- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
আগের কিস্তির আলোচনায় আশা করি আমরা বুঝেছি যে উপলব্ধিকে আমরা এখন ঠিক যেভাবে বুঝে থাকি সেভাবে বুঝলে চলবে না। আমাদের এখনকার বোঝাবুঝির একটা সংকীর্ণ জায়গা আছে। উপলব্ধি ব্যাপারটাকে বুঝবার সেই সংকীর্ণ জায়গা পরিহার করে বা প্রচলিত জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতির সংকীর্ণ গলি থেকে বিষয়বিদ্যা বেরিয়ে আসতে চায়। যা হাজির রয়েছে বা সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে যে বিষয় সামনে হাজির হয় সেই সহজ ও স্বাভাবিক আছেময়তাকে বিষয়বিদ্যা আমলে নিতে চায়। কোন প্রকার জ্ঞানতাত্ত্বিক আঁকা বাঁকা পথে বা ঘুরপথে হারিয়ে যেতে চায় না। এর মানে এই নয় যে বিষয়বিদ্যা জ্ঞানতত্ত্ব বা প্রাচীন দার্শনিক চিন্তা কিম্বা তার ইতিহাসকে অস্বীকার করে; না, সেটা তার উদ্দেশ্য নয়, বরং কোন কিছু যখন আমাদের মধ্যে বিষয় হয়ে হাজির হয় সেই সহজ ও স্বাভাবিক উদয়ের ব্যাপারটিকেই আমরা যে আমলে নিতে ভুলে যাই, কিম্বা আমলে নেই না, বিষয়বিদ্যা সেই ভুলে যাওয়া জায়গাটা আমাদের ধরিয়ে দিতে চায়। বিষয়কে আমলে নেওয়া বিষয়বিদ্যার মৌলিক কোন ধারণা নয়। কিন্তু আজকের কিস্তিতে আমরা দেখবো বাংলা ভাষার নিজের গুণে শব্দটি কিভাবে বিশেষ দার্শনিক তাৎপর্য গ্রহণ করে।
চেয়ারের উদাহরণ ধরে কথা বলছি। চেয়ারের উপলব্ধি বলতে বিষয়বিদ্যা কি বোঝে তাতে আমরা বুঝেছি সেটা কোন সংকীর্ণ ধারণা নয়। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়োপলব্ধি দিয়ে চেয়ারটি আমলে নেওয়া শুরু হয় নি – শুরু হয়েছে ঘরে ঢুকতে গিয়ে চেয়ারটি যে সহজ ও স্বাভাবিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে আমলে এসেছে তাকে আমলে নেবার সেই বিশেষ চরিত্রকে বিচার করে উপলব্ধির গাঠনিক দিক বিশ্লেষণ করা। এই উপলব্ধির মধ্যে চেয়ারের ইন্দ্রিয়োপলব্ধির কোন কারবার হাজির নাই ব্যাপারটা এমন নয়, য়াছে, কিন্তু শুধু ইন্দ্রিয়োপলব্ধিই উপলব্ধি এই সংকীর্ণ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় বিষয়বিদ্যা।
কিন্তু বিষয়বিদ্যা উপলব্ধি বলতে ঠিক কী বোঝে সে আলোচনাতে আমরা প্রবেশই করি নি। উপলব্ধি বলতে বিষয়বিদ্যা ঠিক চেয়ার নামক বিশেষ জিনিসটির উপলব্ধি বোঝে না। বরং উপলব্ধির বিষয় হিসাবে যা আমাদের মধ্যে তৈয়ার হয় বোঝে তার প্রক্রিয়া বা গঠন প্রণালীকে। দুটো এক জিনিস নয়। অর্থাৎ বিষয়বিদ্যা উপলব্ধি বলতে বোঝে স্বয়ং উপলব্ধিকেই। যে ভাবে ও যে পদ্ধতিতে চেয়ার হিসাবে একটি