ফরহাদ মজহার


Sunday 24 November 13

print

ইনটেনশেনালিটি বা ‘বিষয়নিষ্ঠা’ বলতে বিষয়বিদ্যা কী বোঝে তা বোঝাতে বেগ পেতে হচ্ছে আমাদের। এই বাধা ধারনাটিকে আরও বিশদ করবার জন্য আমাদের খুবই কাজে আসে। পুরানা শব্দ ও ধারনাকে নতুন করে ব্যবহার করতে গেলে পুরানা বোঝা বয়ে বড়ানোর দায় চিন্তার ঘাড়ে ভর করে থাকে; সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পাশাপাশি আমরা ধারণাটিকে বাংলাভাষায় আত্মস্থ করে নেবার চেষ্টা করছি। সেটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও দরকারী। ওর ফলে কোন অপরিচ্ছন্নতা যদি তৈরী হয় তবে তাকে সাফ করে তোলার মধ্য দিয়েই আমরা এগুবো। আক্ষরিকতা থেকে ভাবে প্রবেশ করবার কর্তব্য আছে আমাদের। আমরা মানি যে পাশ্চাত্য শব্দ, শব্দবন্ধ বা ধারণাকে আত্মস্থ করা স্রেফ অনুবাদ করার ব্যাপার না; পরিভাষা বানানো বা ভাষান্তর জাতীয় ব্যাপারও নয়। অনুবাদ, ভাষান্তর কিম্বা পরিভাষা বানানোর ব্যবহারিক প্রয়োজন থাকতে পারে, কিন্তু ভাবুকতার জন্য সে্টা খুব কাজের হয় না।

ফলে বাংলাভাষায় ভিনভাষার ধারণা আত্মস্থ করা একটা চ্যালেঞ্জ হিশাবেই আমাদের সামনে হাজির। আক্ষরিকতার খাঁচা ভেঙে ভাবুকতার খোলা জায়গায় দাঁড়ানো খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু আমরা ঝুঁকি নেবো। ইনিটেনশেনালিটির অনুবাদ হিসাবে মনোবৃত্তি, তারপর তাকে কেন বিষয়নিষ্ঠা অনুবাদ করেছি, সেটা এর আগে ব্যাখ্যা করেছি। এখানে দেখাবার চেষ্টা করব যদি ইনটেনশেনালিটির ধারণাগত গভীরতা আমরা ধরতে পারি তাহলে তাকে অনায়াসেই ‘মনের ভাব’ বলে গণ্য করতে পারি। বিষয়হীন ভাব বলে কিছু নাই, ভাব মানে কোন না কোন কিছুর ভাব। এ কথা মনে রাখলে ইন্টেনশেনালিটির মর্মের সঙ্গে এর সঙ্গতি বুঝবো। এখানে সেই সাহস দেখানো হয়েছে। পরের কিস্তিগুলোতে সেটা আরও পরিচ্ছিন্ন হবে আশা করি।

ইনটেনশেনালিটিকে আক্ষরিক ভাবে ইচ্ছা বা ইচ্ছাসম্পন্নতা হিসাবেই আমরা বুঝি। ব্যাখ্যা করে বললে দাঁড়ায় কোন কিছুর দিকে মন নিবদ্ধ করা। সমার্থক ল্যাটিন intention-র আক্ষরিক অর্থও তাইঃ directing-itself-toward। প্রতি মুহূর্তের সপ্রাণ উপস্থিতি মাত্রই কোন না কোন বিষয়ে নিষ্ঠ, নিবদ্ধ বা মনোযোগী থাকা। এভাবেই আমরা জীবন্ত থাকি, এটাই সপ্রাণতার ভাব। বিষয়বিদ্যার ভাষায় psychic comportment । এখন ইচ্ছার জায়গায়, কামনা, বাসনা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, কল্পনা, বোধ, চিন্তা, দুশ্চিন্তা কিম্বা যা খুশী বসাতে পারি। এতে বিষয়বিদ্যা যেভাবে মনের এই নিষ্ঠাকে বুঝতে চায় সেখানে কোন হেরফের হয় না। যে কোন ধরণের মনের অবস্থা হিসাবেই ইন্টেনশেনালিটিকে আমরা গণ্য করতে পারি। বুঝতে পারি। মনের অবস্থা মানে কোন না কোন বিষয়ে নিবদ্ধ থাকার অবস্থা; কামনা, বাসনা, চিন্তা, দুশ্চিন্তা, ভয়, সংকল্প, কল্পনা, স্বপ্ন, রাগ, দুঃখ, কষ্ট – মনের অবস্থা যাই থাকুক – সে অবস্থা কোন না কোন বিষয়ে নিবদ্ধ বা নিষ্ঠ থাকারই অবস্থা। ইনটেনশানের অর্থের মধ্যে নিষ্ঠ থাকার এই হাল নিহিত আছে। কম্পোর্টমেন্টের অর্থ স্বভাব, ভঙ্গী, বৈশিষ্ট ইত্যাদি। ইন্টেনশেনালিটিকে বুঝতে গিয়ে এই কম্পোর্টমেণ্টের ধারনার ওপর হেইডেগার বার বার জোর দিয়েছেন। বিষয়নিষ্ঠা মানে মনের এই কম্পোর্টমেন্ট। বাংলায় একে বলতে পারি স্বভাব, ভঙ্গী, বিশিষ্টতা ইত্যাদি।

