- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
বিষয়বিদ্যা ইনটেনশেনালিটি বা বিষয়নিষ্ঠাকে যেভাবে বিচার করে তার সঙ্গে আক্ষরিক অর্থে শব্দটিকে আমরা যেভাবে বুঝি সেভাবে বুঝলে চলবে না। এ কথা আমরা অনেকবার বলেছি। হেইডেগারও এই দিকটা বারবার হুঁশিয়ার করে দিতে ভুল করেন নি। বিষয়নিষ্ঠার দ্বারা ইচ্ছা, সংকল্প বা কোন কিছুর প্রতি বাসনা জ্ঞাপন বোঝানো হয় না। হেইডেগার এটাও বারবার সতর্ক করতে চেষ্টা করেছেন, যে বিষয়বিদ্যা ঠিক কিভাবে ধারণাটিকে বোঝে সেটা হঠাৎ বুঝে ওঠাও কঠিন। বেশ কয়েক বার ও কয়েক স্তরে চেষ্টার দরকার হয়। আমরাও বাংলায় অনুবাদের ক্ষেত্রে ইনটেনশেনালিটির অনুবাদ হিসাবে নানান পরিভাষা ব্যবহার করেছিঃ মনোবৃত্তি, বিষয়নিষ্ঠা, ভাব – ইত্যাদি। পরীক্ষামূলক ভাবে। বাংলাভাষায় বিষয়বিদ্যার প্রকল্প আত্মস্থ করতে করতে যুৎসই শব্দবন্ধটি নিজের গুণে জানান দেবে, এই ভরসায়।
আমরা এখন মনোবৃত্তি, বিষয়নিষ্ঠা বা ভাবের গঠন বোঝার চেষ্টা করব। আমরা চেয়ারের উদাহরণটা মনে রাখব। খেয়াল করব কিভাবে কোন কিছুকে আমরা সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে উপলব্ধি করি। এর আগের আলোচনা থেকে এটা আশা করি বুঝেছি যে ইনটেনশেনালিটি মানে আমাদের বাইরে হাজির কোন কিছুর সঙ্গে আমাদের মানসিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া না। বরং দৈনন্দিনতার মধ্যে বিভিন্ন বিষয়-আশয়ে সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে নিষ্ঠ থাকার যে ভাব সেই ভাবটা কেমন তা নিয়েই আলোচনা। সেটা বুঝতে হলে ভাবের চরিত্র বা গঠন কেমন সেটা ঘনিষ্ঠ ভাবে নিরীক্ষণ দরকার। আমরা এখন সেই বিষয়ে প্রবেশ করছি।
আমরা চেয়ারের উদাহরণেই থাকব। উদাহরণ নিলেও চেয়ারকে আমরা কিভাবে উপলব্ধি করছি সেই বিশেষ ভাব আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় হবে না। বরং সাধারণ ভাবে উপলব্ধ বিষয়ের গঠন বা গাঠনিক দিক নিয়েই আমরা কথা বলব। আমাদের মধ্যে কোন বিষয়ের উপলব্ধির উদয় ঘটতে হলে যেভাবে বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠ হতে হয় সেই নিষ্ঠার চরিত্রটা আমরা বুঝতে চাই। যার প্রতি (directing itself toward) নিষ্ঠ থাকি বলে সেটা বিষয় হয় সেই বিষয়ের দিক থেকে (toward-which) ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা যাক। অর্থাৎ উপলব্ধির প্রক্রিয়া নিয়ে নয়, উপলব্ধির বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। যেমন, আমাদের চেয়ারের উদাহরণে আমরা ঘরে ঢুকতে গিয়ে চেয়ার পেলাম সামনে, সেটা সরিয়ে প্রবেশ করছি। এই ক্ষেত্রে চেয়ারের একটা উপলব্ধি হয়েছে অবশ্যই। এই উপলব্ধির উপলব্ধ-বিষয়টা আসলে কী?