বিষয়কে উপলব্ধি করেছি তাকে। যে ভাবে ও যে পদ্ধতিতে চেয়ারটিকে আমরা উপলব্ধি করি আর চেয়ার যেভাবে আমাদের চিন্তায় প্রতিফলিত হয় দুইয়ের মধ্যে ফারাক বজায় রাখতে চায় বিষয়বিদ্যা। এটা আমরা বুঝতে পারব যদি মনে রাখি ঘরে ঢুকতে গিয়ে চেয়ারটিকে পথের ওপর বাধা হিসাবে হাজির থাকার মধ্য দিয়ে পারিপার্শ্বিকের অনুষঙ্গ হিসাবে চেয়ারটিকে আমলে নেবার ‘উপলব্ধি’ এক কথা আর চেয়ারকে যেভাবে আমরা আমাদের চিন্তায় প্রতিফলিত করি বা উপলব্ধি করি এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে।
হেইডেগার এই পার্থক্যকে বলছেন উপলব্ধতা (being-perceived)। ধারণাটির খুব ভাল অনুবাদ হোল কিনা সেই দাবি এখন করবো না। যে ভাবে চেয়ারটিকে আমরা সরিয়ে ঘরে ঢুকি সেই স্বাভাবিক উপলব্ধির মধ্যে চেয়ার সম্পর্কে যে ভাবটা তৈয়ার হয় হয়তো অনুবাদটিকে সেভাবে বুঝলে খুব দোষের হবে না। বাংলায় ‘ভাব’ কথাটা আমরা কতো ভাবে ব্যবহার করি সেই দিকে এই ফাঁকে একটু নিবিষ্ট মনোযোগ রাখা দরকার। যদিও এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এই পর্যায়ে করা যাবে না। কিন্তু ইঙ্গিতগুলোর তাৎপর্য মনে রাখলে কাজে লাগবে।
খেয়াল করতে হবে, ভাব অর্থে যে উপলব্ধির কথা এখানে বলা হোল – অর্থাৎ উপলব্ধতা – যে ভাবে সামগ্রিক পরিপার্শ্বিকতা নিয়ে কোন কিছুকে আমরা আমলে নিয়ে থাকি, তাকে চেয়ারের যেসকল গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা এর আগে ভেবেছি এই ক্ষেত্রে সেসবের প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। উপলব্ধতা বিষয়বিদ্যার অন্তর্গত সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা। এ ধারণা নতুন ধরণের কিছু গঠন কাঠামোর ইঙ্গিত করে যাকে প্রথাগত অর্থে আমরা যেভাবে কোন কিছু উপলব্ধি বুঝি সেই উপলব্ধির সঙ্গে মেলে না। আলোচনার এই পর্যায়ে এতোটুকু অনায়াসেই বোঝা যায় যে উপলব্ধি নিয়ে আমরা কথা বলছি সেখানে আগাম কোন উপলব্ধির কর্তাকে অনুমান করা হচ্ছে না, ফলে উপলব্ধির বিষয় আগাগ্ম হাজির রয়েছে সেতাও অনুমান করা হচ্ছে। আমাদের চলা ফেরা জীবন যাপন সততই তো উপলব্ধ জীবন কিম্বা উপলব্ধ জগত; সেই জীবনেরই কোন এক সময় ঘরে ঢুকতে গিয়ে চেয়ার নামক একটা কিছু সামনে পড়ল। বলতে পারি, সামনে উদিত হোল, হাজির হোল, কিম্বা ধরা দিল। এটাও তো উপলব্ধি। বিষয়বিদ্যা উপ্লব্ধতাকে এই বড় পরসরে বের করে আনতে চায়, যাতে জ্ঞানতত্ত্বের শেকলে সজীব জীবনের দিনানুদিনের দিনের যাপন আটকা না পড়ে।