কিন্তু একটু বেবে দেখলে দেখব সবচেয়ে কাছের অনুবাদ হতে পারে ‘ভাব’। এতে অনেকে বিস্মিত হতে পারেন। ভাব বাংলা ভাষায় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। মন সবসময়ই কোন না কোন ভাব নিয়ে থাকে, কোন না কোন বিষয়ে নিবিষ্ট। এই দিক থেকেই ইনটেনশেনালিটিকে ভাব বললে দোষ হয় না; অথচ বাংলাভাষায় একটি পাশ্চাত্য ধারনাকে আন্তরিক করে নেবার একটা সুযোগ তৈরী হয়। পাশ্চাত্য দর্শনকে তার নিজের ইতিহাস ও পরিস্থিতির কারণে ইনটেনশেনালিটির অন্তর্নিহিত মর্ম আবিষ্কার করতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আমরা সেই একই ধারনাকে অনেক সহজে বুঝি।

তাহলে আমরা পরীক্ষামূলক ভাবে মেনে নিচ্ছি ইনটেনশেনালিটি হচ্ছে মনের ভাব। মন কোন না কোন ভাব ছাড়া থাকে না। ভাব ছাড়া মন নাই। যদি ভাবকে চিন্তার আমরা যা বুঝি সেই ধারণা থেকে আলদা করে বোঝার চেষ্টা করি তাহলে চিন্তা মনেরই একটা ভাব মাত্র। মন যখন জগতকে বিষয়ী আর বিষয় হিসাবে ভাগ করার ভাবে থাকে, সেই ভাব হচ্ছে জ্ঞানের অবস্থা, জ্ঞানচর্চার ভাব। কিন্তু এটাই মনের একমাত্র ভাব নয়। এমনকি উন্নত অবস্থা কিনা সেই সম্পর্কেও হেইডেগার প্রশ্ন তুলেছেন। একেই – এই ভাবকেই – একদিকে চিন্তার কর্তা আর বিপরীতে চিন্তার বিষয় -- এই দ্বিধাকেই জ্ঞানতাত্ত্বিক অর্থে আমরা ‘চিন্তা’ বলে অভিহিত করি।

ফরাসী দার্শনিক রেনে দেকার্তের (১৫৯৬ -১৬৫০) সময় থেকে একদিকে চিন্তার কর্তা (বিষয়ী) আর বিপরীতে চিন্তার বিষয় হিসাবে জগতকে নিশ্চিত ভাবে জানবার যে আকুতি তাকে নতুন ভাবে বিষয়বিদ্যার জায়গা থেকে বোঝার জন্য বিষয়নিষ্ঠার ধারনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার। সন্দেহ নাই। রেনে দেকার্তের পর থেকে পাশ্চাত্যে যে জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারা গড়ে উঠেছে হেইডেগার সে পথ থেকে সরে আসতে চাইছেন। এটাও পরিষ্কার। জগতলে দুই ভাগে বিভক্ত করবার এই অপরাধ যে খোদ দেকার্তের তাও নয়, কারন তাকে ভিন্ন ভাবে পড়বারও সুযোগ আছে। সেই তর্ক উহ্য রেখে বলা যায়, দেকার্তের পর থেকে গড়ে ওঠা এই বিশেষ জ্ঞানতাত্ত্বিক ‘ভাব’-এর ওপরই পাশ্চাত্য ইতিহাস দাঁড়িয়ে আছে –দাঁড়িয়ে আছে একটা ‘দ্বিধা’ ওপর – একদিকে মানুষ আর অন্যদিকে প্রকৃতি।