সহজ উত্তর হবে, চেয়ারটাকেই উপলব্ধি করেছি। চেয়ারটা আছে, তাই না? কিন্তু হুঁশিয়ার হয়ে যদি ভাবি তাহলে প্রশ্ন হবে এ আবার কেমন উপলব্ধি? চেয়ার আমার ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধ হয়ে আমার চিন্তার মধ্যে প্রতিফলিত (represent) হয়েছে কি? না। চেয়ারের বিশেষ কোন ‘ছবি’ আমার মাথার মধ্যে তৈরী হয় নি। ঘরে ঢুকতে গিয়ে ‘দেখলাম’ চেয়ারটি আমার সামনে, তাকে হাত দিয়ে সরিয়ে আমি ঘরে প্রবেশ করেছি। এই ‘দেখা’টাই – আবারও বলি, ঘরে ঢোকার মুহূর্তে চেয়ারকে ওই বিশেষ ভাবে দেখাটাই -- ‘দেখা’। এই দেখাটাই চেয়ারটা সামনে আছের উপলব্ধি। এ ছাড়া চেয়ারের বিশেষ কোন ইন্দ্রিয়ানুভূতি আমার ঘটে নি। ঘরে ঢুকতে গিয়ে সামনে পড়ল প্রবেশের বাধা হিসাবে – এই হোল চেয়ারটি সম্পর্কে আমার সহজ ও স্বাভাবিক উপলব্ধির চরিত্র।
চেয়ারটা আছের এই উপলব্ধিটা কেমন? যেমন, ঘরে ঢুকে আমি দেখতে পাচ্ছি চেয়ারটি \ ঘরের এক পাশে পড়ে আছে। শ্যামলী ২২/১৩ খিলজি রোডের যে কক্ষে আমরা হেইডেগার নিয়ে প্রতি বৃহস্পতিবার আলোচনা করি সেই কক্ষের দরজার পাশে; চেয়ারটা নতুন না, ব্যবহারে কিছুটা বিবর্ণ, কিন্তু দেখতে মজবুত লাগে। এটাও বুঝতে পারছি চেয়ারটা অটবি বা হাতিলের চেয়ার নয়, কিন্তু অপরিচিতও নয়; আরও অনেক জায়গায় এই ধরণের চেয়ার আমি দেখেছি; এই রকম কাঠের চেয়ার রুমে আরও কয়েকটি আছে। অন্য ধরনের চেয়ারও রয়েছে, ইত্যাদি। অর্থাৎ চেয়ারের উপলব্ধিটা কেমন সেই প্রশ্ন করলে কোন প্রস্তুতি ছাড়াই এই রকম অনেক কথা আমরা বলতে পারি। অনায়াসেই। সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে। তুচ্ছ কি বিশেষ নানান কথা চেয়ার সম্পর্কে অনায়াসেই বলতে পারি। এই যে চেয়ারটি আছে হয়ে থাকার উপলব্ধি ওর মধ্য দিয়ে আমি আসলে কী উপলব্ধি করছি? সেই উপলব্ধ বিষয়কে হেইডেগার বলছেন জগতের যে-পরিবেশ-পরিস্থিতিতে আমি থাকি,আমরা আছি, তারই অন্তর্গত বিষয়নিষ্ঠতা – পরিপার্শ্বিকতার জিনিস (environmental thing)।
আমার উপলব্ধি এখানে শেষ নাও হতে পারে। আমি বলতে পারি চেয়ারটা বেশ শক্ত। মেটে রঙের, অন্যান্য চেয়ারের তুলনায় একটু বড়। টেবিলের পাশে বসলে একটু উঁচু হয়ে গিয়েছি মনে হয়। ইচ্ছে হলে দরজার পাশ থেকে সরিয়ে চেয়ারটিকে অন্য কোথাও বসানো যায়।
কিম্বা আরও বলতে পারি, চেয়ারটাকে ওপরে তুলে ছেড়ে দিলে চেয়ারটা বেশ জোরেসোরেই মাটিতে পড়ে। কাঠের একটা ওজন আছে, কাঠে তৈরী চেয়ার এই ওজনের ভারে মাটিতে পড়বে। এর কাঠগুলো ভেঙ্গে দা দিয়ে টুকরা করা সম্ভব। আগুনে দিলে কাঠগুলো পুড়বে। এই ক্ষেত্রেও যে-বিষয় আমি উপলব্ধি করেছি সেই বিষয় – অর্থাৎ চেয়ার সম্পর্কেই বলছি। কিন্তু এই বলাগুলো ইন্দ্রিয়োপলব্ধি থেকে উৎপন্ন হয়ে বুদ্ধির পরিমণ্ডলে সংশ্লেষিত কোন অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু উপলব্ধি হিসাবে আগে যে কথাগুলো বলেছি তার সঙ্গে এই কথাগুলোর পার্থক্য আছে। কারন চেয়ারটি সম্পর্কে আমরা যে কথা বলছি সেটা শুধু চেয়ার সম্পর্কে না, তা যে কোন কাঠের বস্তু