চেয়ারের যে উপলব্ধি বিষয়বিদ্যা অন্বিষ্ট সেই উপলব্ধতা তাহলে চেয়ারের মধ্যে নিহিত নাই। কোন পাথর, গাছ কি বাড়ী কি আকাশ যা কিছুকেই আমরা উপলব্ধি করি বলে মনে করি সেটা তাদের গুণ বা বৈশিষ্ট্য নয়। এই উপলব্ধতা এবং উপলব্ধির গঠন কাঠামো উপলব্ধি-প্রক্রিয়ার অন্তর্গত। অর্থাৎ বিষয়নিষ্ঠার। এখন আমরা এভাবে পার্থক্যগুলো আপাতত দাগ দিয়ে রাখতে পারি:
যে বিষয় উপলব্ধি করছি সেই বিষয় – অর্থাৎ পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে বিষয়টিকে আমলে নেবার উপলব্ধি, তার প্রাকৃতিক দিক বা তার বস্তুগত দিক; এবং যে ভাবে ও পদ্ধতিতে বিষয়কে উপলব্ধি করছি সেই উপলব্ধতা – বিষয়নিষ্ঠার দিক থেকে উপলব্ধি: অর্থাৎ উপলব্ধতা, চিন্তার মধ্যের বিষয়ের প্রতিফলন, কোন বিষয়কে বিচার করা, কোন কিছু ভালবাসা, ঘৃণা করা, কোন কিছুর অভাব বোধ করা – এই ব্যাপক অর্থে উপলব্ধি।
উপলব্ধতা ব্যাপারটা আসলে কী? চেয়ার সম্পর্কে বিশেষ কোন তত্ত্ব বা ধারণার বাইরে চেয়ারের উপলব্ধতা আসলে কি কোন বিশেষ অর্থ বহন করে? বিশেষ বস্তু বা বিষয় হিসাবে চেয়ারের যেসব গুণাবলীর উপলব্ধি দিয়ে চেয়ারকে আমরা বুঝি উপলব্ধতাকে তাহলে সেই গুণাবলীর বাইরের কিছু বলেই আমাদের গণ্য করতে হবে। এই প্রাথমিক ভেদজ্ঞান থেকে আমরা নির্দেশ নিতে পারি উপলব্ধতাকে আমরা কিভাবে বুঝব। এটা পরিষ্কার যে ঠিক চেয়ার হিসাবে বুঝলে চলছে না, বরং চেয়ার কিভাবে উপলব্ধির মধ্যে হাজির হচ্ছে সেই দিকেই আমাদের নজর রাখতে হবে। চেয়ারের উদাহরণের ক্ষেত্রে আমরা কি দেখছি? বাস্তবিকই একটা চেয়ার শারিরীক ভাবে বা সশরীরে আমাদের সামনে হাজির। অন্য ভাবে বললে বলা যায় চেয়ার হিসাবে যা বিশেষ ভাবেএই ক্ষেত্রে উপলব্ধির বিষয় হয়েছে সেই বিষয়টি সত্যি সত্যিই বস্তুগত ভাবেই নিজেকে হাজির রেখেছে। সে নিজেই নিজের মতো চিন্তায় হাজির আছে তা নয়, নিজে বাস্তবিকই একটি চেয়ার হিসাবে নিজেকে সামনে হাজির রেখেছে। যাকে সরিয়ে ঘরে ঢুকতে হোল। এভাবে বলার কারন হোল, চেয়ার আমাদের সামনে থাকুক বা না থাকুক আমাদের চিন্তা বা কল্পনায় চেয়ার তো হাজির থাকতেই পারে। চেয়ার বস্তুগত ভাবে সশরীরে হাজির না থাকলেও তো চেয়ার চিন্তার বিষয় হয়। এই ক্ষেত্রে হেইডেগারের ভাষাটা লক্ষ্য করবার মতো। বিষয় নিজেকে কিভাবে দিল বা প্রদান করল সেই দিকটা নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে। পরিস্থিতি বোঝাতে হেইডেগারের ভাষাও ভিন্ন মোড় পরিগ্রহণ করতে শুরু করে। বিষয়বিদ্যায় কোন কিছু বিষয় হিসাবে হাজির থাকার মধ্যে ভিন্নতা থাকতে পারে। দুটো পার্থক্য হেইডেগার নির্ণয় করেছেন। বস্তুগত ভাবে হাজির থাকা বা নিজেকে দেওয়া (bodily-given) আর নিজেকে হাজির (self given) রাখা। এই পার্থক্যকে আরও বিশদ করা দরকার।