কিন্তু এটাই মানুষের 'একমাত্র' ভাব নয়, অতএব এই ভাব মানুষের ইতিহাসের শেষ অবস্থাও নয়। জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবে আমরা যা নির্ণয় করি, সেটাই একমাত্র সত্য নয়। চূড়ান্ত সত্য বা ভাবের সর্বোচ্চ পরিণতি, পরিসমাপ্তি বা শেষ সীমান্তও নয়; মানুষের সার্বজনীন অবস্থা তো নয়ই। পাশ্চাত্যের এই ভাবকে মানুষের সার্বজনীন ভাব হিসাবে নিরন্তর দাবি করার কারণে আমরা মনে করি জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবই সত্য নির্ণয়ের বা সত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হবার একমাত্র পথ। হেইডেগার, বলা বাহুল্য এই দাবিকেই প্রশ্নাত্মক করে তুলেছেন। প্রশ্নাত্মক করে তোলার কারণে দর্শনে তুফান তৈরী হয়েছে। এই জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবকে আঘাত করবার প্রাথমিক সূত্র তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন বিষয়বিদ্যার গোড়ার আবিষ্কারে। যেমন, ইন্টেনশেনালিটি বা বিষয়নিষ্ঠার ধারণায়।

তাহলে মনের ভাব নানান রকম হতে পারে। যখন কোন বিষয়কে আমরা মনের কাছে হাজির করি বা রিপ্রেসেন্ট করি সেটাও বিষয়ে নিবদ্ধ একটি ভাব বা ইনটেনশান; যখন কোন কিছু ইচ্ছা করি, তখন সেটা ইচ্ছায় নিবদ্ধ একটা ভাব বা ইনটেনশান; যখন কোন কিছু মনে করি তখন সেটা স্মৃতিকাতরতায় নিবদ্ধ মনের একটি ভাব বা ইনটেনশান; যখন কিছু বিচার করি তখন বিচারে নিষ্ঠ মনের একটি ভাব বা ইনটেনশান; যখন প্রেম ভালবাসা নিয়ে ভাবি তখন সেটা প্রেমে নিষ্ঠ একটা ভাব। সার কথা হচ্ছে, সকল ক্ষেত্রেই মনের ভাব কোন না কোন বিষয়ে নিবদ্ধ বা নিষ্ঠ।

