জোনায়েদ ইকবাল ও আনোয়ার হোসেন ফরহাদ


Wednesday 11 March 15

print

বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে জানলেও নদীর গুরুত্ব আমরা আলাদা করে উপলব্ধি করি না। অনেকটা বাতাসের মধ্যে থেকেও বাতাসের অস্তিত্ব সম্পর্কে অসচেতন থাকার মতই। ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় এক হাজারেরও বেশি নদী বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে অনেকটা বাতাসের মত। প্রাণ প্রকৃতি রক্ষার দিক থেকে তো বটেই অর্থনৈতিক দিক থেকেও এসব নদীর গুরুত্ব ব্যাপক। কিছু পরিসংখ্যানের সাহায্যে নদী কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে তুলে ধরা যায়। কেবল নদী থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে মৎস্য আহরিত হয় প্রতি হেক্টরে ১৭২ কেজি। সেচ ব্যবস্থাও অনেকাংশে নদীর উপর নির্ভরশীল। শুধু গোদবাড়ী উপজেলায় পদ্মা নদী থেকে পানি উত্তোলন করে দুই হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হয়। আর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপিতে নদী পরিবহন খাতে অবদান ০.৬৩ শতাংশ যা টাকার অংকে ৮০৬৬৩ মিলিয়ন টাকা। তাছাড়া নদী নিজ শরীরে দুষিত ময়লা আবর্জনা বহন করে আমাদের নগর গুলোকে পরিষ্কার রাখতেও সহায়তা করে, যেটার অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণ করা অনেক কঠিন।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছাড়াও আমাদের জীবন যাপন থেকে শুরু করে শিল্প সংস্কৃতিতে নদীর প্রভাব ব্যাপক। কৃত্তিবাস থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রায় সব উল্লেখযোগ্য কবি সাহিত্যিকই নদী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এমন কি চর্যাপদেও পদ্মা নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়।

এই দেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই সব অসংখ্য নদীর মধ্যে গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা অন্যতম। হাজার হাজার বছর ধরে গঙ্গা বাহিত পলি-কাদা দ্বারা এ দেশের বিস্তৃত শ্যামল ভূমি তার উর্বরতা বৃদ্ধি করে চলেছে। গঙ্গা-পদ্মা নিয়ে বিভিন্ন সময় পত্র পত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও পূর্ণাঙ্গ বই তেমন রচিত হয় নি। ‘গঙ্গা পদ্মা পদ্মাবতী’ গঙ্গা পদ্মা নিয়ে এক মলাটের মধ্যে ‘সম্পূর্ণ’ কাজ। যেটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিব বলে ভূমিকাতে নদীর গুরুত্ব নিয়ে এত কথা খরচ করেছি।

মাহবুব সিদ্দিকী জন্মসূত্রে ছেলেবেলা থেকেই পদ্মাকে পেয়েছেন নিবিড়ভাবে। এরপর পুলিশ বিভাগে চাকরীর সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। ছেলেবেলার পদ্মাকে তখন দেখেছেন গবেষকের চোখ দিয়ে। নিজের গবেষণার চোখ দিয়ে দেখা গঙ্গা-পদ্মাকে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন ‘গঙ্গা পদ্মা পদ্মাবতী’ বইয়ে। গঙ্গা-পদ্মার উৎস ও গতিপথ, এর ইতিহাস ও পুরাণ, এর তীরে গড়ে উঠা নগর-বন্দর ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে তিনশ পৃষ্ঠার অধিক এই বইতে। বইয়ের পনেরটি অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে হাজির করা তথ্য গুলোর মধ্যে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়া বিষয় গুলোকে নিচের কয়েকটি ভাগে পেশ করছি।

গঙ্গা না পদ্মা?

