- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
এ আলোচনা আমরা শুরু করেছিলাম বিষয়বিদ্যার ‘শুরুর তিন’ নিয়ে। আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে গোড়ার এই তিন ধারনা বা বিষয় পরিচ্ছিন্ন থাকলে বিষয়বিদ্যা কিভাবে দর্শনকে আমূল বদলে দিয়েছে তা খানিক আমরা অনুমান করতে পারব। এই তিনটি বিষয়ের ওপর গবেষণা ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে বিষয়বিদ্যা মনোবিদ্যার ভূগোল হেঁটে এসে দর্শনের দেশে প্রবেশ করেছে। বিষয়বিদ্যার আগে দার্শনিক চিন্তার যে ধরণ আমরা দেখি সেই ধরণও বদলে গিয়েছে। তার পরিণতি হিসাবে মার্টিন হেইডেগারের আবির্ভাব এবং তার সর্বব্যাপী প্রভাব – পক্ষে বা বিপক্ষে – খোদ দর্শনের ভূগোল, জগত ও দিগন্তকেই বদলে দিয়েছে বলা যায়। ফলে বিষয়বিদ্যা এবং বিষয়বিদ্যা হয়ে মার্টিন হেইডেগারের দর্শনের পর্যালোচনা ছাড়া পাশ্চাত্য চিন্তার জগতে নতুন ভাবে চিন্তা করা কঠিন। এতে আর কোন সন্দেহ নাই। হেইডেগারের পর নতুন চিন্তাবীরদের আবির্ভাব ঘটে নি তা নয়, কিন্তু প্রায় সকলকেই হয় হেইডেগারের মধ্য দিয়ে কিম্বা তাঁর চিন্তাকে মোকাবিলা করে নিজের চিন্তা পেশ করতে হয়েছে।
যে তিনিটি বিষয় নিয়ে আমরা শুরুতেই আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তারা হচ্ছে (ক) মনোবৃত্তি (intentionality) বা বিষয়নিষ্ঠা; (খ) বৌদ্ধিক উপলব্ধির আগাম শর্ত (Categorical Intuition) বা দিব্যজ্ঞান এবং (গ) ‘আগাম’ (a priori) বা যে কোন বৌদ্ধিক ধারণা নির্মিত হবার আগে জগতের সঙ্গে আমাদের নির্লৌকিক সম্বন্ধ বিচার। আমরা দাবি করেছি, শুরুর এই তিনটি ধারণা সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন হতে পারলে এ কালে যাকে ফেনোমেনলজি বলা হয় তার খেই আমরা ধরতে পারব। কিন্তু ধারনাগুলো পরিচ্ছন্ন করে তোলা এবং বাংলাভাষার মধ্যে আত্মস্থ করে বোঝা কঠিন কাজ। সেই কঠিন চেষ্টাটাই আমরা করছি ও করব।
শুরুতেই, আমরা বুঝতে পারছি ধারনাগুলোকে অনুবাদ করতে গিয়ে আমরা আক্ষরিকতা এবং ভাবুকতার মধ্যে হোঁচট খাচ্ছি। পাশ্চাত্য দর্শনের মতো বাংলাভাষায় গদ্যে দর্শনের কোন ধারাবাহিক চর্চার ইতিহাস নাই। ফলে বাংলাভাষার দর্শন বা ভাবের ইতিহাসের মধ্যে ধারনাগুলোকে আত্মস্ত করা যথেষ্ঠ কঠিন। শুরুতে পাঠকদের সঙ্গে ধারণাগুলোর আক্ষরিক ভাব ধরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আক্ষরিকতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আগের অনুবাদের পাশাপাশি ভাবগত দিক থেকেও পরীক্ষামূলক ভাবে নতুন পরিভাষা ব্যবহারের চেষ্টা করছি। যে কারণে আমরা পাশাপাশি দুটো অনুবাদ পেশ করছি। তারা কতোটুকু বিষয়বিদ্যার ভাব ধারণ করতে পারে সেটা ক্রমে ক্রমে আমরা দেখব।