মুশকিল তৈরী হয় যখন আমরা উপলব্ধির বিষয় আর বিষয়নিষ্ঠার বিষয়ের মধ্যে গোলমাল পাকিয়ে ফেলি। আমরা মনে করি কোন কিছুকে যদি ‘বিষয়’ হতে হয় তবে তাকে অবশ্যই বুঝি ইন্দ্রিয়োপোলব্ধির বিষয় হতে হবে, নইলে তা সত্য হতে পারে না। যে কারণে কল্পনা, স্বপ্ন, আশা, নিরাশা, দুঃস্বপ্ন ইত্যাদি সত্য নয়; কারন তাদের সঙ্গে বাইরের কোন বাস্তবতার সম্বন্ধ নাই। বিষয়বিদ্যা ‘বিষয়’ কে এই সংকীর্ণ অর্থে বিচার করে না। মনের ভাবের যা বিষয় তা বাইরে আছে কি নাই তার দ্বারা বিষয়বিদ্যা সত্য নির্ণয়ের পরিশ্রম করে না। এই যে বাইরের কোন বস্তু বা বাস্তবতার সঙ্গে মনের মধ্যে উদিত হওয়া বা তৈরী করা ধারণা বা ভাবের সঙ্গে যুক্ত করে সত্য নির্ণয়ের পদ্ধতি – এটাও তো মনেরই একটা ভাব মাত্র। এই ভাব সাধারণত প্রত্যক্ষবাদ ( Empiricism) হিসাবে পরিচিত। বিষয়বিদ্যার আগ্রহ এই সংকীর্ণ প্রত্যক্ষবাদ বা ইতরোচিত বস্তুবাদে নয়। তার আগ্রহ মনের মধ্যে যা কিছুই ‘বিষয়’ হিসাবে উদিত বা হাজির হয় তাকে স্বীকার বা শনাক্ত করা, বর্ণনা করা এবং পরিস্থিতি বিচার করে তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করা। কিভাবে এই উদয়টা ঘটছে সেই দিকে নজর নিবদ্ধ রাখা। হেইডেগার বলছে্ন, উপলব্ধি বলতে আমরা এটা বুঝবনা যে তাকে কেবলই ইন্দ্রিয়পরায়ন উপলব্ধি হতে হবে। বিষয়নিষ্ঠার মধ্যে যাকে আমরা বিষয়ের উপলব্ধি বলি তাকে ইন্দ্রিয়পরায়ন উপলব্ধি হতে হবে এমন কোন কথা নাই। এমনকি হেইডেগার বলছেন, তাকে যে উপলব্ধিই হতে হবে তারও তো কোন কথা নাই।

উদাহরণ: আমার হঠাৎ মনে হোল আমার মাথার ওপর একটা কালো কাক উড়ে গেল, এবং কাকের কর্কশ কা কা আওয়াজও যেন আমি শুনলাম মনে হোল; আমি মন খারাপ করে বসে আছি, হঠাৎ মনে হোল আমার মা বুঝি আমার মাথার চুল বিলি করে দিচ্ছেন, বিলি করতে করতে কথা বলছেন, অথচ মা মারা গিয়েছেন বহু আগে; হেলুসিনেশানও হতে পারে আমার, কিন্তু সবই তো উপলব্ধি করছি আমি।

একটি গহিন নির্জন বনের পথ ধরে যাচ্ছি, মনে হচ্ছে কে যেন সামনে থেকে কাছে এগিয়ে আসছে; কাছে গিয়ে দেখা গেল আসলে গাছের একটি গুঁড়ি। দূর থেকে কারো কাছে এগিয়ে আসা উপলব্ধি করেছি মনে, সেটা বিভ্রান্তি হতে পারে, কিন্তু উপলব্ধি তো বটেই। অথচ যা উপলব্ধি করলাম বাস্তবে তার কোন অস্তিত্বই নাই। হেইডেগার বলছেন, “এই ধরণের উদাহরণ থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে উপলব্ধির মধ্যে সত্যিকারের কোন বস্তু বা বিষয় গরহাজির থাকতেই পারে” কিন্তু তারপরও সত্য হোল সেটাও কোন না কোন বিষয়েরই উপলব্ধি। অতএব বিষয়নিষ্ঠায় বিষয়ের যে-উপলব্ধি তা যে কোন না কোন বাইরের বিষয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত হতে হবে তার কোন কথা নাই। তারপরও সেটা বিষয়েরই উপলব্ধি

হেইডেগার বিষয়নিষ্ঠার প্রতি তাঁর সমসাময়িক দার্শনিকদের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে বলছেন, দেকার্তের সময় থেকে প্রত্যেকে  জানেন, আর পর্যালোচনামূলক দর্শনে প্রত্যেক দার্শনিকই ধরে নেন -- আমাদের চেতনার মধ্যে যে-উপাদান আগাম হাজির থাকে তাকেই আমরা উপলব্ধি করি বা বোঝার চেষ্টা করি। কোন কিছু উপলব্ধি করারার অর্থ হচ্ছে যা উপলব্ধি করছি তা উপলব্ধির বাইরের আগেই হাজির রয়েছে। এই অনুমান থেকে তারা শুরু করেন বলে বিষয়নিষ্ঠা নিয়ে আমরা এখানে যেভাবে আলোচনা করছি তাকে ইন্দ্রিয়োপলব্ধির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে গিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলেন। ইন্দ্রিয়োপলব্ধ বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠাও বিষয়নিষ্ঠা অবশ্যই। যারা বিষয়বিদ্যার সমালোচক তারা ইন্দ্রিইয়োপলব্ধির ক্ষেত্রে বিষয়নিষ্ঠাকে প্রয়োগ করতে গিয়ে দুটো অনুমান করেন। এই দুই অনুমানের কারনে বিষয়নিষ্ঠা বা মনের ভাব বলতে আমরা যা বোঝার চেষ্টা করছি তার সঙ্গে গোলমাল পাকিয়ে ফেলা হয়।