গঙ্গা ও পদ্মা একই নদী। গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে প্রবেশের পর গঙ্গা সাধারণভাবে পদ্মা নামে পরিচিত। কেন? পদ্মা নামের উৎপত্তি কোথা থেকে? সাধারণ পাঠকের মনে এ প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। লেখক মাহবুব সিদ্দিকী বইয়ের প্রথম অধ্যায়েই এ বিষয়ে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সাধারণভাবে এটাকে পদ্মা নামে অভিহিত করা হলেও সরকারিভাবে অথবা ভূগোলবিদ বা ইতিহাসবেত্তাগণের কাছে এটা গঙ্গা নামেই বিবেচিত। লেখক জানাচ্ছেন, “সরকারি নথি, দলিল, মানচিত্র এসবকিছুর ভিত্তিতে এই তথ্যটিই সঠিক। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ভাটিতে অবস্থিত গঙ্গা/কপোতাক্ষ প্রজেক্ট এই সত্যতার সাক্ষ্য বহন করছে।” তাহলে একে পদ্মা বলা হয় কখন থেকে? কেনই বা বলা হয়? লেখকে দাবি, “প্রথম পদ্মা বা পদ্মাবতী নামটি এসেছে শ্রীচৈতন্য কর্তৃক পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ শেষে রাজশাহীর প্রেমতলী(প্রেমস্থলী)নামক স্থানে এসে পদ্মায় স্নান করার মধ্য দিয়ে।” শ্রীচৈতন্যের স্নান করার সাথে পদ্মা নামের কি সম্পর্ক আছে? এর সাথে কি বাংলার ভাবের কোন যোগসূত্র আছে? এ ব্যাপারে লেখক আর কিছুই আমাদের জানান নি। শুধু বলছেন, “যদিও এই ঘটনার সপক্ষে তেমন কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই।” হয়ত লেখক এ বিষয়টা নিয়ে পরবর্তীতে আরও গবেষণা করবেন। তারপর পদ্মা নামের উল্লেখ প্রথম কোথায় কোথায় পাওয়া তার একটা আলোচনা করেছেন এই প্রথম অধ্যায়ে।

প্রবাহ পথ

লেখক গঙ্গা-পদ্মার প্রবাহ পথ আলোচনা করার জন্য আলাদা একটি অধ্যায়ই রেখেছেন। তবে এর বাইরেও আরও কয়েকটি অধ্যায়েও গঙ্গা-পদ্মা প্রবাহের আলোচনা করেছেন। যেখানে পদ্মার উপনদী, শাখা প্রশাখা, মৃত নদী গুলো বর্ণনা রয়েছে। লেখক কত বিস্তৃতভাবে গঙ্গার প্রবাহ পথের বর্ণনা দিয়েছেন একটি উদাহরণ দিলে পাঠক সহজে বুঝতে পারবেন, যেমন গঙ্গার একটি শাখা ‘ভাগীরথী’, ভাগীরথীর একটি উপনদী ‘দামোদর’, লেখক প্রত্যেকটির প্রবাহের আলাদা আলাদা বর্ণনা তুলে ধরেছেন। গঙ্গা-পদ্মার শাখা প্রশাখা আলোচনা হয়েছে নবম অধ্যায়ে, যেখানে মোট ছত্রিশটি নদীর প্রবাহের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। লেখক বর্তমানে সজীব নদীর প্রবাহ পথের পাশাপাশি ‘সরস্বতী’, ‘মির্জা মহামুদ’ এর মত মৃত নদীগুলোরও বর্ণনা দিয়েছেন। এই সব নদীর প্রবাহ পথ উদ্ধারের ক্ষেত্রে লেখক কোন সময় পুরানো মানচিত্র বা বই এর আশ্রয় নেন। কোন সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ সাথে নিয়ে নিজে সরেজমিনে গিয়ে হাজির হন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে পদ্মার মৃত শাখা নদী নিয়ে ‘ফিরিয়ে দাও সেই প্রবাহ’ নামে লেখকের আলাদা একটি বই আছে। পদ্মার বর্তমান প্রবাহের সাথে প্রাচীন প্রবাহ পথেরও তুলনা রয়েছে, যেমন খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে বিহারের ‘আরা’ শহরের পাশ দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত হত, বর্তমানে ‘আরা’ থেকে ২০ কিলোমিটারের আধিক্য দূর দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত হচ্ছে।