সম্পর্কে বলা চলে। এগুলো কাঠের গুণ, ঠিক চেয়ারের নয়। যখন কাঠের গুণ নিয়ে কথা বলি তখন চেয়ার নামক জিনিস নিয়ে কথা বলছি না, বলছি কাঠ নামক প্রাকৃতিক জিনিস সম্পর্কে। তাহলে চেয়ার নামক যে জিনিসটাকে আমি ঘরে ঢুকতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, প্রাকৃতিক বস্তু হিসাবে চেয়ারকে ব্যাখা করলে সেই চেয়ার নিয়ে কথা বলার আর কোন অর্থ থাকে না। বিষয় হিসাবে কাঠ নিয়ে কথা বলা আর ঘরে ঢুকতে গিয়ে যে চেয়ারকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েছি সেই চেয়ার সম্পর্কে কথা বলা এক কথা হোল না।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে পারিপার্শ্বিকতার জিনিস আর প্রাকৃতিক জিনিসের মধ্যে পার্থক্য আছে। হেইডেগার এটা বোঝাতে একটি মজার উদাহরণ দিয়েছেন। কাউকে ভালবাসলে আমরা তাকে গোলাপ ফুল দিতে চাই। দিয়ে বলতে পারি, ‘তোমাকে গোলাপ দিলাম’। কিন্তু তা না বলে বলতে পারি, ‘তোমাকে ফুল দিলাম’। কিন্তু এটাতো নিশ্চয়ই আমরা বলি না যে তোমাকে একটি উদ্ভিদ দিলাম, কিম্বা একটি গাছ। কিন্তু গোলাপ তো আসলেই উদ্ভিদ। ফুলের গাছ। তো বলি না কেন যে ‘তোমাকে ফুলের গাছ দিচ্ছি, প্রিয়তমা, আমার ভালবাসা গ্রহণ করো’।
বলিনা কারন আমাদের ভাষা পারিপার্শ্বিক জিনিস আর প্রাকৃতিক জিনিসের মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখে। বা, বজায় রাখতে জানে। একটি গোলাপ আমরা যেভাবে উপলব্ধি করি তাকে যেমন ফুল বলা যায়, তেমনি উদ্ভিদও বলা যায়। কিন্তু উদ্ভিদ বিদ্যার বিষয় ভালবাসার গোলাপ না, বরং গোলাপ গাছ। গোলাপ পারিপার্শ্বিকতার বিষয়, আর গোলাপ গাছ প্রাকৃতিক।
উপলব্ধ বিষয় তাহলে দুটোই – পারিপার্শ্বিকতার জিনিস আর একই সঙ্গে প্রকৃতিরও। উপলব্ধ বিষয়ের মধ্যে পারিপার্শ্বিকতা ও প্রাকৃতিকতা দুটাই সমান হাজির। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বিষয়বিদ্যা উপলব্ধ বিষয় হিসাবে আমাদের যা বোঝাতে চায় তার উত্তর কি এতে মেলে? যদি বলি চেয়ারকে আমি পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে ও প্রাকৃতিক জিনিস হিসাবে দুভাবেই উপলব্ধি করি; তাতে এটা পরিষ্কার যে এই দুই উপলব্ধি এক নয়। তাহলে তাদের সম্পর্ক বিচার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে ওঠে। এই বিষয়ে আমাদের ফিরে আসতে হবে। কিন্তু এখন আমরা আলোচনার যে পর্যায়ে রয়েছি সে পর্যায়ে আরও কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় পরিচ্ছন্ন করা দরকার।
চেয়ারটির উপলব্ধি সম্পর্কে আমরা বলতে পারি যে চেয়ারটা বেশ শক্ত। এই অর্থে যে চেয়ারটা বসতে আরাম পাওয়া যায় নি। কাঠের প্রাকৃতিক গুণ বিচার করে এ কথা বলা হয় নি। চেয়ারটি সম্পর্কে বলা হয়েছে। একটা কাঠের বস্তু হিসাবে তার গুণাগুণ এখানে বিচার্য নয়। সেটা আলাদা ভাবে বস্তুগত ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলা যায়। কিন্তু আমাদের উদাহরণে যেটা পরিষ্কার করতে চাইছি সেটা অন্য বিষয়। চেয়ারের ওজন, কাঠিন্য কিম্বা অন্য কোন প্রাকৃতিক গুণ দেখা যাচ্ছে সুনির্দিষ্ট পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে নিজেকে হাজির করে। চেয়ারটাতে বসতে আরাম না পাওয়াটার মধ্যে কাঠের কাঠিন্য, কিম্বা মিস্ত্রীর বানানোর ভালোমন্দ হাজির রয়েছে। কিন্তু কাঠের কাঠিন্য বিচার করে, কিম্বা কাঠমিস্ত্রীর বানানোর ত্রুটি জেনে চেয়ারটিতে বসবার অস্বস্তির কথা বলা হচ্ছে না। বরং যাকে আমরা পরিপার্শ্বিক জিনিস হিসাবে উপলব্ধি করছি সেই উপলব্ধির চরিত্রই আমাদের চেয়ারটিকে এভাবে উপলব্ধি করাচ্ছে। হেইডেগারের ভাষাটা এই ক্ষেত্রে খুব তাৎপর্যপূর্ণ। বলছেন, উপলব্ধ বিষয়ই নিজেকে নিজে হাজির করছে, বা নিজেকে দিচ্ছে – পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে নিজে হাজির হয়ে তার এই দেওয়া – এই উপলব্ধি ঘটানো। পারিপার্শ্বিকতার প্রতি আমরা মনোযোগী না থাকতে পারি, পারিপার্শ্বিক জিনিসের এই স্বভাব আমাদের অনেকের কাছে লুকানো থাকতে পারে, কিন্তু এভাবেই পরিপার্শ্বিক জিনিস আমাদের মধ্যে নিজেকে পারিপার্শ্বিকতার বিষয় হিসাবে হাজির করে।
পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে যাকে বিষয় হিসাবে উপলব্ধি করি তার প্রাকৃতিকতাকে বোঝার জন্য আমরা আরও গভীরে যেতে পারি। দেখাতে পারি তার একটা বস্তুগুণ আছে, এই বস্তুর চরিত্র হচ্ছে তার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আছে। আর যা কিছুই বস্তুগুণ সম্পন্ন তার রঙ থাকে। আর বস্তু কোন না কোন জায়গা অধিকার করে থাকে। সে জায়গা থেকে তার স্থানান্তর সম্ভব। ইত্যাদি। ফলে পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে যা ধরা দিচ্ছে তাকে নিয়ে বিস্তর গবেষণা হতে পারে। হয়তো হয়েছেও। কিন্তু ঢোকার সময় যে চেয়ারটিকে সরিয়ে আমরা ঘরে প্রবেশ করলাম পারিপার্শ্বিক বা প্রাকৃতিক জিনিস হিসাবে এই সকল‘উপলব্ধি’ হাজির থাকে না। যখন কাঠ নিয়ে গবেষণা বা পরীক্ষা নিরীক্ষা করি তখন গবেষণাটা হয় নিছক বস্তুগুণ নিয়ে গবেষণা; যে চেয়ার আমি উপলব্ধি করছি, সেই বিষয় নয়। বস্তুগুনের পরীক্ষা নিরীক্ষার সময় কাঠের বস্তুত্ব, ঘনত্ব, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, তার স্থান বদল হয় কি হয় না ইত্যাদি নানান বিষয় নির্ণয় করা যেতে পারে। কিন্তু সেই সব বিষয় বিশেষ যে চেয়ার নিয়ে আমরা কথা বলছি সেই চেয়ারের তৎক্ষনাত উপলব্ধির অন্তর্গত নয়।
বিষয়কে এই তিন ভাবে নির্ণয়ের ক্ষেত্রে উপলব্ধির বিষয় হিসাবে যা ধরা পড়ছে সে ব্যাপারেই বিষয়বিদ্যার বিশেষ আগ্রহ। এগুলো নির্ণয় সম্ভব যদি যা সামনে হাজির তাকে আমরা আমলে নেই। উপলব্ধিকে এই ব্যাপক অর্থে প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক জ্ঞান করেই বুঝতে হবে। বিষয়বিদ্যার আগে বা বাইরে মনোবিজ্ঞান বা পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বের ধারার কাছে উপলব্ধিকে এভাবে বোঝার চেষ্টা তুচ্ছ আর অবৈজ্ঞানিক বলেই পরিগণিত হোত -- এভাবে উপলব্ধিকে পারিপার্শ্বিক আর প্রাকৃতিক ভাবে বোঝা। ঘরে ঢুকতে গিয়ে চেয়ারটি আমার সামনে আছে এই সাধারণ উপলব্ধিকে জ্ঞানতত্ত্ব আমলে নেয় না। কারণ শুরুতেই নাকি আমরা চেয়ারকে চেয়ার হিশাবে দেখি না – দেখি রঙিন, আকার সম্পন্ন কিছু ইন্দ্রিয়ানুভূতি হিসাবে। তারপর ওর মধ্যে আমরা অন্যান্য গুণাবলী আরোপ করে উপলব্ধি করি। ইত্যাদি।