প্রথম অনুমান হোল, মন সততই বুঝি বাইরের কোন বস্তুগত জিনিস বা বাস্তবকে উপলব্ধি করতে সক্রিয়। বুঝি তার নিষ্ঠা সবসময়ই বহির্গামী -- নিজের বাইরের কোন বস্তু বা বিষয়ের দিকেই বুঝি সতত নিবদ্ধ। কিন্তু দেকার্তের সময় থেকে দেকার্তে তো বটেই, সব দার্শনিকরাই জানেন, এই ধরণের কোনপ্রকার পরাবিদ্যামূলক অনুমান দেকার্তে বরদাশত করেন নি। ‘আমি ভাবি তাই আমি আছি’—এই সিদ্ধান্ত নেবার সময় তিনি এই অনুমান করেন নি যে তিনি মনের বাইরের কিছু নিয়ে ভাবছেন। বাইরের বিষয় তো বিভ্রান্তিমূলক হতে পারে, হতে পারে হেলুসেনেশান। বরং শুরু থেকেই প্রতিটি ইন্দ্রিয়োপলব্ধিকে সন্দেহ করেই নিশ্চিত জ্ঞান নির্ণয়ের পদ্ধতির তিনি প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁর চিন্তার পদ্ধতির মধ্যে শুধু ইন্দ্রিয়োপলব্ধিই চিন্তার বিষয় -- এই ধরণের আগাম অনুমান রীতিমতো নিষিদ্ধ ব্যাপার। তিনি কোন কিছু আগাম অনুমান করে বা ধরে নিয়ে চিন্তা করার অভ্যাস অস্বীকার করেছিলেন। একইভাবে বিষয়নিষ্ঠাও ‘বিষয়’কে শনাক্ত ও বর্ণনা করতে গিয়ে এই ধরণের পরাবিদ্যা এড়িয়ে চলতে চাইছে। বিষয়বিদ্যার সমালোচকরা এই পরাবিদ্যাকে পরিহার না করেই উলটা বিষয়নিষ্ঠা পরাবিদ্যার বোঝা বহন করছে বলে অন্যায় সমালোচনা করেছেন। দেকার্তে

দ্বিতীয়ত, ইনটেনশেনালিটি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেই অনুমান করেন সত্যিকারের বস্তু বা বাস্তবতার সঙ্গে মানসিক প্রক্রিয়া, চিন্তা বা মনের ভাব কোন না কোন ভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু যে উদাহরণগুলো ওপরে দেওয়া হোল -- হেলুসিনেশান, হেঁয়ালি বা মনের ভুল – যেভাবেই বলি, তাতে প্রমাণিত হয় যে বিষয়নিষ্ঠা এই আগাম অনুমান করে না। কোন কিছু বাস্তবে না থাকলেও তার উপলব্ধি ঘটতে পারে।