আজ আমরা বিষয়বিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ‘ইন্টেনশেনালিটি’ নিয়ে আলোচনা করব।
ইংরেজি ‘ইনটেনশান’ কথাটা বাংলায় আমরা অনুবাদ করি কোন কিছু ইচ্ছা বা অভিপ্রায় করা অর্থে। কিন্তু বিষয়বিদ্যা ধারণাটিকে এভাবে ব্যবহার করে না। ধারণাটি আধুনিক কালের নয়। আধুনিক দর্শন গড়ে উঠবার আগে ধর্মতাত্ত্বিক ও স্কলাস্টিক চিন্তার মধ্যে ধারনাটির ব্যবহার ছিল। ব্রেনতানো যখন ধারণাটি ব্যবহার করছিলেন, তখন তিনি আগেভাগেই বলে রেখেছিলেন যে এরিস্টটল এবং স্কলাস্টিক দার্শনিকরা এর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তিনি তাদের কাছ থেকেই ধারণাটি ধার নিয়ে তাকে তার মতো করে পরিচ্ছন্ন করেছেন।
আমরা আগেই বলেছি, ইনটেনশেনালিটির আক্ষরিক অনুবাদ হতে পারত ইচ্ছা বা অভিপ্রায়, কিন্তু তাতে দর্শনে ধারনাটি যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তার সঙ্গে অসঙ্গতি ঘটত। মনোবৃত্তি বললেও মুস্কিল আসান হয় না। সেই ক্ষেত্রে অনুবাদটা আক্ষরিক হয়ে ওঠে। যে কারণে এর ভাবগত দিক বোঝাবার জন্য পাশাপাশি ‘বিষয়নিষ্ঠা’ কথাটা ব্যবহার করছি। এই অর্থে যে আমরা যখন ভাবি তখন কিছু না কিছু নিয়ে ভাবি। কোন না কোন বিষয়ের প্রতি আমাদের চিন্তা নিষ্ঠ বা নিবিষ্ট থাকে। বিষয়হীন চিন্তা বলে কোন চিন্তা নাই। বিষয়বিদ্যায় এটা খুবই প্রাথমিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা। দর্শনে ধারণাটি যেভাবে দানা বেঁধেছে মনোবৃত্তি বললে বাংলায় তা পুরাপুরি ধারণ করা না গেলেও ইনটেনশেনালিটিকে যদি ‘বিষয়নিষ্ঠা’ হিসাবে বুঝি তাহলে আমাদের মুশকিল কিছুটা আসান হয়। অর্থাৎ ইনটেনশেনালিটির অর্থ অভিপ্রায় নয়। বাংলায় অভিপ্রায় বলতে আমরা কোন কিছু ইচ্ছা বা বাঞ্ছা করা বুঝি। কিন্তু বিষয়বিদ্যায় সেভাবে ধারণাটি দানা বাঁধে নি।
ফ্রানৎস ব্রেনতানো ও এডমুণ্ড হুসার্লের হাত হয়ে এই শব্দবন্ধ ও ধারণার আগমন। ফলে এর গায়ে মনস্তাত্ত্বিক আঁচড় রয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিষয়বিদ্যায় ইনটেনশেনালিটি মনের অভিপ্রায় বা ইচ্ছা নিয়ে কথা হয় না, কিন্তু মনকে বাদও দেওয়া হয় না। মনোবৃত্তির মানে হচ্ছে কোন কিছু হাজির বা পেশ করবার জন্য মনের নিবিষ্টতা বা বৃত্তি। সেটা হতে পারে কোন বস্তু, বিষয় ধারণা কিম্বা কোন কামনা , বাসনা বা ইচ্ছা মনে ধারণ, ইত্যাদি। মনকে বাদ দেওয়া হয় নি কথাটা বলে রাখছি এ কারনে যে আমরা তো সারাক্ষণই মন নিয়ে কথা বলি। কিন্তু ‘মন’ কী? দর্শন তো এই প্রশ্নকে এড়িয়ে যেতে পারে না। আবার ‘মন’ আর ‘চিন্তা’র মধ্যে পার্থক্য কি? আমরা দুটো শব্দকে