যমুনা ব্রিজ আমার চিন্তার বিষয় হতে পারে। চিন্তার মধ্যে উদয় ঘটতে পারে তার। মনে মনে ব্রিজটি নিয়ে ভাবতে পারি আমি। না, যমুনা ব্রিজ নিয়ে কোন কল্পনা নয়, কোন ফান্টাসি নয়, আসলেই ব্রিজটি যেমন তেমনই আমি ব্রিজটি নিয়ে ভাবতে পারি। ব্রিজে বা বিষয়ে নিষ্ঠ হতে পারি। কিন্তু ব্রিজটি বাস্তবিক অর্থে আমার সামনে হাজির নাই। যদি আমি ঢাকা থেকে গাড়ি করে যমুনা ব্রিজের কাছে যাই আর ব্রিজের সামনে দাঁড়াই তখন ব্রিজটি নিজেকে আমার সামনে সশরীরে দেয়, হাজির হয় বা হাজির থাকে। এর মানে হচ্ছে কোন কিছুর হাজির থাকা, হাজির হওয়া বা উদয় হওয়া আর সেই বস্তুর সশরীরের হাজির থাকার, হাজির হওয়া বা উদয় হওয়ার মধ্যে ফারাক আছে। এগুলো তুচ্ছ মনে হতে পারে, অথচ এই তুচ্ছ বিষয়ে নিষ্ঠাই দর্শনের দিগন্তকে বদলে দিয়েছে।
এর মানে যে-বিষয় আমাদের চিন্তায় নিজেকে ‘দেয়’ তা সশরীরে হাজির থাকবে এমন কোন কথা নাই। আর যা সশরীরে হাজির থাকে, সে চিন্তায় নিজেকে হাজির করেই রেখেছে। কোন কিছুর সশরীরে হাজির থাকার অর্থ চিন্তায় হাজির থাকার অতিরিক্ত হাজির থাকা। চিন্তায় উদিত থাকা, হাজির থাকা বা চিন্তার বিষয় হবার জন্য কোন বিষয়ের সশরীরে হাজির থাকা জরুরী নয়। ব্রিজ নিজেকে কিভাবে চিন্তায় নিজেকে হাজির করছে তার ওপর উপলব্ধির এই পার্থক্য নির্ভর করে। এই ক্ষেত্রে ব্রিজের হাজিরাকে নিজেকে নিজে ‘দেওয়া’ বলেছেন হেইডেগার। আলোচনার এই পর্যায়ে এই দেওয়া কথাটার মানে আমরা পরাপুরি বুঝবোনা। কিন্তু আশা করি আলোচনার সুযোগ পাবো পরে। এখানে চিন্তার কর্তাসত্তা মানুষকে হেইডেগার আগাম অনুমান করেন নি। বরং ব্রিজ নামক একটি বিষয় ‘নিজেকে নিজে কিভাবে দিচ্ছে’ সেই দিকটার ওপর বিশেষ ভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। নিজেকে এমনি দেওয়া আর নিজেকে সশরীরে দেওয়ার পার্থক্য বিচার করছেন তিনি এখানে।
নিজেকে নিজে দেওয়ার ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয় যদি আরেক ধরনের বিষয়নিষ্ঠার দিকে আমরা মনোযোগ দেই। একে বলা হয় খালি বা বিষয়হীন বিষয়নিষ্ঠা (empty intending)। আমরা অনেক সময় অনেক কিছু নিয়ে ভাবি কিন্তু যে বিষয় নিয়ে ভাবি সেই বিষয় মনের সামনে হাজির থাকে তাও নয়। যেমন আমরা যখন কারো সঙ্গে কথোপকথন করি। তখন বহু বিষয় আমাদের মনের ওপর দিয়ে স্রোতের মতো চলে যায়, কথা বলার সময় সেই সকল বিষয় সুনির্দিষ্ট ভাবে আমাদের মনে উদিত হয় বা হাজির থাকে এটা বলা যাবে না।
