাঠ করিলে ইহা বুঝিতে পারা যায়’। কাজেই সঞ্জীবনী পাঠের পক্ষে জোর সুপারিশ করছি প্রিয় পাঠক, পাঠিকা সকল!

আহমদ ছফা সঞ্জীবনী। সলিমুল্লাহ খান

আগামী প্রকাশনী এবং এশীয় শিল্প সাংস্কৃতিক সভা, ঢাকা। ফেব্রুয়ারি ২০১০

৩৮৩ পৃষ্ঠা । ৪৫০ টাকা


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)

Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 9403 Leave comments (0) Bookmark and Share


Go Back To Arts & Culture
EMAIL
PASSWORD