জ্ঞানতাত্ত্বিক বা বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির বাইরে ও বিপরীতে বিষয়বিদ্যা তুচ্ছকেই প্রধান করে তোলে। বিষয়বিদ্যার মৌলিক আবিষ্কারটা এখান থেকেই ধরা পড়তে শুরু করে। বিষয়বিদ্যা তুচ্ছকেই চায়, কারন আমরা যখন চেয়ারকে ‘দেখি’ তখন চেয়ারকেই ‘দেখি’। এই দেখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘দেখা’ বলতে এটা চোখ দিয়ে দেখা বোঝাচ্ছে না। এটা চোখের ইন্দ্রিয়োপলব্ধির বিষয় নয়। বরং ‘যা হাজির তাকে সোজা ও সরল ভাবে আমলে নেওয়ার ব্যাপার’। যদি আমরা এই তুচ্ছ ব্যাপারটা বুঝি তাহলে পাশ্চাত্য দর্শনের দিক থেকে অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কারের দিকটা বোঝার দিকে বড় এক কদম এগিয়ে যেতে পারব। যা আমাদের সামনে আপনাতেই হাজির হয় তাকে তার মতো করেই বোঝার গুরুত্ব আমরা বুঝব। কেউ চেয়ারের মধ্যে ‘দেখতে’ পারে এর আগে এই চেয়ারে সে ঘরের কোথায় কোন কোনায় বসে ছিল। কিম্বা কেউ চেয়ারের মধ্যে সেই কারখানাটিকেও ‘দেখতে’ পারতে পারে যে কারখানায় এই ধরনের চেয়ার তৈরী হয়। কিন্তু চেয়ার কিভাবে আমাদের উপলব্ধির বিষয় হোল সেটা বুঝতে গিয়ে আমরা চেয়ার নিয়ে কোন উপসংহার টানছিনা। কোন গবেষণাও করছি না। কিন্তু চেয়ারের মধ্যে চেয়ার তৈরীর কারখানার উপলব্ধি ঘটতে পারে, এতে অবাক হই না। উপলব্ধির অর্থ এতোটাই ব্যাপক। উপলব্ধিকে যে শুধু ইন্দ্রিয়পরায়ন বা ইন্দ্রিয়োপলব্ধিই হতে হবে তার কোন কথা নাই। যে তুচ্ছ হাজিরাকে আমলে নিয়ে আমরা উপলব্ধির ক্ষেত্রকে বিস্তৃত ও গভীর করছি তার সঙ্গে মনোবিজ্ঞান বা জ্ঞানতত্ত্বের কোন শাখার সঙ্গেই মেলে না। কোন বিজ্ঞানের পক্ষেই উপলব্ধির এমন ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ‘দেখা’ অর্থে যে উপলব্ধির কথা বলা হোল ক্রমে ক্রমে আমরা দেখব যাকে আমরা বস্তুগুণ বলছি, কিম্বা বস্তুগুণের অন্তর্গত দেশ, কাল, বর্ণ, পরিমাণ ইত্যাদি – সবই এই দেখা বা উপলব্ধির অন্তর্ভুক্ত। কিছুই এই তুচ্ছতাকে আমলে নেবার বাইরে নাই। সবকিছু আমি ঘরে ঢোকার সময় চেয়ারকে যেভাবে উপলব্ধি করলাম তখন আবিষ্কার করি নি। যা দেখছি তাকে সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে আমলে নেবার অর্থ একই সঙ্গে এই বস্তুগুণকেও আমলে নেওয়া। চেয়ারের এই গুণও বর্তমান, এই বর্তমানতাকেও হিসাবে নেওয়া।
হেইডেগার সাবধান করছেন এ কথা বলে যে , অতএব এই দেখা – বা যা হাজির তাকে সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে আমলে নেবার তুচ্ছতাকে যেন আমরা কোন মিস্টিক উপলব্ধি বা আধ্যাত্মিক প্রেরণা গণ্য না করি।
সেটা ক্রমে আরও পরিচ্ছন্ন করা যাবে আশা করি।
১৮ ডিসেম্বর ২০১৩। ৪ পৌষ ১৪২০। রিদয়পুর।
লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)