লেখক সরেজমিনে গিয়ে গঙ্গা-পদ্মার এসব প্রবাহ পথ নির্ণয় করেছেন। গঙ্গা-পদ্মা সহ উপ ও শাখা নদীগুলো কখনো ডানে, কখনো বামে, কোথাও রাস্তার পাশ দিয়ে, কোথাও গ্রামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার এমন পুংকনাপুঙ্ক বর্ণনা লেখক দিয়েছেন যে, পাঠক ইচ্ছে করলে সে বর্ণনা অনুসরণ করে নদী পথের একটা মানচিত্র এঁকে ফেলতে পারবেন।

padma

নদী কেন্দ্রিক জনজীবনের অতীত-বর্তমান

গঙ্গা-পদ্মা মানে শুধু গতিপথ নয়; ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, এর তীরে গড়ে নগর-বন্দর ও এ অববাহিকায় বাস করা মানুষের জীবন, ভাষা, সাহিত্য, আচার-সংস্কৃতি সব মিলিয়েই হল গঙ্গা-পদ্মা। লেখক মাহবুব সিদ্দীকী গঙ্গা-পদ্মার এই সামগ্রিক চিত্র পাঠকের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এখানেই এই বইয়ের বিশেষত্ব। যেমন বাংলাদেশের প্রথম রেলপথ চালু হওয়ার ইতিহাসের সাথেও গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকা জড়িত। ১৮৬২ সালের ১৬ নভেম্বর কলকাতা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে তদানীন্তন বাংলাদেশ প্রথম রেল যুগে প্রবেশ করে। “তখনকার কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গার তীর দিয়ে রেল যোগাযোগ স্থাপন করে পদ্মার পূর্বদিকে অবস্থিত পূর্ববাংলার অন্য জেলাগুলোর সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন করা। এরই ধারাবাহিকতায় গঙ্গার প্রধান শাখা গড়াই নদীর ওপর(কুমারখালি থানা) এবং পাংশা থানার অন্তর্গত চন্দনা নদীর ওপর মোট দুটি বড় আকারের রেলওয়ে ব্রিজ নির্মিত হল ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে।’’ পরিকল্পনা ছিল গঙ্গার প্রবাহের অববাহিকা দিয়ে রেলপথ বসিয়ে ঢাকা অবধি অগ্রসর হওয়ার। যদিও গঙ্গার বিশালত্ব এবং ঘন ঘন খাত পরিবর্তন সহ প্রবল বন্যার কথা বিবেচনা করে এই পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়। গঙ্গা-পদ্মা সংশ্লিষ্ট এরকম বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা ও ব্যক্তির বর্ণনা পাঠক পুরো বইয়ের বিভিন্ন অংশে খুঁজে পাবেন। এছাড়া বাংলার বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম প্রতাপাদিত্যের উপর আলাদা একটি অধ্যায়ও যুক্ত করা হয়েছে।

গঙ্গা-পদ্মার বয়ে চলা হাজার বছরের। এই দীর্ঘ সময়ে ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার তীরে বিভিন্ন নগর-বন্দর গড়ে উঠেছে। গঙ্গা-পদ্মা তীরবর্তী প্রাচীন নগর-বন্দর অধ্যায়ে গঙ্গা-পদ্মার তীরে বিভিন্ন সময়ের গড়ে উঠা চৌদ্দটি নগর-বন্দরের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন। এ অধ্যায়ে পাঠক বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ শহর যেমন হরিদ্বার, এলাহাবাদ, কাশী, পাটনা, গৌড়, নদীয়া প্রভৃতি শহরের গড়ে উঠার কারণ, ইতিহাস, এর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গুরুত্ব, এসব শহরে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারনা লাভ করতে পারবেন।

কীর্তিনাশা?