অদল বদল কর ব্যবহার করলেও দুইয়ের ব্যবহারে পার্থক্যও বজায় রাখি। আমাদের মধ্যে ‘মন’ আছে, এটা আমরা ধরে নেই। কিন্তু কি করে সেটা জানি? প্রকৃতিবিজ্ঞানের প্রণোদনায় একসময় মনে করা হোত মন আমাদের একটি প্রাকৃতিক বা শারিরীক ইন্দ্রিয় যাকে প্রকৃতিবিজ্ঞানের পদ্ধতি ও প্রকরণ দিয়ে শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব। এই অনুমানে শরীরবিজ্ঞানেরই সম্প্রসারণ হিসাবে মনস্তত্ত্ব (psychology) বা মনোবিদ্যা গড়ে উঠেছিল। সেই কালপর্ব মনস্তত্ত্ব বা মনোবিদ্যা পেরিয়ে এসেছে। মন নিয়ে গবেষণার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি গড়ে উঠতে সময় লেগেছে। এরপর ‘মন’কে সুনির্দিষ্ট গবেষণার ক্ষেত্র হিসাবে শনাক্ত করে মনোবিজ্ঞান তার মনের স্বভাব বিচারের গবেষণা করেছে। সেটা করতে প্রায়ই সে দর্শনের পরিমণ্ডলে প্রবেশ করেছে। একসময় দর্শনও প্রকৃতিবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান থেকে তার নিজের পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট ও আলাদা করতে সচেষ্ট হয়েছে এবং মনকে দর্শন হিসাবে বিচার করতে গিয়ে চিন্তার স্বভাব বিচারে নিষ্ঠ হয়েছে। মনস্তত্ত্ব বা মনোবিদ্যা থেকে আলাদা হয়ে দর্শন নিজেকে ‘বিষয়বিদ্যা’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
কিন্তু ‘মন’ আসলে কী, এই প্রশ্ন তারপরও রয়ে গিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে চিন্তা, বুদ্ধি, ভাবনা ইত্যাদি কি মনেরই প্রতিভা? মনেরই কোন বৃত্তি? বলাবাহুল্য, দর্শন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আগ্রহী। সে কারণে ব্রেনতানো বা হুসার্ল মনের তত্ত্ব বা মনস্তত্ত্বের মধ্যে চিন্তার কায়কারবার অন্বেষণ করেছেন। মনকে বাদ দেন নি। ইনটেনশেনালিটির অনুবাদ আক্ষরিক ভাবে মনোবৃত্তি করলে তাই বড় ধরণের দোষ হয় না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এর ভাবগত তাৎপর্য এই আক্ষরিক অনুবাদে বাংলাভাষায় আত্মস্থ হয় না। তবে যদি মনে রাখি যে মন যখন চিন্তা করে তখন তা কখনই বিষয়হীন হয় না, কোন না কোন বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠ থেকেই মন চিন্তা করে – তখন আমরা বাংলা ভাবের দিক থেকে তাকে বোঝা ও আত্মস্থ করার কাজে এককদম এগিয়ে যাই। ইনটেনশেনালিটির অর্থ সে কারণে বিষয়নিষ্ঠাও বটে।