যমুনা ব্রিজের উদাহরণই নিয়েই বলি। যমুনা ব্রিজ নিয়ে বিস্তর কথা বলতে পারি আমরা; আলোচনায় ব্রিজের বিষয়ে নিষ্ঠ থাকলেও আমাদের নিষ্ঠা আলোচনার প্রতি নিবিষ্ট থাকবে – ঠিক ব্রিজের প্রতি নয়। ব্রিজ নিয়ে কথা বলার সময় ব্রিজকে বিষয় হিসাবে সুনির্দিষ্ট ভাবে মনে জায়গা দেবার দরকার নাই। ব্রিজ নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু ব্রিজ নিয়ে ভাবছি না, বিষয় হিসাবে ব্রিজকে সুনির্দিষ্ট ভাবে মনে উদয় ঘটানো দরকার মনে করছি না। সেই জায়গাটা খালি রাখছি। ব্রিজের প্রতি চিন্তায় নিষ্ঠ থাকছিনা, বরং ব্রিজ নিয়ে কথার প্রতি নিষ্ঠ থাকছি। আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তার বা কথোপকথনের বড় একটি অংশ এভাবেই চলে। আমরা যে বিষয় নিয়ে কথা বলি সেই বিষয়কে কল্পনায় বা চিন্তায় প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়োজন বোধ নাও করতে পারি। এই ক্ষেত্রে যে বিষয়ে আমাদের নিষ্ঠা – অর্থাৎ যে বিষয় নিয়ে আমাদের কথোপকথন তাকে সরাসরি মনে রাখলেও বিষয়কে আমরা পূর্ণ করি না। খালি রাখি। ব্রিজে নিষ্ঠ থাকি কিন্তু এই নিষ্ঠাকে খালি রাখি। সেটা ফাঁকা থেকে যায়। কিন্তু কথোকথনে সেটা কোন বাধা হয় না। বিষয় নিয়ে কথা বলি, কিন্তু ব্রিজ মনে হাজির নাই। মন ব্রিজ শূন্য। এই অবস্থাকেই বিষয়বিদ্যা বলে ‘বিষয়হীন বিষয়নিষ্ঠা’ (Empty intending)।
একটা বাক্যের উদাহরণ নেওয়া যাক। ৪ + ৩ = ৩ + ৪। কোন প্রকার চিন্তা না করে আমরা এই বাক্যটা হাজার বার উচ্চারণ করতে পারি। কিন্তু চিন্তাশূন্য ভাবে বকবকিয়ে গেলেও যে কেউই বুঝতে পারে বাক্যটি অর্থহীন নয়। অর্থাৎ চারের সঙ্গে তিন যোগ দেওয়া আর তিনের সঙ্গে চার যোগ দেওয়া একই কথা।
কিন্তু এই বাক্যটি নিয়ে আমরা আরও গভীর ভাবেও ভাবতে পারি। যে ভাবনা আমাদের গণিতের ভিত্তি বুঝতে সহায়তা করে। আমরা এই বাক্যের মধ্যে আরও নানান গাণিতিক অর্থ আন্দাজ করতে পারি। যোগ চিহ্নের অর্থ নিয়ে প্রচুর কিছু বিবেচনার দিক মেলে ধরতে পারি। ইত্যাদি।
অর্থাৎ আমরা বিষয়কে কিভাবে আমলে নিচ্ছি তার ধরণের বিচার বিষয়বিদ্যার জন্য খুবই প্রাথমিক অথচ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। গোড়ার এই সকল ধারণা পরিচ্ছন্ন থাকলে আগামি কিস্তির বিষয়গুলো বুঝতে সুবিধা হবে। তুলনামূলক ভাবে কঠিন হলেও বাংলা ভাষায় পাশ্চাত্য দর্শনকে আত্মস্থ করবার চেষ্টা আমরা অব্যাহত রাখব।
১ জানুয়ারি ২০১৪। ১৮ পৌষ ১৪২০। রিদয়পুর।
লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)