পদ্মাকে কীর্তিনাশা নামেও ডাকা হয়। পদ্মার এই কীর্তিনাশা খেতাব পাওয়ার কারণ কি? কার কীর্তি নাশের কারণে পদ্মার এই খেতাব? কখন থেকে পদ্মার কপালে এই খেতাব জুটল? কিংবা পদ্মা কি আসলেই কীর্তিনাশা? পদ্মার এই কীর্তিনাশা খেতাবের পিছনে জড়িয়া আছে কয়েকটি নাম-চাঁদ রায়, কেদার রায় ও রাজা রাজবল্লভ। বাংলার বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের রাজধানী ছিল বিক্রমপুর পরগনার মাঝে শ্রীপুর নামক প্রাচীন নগরীতে। “এখানে ছিল সুন্দর ও সুবিশাল কারুকার্যখচিত প্রাসাদ, সেনানিবাস, বিচারালয়, কারাগার, কোষাগার।” ১৭৮৭ সালের আগস্ট মাসে হিমালয়ের হিমবাহ মাত্রাতিরিক্ত গলে গিয়ে হঠাৎ করেই তিস্তায় প্রবল বন্যার সৃষ্টি করে। এ প্রবল জলরাশি তার বালি, কাদা, পলি নিয়ে ময়মনসিংগামী ব্রক্ষপুত্রের মুখ অনেকটা বন্ধ করে দেয়। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র মিলিত হয়ে গঙ্গার সাথে মিশে পদ্মার নামে মহাপ্লাবন আকারে হঠাৎ করে কালিগঙ্গার প্রবাহ পথ বেছে নেয়। কালীগঙ্গা হচ্ছে চাঁদ রায় ও কেদার রায় প্রতিষ্ঠিত শ্রীপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী। ১৭৮৭ সালের এই প্রবল বন্যায় সাজানো গোছানো শ্রীপুর মুহূর্তেই তছনছ হয়ে যায়। শ্রীপুর গ্রাস করে পদ্মা এগিয়ে যায় রাজবল্লভের সুশোভিত রাজনগরের দিকে। রাজবল্লভ বাংলার ইতিহাসে খলনায়কদের অন্যতম যিনি পলাশীর যুদ্ধে ক্লাইভের পক্ষে নিয়েছিলেন। রাজবল্লভ নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা পাঠক এখানে পাবেন। সেই রাজবল্লভের রাজনগরেরও শ্রীপুরের মত পদ্মা তার পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এভাবে পদ্মা চাঁদ রায়, কেদার রায় ও রাজবল্লভের কীর্তি নাশ করে কীর্তিনাশা নাম ধারণ করে।

কথায় আছে নদীর এপার ভাঙ্গে তো ঐপার গড়ে। পদ্মা কেদার রায়-রাজবল্লভের কীর্তি নাশ করলেও দেখা গেল বন্যার প্লাবনে বয়ে আনা কাদা পলির আস্তরণে নিচু ভূমি অনেকটাই উঁচু হয়ে গেছে। নতুনভাবে পাওয়া এই ভূমি হচ্ছে বাংলার স্বর্ণভান্ডার এবং ঐশ্বর্যের খনি। “আজকের ফরিদপুরসহ দক্ষিণ বিক্রমপুর এবং চন্দদ্বীপ গঠিত হয়েছে প্রধানত পদ্মা ও এর শাখা-প্রশাখার বয়ে আনা পলি, কাদা ও বালু দিয়ে।” এ সংক্রান্ত আরও বিস্তারিত জানা যাবে ‘কীর্তিনাশা চন্দ্রদ্বীপ-রাজবল্লভ’ অধ্যায়ে।

তার মানে দেখা যাচ্ছে পদ্মা সহ সকল নদীই শুধু ভাঙ্গে না গড়েও। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমাদের নদীর ‘কৃত্তি নাশ’ কেন কেবল চোখে পড়ে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের প্রকৃতি চিন্তার মধ্যে। মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ককে আমার কিভাবে মূল্যায়ন করি তার মধ্যে। এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য তুলিনি, যা এখানে সম্ভবও না। তবে এই অধ্যায়টি প্রছন্নভাবে আমাদেরকে এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি করে দেয়।