কোন অর্থে বিষয়নিষ্ঠা? ফ্রানৎস ব্রেনতানোর দাবি হচ্ছে, যে-কোন চিত্তবৃত্তি বা মানসিক অবস্থার অর্থ হচ্ছে নিজের মধ্যে কোন না কোন বিষয় ধারণ করা, পেশ করা, তার সঙ্গে বা তার প্রতি সম্বন্ধযুক্ত থাকা, ইত্যাদি। চিত্তবৃত্তি বা মনোবৃত্তির নানান ধরণ ও স্তর রয়েছে। ব্রেনতানো বস্তু জগতের কোন কিছুর অস্তিত্ব বিচার আর মনের জগতে উদিত হওয়া বিষয়ের অস্তিত্বের বিচারের মধ্যে পার্থক্য দেখাতে চাইছেন। যখন আমরা চিন্তা করি তখন তো চিন্তার ‘বিষয়’ হিসাবে কিছু না কিছু মনে অস্তিত্বমান, সে ‘বিষয়’ বাস্তবে না থাকলেও মনে তো আছে। কোন কিছুর চিন্তা করার মানে এই নয় যে বস্তুজগতে বা বাস্তবে তার অস্তিত্ব থাকতে হবে, কিন্তু যেহেতু তা মনের বৃত্তি হিসাবে ‘আছে’ -- চিন্তা যে কারণে তার প্রতি নিষ্ঠ -- সে কারনে তাকে ‘নাই’ বলাও যাচ্ছে না। মন কোন না কোন বিষয়ের সঙ্গে নিষ্ঠ থেকেই চিন্তা করে, অন্যদিক বিষয়াদি ‘আছে’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আমরা ‘মন’ নামক কিছু একটা বিষয়ের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারি। আমরা যখন বলি যে আমরা চিন্তা করছি, তখন তার মানে দাঁড়ায় আমরা কিছু না কিছু চিন্তা করছি। বিষয়হীন চিন্তা বলে কিছু নাই। বিষয়ও চিন্তার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়েই বিষয় হয়ে থাকে । ব্রেনতানো এটাই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, আর হুসার্ল সেখান থেকেই শুরু করেছেন। হেইডেগারে এসে ধারণাটির ব্যবহার যখন আরও বিকশিত হোল তখন দেখা গেল দৈনন্দিন ইন্দ্রিয়পরায়ন উপলব্ধির (perception) স্বভাব আদতে কেমন সেই দিকগুলো ব্যাখ্যা করবার জন্য হেইডেগার ধারণাটি ব্যবহার করছেন। আমরা যখন কোন কাজ করি বা চিন্তা করি সকল সময়ই আমরা কোন না কোন বিষয়ে নিষ্ঠ থাকি, কোন না কোন ভাবে জগতের সঙ্গে মন বা চিন্তার দিক থেকে সম্বন্ধযুক্ত থাকি।
হেইডেগার ‘বিষয়নিষ্ঠা’-কে বিষয়বিদ্যার খুব বড় ধরণের আবিষ্কার গণ্য করতেন। কিন্তু তাঁর সময়ে তর্ক উঠেছিল যদি এরিস্টটল আর স্কলাস্টিকরা এই ধারণাটির সঙ্গে পরিচিতই থেকে থাকেন তাহলে তাকে ‘আবিষ্কার’ বলা যায় কিভাবে? হেইডেগার বলছেন এরিস্টটল এবং স্কলাস্টিকদের কাছে ধারণাটি ছিল আবছা, চিন্তার স্বভাব বিচারের দিক থেকে এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হলে এর যে গভী্র ও বিস্তৃত বিশ্লেষণ জরুরী ছিল তাঁরা সেটা করেন নি। মানুষ স্বঃতস্ফূর্ত বা অব্যবহিত ভাবে বাইরের জগতের সঙ্গে যেভাবে চিন্তায় সম্বন্ধযুক্ত থাকে সেই সম্বন্ধের ধরণ বা কাঠামো সম্পর্কে তাঁদের একটা আগাম উপলব্ধি ছিল। তাকে নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিত করে গবেষণা ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এই সম্বন্ধের সম্ভাবনা, চরিত্র ও দিগন্তকে নিশ্চিত ভাবে পথ দেখিয়েছে বিষয়বিদ্যা। আবছা পরিচিতি থেকে শুরু করে মনের মধ্যে উদিত বিষয়সমূহের শ্রেণিকরণ করা এবং প্রতিটি