হেইডেগারের দাবি হচ্ছে এভাবে পুরানা অনুমান মাথায় নিয়ে বিষয়বিদ্যা মনের ভাব বা বিষয়নিষ্ঠা বলতে আসলে কি বোঝাতে চাইছে তার কোন হদিস করা যাবে না। আমরা এর তাৎপর্য মোটেও বুঝবো না। মনের কাছে যা হেঁয়ালি, হেলুসিনেশান বা মনের ভুল ইত্যাদি কোন ক্ষেত্রেই বাস্তবের কোন কিছুর বাস্তবিক অস্তিত্বের সঙ্গে বিষয়নিষ্ঠার বিষয় বা মনের ভাবের কোন সম্পর্ক নাই । আছে শুধু মাত্র মনের ভাবটাই, আছে মনের মধ্যে উদিত হওয়া কোন না কোন বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠা। আসলে মাথার ওপর কাক উড়ে যাচ্ছে মনের ভুল বা হেলুসিনেশান হলেও সেটা তো মনের ভুল বা হেলুসিনেশান হিসাবে সত্য। সেটা থাকলে মনের মধ্যেই আছে, আর সে কারণে সেটাও এক বাস্তবতা – মনের বাস্তবতা। সেও এক বাস্তব উপলব্ধি, কোন কিছুর উপলব্ধির সত্য। এই উপলব্ধি বাস্তবে কোন কিছুর সঙ্গে বাস্তবিক অর্থে সম্পর্কিত না থাকলেও উপলব্ধি তো বটেই। আর বাস্তবে কোন কিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত না হলেও এই উপলব্ধিও তো কোন না কোন বিষয়ের প্রতিই নিষ্ঠ, কোন না কোন বিষয়ের দিকে নিবদ্ধ। হেঁয়ালি, মনের ভুল, ভ্রান্তি সবই শেষাবধি কোন না কোন বিষয়েই নিষ্ঠ বলে আমরা তা উপলব্ধি করি। সেই উপলব্ধির বিষয় বাস্তবে থাকুক কি না থাকুক তাতে কিছুই আসে যায় না। এই উদাহরনগুলোর গুরুত্ব হচ্ছে মানুষের জীবন যে আসলে জ্ঞানতাত্ত্বিক জীবন নয় সেই দিকটার ওপর জোর দেওয়া। আর মানুষ মাত্রই চিন্তাসম্পন্ন কথাটার মানে পরিষ্কার করা। এর অর্থ হচ্ছে মানুষ প্রতিমূহূর্তেই কোন না কোন বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠ, আমাদের প্রতিটি মুহূর্তই ভাবের মূহূর্ত। আর ওর মধ্যেই মানুষ বাস করে – আর একেই আমরা জীবন বলি। জ্ঞানতাত্বিক ভাবের মুহুর্তই আমাদের জীবনের একমাত্র সত্য, আর অন্য ভাব মিথ্যা -- ব্যাপারটাও তাও নয়।

হেইডেগার বলছেন, জীবন মানেই বিষয়নিষ্ঠতা – এটা আমাদের শুরুতেই বুঝতে হবে। অর্থাৎ আমরা সবস্ময়ই কণ না কোন ভাবে থাকি।  দ্বিতীয় যে শিক্ষা শুরুতেই তিনি দিতে চেয়েছেন সেটা হোল বিষয়ের প্রতি নিষ্ঠা সেই ব্যাপারটা আসলে কী সেই দিকে আমাদের নজর দেবার প্রয়োজনীয়তা। বা, আরও সহজ ভাবে যদি বল, যাকে আমরা এখন মনের ভাব বলছি, সেই ভাবের গঠন (structure) বা স্বভাবটা কেমন সেই দিকেই নজর নিবদ্ধ করার শিক্ষা। দর্শনে এটা নতুন জিনিস। জ্ঞানতাত্ব্বিক ‘দ্বিধা’ থেকে বেরিয়ে আসার পাশ্চাত্যের দর্শনের জগতে এ ছিল একটা একটা বড়সড় উল্লম্ফন।

আগামিতে আমরা বিষয়নিষ্ঠার গাঠনিক দিক নিয়ে আলোচনা শুরু করব। সে আলোচনা ইন্দ্রিয়োপোলব্ধিকে বিষয়বিদ্যার দিক থেকে আরও বিশ্লেষণের চেষ্টা করব। একই সঙ্গে বিষয়নিষ্ঠাকে আমরা মনের ‘ভাব’ বলে বাংলা ভাষার অন্দরমহলে যেভাবে আত্মস্থ করতে চাইছি সেই চেষ্টা আদৌ টেঁকে কিনা সেটাও লিখতে লিখতে উলটে পালটে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখব।

১৯ নভেম্বর ২০১৩। ৫ অগ্রহায়ন ১৪২০। আরশিনগর। ঈশ্বরদী।

 

 


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)

Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 7047 Leave comments (0) Bookmark and Share


Go Back To Arts & Culture
EMAIL
PASSWORD