ফারাক্কা প্রসঙ্গ

“১৯৭২-৭৩ সালে রাজশাহী শহরে নলকূপের পানি পেতে এক চাপের অধিক দুই চাপ দিতে হত না। আমার অনুজ শামীম ১৯৮৪ সালে বাড়ির নলকূপে চাপ দিতে গিয়ে কয় একবার চাপ দিয়েও যখন পানির দেখা পেল না, তখন জোরে চাপ দিতে গিয়ে হ্যান্ডলটি ফসকে যায় এবং প্রচণ্ড বেগে থুতনিতে আঘাত পায়। মারাত্মক ভাবে জখম প্রাপ্ত অবস্থায় হাসপাতালে রাখতে হয় ১৫ দিন।” দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিলাম, যাতে পাঠক লেখকের জীবনের ছোট ঘটনাটির মধ্য দিয়ে মধ্য দিয়ে ফারাক্কার প্রভাব সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারেন। এ ঘটনা আসলে বৃহত্তর রাজশাহীসহ আশে পাশের অঞ্চল সমূহের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে ফারাক্কা বাঁধ কত ভাবে তছনছ করেছে তার নজির। তাই গঙ্গা-পদ্মা নিয়ে আলোচনা ফারাক্কা বাদ দিয়ে কি করা সম্ভব? অন্তত বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে না। মাহবুব সিদ্দিকীর পক্ষেও সম্ভব হয় নি। তিনি বইয়ের শেষ অধ্যায় রেখেছেন ফারাক্কার জন্য। গঙ্গার উপর ভারতের নির্মিত এই বাঁধ বাংলাদেশের প্রাণ ও প্রকৃতির উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এ দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য করাল গ্রাস রুপী এই বাঁধ তাই এ দেশের মানুষের কাছে মরণ ফাঁদ হিসেবে পরিচিত। লেখক মাহবুব সিদ্দিকী ফারাক্কা বাঁধের ইতিহাস, তারিখ ও সাল ধরে ফারাক্কা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের মধ্যে বৈঠক ও বিভিন্ন চুক্তি এবং তার কার্যকারিতা প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

সব শেষে যমুনা বিষয়ক একটা অস্পষ্টতা উল্লেখ করে শেষ করব। প্রবাহ পথের বর্ণনার এক পর্যায়ে বলা হচ্ছে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিস্তার মহা প্লাবনের আগে ‘যমুনা নদীর সৃষ্টি হয়নি’। এই তথ্য প্রবাহ পথের বর্ণনা ছাড়াও আরো কয়েক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। তাই যদি হয় কৈলাস শৃঙ্গের মানস সরবর থেকে উৎপন্ন হওয়া যমুনা নদী, যেটি বাংলাদেশে কুড়ি গ্রাম দিয়ে প্রবেশ করেছে সেই নদী তখন কোথায় ছিল? নাকি ছিল তখন অন্য নামে ডাকা হত? এই প্রশ্ন গুলো পাঠককে বার বার খোঁচাতে থাকে।

উপরের বিষয় গুলো ছাড়াও সুন্দরবনসহ আরোকিছু বিষয়ে আলোচনা করেছেন যেগুলো আমাদের লেখাতে আসে নি। লেখক গঙ্গা পদ্মার গতিপথ নিয়ে যে তথ্যগুলো হাজির করছেন তা কোন সেকেন্ডারি তথ্য নয়। এই তথ্যগুলো লেখক সশরীরে নদীকে অনুসরণ করে লিপিবদ্ধ করছেন, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যা এই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই গতি পথের বর্ণনা পাঠে কিছু ক্লান্তি উৎপাদন হলেও গবেষকদের কাছে এই কাঁচা তথ্য গুলো অতিশয় মূল্যবান বিবেচিত হবে বলে আমাদের ধারনা।

 


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)

Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 11424 Leave comments (0) Bookmark and Share


Go Back To Arts & Culture
EMAIL
PASSWORD