বিষয়ের বিশ্লেষণ সম্পাদন একটি লম্বা পথ, দর্শনের দিক থেকে সেটা একটা লম্বা ভ্রমণ। বিষয়বিদ্যার বিকাশের আগে দার্শনিকরা মনে করতেন ই্নটেনশেনালিটি একটা অপরিচ্ছন্ন, অস্পষ্ট, পরাবিদ্যামূলক বদ্ধ চিন্তা বা ধারণা। দর্শনে এর কোন উপযোগিতা নাই। বিষয়বিদ্যাকে সেই পথ পাড়ি দিয়ে ‘বিষয়নিষ্ঠা’র দার্শনিক তাৎপর্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। ফলে ‘বিষয়নিষ্ঠা’ বিষয়বিদ্যারই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।
হেইডেগার হুসার্লের সমসাময়িক একজন দার্শনিক রিকার্টের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। রিকার্ট বলেছিলেন, জগতের সঙ্গে অব্যবহিত সম্বন্ধ বিচার করতে ‘বিষয়নিষ্ঠা’র ধারণা হুসার্ল নির্মাণ করেছেন ঠিকই, কিন্তু সেটা এক্কেবারেই ব্যখ্যাহীন ও অস্পষ্ট থেকে গেছে। ফলে পরাবিদ্যার ঐতিহ্যগত গোঁড়ামি থেকে তা বের হয়ে আসতে পারে নি। পরাবিদ্যার মধ্যেই খাবি খেয়েছে। ফলে যাঁরা বিষয়বিদ্যা চর্চা করছেন তারা তাদের সামনে দর্শনের যে তর্কগুলো হাজির তাকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারছেন না। রিকার্টের এই মন্তব্যকে হেইডেগার জোর গলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। বলছেন,
“আমরা পরিষ্কার ভাবেই এই ধরণের মত প্রত্যাখান করি। এ জন্য নয় যে ব্রেনতানোর বিপরীতে হুসার্লের মৌলিক অবদান আমরা ধরে রাখতে চাই। বরং বিষয়বিদ্যা বোঝার জন্য যেসকল অতি প্রাথমিক বিবেচনা আমলে রাখা ও সে সম্পর্কে সুশৃংখল পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার তাকে শুরুতেই লণ্ডভণ্ড করে দেবার বিপদ থেকে রক্ষার জন্যই এই ধরণের মূল্যায়ন প্রত্যাখান জরুরী”।
বলাবাহুল্য বিষয়নিষ্ঠা সম্পর্কে রিকার্টের কিম্বা অন্য আরও অনেকের এই ধরণের মূল্যায়ন প্রত্যাখান করেই হেইডেগার ক্ষান্ত থাকেন নি। তিনি দেখাতে চেয়েছেন বিষয়নিষ্ঠা ব্যাপারটাকে বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে এটা আসলে মৃন্ময় বা চিন্ময় সত্তা হিসাবে আমাদের জগতের সঙ্গে সতত নিষ্ঠ থাকার ভাব বা স্বভাব। যদি চিন্তা করার অর্থ হয় কিছু না কিছুর চিন্তা করা তাহলে চিন্তা করার অর্থ জগত থেকে সম্বন্ধবিহীন হয়ে চিন্তা নিশ্চয়ই নয়। সেটা হতেও পারে না। যাকে আমরা জীবন্ত বা জেগে থাকা বলি, ব্যাপারটা তো আসলে সেরকমই। হেইডেগার একে বলেছেন জীবন্ত উপলব্ধি। বিষয়নিষ্ঠ হয়ে থাকা হচ্ছে আমাদের এমন একটা স্বভাব যার মধ্য দিয়ে আমরা জীবন্ত – অর্থাৎ জগতের সঙ্গে অব্যবহিত ভাবে নিরন্তর সম্বন্ধযুক্ত থাকি।
কিন্তু সেটা আপনা আপনি আমরা বুঝতে পারবো না। সেটা বুঝতে হলে আমাদের লম্বা আলোচনা দরকার। পরের কিস্তি থেকে আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করব। এখন এটুকু বলে রাখা দরকার যে হেইডেগার এডমুণ্ড হুসার্লকে নির্বিচারে গ্রহণ করেন নি। বিষয়নিষ্ঠা সম্পর্কে তাঁর ও হুসার্লের চিন্তা ভিন্ন। বিষয়বিদ্যা সম্পর্কে আমাদের আগ্রহের একটা বড় কারন যেহেতু মার্টিন হেইডেগার, অতএব তিনি ধারণাটির যেভাবে পর্যালোচনা করেছেন আমরা তা অনুসরণ করব। পাশাপাশি অন্যদের দরকারি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণও উল্লেখ করবার চেষ্টা করব।
যারা হেইডেগারের ‘বীং এন্ড টাইম’ গ্রন্থটি পড়তে আগ্রহী তাঁরা সম্ভবত জানেন যে হেইডেগার এই বইতে রেনে দেকার্তের হাত ধরে দর্শনের পাশ্চাত্য ঐতিহ্যকে প্রশ্নবোধক করে তুলেছেন। সেই ঐতিহ্যের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে জ্ঞানচর্চাকে দৈনন্দিনের জীবনাচার বা জীবনচর্চা থেকে আলাদা ব্যাপার বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা। আমরা ধরে নিয়ে থাকি জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র দৈনন্দিনের জীবনযাপন থেকে আলাদা একটা ব্যাপার। জগত আমাদের কাছে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে জ্ঞানের ক্ষেত্রে দৈনন্দিনতার জগত থেকে আলাদা হয়ে জগত নিয়ে ভাবলে। এই বিভাজন বহাল রাখি বলে আমরা জ্ঞানচর্চাকে জীবনচর্চা থেকে আলাদা গণ্য করি। বা দৈনন্দিন জীবনে আমরা যেভাবে বেঁচে থাকি সেই জীবন্ত উপলব্ধি ও তৎপরতার জগত থেকে ভিন্ন ব্যপার বলে ভাবতে শুরু করি। একই কারণে জ্ঞানচর্চাকে জীবনচর্চার ওপরে স্থান দিয়ে থাকি। অর্থাৎ মনে করি জগতের ‘অর্থ’ একমাত্র জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়েই ব্যক্ত করা সম্ভব।
হেইডেগার এই ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে দেখিয়েছেন জগত অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে, দৈনন্দিনতার চর্চায়। ব্যাপারটা এমন নয় যে আমরা যখন কোন কাজ করি তখন চিন্তা করি না, কিম্বা যখন চিন্তা করি তখন কোন কাজ করি না। কথাটা যতো সহজ ভাবে আমরা এখন বলতে পারছি সেই উপলব্ধিটুকু অর্জন করতে দর্শনকে বিস্তর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। পাশ্চাত্য দর্শনের জগতে এই সিদ্ধান্ত বৈপ্লবিক। সেই পথের শুরুতেই রয়েছে মনোবৃত্তি বা বিষয়নিষ্ঠার ধারণা। ফলে ধারণাটিকে পরিচ্ছন্ন ভাবে বোঝার ওপর হেইডেগার বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।
আগামি কয়েকটি কিস্তিতে বিষয়নিষ্ঠাকে অতএব নানান দিক থেকে আমরা আলোচনা করব।
২৩ অক্টোবর ২০১৩। ৮ কার্তিক ১৪২০।
লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)